নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/ষোড়শ অধ্যায়

ষোড়শ অধ্যায়

ইউরোপে তিনমাস

 ১৮৯৯ সালে, আমার ৩৯।৪০ বৎসর বয়সে আমি ইউরোপে বেড়াইবার সুযোগ পাই। এই সুযোগ অতি অভাবনীয়রূপে আসিয়াছিল। ইহার পূর্ব্বে আমার ইউরোপ-ভ্রমণের সামান্য মাত্র আকাঙ্ক্ষা বা চেষ্টা ছিল না।

 একদিন সন্ধ্যাকালে বোস্টননগরের কয়েকজন ইয়াঙ্কি রমণী টাস্কেজীবিদ্যালয়ে অর্থসাহায্যের জন্য একটা সভা আহ্বান করিয়াছিলেন। ধূমপানের সহিত ঐ সভার কার্য্য সম্পন্ন হয়। আমিও সভার উপস্থিত ছিলাম। একজন আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “ওয়াশিংটন মহাশয়, আপনাকে বড়ই দুর্ব্বল ও ক্লান্ত বোধ হইতেছে। আপনি খাটিয়া খাটিয়া অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছেন। আপনার কিছুকাল কাজকর্ম্ম হইতে সম্পূর্ণরূপে বিদায় লওয়া আবশ্যক। অন্ততঃ মানসিক উদ্বেগ নিরারণের জন্য চেষ্টিত হওয়া উচিত।” অমনি আর একজন বলিলেন, “এদেশ ছাড়িয়া বাহিরে যাইতে পারিলেই আপনার উদ্বেগ কমিবে। দূরদেশে থাকিলে টাস্কেজীর জন্য চিন্তা কম করিতে হইবে। মনে শান্তি সর্ব্বদাই থাকিবে। ২৪ ঘণ্টা ভাবিয়া কাটাইবার প্রয়োজন হইবে না।” সেই সঙ্গে একজন তৃতীয় শ্বেতাঙ্গ রমণী জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কখনও ইউরোপ দেখিয়াছেন কি?” আমি অপর দুইজনকে বিশেষ কিছু বলিলাম না—আমার জন্য তাঁহারা চিন্তিত, এজন্য তাঁহাদিগকে ধন্যবাদ প্রদান করিলাম। এই রমণীকে বলিলাম “ইউরোপ যাইবার কথা এতদিন কখনও আমার মনেই আসে নাই।”

 কিছুদিন পরে একখানা পত্র পাইলাম, “বোষ্টনের কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ও রমণী আপনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করিতেছেন। আপনার স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য আপনি কিছুকাল ইউরোপ ভ্রমণ করুন—এইরূপ তাঁহাদের ইচ্ছা। আপনাকে যাইতেই হইবে। এ অনুরোধ অগ্রাহ্য করিবেন না। আমরা আপনার কাজের জন্য, আপনাদের বিদ্যালয়ের জন্য, আপনার জাতির জন্য এই অনুরোধ অথবা আজ্ঞা করিতেছি। আশা করি, আপনি নিগ্রোসমাজের ভবিষ্যৎ ভাবিয়া আমাদিগের এই আজ্ঞা শিরোধার্য্য করিবেন।”

 আমি আমার শ্বেতাঙ্গ বন্ধুগণকে জানাইলাম, “আপনাদের অনুগ্রহপত্র পাইয়া যার পর নাই কৃতার্থ হইয়াছি। কিন্তু আমার পক্ষে আমেরিকা ত্যাগ করা সম্প্রতি অসম্ভব। বৎসর খানেক পূর্ব্বে কথাচ্ছলে আমার একজন ধনী বন্ধু আমাকে এজন্য সমস্ত খরচ দিতে চাহিয়াছিলেন। তখন আমি তাঁহাকে অমান্য করিয়াছি। আমি আমার কাজে একেবারে ডুবিয়া আছি বলিলেই চলে। সে কথা আমার মন হইতে এত দূরে চলিয়া গিয়াছে, যে আপনাদের এই পত্র পাইবার পূর্ব্বে তাহা ভুলিয়াই গিয়াছিলাম। যাহা হউক, আমি আপনাদের সম্মান করিতে পারিলাম না। আমি আমেরিকা ছাড়িয়া গেলে, টাস্কেজীর অন্যান্য ক্ষতি কিছু হইবে না। কিন্তু আজকাল খরচ এত বাড়িয়াছে যে, সে সমুদয় আমি ব্যতীত আর কেহ সংগ্রহ করিতে পারিবে না। সুতরাং আমার ইউরোপ ভ্রমণ এবং টাস্কেজীর সর্ব্বনাশ এক কথা।”

