নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/একাদশ অধ্যায়
একাদশ অধ্যায়
শিক্ষালয়ে বিশ্বশক্তি
আমি সমগ্র জগতকেই মানুষের বিদ্যালয় মনে করি। এজন্য টাস্কেজী বিদ্যালয়ের ছাত্রদিগকে সংসারের সকল প্রকার কাজ কর্ম্ম করিতে বাধ্য করিতাম। আমাদের বিদ্যালয়টা এইরূপে একটা ছোট খাট পৃথিবীর মত হইয়া পড়িয়াছিল। সমস্ত বিশ্বের সকল প্রকার শক্তিই এই শিক্ষালয়ের আবহাওয়ায় স্থান পাইত। উৎসব আমোদের ভিতর দিয়া, পশুপালন, অতিথিসেবার ভিতর দিয়া, লোকহিত পরোপকারের ভিতর দিয়া টাস্কেজী বিদ্যালয়ের ছাত্রেরা মানুষ হইতে থাকিত। এজন্যই আমি ছাত্রাবাসের সকল গৃহস্থালীর কাজই ছাত্র ও ছাত্রীদিগকে দিয়া করাইতাম।
ছাত্রাবাস খোলা হইবার অল্পকালের মধ্যেই বিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা অভাবিতরূপে বাড়িয়া গেল। ইহাদের ভোজন শয়নের ব্যবস্থা করিবার জন্য আমরা বিব্রত হইয়া পড়িলাম। পূর্ব্বেই বলিয়াছি আমাদের কাহারই গৃহস্থালীজ্ঞান ছিল না, সকল বিষয়েই বিশৃঙ্খলা চলিতেছিল। তাহার উপর অর্থাভাব। এখন স্থানাভাবও বেশ ভোগ করিতে হইল। কাজেই স্কুলের নিকটে নূতন ছাত্রদের জন্য কতকগুলি কাঠের কামরা ভাড়া করিয়া লইলাম। এ গুলির বড়ই জীর্ণ অবস্থা। শীতকালের ঠাণ্ডা বাতাসে ছেলেরা অত্যন্ত কষ্ট পাইতে লাগিল।
আমরা ছেলেদের নিকট মাসিক ২৪৲ টাকা করিয়া লইতাম। ঘরভাড়া, খাওয়া, স্নানের জল, ঘর গরম করিবার জন্য কয়লা ইত্যাদি সকল খরচই এই টাকায় চলিত। এই সঙ্গে বলা আবশ্যক যে, মাত্র ২৪৲ টাকায় কুলাইত না। খরচ আরও বেশী পড়িত। কিন্তু অনেক ছাত্রই স্কুলের নানা কাজ করিয়া দিত। এজন্য তাহাদের বেতন না দিয়া আবশ্যক খরচ হইতে কাটিয়া রাখিতাম। বিদ্যালয়ে পড়িবার খরচ বার্ষিক ১৫০৲ টাকা। এই টাকাটা আমরা নানা স্থান হইতে সংগ্রহ করিয়া দিতাম। সুতরাং এই বিদ্যালয়কে ছাত্রদের পক্ষে অবৈতনিক বলা যাইতে পারে।
দেখা গেল, ছাত্রদের নিকট মাস মাস নগদ ২৪৲ টাকা মাত্র আদায় হইত। সকলের টাকা একত্র করিয়া একসঙ্গে খরচ চালাইতে কিছু সুবিধাই পড়িত সন্দেহ নাই। কিন্তু হাতে কিছুই বাঁচিত না। অথচ পুঁজি বা মূলধন না থাকিলে ছাত্রাবাসের হোটেলখানা ভাল করিয়া চালান কঠিন। আমরা শুইবার ঘরে খাট, গদি, তোষক ইত্যাদি কিছুই জোগাইতে পারিতাম না। শীতকালের রাত্রে ছেলেরা কষ্ট পাইত। রাত্রে উঠিয়া, অনেক সময়ে আমি তাহাদিগকে সান্ত্বনা দিতে যাইতাম। দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম হইত না। কোন কোন ঘরে যাইয়া দেখিতাম—তিন চারিজন ছাত্র জড়াজড়ি করিয়া আগুন পোহাইতেছে। সকলের পীঠের উপর দিয়া একটা কম্বল ফেলা আছে। কেহই ঘুমাইতে