নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/দ্বাদশ অধ্যায়

দ্বাদশ অল্যায়

আমার টাকা আসে কোথা হ’তে?

 পোর্টার হল নির্ম্মিত হইবার পর ছাত্র ও ছাত্রী সংখ্যা খুব বাড়িতে লাগিল। এজন্য আমাদের চতুঃসীমার বাহিরে কতকগুলি কাঠের কুঠুরী ভাড়া নিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। তাহাতেও কুলাইল না। অগত্যা আমরা আর একটা গৃহ নির্ম্মাণের জন্য উদ্‌গ্রীব হইলাম।

 এই গৃহের আনুমানিক ব্যয় স্থির করা গেল। দেখিলাম ৩০,০০০৲ টাকার কমে কোন মতেই এ ঘর তৈয়ারী হইতে পারে না। সুতরাং এবার পোর্টার হল অপেক্ষা বৃহত্তর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিতে হইল।

 প্রথমেই আমরা বাড়ীটার নাম ঠিক করিয়া লইলাম। সকলে মিলিয়া সাব্যস্থ করিলাম—‘আলাবামা-ভবন’ নাম দিলে ঐ প্রদেশের সকল অধিবাসীর সাহানুভূতি আকৃষ্ট করা যাইবে। সুতরাং আলাবামা-ভবনের জন্য আমরা উঠিয়া পড়িয়া লাগিলাম। ছাত্রেরা মাটী খুঁড়িয়া জমি পরিষ্কার করিতে লাগিল—দেওয়ালের জন্য ভিত্তির গর্ত্ত খুঁড়া হইতে থাকিল। অথচ আমাদের হাতে তখনও পয়সা নাই। শ্রীমতী ডেভিড্‌সন আবার টাস্কেজীর পাড়ায় পাড়ায় ভিক্ষার ঝুলি লইয়া বাহির হইলেন।

 অর্থাভাবে আমি বড়ই চিন্তিত হইয়াছি এমন সময়ে আমার গুরুদেব মহাপ্রাণ আর্মষ্ট্রঙ্গের একখানা টেলিগ্রাম পাইলাম। তিনি লিখিয়াছেন “আমার সঙ্গে উত্তরপ্রান্তের ইয়াঙ্কিমহলে অর্থ সংগ্রহের জন্য বাহির হইতে পারিবে? একমাস লাগিবে। যদি পার শীঘ্রই হ্যাম্পটনে চলিয়া এস।” তৎক্ষণাৎ আমি হ্যাম্পটনে চলিয়া গেলাম। যাইয়াই দেখি আমাদের ভিক্ষা আদায়ের জন্য আর্মষ্ট্রঙ্গ সকল ব্যবস্থাই করিয়া রাখিয়াছেন। তিনি উত্তর প্রান্তের স্থানে স্থানে সংবাদ পাঠাইয়াছেন যে আমরা টাস্কেজী বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহে সেই সকল স্থানে উপস্থিত হইব। হ্যাম্পটনের গায়কদলের দুই চারিজন আমাদের সঙ্গে শফরে বাহির হইল। এই অভিযানের সমস্ত খরচ হ্যাম্পটনের বিদ্যালয় হইতে বহন করা হইবে তাহাও বুঝিতে পারিলাম।

 আর্মষ্ট্রঙ্গের দুইটি উদ্দেশ্য ছিল। তিনি এই উপায়ে আমাকে ইয়াঙ্কিমহলে সুপরিচিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে পারিবেন ভাবিয়াছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আলাবামা ভবনের জন্যও টাকা উঠাইবেন স্থির করিয়াছিলেন। আর্মষ্ট্রঙ্গের উদারতা ও ত্যাগশীলতা আমাদের জন্য আরও কতবার দেখিয়াছি।

 উত্তর প্রান্তে বক্তৃতা করিবার সময়ে আমষ্ট্রঙ্গের একটা উপদেশ আমি সর্ব্বদা মনে রাখিতাম। তিনি বলিতেন “ফাঁকা কথা কখনও বলিবে না। প্রত্যেক শব্দেই যেন একটা নূতন বস্তু, নূতন ভাব মনের মধ্যে আসে। শ্রোতারা যেন বুঝে যে কতকগুলি কাজের কথা বলিতেছ।” বক্তৃতা করিবার নিয়ম ইহা অপেক্ষা আর কি ভাল হইতে পারে?

 নিউ-ইয়র্ক, ব্রুকলিন, বোষ্টন, ফিলাডেল্‌ফিয়া এবং অন্যান্য বড় সহরে টাস্কেজীর জন্য সভা হইল। সভায় অনেক লোক আসিত। আমরা দুই জনেই বক্তৃতা করিতাম। টাস্কেজী বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ও কার্য্যপ্রণালী বিবৃত হইত। সঙ্গে সঙ্গে আলাবামাভবনের জন্যও ভিক্ষা করা হইত। লোকেরা সন্তুষ্টই হইত বুঝিতাম। একমাস এইরূপ সভা করিয়া মন্দ টাকা উঠে নাই। আমাদের প্রচার কার্য্যও খুব ভাল হইয়াছিল।

 পরে আমি অনেকবার একাকী ভিক্ষার ঝুলি লইয়া উত্তর অঞ্চলে বাহির হইয়াছি। বলিতে কি, গত ১৫ বৎসরের ভিতর অধিকাংশ কালই আমি টাস্কেজীর বাহিরে বাহিরে কাটাইয়াছি। বিদ্যালয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ-সম্বন্ধ বেশী রাখিতে পারি নাই। আমাদের নূতন নূতন বিভাগের উন্নতি করিবার জন্য অর্থাভাবে যুক্ত-রাজ্যের প্রদেশে প্রদেশে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইয়াছে। এই বার আমরা অর্থসংগ্রহের অভিজ্ঞতা পাঠকগণকে কিছু বলিব।

