নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/পঞ্চদশ অধ্যায়

পঞ্চদশ অধ্যায়

নানা কথা

 আমার বক্তৃতা শেষ হইবামাত্র জর্জ্জিয়ার শাসনকর্ত্তা বুলক মঞ্চের উপর দৌড়াইয়া আসিয়া আবেগভরে আমার হাত ধরিলেন। এইরূপে অসংখ্য লোক আমাকে সুখ্যাতি করিতে লাগিল। সভাস্থল আমার জন্য জয়ধ্বনিতে মুখরিত হইয়া উঠিল।

 আমি আটলাণ্টা হইতে টাস্কেজীতে ফিরিয়া আসিলাম। রাস্তায় লোকজন আমাকে দেখিয়া অভিবাদন করিয়া কৃতার্থবোধ করিতেছিল। তিনমাস ধরিয়া যুক্তরাজ্যের উত্তর দক্ষিণ সকল প্রান্তের সংবাদপত্রই আমার প্রশংসা চালাইতে লাগিল। দেশের প্রসিদ্ধ পত্রিকাসম্পাদকগণ একবাক্যে বক্তৃতার সাধুবাদ করিতে থাকিলেন।

 টাস্কেজীতে আমার নিকট কত পত্র আসিল সকলে আমাকে রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের জন্য বক্তারপদে নিযুক্ত করিতে চাহেন। এক সম্প্রদায় আমাকে লিখিলেন—“আপনি যদি আমাদের জন্য নানাস্থানে বক্তৃতা করিবার ভার গ্রহণ করেন তাহা হইলে এককালীন ১৫০,০০০৲ দিতে প্রস্তুত আছি। অথবা প্রত্যেক রাত্রে ৬০০৲ করিয়া আপনার পারিশ্রমিক দিতে পারি।” আমি এই সকল সম্প্রদায়কে নম্রভাবে উত্তর দিতাম, “আমি আমার জীবনব্রত টাস্কেজী বিদ্যালয়েই উদযাপন করিব। সুতরাং আপনাদের অনুরোধ রক্ষা করিতে আমি নিতান্তই অসমর্থ। অধিকন্তু বক্তৃতা করাকে জীবনের ব্যবসায়রূপে গ্রহণ করিতে আমি পারিব না। আপনারা আমায় মাপ করিবেন।”

 এই সময়ে ক্লীভল্যাণ্ড যুক্ত-রাষ্ট্রের সর্ব্বোচ্চ শাসনকর্ত্তা বা সভাপতি ছিলেন। তাঁহার নিকট ওয়াশিংটনদরবারে আমার বক্তৃতার একটা নকল পাঠাইয়াছিলাম। তিনি স্বহস্তে পত্র লিখিয়া আমাকে জানাইলেন, আটলাণ্টা প্রদর্শনীতে যদি অন্য কোন কাজও না হইত, এবং কেবলমাত্র আপনার বক্তৃতার জন্যই যদি এই সম্মিলনের অধিবেশন হইত, তাহা হইলেও ঐ অনুষ্ঠানের অঙ্গহানি হইত না। আপনার বক্তৃতায় কৃষ্ণাঙ্গ শ্বেতাঙ্গ উভয়েরই যথেষ্ট উপকার হইবে।”

 তাহার পর ক্লীভল্যাণ্ড প্রদর্শনী দেখিতে আটলাণ্টায় আসেন। সেই সময়ে আমি তাঁহার সঙ্গে দেখা করি। আমার অনুরোধে তিনি নিগ্রোবিভাগে প্রদর্শিত দ্রব্যগুলি যত্নসহকারে দেখিলেন। এই সুযোগে অনেক নিগ্রো পুরুষ ও রমণী তাঁহার সঙ্গে করমর্দ্দন করিল। বহুলোকে তাঁহার নিজ হাতের সহি নাম লইয়া রাখিতে উৎসুক হইল। তিনি তাঁহাদের খাতায় বা কাগজে বেশ আদরের সহিত স্বীয় নাম লিখিয়া দিলেন।