 আমার পত্র পাইয়া একজন লিখিলেন,—“টাস্কেজীর খরচপত্রের জন্য ভাবিবেন না। আমরা তাহার সমস্ত দায়িত্ব লইতেছি। শ্রীযুক্ত হিগিনসন এবং তাহার বন্ধুবর্গ আপনার অনুপস্থিতিকালে বিদ্যালয়ের ব্যয়ের জন্য আবশ্যক টাকা দিবেন। তাঁহারা নিজেদের নাম প্রকাশ করিতে অনিচ্ছুক। সুতরাং আর আপত্তি করিবার আপনার অধিকার নাই।”

 কাজেই আমি ইউরোপ যাইতে বাধ্য হইলাম। আমার মনে অনেক কথা আসিতে লাগিল। আমার শৈশবের গোলামাবাদ, গোলামখানার অনশন ও অনিদ্রা, যৌবনের কঠোর জীবনসংগ্রাম—সর্ব্বদা দারিদ্র্য ও নৈরাশ্যের সহিত পরিচয়—সকল চিত্রই সম্মুখে উপস্থিত হইতে লাগিল। প্রৌঢ় বয়সের পূর্ব্বে আমি কখনও টেবিলে বসিয়া খানা খাইবার সুযোগ পাই নাই। ইউরোপ, লণ্ডন, প্যারি,—এ সকল স্থানকে আমি মানবদুর্ল্লভ স্বর্গরাজ্য বিবেচনাই করিতে শিখিয়াছি। আজ আমি সেই স্বর্গরাজ্যে বেড়াইতে চলিলাম! আজ আমি সুন্দর পোষাকে, সুখাদ্য ও সুপেয় উপভোগ করিতে করিতে ইউরোপ ভ্রমণে বাহির হইব! আমার নিকট সবই স্বপ্নের ন্যায় অলীক বোধ হইতে লাগিল।

 আরও দুইটি চিন্তায় আমি কষ্ট পাইতে লাগিলাম। মনে হইল—আমার জাতিরা আমাকে কি বলিবে? তাহারা ত বুঝিবে না যে, আমি বাধ্য হইয়া ইউরোপ যাইতেছি। তাহারা সহজেই ধরিয়া লইবে, আমার ‘চাল’ বাড়িয়াছে—আমি আজকাল বড় লোকের সঙ্গে মিশি, বড়মহলে চলাফেরা করি, সুখে স্বচ্ছন্দে দেশ বিদেশ ঘুরিয়া বেড়াই, এবং নানা উপায়ে নামজাদা লোক হইতে চেষ্টা করি। তাহারা আমার হৃদয়ের কথা ত বুঝিবে না—তাহারা আমাকে ক্ষমা করিবে না। তাহারা বলিবে, ‘জানি জানি খানিকটা কাজ করিবার পর সকলেরই মাথা বিগ্‌ড়াইয়া যায়—সকলেই ‘ধরাকে সরা’ জ্ঞান করে। ঐ সেদিন দেখিলে না, আর একজন নিগ্রো অধঃপাতে গেল। ভাবিয়াছিলাম সেই লোকটার দ্বারা নিগ্রো সমাজের উপকার হইবে। কিন্তু অল্পদিনের ভিতরই, সে সকলকে অগ্রাহ্য করিতে শুরু করিল। সে যেন কি অপরূপ জীব স্বর্গ হইতে মর্ত্ত্যে নামিয়া আসিয়াছে। সে আজ আমাদের পূজা চায়! ওয়াশিংটনও দেখিতেছি সেই বাবুগিরি ও ‘নেতা’-গিরির পথ ধরিল। ভাই, কথায় বলে, প্রতিষ্ঠা ও যশের আকাঙ্ক্ষা সাধু পুরুষদেরও ছাড়ে না। আর, একবার প্রতিষ্ঠার দিকে নজর গেলে কোন লোকের দ্বারা সংসারের উপকার হয় না। সুতরাং ওয়াশিংটনকেও খরচের খাতায় লেখ।”

