নীল তারা ইত্যাদি গল্প/তিলোত্তমা
তিলোত্তমা
সিদ্ধিনাথের নাম আপনারা শুনে থাকবেন।[১] বিদ্যার খ্যাতি আছে, সরকারী কলেজে পড়াতেন, কিন্তু মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় চাকরি ছেড়ে তিন বৎসর প্রায় নিষ্কর্মা হয়ে বাড়িতে বসে ছিলেন। এখন ভাল আছেন, শিবচন্দ্র কলেজে পড়াচ্ছেন। সম্প্রতি কুবুদ্ধির উৎপত্তি সম্বন্ধে থিসিস লিখে পিএচ. ডি. ডিগ্রী পেয়েছেন।
সিদ্ধিনাথের বাল্যবন্ধু উকিল গোপাল মুখুজ্যের বাড়িতে যথারীতি সান্ধ্য আড্ডা বসেছে। উপস্থিত আছেন—গোপালবাবু, তাঁর পত্নী নমিতা, নমিতার ছোট বোন (সিদ্ধিনাথের ভূতপূর্ব ছাত্রী) অসিতা, অসিতার স্বামী রমেশ ডাক্তার, আর সিদ্ধিনাথ। সিদ্ধিনাথের বাড়ি খুব কাছে। তাঁর স্ত্রী নবদুর্গা একটু সেকেলে, এই মেয়ে পুরুষের আড্ডায় তিনি আসেন না।
আড্ডারম্ভে গোপালবাবু বললেন, ওহে সিদ্ধিনাথ, তুমি ডক্টরেট পেয়েছ তাতে আমরা সবাই খুব খুশী হয়েছি। এই সম্মান তোমার বিদ্যের তুলনায় অবশ্য কিছুই নয়, তবে শোনায় ভাল—ডক্টর সিদ্ধিনাথ ভট্টাচার্জি। নমিতা তোমাকে আর অশ্রদ্ধা করতে পারবে না।
নমিতা বললেন, ডক্টর একটা নিতান্ত বাজে উপাধি, গণ্ডা গণ্ডা ডক্টর পথে ঘাটে গড়াগড়ি যাচ্ছে। আমি ওঁকে একটি ভাল উপাধি দিচ্ছি—বকবক্তা।
অসিতা বলল, মানে কি দিদি?
—মানে খুব সোজা। যে বকে সে বক্তা, আর যে বকবক করে সে বকবক্তা।
সিদ্ধিনাথ বললেন, থ্যাংক ইউ নমিতা দেবী, আপনার প্রদত্ত উপাধিটির মর্যাদা রাখতে আমি সর্বদাই চেষ্টা করব।
নমিতা বললেন, তবে আর সময় নষ্ট করেন কেন, আপনার বকবক্তৃতা এখনই শুরু করুন না।
—কোন্ বিষয় শুনতে চান? শংকরের অদ্বৈতবাদ, মার্কসের দ্বান্দ্বিক জড়বাদ, শরীরতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, না পরলোকতত্ত্ব?
গোপালবাবু বললেন, এসব নবিস তত্ত্ব শুনতে চাই না। প্রেমের কথা যদি তোমার কিছু জানা থাকে তো তাই বল।
—হাড়ে হাড়ে জানা আছে। আমি নিজেই একবার বিশ্রী রকম প্রেমে পড়েছিলুম।
নমিতা বললেন, আম্পর্ধা কম নয়! বাড়িতে পাহারাওয়ালী গিন্নী থাকতে প্রেমে পড়লেন কোন্ আক্কেলে? বলতে লজ্জা হয় না?