 এইবার আমার স্বজাতিগণের কথা বলি। তাহারা প্রথম প্রথম আমার বক্তৃতার বেশ সুখ্যাতিই করিল। আমার প্রতিপত্তিতে তাহারা গৌরববোধ করিতে লাগিল। ক্রমশঃ তাহাদের মত বদলাইয়া গেল। তাহারা ভাবিল—আমি বড়ই সাদাসিধা লোক—আমার রাষ্ট্রীয় মতগুলি নিতান্তই নরম সুরের। তাহাদের মনে হইল, আমি শ্বেতাঙ্গদিগের প্রশংসা অত্যধিক করিয়াছি। তাহাদের বিচারে আমার আর কিছু গরম গরম কথা বলা উচিত ছিল—নিগ্রোদিগের অধিকার এবং দাবীদাবা বেশ জোরের সহিত প্রচার করা উচিত ছিল। তাহারা ক্রমশঃ কাগজে আমার নিন্দা শুরু করিল। তাহাদের বিশ্বাস, আমি আমার কর্ত্তব্যপালনে ত্রুটি করিয়াছি। আমি ভীরু ও দায়িত্ববোধ হীন, আমি সুযোগ পাইয়াও নিগ্রোজাতির কার্য্য উদ্ধার করিতে পারিলাম না।

 নিগ্রোসমাজে আমার দুর্নাম রটিতে থাকিল। এই সঙ্গে আমার আর একটা কথা মনে পড়িতেছে। টাস্কেজীবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দশ বৎসর পরে, অর্থাৎ এই বক্তৃতার প্রায় ৫ বৎসর পূর্ব্বে কোন সম্পাদকের অনুরোধে আমি একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম। তাহাতে নিগ্রো সমাজের ধর্ম্মগুরুদিগের নৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছিলাম। অনেক স্পষ্ট কথা লিখিতে হইয়াছিল। সুতরাং আমার প্রদত্ত চিত্র নিগ্রোসমাজের পক্ষে রুচিকর হয় নাই। ধর্ম্মগুরুরা আমার উপর ক্ষেপিয়া গেলেন—আমার স্কুল ভাঙ্গিবার জন্য কত চেষ্টা করিলেন। এমন কি, এজন্য তাঁহাদের ‘আড়কাটি’ও নিযুক্ত হইল। তাহারা আমার বিদ্যালয়ের ছাত্রদিগকে ভাগাইবার জন্য প্রাণপণ করিতে থাকিল। অনেক সংবাদপত্রও আমার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে যোগ দিল। কেহ কেহ আমাকে কৈফিয়ৎ দিবার জন্য আহ্বান করিল।

 আমি কোন কথা বলিলাম না—চুপ করিয়া রহিলাম। আমার উপর দিয়া ঝড় বহিয়া গেল। আমি নিজের কথা সপ্রমাণ করিতে কিছুমাত্র চেষ্টিত হইলাম না—আমার বাক্যের ও চরিত্রের তীব্র সমালোচনাগুলিতেও কর্ণপাত করিলাম না। আমি বুঝিতাম, আমি কর্ত্তব্য করিয়াছি—যথাসময়ে আমার কৈফিয়ৎগুলি লোকেরা আপনাআপনিই বুঝিতে পারিবে। আমার আত্মরক্ষার জন্য এখন বাজারে নামিয়া প্রতিবাদ বা কথা কাটাকাটির প্রয়োজন নাই।

 সত্যই, তাহা হইল—ক্রমশঃ লোকেরা আমার মতই মানিয়া লইতে বাধ্য হইল। ধর্ম্মগুরুগণের চরিত্র সম্বন্ধে নানা স্থান হইতে নানা আপত্তি উঠিতে লাগিল, আমি ধীরভাবে দেখিতে লাগিলাম—কাল প্রভাবেই আমার কৈফিয়ৎ সমাজে পৌঁছিয়াছে।

 এই আটলাণ্টা বক্তৃতা সম্বন্ধেও তাহাই করিলাম। নিগ্রোসমাজের প্রতিকূল সমালোচনায় চুলমাত্র বিচলিত হইলাম না। সংবাদপত্রে আমার নিজের মত খোলসা করিয়া বলিবার প্রয়োজন বোধও করিলাম না।

 ইতিমধ্যে হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি শ্রীযুক্ত গিলম্যান পত্র লিখিলেন, “মহাশয়, আটলাণ্টা প্রদর্শনীর পুরস্কার নির্ব্বাচনব্যাপারে আপনাকে একজন পরীক্ষক মনোনীত করা হইয়াছে। আপনাকে শিক্ষা-বিভাগের প্রদর্শিত দ্রব্যগুলি পরীক্ষা করিতে হইবে। আপনার সময় হইবে কি? টেলিগ্রাফে উত্তর দিবেন।”

