নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/ত্রয়োদশ অধ্যায়
ত্রয়োদশ অধ্যায়
২০০০ মাইল দূরে ৫ মিনিটের বক্তৃতা
পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে ‘পোর্টার হল’ নির্ম্মিত হইবার পর টাস্কেজী বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিবার জন্য অনেক ছাত্র ও ছাত্রী দরখাস্ত করিতে লাগিল। এই সকল নূতন ছাত্রদের জন্য ‘আলাবামা-ভবন’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হইলাম। কিন্তু নিঃস্ব ছাত্রও অনেক ভর্ত্তি হইতে চাহিল। তাহারা নিজ খরচের কিয়দংশও ঘর হইতে আনিতে পারিত না। এজন্য আমরা ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তিন বৎসরের মধ্যেই একটা নৈশবিভাগ খুলিতে বাধ্য হইলাম।
আমি ইতিপূর্ব্বে হ্যাম্পটনে একটা নৈশবিদ্যালয় খুলিয়া আসিয়াছি। সেই নিয়মেই টাস্কেজীতেও নৈশশিক্ষা প্রবর্ত্তিত হইল। ১২ জন ছাত্র লইয়া কার্য্য আরম্ভ করা গেল। তাহাদিগকে দিনে ১০ ঘণ্টা করিয়া আমাদের কোন কৃষিকার্য্যে বা শিল্পে খাটিতে হইত। রাত্রিকালে মাত্র দুই ঘণ্টা করিয়া ইহাদিগকে পড়ান হইত। কাজের বেতনস্বরূপ খাওয়া খরচের অতিরিক্ত কিছু নগদ টাকা তাহাদিগকে দিতাম। এই টাকা তাহারা বিদ্যালয়ে জমা রাখিত। এইরূপে দুইবৎসর নৈশবিদ্যালয়ে থাকিবার পর তাহাদিগকে দিবাবিদ্যালয়ে ভর্ত্তি করা যাইত। তখন তাহাদিগের পুঁজি টাকা হইতে খাওয়া খরচ চলিত। এই উপায়ে নৈশবিদ্যালয়ের কার্য্য গত ১৫ বৎসর চলিয়াছে। আজ ইহার ছাত্রসংখ্যা ৪৫৭।
আমি নৈশবিদ্যালয়ের খুব পক্ষপাতী। কারণ ইহার নিয়মে ছাত্রের অগ্নি-পরীক্ষা হইয়া যায়। বিদ্যাশিক্ষার জন্য আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা না থাকিলে কেহ এত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করিয়া এইরূপে জীবন চালাইতে পারে না।
দিবা-বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হইবার পরও এই ছাত্রদিগকে কোন ব্যবসায়ে লাগাইয়া রাখিতাম। সপ্তাহে অন্ততঃ দুই দিন তাহাদিগকে কাজ করিতে হইত। সপ্তাহের অপর ৪ দিন তাহারা সাধারণ ছাত্রের ন্যায় লেখাপড়া শিখিত। তাহা ছাড়া গরমের ছুটির সময়ে তিন মাস পুরাপুরি তাহাদিগকে খাটিতে হইত। এইরূপে নৈশবিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া এবং পরে দিবাবিদ্যালয়ের শিক্ষা পাইয়া অনেক নিগ্রো পুরুষ ও রমণী ‘মানুষ’ হইয়া গিয়াছে। আজ নিগ্রোসমাজে বহু লব্ধপ্রতিষ্ঠ শিল্পী ও ব্যবসায়ী দেখিতে পাই। তাঁহাদের অনেকেই এই নৈশবিদ্যালয়ের অগ্নি-পরীক্ষার ভিতর দিয়া জীবন আরম্ভ করিয়াছেন। আমাদের নৈশবিদ্যালয়ে জীবন যাপন করিলে কেহই ভবিষ্যতে কর্ম্মঠ চাষী বা কারিগর না হইয়া যায় না।
কৃষি শিল্প ব্যবসায়ের কথা এত বলিতেছি! কেহ যেন না ভাবেন যে আমরা আধ্যাত্মিক বিষয়ে নিতান্ত অমনোযোগী। খৃষ্ট ধর্ম্মের প্রচার টাস্কেজীতে যথেষ্টই হইয়া থাকে। আমরা কোন দলের বা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নহি—কিন্তু সাধারণ ভাবে খৃষ্টমত নানা উপায়ে আমাদের শিক্ষালয়ে প্রচারিত হইয়া থাকে। আমাদের ধর্ম্ম-বক্তৃতা, ধর্ম্মসভা, রবিবারের বিদ্যালয়, খৃষ্টপ্রচারসমিতি, খৃষ্টান যুবক সমিতি, ইত্যাদি নানা অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই ইহার প্রমাণ।
অনেকেই আমাকে আমার বাগ্মিতার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। আমি কি উপায়ে বক্তৃতা দিতে শিখিলাম কেহ কেহ জানিতে চাহেন। সত্য কথা, আমি বক্তৃতা করিয়া জীবন যাপন করিব উদ্দেশ্য আমার কোন দিনই ছিল না। আমার জীবনের সাধ—কার্য্য, কথা নহে। কথা বলিয়া কর্ম্মের প্রচার করা আপক্ষা নিজে কর্ম্ম করিয়া প্রয়োজন হইলে অন্যকে তাহা প্রচারের ভার দেওয়া—এই রূপই আমার ইচ্ছা চিরকাল রহিয়াছে।