—মানুষের যা স্বাভাবিক ধর্ম তা স্বীকার করতে লজ্জা হবে কেন। আপনার মুখেই তো শুনেছি যে অসিতার বউভাতের ভোজে আপনি গবগব করে চার গণ্ডা ভেটকি মাছের ফ্রাই খেয়েছিলেন। তার জন্যে তো আপনাকে রাক্কুসী কি মেছোপেতনী বলছি না।
গোপালবাবু বললেন, আঃ ঝগড়া কর কেন। নমিতা, সিধুকে বলতে দাও তোমার মন্তব্য শেষে ক’রো।
সিদ্ধিনাথ বলতে লাগলেন।—ব্যাপারটা ঘটেছিল আমার বিবাহের আগে, গিন্নী থাকতে প্রেম হবার জো কি। তখন বয়স বাইশ-তেইশ, পোস্টগ্রাজুয়েটে পড়ি, বাবা মা দুজনেই বর্তমান। ওহে রমেশ ভাক্তার, তোমাদের শাস্ত্রে এই কথা বলে তো—কোনও দেশে একটা নতুন ব্যাধি যদি আসে তবে প্রথম প্রথম তা মারাত্মক হয়, কিন্তু দু-এক শ বছর পরে তার প্রকোপ অনেক কমে যায়?
রমেশ বলল, আজ্ঞে হাঁ, কোনও কোনও রোগের বেলা তাই হয় বটে।
—প্রেমও সেই রকম ব্যাধি। এর তিন দশা আছে। প্রাইমারি স্টেজে প্রেম হল নাইণ্টি পারসেণ্ট লালসা, টেন পারসেণ্ট ভালবাসা। সেকণ্ডারি স্টেজে হাফ অ্যাণ্ড হাফ; টারশারিতে প্রায় সবটাই ভালবাসা, নামমাত্র লালসা। পুরাকালে পূর্বরাগ অর্থাৎ প্রেমের প্রথম আক্রমণ অতি সাংঘাতিক হত। কাদম্বরীতে বাণভট্ট লিখেছেন—মহাশ্বেতার প্রেমে পড়ে পুণ্ডরীক হার্ট ফেল করে মারা যায়। আরব্য উপন্যাসের অনেক নায়ক নায়িকা প্রেমে শয্যাশায়ী হত। অমন যে জবরদন্ত রাজর্ষি আরংজেব বাদশা, তিনিও প্রথম যৌবনে গোলকণ্ডার এক নবাবনন্দিনীকে দেখে মরণাপন্ন হয়েছিলেন। আজকাল এরকম বড় একটা দেখা যায় না, কারণ মেয়ে পুরুষ সবাই খুব হিসেবী হয়েছে, তা ছাড়া দেদার প্রেমের গল্প পড়ে আর সিনেমার ছবি দেখে দেখে খানিকটা ইমিউনিটিও এসেছে। কিন্তু দৈবক্রমে আমি যে প্রেমের কবলে পড়েছিলাম তা সেই সেকেলে ভিরুলেণ্ট টাইপের। তবে বেশী ভুগতে হয় নি, পাঁচ দিনের মধ্যেই সেরে উঠি।
নমিতা বললেন, কিসে সারল, পেনিসিলিন না খ্যাপা কুকুরের ইনজেকশনে?
—ওষুধের কাজ নয়। গুরুর কৃপায় সেরেছিল।
—আপনি তো পাষণ্ড লোক, আপনার আবার গুরু কে?
—যিনি জ্ঞানদাতা বা শিক্ষাদাতা তিনিই গুরু। সম্প্রতি আমার দুটি গুরু জুটেছে— আমার ছাত্র পরাশর হোড়, আর এ পাড়ার বকাট ছোকরা গুলচাঁদ। পরাশরের কাছে কবিতা রচনা শিখছি, আর গুলচাঁদের কাছে বাইসিক্ল চড়া।
অসিতা বলল, সার আপনি তো বলতেন যে কাব্যচর্চা আর গাঁজা খাওয়া দুই সমান, তবে শিখছেন কেন? কিছু লিখছেন নাকি?
—রাম বল। লেখবার জন্যে শিখছি না, শুধু কবিতা লেখার প্যাঁচটা জানতে চাই। আর বাইসিক্ল শিখছি ট্রাম-বাসের ভাড়া বাঁচাবার জন্যে। দেখ অসিতা, কবিতা লেখা অতি সোজা কাজ, মাস খানিক প্র্যাকটিস করলে তুমিও পারবে, হয়তো তোমার দিদিও বছর খানিক চেষ্টা করলে পারবেন। কেন যে লোকে কবিদের খাতির করে—
নমিতা বললেন, বাজে কথা রাখুন। কার সঙ্গে প্রেম হয়েছিল? অত চট করে সারলই বা কি করে? প্রতিদ্বন্দী আপনাকে ঠেঙিয়েছিল নাকি?