 পরোপকারী এবং লোক-হিত-ব্রতধারী ব্যক্তি মাত্রেরই অর্থ সংগ্রহে বাহির হইতে হয়। বিদ্যাদানের জন্য, অথবা দরিদ্রের অভাব নিবারণের জন্য—যে জন্যই হউক, ভিক্ষা না করিলে বড় কাজ কখনই সমাধা হয় না। এরূপ বহু “ভিক্ষুকে”র সঙ্গে কার্য্যক্ষেত্রে আমার দেখা হইয়াছে। তাঁহারা অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়া থাকেন, “মহাশয়, আপনি এত টাকা পান কোথা হইতে? লোকেরা আপনার কথায় কাণ দেয় কেন? তাহাদিগকে বুঝাইবার জন্য আপনি কিরূপ চেষ্টা করিয়া থাকেন? আপনার অর্থসংগ্রহ কার্য্যের কোন নিয়ম বা প্রণালী আছে কি? আমাদিগকে পরামর্শ দিলে বড়ই উপকৃত ও বাধিত হইব। কারণ আমরাও দুই একটা কাজের ভার লইয়া বিব্রত হইয়া পড়িয়াছি। লোকের সহানুভূতি কোন মতেই আকৃষ্ট করিতে পারিতেছি না। আপনার সঙ্গে দৈবক্রমে দেখা হইল ভালই হইয়াছে। আপনার প্রদর্শিত পথে চলিতে পারিলে আমাদের অর্থ-দৈন্য বোধ হয় ঘুচিতে পারিবে।”

 পরোপকার ও মানবসেবার উদ্দেশ্যে ভিক্ষা বৃত্তির জন্য কোন নিয়ম আছে কি না বলিতে পরি না। আমি সংসারে ঘুরিয়া “ভিক্ষা বিজ্ঞানের” দুইটি সূত্র মাত্র আবিষ্কার করিয়াছি। প্রথমতঃ তুমি যে কাজটা করিতেছ তাহা জগতে প্রচার করা আবশ্যক। এই প্রচার কার্য্যে তন্ময় হইয়া যাওয়া প্রয়োজন। নিজের সমগ্র চিন্তা এই প্রচারে প্রয়াগ করা কর্ত্তব্য। অধিকন্তু কেবল মাত্র কয়েকজন ব্যক্তি বিশেষের নিকট কার্য্যের পরিচয় দিলে চলিবে না। সাধারণ জনগণও যেনন তোমার আরব্ধ অনুষ্ঠান সম্বন্ধে জানিতে ও শুনিতে পায়। এজন্য দেশের মধ্যে যতগুলি কর্ম্মকেন্দ্র, সভা সমিতি, পরিষৎ, প্রতিষ্ঠান বা সঙ্ঘ বর্ত্তমান আছে সকলগুলির ভিতরই তোমার কর্ম্মের আন্দোলন পৌঁছাইবার চেষ্টা করা উচিত।

 দ্বিতীয়তঃ, প্রচারের ফল কি হইতেছে তাহার জন্য উদ্বিগ্ন হইও না। ধর্ম্মভাবে প্রচারকার্য্যে লাগিয়া যাও। টাকা না পাইলেও দুঃখিত হইবার প্রয়োজন নাই। উদ্বেগে শরীর অবসন্ন হয়, চিত্তবিক্ষিপ্ত হয়—কার্য্য করিবার ক্ষমতা কমিয়া আসে।

 ভিক্ষাবিজ্ঞানের এই দ্বিতীয় সূত্র কার্য্যে পরিণত করা বড়ই কঠিন। অনেক সময়ে ধার করিয়া কাজ আরম্ভ করিয়াছি। পাওনাদারের বিল উপস্থিত—টাকা দিবার ক্ষমতা নাই। সেই সময়ে রাত্রে বিছানায় পড়িয়া এপাশ ওপাশ না করিয়া থাকা অসম্ভব। আমি অনেক স্থলেই আমার চিত্তের শান্তিরক্ষা করিতে পারি নাই—বহুরাত্রি না ঘুমাইয়া কাটাইয়াছি। রাস্তায় বা বারান্দায় পাগলের মত ছুটাছুটি করিতে হইয়াছে। অবশ্য এত দুরবস্থার মধ্যেও আমার ধীরতা এবং গাম্ভীর্য্য অনেকটাই ছিল। তাহা না হইলে এতদিন সহ্য করিয়া এককাজে লাগিয়া থাকিতে পারিতাম কি?

 সংসার দেখিয়া আমার জ্ঞান জন্মিয়াছে যে, জগতের যত বড় বড় কাজ সবই এইরূপ স্থিরচিত্ত সহিষ্ণুতাসম্পন্ন গাম্ভীর্য্যবিশিষ্ট কর্ম্মবীরগণের দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে। তাঁহাদের মাথার বোঝা বড় কম থাকে না। অসাধ্যসাধনেই তাঁহারা ব্রতী হইয়াছেন—নিতান্ত ‘না’কেও তাঁহাদের ‘হাঁ’তে পরিণত করিতে হইয়াছে। নৈরাশ্য বিফলতা এবং দৈন্যদারিদ্র্যের মধ্যে থাকিয়াই তাঁহাদিগকে বহু ব্যয়সাপেক্ষ বিশালকর্ম্মে হস্তক্ষেপ করিতে হইয়াছে। তথাপি তাঁহারা শান্ত গম্ভীর, এবং লোকপ্রিয় ও সৌজন্যবান্ রহিয়াছেন। এই চরিত্রবলেই জগৎকে পদানত করা যায়—বিশ্বশক্তিকে স্ববশে আনা যায়।