পূর্ব্বেই বলিয়াছি আমার গুরুদেব আর্মষ্ট্রঙ্গের সঙ্গে আমি উত্তর অঞ্চলের ইয়াঙ্কি মহলে টাস্কেজী বিদ্যালয়ের “আলাবামা ভবনে”র জন্য প্রচারকার্য্য করিতে গিয়াছিলাম। এই সূত্রে সর্ব্বত্র আমার খ্যাতি রটে—আমার বক্তৃতা করিবার ক্ষমতা দেখিয়া লোকেরা আনন্দিত হয়।
যুক্ত-রাষ্ট্রের জাতীয়শিক্ষাপরিষদের সভাপতি অনারেবল শ্রীযুক্ত টমাস বিক্নেল মহোদয় আমার কোন বক্তৃতা শুনিয়াছিলেন। তাহার কিছুদিন পরেই তিনি আমাকে উইস্কন্সিন প্রদেশের ম্যাডিসন-নগরে একটা বক্তৃতা দিতে আহ্বান করেন। সেই শিক্ষাপরিষদের এক অধিবেশনে আমাকে বক্তৃতা দিতে হইল। প্রায় ৪০০০ লোক উপস্থিত ছিল। আলাবামা প্রদেশেরও কোন কোন শ্বেতাঙ্গ, এমনকি টাস্কেজী নগরেরও কেহ কেহ সভায় আসিয়াছিলেন। এই শ্বেতাঙ্গেরা বক্তৃতার শেষে আমাকে বলিলেন “ওয়াশিংটন মহাশয়, আপনার উদারতা দেখিয়া আমরা বড়ই প্রীত হইয়াছি। ভাবিয়াছিলাম, আপনি উত্তর অঞ্চলে আদর আপ্যায়ন পাইয়া আমাদের দক্ষিণ অঞ্চলের শ্বেতাঙ্গদিগকে যার পর নাই গালি দিবেন। কিন্তু আপনার বক্তৃতায় বিদ্বেষের লেশ মাত্র নাই। আপনার চরিত্রবত্তায় আমরা অনেক শিক্ষা পাইলাম।”
আমি দক্ষিণ অঞ্চলের শ্বেতাঙ্গদিগকে তিরস্কার করিব কেন? আমি যে তাঁহাদিগের নিকট সত্য সত্যই ঋণী। আমার বক্তৃতার সারমর্ম্ম একটি শ্বেতাঙ্গ রমণী কোন সংবাদ পত্রে পাঠাইয়াছিলেন। তিনি প্রকাশ করিয়াছেন “ওয়াশিংটনের বক্তৃতা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী এবং উদারতার পরিচায়ক। তিনি দক্ষিণ প্রান্তের শ্বেতাঙ্গদিগকে কিছুমাত্র গালি দেন নাই—বরং টাস্কেজী বিদ্যালয়ের পক্ষ হইতে তাঁহাদিগকে কৃতজ্ঞতা জানাইয়াছেন।”
আমার এই ম্যাডিসন বক্তৃতায়ই সর্ব্বপ্রথম কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ সমস্যার আলোচনা করি। ইহার পূর্ব্বে এ সকল কথা কোন প্রকাশ্য সভায় কখনও তুলি নাই। শিক্ষাবিষয়ক বক্তৃতাই এতদিন দিয়া আসিয়াছি, এবং টাস্কেজী বিদ্যালয়ের কার্য্যপ্রণালীই সকলকে জানাইয়া আসিয়াছি। এইবার সত্যসত্যই রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে যোগ দিলাম। আমার আলোচনার রীতি দেখিয়া প্রায় সকলেই খুসী হইয়াছিলেন। আমার রাষ্ট্রীয় মতগুলি প্রচারিত হইলে জাতি-বিদ্বেষ অনেকটা কমিবার সম্ভাবনা—কেহ কেহ ইহাও বুঝিলেন।
আমি জানি, গালি দিয়া কখনও কাহাকে ভাল করা যায় না, অথবা তাহার চরিত্র পরিবর্ত্তন করা যায় না। বরং তাহারা যতটুকু প্রশংসাযোগ্য কর্ম্ম করিয়াছে সেই টুকুর জন্য সর্ব্বদা কৃতজ্ঞ থাকাই উচিত। এজন্য উত্তর অঞ্চলে বক্তৃতা করিতে যাইয়া আমি কখনই দক্ষিণ অঞ্চলের নিন্দা করি নাই। আমি দক্ষিণ অঞ্চলের লোকদিগকে মুখের উপর যে সকল কথা বলিতে না পারি সে কথা তাহাদের পশ্চাতে আমি কখনই বলিতে ইচ্ছা করিতাম না। অমি সরলতা ভালবাসি।
আমি অবশ্য ন্যায্য তিরস্কার করিতেও ছাড়ি না। যখন সত্যসত্যই বুঝি যে শ্বেতাঙ্গেরা অন্যায় করিতেছে তাহা আমি তাহাদিগকে সাম্না সাম্নি বলিতে ভয় পাই না। বরং আমি দেখিয়াছি, যে, অনেক লোক এইরূপ স্পষ্টবক্তাদিগকে ভালবাসে। নিরপেক্ষ ও স্বাধীন সমালোচনার প্রভাব অস্বীকার করা কঠিন। আমার সমালোচনা অনুসারে দক্ষিণ প্রান্তের লোকেরা কার্য্য আরম্ভ করিতে অনিচ্ছুক থাকিতে পারেন। কিন্তু স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারিলে আমার কথাগুলি এবং যুক্তিগুলি তাঁহারা মানিয়া লইতে বাধ্য।
