নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/চতুর্দ্দশ অধ্যায়

চতুর্দ্দশ অধ্যায়

আটলাণ্টা-সম্মিলনে অভিভাষণ

 জর্জ্জিয়া-প্রদেশের রাষ্ট্র-শাসক বুলক একটি ক্ষুদ্র বক্তৃতা করিয়া প্রদর্শনী খুলিলেন। পরে ধর্ম্মগুরু নেল্‌সন স্তোত্র পাঠ করিলেন এবং একটি ‘প্রদর্শনী-মঙ্গল’ কবিতাও পঠিত হইল।

 এই সকল আনুষ্ঠানিক কার্য্য শেষ হইবার পর সম্মিলনের কার্য্য আরম্ভ হইল। প্রদর্শনীর সভাপতি তাঁহার অভিভাষণ পাঠ করিলেন। রমণী-বিভাগের সভাপতির বক্তৃতাও হইয়া গেল। তাহার পর বুলক মহোদয় আমাকে সমবেত জনমণ্ডলীর নিকট পরিচিত করিয়া দিলেন। তিনি বলিলেন “ইনি বুকার ওয়াশিংটন—নিগ্রোসমাজের একজন শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। ইনি আমাদিগকে নিগ্রোজাতির কৃতিত্ব ও সভ্যতার বিবরণ প্রদান করিবেন।”

 আমি বক্তৃতা করিতে আরম্ভ করিলাম—অমনি চারিদিক হইতে জয়ধ্বনি উঠিল। নিগ্রোমহল হইতেই বিশেষ উৎসাহ পাওয়া গেল—এবং হাজার হাজার লোকের দৃষ্টি আমার দিকে পড়িল। নিম্নে আমার বক্তৃতা উদ্ধৃত করিতেছি।

 “সভাপতি মহাশয়, প্রদর্শনী ও সম্মিলনের ধুরন্ধরগণ, এবং বন্ধুগণ,

 দক্ষিণ অঞ্চলের ১/৩ অংশ লোক নিগ্রো সমাজের অন্তর্গত। নিগ্রোসমাজকে বাদ দিয়া কর্ম্ম করিলে কোন অনুষ্ঠানই এ অঞ্চলে সুফল প্রদান করিতে পারে না। এ অঞ্চলের আর্থিক, রাষ্ট্রীয় ও নৈতিক উন্নতি বিধানের জন্য কৃষ্ণাঙ্গ জাতির সহযোগিতা গ্রহণ করা অবশ্যকর্ত্তব্য।

 আপনারা এই প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে নিগ্রোজাতিকে উপেক্ষা করেন নাই, বরং সকল অবস্থায়ই কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের সাহায্য গ্রহণ করিয়া অগ্রসর হইয়াছেন। এইরূপে প্রতি পদে আপনারা স্বজাতির চরিত্রবত্তা এবং বুদ্ধিমত্তার যথোচিত সম্মান করিয়াছেন। এজন্য আমার স্বজাতিগণ আপনাদের নিকট আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছে। আমি তাহাদের মুখপাত্র স্বরূপ এই প্রদর্শনীর কর্ম্মকর্ত্তাদিগকে তাঁহাদের উদারতার জন্য ধন্যবাদ প্রদান করিতেছি।

 আপনারা আমাদিগকে এই উপায়ে সম্মানিত করিয়া শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের ঐক্যবন্ধন দৃঢ় করিলেন। আমাদের স্বাধীনতালাভের পর এরূপ ভ্রাতৃভাব, সহৃদয়তা এবং পরস্পর সাপেক্ষতা আর দেখা যায় নাই।