 যখনই কোন মহৎকর্ম্ম আরম্ভ কর, তখনই উহাতে তন্ময় হইয়া যাইবে—সেই কর্ম্মের মধ্যে নিজকে ডুবাইয়া ফেলিবে। নিজকে এই উপায়ে ভুলিতে না পারিলে অর্থাৎ কার্য্যকে তোমার কৃতিত্ব অপেক্ষা বেশী ভাল না বাসিলে তুমি সুখ পাইবে না— চিত্তের উদ্বেগও কমিবে না। তোমার জীবনের লক্ষ্যকে আন্তরিকভাবে ভালবাস, নিজের অহঙ্কার ভুলিয়া যাও, দেখিবে কর্ম্মের সুফলাভাবেও তুমি দুঃখিত না হইয়া থাকিতে পারিতেছ। কিন্তু যদি নিজকে সম্পূর্ণরূপে ভুলিতে না পার, তাহা হইলে তোমার কর্ম্মের বিফলতায় তুমি পাগল হইয়া পড়িবে।

 অতএব নিজকে ভুলিতে শিখ—নিজের অহঙ্কার বিসর্জ্জন দাও। যে ব্রত গ্রহণ করিয়াছ তাহাকে ধ্যান করিতে করিতে নিজের অস্তিত্ব বিস্মৃত হইয়া যাও। তবেই দেখিবে, অল্পমাত্র ফললাভেও চিত্তে শান্তি থাকিবে। চোখের সম্মুখে তোমার আরব্ধ কর্ম্ম নষ্ট হইয়া গেলেও তুমি আনন্দে থাকিতে পারিবে, এবং প্রয়োজন হইলে নূতন উৎসাহে নব নব কর্ম্ম আরম্ভ করিতে পারিবে।

 আমি টাস্কেজীর জন্য ভিক্ষায় বাহির হইয়া দেখিয়াছি অনেক লোকে ধনী লোকদিগকে তিরস্কার করেন। তাঁহারা বলেন “কি বলিব মহাশয়, এই বড় লোকগুলা যদি মানুষ হইত তাহা হইলে আমাদের একটা দুইটা অনুষ্ঠান কেন, একসঙ্গে ৫০টা কর্ম্মই অনায়াসে চলিতে পারিত। ইহাঁরা বিলাসসাগরে সাঁতার কাটিতেছেন—নিজ সুখভোগে অর্থের অপব্যয় করিতেছেন—অথচ দশের কাজে এক পয়সাও দিতে নারাজ।” ইহাঁরা সকলেই মহাদুঃখে এরূপ কথা বলিয়া থাকেন। ইহাঁদের উদ্দেশ্য ভালই—কারণ ইহাঁরা লোকহিতব্রতে বাহির হইয়াছেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস, ইহাঁদের বিষয়টা একটুকু গভীরভাবে না বুঝিবার দোষ আছে।

 আমি এইরূপ পরোপকার ব্রতধারী লোকসেবক ভিক্ষুকগণকে বলিয়া থাকি, “মহাশয়, মনে করুন, দেশে একজনও ধনী লোক নাই। মনে করুন বড়লোকদিগের টাকাকড়ি সবই সংসারের সকল লোকের মধ্যে বিভক্ত করিয়া দেওয়া হইল। ভাবিয়া দেখুন ত, তখন দেশের অবস্থা কি হইবে? এই যে এত বড় বড় কারবার, কারখানা, ফ্যাক্টরী, জাহাজ কোম্পানী, চাষ বাস ইত্যাদি কত কি দেখিতেছেন—এই সমুদয়ের একটাও থাকিবে কি? এইগুলি না থাকিলে এত কুলীমজুর কেরাণী কর্ম্মচারীর অন্নসংস্থান হইবে কি? দেশময় দারিদ্র্য দুঃখ ছড়াইয়া পড়িবে যে! দেশের কৃষি শিল্প, বাণিজ্য সবই লুপ্ত হইয়া যাইবে যে! সমাজের লক্ষ্মীশ্রী কোথায়ও থাকিবে না। বড় লোকেরা কি সত্য সত্যই সমাজের পাপ ও কলঙ্কস্বরূপ?”

 ধনীলোক সম্বন্ধে আমার আরও অনেক বক্তব্য আছে। আমি আমার ‘ভিক্ষুক’ বন্ধুগণকে বলিয়া থাকি, “কত শত লোক ধনী মহাত্মাদের দ্বারা প্রতিপালিত হয় আপনারা তাহার খবর রাখেন? প্রত্যেক ধনী ব্যক্তিরই গুপ্তদান অসংখ্য আছে। সকল দানের খবরই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় না। আপনি হয়ত একজনের নিকট কিছু পাইলেন না। কিন্তু তাহা বলিয়াই তাঁহাকে আপনি নির্দ্দয়, বিলাসী বা স্বার্থপর বিবেচনা করেন কেন? আপনার অজ্ঞাতসারে তিনি হয়ত কত দরিদ্রের অন্ন বস্ত্র সংস্থান করিতেছেন!”

 আমি সত্য কথা বলিতে পারি, আমেরিকার ধনী ব্যক্তিগণকে প্রতিদিন অন্ততঃ ২০।২২ জন নূতন নূতন লোকের সাহায্য করিতে হয়। আমি বড় বড় সহরের নামজাদা লোকদের বাড়ীতে সাহায্য প্রার্থী হইয়া দেখিয়াছি—আমার মত আরও ১২ জন লোক তাঁহাদের নিজ নিজ প্রস্তাব লইয়া হাজির হইয়াছেন। এই ত গেল সাক্ষাতে ভিক্ষার কথা। তাহা ছাড়া চিঠিপত্রের দ্বারা কত দূর দূর স্থান হইতে লোকেরা বড় লোকের নাম শুনিয়া ভিক্ষাপ্রার্থী হয় তাহার সন্ধান কে রাখে?