এজন্য আমি নিয়ম করিয়াছি যে, দক্ষিণের দোষগুলি আমি দক্ষিণবাসীদিগকেই বলিব। তাহাদের দোষ উত্তর অঞ্চলে রটাইয়া লাভ কি? দক্ষিণের লোকজন লইয়াই আমাদের কারবার। সুতরাং তাহাদের মতিগতি পরিবর্ত্তন করিবার জন্য তাহাদের সঙ্গেই সর্ব্বদা বুঝাপড়া, বাক্বিতণ্ডা ইত্যাদি হওয়া আবশ্যক।
ম্যাডিসনের বক্তৃতায় আমার প্রধান কথা ছিল—“নিগ্রোয় ও শ্বেতাঙ্গে সদ্ভাব বৃদ্ধি করা অত্যন্ত আবশ্যক। যত উপায়ে সম্ভব এই দুই সমাজে বন্ধুত্বের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত করিতেই হইবে।” নিগ্রোদিগের কর্ত্তব্যও আমি বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। আমার মতে কেবল ক্ষমতা বা অধিকার পাইবার জন্য চেষ্টা করিলে চলিবে না। নিগ্রোরা সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিতে স্বার্থপর ভাবে কেবলমাত্র নিজ সমাজের কথা ভাবিলেই চলিবে না। তাহাদিগকে নিরপেক্ষতা এবং ‘জাতীয়তা’ অর্জ্জন করিতে হইবে। সমগ্র আমেরিকার স্বার্থ তাহাদিগকে বিচার করিয়া দেখিতে হইবে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয়’ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গ বা কেবলমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের কথা ভাবিলে চলিবে না। এক সঙ্গে উভয় সম্প্রদায়ের কথা যিনি ভাবিতে অক্ষম তিনি তাঁহার কর্ত্তব্য পালনের অযোগ্য। এই সকল কথা বলিয়া আমি আমার স্বজাতিগণকে তাহাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছি।
এই গেল আমার বক্তৃতার রাষ্ট্রীয় অংশ। সঙ্গে সঙ্গে নিগ্রোসমাজের উন্নতির উপায়ও আলোচনা করিয়াছিলাম। আমি বলিলাম আমাদের উন্নতির প্রধান উপায় দুইটি—প্রথম শিক্ষা, দ্বিতীয় শিল্প, কৃষি ও ব্যবসায়। আমার বক্তৃতার খানিকটা নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি,—“ভাই নিগ্রো, মনে রাখিও তুমি আমেরিকা-জননীর কনিষ্ঠ সন্তান। মনে রাখিও তোমাকে শ্বেতাঙ্গ ভ্রাতার সমান হইবার জন্য বর্ত্তমানে কঠোর সাধনায় ব্রতী হইতে হইবে। তোমার বিদ্যা বুদ্ধি মার্জ্জিত হওয়া আবশ্যক—তোমার চরিত্র গঠিত হওয়া আবশ্যক। নানা সদ্গুণ অর্জ্জন করিয়া তুমি আমেরিকার জনসমাজের অত্যাবশ্যক অঙ্গে পরিণত হও—দেখিবে কেহ তোমাকে এই স্থান হইতে বিতাড়িত করিতে পারিবে না। দেখিবে কেহই তোমাকে অবনত পদদলিত করিয়া রাখিতে পারিবে না।
আমি বলিতেছি তোমার চরিত্র গঠিত হইয়া গেলে তুমি অসাধ্য সাধন করিতে পারিবে। তুমি নানা উপায়ে তোমার ক্ষমতা দেখাইতে থাক—শ্বেতাঙ্গ তোমাকে সম্মান করিতে বাধ্য হইবে। তোমার কার্য্যকরী শক্তির পরিচয় দাও তোমাকে ছাড়িয়া থাকিতে শ্বেতাঙ্গের কষ্ট হইবে। তুমি যে আমেরিকার অভাব মোচন করিতে পার, তুমি যে আমেরিকাকে ধনে ধান্যে ভরিয়া ফেলিতে পার—তাহা শ্বেতাঙ্গকে বুঝাইবার জন্য কি করিতেছ? যখনই তাহারা বুঝিবে যে, তোমাদের বিদ্যায় বুদ্ধিতে ও চরিত্রে আমেরিকার ঐশ্বর্য্য বাড়িতেছে এবং আমেরিকা জগতে উন্নত হইতেছে তখনই তাহারা তোমাদিগকে মাথায় করিয়া রাখিবে। আমি বলিতেছি তোমার কাল চামড়া ও তোমার বাপদাদার গোলামী তোমার ভবিষ্যৎ সম্মান লাভের কিছুমাত্র বিঘ্ন হইবে না।
আমি জানি একজন কৃষ্ণাঙ্গ নিগ্রো নিজ বিদ্যাবলে তিন বিঘা জমি চষিয়া ৬৬ বুশেল শকরকন্দ আলু পাইয়াছিলেন। অথচ তাঁহার পল্লীর অন্যান্য শ্বেতকায় চাষীরা ৪ বুশেল মাত্র পাইত। তিনি উন্নত কৃষিবিজ্ঞানে পণ্ডিত ছিলেন এবং নূতন কৃষি-প্রণালী জানিতেন—শ্বেতাঙ্গেরা জানিত না। কাজেই পল্লীসমাজে এই কৃষ্ণাঙ্গ নিগ্রো সকলেরই পূজার পাত্র হইয়া পড়িলেন। বুঝিয়া দেখ—কেন? শ্বেতাঙ্গেরা বুঝিত যে, এই ব্যক্তি সমাজের একটা সমৃদ্ধির উপায় বাহির করিয়া ফেলিয়াছেন। অতএব তোমরা কৃষিকর্ম্মে অভ্যস্ত হইতে থাক, মনোযোগের সহিত শিল্প কর্ম্মে লাগিয়া যাও, এবং এইরূপ কার্য্য করিতে করিতেই চরিত্র ও বুদ্ধি গঠিত কর, তোমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হইবে।”