পায় নাই। একদিন রাত্রে খুব বেশী শীত পড়িয়াছিল। পরদিন সকালে ধর্ম্ম মন্দিরে যাইয়া ছাত্রদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম “কাল রাত্রে তোমাদের কার কার হাত পা জমিয়া গিয়াছিল?” অমনি তিন জন ছাত্র হাত তুলিয়া বুঝাইল। এত কষ্ট স্বীকার করিয়াও ছাত্রেরা কখন বিরক্তির ভাব দেখায় নাই। তাহারা দেখিত যে আমরা যথাসাধ্য তাহাদিগকে সুখে রাখিতেই চেষ্টা করিতেছি। বরং তাহারা শিক্ষকদিগেরই কষ্ট যাহাতে না হয় তাহার জন্য উদ্গ্রীব হইত। শীত সহ্য করা তাহাদের ছাত্রজীবনের অন্যতম ব্রত স্বরূপ হইয়াছিল।
আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ মহাশয়েরা সর্ব্বদা বলিয়া থাকেন, “নিগ্রোজাতি শাসন কর্ম্মে স্বায়ত্ত বিধান চাহে কেন? আমরা উহাদের উপর কর্ত্তৃত্ব করি বলিয়া উহাদের মধ্যে সংযম, শান্তি, শৃঙ্খলা থাকে। আমরা ছাড়িয়া দিলে উহাদের সমাজে অশান্তি, অত্যাচার, ব্যভিচার ইত্যাদি বিরাজ করিবে। এক নিগ্রো অন্য নিগ্রোর অধীন থাকিতেই চাহে না। উহারা কখনই নিজে মিলিয়া মিশিয়া কাজ কর্ম্ম করিতে পারিবে না। আমাদের শাসনেই উহারা সুখে আছে।” আমি পূর্ব্বে এ কথা কিছু কিছু বিশ্বাস করিতাম। কিন্তু টাস্কেজী বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতায় একথা আর আমি স্বীকার করিতে প্রস্তুত নহি।
টাস্কেজী বিদ্যালয়ের পরিচালনা একটা রাষ্ট্রশাসন অপেক্ষা নিতান্ত কম ব্যাপার নয়। অথচ এখানে একজন শ্বেতাঙ্গেরও কিঞ্চিন্মাত্র আধিপত্য নাই। ইহা একটা পূরাপূরি নিগ্রোজাতির কর্ম্ম-কেন্দ্র। কৃষ্ণাঙ্গসমাজে স্বায়ত্ত শাসন অসম্ভব নয়—এই প্রতিষ্ঠানে তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। বিগত ১৯ বৎসরের ভিতর এখানকার কোন ছাত্র শিক্ষক বা অন্য কর্ম্মচারীকে অপমান বা নিন্দা করিয়াছে বলিয়া মনে হয় না। অবশ্য ছেলে মানুষীগুলি ধরা উচিত নয়। আমাদের অধ্যাপক, কেরাণী এবং পরিচালকেরাও কখন অত্যাচারী হইয়াছেন—একথা শুনি নাই। বরং ছাত্রে শিক্ষকে, কেরাণীতে পরিচালকে সর্ব্বদা প্রীতি, সৌহার্দ্য এবং ঐক্যের বন্ধনই লক্ষ্য করিয়াছি। পরস্পর পরস্পরকে সম্মান করিয়া চলে। একজনের সুখ দুঃখে অভাব-অভিযোগে অন্যান্য সকলেই সাড়া দেয়। এই প্রকাণ্ড নিগ্রোসংসারের সকল কাজই সুশৃঙ্খলার সহিত চলিতেছে। কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ কি সত্য সত্যই স্বায়ত্ত শাসনের এবং ঐক্যগ্রন্থনের অনুপযুক্ত? টাস্কেজী বিদ্যালয়ের পরিচালনা দেখিলে কেহই নিগ্রো জাতি সম্বন্ধে আর মিথ্যা অপবাদ রটাইতে পারিবেন না। আজ আমি সাহসভরে একথা জগতে প্রচার করিতেছি।