 তার পর সৎকর্ম্মের নীরব বন্ধু আমেরিকায় কত আছেন তাহার সংখ্যা করা অসম্ভব। তাঁহাদের নাম জগতে কেহই জানিতে পায় না। অথচ লক্ষ লক্ষ টাকা দান করিয়া তাঁহারা দরিদ্রের সুখবিধান করিতেছেন। আমি ১০।১২ ব্যক্তির সন্ধান পাইয়াছি—তাঁহারা লোকসমাজে বড়ই অর্থপিশাচ, লোভী, হৃদয়হীন বলিয়া খ্যাত। অথচ প্রতি বৎসর লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকিয়া তাঁহারা অজস্র টাকার সদ্ব্যয় করিতেছেন। নিউ ইয়র্কেই এইরূপ পরদুঃখে দুঃখী অথচ নীরব দাতা দুই জনকে আমি জানি। ইহাঁরা ইয়াঙ্কি রমণী। তাঁহারা গত ৮ বৎসর ধরিয়া আমাকে টাস্কেজী বিদ্যালয়ের গৃহ-নির্ম্মাণ-তহবিলে এবং অন্যান্য কাজে অর্থসাহায্য করিয়া আসিতেছেন। এতদ্ব্যতীত তাঁহাদের অন্যান্য দানও আছে।

 আজ আমি একটা কথা খোলাখুলি বলিব। অনেক কোটি টাকা আমার হাত দিয়া টাস্কেজীর জন্য জলের মত খরচ হইয়াছে—একথা কাহারও অজানা নাই। কিন্তু আমি বলিতে চাহি ইহা আমার “ভিক্ষা”লব্ধ টাকা নহে! আমি কখনও ‘ভিক্ষা’ করি নাই—আমি ‘ভিক্ষুক’ নহি! আমার অর্থসংগ্রহ কার্য্যকে আমি কোন মতেই ‘ভিক্ষা,’ ‘ভিক্ষুকবৃত্তি’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করিতে পারিব না।

 আমি জানি, ‘ভিক্ষা’ করিলে টাকা পাওয়া যায় না। দিনরাত্রি বড় লোকের দরবারে বসিয়া অর্থ সাহায্যের কথা পাড়িলে অর্থ সংগ্রহ হয় না। যাঁহারা ঐরূপ করিয়া থাকেন তাঁহারা আত্মসম্মান-বোধহীন—সত্য সত্যই ভিক্ষুক। কিন্তু আমার আত্মসম্মানবোধ সর্ব্বদাই থাকে—আমি নিজকে কখনও কাহার নিকট ছোট করি না। আমি বুঝি, মানুষ মাত্রেরই কর্ত্তব্য জ্ঞান আছে, মানুষ মাত্রেরই সেবা-প্রবৃত্তি আছে, মানুষ মাত্রেই লোকের উপকার করিতে পারিলে সুখী হয়। সুতরাং কোন স্থানে একটা ভাল কাজ হইতেছে, একথা জানিতে পারিলেই সকলে সেদিকে দৃষ্টি দেয়। যাহার যে ক্ষমতা সে সেই উপায়ে তাহার সাহায্য করে। ধনী ধন দান করিতে উৎসাহী হন। বিদ্বান্ তাহার জন্য লোক-সমাজে সহানুভূতি সৃষ্টি করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। যাহাদের শারীরিক শক্তিই একমাত্র সম্বল তাহারা সেই কর্ম্মের জন্য হাতে পায়ে খাটিয়া আনন্দিত হয়। আমি আরও বুঝি যে, দাতা সংসারে অনেকেই আছেন, কিন্তু দান গ্রহণ করিবার উপযুক্ত লোকই খুব অল্প। টাকা পাওয়া খুব সহজ—কিন্তু টাকা পাইয়া তাহার সদ্ব্যবহার করাই বড় কঠিন। হায়, যাঁহারা বড় লোকের নিকট টাকা আদায় করিতে যান তাঁহারা যদি এই কথাগুলি মনে রাখিতেন তাহা হইলে তাঁহারাও হতাশ হইতেন না, এবং বড়লোকদিগকেও তিরস্কার করিতেন না।

 আমি অর্থসংগ্রহের দায়িত্ব মর্ম্মে মর্ম্মে বুঝিয়াছি। টাকার কথা লোকজনকে বেশী বলি না—কার্য্যের কথাই বেশী বলি। কোন কার্য্যের সুফল কুফল, এদিক ওদিক, কর্ম্ম প্রণালী, সমাজের অন্যান্য কার্য্য ও চিন্তার সঙ্গে আমার আরব্ধ কর্ম্ম ও চিন্তার সম্বন্ধ, আমার জীবনের লক্ষ্য, ইত্যাদি বিষয়েই আমি লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করি। এই উপায়ে ধনী নির্দ্ধন সকল সমাজেই আমি প্রচারকের কার্য্য করিয়া থাকি। এইরূপ নানাবিধ কথাপ্রসঙ্গে আমাদের মধ্যে হৃদ্যতা ও বন্ধুত্বের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়। আমি ভিক্ষা করিতে বড়ই নারাজ। আমি কোন দিনই ভিক্ষা করি নাই। আমি ভিক্ষুক নহি। আমি কর্ম্মের উপাসক—আমি কর্ম্মের প্রচারক আমি সর্ব্বত্র সদ্ভাবের বিস্তারই করিয়াছি—আমি সকল মহলেই শিক্ষা-প্রচারক রূপে পরিচিত। আমার অর্থসংগ্রহ এই লোক-শিক্ষা-বিস্তারের আনুষঙ্গিক ফল মাত্র।