—ধৈর্য ধরুন, যথাক্রমে সবই শুনবেন। প্রেমে পড়ার চারপাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই কাবু হয়েছিলাম। আহারে রুচি নেই, মাথা টিপটিপ করে, বুক ঢিপঢিপ করে, ঘুম মোটেই হয় না, লেখাপড়া চুলোয় গেল, চব্বিশ ঘণ্টা শয্যাশায়ী। মা বললেন, হাঁরে সিধু তোর হয়েছে কি? কপালটা যেন ছ্যাঁকছ্যাঁক করছে। বাবা ডাক্তার ডাকালেন। নাড়ী জিব বুক পেট সব দেখে ডাক্তার বললেন, ডেংগু মনে হচ্ছে, ভয়ের কারণ নেই, নড়াচড়া বন্ধ রাখবে, লিকুইড ডায়েট চলবে। এক আউন্স ক্যাস্টর অয়েল এখনই খাইয়ে দিন, আর দশ গ্রেন কুইনীন নেবুর রস দিয়ে জলে গুলে এবেলা একবার ওবেলা একবার। মুখেটা তেতো রাখা দরকার।
রামদাস কাব্যসাংখ্যবেদান্তচুঞ্চু তখন ইউনিভার্সিটিতে প্রাচ্যদর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। এখন তিনি নাগপুরে আছেন। বয়স বেশী নয়, আমার চাইতে ছ-সাত বছরের বড়। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতরা একটু রসিক হয়ে থাকেন। রামদাসও রসিক লোক, ছাত্রদের সঙ্গে ইয়ারকি দিতেন, কিন্তু সকলেই তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করত। আমাকে তিনি বিশেষ রকম স্নেহ করতেন, কারণ বিদ্যায় আর রূপে আমিই ক্লাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলুম।
নমিতা বললেন, জন্ম ইস্তক বিদ্যের জাহাজ ছিলেন তা না হয় মানলুম, কিন্তু রূপ আবার কোথায় পেলেন? এই তো গুলিখোরের মতন চেহারা, গরুর মতন ড্যাবডেবে চোখ, শুওরকুঁচির মতন চুল—
—সকলেই আপনার মতন অন্ধ নয়, সমঝদার রূপদর্শী লোক ঢের আছে। দু দিন আমাকে ক্লাসে দেখতে না পেয়ে চুঞ্চু মশায় জিজ্ঞাসা করলেন, সিদ্ধিনাথ কামাই করছে কেন? ছাত্ররা বলল, তার ভারী অসুখ। আমার বাবার সঙ্গে তাঁর বাবার বন্ধুত্ব ছিল। সেই সূত্রে চুঞ্চু মশায় মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসতেন। অসুখ শুনে আমাকে দেখতে এলেন।
নমিতা বললেন, বকবক করে শুধু রাজে কথা বলছেন। প্রেমে পড়লেন অথচ প্রেমপাত্রীটির কোনও খবর নেই। তার নাম কি, পরিচয় কি, দেখতে কেমন, সব বৃত্তান্ত খুলে বলুন, আপনার রামদাস চুঞ্চুর কথা শুনতে চাই না।
—ব্যস্ত হবেন না, কি জাতি কি নাম ধরে কোথায় বসতি করে সবই শুনতে পাবেন। মেয়েটি দেখতে কেমন তা জানবার জন্যে ছটফট করছেন, নয়? আচ্ছা এখনই বলে দিচ্ছি —অতি সুশ্রী গৌরী তন্বী, আপনার মতন গোবদা নয়, হিংসুটেও নয়। গোপাল কি দেখে যে আপনার প্রেমে মজেছে তা বুঝতেই পারি না।
—বোঝবার কোনও দরকার নেই, পরচর্চা না করে নিজের কথা বলুন।
—শুনুন। চুঞ্চু মশায় যখন দেখতে এলেন তখন আমার ঘরে আর কেউ ছিল না। আমি চিতপাত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি, কপালে ওডিকলোনের পটি, চোখে উদাস করুণ দৃষ্টি, মুখ দিয়ে মাঝে মাঝে আঃ ইঃ উঃ এঃ ওঃ প্রভৃতি কাতর ধ্বনি বেরুচ্ছে।
রামদাস প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে সিদ্ধিনাথ?