 কেবল তাহাই নহে। আমরা এই সুযোগে শিল্প ও ব্যবসায় হিসাবে এক নবজীবন লাভ করিতে থাকিব। এতদিন আমরা রাষ্ট্রীয় ও শিল্পকর্ম্মে অনেকটা অনভ্যস্ত ছিলাম। গোড়ার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্ব্বে আমরা উচ্চ অধিকারলাভের আকাঙ্ক্ষা রাখিতাম। সম্পত্তির মালিক না হইয়াই প্রদেশ-রাষ্ট্রের এবং যুক্ত-রাষ্ট্রের মন্ত্রণা-সভার পদলাভের আশা করিতাম। কৃষিকর্ম্মে, শিল্পে ও ব্যবসায়ে পরিশ্রম স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হইয়া রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে এবং গলাবাজীতে সময় ব্যয় করিতাম। এরূপ অস্বাভাবিক আশা, আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়াসের যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা যে সময়ে স্বাধীনতা পাই তখন আমরা সকল বিষয়ে নিতান্ত শিশু ছিলাম—কোনদিকেই আমাদের কোনরূপ অভিক্ষতাঅভিক্ষতা ছিল না। এজন্য সংসারের লোভনীয় পদ ও সম্মানগুলির প্রতি আমরা প্রথমেই অনুরক্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম। এগুলিকে লাভ করিবার উপায় ও কৌশলের প্রতি দৃষ্টি পড়ে নাই। আমরা ফললাভের জন্যই বেশী ব্যগ্র হইয়াছিলাম—ফললাভের প্রণালীগুলি আয়ত্ত করিতে যত্ন লই নাই।

 বহুদিন ধরিয়া একটি জাহাজ সমুদ্রে পথ হারাইয়া এদিক ওদিক ঘুরিতেছিল। হঠাৎ এক দিন একটি নূতন জাহাজের সঙ্গে তাহার সাক্ষাৎ হইল। পথভ্রান্ত জাহাজের মাস্তুল হইতে তাহার দিকে নিশান তোলা হইল—“জল চাই জল চাই, আমরা তৃষ্ণায় মরিতেছি।” নূতন জাহাজ হইতে তৎক্ষণাৎ উত্তর আসিল “যেখানে তোমাদের জাহাজ রহিয়াছে সেই খানেই ভাল জল পাইবে। ঠিক সেই খানেই বাল্‌তি ফেল।”

 পথভ্রান্ত জাহাজ আবার জানাইল “জল, জল, শীঘ্র ভাল জল পাঠাও।” নূতন জাহাজ আবার উত্তর করিল “ঐখানেই সুস্বাদু পানীয় জল পাইবে। বাল্‌তি ফেলিলেই ভাল জল উঠিবে।” এইরূপে তিন চারিবার দুই জাহাজে প্রার্থনা ও উত্তর চলিতে লাগিল। শেষে সেই পথভ্রান্ত জাহাজের কর্ত্তা বাল্‌তি ফেলিয়া দেখিলেন—অতি নির্ম্মল ও মিষ্ট জল উঠিয়া আসিল। তাঁহাদের জাহাজ সমুদ্র ছাড়িয়া অনেকক্ষণ আমাজন নদে পড়িয়াছে।

 আমাদের নিগ্রোসমাজকেও আমি সেইরূপ বলি—“যেখানে আছ সেই খানেই বাল্‌তি ফেল। ভাল জল পাইবে। তৃষ্ণায় অধীর হইতে হইবে না। ”

 তোমরা ভাবিতেছ আমেরিকা ছাড়িয়া গেলে সুখী হইবে? তোমরা ভাবিয়াছ তোমাদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গসমাজের সদ্ভাব কোনদিনই জন্মিবে না? তোমরা ভুল বুঝিতেছ— সেই পথভ্রান্ত জাহাজের নাবিকদের মত পুরাতন মোহে মজিয়া রহিয়াছ।

 চক্ষু খুলিয়া দেখ—দেখিবে স্বাস্থ্যকর সুমিষ্ট জল তোমার সম্মুখেই রহিয়াছে। বুঝিবে শ্বেতাঙ্গ তোমার ভাই—দেখিবে আমেরিকাই তোমার স্বদেশ। দূরে যাইবার প্রয়োজন নাই—শ্বেতাঙ্গ প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাব-বিনিময় ও কার্য্য-বিনিময় কর। যে দেশের আব্‌হাওয়ায় বাস করিতেছ সেই আব্‌হাওয়া হইতেই নিঃশ্বাস গ্রহণ কর। সত্বরেই এক হৃষ্টপুষ্ট ও চরিত্রবান্ জাতি রূপে গড়িয়া উঠিতে পারিবে।