 অর্থসংগ্রহকার্য্যে ব্যাপৃত থাকিলে পরোক্ষ ভাবে একটা মস্ত লাভ হয়। সাংসারিক জ্ঞান খুব বাড়িয়া যায়—লোকচরিত্র বুঝিতে পারা যায়। অনেক লোকের সংশ্রবে আসিতে হয়—নানা কথা বুঝা যায়—নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা জন্মে। তাহা ছাড়া জগতের অনেক গুপ্ত মহাপুরুষ এবং চরিত্রবান্ নরনারীর সাক্ষাৎ লাভ হয়। যাঁহাদের নাম খবরের কাগজে উঠে না অথচ যাঁহারা পরহিত করিতে পারিলেই সুখী হন এরূপ অনেক মহাত্মার পরিচয় পাওয়া যায়। এই সকল লোকের সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলিতে পারাও মহা সৌভাগ্যের বিষয়। আমি এরূপ দাতা ব্যক্তির সংশ্রবে আসিয়া বহুবার জীবন ধন্য করিয়াছি। আমি বোষ্টন-নগরের দুই একটি ঘটনা উল্লেখ করিতেছি। এক বাড়ীতে গৃহস্বামী বাহিরে গিয়াছিলেন। তাঁহার পত্নীর নিকট আমার সংবাদ পাঠান হইল। ইতিমধ্যে স্বামী আসিয়া উপস্থিত। আমাকে দেখিয়াই বিরক্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন “কি চাই?” আমি আমার উদ্দেশ্য বুঝাইতে গেলাম। তিনি আরও ক্ষেপিয়া উঠিলেন। আমি আস্তে আস্তে সরিয়া পড়িলাম। এই বাড়ীর নিকটেই আর একজন ভদ্রলোকের কাছে গেলাম। আমার কথা শুনিবামাত্রই তিনি বেশ মোটা টাকার জন্য একটা চেক্‌ সহি করিয়া দিলেন। আমি তাঁহাকে ধন্যবাদদিবারও অবসর পাইলাম না। তিনি বলিতে লাগিলেন “আপনি আমাদেরই কার্য্য করিতেছেন। মহাশয়, আপনাকে সাহায্য করিবার সুযোগ পাইয়া আমি কৃতার্থ হইলাম।”

 আমি বলিতে পারি যে, সংসার হইতে প্রথম শ্রেণীর লোক কমিয়া আসিতেছে, দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক সংখ্যাই বাড়িতেছে। ধনী লোকেরা পরহিতব্রতধারী ব্যক্তিগণকে আর ‘ভিক্ষুক’ বা উৎপাত স্বরূপ মনে করেন না। তাঁহারা আমাদের মত লোককে সৎকর্ম্মের যন্ত্র ও উপলক্ষ্য স্বরূপ শ্রদ্ধা করেন। তাঁহাদেরই কর্ত্তব্য কর্ম্মের কিয়দংশ আমরা করিতেছি—এইরূপই আজকাল কার ধনী মহাত্মাগণের ধারণা জন্মিতেছে।

 বোষ্টন-নগরে যাঁহারই বাড়ীতে আমি প্রার্থী হইয়াছি তিনিই আমাকে বলিয়াছেন, “আপনার এই মহৎকর্ম্মের জন্য আমার নিকটেও আসিয়াছেন, এইজন্য আমি আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ দিতেছি। আপনার অনুগ্রহে আমিও একটা সৎকার্য্যে আমার ক্ষুদ্রশক্তি প্রয়োগের সুযোগ পাইলাম। এ অঞ্চলে ভবিষ্যতে আসিলে যেন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়।” ধনী ব্যক্তিরা ধনদানের উপযুক্ত সুযোগ খুঁজিয়া থাকেন—এই বিশ্বাসই আমার দিন দিন বাড়িতেছে।

 প্রথম প্রথম অর্থসংগ্রহে বাহির হইয়া বড় কষ্টেই পড়িতাম। মনে আছে তখন উত্তর অঞ্চলের সহরে সহরে পল্লীতে পল্লীতে দিনরাত খাটিয়াও একটাকা মাত্র পাইতাম না। অনেক লোকের নিকট বড় আশা করিয়া যাইতাম কিন্তু তাঁহারা এক পয়সাও না দিয়া বিদায় করিতেন। এইরূপে নিষ্ফল ভাবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটিত। হঠাৎ দেখিতাম, যাহার নিকট কখনও কিছুমাত্র আশা করিতে পারি নাই সেই ব্যক্তিই সাহায্য দান করিয়া ভগ্নহৃদয়ে আশার আলোক বিকিরণ করিতেন।

 একদিন নানা লোকের পরামর্শে কনেষ্টিকাট প্রদেশের এক পল্লীতে ধনী ব্যক্তির শরণাপন্ন হইলাম। সহর হইতে প্রায় দুই মাইল দূরে তাঁহার গৃহ। সেইখানে শীতে ঝড়ে হাঁটিয়া গিয়া দেখা করিলাম। তিনি কত কথাই পাড়িলেন—অনেক গল্প হইল। কিন্তু একটি পয়সাও দিলেন না। আমি বুঝিলাম ইহাঁর নিকট প্রচার করাও কর্ত্তব্য ছিল। তাহাই করিয়াছি। নাই বা পাইলাম কিছু সাহায্য।