বললুম, কি জানি সার। শরীর অত্যন্ত খারাপ, বড় যন্ত্রণা, আমি আর বাঁচব না।
চুঞ্চু মশায় আমার নাড়ী দেখলেন, চোখ দেখলেন, বুকে আর পিঠে হাত বুলুলেন। তার পর ঠোঁট কুঁচকে মাথা নেড়ে বললেন, হুঁ, সব লক্ষণ মিলে যাচ্ছে।
—কিসের লক্ষণ পণ্ডিত মশায়?
—সাত্ত্বিক বিকারের অষ্ট লক্ষণ প্রকট হয়েছে—স্তম্ভ স্বেদ রোমাঞ্চ স্বরভঙ্গ বেপথু বৈবর্ণ্য অশ্রু, মূর্ছা।
—সাত্ত্বিক বিকার মানে কি সার?
—মানে, তুমি ঘোরতর প্রেমে পড়েছ, সুদুস্তর পঙ্কে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছ। ঠিক বলেছি কি না?
আমি ঢাকবার চেষ্টা করলুম না, বললুম, আজ্ঞে ঠিক।
—পাত্রীটি কে? নাম ধাম বলে ফেল, যদি অলঙ্ঘনীয় বাধা না থাকে তবে সম্বন্ধের চেষ্টা করব।
—কোনও আশা নেই সার, বৈবাহিক অবৈবাহিক কোনও সম্পর্কই হবার জো নেই। আমার নাগালের একদম বাইরে।
চুঞ্চু মশায় বললেন, যদি নাগালের বাইরেই হয় এবং কোনও আশা না থাকে তবে বৃথা তার চিন্তা করছ কেন? মন থেকে একবারে মুছে ফেল।
—চেষ্টা তো করছি, কিন্তু পারছি না যে।
—আচ্ছা তার ব্যবস্থা আমি করছি। আগে তার পরিচয় দাও।
আমি সবিস্তারে পরিচয় দিলুম। তাকে দিনেমায় দেখেছি, তিলোত্তমা ছবিতে নায়িকার পার্টে—
নমিতা বললেন, আরে রাম রাম, ছি ছি, এত ভনিতার পর সিনেমার অ্যাকট্রেস! ইস্কুলের চ্যাংড়া ছেলেরাই তো সে রকম প্রেমে পড়ে। ডক্টর সিদ্ধিনাথ বকবক্তার নজর অত ছোট তা মনে করি নি, উঁচুদরের কিছু আশা করেছিলুম। অন্তত একটি পিস্তলওয়ালী অগ্নিদিদি, কিংবা নাটোরের বনলতা সেন।
অসিতা বলল, অমন আশা তোমার করাই অন্যায় দিদি, এঁর তো তখন কম বয়স, ডক্টর বা বকবক্তা কোনও খেতাবই পান নি।
সিদ্ধিনাথ বললেন, ছি ছি করবার কোনও কারণ নেই আমার মনোরথে আকাশের নক্ষর জোতা ছিল। তিলোত্তমা ছবিতে সে নায়িকা সাজত, তার নিজের নামও তিলোত্তমা। তার বাপ আর ঠাকুদা বাঙালী, ঠাকুমা বর্মী, মা অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান, দিদিমা ইংরেজ, দাদামশায় পঞ্জাবী। অ্যাভারেজ বাঙালী মেয়ে মোটেই সুশ্রী নয়। জারুল কাঠের মতন গায়ের রং, ছোট ছোট চোখ, এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত মুখের হাঁ—যেন ইঁদুর ধরা জাঁতিকল, মোটা ঠোঁট, থুতনি এতটটুকু। বিশ্বাস না হয় তো আরশিতে মুখে দেখবেন!