 কৃষিকর্ম্মে মনোনিবেশ কর। শিল্প ও ব্যবসায়ে মনোযোগী হও। অন্যান্য নানাপ্রকার চাকরী, কেরাণীগিরি ইত্যাদিতে লাগিয়া যাও। বিদেশে যাইবার প্রয়োজন নাই। “যেখানে আছ সেইখানেই বাল্‌তি ফেল।”

 দক্ষিণ অঞ্চলের শ্বেতাঙ্গদিগের অনেক দোষই আছে স্বীকার করি। কিন্তু এ কথাও মুক্তকণ্ঠে আমি বলিতেছি যে, এখানে নিগ্রোজাতি ব্যবসায় হিসাবে কোন অসুবিধাই ভোগ করে না। বরং আমাদের আর্থিক উন্নতির যথেষ্ট সুযোগই আমার স্বজাতিগণ এখানে পাইয়াছে। কোন নিগ্রোই তাহা ভুলিয়া থাকিতে পারিবে না।

 আমরা অল্পকাল হইল স্বাধীন হইয়াছি। বলা বাহুল্য, অন্যান্য স্বাধীনজাতির যে অবস্থা আমাদেরও সেই অবস্থাই হইবে। পুরাতন লব্ধপ্রতিষ্ঠ-জাতির মধ্যে ব্যক্তিমাত্রকেই খাটিয়া খাইতে হয়। সংসারের কাজকর্ম্মে বিদ্যাবুদ্ধি ও চরিত্রবলের প্রয়োগ করিয়াই তাহারা জগতে বিরাজ করিতেছে। নিগ্রোজাতিকেও সেইরূপ পরিশ্রম স্বীকার করিতে হইবে। আমাদের অন্নের গ্রাস আমাদিগকে নিজহাতেই মুখে তুলিতে হইবে। তাহার জন্য শারীরিক পরিশ্রম অত্যাবশ্যক।

 “গোলামীর যুগে পরিশ্রম করিতাম—কিন্তু এখন স্বাধীন হইয়াছি পরিশ্রম করিব কেন?”—কোন চিন্তাশীল ব্যক্তিই এরূপ ভাবিতে পারেন না। কারণ স্বাধীনতার অর্থ পরিশ্রম হইতে মুক্তিলাভ নয়! স্বাধীনতার যুগেও হাতে পায়ে খাটিতে হইবে—মাথার ঘাম পায়ে ফেলিতে হইবে।

 গোলামীযুগে পরের স্বার্থে খাটিতাম, পরের নেতৃত্বে খাটিতাম, পরকে সুখী করিবার জন্য খাটিতাম। সে খাটায় কিছুমাত্র নিজস্ব ছিল না, নিজের লাভ দেখিতাম না, নিজের আনন্দ পাইতাম না। কিন্তু স্বাধীনতার যুগে খাটিব—নিজের জন্য, নিজ আনন্দের জন্য, নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য—সকল বিষয়ে নিজের কর্ত্তৃত্ববোধ জাগাইবার জন্য—সর্ব্বত্র নিজকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য। কিন্তু খাটা বন্ধ হইবে না। যতদিন মানুষ থাকিব ততদিন খাটিতেই হইবে।

 আমার নিগ্রো ভ্রাতারা সর্ব্বদা একথা মনে রাখিয়া চলিবেন। স্বাধীন হইয়াছি বলিয়া বাবুগিরি ও বিলাসের সুযোগ পাইয়াছি—একথা যেন আমরা না বুঝি! বরং এখন হইতে আমাদিগকে কঠোর সংযম পালন করিতে হইবে। সৌখীন ও চকচকে পদার্থের প্রলোভন ছাড়াইয়া যথার্থ টেকসই, স্থায়ী এবং কার্য্যোপযোগী জিনিষপত্রের আদর করিতে হইবে। অলঙ্কার বেশভূষা ইত্যাদির আকাঙ্ক্ষা এখন কিছু বর্জ্জন করা আবশ্যক। সকল বিষয়েই আমাদের এখন কষ্টকর সাধনার যুগ।