 কিন্তু দুই বৎসর পর এই ব্যক্তি আমার নিকট টাস্কেজীর ঠিকানায় পত্র লিখিলেন; “মহাশয়, এই পত্রের সঙ্গে নিউ ইয়র্ক ব্যাঙ্কের উপর আপনার নামে একখানা চেক্‌ সহি করিয়া দিলাম। চেকের মূল্য ৩০,০০০৲। আমি এই টাকা আপনার বিদ্যালয়ের জন্য উইল করিয়া রাখিয়াছিলাম। শেষে ভাবিয়াছি বাঁচিয়া থাকিতে থাকিতেই ইহা দিয়া যাওয়া ভাল। আপনি দুই বৎসর পূর্ব্বে আমার বাড়ীতে অনুগ্রহ পূর্ব্বক পদার্পণ করিয়াছিলেন সে কথা আপনার মনে থাকিতে পারে। সেদিনকার কথোপকথন আমি বেশ মনে রাখিয়াছি।”

 এই ৩০,০০০৲ টাকা আমার নিকট এক অতি দুঃসময়ে পৌঁছিয়াছিল। ইহা না পাইলে আমাদের যথেষ্ট ক্ষতিই হইত। পাইয়া আমাদের ঘাড়ের বোঝা অনেকটা হালকা হইয়াছিল।

 শ্রীযুক্ত কলিস্ হাণ্টিংডনকে রেল-বিভাগের কে না চিনে? তিনি আজ সমগ্র আমেরিকায় সুপ্রসিদ্ধ। তিনি আমাকে প্রথম সাহায্য করেন মাত্র ৬৲ দিয়া। মৃত্যুকালে আমাদিগকে ১৫০,০০০৲ দিয়া গিয়াছেন। এই দুই দানের মধ্যে আমরা ইহাঁর নিকট ক্ষুদ্র বৃহৎ আরও অনেক সাহায্য পাইয়াছি।

 অনেকে বলিয়। থাকেন “টাস্কেজীর বরাত ভাল—তাই ১৫০,০০০৲ পাইয়াছে।” আমি তাঁহাদিগকে বলি “তাহা নহে—কপালের গুণে টাকা একবার আসিতে পারে, দুইবার আসিতে পারে। কিন্তু বার বার আসে না। স্থিরভাবে নিয়মিতরূপ কর্ম্ম করিয়া উন্নতি না দেখাইতে পারিলে সংসারের লোক মজে না।” হাণ্টিংডনের কথা বলিলেই বুঝা যাইবে। তিনি প্রথমে ৬৲ দিয়াই মনে করিয়াছিলেন—“টাস্কেজীওয়ালারা আর বেশী পাইবার যোগ্য নয়।” আমি তাঁহার নিকট এত কম কোন মতেই আশা করি নাই। যাহা হউক আমি তখনই স্থির করিলাম যে, আমাদের কার্য্যফলে ইহাঁকে খুসী করিবই, এবং তখন তিনি উদারতার সহিতই দান করিতে বাধ্য হইবেন। সত্যই তাহা ঘটিয়াছিল। তিনি ক্রমশঃ দেখিতে লাগিলেন যে, টাস্কেজীর কাজ কর্ম্মে উন্নতি হইতেছে, ইহার মধ্যে নিত্য নূতন ব্যবস্থা করা হইতেছে—ইহারা কোন এক জায়গায় বসিয়া নাই। ঠিক সেই রূপই তিনি তাঁহার দানের মাত্রা বাড়াইয়াছিলেন। এই অনুপাতে ৬৲ হইতে শেষ পর্য্যন্ত এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্য্যন্ত পাইয়াছি।

 একবার সাহস করিয়া বোষ্টন-নগরের ট্রিনিটি-ধর্ম্মমন্দিরের প্রচারক রেভারেণ্ড উইন্‌চেষ্টার ডোনাল্ড মহোদয়কে টাস্কেজীতে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলাম। তাঁহার নিকট ধর্ম্মোপদেশ পাইবার ইচ্ছায় এইরূপ করা হইয়াছিল। তাঁহার সঙ্গে লোক জন অনেক আসিবে বুঝিতে পারিয়াছিলাম। তাহা ছাড়া বিদ্যালয়ের মধ্যেই মহাসমারোহ পড়িয়া গেল। কাজেই আমাদের ক্ষুদ্র ধর্ম্মমন্দিরে বক্তৃতার স্থানাভাব বিবেচনা করিয়া সামিয়ানা খাটাইয়া একটা ঘর তৈয়ারী করা হইল। লতাপাতা ফুলপত্রে গৃহ সুসজ্জিত করাও হইল। বক্তৃতা আরম্ভ হইবার পরক্ষণ হইতেই মহা বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। ডোনাল্ড মহোদয় ভিজিতে লাগিলেন। আমাদের একজন আসিয়া তাঁহার মাথায় ছাতা ধরিল। অনেকক্ষণ পর বৃষ্টি থামিলে আবার বক্তৃতা হইল। শেষে সভা হইয়া গেলে পোষাক পরিবর্ত্তন করিতে করিতে ডোনাল্ড মহোদয় বলিলেন—“ওয়াশিংটন মহাশয় টাস্কেজীর যে বিরাট ব্যাপার দেখিতেছি, এখানে একটা বড় ধর্ম্মমন্দির থাকা আবশ্যক।”

 একথা অবশ্য প্রচারিত হইবার সময় ছিল না। মহা বিস্ময়ের কথা—পরদিন সকালেই ইটালী হইতে একখানা পত্র পাইলাম। দুই জন রমণী লিখিয়াছেন তাঁহারা আমাদের ধর্ম্মমন্দিরের জন্য সকল অর্থব্যয়ের ভার বহন করিবেন।