নমিতা বললেন, বাঙালী পুরুষদের চেহারা কেমন তা শুনবেন? চোয়াড়ে গড়ন, আবলুস কাঠের মতন রং—
সিদ্ধিনাথ হাত নেড়ে বললেন, থামুন থামুন যা বলবার গোপালকে আড়ালে বলবেন, অন্যের কাছে পতিনিন্দা মহাপাপ। যা বলছিলুম শুনুন। তিলোত্তমার দেহে চার জাতের রক্ত মিশেছিল, সেজন্যই সে অসাধারণ সুন্দরী। গোড়ালি পর্যন্ত চুল, চাঁপা ফুলের মতন রং—
অসিতা বলল, রং কি করে টের পেলেন সার? তখন তো টেকনিকলার হয় নি।
রংটা অনুমান করেছিলুম। লম্বা ছিপছিপে গড়ন, পক্কবিম্বাধরোষ্ঠী, চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা, পীনস্তনী, নিরিড়নিতম্বা। কালিদাস থাকে বলেছেন—যুবতিবিষয়ে বিধাতার আদ্যা সৃষ্টি।
নমিতা বললেন, বিধাতার সৃষ্টি থোড়াই, আপনি আদেখলে হাঁদা ছিলেন তাই আসল রূপ টের পান নি। রং সুর্মা পরচুল তুলো আর খড় দিয়ে কি গড়া যায় তার কোনও আইডিয়াই আপনার নেই।
—হুঁ, রামদাস চুঞ্চুও তাই বলেছিলেন বটে। তার পর শুনুন। তিলোত্তমার গলার আওয়াজ এত মিষ্টি যে তা বলবার নয়।
—উপমা খুঁজে পাচ্ছেন না? রুপুলী কণ্ঠস্বর বলা চলবে?
—ও হল ইংরিজীর অন্ধ নকল, কণ্ঠস্বর সোনালী রুপুলী হয় না। সোনা রুপোর আওয়াজও ভাল নয়। বরং স্টীলের তারের সঙ্গে তুলনা দেওয়া যেতে পারে, যেমন বীণার ঝংকার কিংবা দামী ঘড়ির গংএর ডিং ডং। তার পর শুনুন। রামদাস চুঞ্চু তিলোত্তমার বিবরণ শুনে প্রশ্ন করলেন, তার সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে?
বললুম, আলাপ কোত্থেকে হবে সার, সে থাকে বোম্বাইএ। তাকে কোনও দিন সশরীরে দেখি নি, শুধু ছবিতেই তার মূর্তি দেখেছি, ছবিতেই তার কথা আর গান শুনেছি।
চুঞ্চু মশায় সহাস্যে বললেন, বেশ বেশ! কায়া দেখনি, শুধু ছায়া দেখেছ। এখন শুয়ে শুয়ে ছায়াও দেখছ না, শুধু মায়া দেখছ। ভয় নেই, আমি তোমাকে উদ্ধার করব। সাংখ্য দর্শনে বলে—প্রকৃতি এক, আর পুরুষ অনেক। পুরুষ আসলে শুদ্ধ বুদ্ধ নির্বিকার, কিন্তু তার সামনে যখন প্রকৃতি সেজেগুজে নৃত্য করে তখন পুরুষের বিকার হয়, সে ভবযন্ত্রণা ভোগ করে। প্রজ্ঞা লাভ করলেই পুরুষের নেশা ছুটে যায়, প্রকৃতি অন্তর্হিত হয়। তুমি একজন পুরুষ, তিলোত্তমারূপী প্রকৃতি তোমার সামনে নেচেছিল, এখনও তোমার মনের মধ্যে নাচছে, তাই তোমার এই দুর্দশা। বৎস সিদ্ধিনাথ প্রবুদ্ধ হও, তোমার পৌরুষ দেখাও, প্রকৃতিকে ধমক দিয়ে বল, দূর হ মায়াবিনী। ভাগো গেট আউট। ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মোহমুক্ত হয়ে কৈবল্য লাভ কর।
আমি বললুম, ওসব তত্ত্বকথায় কিছুই হবে না সার।
—বেশ, সাংখ্যে যদি কাজ না হয় তবে অদ্বৈতবাদ শোন। এই জগতে হরেক রকম যা দেখছ তার কোনও অস্তিত্ব নেই, শুধুই মায়া। একমাত্র ব্রহ্মই আছেন, তিনি পুরুষ নন স্ত্রী নন ক্লীবলিঙ্গ, এবং তুমিই সেই রহ্ম।
—বলেন কি সার! আপনি ব্রহ্ম নন?
