নীল তারা

ষাট বৎসর আগেকার কথা, কুইন ভিক্টোরিয়ার আমল। তখন কলকাতায় বিজলী বাতি মোটর গাড়ি রেডিও লাউড স্পীকার ছিল না, আকাশে এয়ারোপ্লেন উড়ত না, রবীন্দ্রনাথ প্রখ্যাত হন নি, লোকে হেমচন্দ্রকে শ্রেষ্ঠ কবি বলত। কিন্তু রাখাল মাষ্টার মনে করত সে আরও উঁচু দরের কবি, হতাশের আক্ষেপের চাইতেও ভাল কবিতা লিখতে পারে। সে তার অনুগত ছাত্র নারানকে বলত, আজ কি একখানা লিখেছি শুনবি?—ক্ষিপ্ত বায়ু ধূলি মাখে গায়। আর একটা শুনবি?—শুষ্ক বৃদ্ধে ঝটিকার প্রভাব কোথায়। আর কেউ পারে এমন লিখতে?

 রাখাল মুস্তাফী শুধু এনট্রান্স পাস, কিন্তু বিদ্বান লোক, বিস্তর বাংলা ইংরেজী বই পড়েছিল। সেকালে বেশী পাস না করলেও মাস্টারি করা চলত। কবিতা রচনা ছাড়া গান বাজনা আর দাবা খেলাতেও তার শখ ছিল। প্রথম বয়সে রাখাল বেহালা জুবিলি হাইস্কুলে থার্ড মাস্টারি করত, তার পর দৈবক্রমে রূপচাঁদপুরের রাজাবাহাদুর রৌপ্যেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর সুনজরে পড়ে দু বৎসর তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজ করেছিল। কোনও কারণে সে চাকরি ছেড়ে তাকে চলে আসতে হয়। তার পর দশ বৎসর কেটে গেছে, এখন রাখাল বেহালায় তার পৈতৃক বাড়িতেই থাকে এবং আবার জুবিলি স্কুলে মাস্টারি করছে।

 যখনকার কথা বলছি তখন রাখালের বয়স প্রায় তেত্রিশ। সুপুরুষ, কিন্তু চেহারার যত্ন নেয় না, উস্কখুস্ক চুল, দাড়ি কামায় না, তাতে একটু পাকও ধরেছে। পাড়ার লোকে বলে পাগলা মাষ্টার। সেকালে লোকে অল্প বয়সে বিবাহ করত, কিন্তু রাখাল এখনও অবিবাহিত। বাড়িতে সে একাই থাকে, তার মা দু বৎসর আগে মারা গেছেন।

 রবিবার, সকাল আটটা। রাখাল তার বাইরের ঘরের সামনের বারান্দায় একটা তক্তপোশে বসে হুঁকো টানছে আর কবিতা লিখছে। বাড়ি থেকে প্রায় এক শ গজ দূরে একটা আধপাকা রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে। রাখাল দেখতে পেল, একটা ভাড়াটে ফিটন গাড়ি এসে থামল, তা থেকে দুজন সাহেব আর একজন বাঙালী নামল। গাড়ি দাঁড়িয়ে রইল, আরোহীরা হনহন করে রাখালের বাড়ির দিকে এগিয়ে এল।

 সাহেবদের একজন লম্বা রোগা, গোঁফদাড়ি নেই, গাল একটু তোবড়া, সামনের চুল কমে যাওয়ায় কপাল প্রশস্ত দেখাচ্ছে। অন্য জন মাঝারি আকারের, দোহারা গড়ন, গোঁফ আছে, একটু খুঁড়িয়ে চলেন। তাঁদের বাঙালী সঙ্গীটি কালো, পাকাটে মজবুত গড়ন, চুল ছোট করে ছাঁটা, গোঁফের ডগা পাক দেওয়া, পরনে ধুতি আর সাদা ড্রিলের কোট। রাখাল হুঁকোটি রেখে অবাক হয়ে আগন্তুকদের দিকে চেয়ে রইল।