 সকল স্বাধীন জাতিই বিবেচনা করেন যে, কবিতারচনায় যে কৃতিত্ব, জমি চাষেও সেই কৃতিত্ব। সুতরাং যাঁহারা সমাজকে ধনে সম্পদে উন্নত করিতেছেন তাঁহাদের সম্মান বড় কম নয়। এই বুঝিয়া আমাদেরও এই ধনসম্পদ্‌বৃদ্ধির কর্ম্মে মনোযোগী হইতে হইবে। আমরা এই গোড়ার কথা ভুলিয়া গেলে উন্নতির উচ্চ স্তরগুলিতে উঠিতে পারিব না।

 তারপর আমরা যেন সর্ব্বদা মনে রাখি যে, আমাদের সুযোগ ও সুবিধা, বর্ত্তমানে অনেকই রহিয়াছে। অবশ্য কতকগুলি বাধা ও বিঘ্ন আমাদের চরম উন্নতির প্রতিবন্ধক হইয়া আছে—তাহা আমি অস্বীকার করিতেছি না। কিন্তু সর্ব্বদা সেই অসুবিধার কথা ভাবিবার প্রয়োজন নাই, এবং ভাবিয়া ভাবিয়া সেইগুলিকে বাড়াইয়া তুলিবার প্রয়োজন নাই। আমাদের হাতের কাছে যে সকল সুবিধা পাইতেছি সেইগুলিকে বুদ্ধিমানের ন্যায় ব্যবহার করিব না কেন? বর্ত্তমান অবস্থায় আমরা যদি জগতের শক্তিগুলি যথাসম্ভব সদ্ব্যবহার করিয়া নিজেদের কাজে না লাগাই, তাহা হইলে ভবিষ্যতের জন্য আমরা কি করিয়া গেলাম? আমাদের বংশধরগণের উচ্চতর কর্ম্ম ও চিন্তার জন্য আমাদের এক্ষণে সুদৃঢ় ভিত্তি গঠন করিয়া রাখা আবশ্যক নহে কি? এজন্য বর্ত্তমানের সুযোগ যাহা কিছু পাইতেছি সকলই আমাদের প্রাণপণে নিগ্রোসমাজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা কর্ত্তব্য।

 আমার শ্বেতাঙ্গ দেশবাসীদিগকেও আমি বলিতেছি—‘আপনারাও যেখানে আছেন, ঠিক সেইখানে বাল্‌তি ফেলুন’—আপনাদের অভাবেরও পূরণ হইবে। বিদেশ হইতে লোক আমদানী করিবার প্রয়োজন নাই। স্বদেশের কৃষ্ণাঙ্গসমাজের মধ্যে বাল্‌তি ফেলুন—আমেরিকার নিগ্রোজাতির সঙ্গে সকল বিষয়ে মিলিয়া মিশিয়া কাজ করুন। আমেরিকাজননী প্রবল পরাক্রান্ত হইয়া উঠিবেন।

 এই নিগ্রোরা আপনাদের যমজ ভ্রাতা। ইহারা আপনাদের সুখে-দুঃখে উৎসবে-ব্যসনে সকল অবস্থায়ই সঙ্গী রহিয়াছে। আপনারা কি ইহাদের নিকট ঋণী নহেন?

 “নিগ্রোজাতির স্বভাব চরিত্র আপনাদের অজানা নাই। ইহাদের প্রভুভক্তি এবং চরিত্রবত্তার পরীক্ষা আপনারা বহুবার করিয়াছেন। আপনারা ইহাদিগকে বিশ্বাস করিয়া আপনাদের স্ত্রীপুত্ত্রপরিবার ও ধনসম্পত্তি সম্বন্ধে কতবার নিশ্চিন্ত হইয়াছেন—সে সকল কথা আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। ইহারা যে বিশ্বাসঘাতক নয় তাহার সাক্ষ্য আপনারাই সর্ব্বোৎকৃষ্টরূপে দিতে পারিবেন।