 সম্প্রতি য়্যাণ্ড্রু কার্ণেজি মহোদয়ের নিকট আমি ৬০,০০০৲ টাকা পাইয়াছি। এই টাকার দ্বারা গ্রন্থশালা নির্ম্মাণ করিতে হইবে—তাঁহার এইরূপ ইচ্ছা। এতদিন আমাদের গ্রন্থশালা ছিল না বলিলেই চলে। সেই পোড়োবাড়ীর এক কোণে কতকগুলি আলমারী ছিল। তাহাকেই গ্রন্থশালা বলিতাম। ইহার আয়তন অতি ক্ষুদ্র—১২ ফিট লম্বা এবং পাঁচ ফিট চৌড়া। আজি কার্ণেজির কৃপায় আমাদের এক প্রকাণ্ড গ্রন্থশালা নির্ম্মিত হইতে চলিয়াছে। কিন্তু কার্নেজি মহোদয়ের অনুগ্রহ পাইলাম কি করিয়া? একদিনে তিনি আমাদের প্রতি কৃপা করেন নাই। তাঁহার অনুগ্রহ লাভ করিবার জন্য আমাকে দশ বৎসর অপেক্ষা করিতে হইয়াছে। ১৮৯০ সালে আমি তাঁহার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করি। তখন তিনি আমার কার্য্যে কিছুই সহানুভূতি দেখাইলেন না। দশ বৎসর কঠোর পরিশ্রমের পর আমি তাঁহার নিকট নিম্নলিখিত পত্র লিখি:—

“টাস্কেজী আলাবামা,”
১৫ই ডিসেম্বর, ১৯০০।

সবিনয় নিবেদন,

 কয়েকদিন পূর্ব্বে আপনার ভবনে আমার সঙ্গে আপনার যে কথাবার্ত্তা হয়, তদনুসারে আপনার নিকট এই পত্র পাঠাইতেছি। আপনি আমাদের গ্রন্থশালার আবশ্যকতা বুঝিতে চাহিয়াছিলেন। এজন্য জানাইতেছি যে,—

১।  আমাদের বিদ্যালয়ে সম্প্রতি ১১০০ ছাত্র এবং ৮৬ জন শিক্ষক ও কর্ম্মচারী এই গ্রন্থশালা ব্যবহার করিবেন। অধিকন্তু শিক্ষক ও কর্ম্মচারিগণের পরিবারস্থ লোকজন এবং আমাদের বিদ্যালয়ের সমীপস্থ প্রায় ২০০ নিগ্রো পুরুষ ও রমণী এই গ্রন্থশালা হইতে উপকার লাভ করিতে পারিবেন।

২।  আমাদের এক্ষণে ১২,০০০ গ্রন্থ, সংবাদপত্র ইত্যাদি রহিয়াছে। এগুলি বন্ধুগণের দানে সংগৃহীত। স্থানাভাবে ইহাদিগকে রক্ষা করা যাইতেছে না। পাঠাগার না থাকায়ও গ্রন্থ-ব্যবহারের অসুবিধা ঘটিতেছে।

৩। আমাদের বিদ্যালয় হইতে গ্রাজুয়েট হইয়া অনেক ছাত্র বাহির হইয়াছেন। ইহাঁরা দক্ষিণ অঞ্চলের প্রত্যেক প্রদেশেই কর্ম্ম করিয়া থাকেন। গ্রন্থশালা প্রতিষ্ঠিত হইলে ইহাঁদের সাহায্যে সমগ্র নিগ্রোসমাজে সৎসাহিত্য প্রচারিত হইতে পারিবে।

৪। আমাদের প্রয়োজনীয় গৃহ-নির্ম্মাণ করিতে ৬০,০০০৲ টাকা লাগিবে। ইট গড়া, মিস্ত্রির কাজ, সূত্রধর ও কর্ম্মকারের কার্য্য ইত্যাদি গৃহ-নির্ম্মাণ বিষয়ক সকল ব্যাপারই আমাদের ছাত্রগণ স্বহস্তে নিষ্পন্ন করিবে।

৫।  সুতরাং আপনার দানে এক সঙ্গে তিন কার্য্য হইবে। প্রথমতঃ গ্রন্থশালা ত নির্ম্মিত হইবেই। দ্বিতীয়তঃ, ছাত্রেরা গৃহ নির্ম্মাণের সুযোগ পাইয়া কতকগুলি নূতন শিল্প শিখিয়া ফেলিবে। অধিকন্তু, এই কার্য্যে যোগদান করিয়া তাহারা যে পারিশ্রমিক পাইবে তাহার দ্বারা তাহাদের বিদ্যাশিক্ষার ব্যয় সংগ্রহ হইবে। এক দানে এত সুফল ফলিবার সুযোগ সাধারণতঃ উপস্থিত হয় না।

 অন্যান্য সংবাদ আবশ্যক হইলে পরে দিতে পারি।

ইতি নিবেদক— 
বুকার টি ওয়াশিংটন,
পরিচালক,
টাস্কেজী শিল্প-বিদ্যালয়।

ঠিকানা:— 
য়্যাণ্ড্রু কার্ণেজি
 ৫, ওয়েষ্ট ৫১নং ষ্ট্রীট,
 নিউইয়র্ক।

 যথা সময়ে উত্তর আসিল “আমি আপনার মহৎ উদ্দেশ্যে আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ করিতেছি। আপনার সৎকার্য্যে আমি যোগদান করিবার সুযোগ পাইয়া পুলকিত হইলাম। গৃহনির্ম্মাণ ব্যাপারে যে খরচ পড়িবে তাহার বিলগুলি আমার নিকট পাঠাইবেন। আমি ৬০,০০০৲ পর্যন্ত আপনার পাওনাদারদিগকে টাকা শোধ করিয়া দিব।”