 আমি নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিলাম। নিগ্রো ও শ্বেতাঙ্গ উভয় প্রকার বিদ্যালয়ের ছাত্রদিগের কার্য্যই আমাকে পরীক্ষা করিতে হইল। বড় বড় বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণের সঙ্গে একত্র হইয়া আমি কার্য্য করিলাম।

 আমি বিচক্ষণ ব্যবসায়ীদিগের সভায় বক্তৃতা করিতে পাইলে সুখী হই। বোষ্টন, নিউ-ইয়র্ক, শিকাগো এবং বাষ্ণেলো ইত্যাদি নগরের ব্যবসায়িগণ অত্যন্ত ধীরবুদ্ধি সম্পন্ন এবং সহজেই প্রতিপাদ্য বিষয়ের সার কথা বুঝিয়া লইতে পারেন। ইহাঁদিগকে বেশী কথা বলিতে হয় না। ইহাঁরা অল্প কথার মানুষ। এই মহলে বক্তৃতা করিয়াই আমি সর্ব্বাপেক্ষা বেশী আনন্দ পাইয়াছি।

 তাহার পর আমি দক্ষিণ অঞ্চলের লোকজনকে শ্রোতৃমণ্ডলীরূপে পাইলে আনন্দিত হই। ইহারা বেশ উৎসাহশীল—সামান্য মাত্র উত্তেজনা পাইলেই বক্তাকে মাথায় করিয়া রাখিতে চায়।

 আমি এই হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদিগকে তৃতীয় স্থান দিয়া থাকি। হার্ভার্ড, ইয়েল, উইলিয়ম্‌স্, আমহার্ষ্ট, ফিস্ক, পেনসিলভেনিয়া, ওয়েলেস্‌লি, মিচিগান, ইত্যাদি আমেরিকার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অধ্যাপকগণের সভায় আমার বক্তৃতা দিতে হইয়াছে। ছেলে মহলে বক্তৃতা দিয়া আমার বেশী সুখ হয় না। আমি কাজের লোক পাইলেই খুসী হই।

 বাজারে একটা গুজব রটিয়াছে যে, নিগ্রো-রমণীদিগের মধ্যে শতকরা ১০ জনের চরিত্রও সৎ কি না সন্দেহ। এরূপ মিথ্যা অপবাদ প্রচার করা নিতান্তই অন্যায়। কোন সমাজ সম্বন্ধেই চরিত্রবিষয়ক মত প্রকাশ করা বড় কঠিন। আমি যদি নিউ ইয়র্ক নগরে জঘন্য মহল্লার লোক সংখ্যা গণনা করিয়া স্বপ্রমাণ করিতে চাহি যে, শ্বেতাঙ্গ সমাজে সচ্চরিত্রা রমণী একজনও নাই তাহাও এইরূপ দায়িত্বহীন মত প্রচার হইবে না কি?

 আমেরিকার সঙ্গে স্পেনের যুদ্ধ সমাপ্ত হইবার পর যুক্তরাজ্যের নানাস্থানে শান্তি উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য নানা উদ্যোগ হয়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আমাকে এক উৎসবে বক্তৃতা করিতে আহ্বান করেন। ১৬ই অক্টোবর রবিবার সন্ধ্যাকালে সভা হয়। এত বড় সভায় আমি আর কখনও বক্তৃতা দিই নাই। ১৬০০০ লোক সভায় উপস্থিত ছিল।

 এই সভায় যুক্তরাষ্ট্রের সভাপতি উইলিয়ম ম্যাক্‌ কিন্‌লিও উপস্থিত ছিলেন। আমি তাঁহাকে ধন্যবাদ দিতে যাইয়া বলিয়াছিলাম, “আপনার উদারতায় নিগ্রোজাতি স্বদেশের জন্য যুদ্ধ করিবার সুযোগ পাইয়াছিল। কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকা-সন্তান তাহার শ্বেতাঙ্গ ভাইএর সঙ্গে একক্ষেত্রে দাঁড়াইয়া শত্রুর বিরুদ্ধে কর্ম্ম করিয়াছিল। এজন্য আমরা আপনার নিকট কৃতজ্ঞ।” এই কথা শুনিবামাত্র সভামণ্ডপ মুখরিত করিয়া সভাপতি মহোদয়ের জয়ধ্বনি উত্থিত হইল। কিন্‌লি জনমণ্ডলীকে অভিবাদন করিবার জন্য আসন হইতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন—অমনি আবার গভীরতর জয়ধ্বনি উঠিতে লাগিল!