আমার এই সকল মত আমি আজীবন পোষণ করিয়াছি। এইবার প্রথম প্রচার করিলাম। পরেও আমি কখন এইমত পরিবর্ত্তন করি নাই।
যৌবনকালে আমি নিগ্রোজাতির নিপীড়নকারী ব্যক্তিদিগকে বড়ই ঘৃণা করিতাম। আজকাল ইহাদিগকে আর ঘৃণা বা নিন্দা করি না—ইহাদিগকে দেখিয়া দুঃখিত হই মাত্র।
অন্যলোককে দাবিয়া রাখিতে পারিলে অনেকে খুসী হয়। নিজের ক্ষমতার বড়াই করিবার জন্য বহু ব্যক্তি অপর ব্যক্তি বা জাতিকে চাপিয়া রাখিতে চাহে। অপর লোকের যশোলাভে ও উন্নতিতে ইহাদের বুক চড় চড় করে এবং চোখ টাটায়। কিন্তু ইহারা কি মুর্খ! ইহারা একসঙ্গে সঙ্কীর্ণতা এবং বুদ্ধিহীনতার পরিচয় দিতেছে। এইরূপ স্বার্থপর, পরশ্রীকাতর, চরিত্রহীন লোকদিগকে উপলক্ষ্য করিয়া আমি অনেকসময়ে স্বগত বলিয়া থাকি,—
“ওহে ক্ষুদ্রচেতা পরপীড়নকারী ব্যক্তিগণ, তোমরা কি মনে করিয়াছ যে, যে সকল সুযোগ পাইয়া তোমরা খানিকটা উন্নত হইয়াছ, সেই সকল সুযোগ সংসারের অন্য কোন লোক কখনই পাইবে না? তুমি আমাকে বা উহাকে বা দশজন ব্যক্তিকে চাপিয়া রাখিয়া কি করিবে? তুমি কি সংসারের সকল কর্ম্মক্ষেত্রগুলিই একচেটিয়া করিয়া রাখিয়াছ? দেশের সর্ব্বত্রই কি তুমি একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করিতে পারিয়াছ? অত ক্ষমতা তোমার নাই। এই বিশাল মানবজগতের মধ্যে তুমি এক নগণ্য কীট মাত্র। বিরাট কর্ম্মক্ষেত্রের এক কণামাত্রে দাঁড়াইয়া তুমি আস্ফালন করিতেছ!
বিশ্বে প্রতিদিন কত নূতন নূতন শক্তির সৃষ্টি হইতেছে—কত নূতন নূতন সুযোগ পাইয়া কত নূতন নূতন কর্ম্মবীরের অভ্যুদয় হইতেছে—জগৎ প্রতিদিন বাড়িয়াই চলিয়াছে। এই নিত্যনূতন বিকাশকে রুদ্ধ করিবার ক্ষমতা কাহারও নাই। যে নিয়মে তুমি বড় হইয়াছ, ঠিক সেই নিয়মেই সংসারের লক্ষ লক্ষ নরনারী বড় হইতেছে ও হইবে। তাহাদের উন্নতি দেখিয়া তোমার কষ্ট হয়—তুমি নির্ব্বোধ। তুমি তাহাদিগকে তোমার সমান যশস্বী হইতে দিতে চাহ না—তুমি মুর্খ। ঐ দেখ, তোমার অজ্ঞাতসারে তোমাকে অবজ্ঞা করিয়াই নূতন নূতন কর্ম্মী ও চিন্তাবীর জগতে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতেছেন। চিরউন্নতিশীল সংসারের প্রবল প্রবাহের মধ্যে তোমার মত কত কীট তৃণের ন্যায় অহরহ ভাসিয়া যাইতেছে।
যদি চক্ষু থাকিত, তাহা হইলে দেখিতে পারিতে। যদি বুদ্ধি থাকিত, তাহা হইলে লজ্জিত হইতে। যদি মানুষ হইতে, তাহা হইলে নিজের অহঙ্কার খর্ব্ব করিতে শিখিতে, এবং নিজ জীবনকে সমগ্র সমাজের উন্নতিবিধানের অন্যতম ক্ষুদ্র যন্ত্রস্বরূপ বিবেচনা করিতে পারিতে; তখন আপামর জনসাধারণের পরিপূর্ণ বিকাশলাভের সাহায্য করিতে যত্নবান হইতে। যদি ধর্ম্মজ্ঞান থাকিত, তাহা হইলে অপরকে তোমা অপেক্ষা প্রসিদ্ধ করিবার সুযোগ সৃষ্টি পূর্ব্বক জীবন ধন্য করিতে উৎসাহী হইতে।”
আমার ম্যাডিসনের বক্তৃতায় উত্তর মহলে একটা হৈ চৈ পড়িয়া গেল। এই তোলাপাড়ার হুজুগে বহুস্থান হইতে বক্তৃতা করিবার জন্য নিমন্ত্রণ আসিতে লাগিল। আমি বোষ্টননগরে থাকিয়া ইয়াঙ্কি মহলের নানা স্থানে আমার মত প্রচার করিবার সুযোগ পাইলাম। কিন্তু আমার বিশেষ ইচ্ছা—দক্ষিণ প্রান্তে যাইয়া এই কথাগুলি প্রকাশ্যসভায় বলিয়া আসি। আমি এজন্য সুযোগ খুঁজিতে লাগিলাম। সৌভাগ্যক্রমে একটা সুবিধা পাওয়া গেল।