—আমিও ব্রহ্ম; তোমার সহপাঠীরা, তোমাদের ভাইসচ্যান্সেলার, প্রত্যেকেই ব্রহ্ম; সবাই এক, শুধু মায়ার জন্য আলাদা আলাদা বোধ হয়।
—আপনি বলতে চান তিলোত্তমা আর আমাদের বাড়ির কুঁজী বুড়ী কি দুইই এক?
—তাতে বিন্দমাত্র সন্দেহ নেই। সুন্দরী বা কুৎসিত, সাধু বা অসাধু, সব তুল্যমূল্য, এক পরমাত্মা সর্বভূতে বিরাজমান। বোকা লোক মনে করে এক সের তুলোর চাইতে এক সের লোহা বেশী ভারী, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দুইএরই ওজন সমান।
—মানি না সার। আপনি নীচের ওই উঠনে দাঁড়ান, আমি দোতলা থেকে আপনার মাথায় এক সের তুলো ফেলব, তার পর এক সের লোহা ফেলব। তার পরেও যদি বেঁচে থাকেন তবে আপনার কথা মানব।
অট্টহাস্য করে চুঞ্চু মশায় বললেন, ওহে সিদ্ধিনাথ, গুরুমারা বিদ্যে এখনও তোমার হয় নি, একটু সায়েন্স পড়ো। তুমি গুরুত্ব আর আপেক্ষিক গুরুত্ব ভার আর সংঘাত গুলিয়ে ফেলেছ।
আমি বললুম, খাই বলুন সার, আপনার অদ্বৈতবাদে কোনও ফল হবে না। তিলোত্তমা হচ্ছে আলোকসামান্যা নারী, তার সঙ্গে অন্য কারও তুলনাই হতে পারে না। তার চেহারা অভিনয় আর গান আমাকে জাদু করেছে।
চুঞ্চু মশার বললেন, তবে কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োগ কর, যাকে বলে কমন সেন্স। পক্ষিরাজ ঘোড়া, আকাশকুসুম, শিংওয়ালা খরগোশ এ সবে বিশ্বাস কর?
—আজ্ঞে না, ওসব তো কল্পনা, কিন্তু তিলোত্তমা বাস্তব।
—একবারেই ভুল। কবি খুব হাতে রেখেই বলেছেন, অর্ধেক কল্পনা তুমি অর্ধেক মানবী। তোমার তিলোত্তমা অর্ধেক নয়, পনরো আনা কল্পনা। তুমি তার কতটকু জানহে ছোকরা? তার মূর্তিটা জোড়াতালি দিয়ে তৈরী; তার ভাষা নিজের নয়, নাট্যকারের; তার গানও নিজের নয়, অন্য মেয়ে আড়াল থেকে গেয়েছে। একটা কৃত্রিম মানবীর চিত্রার্পিতা ছায়া দেখে তুমি ভুলেছ। তার মেজাজ তুমি জান না, হয়তো খেঁকী কুঁদুলী, হয়তো নেশা করে, হয়তো দেমাকে মটমট করছে, হয়তো তার কালচারও বিশেষ কিছু নেই।
একটু ভেবে আমি বললুম, পণ্ডিত মশায়, আপনার কথা শুনে এখন মনে পড়ছে—তিলোত্তমা সরোবরকে সড়োবড়, জিহ্বাকে জেহোভা, আর প্রেমকে ফ্রেম বলেছিল।