 সভাসমিতিতে বক্তৃতা করিতে গেলে একটা বিপদে প্রায়ই পড়িতে হয়। কতকগুলি হুজুগের পাণ্ডাদিগের পাল্লা এড়ান বড়ই মুস্কিল। ইহারা ‘রাতারাত’ বড়লোক করিবার উপায় প্রচার করিয়া বেড়ান। বিনা ক্লেশে নিগ্রোজাতির উদ্ধার সাধনের পথ আবিষ্কার করিয়াছেন বলিয়া ইহাঁরা হাটে বাজারে লোক জমা করেন। ইহারা ধৈর্য্য সহিষ্ণুতা ইত্যাদির একেবারেই পক্ষপাতী নন। ইহাঁরা অনেক সময় কেবল তর্কের খাতিরেই তর্ক করেন। যুক্তিতে পরাস্ত হইলেও ইহাঁরা তাহা স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হন। এই সকল ভবঘুরে তার্কিকদিগকে আমি দূর হইতে নমস্কার করি। তথাপি আমাকে বহুবার ইহাদের সঙ্গে বাক্‌যুদ্ধে শক্তির অপব্যয় করিতে হইয়াছে।

 আর এক জাতীয় লোক আছে। তাহারা নামজাদা লোকের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়া আনন্দ পায়। ইহারা একপ্রকার উৎপাত বিশেষ। কোন কাজ কর্ম্ম নাই—লোকের সময় নষ্ট করাই ইহাদের স্বধর্ম্ম। একদিন সন্ধ্যাকালে বোষ্টন-নগরের এক বড় সভায় বক্তৃতা করিয়াছি। পরদিন সকাল হইবার পূর্ব্বেই দেখি আমার নিকট এক কার্ড উপস্থিত। আমি তাড়াতাড়ি বিছানা হইতে উঠিয়া বৈঠকখানায় ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করিতে বাহির হইলাম। যাইয়া দেখি একটি লোক বসিয়া আছে। সে বলিল, “কাল রাত্রে আপনি বেশ ভাল কথা বলিয়াছিলেন। আমার ভাল লাগিয়াছে। তাই আজ সকালে আরও কিছু সৎকথা শুনিতে আসিলাম।”

 আমার বন্ধুগণ আমাকে অনেক সময়ে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, “ওয়াশিংটন, তুমি এত সময় পাও কোথায়? সর্ব্বদা ত তুমি বাহিরে বাহিরে দেশভ্রমণ করিয়াই বেড়াইতেছ? বক্তৃতা দিতেই তোমার সকল সময় চলিয়া যায়! তোমার টাস্কেজীর কাজকর্ম্ম চলে কিরূপে? অথচ টাস্কেজী ত দিন দিন উন্নতির পথেই অগ্রসর হইতেছে দেখিতেছি।”

 এই সকল প্রশ্নের আমি সাধারণ উত্তর দিয়া থাকি—“দেখ, একটা মামুলি কথা আছে যে, ‘নিজে যে কাজ করিতে পার অপরকে সেই কাজ করিতে বলিও না।’ আমি কিন্তু এই প্রবাদ বাক্য মানি না। আমি আর একটা নূতন নিয়ম করিয়াছি। আমার মত এই যে, ‘অন্য লোকে যে কাজটা বেশ ভাল করিয়া করিতে পারে, তাহার জন্য তুমি মাথা ঘামাইও না। তাহাকেই সেই কাজ করিতে দাও। তুমি নিশ্চিন্ত হইয়া অন্যান্য কাজ করিতে থাক।’ এই নিয়ম অনুসারে চলি বলিয়া আমার টাস্কেজী বিদ্যালয়ের কাজও কম হয় না, অথচ আমিও প্রায়ই টাস্কেজীর বাহিরে বাহিরে নানা কাজ করিয়া কাটাই।”