 এই ত গেল লোক-নিন্দার ভয়, তাহা ছাড়া আমার নিজের মনকে প্রবোধ দিতেও অনেক সময় লাগিল। আমি না হয় টাস্কেজী বিদ্যালয়ের জন্য ৩।৪ মাসের খরচ পত্র পাইলাম। না হয় ধরিয়া লইলাম, আমার অভাবে এ কয়দিনে টাস্কেজীর কোন ক্ষতিই হইবে না। কিন্তু আমি এতকাল না খাটিয়া, না ভাবিয়া থাকিব কি করিয়া? আমার কর্ত্তব্যজ্ঞান কি নাই? আমি কি ভগবানকে ফাঁকি দিতে বসিয়াছি? আমি এইরূপ বিদায় লইয়া কি স্বার্থপরতা দেখাইতেছি না? কাজ ছাড়িয়া থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব—জীবনে আর কোন দিন অবকাশ ভোগ ত করি নাই।

 যাহা হউক, যাইতে বাধ্য হইলাম। ১০ই মে তারিখে রওনা হওয়া গেল। শ্রীযুক্ত গ্যারিসন এবং অন্যান্য ইয়াঙ্কি বন্ধুগণ ফ্রান্সে এবং ইংলণ্ডে তাঁহাদের কয়েকজন বন্ধুর নিকট আমাকে পরিচয়-পত্র দিলেন। তাঁহারা নানা স্থানে লিখিয়া আমার জন্য থাকিবার ও অন্যান্য ব্যবস্থা ইত্যাদি করিয়া রাখিলেন। নিউইয়র্কে জাহাজে উঠিলাম। জাহাজে থাকিতে থাকিতে একখানা পত্র পাইলাম। লেখা আছে দুইজন রমণী টাস্কেজী বিদ্যালয়ের স্ত্রীশিক্ষাবিভাগের জন্য গৃহনির্ম্মাণের ব্যয়ভার বহন করিবেন।

 আমাদের জাহাজের নাম ফ্রিস্‌ল্যাণ্ড। রেড্‌ষ্টার লাইন কোম্পানীর ইহা একখানা বৃহৎ ও সুন্দর জাহাজ। পূর্ব্বে আমি কখনও এত বড় সমুদ্র-পোতে চড়ি নাই। সুতরাং এদিক ওদিক ঘুরিয়া জাহাজ দেখার কৌতুহল মিটাইয়া লইলাম। ভাবিয়াছিলাম, জাহাজে নিগ্রো বলিয়া আমাদের যথেষ্ট অসম্মান ভোগ করিতে হইবে। কিন্তু আমাদের সেরূপ কিছু ভোগ করিতে হইল না। জাহাজের কাপ্তেনেরা আমাকে চিনিতেন বুঝিতে পারিলাম।

 জাহাজ ছাড়িবার পর হইতে বহুদিনের বোঝা যেন একসঙ্গে আমার ঘাড় হইতে নামিয়া গেল। আমি আমার কামরার মধ্যে রোজ ১৫ ঘণ্টা করিয়া ঘুমাইতাম। তখন বুঝিলাম, সত্য সত্যই আমার শারীরিক ক্লান্তি ও দুর্ব্বলতা কত বেশী ছিল। এই কয়দিন একস্থানে এক বিছানায় এতক্ষণ ঘুমাইতাম, অথচ দিনে রাত্রের মধ্যে কোন সময় নির্দ্দিষ্ট কোন কাজই ছিল না। আমার জীবনে এইরূপ অভিজ্ঞতা আর কখনও পাই নাই। আমি সেই বাল্যকথাগুলি স্মরণ করিলাম—সেই যখন আমি একরাত্রে তিন পল্লীর মেজেতে শুইয়া অনশনে কাটাইয়াছি।