 এতক্ষণ বড় বড় দানের কথাই বলিলাম। কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাহায্যের মাহাত্ম্য কম নয়। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত লোকসমাজ হইতে ছোট ছোট দান টাস্কেজীর জন্য আমি অসংখ্য পাইয়াছি। এই ক্ষুদ্র দানগুলির প্রভাবেই টাস্কেজীর নাম সর্ব্বত্র সুপ্রচারিত হইয়াছে। এই সমুদয়ের সাহায্যেই সহস্র সহস্র নরনারীর সহানুভূতি এবং অনুরাগ আমার শিক্ষাসমিতির প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছে। আমার মতে, এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুষ্টিলাভেই অনুষ্ঠানগুলি ‘জাতীয়’ এবং সর্ব্বজনপ্রিয় হইয়া উঠে। ইহার দ্বারাই প্রতিষ্ঠান ও কর্ম্মকেন্দ্রগুলি গণশক্তির উপর দাঁড়াইয়া যায়—দেশের জনসাধারণ এইগুলিকে আপনার নিজের সম্পত্তি বলিয়া গৌরব অনুভব করিতে পারে।

 দরিদ্র লোকেরা এক পয়সা, দুই আনা, চৌদ্দপয়সা, বা একটা জামা, দুটা আলু, একটা শূকর বা খানিকটা চিনি ও নুন মাত্র দান করিতে পারে সত্য। কিন্তু এইগুলির সমবায়ে কম অর্থ সঞ্চিত হয় না। অধিকন্তু, এই নগন্য দানের অন্যবিধ মূল্যও অসীম। কারণ ইহাতে নিরন্ন, বিদ্যাহীন, অশিক্ষিত, অর্দ্ধশিক্ষিত অথবা নিতান্ত দরিদ্র লোকের পূর্ণ হৃদয়ই থাকে। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানের সঙ্গে আমরা অনেকগুলি হৃদয় ও প্রাণ আমাদের কর্ম্মকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লাভ করি। এতগুলি হৃদয়ের রাজা হইতে পারা কি কম সৌভাগ্যের কথা? এই মূল্যবান্ হৃদয়গুলিকে ভবিষ্যতে সৎকর্ম্মের জন্য চালিত করিতে পারিলে কি সমাজের কম মঙ্গল সাধিত হইতে পারে?

 এই জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানগুলিকে আমি চিরকাল ভক্তিভাবে গ্রহণ করিয়া আসিয়াছি। এই গুলিকেই আমি টাস্কেজী-বিদ্যালয়ের ভিত্তি বিবেচনা করিয়া থাকি। ইহাদের সাহায্যে ‘চটক্’ দেখাইবার উপযুক্ত, বা লোক দেখান বড় কিছু গৃহ বা আসবাব ইত্যাদি সৃষ্টি করিতে পারি নাই সত্য। কিন্তু জন সমাজের অগোচরে থাকিয়া,—আমাদের অন্তর্য্যামীভাবে জনসাধারণের এই হৃদয়বত্তা ও এই সহানুভূতি আমাদের বিদ্যালয়ের জীবনীশক্তিরূপে কর্ম্ম করিতেছে। ইহারই ফলে টাস্কেজী-বিদ্যালয়ের শিকড়গুলি আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গমহলের অন্তরে অন্তরে প্রবিষ্ট হইয়াছে।

 এই ক্ষুদ্র দান উপলক্ষ্যে আমার আর একটা কথা বলাও আবশ্যক। আমাদের বিদ্যালয় হইতে যাহারা বাহির হইয়া গিয়াছে তাহারা সময়ে সময়ে অথবা নিয়মিতরূপে আমাদিগকে সাহায্য করিয়া থাকে। আমাদের পুরাতন ছাত্রেরা এইরূপে আমাদের সঙ্গে জীবনব্যাপী সম্বন্ধ রক্ষা করিয়া চলে।

 প্রথম তিন বৎসরের কার্য্যফলে আমরা আলাবামা প্রদেশের রাষ্ট্র হইতে বর্দ্ধিত হারে সাহায্য পাইয়া আসিতেছি। প্রথমে আমরা ৬০০০৲ টাকা মাত্র বার্ষিক পাইতাম। ইহাঁরা এক্ষণে ৯,০০০৲ করিয়া দিতে লাগিলেন। তাহার পরে ইহাঁরা ১৩,৫০০৲ করিয়া দিয়া আসিতেছেন।

 আর একটা মোটা সাহায্য আমরা “শ্লেটার ভাণ্ডার” হইতে পাইয়া আসিতেছি। প্রথম প্রথম এই ভাণ্ডারের কর্মকর্ত্তারা ৩০০০৲ করিয়া দিতেন—ক্রমশঃ আমাদের কাজে সন্তুষ্ট হইয়া দানের হার বাড়াইয়া দিয়াছিলেন। সম্প্রতি ৩৩,০০০৲ করিয়া পাইতেছি।

 তৃতীয়তঃ, “পীবতি-ভাণ্ডার” হইতেও আমরা সাহায্য পাইয়া থাকি। প্রথমতঃ ১৫০০৲ পাইতাম—এক্ষণে বার্ষিক ৪৫০০৲ পাইতেছি।

 এই দুই ধন-ভাণ্ডার হইতে সাহায্য পাইবার উপলক্ষ্যে আমি কয়েকজন সহৃদয় শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির পরিচয় পাইয়াছি। ইহাঁরা বড় বড় ব্যবসায়ের ধুরন্ধর অথবা প্রকাণ্ড কর্ম্মকেন্দ্রসমূহের পরিচালক। এত দায়িত্বপূর্ণ কর্ম্মে লিপ্ত থাকিয়াও ইহাঁরা কি দরিদ্রের ক্রন্দনে কর্ণপাত করিতে সময় পান! নিগ্রোসমাজের হিতাকাঙ্ক্ষায় ইহাঁরা আমার সঙ্গে কত সময়ে কত আলোচনা করিয়াছেন!