 টাস্কেজী বিদ্যালয় আজকাল বেশ পাকা বন্দোবস্তের উপর দাঁড়াইয়া গিয়াছে। ইহার পরিচালনার নিয়ম অতি সুন্দর ও শৃঙ্খলাযুক্ত রূপে গড়িয়া উঠিয়াছে। কোন একজন লোকের অভাব হইলে ওখানকার কার্য্যের বিশেষ ক্ষতি হয় না। কোন একজন ব্যক্তিকেই সর্ব্বদা এখানে লাগিয়া না থাকিলেও চলে। আজ আমাদের কর্ম্মচারীদিগের সংখ্যা ৮৬। শ্রমবিভাগ এবং দায়িত্ব বিভাগ এত সুন্দর ভাবে করা হইয়াছে যে, কলের মত কাজ চলিতে থাকে। অধিকাংশ শিক্ষক ও কর্ম্মচারীই অনেক দিন হইতে এই কার্য্যে নিযুক্ত আছেন। আমার মত ইহাঁরাও এই বিদ্যালয়ের জন্য দায়িত্ব বুঝিয়া চলেন। ইহাঁরা সকলেই নিজের কাজ স্বরূপ বিদ্যালয়ের কাজগুলি করিয়া থাকেন।

 অধিকন্তু, আমি পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, টাস্কেজীর সকল খবর রোজই আমার নিকট পৌঁছিয়া থাকে। আমি এজন্য দৈনিক কার্য্যাবলীর হিসাব রাখিবার এক অতি সহজ নিয়ম বাহির করিয়াছি। এই কার্য্যতালিকা ও হিসাব-বহি দেখিয়া আমি প্রতিদিনকার আয়, খরচ পত্র, ছাত্র সংখ্যা কার খানাগুলির অবস্থা, কৃষি ক্ষেত্রের আমদানী রপ্তানী, দেনা পাওনা, শিক্ষক ও ছাত্রদের সম্বন্ধ ইত্যাদি সকল কথাই বুঝিয়া লই। এমন কি, কোন্ ছাত্র কি কারণে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হইতে পারিল না, তাহা পর্য্যন্ত এই দৈনিক কার্য্যতালিকা হইতে জানিবার উপায় আছে। অধিক কি বলিব, মাংস আজ কাঁচা রান্না হইয়াছে কি পুড়িয়া গিয়াছে, এবং আজকার শাক শব্জীগুলি বাজার হইতে কিনিয়া আনা হইয়াছে কি আমাদের বাগান হইতেই আনিয়াছে তাহাও আমি ৪০০০ মাইল দূরে থাকিয়া জানিতে পাই!

 আমি প্রতিদিনই আমার দৈনিক কাজ শেষ করিয়া ফেলি। সুবিধা হইলে পর দিনের কাজও খানিকটা করিয়া রাখি। অবশ্য সর্ব্বদাই আমি দুর্ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকি। সকালের কার্য্য আরম্ভ করিবার সময়েই আমি ধরিয়া রাখি—আজ হয়ত কোন ঘরে আগুন লাগিবে, অথবা ছাত্রদের কোন দুর্ঘটনা ঘটিবে, অথবা কোন সংবাদপত্রে আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন হইতেছে দেখিতে পাইব, অথবা বাজারে আমার নিন্দা রটিতেছে শুনিতে পাইব। আমি প্রথম হইতেই এইরূপ দুর্ঘটনা, লোকনিন্দা, অপমান ও বিফলতার জন্য বুক বাঁধিয়া রাখি। এজন্য যখন আমার উপর দিয়া বিপদ বহিয়া যায় আমি বিচলিত হই না—গম্ভীর ভাবে স্থিরচিত্তে সকল যাতনা ও নৈরাশ্য ও বেদনা সহ্য করিতে থাকি। চিত্তকে প্রশান্ত রাখিবার জন্য আমি পূর্ব্ব হইতেই এইরূপ বিফলতার কথা ভাবিয়া রাখি। কাজেই বিফলতা আমাকে কাবু করিতে পারে না।

 আমি অবকাশ কাহাকে বলে জানি না। বিগত ১৯ বৎসরের মধ্যে আমি একদিনও কাজ হইতে ছুটি লই নাই। তবে ১৮৯৯ সালে কয়েক জন বন্ধু জোর করিয়া আমাকে ইউরোপ ভ্রমণে পাঠাইয়াছিলেন। তাঁহারাই সমস্ত ব্যয় বহন করিয়াছিলেন। এই জন্য তিন মাস আমার পূরাপূরি ছুটি ঘটিয়াছিল। তাহা ছাড়া বিশ্রাম, আরাম, বিদায় আমি কখনই ভোগ করিতে চেষ্টা করি নাই। আমি প্রতিদিন সুখে ঘুমাইবার আয়োজন করি। যথারীতি ঘুমাইতে পাইলে আমার কোন ক্লান্তির কারণ থাকে না। এখন শরীরকে এমন স্ববশ করিয়া ফেলিয়াছি যে, ২০ মিনিট মাত্র ঘুমাইতে পাইলেই নূতন উদ্যমে নূতন কাজে লাগিয়া যাইতে পারি।