 দশদিন জাহাজ চলিয়া বেলজিয়াম দেশের য়্যাণ্টোয়ার্প নগরে পৌঁছিল। সেদিন ওদেশে একটা ছুটির দিন ছিল। সকলেই আনন্দে উৎসবে মগ্ন। বেলজিয়ামের লোকেরা বৎসরে এইরূপ অনেক আনন্দের দিন সুখে কাটাইয়া থাকে। সহরের বড় মাঠের সম্মুখেই আমাদের হোটেল। আমরা কামরা হইতে সেই উদ্যানের সকল দৃশ্যই দেখিতে পাইলাম। পল্লী হইতে নগরে কত লোক আসিয়াছে। নানা রংয়ের ফুল বিক্রী হইতেছে। স্ত্রীলোকেরা দুধের ভাঁড় আনিয়াছে। ভাঁড়গুলি খুব বড় বড় ও চক্‌চকে। কুকুরে এই সকল বহিয়া আনে। লোকজন গির্জ্জার মধ্যে প্রবেশ করিতেছে। এই দৃশ্য আমার চোখে সম্পূর্ণ নূতন জগতের বার্ত্তা আনিয়া দিল।

 কিছুকাল এই সহরে কাটাইলাম। পরে কয়েকজন বন্ধুর নিমন্ত্রণ পাইয়া তাঁহাদের সঙ্গে হল্যাণ্ডদেশ দেখিতে গেলাম। আমাদের দলে কয়েকজন ইয়াঙ্কি পুরুষ ছিলেন। আমাদের জাহাজেই ইহাঁরা আমেরিকা হইতে আসিয়াছেন। ইহাঁদের মধ্যে কেহ কেহ চিত্রকর—ছবি আঁকিতে বেশ নিপুণ এই ভ্রমণটা অতিশয় সুখকরই হইয়াছিল। একটা পুরাতন ধরণের নৌকায় করিয়া হল্যাণ্ডের খালে খালে বেড়াইতে পাইয়াছিলাম। এই উপায়ে এদেশের পল্লী-জীবন অনেকটা বুঝিতে পারিলাম। খাল দিয়া পল্লীগ্রামগুলি দেখিতে দেখিতে আমরা রটার্ডামে পৌঁছিলাম। তার পর হেগ দেখিতে গেলাম। সেখানে তখন জগতের রাষ্ট্রনীতিবিশারদেরা শান্তি-সম্মিলনে ব্যাপৃত। আমাদের স্বদেশীয় প্রতিনিধিরাও এ সভায় যোগ দিতে আসিয়াছেন। তাঁহারা আমাদিগকে দেখিয়া আপ্যায়িত করিলেন।

 হল্যাণ্ডের কৃষিকার্য্য আমার পক্ষে যথেষ্ট শিক্ষাপ্রদ হইয়াছিল। এখানকার পশুপালনও বেশ দক্ষতার সহিত হইয়া থাকে। হলষ্টাইন-নগরের গাভী বলদ ইত্যাদি জগতে সর্ব্বোৎকৃষ্ট মনে হইল। হল্যাণ্ডবাসী কৃষকেরা অতি সামান্য মাত্র ভূমি হইতে অত্যন্ত বেশী পরিমাণ ফসল উৎপাদন করিয়া থাকে। কৃষিকার্য্যে ইহাদের ক্ষমতা দেখিয়া আমি বিস্মিত হইয়াছিলাম। পূর্ব্বে আমি কখন ভাবিতে পারিতাম না যে অত কম জমি চষিয়া অত বেশী ফল পাওয়া যায়। দেখিয়া বোধ হইল হল্যাণ্ডের এক ছটাক জমিও বাজে পড়িয়া নাই—সর্ব্বত্রই সুন্দর চাষ আবাদ হইতেছে। আর চারিদিকেই শস্যশ্যামল প্রান্তর তাহার মধ্যে ৪০০।৫০০ বলিষ্ঠ গাভী আনন্দে বিচরণ করিতেছে। এরূপ গোচারণের মাঠ এবং সুন্দর কৃষিকার্য্য দেখিবার জন্য সকলেরই একবার হল্যাণ্ড যাওয়া উচিত।