—তবেই বোঝ। তুমি আবার ভীষণ খুঁতখুঁতে। যদি তোমাদের মিলন হয়, তার সঙ্গে তুমি যদি ঘর কর, তবে দুদিনেই তার গ্ল্যামার লোপ পাবে। সেকালে কলকাতায় একজন অতি শৌখিন বনেদী বড়লোক ছিলেন। তিনি রোজ সন্ধ্যায় তাঁর রূপসী রক্ষিতার বাড়িতে যেতেন, দুপুর রাতে বাড়ি ফিরতেন। কোনও কারণে দুদিন তিনি যেতে পারেন নি। বিরহযন্ত্রণা সইতে না পেরে তৃতীয় দিনে ভোর বেলায় তিনি হাজির হলেন। দেখলেন, তাঁর প্রেয়সী গামছা পরে গাড়ু হাতে কোথায় চলেছেন। তাই দেখে ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়ে বললেন, এঃ তুমি—তুমি—
নমিতা বললেন, আপনি অতি অসভ্য, মুখে কিছুই বাধে না।
—ও তো আমি বলি নি, গুরুমুখে যা শুনেছি তাই আবৃত্তি করেছি। প্রেয়সীর সেই অদৃষ্টপূর্ব প্রাকৃত রূপ দেখে ভদ্রলোকের মোহ কেটে গেল, তিনি বৈরাগ্য অবলম্বন করে বৃন্দাবনবাসী হলেন।
নমিতা বললেন, আপনার নিজের কি হল তাই বলুন।
—তার পর চুঞ্চু মশায় বললেন, ওহে সিদ্ধিনাথ এখন তোমাকে আসল তিলোত্তমার ইতিহাস বলছি শোন। সুন্দ উপসন্দ দুই ভাই ছিল হরিহরাত্মা। তাদের উপদ্রবে ব্যতিব্যস্ত হয়ে দেবতারা ব্রহ্মার শরণ নিলেন। ব্রহ্মা বললেন, ভয় নেই, আমি দুদিনে ওদের সাবাড় করে দিচ্ছি। তিনি ব্রাহ্মী মায়ায় এক সিন্থেটিক ললনা সৃষ্টি করলেন। জগতের যাবতীয় সুন্দর বস্তুর তিল তিল উপাদানের সংযোগে তৈরী সেজন্য তার নাম হল তিলোত্তমা। তার ট্রায়াল দেখবার জন্য দেবতারা ব্রহ্মসভায় সমবেত হলেন। ব্রহ্মার চার দিকে ঘুরে ঘুরে তিলোত্তমা নাচতে লাগল। পিতামহ প্রবীণ লোক, চক্ষুলজ্জা আছে, ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে পারেন না, অথচ দেখবার লোভ ষোল আনা। অগত্যা তাঁর ঘাড়ের চার দিকে চারটে মণ্ডু বার হল। ইন্দ্রের সর্বাঙ্গে সহস্র লোচন ফুটে উঠল, তাই দিয়ে তিনি চোঁ চোঁ করে তিলোত্তমার রুপসুধা পান করতে লাগলেন। অনেক ক্ষণ নাচ দেখে ব্রহ্মা বললেন, বাঃ, খাসা হয়েছে, এখন তুমি সুন্দ উপসুন্দের কাছে গিয়ে তাদের সামনে নৃত্য কর। তিলোত্তমা তাই করল। তাকে দখল করবার জন্য দুই ভাই কাড়াকাড়ি মারামারি করে দুজনেই মরল। দেবতারা নিরাপদ হলেন। ইন্দ্র বললেন, তিলোত্তমা, আমার সঙ্গে অমরাবতীতে চল, শচীকে বরখাস্ত করে তোমাকেই ইন্দ্রাণী করব। বিষ্ণু বললেন, খবরদার, তিলোত্তমার দিকে নজর দিও না, ও বৈকুণ্ঠে যাবে, আমার পদসেবা করবে। মহেশ্বর বললেন, ওহে বিষ্ণু, তোমার তো বিস্তর সেবাদাসী আছে, তিলোত্তমা আমার সঙ্গে কৈলাসে যাবে, পার্বতীর একজন ঝি দরকার। তখন রহ্মা বেগতিক দেখে বললেন, তিলোত্তমে, স্ফট