 অধিকন্তু, এই কৃষ্ণাঙ্গ-সমাজ আপনাদের আর্থিক উন্নতির প্রধান অবলম্বন। ইহারাই মূকভাবে এতদিন আপনাদের জমি চষিয়াছে। ইহারা কখনও ধর্ম্ম-ঘট করে নাই —আপনাদিগকে জব্দ করিয়া, নিজেদের বেতন বা অন্যান্য অধিকার বাড়াইবার জন্য চেষ্টিত হয় নাই। বিনাবাক্যব্যয়ে ইহারা আপনাদের জঙ্গল পরিষ্কার করিয়াছে—রেলপথ তৈয়ারী করিয়াছে—নগর নির্ম্মাণ করিয়াছে। নিগ্রো কুলীরাই পৃথিবী খুঁড়িয়া অন্ধকারময় খাদ হইতে ধাতুরত্ন তুলিয়া আনিয়াছে—ইহাদের সাহায্যেই আমেরিকার দক্ষিণ অঞ্চলের সকল সুখ ও শ্রী পুষ্ট হইয়াছে।

 আপনারা এই সমাজের প্রতি কি কৃতজ্ঞ হইবেন না? আপনারা কি আপনাদের পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক গৌরবের মূলকারণ স্বরূপ নিগ্রোজাতিকে অবজ্ঞা করিয়া থাকিতে পারেন? আমি প্রার্থনা করিতেছি—শ্বেতাঙ্গ-সমাজের অগ্রণীগণ, আপনারা কৃষ্ণাঙ্গ-সমাজের মধ্যেই আপনাদের বাল্‌তি ফেলুন। প্রতিকার্য্যে ইহাদিগের সহযোগিতা গ্রহণ করুন।

 আপনারা ঠিক পথেই চলিয়াছেন আপনারা নিগ্রোশ্বেতাঙ্গের মিলন পথই ধরিয়াছেন তাহা আমি বেশ বুঝিতেছি। আজকার এই প্রদর্শনীই তাহার সাক্ষ্য। এই সম্মিলনে আমি যে বক্তৃতা দিবার সুযোগ পাইয়াছি—ইহাই তাহার সাক্ষ্য। আপনারা নিগ্রোসমাজকে সম্মান করিতেছেন।

 আপনারা এক্ষণে আমার স্বজাতিদিগকে উন্নতির নব নব পথে চালিত করুন। তাহাদের উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করুন—তাহাদের হৃদয়ের উৎকর্ষসাধনের জন্য চেষ্টিত হউন। তাহাদিগকে কৃষি, শিল্প, কলা, সাহিত্য, চিত্র, স্থাপত্য ইত্যাদি সভ্যতার বিবিধ বিভাগে প্রতিষ্ঠিত হইবার সুযোগ প্রদান করুন। দেখিবেন,—দেশের মাটি উর্ব্বর হইতে থাকিবে—ধরণী ফলেফুলে ভরা হইয়া আপনাদের আনন্দ বিধান করিতে থাকিবে। আমেরিকার পল্লীগুলি উদ্যানে পরিণত হইবে—নগরগুলি নব নব ফ্যাক্টরী বক্ষে ধারণ করিয়া সমৃদ্ধ হইবে।

 আর জানিয়া রাখিবেন, যখন প্রয়োজন হইবে, আপনাদের স্বাধীনতা রক্ষা করিবার জন্য আমরা আমাদের রক্তের শেষবিন্দু পর্য্যন্ত দান করিব। এরূপ প্রভুভক্ত বিশ্বাসী এবং কৃতজ্ঞ জাতি আপনারা বিদেশ হইতে আমদানী করিতে পারিবেন না। “অপনারা যেখানে আছেন সেইখানেই বাল্‌তি ফেলুন।”