 হল্যাণ্ড হইতে আবার বেলজিয়ামে ফিরিয়া আসিলাম। এবারে য়্যাণ্টোয়ার্পে গেলাম না। ব্রসেল্‌সে অল্পক্ষণ ছিলাম। এখানে ওয়াটার্লুর যুদ্ধক্ষেত্র দেখিয়া আসিলাম। পরে ফ্রান্সে চলিলাম—প্রথমেই প্যারিনগরে নামিলাম। পৌঁছিবামাত্রই এক নিমন্ত্রণ পাওয়া গেল। প্যারির ইউনিভার্সিটি-ক্লব আমাদের আমেরিকাবাসী কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। ফ্রান্সের যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি এই নিমন্ত্রণ-সভায় সভাপতি হইয়াছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব্বর্তন সভাপতি শ্রীযুক্ত হ্যারিসনকেও এই নিমন্ত্রণে যোগদান করিতে আহ্বান করা হইয়াছিল। তিনিও উপস্থিত ছিলেন।

 ভোজনান্তে যথাবিধি বক্তৃতা হইল। হ্যারিসন মহোদয় আমার কথা এবং টাস্কেজীবিদ্যালয়ের কথা সভামধ্যে প্রচার করিলেন। আমার দ্বারা নিগ্রোসমস্যার কিরূপ মীমাংসা হইতেেছে তাহাও তিনি কিছু বুঝাইলেন।

 প্যারিনগরে আমেরিকার একজন নিগ্রো চিত্রকরের সুখ্যাতি ছড়াইয়া পড়িয়াছে। তিনি ফ্রান্সে বেশ নাম করিয়াছেন বুঝিতে পারিলাম। সকল শ্রেণীর ফরাসীরাই ইহাঁর কারুকার্য্যের প্রশংসা করিয়া থাকেন। এমন কি লাক্সেমবার্গ প্যালাসের চিত্রভবনে তাঁহার হাতের কাজ রক্ষিত হইয়াছে। এত বড় চিত্রশালায় নিগ্রোর স্থান হইয়াছে শুনিয়া ফ্রান্সের ইয়াঙ্কিরা আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন। এই নিগ্রো চিত্রকরের নাম হেন্‌রি ট্যানার। তাঁহার সঙ্গে আমাদের আলাপও হইল। তাঁহাকে দেখিয়া আমার মনে হইল, ‘রূপেতে কি করে বাপু গুণ যদি থাকে?’ জগৎ গুণের দাস। বিদ্যাবুদ্ধি থাকিলে সংসারের সকলকেই বশে আনা যায়। একথা আমি আমার নিগ্রো ভ্রাতাদিগকে সর্ব্বদাই বলিয়া আসিয়াছি। ফ্রান্সে ট্যানারের প্রতিপত্তি দেখিয়া সেই কথা আমার বার বার মনে হইতে লাগিল। ইউরোপের ও আমেরিকার কত শত লোক ট্যানারের অঙ্কিত চিত্রগুলি দেখিয়া গিয়াছেন। কিন্তু কেহ ত কখনও জিজ্ঞাসা করেন নাই—“ও গুলি কাহার তৈয়ারী? সে ব্যক্তির চামড়া সাদা কি কাল, সে কি ইংরাজ না জার্ম্মাণ, না আমেরিকার নিগ্রো?” যে ব্যক্তিই কোন কাজ ভাল করিয়া করিতে পারিবে সে মানবসংসারে প্রতিষ্ঠালাভ করিবেই। তাহাকে ছাড়িয়া দিলে মানবজাতি দরিদ্র হইবে।