১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে জর্জ্জিয়া প্রদেশের আট্লাণ্টা নগরে একটা বিরাট খৃষ্টান মহাসভার আয়োজন হইতেছিল। এই সময়ে বোষ্টনেও আমার অনেক কাজ ছিল। তথাপি জর্জিয়ার কর্ম্মকর্ত্তাদিগের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিলাম। বোষ্টন হইতে আট্লাণ্টা ২০০০ মাইল। এতদূর যাইতে হইবে। অথচ বক্তৃতা করিবার মাত্র ৩০ মিনিট পূর্ব্বে সভাস্থলে আমার গাড়ী পৌঁছিবে। এখানে ৫ মিনিট মাত্র বক্তৃতা করিতে সময় পাইব। আলাণ্টায় সর্ব্বসমেত একঘণ্টা মাত্র থাকিয়া পুনরায় আমাকে বোষ্টনে আসিতে হইবে। আমার কাজের ভিড় এত। যাহা হউক দক্ষিণ অঞ্চলের এই মহাসম্মিলনে বক্তৃতা করিবার সুযোগ ছাড়িলাম না।
এখানে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ উভয় সমাজেরই গণ্যমান্য লোক উপস্থিত ছিলেন। সর্ব্বসমেত ২০০০ লোকের সমাগম হইয়াছিল। আমার শিক্ষাপ্রণালীর বিবরণ দিলাম—শিল্পশিক্ষানীতি বুঝাইয়া দিলাম এতদ্ব্যতীত নিগ্রোসমাজের কর্ত্তব্য ও দায়িত্বের কথা বলিলাম। অধিকন্তু শ্বেতাঙ্গদিগের যথোচিত সমালোচনা করিতেও ছাড়িলাম না। আট্লাণ্টার সংবাদপত্রগুলি আমার বক্তৃতার খুব তারিফ করিতে লাগিল। আমার কার্য্যোদ্ধার হইয়া গেল—দক্ষিণ প্রান্তের শ্বেতাঙ্গ মহলে আমি সুপ্রতিষ্ঠিত হইলাম।
ইহার পর হইতে কৃষ্ণাঙ্গ ও শেতাঙ্গ সকলেই আমার বক্তৃতা শুনিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতেন। টাস্কেজীর কাজকর্ম্ম হইতে বিদায় লইয়া আমাকে এই বক্তৃতাকার্য্যে লাগিয়া থাকিতে হইত। উত্তর অঞ্চলে আমি টাস্কেজীর জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিতাম। নিগ্রোমহলে আমার স্বজাতির বর্ত্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ উন্নতির উপায় আলোচনা করিতাম।
এইবার আমি আমার জীবনের একটা বিশেষ স্মরণীয় দিনের উল্লেখ করিব। সেই দিন হইতে আমি সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে সুপরিচিত হইয়াছি। তখন হইতে আমার যশ কেবল মাত্র নিগ্রোসমাজে অথবা আমার সাহায্যকারী শ্বেতাঙ্গ বন্ধু মহলেই আবদ্ধ থাকিল না। আমার নাম জেলা হইতে জেলায়, প্রদেশ হইতে প্রদেশে সর্ব্বত্র ছড়াইয়া পড়িল। আমি কোন প্রদেশ বা সম্প্রদায়ের কর্ম্মবীর মাত্র থাকিলাম না। সকল প্রদেশের লোকই আমাকে সমগ্র ‘জাতির’ অন্যতম নেতারূপে গ্রহণ করিল। আমেরিকা ভূখণ্ডের একজন জন-নায়ক বা কর্ম্মীপুরুষ অথবা একজন যুক্তরাষ্ট্র-বীররূপে আমি সম্মান পাইতে লাগিলাম।
১৮৯৫ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর আমার জীবনের এই স্মরণীয় দিন। এদিন আটলাণ্টা নগরে এক বিপুল প্রদর্শনী খোলা হয়। এই প্রদর্শনীতে আমি আমার শিক্ষানীতি এবং রাষ্ট্রীয় মত প্রচার করিবার জন্য বক্তৃতা করিতে সুযোগ পাই।
এই প্রদর্শনীর বিষয় সবিশেষ বলা আবশ্যক। আটলাণ্টার খৃষ্টান মহাসভায় বক্তৃতা করার ফলে ঐ অঞ্চলে আমার খ্যাতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাহার কিছু কাল পরে ১৮৯৫ সালে ঐ নগরের কয়েকজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক আমার নিকট টেলিগ্রাম করেন, “আট্লাণ্টায় এক বিরাট প্রদর্শনী ও সম্মিলনের আয়োজন হইতেছে। এইজন্য যুক্তরাষ্ট্রের ধনসচিবের নিকট হইতে অর্থসাহায্য আবশ্যক। আমাদের নগরবাসী কয়েকজন এই কার্য্য উপলক্ষ্যে ওয়াশিংটনের যুক্তদরবারে যাইয়া আবেদন করিবেন। ‘জাতীয়’-মহাসমিতি কংগ্রেসের সম্মুখে ইহাঁরা আমাদের অভাব জানাইবেন। আপনাকে এই প্রতিনিধিগণের সঙ্গে আমাদের পক্ষ হইতে যোগদান করিতে হইবে।”