 আমি কখনও কিছু পুস্তকাদি পাঠ করি কি? রেলগাড়িতে চলিতে চলিতেই যেটুকু পড়িবার সুযোগ পাই তাহা ছাড়া আমার ভাগ্যে আর পড়িবার সময় জুটে না। সংবাদপত্র পাঠ করিতে আমি বড়ই ভালবাসি। এ সব যত পাই তত পড়ি—ভাল মন্দ বিচার করিয়া দেখি না—এগুলি পড়া আমার একটা নেশা। উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি আমি চোখে দেখিতে পারি না। অনেক সময়ে ‘সভ্যতার খাতিরে’ মহাবিখ্যাত দুই একটা উপন্যাস পড়িতে বাধ্য হইয়া থাকি! তাহা না হইলে বন্ধুমহলে এবং ভদ্রসমাজে মুখ দেখান কঠিন হইয়া পড়ে। গ্রন্থের মধ্যে জীবন চরিতগুলি আমার অতি প্রিয় বস্তু। আমি কোন কাল্পনিক ঘটনা বা ব্যক্তির জীবন আলোচনা করিতে পছন্দ করি না। রক্তমাংসের মানুষ সংসারে যাহা যাহা করিয়াছে আমি সেই সমুদয়ের যথার্থ বৃত্তান্ত জানিতে উৎসুক। মহাপ্রাণ সভাপতি আব্রাহাম লিঙ্কলন সম্বন্ধে আমেরিকার সংবাদপত্রে, সমালোচনাপত্রে এবং গ্রন্থে ও পুস্তিকায় যে কোন রচনা প্রকাশিত হইয়াছে বোধ হয় আমি তাহার কোনটাই পড়িতে ছাড়ি নাই। সাহিত্য-সংসারের তিনি আমার ধ্রুবতারা। তাঁহার জীবনী আলোচনা করিয়াই আমি আমার কর্ম্মজীবন নিয়ন্ত্রিত করিয়া থাকি।

 বৎসরে বোধ হয় প্রায় ছয় মাস আমি টাস্কেজীর বাহিরে কাটাই। ইহাতে আমার অনেক উপকার হয়। প্রথমতঃ কার্য্য পরিবর্ত্তনই একটা বিশ্রাম স্বরূপ। নূতন নূতন লোকের সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া অভিনব কর্ম্মক্ষেত্রে আসিয়া নবজীবন লাভ করি। দ্বিতীয়তঃ একস্থানে থাকিলে সেই ক্ষেত্রের খুটিনাটিগুলি লইয়া দিন কাটাইতে হয়। একটা সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে জীবন ঘুরিতে থাকে। কর্ম্ম ও চিন্তাশক্তির বিকাশ বন্ধ হইয়া যায়। ফলতঃ চিত্তে স্ফূর্ত্তি ও আনন্দের অভাব ঘটিতে থাকে। কিন্তু তফাতে থাকিলে সেখানকার দোষ ও অসম্পূর্ণতাগুলি সর্ব্বদা চোখে পড়ে না। খানিকটা দূর ও বিস্তৃত দৃষ্টির সহিত সেই প্রতিষ্ঠানকে দেখিবার সুযোগ আসে। তৃতীয়তঃ, নূতন নূতন প্রতিষ্ঠান ও কর্ম্মকেন্দ্রের কার্য্যপ্রণালী দেখিয়া নানা বিষয়ে জ্ঞান বাড়িতে থাকে। বিদ্যাদানের বিচিত্র নিয়মগুলি নিজ চোখে দেখিয়া অভিজ্ঞতা লাভ হয়। এতদ্ব্যতীত বড় বড় পণ্ডিত, অধ্যাপক, বিজ্ঞানবীর, শিক্ষাপ্রচারক ও সাহিত্যরথীদিগের সঙ্গে আলাপ পরিচয় এবং ভাব বিনিময় হইতে থাকে। তাহাতেও বিশেষ লাভবান্ হওয়া যায়।