নিগ্রো যুবকেরা ভক্তি জানে—গুরুজনকে শ্রদ্ধা করিতে পারে। আমি কতবার দেখিয়াছি—কোন শিক্ষক বা পরিচালক স্বহস্তে পুস্তক, ছাতা বা আর কিছু বহিয়া লইতেছেন দেখিলে ছাত্রেরা তাঁহাদিগের নিকট আসিয়া সেইগুলি লইয়া সঙ্গে সঙ্গে যাইতে চাহে। শিক্ষকগণকে সুখী রাখিতে তাহারা কি যত্নই না করে? বৃষ্টি পড়িতেছে এমন সময়ে কোন শিক্ষক যদি ঘরের বাহিরে থাকেন, ছাত্রেরা তৎক্ষণাৎ ছাতা লইয়া তাঁহার মাথায় ধরিতে আসে। নিগ্রো-সন্তানও মানুষ—তাহাদেরও হৃদয় আছে—তাহারা গুরুকে ভক্তি করিতে পারে।
আজকাল শ্বেতাঙ্গ মহলে নিগ্রো সম্বন্ধে মনোভাব পরিবর্ত্তিত হইতে আরম্ভ করিয়াছে। শ্বেতাঙ্গেরা আমাদিগকে বর্ব্বর পশু অসভ্য কিছু কম মনে করিতে শিখিতেছেন। টাস্কেজীর শ্বেতাঙ্গেরা সকলে আজকাল আমাকে সম্মান করিয়া থাকেন। অনেক সময়ে গায়ে পড়িয়াও শ্রদ্ধা দেখাইতে কুণ্ঠিত হন না। টাস্কেজীর বাহিরেও নিগ্রোজাতির প্রতি সুদৃষ্টি পড়িয়াছে। আমি এখন নানাস্থানে শ্বেতাঙ্গসমাজ হইতে আদর আপ্যায়ন পাইয়া থাকি। সেদিন টেক্সাস প্রদেশে রেলগাড়ীতে যাইতেছিলাম। প্রত্যেক স্টেশনেই দেখি কত শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ও রমণী আসিয়া আমার সঙ্গে “যেচে” আলাপ করিলেন। আমি তাঁহাদিগকে কখনও দেখি নাই। কিন্তু তাঁহারা আমার নাম শুনিয়াছেন। সকলের মুখেই এক কথা “আপনি আমাদের দক্ষিণ অঞ্চলে যে সৎকার্য্যে ব্রতী হইয়াছেন তাহার জন্য আমরা সকলেই গৌরবান্বিত। আপনাকে আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি।”
আমি আর একবার শ্বেতাঙ্গদিগের “ভালবাসার অত্যাচারে” পড়িয়াছিলাম। ইহাঁরা আমার সঙ্গে জনেক সময়ে গায়ে পড়িয়া আলাপ করেন, সম্মান করেন, ভোজ দেন। আমি তাহাতে বড়ই বিব্রত বোধ করি। একদিন উত্তর অঞ্চলে রেলে যাইতেছিলাম। অত্যন্ত ক্লান্ত থাকায় বেশী পয়সা দিয়া শুইবার কামরার জন্য টিকিট করিয়াছিলাম। রেলগাড়ীর এই কামরাগুলিকে “পুলম্যান শ্লীপার” বলে। গাড়ীতে উঠিয়াই দেখি দুইজন ইয়াঙ্কি রমণী। ইহাঁদিগকে আমি চিনিতাম। ইহাঁরা বোষ্টন-নগরের বড়ঘরের মেয়ে। ইহাঁরা আমাকে তাঁহাদের কামরায়ই জায়গা দিলেন। আমি ভাবিলাম—ইহাঁরা বোধ হয় দক্ষিণ অঞ্চলের আদব কায়দা জানেন না। যাহা হউক, তাঁহাদের উপরোধে সেই কামরাতেই গেলাম। পরে দেখি, ইহাঁদের আদেশ অনুসারে গাড়ীর হোটেলওয়ালা খানা আনিয়া হাজির করিল। আমি বড়ই লজ্জিত হইতেছিলাম। গাড়ীর মধ্যে অনেক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ছিলেন। তাঁহারা আমাদের দিকে দেখিতে লাগিলেন এবং কাণাঘুষা করিতে লাগিলেন। আমি রমণীদ্বয়ের নিকট বিদায় চাহিলাম। তাঁহারা কোন মতেই ছাড়িলেন না। আমাকে তাঁহাদের সঙ্গে এক টেবিলে নৈশভোজন করিতে হইল!