 ফরাসীজাতিটাকে বড় হুজুগপ্রিয় বোধ হইল। ইহারা সুখভোগে ও বিলাসে যেন হাবুডুবু খাইতেছে। ইহাদের নৈতিক চরিত্র বড় বেশী উচ্চ অঙ্গের ভাবিতে পারিলাম না। আমাদের কৃষ্ণাঙ্গসমাজ অপেক্ষা ফরাসীজাতির এ বিষয়ে কোন উৎকর্ষ লক্ষ্য করা গেল না। অবশ্য ইহারা আমাদের অপেক্ষা পুরাতন জাতি। ইউরোপের বিশাল মানবসমাজের মধ্যে থাকিতে থাকিতে ইহাদের বিদ্যাবুদ্ধি খানিকটা বেশী মার্জ্জিত হইয়াছে। জীবনসংগ্রামের অত বড় আবর্ত্তের মধ্যে পড়িয়া বাঁচিয়া থাকিতে হইলে নানা প্রকার সামর্থ্যের প্রয়োজন হয়। আর সংগ্রাম করিতে করিতে নানাবিধ শক্তি নূতন অর্জ্জিতও হইয়া থাকে। আমার স্বজাতিও কালে এইরূপ শক্তিসম্পন্ন হইয়া উঠিবে—সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। ফরাসীরা জীবন কিছু আগে আরম্ভ করিয়াছে—আমরা সংসারে কিছু পরে আসিয়া দেখা দিয়াছি। এই যা প্রভেদ। ফরাসীদিগকে সত্যবাদী মনে হইল না। তাহারা কথার মূল্যও বেশী স্বীকার করে না। এ সকল বিষয়ে উহারা আমেরিকার নিগ্রোর অপেক্ষা উচ্চ স্তরের লোক কোন মতেই নয়। কোন কোন বিষয়ে নিগ্রোরাই উহাদের অপেক্ষা বোধ হয় উন্নত। কারণ জীবে দয়া ইহাদের নাই বলিলেই চলে। ইহারা গো-বলদ ইত্যাদি জীবজন্তুর প্রতি বড়ই নির্ম্মম। মোটের উপর, ফ্রান্স ছাড়িয়া যাইবার সময়ে আমার স্বজাতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অতি উজ্জ্বল আশাই আমার চিত্ত অধিকার করিল।

 প্যারি হইতে লণ্ডনে পৌঁছিলাম। তখন জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ। ইংলণ্ডের রাজধানীতে মহা সমারোহ চলিতেছে। পার্ল্যামেণ্ট মহাসভার অধিবেশন শুরু হইয়াছে। আমার ইয়াঙ্কি বন্ধুগণ প্রথম হইতেই ইংলণ্ডে অনেকের নিকট পত্র দিয়া রাখিয়াছিলেন। আমি পৌঁছিবামাত্র সকলেই আমাকে বক্তৃতা দিতে অনুরোধ করিলেন। আমি স্বাস্থ্যের জন্য বেড়াইতে আসিয়াছি এই আপত্তি তুলিয়া অনেকগুলি এড়াইতে পারিলাম। কিন্তু দুই একস্থলে আমি বক্তৃতা করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। লণ্ডনে, বার্ম্মিংহামে, ব্রিষ্টলে বড় বড় লোকেরা আমাকে অতিথি হইতে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন।

 ইংলণ্ডের অনেক স্থানেই গোলামী নিবারণ সমিতির বন্ধু ও সভ্যগণের সঙ্গে আলাপ হইয়াছিল। তাঁহারা আমেরিকার দাসত্বপ্রথার বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাহায্যই করিতেন বুঝিতে পারা গেল।

 ব্রিস্টলে এক মহাসভার অধিবেশনে যোগদান করি। সেখানে রাণী ভিক্টোরিয়া উপস্থিত ছিলেন। তাঁহার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়।

 পার্ল্যামেণ্টের কমন্স-ভবনে একদিন ষ্ট্যান্‌লি মহোদয়ের সঙ্গে কথাবার্ত্তা হয়। তিনি আফ্রিকার অনেক গল্প করিলেন। তাহাতে বুঝিলাম, আমেরিকার নিগ্রোরা মাতৃভূমি আফ্রিকায় ফিরিয়া গেলে বড় সুখী হইতে পারিবে না। আমেরিকাকেই তাহাদের জন্মভূমি ও মাতৃভূমি বিবেচনা করা কর্ত্তব্য। আমেরিকাই তাহাদের এক্ষণে স্বদেশ, সুতরাং ভূস্বর্গ।

 আমরা দুই চারিজন সম্ভ্রান্ত ইংরাজের পল্লী-গৃহে বাস করিবার সুযোগ পাইয়াছিলাম। তাঁহাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন দেখিয়া বোধ হইয়াছিল, আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ অপেক্ষা ইংলণ্ডের শ্বেতাঙ্গেরা বেশী সভ্য ও সুখী। ইহাঁদের পারিবারিক প্রথা ও গৃহস্থালী আমার নিকট আদর্শ জীবনযাপন প্রণালী মনে হইত। ইহাঁরা সুখে স্বচ্ছন্দে থাকিতে জানেন। কলের মত ইহাঁদের কাজকর্ম্ম সম্পন্ন হয়।