জর্জ্জিয়া প্রদেশের ২৩জন বিচক্ষণ শ্বেতাঙ্গ এই উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্ব্বাচিত হইয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত এই প্রতিনিধি সভায় তিনজন নিগ্রোর স্থানও ছিল। আমি তাঁহাদের একজন হইলাম। যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয়’-দরবারে তিন চারিজন বক্তৃতা করিলেন—আমাকেও বক্তৃতা করিতে হইল। আমি আটলাণ্টার পক্ষ হইতে সেই জাতীয়-মহাসমিতিতে নিবেদন করিলাম, “দক্ষিণপ্রান্তের শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গসমাজে ভ্রাতৃভাব বর্দ্ধন করা অত্যাবশ্যক। এজন্য আপনারা বদ্ধপরিকর হউন। শীঘ্রই ঐ অঞ্চলের সর্ব্ববিধ শ্রীবৃদ্ধি সাধনের ব্যবস্থা করুন। কৃষি, শিল্প, ও ব্যবসায়ের দ্বারা উহাদের আর্থিক ও মানসিক উন্নতির সাহায্য করিলে এই কার্য্য সহজেই সিদ্ধ হইবে। সম্প্রতি আটলাণ্টার প্রদর্শনী উপলক্ষে মহাসুযোগ উপস্থিত। ইহাতে গোলামীনিবারণের যুগ হইতে বিগত বিশবৎসরের মধ্যে উভয়জাতির উন্নতির পরিচয় পাওয়া যাইবে। এই প্রদর্শনীর দ্বারাই আবার উভয়ের ভবিষ্যৎ উন্নতির পথও উন্মুক্ত হইয়া পড়িবে।”
আমি প্রায় ১৫।২০ মিনিট কংগ্রেসের সম্মুখে বক্তৃতা করিলাম। আমার বক্তব্যের শেষ অংশ এই—“নিগ্রোরা রাষ্ট্রীয় অধিকার পাইতেছে সত্য; কিন্তু কেবল মাত্র ভোট দিয়া প্রতিনিধি নির্ব্বাচনের ক্ষমতা থাকিলে কি হইবে? তাহাদের ধনসম্পত্তি নাই। এক্ষণে তাহাদের সম্পত্তির মালিক হওয়া আবশ্যক। এজন্য তাহাদের কৃষিকর্ম্মে শিল্পে ও ব্যবসায়ে নিযুক্ত হওয়া কর্ত্তব্য। এই সকল বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাহাদের সহায় হইতে পারেন। তাহাদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করিলে অচিরেই তাহাদের চরিত্র গঠিত হইবে—এবং তাহারা বিষয় সম্পত্তির অধিকারী হইয়া যথার্থ দায়িত্বের সহিত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করিতে পারিবে। আটলাণ্টার সম্মিলনে কংগ্রেস এক মহাসুযোগ পাইবেন। উত্তরপ্রান্তে ও দক্ষিণপ্রান্তে সন্ধি স্থাপিত হইবার পর কংগ্রেস এরূপ সুযোগ আর পান নাই। তাঁহারা ইচ্ছা করিলে এইবার আমেরিকার নবজীবন প্রবর্ত্তনের সূত্রপাত করিতে পারেন।”
আমার কথা বলা হইয়া গেলে আমার প্রতিনিধি বন্ধুগণ আমার খুব সুখ্যাতি করিলেন। কংগ্রেসের সভ্য মহোদয়গণও আমার প্রশংসা করিলেন। কংগ্রেসের মহাসভা হইতে আমাদের আবেদন মঞ্জুর করা হইল। আটলাণ্টা প্রদর্শনীর ব্যয় যুক্ত-রাষ্ট্রের ‘জাতীয়’ কোষাগার হইতে পাওয়া যাইবে—আশা পাইলাম।
তারপর প্রদর্শনী সাজাইবার ব্যবস্থা চলিতে লাগিল। কর্ম্মকর্ত্তারা স্থির করিলেন নিগ্রোসমাজের জন্য বিশেষ এক বিভাগ খোলা আবশ্যক। স্বাধীনতা লাভের পর ২০ বৎসরের মধ্যে নিগ্রোরা শিল্পে, কৃষিকর্ম্মে, শিক্ষায়, নানা কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছে। সেই গুলি একস্থানে জমা করিয়া দেখান কর্ত্তব্য। আটলাণ্টার প্রতি প্রদর্শনীতে তাহার জন্য স্বতন্ত্র আয়োজন করিবার প্রস্তাব হইল। নিগ্রোবিভাগের ঘরবাড়ী সাজসজ্জা আসবাব পত্র সবই নিগ্রোরা নিজেদের দ্বারাই করিয়া লইবে—ইহাও স্থির হইয়া গেল।
প্রদর্শনীর নিগ্রো-বিভাগের জন্য একজন কর্ত্তা নির্ব্বাচিত হইল। জর্জ্জিয়া প্রদেশবাসী আমাকেই চাহিলেন। কিন্তু টাস্কেজীর কাজে আমি ব্যস্ত—এজন্য সেই পদ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। আমার প্রস্তাবে অন্য একজন নিগ্রোকে এই কার্য্যে নিযুক্ত করা হইল।
নিগ্রো-বিভাগের মধ্যে দুইটা কামরাই সকলের দৃষ্টি সর্ব্বাপেক্ষা বেশী আকৃষ্ট করিয়াছিল। প্রথমতঃ হ্যাম্পটন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাজকর্ম্ম, দ্বিতীয়তঃ টাস্কেজী বিদ্যালয়ের ছেলেদের হাতের কাজ। বলা বাহুল্য, সর্ব্বাপেক্ষা বেশী বিস্মিত হইয়াছিল, দক্ষিণপ্রান্তের শ্বেতাঙ্গগণ।