কেবল তাহাই নহে। তাঁহাদের একজনের ব্যাগে নূতন ফ্যাসানের একপ্রকার উৎকৃষ্ট চা ছিল। তিনি জানিতেন হোটেলের বাবুরচি সে চা কখনও দেখে নাই। সুতরাং তাহারা উহা ভাল করিয়া তৈয়ারী করিতে পারিবে না। এজন্য তিনি নিজেই উঠিয়া গিয়া হোটেল হইতে চা তৈয়ারী করিয়া আনিলেন। আমার জন্য শ্বেতাঙ্গদিগের এত আয়োজন! প্রায় ১॥-২ ঘণ্টা ধরিয়া গল্প করিতে করিতে খানা খাওয়া শেষ হইল। জীবনে আর কখনও আমি এতক্ষণ ধরিয়া খানা খাই নাই। খাওয়ার পরই আমি ধূমপান করিবার জন্য ওখান হইতে অন্য ঘরে উঠিয়া গেলাম। হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচা গেল। কিন্তু সেইখানে গিয়াই দেখি শ্বেতাঙ্গ পুরুষেরা আমাকে চিনিয়া ফেলিয়াছে। সকলেই আমার সঙ্গে আলাপ করিল। আমার টাস্কেজীর কথা তুলিয়া সকলেই আমার প্রশংসা করিতে লাগিল।
আমার ছাত্রদিগকে আমি সর্ব্বদাই বুঝাইয়া থাকি, “দেখ, এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আমি সত্য। ইহার শিক্ষক ও পরিচালকগণ সকলেই আমার বন্ধু বা পুরাতন ছাত্র এবং নিজ হাতে তৈয়ারী করা লোক, ইহাও সত্য। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। আমরা সকলেই ইহার সেবক ও ভৃত্য মাত্র। বাস্তবিক পক্ষে, এই বিদ্যালয় তোমাদের, তোমরাই ইহার সুনাম কুনামের জন্য দায়ী। ইহার উন্নতি অবনতিতে তোমাদেরই ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বা অনুজ্জ্বল। তোমরা আমাকে তোমাদের শাসন-কর্ত্তা মনে করিও না। তোমাদের একজন প্রবীণ বন্ধু বা অভিজ্ঞতা বিশিষ্ট পরামর্শদাতারূপে গ্রহণ করিও। কিন্তু বিদ্যালয়ের পরিচালনা সম্বন্ধে সকল বিষয়ে তোমাদিগকেই দৃষ্টি রাখিয়া চলিতে হইবে।” আমি এগুলি কেবল কথার কথা বলিতাম না—নানা উপায়ে ছাত্রদিগকে দায়িত্বের মধ্যে ফেলিতাম। এমন সব ঘটনাচক্র সৃষ্টি করিয়া তুলিতাম যাহাতে ছাত্রেরা নিজ নিজ কর্ত্তৃত্ব ফলাইবার সুযোগ পাইত। তাহারা বুঝিতে পারিত যে, সত্যসত্যই তাহারা বিদ্যালয়ের জন্য দায়ী।
আমি সরলভাবে ছাত্রদিগের সঙ্গে মিশি। তাহাদের সঙ্গে পরামর্শ করি—তাহাদের মতানুসারে কার্য্যও করি। তাহাদের সঙ্গে আলোচনা না করিয়া বিদ্যালয়ের ছোট বড় কোন কাজেই আমি হাত দিই না। বৎসরে ৩।