স্ফট স্ফোটয় স্ফোটয়! তিলোত্তমা দড়াম করে ফেটে গেল, অ্যাটম বোমার মতন। তার সমস্ত সত্তা বিশ্লিষ্ট হল, যে উপাদান যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই ফিরে গেল—কান্তি বিদ্যুল্লতায়, কেশরাশি মেঘমালায়, মুখচ্ছবি পূর্ণচন্দ্রে, দৃষ্টি মৃগলোচনে, ওষ্ঠরাগ পক্ক বিম্বে, দন্তরুচি কুন্দকলিকায়, কণ্ঠস্বর বেনুবীণায়, বাহু মৃণালদণ্ডে, পয়োধর বিল্বফলে, নিতম্ব করিকুম্ভে, ঊরু কদলীকাণ্ডে। পড়ে রইল শুধু একটু রেডিও-অ্যাকটিভ ধোঁয়া।
অসিতা বলল, তিলোত্তমার মন কোথায় ফিরে গেল তা তো বললেন না সার।
—তার মন বুদ্ধি চিত্ত অহংকার কিছুই ছিল না, আত্মাও ছিল না। তিলোত্তমা একটা রোবট। পুরাণকথা শেষ করে চুঞ্চু মশায় প্রশ্ন করলেন, বৎস সিদ্ধিনাথ, এখন কিঞ্চিৎ সুস্থ বোধ করছ কি? মোহ অপগত হয়েছে?
আমি লাফ দিয়ে উঠে বললুম, একদম সেরে গেছি সার। আমার মানসী তিলোত্তমাও এক্সপ্লোড করে বিলীন হয়েছে।
চুঞ্চু মশায় বললেন, এখনও বলা যায় না, কিছু ধোঁয়া থাকতে পারে। দেখ সিদ্ধিনাথ, তোমার চটপট বিবাহ হওয়া দরকার, তোমার বাপ মায়েরও সেই ইচ্ছে। আমার ছোট শালী নবদুর্গা দেখতে নেহাত মন্দ নয়, কাল বিকেলে আমাদের বাড়িতে এসে তাকে একবার দেখো!
আমি উত্তর দিলুম, দেখবার দরকার নেই সার। ছায়া দেখে একবার ভুলেছি, কায়া দেখে আর ভুলতে চাই না। ওই নবদুর্গা না বনদুর্গা কি নাম বললেন, ওকেই বিয়ে করব। আপনি যখন বলছেন তখন আর কথা কি।
চুঞ্চু মশায় বললেন, ঠিক বলেছ সিদ্ধিনাথ। দেখে তুমি কি আর বুঝবে, আমি তো দশ বছরেও নবদুর্গার দিদি জয়দুর্গার ইয়ত্তা পাই নি। বিবাহ হয়ে থাক, তার পর ধীরে সুস্থে যত দিন খুশি দেখো।
তার পর চুঞ্চু মশায় বাবাকে বললেন, বাবা মা রাজী হলেন, দু মাসের মধ্যে নবদুর্গার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল।
গোপালবাবু বললেন, সিদ্ধিনাথের ইতিহাস তো শেষ হল, এখন নমিতা তোমার মন্তব্য বলতে পার।
নমিতা বললেন, আপনার গিন্নীকে এই কেচ্ছা শুনিয়েছেন?
সিদ্ধিনাথ বললেন, শুনিয়েছি। আরও অনেক রকম জীবনস্মৃতি তাঁকে বলেছি, কিন্তু পতিবাক্যে তাঁর আস্থা নেই, আমার কোনও কথাই তিনি বিশ্বাস করেন না।
—জীবনস্মৃতি না ছাই, বকবক করে আবোলতাবোল বানিরে বলেছেন। আগাগোড়া মিথ্যে, শুধু নবদুর্গা সত্যি।
- ↑ সিদ্ধিনাথের পূর্বকথা ‘গল্পকল্প’ পুস্তকে আছে।