 অতীতের কথাগুলি স্মরণ করুন, সেই গোলামীর যুগ স্মরণ করুন—সেই গোলামী যুগের শেষ অবস্থা, সেই উত্তরপ্রান্তে ও দক্ষিণপ্রান্তে লড়াইয়ের কথা স্মরণ করুন। অতীতে আমরা আপনাদের সন্তান সন্ততি পালন করিয়াছি, বৃদ্ধ মাতাপিতার সেবা করিয়াছি। আপনাদের রোগে ও শোকে আমরাই অসুখ ও রোগের ক্লেশ সহ্য করিয়াছি। আপনাদের শয্যাপার্শ্বে কত দিনরাত্রি আমরা অনশনে কাটাইয়াছি। আপনাদের অভিভাবকগণের মৃত্যুকালে আমরা কত আঁখিজল ফেলিয়াছি। আমরা আমাদের রক্তদিয়া আপনাদিগকে মানুষ করিয়াছি। নূতন কোন্ জাতি আসিয়া আপনাদিগের সেরূপ সেবাশুশ্রূষা করিবে?

 এতকাল আমরা আপনাদের জন্য যাহা করিয়া আসিয়াছি ভবিষ্যতেও আমরা ঠিক সেইরূপই করিব। আমরা আপনাদের ধর্ম্ম, সমাজ, শিল্প, শিক্ষা, রাষ্ট্র, ইত্যাদি সকল কর্ম্মক্ষেত্রেই আপনাদের সহযোগী এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতা হইয়া থাকিব। আমরা শ্বেতাঙ্গের স্বার্থকে নিজ স্বার্থ বিবেচনা করিয়া সকল বিষয়ে এক পরিবারভুক্তরূপে জীবন যাপন করিব। আবশ্যক হইলে এই ৮০ লক্ষ নিগ্রোজাতি প্রাণপাত করিয়া আমেরিকার গৌরব রক্ষা করিবে। প্রত্যেক নিগ্রোর জীবন সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও ‘ইজ্জতে’র জন্য উৎসর্গীকৃত জানিয়া রাখিবেন।

 জানিয়া রাখিবেন—নিগ্রো ও শ্বেতাঙ্গ লেন-দেন—খাওয়া, পরায় পাঁচ আঙ্গুলের মত স্বতন্ত্র থাকিলেও থাকিতে পারে। কিন্তু এই দুই সমাজ যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয়’ মঙ্গলের জন্য আমার এই বাহুর মত ঐক্য বিশিষ্ট। আমরা পরস্পর-সাপেক্ষ—আমাদের একতা মানবদেহের ন্যায় স্বাভাবিক গ্রন্থিপ্রসূত। দুইএর স্বার্থ সম্পূর্ণ এক।

 আমেরিকাবাসী এক অঙ্গকে ছাড়িয়া অন্য অঙ্গকে পুষ্ট ও উন্নত করিতে পারিবে না। আমাদের প্রত্যেকের সম্মান ও স্বাধীনতা অপরের সম্মান ও স্বাধীনতার উপর সম্পূর্ণরূপেই নির্ভর করিতেছে। আপনারা নিগ্রোজাতিকে দাবিয়া চাপিতে এবং পঙ্গু করিয়া রাখিতে চেষ্টা করিলে সত্য সত্যই আত্মহত্যা করিয়া ফেলিবেন। তাহা না করিয়া আপনারা নিগ্রোকে আমেরিকার উপযুক্ত-সন্তানে পরিণত করিতে চেষ্টিত হউন, অভিভাবকের ন্যায় তাহাকে উৎসাহিত করুন, তাহাকে সাহায্য করুন, তাহার শিশুসুলভ চিন্তাশক্তিরাশিকে সংরক্ষিত, পরিপুষ্ট করুন, তাহার অনুন্নত কর্ম্মশক্তিগুলিকে নানা উপায়ে বাড়াইয়া তুলিবার চেষ্টা করুন। এই “সংরক্ষণে”র জন্য আপনাদের যথেষ্ট পরিশ্রম স্বীকার করিতে হইবে, এবং যথেষ্ট অর্থব্যয় এবং সময়-ব্যয় করাও আবশ্যক হইবে। কিন্তু বর্ত্তমানে আপনারা এই সংরক্ষণ ও পরিপোষক কার্য্যের জন্য যে ক্ষতি সহ্য করিবেন তাহা সমস্তই অল্পকালের মধ্যে সুদে আসলে উঠিয়া আসিবে। আপনাদের এই প্রয়াস অতি সত্বর সুফল প্রসব করিতে থাকিবে— যুক্তরাষ্ট্র ধন্য হইবে।