৪ বার ছাত্রেরা আমার নিকট পত্র দ্বারা বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য প্রস্তাব লিখিয়া পাঠায়। এই নিয়ম আমিই করিয়া দিয়াছি। এই সকল প্রস্তাব পড়িয়া আমার নিজের অনেক গলদ বুঝিতে পারি—এবং বিদ্যালয়ের পরিচালনা সম্বন্ধে আরও সতর্ক হই। তাহা ছাড়া মাঝে মাঝে আমি তাহাদিগকে ডাকিয়া পাঠাই। খোলাখুলি অনেক বিষয় আলোচিত হয়। আমাদের ভুল এবং অসম্পূর্ণতাগুলি সংশোধন করিবার উপায় নির্দ্ধারিত হয়—পরে সেইগুলি কার্য্যে পরিণত করিয়া থাকি। অধিকন্তু, ছাত্রদিগের অনেক আলোচনা-সমিতি আছে। সেখানেও বিদ্যালয় সম্বন্ধে নানা তর্ক প্রশ্ন উঠে। তাহাতে আমি যোগদান করিয়া অনেক নূতন কথা শিখিতে পারি।
ছাত্রদের পরামর্শ অনুসারে কাজ যখন হইতে থাকে তখন তাহারা যার পর নাই আনন্দিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বজ্ঞানও বাড়িতে থাকে। তখন আবোল তাবোল বকিতে অথবা বিশেষ চিন্তা না করিয়া যাহা তাহা বলিয়া ফেলিতে তাহারা পারে না। যাহাদের কথার দাম নাই তাহারা অনর্থক বাক্যব্যয় করিতে অভ্যস্ত। কিন্তু টাস্কেজীতে ছাত্রেরা যে কথা বলে সেই কথা অনুসারে সত্য সত্যই কাজ হইয়া থাকে। কাজেই তাহারা সংযত ধীর ও গম্ভীরভাবে সকল বিষয়ের মীমাংসা করিতে বাধ্য হয়। এইরূপে দায়িত্বপূর্ণ কার্য্য করিতে করিতে ভবিষ্যতের জন্য দায়িত্বজ্ঞান সঞ্চিত হয়। ক্রমশঃ তাহারা বড় বড় কাজ করিবার শক্তি অর্জ্জন করিতে পারে।
যত লোকের মধ্যে এই কর্ত্তৃত্ববোধ জাগান যায় ততই সমাজের মঙ্গল। সকল মানুষকেই বুঝান উচিত “তুমি মানুষ। তোমার নিজের মাথা খাটাইয়া কাজ করিবার ক্ষমতা আছে, তোমার স্বাধীনভাবে চিন্তা করিবার শক্তি আছে। তুমি পরের সাহায্য না লইয়া কাজ ও চিন্তা করিতে থাক। তুমি কর্ত্তারূপে নানা অনুষ্ঠানের সৃষ্টি করিতে লাগিয়া যাও। তুমি কি সর্ব্বদা অপর লোকের কেরাণীমাত্র থাকিবে? তুমি কি পরকীয় চিন্তার অনুবাদক মাত্ররূপে জীবন কাটাইবে? না। তুমিও লোকজন খাটাইতে শিখ, তুমিও দশজনকে কাজে নামাইতে চেষ্টা কর। তুমি মানুষ, তুমি কর্ম্মকর্ত্তা হইবার আকাঙ্ক্ষা কর, ভিন্ন ভিন্ন কর্ম্মকেন্দ্র গড়িয়া তুলিবার জন্য উদ্যোগী হও।”
আমার বিশ্বাস, কুলী ও মজুর মহলে যদি এইরূপে কর্ত্তৃত্ববোধ এবং দায়িত্বজ্ঞান জাগান যায় তাহা হইলে সমাজে বহু ধর্ম্মঘট, কুলীবিভ্রাট, অপব্যয়, উৎপীড়ন ইত্যাদি হইতে রক্ষা পাওয়া যায়। ধনবান্ মহাজনেরা এবং কলকারখানার মালিক মহাশয়েরা তাঁহাদের কর্ম্মচারী কেরাণী এবং শ্রমজীবীদিগকে এই কথা বলিতে অভ্যস্ত হইবেন না কি? একবার যদি তাঁহারা নিজেদের অহঙ্কার ত্যাগ করিয়া কুলী মজুর কেরাণী ও কর্ম্মচারীদিগের সঙ্গে মিশিতে পারেন তাহা হইলে সমস্ত কারবার ও কারখানার মধ্যে একটা নূতন প্রাণ সৃষ্টি হয়। মালিকেরা বেতনপ্রাপ্ত কর্ম্মীদিগের পরামর্শ গ্রহণ করিলে আপনা আপনিই ইহারা কারবারটিকে কৃতকার্য্য করিয়া তুলিতে চেষ্টিত হইবে। তাহারা ইহাকে আপনার নিজের বলিয়া জ্ঞান করিবে।