 এদেশের চাকরেরাও বেশ ভদ্রতা জানে। আমেরিকায় ভৃত্য ত পাওয়াই যায় না। আর তাহারা মনিবগণকে সম্মান আদৌ করে না। আমেরিকার চাকরেরা বুঝে যে, তাহারা দুই চারি বৎসরের ভিতরই হয় ত মনিব হইয়া পড়িবে! ইংলণ্ডের চাকরেরা চিরজীবন চাকরই থাকিবে, সুতরাং বড় আকাঙ্ক্ষা তাহাদের নাই। কোন্ নিয়ম ভাল? তাহার উত্তর এ যাত্রায় আর দিলাম না।

 ইংলণ্ডের লোকেরা আইন ও শাসনের নিয়মগুলি সম্মান করিয়া চলে। অতি সহজেই এখানে বড় বড় কাজ নিষ্পন্ন হইয়া যায়। ইংরাজজাতি কিছু বেশী ধীর—সকল কাজেই ইহারা সময় অধিক লইয়া থাকে। ইহাদের খানা খাইতে খুব বেশী সময় লাগে। স্থিতিশীল ইংরাজের উল্টা আমাদের আমেরিকার ইয়াঙ্কি। ইয়াঙ্কিরা বড়ই তড়বড়ে—২৪ ঘণ্টা চলাফেরা করিতেছে—সর্ব্বদাই উদ্বিগ্ন, শশব্যস্ত—চুপ করিয়া অথবা সময় বেশী খরচ করিয়া কোন কাজ ইহারা করিতে জানে না। কিন্তু স্থিতিশীল ইংরাজেরা গতিশীল ইয়াঙ্কি অপেক্ষা মোটের উপর কম কাজ করে কি?

 ইংরাজেরা আমেরিকাবাসীর তুলনায় গম্ভীর ও চিন্তাশীল। ইহারা কথায় কথায় হো হো করিয়া হাসে না বা কোন কিছু প্রস্তাবে হঠাৎ উত্তেজিত হইয়া যায় না। ইহারা শান্তভাবে বিষয়টা তলাইয়া দেখিবার ও বুঝিবার চেষ্টা করে।

 ইউরোপে তিনমাস কাটিয়া গেল। পরে ‘সেণ্টলুই’ জাহাজে ইংলণ্ডের সাদাম্পটন বন্দর হইতে আমেরিকা যাত্রা করিলাম।

 ফ্রান্সে থাকিতে থাকিতে আমি ওয়েষ্ট-ভার্জ্জিনিয়া প্রদেশ হইতে দুইখানা পত্র পাই। এই প্রদেশের ম্যাল্‌ডেন নগরে আমার বাল্যজীবন কাটিয়াছে। একখানা পত্র প্রদেশরাষ্ট্রের কর্ত্তা চার্লষ্টন-নগরের শাসন-কর্ত্তারা লিখিয়াছেন। আর একখানা চার্লষ্টনের নিগ্রো ও শ্বেতাঙ্গ সমাজদ্বয়ের গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবৃন্দ ও জনসাধারণ লিখিয়াছেন। দুইটাতেই আমাকে ইউরোপ হইতে ফিরিবার সময়ে চার্লষ্টন হইয়া যাইবার অনুরোধ ছিল। আমি আমার বাল্য-লীলার নিকেতন হইতে এই নিমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করিতে পারিলাম না।

 যথা সময়ে চার্লষ্টনে গাড়ী হইতে নামিলাম। প্রদেশরাষ্ট্রের ভূতপূর্ব্ব শাসন কর্ত্তা এবং অসংখ্য লোক আমাকে অভ্যর্থনা করিলেন। তারপরদিন বর্ত্তমান শাসন-কর্ত্তার গৃহে দরবার হইল। সেইখানে আমাকে লইয়া যথেষ্ট আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা হইয়াছিল।