আটলাণ্টা-মহাপ্রদর্শনীর দিন অগ্রসর হইতে লাগিল। এই প্রদর্শনী উন্মুক্ত করিবার জন্য কার্য্যপ্রণালী আলোচিত হইল। এই প্রদর্শনীতে নিগ্রোদিগকে আহ্বান করা হইয়াছে। তাহাদের বিদ্যা বুদ্ধির নিদর্শন স্বরূপ কাজ কর্ম্ম প্রদর্শিত হইবার ব্যবস্থা হইয়াছে। দুই তিন জন নিগ্রো ওয়াশিংটন পর্য্যন্ত যাইয়া ‘জাতীয়’ মহাসমিতির নিকট আবেদন করিয়া আসিয়াছেন—এবং নিগ্রোদিগকে প্রদর্শনীর কার্য্যে ও নেতৃত্বের পদে নিযুক্ত করা হইয়াছে। কাজেই প্রদর্শনী খুলিবার উৎসবে যে সম্মিলন হইবে তাহাতে নিগ্রোর আসন থাকাও বাঞ্ছনীয়। নিগ্রোর পক্ষ হইতে একজন প্রতিনিধির সেই সম্মিলনে বক্তৃতা করা আবশ্যক। কোন কোন শ্বেতাঙ্গ আপত্তি করিলেন; বলিলেন “অতবড় বিরাট ব্যাপারে কৃষ্ণাঙ্গের স্থান দিবার প্রয়োজন নাই।” শেষ পর্য্যন্ত সাব্যস্থ হইল, একজন নিগ্রো প্রতিনিধিকে বক্তৃতার জন্য নিমন্ত্রণ করা হইবে। কয়েকদিন পরে আমিই সেই নিমন্ত্রণ পাইলাম।
আমি বিষম সমস্যায় পড়িলাম। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে আমি গোলাম ছিলাম। আমার মনিবেরা কেহ কেহ হয়ত এই সম্মিলনে উপস্থিত থাকিবেন। তাঁহাদের সম্মুখে আমি স্বাধীন ভাবে কেমন করিয়া বক্তৃতা করিব?
তারপর নিগ্রোজাতির পক্ষে শ্বেতাঙ্গের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বক্তৃতা করিবার সুযোগ এই প্রথম পাওয়া গেল। এই ঘটনার উপর নিগ্রোসমাজের ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করিতেছে। এই সভাস্থলে, আবার, কৃষ্ণাঙ্গও অনেক থাকিবেন এবং উত্তর অঞ্চলের শ্বেতাঙ্গও অনেক আসিবেন। সমগ্র যুক্তরাজ্যের ইহা মহাসম্মিলন বলিলে কোন অত্যুক্তি হয় না। এই সর্ব্বজন সমাগমের আসরে, এই “জাতীয়” সভামণ্ডপে দাঁড়াইয়া সকল প্রদেশ ও সকল সম্প্রদায়ের মান্য রক্ষা করিয়া কথা বলা কি সহজ?
আমার স্বজাতির প্রতি কর্ত্তব্য আছে। তাহা পালন করিতেই হইবে। আমাদের দক্ষিণ অঞ্চলের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেই হইবে—অথচ তাহাদের দোষের কথা উল্লেখ না করিলেই বা চলিবে কেন? এদিকে উত্তর অঞ্চলের ইয়াঙ্কিগণ তাঁহারাও আমার বক্তৃতা শুনিয়া সমগ্র আমেরিকার নিগ্রোসমস্যা বুঝিতে চেষ্টা করিবেন। দক্ষিণপ্রান্তের নিগ্রোয় ও শ্বেতাঙ্গে সম্বন্ধ কিরূপ দাঁড়াইয়াছে তাঁহারা আমার বক্তৃতা হইতেই তাহার পরিচয় লইবেন। সুতরাং আমার দায়িত্ব অতি গুরুতর—সমগ্র আমেরিকাজাতি আমার পরীক্ষক ও বিচারক। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার উপযুক্ত শিক্ষা আমি এতদিন লাভ করিয়াছি কি? এই সময়ে আমার বয়স ৩৫। ৩৬ বৎসর।
আমার মাথায় কত কথাই আসিতে লাগিল। আমি নানা উপায়ে সমস্যাটা তলাইয়া মজাইয়া বুঝিতে চেষ্টা করিলাম। ইতিমধ্যে সমগ্র আমেরিকার সংবাদপত্রগুলি আমাকে প্রকাশ্যভাবে পরামর্শ দিতে লাগিল। কেহ লিখিল—“আমার অমুক অমুক বিষয় আলোচনা করা উচিত, অমুক অমুক প্রশ্নের উত্থাপন না করাই ভাল।” কোন সম্পাদক মহাশয় পরামর্শ দিলেন—“ওয়াশিংটন এই এই কথা যেন বলেন।” ইত্যাদি। আমার স্বজাতিগণ এবং দক্ষিণ প্রান্তের শ্বেতাঙ্গেরাও আমাকে উপদেশ দিতে ছাড়িলেন না। যাহা হউক আমার নিজের বক্তব্য স্থির করিয়া ফেলিলাম। ১৮ই সেপ্টেম্বর সভা হইবে—তাহার পূর্ব্বেই আমার বক্তৃতা লেখা হইয়া গেল। টাস্কেজীর শিক্ষকগণকে আমার প্রবন্ধ পড়িয়া শুনাইলাম। তাঁহাদের আলোচনা অনুসারে বক্তৃতার কিয়দংশ মার্জ্জিতও করাইয়া লইলাম।