এই আত্মবোধ জাগাইবার উপায় আর কিছুই নয়। কেরাণী কুলী সকলেরই কর্ত্তৃত্ববোধ ও দায়িত্বজ্ঞান জন্মিলে এই কার্য্য সহজেই সিদ্ধ হইবে। এজন্য ইহাদের সঙ্গে মালিক মহাশয়দিগের সরল আলোচনা, কথাবার্ত্তা, পরামর্শ গ্রহণ এবং ভাবের আদান প্রদান আবশ্যক। অজস্র টাকা খরচ করিয়া যে ফললাভ না হয় সহৃদয়তার দ্বারা তাহা অপেক্ষা বেশী কাজ হয়, মুখের কথায় তাহা অপেক্ষা বেশী কাজ হয়, বিশ্বাস করিলে তাহা অপেক্ষা বেশী কাজ হয়। আমি যদি কখনও কাহাকে বিশ্বাস করি সে কখনই আমাকে বিপদে ফেলিতে পারিবে না। সে যদি বুঝে যে তাহার উপর নির্ভর করিয়া আমি কোন কাজে নামিয়াছি, সে যথাসাধ্য সেই কাজে লাগিয়া থাকিবে। বিশ্বাস সর্ব্বত্রই জয়লাভ করে—অবিশ্বাস ও সন্দিগ্ধ চিত্ততায় কখনও কাজ হয় না। বিশ্বাসের ক্ষমতা সকল সমাজেই দেখা যায়। নিগ্রোকে বিশ্বাস কর, তাহার দ্বারা অসাধ্য সাধন করিতে পারিবে। কুলী মজুরদিগের উপর যথার্থভাবে নির্ভর কর, তোমার কারবার কখনই বিফল হইবে না। এই বুঝিয়াই আমি আমার ছাত্রগণকে এত বিশ্বাস করিতাম—তাহাদের উপর সকল বিষয়ে নির্ভর করিতাম—তাহাদিগকেই বিদ্যালয়ের কর্ত্তা বিবেচনা করিতাম। তাহাদের কর্ত্তৃত্বে আমরা সুফলই পাইয়াছি।
পূর্ব্বেই বলিয়াছি, আমার ছাত্রেরা বিদ্যালয়ের বাড়ীঘর সবই প্রস্তুত করিয়াছে। এখন বলিতেছি যে তাহারা তাহাদের ব্যবহারোপযোগী টেবিল চেয়ার আলমারি ডেস্ক ইত্যাদিও প্রস্তুত করিয়া লইয়াছে। প্রথমে আমাদের ছাত্রাবাসে খাট ছিল না। একখানা করিয়া খাট ছাত্রেরা তৈয়ারী করিতে লাগিল। ততদিন তাহারা মাটিতেই শুইয়া থাকিত। এদিকে গদি বা তোষকও ছিল না। তাহাও নিজ হাতে তাহারাই করিয়া লইল। কতকগুলি সস্তা কাপড়ের বস্তা কিনিয়া আনা হইয়াছিল। তাহার মধ্যে সালপাতা ভরিয়া গদি তৈয়ার হইত। প্রথম প্রথম এগুলি বড় অপরিষ্কার ভাবে প্রস্তুত হইয়াছিল। গদির ভিতর হইতে গোঁজ বাহির হইয়া থাকিত। শুইতে গেলে এগুলি গায়ে লাগিত। ক্রমশঃ গদি তৈয়ারী ব্যবসায় আমরা বেশ দক্ষতালাভ করিয়াছি। আজকাল টাস্কেজী বিদ্যালয়ে গদি তোষক তৈয়ারীর কাজ খুব ভাল রকমই চলে। আমাদের গদির কারখানার সুনামও বেশ প্রচারিত হইয়াছে। ফলতঃ আমাদের একটা বড় আয়ের উপায় এই গদি খানা হইতে দেখিতে পাইতেছি।