 ভাবিয়া দেখুন আপনাদের কার্য্যফল কি হইবে। যদি আপনারা নিগ্রোজাতিকে এক্ষণে তুলিয়া ধরিতে চেষ্টা করেন, তাহা হইলে অনতিদূর ভবিষ্যতে ৮০ লক্ষ নূতন কণ্ঠ হইতে আমেরিকার যশোগান উত্থিত হইবে—৮০ লক্ষ নূতন কণ্ঠে জননী জন্মভূমির বন্দনা গীত হইবে। আর যদি এক্ষণে আপনারা স্বার্থত্যাগ করিয়া এই অবনত সমাজকে উন্নত করিতে চেষ্টিত না হন, তাহা হইলে, এই ৮০ লক্ষ কণ্ঠ আপনাদের বিরুদ্ধে সমস্ত সংসারময় নিন্দা রটাইতে থাকিবে। আজ যদি আপনারা নিগ্রোজাতির বাহুবল সংরক্ষিত করিবার প্রয়াসী হন, অনতিদূর ভবিষ্যতেই দেখিতে পাইবেন—১৬০ লক্ষ নূতন হস্তে আপনাদের মাতৃভূমির বোঝা তুলিয়া ধরা হইয়াছে—আপনাদের নিজের ঘাড় অনেকটা হাল্‌কা হইয়াছে। আর যদি আজ ইহাদের বাহুতে শক্তি পুষ্ট করিবার জন্য আপনারা সচেষ্ট না হন, তাহা হইলে দেখিবেন, আপনাদের বিপৎকালে ও দুঃসময়ে এই ১৬০ লক্ষ হাত আপনাদিগকে ধরিয়া পশ্চাতে টানিয়া রাখিতেছে। হয়, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলের অংশ শক্তি, না হয় আমরা ইহার ১/৩ অংশ দুর্বলতা। হয় আমাদের দ্বারা এই প্রান্তের কার্য্যক্ষমতা, চরিত্রবত্তা, বুদ্ধিমত্তা ১/৩ অংশ বাড়িবে, না হয় ইহার ১/৩ অংশ অপটুত্ব, চরিত্রহীনতা এবং অজ্ঞতা বাড়িবে। হয় আমরা দক্ষিণপ্রান্তের আর্থিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নতির যন্ত্র স্বরূপ হইয়া থাকিব, না হয় আমাদের প্রভাবে আর্থিক ও রাষ্ট্রীয় অবনতির দিকে এই অঞ্চলকে নামিতে হইবে।

 তার পর প্রদর্শনীর কর্ম্মকর্তাদিগের নিকট আমার নিবেদন। আজ আমরা আপনাদের এই বিরাট আয়োজনে আমাদের ক্ষুদ্র শক্তির পরিচয় প্রদান করিবার সুযোগ পাইয়াছি। কিন্তু আমরা বেশী কিছু প্রদর্শন করিতে পারিলাম না। আপনারা নিগ্রোজাতির নিকট এত শীঘ্র বেশী কিছু আশা করিতে পারেন না।

 ত্রিশবৎসর পূর্ব্বে আমরা কেনা গোলাম ছিলাম। যখন স্বাধীনতা পাই, তখন দুটা একটা কম্বল, দুটা চারটা মুরগীর ছানা অথবা দুটা চারিটা শাকশব্জী মাত্র আমাদের সম্বল ছিল। সেইটুকুই আমাদের মূলধন জানিয়া রাখিবেন। সে সব কথা আর মনে করিয়া দিতে হইবে কি? এই নিঃসম্বল অবস্থায়ই ত্রিশবৎসরের মধ্যে আমাদিগকে নানা কর্ম্মক্ষেত্রে দাঁড়াইতে হইয়াছে। কৃষিকর্ম্মের যন্ত্র হাতিয়ার বলুন, গাড়ীজুড়ি বলুন, এঞ্জিনষ্টীমার বলুন, সংবাদপত্র পুস্তকাদি বলুন, চিত্রকলা, মূর্ত্তিগঠনই বা বলুন, অথবা দোকানদারী এবং ব্যাঙ্ক পরিচালনাই বলুন—সকলই আমাদিগকে শিশুর মত আরম্ভ করিতে হইয়াছে। বিনা মূলধনে ও বিনা অভিজ্ঞতায়, আমরা এই সকল কর্ম্মে প্রবেশ করিয়াছি। ত্রিশবৎসরের ভিতর কত ফলই বা পাইতে পারি? তথাপি যে আপনাদের বিরাট কাণ্ডের এক কোণে আমরা আমাদের ক্ষুদ্র সভ্যতার নিদর্শনগুলি দেখাইতে পারিয়াছি ইহাই বিস্ময়ের কথা।