১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে টাস্কেজী হইতে আটলাণ্টার সম্মিলনে রওনা হওয়া গেল। টাস্কেজীতে রেলে চড়িতে যাইতেছি, এমন সময়ে একজন শ্বেতাঙ্গ চাষী আমাকে ঠাট্টা করিয়া বলিল,—“কিহে ওয়াশিংটন ভায়া এতদিন তুমি উত্তর অঞ্চলের ইয়াঙ্কি মহলে বক্তৃতা মারিয়াছ। অথবা তোমার স্বজাতিগণকে তাহাদের কর্ত্তব্য শিখাইয়াছ এবং কখনও কখনও দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গ মহলেও আমাদের উপর গলাবাজী করিয়াছ। কিন্তু এবার তোমাকে এক সঙ্গে সকল মহলেই কথা বলিতে হইবে। দেখিতেছি তুমি এবার শক্ত পাল্লায় পড়িয়াছ। এবার উদ্ধার পাইলে বুঝিব ওয়াশিংটন সত্যসত্যই একজন মানুষ।” চাষী আমার মনোভাব ঠিক বুঝিতে পারিয়াছিল—সত্যই আমার তখনকার অবস্থা বড় কঠিন।
আমি রেলে চলিলাম। ষ্টেসনে ষ্টেসনে কত শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গ আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়াই আমার সম্বন্ধে আলোচনা করিতে লাগিল। আমার দিকে অনেকে আঙ্গুল দিয়া অন্যকে দেখাইয়া দিল। গাড়ী হইতে আটলাণ্টায় পদার্পণ করিবামাত্র এক বৃদ্ধ নিগ্রো আর একজনকে বলিল “ঐ লোকটা কালকার সভায় আমাদের স্বজাতির পক্ষ হইতে বক্তৃতা করিবে। আমি সভায় শুনিতে যাইবই স্থির করিয়াছি।”
আটলাণ্টায় সেদিন লোকে লোকারণ্য হইয়া গিয়াছে। আমেরিকার ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ হইতে প্রতিনিধি, দর্শক, ব্যবসায়ী ও শিল্পীর সমাগম হইয়াছে। সেনাবিভাগের লোকজন আসিয়াছে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের কর্ম্মচারী এবং রাষ্ট্রীয় দূতগণও সমবেত হইয়াছে। আটলাণ্টায় সেদিন বিশ্বের মহাবাজার বসিয়াছে বোধ হইল।
সমস্ত রাত্রি আমার ঘুম হইল না। সকালে উঠিবামাত্র ভগবানের নিকট আমার বক্তৃতার সফলতার জন্য প্রার্থনা করিলাম। সকল বক্তৃতার পূর্ব্বেই আমি ভগবানের করুণা ভিক্ষা করিয়া থাকি।
তারপর আমাকে সভামণ্ডপে লইয়া যাইবার জন্য কয়েকজন লোক আমার গৃহে আসিলেন। সভাস্থলে যাইবার পূর্ব্বে এক বিশাল শোভাযাত্রা বাহির হইল। এই শোভাযাত্রায় কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ এবং কয়েক দল কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যও যোগ দান করিয়াছিল। তিন ঘণ্টা ক্রমাগত চলিয়া সেই লোকপ্রবাহ প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে আসিয়া উপস্থিত হইল। গরমে আমার শরীর ঘর্ম্মাক্ত হইয়া গেল। একে আমার মানসিক উদ্বেগ তাহার উপর এই ক্লান্তি। আমি ভাবিলাম—আমার বক্তৃতা দেওয়া হইবে না। অবশেষে সম্মিলন-গৃহে প্রবেশ করিলাম।
সভামণ্ডপ অতি সুবিস্তৃত ও গোলাকার। নীচ হইতে উপরিভাগ পর্য্যন্ত কোথায়ও নূতন লোক বসিবার বিন্দুমাত্র স্থান নাই—সকল আসনই পূর্ণ। আমি গৃহে প্রবেশ করিবামাত্র কৃষ্ণাঙ্গেরা জয়ধ্বনি করিতে লাগিল। কোন কোন শ্বেতাঙ্গও সেই ধ্বনিতে যোগদান করিলেন। আমি শুনিয়াছিলাম যে অনেক শ্বেতাঙ্গই আমার বক্তৃতা শুনিতে আসিবেন। কাহারও উদ্দেশ্য কেবল শুনা মাত্র। কেহ কেহ অবশ্য আমার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। আর অধিকাংশ লোকই মজা দেখিতে আসিয়াছে। তাহাদের বিশ্বাস আমি সকল অনুষ্ঠানটা পণ্ড করিয়া ফেলিব। তাহা হইলে আমাকে লইয়া হাসি ঠাট্টা করিতে পারিবে।
আমার একজন সহৃদয় শ্বেতাঙ্গ বন্ধু ব্যাপার দেখিয়া সভাগৃহেই প্রবেশ করিলেন না। আমি যদি সুফল লাভ না করি তাহা হইলে বড়ই লজ্জা ও নিন্দার বিষয় হইবে। এই ভাবিয়া তিনি অস্থিরভাবে সভাগৃহের বাহিরে ‘পায়চারি’ করিতে লাগিলেন। বাস্তবিক পক্ষে, আমার এই বক্তৃতা সম্বন্ধে পূর্ব্ব হইতে নানা লোকের মনে নানা সন্দেহ উঠিয়াছিল।