এইরূপে ছাত্রাবাস, বোর্ডিং গৃহ, ভোজনালয়, রন্ধনশালা ইত্যাদি সকল ঘরের জন্য সকল প্রকার আস্বাবই আমাদের ছাত্রেরা নিজ হাতে প্রস্তুত করিয়া লইল—প্রথম অবস্থায় প্রায় সবই বিশ্রী ও কদাকার হইত। পরে কারিগরিতে উন্নতি হইয়াছে। এখন সব জিনিষেই উচ্চ অঙ্গের শিল্প জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। সুতরাং বিদ্যালয়ের আবহাওয়ার মধ্যে সৌন্দর্য্য বেশ আছে। অধিকন্তু এই সকল কারবার হইতে ব্যবসায়ও চলিতেছে—তাহাতে বিদ্যালয় চালাইবার খরচ কিছু কিছু উঠিয়া থাকে।
আমি ছাত্রাবাসের প্রথম অবস্থায় ছাত্রদিগের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতাম। তাহাদিগকে প্রায়ই বলিতাম, “আমরা গরিব—থালাবাটি পর্য্যাপ্ত পরিমাণে নাই। আমাদের চেয়ার টেবিল, গদি খাট ইত্যাদি সবই বিশ্রী ও কোন রকমে চলনসই। লোকে এগুলি দেখিয়া দুঃখিত হইতে পারে—কিন্তু কেহই নিন্দা করিবে না। তাহারা জানে, পয়সা থাকিলেই আমরা বেশী দামে চক্চকে জিনিষ তৈয়ারী করিতে বা কিনিতে পারিতাম। কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ত পয়সার জিনিষ নয়। উহা আমাদের যার যার নিজের হাতে! ইহার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। আমরা যদি অপরিষ্কারভাবে গৃহস্থালী চালাই, বা চলিফিরি তাহার জন্য লোকেরা আমাদিগকে নিন্দা করিবে, তিরস্কার করিবে। এ-নিন্দা ও তিরস্কার এড়াইবার কোন উপায় থাকিবে না। আমাদের স্বভাবই ইহার জন্য দায়ী। অতএব লোকে যেন আমাদিগকে সর্ব্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দেখে।”
এই শরীর পালন ও স্বাস্থ্য বিধান সম্পর্কে আর একটা কথা বলিব। আমি দাঁত মাজার গুণ সম্বন্ধে ছাত্রদিগকে সর্ব্বদা উপদেশ দিয়া থাকি। আমি আমার গুরুদেব আর্মস্ট্রঙ্গের নিকট দাঁত মাজার উপকারিতা সম্বন্ধে বিশেষ শিক্ষা পাইয়াছি। তিনি বলিতেন ‘দাঁত মাজা একটা ধর্ম্মবিশেষ’। আমি টাস্কেজীর ছাত্রাবাসে এই ধর্ম্ম প্রচারে কোন ত্রুটি করিতাম না। তাহার পর দুইটা চাদরের মধ্যে কেমন করিয়া শুইতে হয় ছাত্রদিগকে তাহাও শিখাইতাম। আমার ছাত্রাবস্থায় এ বিষয়ে যে দুর্দ্দশা হইয়াছিল আমার বেশ মনে আছে। তাহা ছাড়া জামা পরিষ্কার রাখা, কোটে বোতাম লাগান ইত্যাদি বিষয়ও ছাত্রদিগকে শিখাইতে হইত। এইরূপে উৎসব আমোদ কষ্টস্বীকার শীত ভোগ, খাওয়া পরা চলা ফেরা লেন দেন ইত্যাদি জীবনের নিত্যকর্ম্ম পদ্ধতির ভিতর দিয়া ছাত্রেরা গড়িয়া উঠিতে লাগিল।