 এই সঙ্গে আমি শ্বেতাঙ্গ-সমাজকে আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা অবশ্য কর্ত্তব্য বিবেচনা করিতেছি। দক্ষিণ প্রান্তের শ্বেতাঙ্গ জনগণ হইতে আমরা গত ত্রিশবৎসর অশেষ সাহায্য ও পরামর্শ পাইয়াছি। উত্তর অঞ্চলের ধনী মহাত্মারাও আমাদিগকে ধনদান করিয়া নানা উপায়ে কর্ম্মজীবনে অগ্রসর করিয়া দিয়াছেন। আজ আমরা আপনাদের সম্মুখে যাহা উপস্থিত করিতে পারিয়াছি তাহার জন্য শ্বেতাঙ্গ-সমাজের নিকট আমরা সত্যসত্যই ঋণী। আপনাদের সাহায্য না পাইলে এত অল্পকালের ভিতর নিগ্রোজাতি এই উন্নতি দেখাইতে পারিত না।

 পুনরায় আমি দক্ষিণ প্রান্তের জননায়কগণকে বলিতেছি—এই প্রদর্শনী ও সম্মিলনের ন্যায় শুভ অবসর আমাদের দুই সমাজের পক্ষে আর আসে নাই। কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ সমাজের সৌহার্দ্দ্য ও মিলনের সূত্র এইবার যেরূপ দৃঢ়ভাবে গ্রন্থিত হইল আমাদের স্বাধীনতা লাভের পর আর কখনও সেরূপ হয় নাই। আজ এই মিলনমন্দিরে দাঁড়াইয়া ভগবানের কৃপা ভিক্ষা করিতেছি, এবং নিবেদন করিতেছি, য়ে, নিগ্রোসন্তান অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতেও শ্বেতাঙ্গকে ভাই বলিয়া জানিবে। আপনারাও ভগবানের কৃপায় আমাদিগকে বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্ত হউন, আমাদের উন্নতিকে আপনাদের উন্নতি বিবেচনা করিতে শিখুন এবং দুই জাতিকে অচ্ছেদ্য প্রেম-বন্ধনে সম্মিলিত করিয়া যুক্তরাষ্ট্রে যুগান্তর সৃষ্টির সহায়তা করুন। ভ্রাতৃভাবের বৃদ্ধি হইলেই এই প্রদর্শনীর সার্থকতা হইবে।

 এইরূপে পরজাতিবিদ্বেষ ও পরজাতিপীড়ন আমেরিকা হইতে লুপ্ত হইলেই এবং জাতিনির্ব্বিশেষে ন্যায্য বিচারের প্রবর্ত্তন ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিভাগের ব্যবস্থা করিলেই এখানে নবজীবন আসিবে। সেই নবজীবনের আবির্ভাবেই আজকার এই কৃষি, শিল্প, চিত্র, মূর্ত্তি, ও ব্যবসায়ের প্রদর্শন যথার্থ ফলপ্রসূ হইবে। সেই নূতন ‘জাতীয়’ ধর্ম্ম প্রতিষ্ঠিত হইলেই এবং সেই নবীন আধ্যাত্মিক দৃষ্টির বিকাশ হইলেই, এই লোহালক্কড় ইট কাঠ ছবি ছাপার প্রচার সার্থক হইবে।”