 কাছে এসে লম্বা সাহেব হ্যাট তুলে বললেন, গুড মর্নিং সার। অন্য সাহেব হ্যাট না খুলেই বললেন, গড মর্নিং বাবু। তাঁদের বাঙালী সঙ্গী নীরবে রইলেন।

 রাখাল সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে উঠে সেলাম করে বলল, গুড মর্নিং, গুড মর্নিং সার। ভেরি সরি, আমার বাড়িতে চেয়ার নেই, দয়া করে এই তক্তপোশে—এই উড্‌ন প্ল্যাটফর্মে বসুন।

 লম্বা বললেন, দ্যাট্‌স অল রাইট, আমরা বসছি, আপনিও বসুন। মিস্টার রাখাল মুস্তৌফীর সঙ্গেই কি কথা বলছি?

 —আজ্ঞে হাঁ।

 দুই সাহেব নিজের নিজের কার্ড রাখালকে দিয়ে তক্তপোশে বসলেন, রাখালও বসল। আগন্তুক বাঙালী ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রইলেন, সাহেবের সঙ্গে একাসনে বসতে তিনি পারেন না।

 গুঁফো সাহেব মুখের সিগারেট ফেলে দিয়ে বললেন, এই বেঙ্গলী বাবু হচ্ছেন আমাদের দোভাষী বাঞ্ছারাম খাঞ্জা। বোধ হয় এঁর দরকার হবে না, আপনি ইংরেজী জানেন দেখছি, আমরা সরাসরি আলাপ করতে পারব। ওয়েল মুস্তৌফী বাবু, আমার এই ফেমস্ ফ্রেণ্ডের নাম আপনি শুনেছেন বোধ হয়?

 কার্ড দুটো ভাল করে পড়ে রাখাল বলল, আজ্ঞে শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না, ভেরি সরি।

 —কি আশ্চর্য, আপনি তো একজন শিক্ষিত লোক, স্ট্রাণ্ড ম্যাগাজিনে এঁর কথা পড়েন নি?

 -পুওর ম্যান সার, স্ট্রাণ্ড ম্যাগাজিন কোথা পাব? শুধু বঙ্গবাসী জন্মভূমি আর মাঝে মাঝে হিন্দু পেট্রিয়ট পড়ি।

 —ইংরেজী গল্পের বই পড়েন না?

 —তা অনেক পড়েছি, স্কট ডিকেন্স লীটন জর্জ ইলিয়ট আমার পড়া আছে।

 —ক্রাইম স্টোরিজ পড়েন না?

 —রেনল্ড্‌সের বিস্তর নভেল পড়েছি, মায় মিস্ট্রিজ অভ দি ফোর্ট অভ লণ্ডন।

 —ফর শেম মুস্তৌফী বাবু। ওর বই ছুঁতে নেই, দেশদ্রোহী বজ্জাত লোক।

 —তিনি কি করেছেন সার?

 —সে লিখেছে, ফ্রেঞ্চ জাতি সবচেয়ে সভ্য, নেপোলিয়নের মতন গ্রেট ম্যান জন্মায় নি, আর ব্রিটিশ মন্ত্রীরা এতই অপদার্থ যে যত সব জার্মন বদমাশ ধরে এনে আমাদের রাজকুমারীদের সঙ্গে বিয়ে দেয়। যাক সে কথা। তা হলে আমার এই বিখ্যাত বন্ধু সম্বন্ধে আপনি কিছুই জানেন না?

 রাখাল একটু কুণ্ঠিত হয়ে বলল, শুধু এইটুকু জানি, ইনি এই প্রথম এদেশে এসেছেন, কিন্তু আপনি নতুন আসেন নি।

 লম্বা সাহেব আশ্চর্য হয়ে বললেন, দ্যাট্‌স ফাইন! আর কি জানেন মিস্টার মুস্তৌফী?

 —কাল রাত্রে আপনাদের ভাল ঘুম হয় নি।

 —ভেরি ভেরি গুড। আর কি জানেন?

 —আপনারা কাল লংকা খেয়েছিলেন।

 —লংকা? ইউ মীন সীলোন, আইল্যাণ্ড অভ রাবণ?

 —আজ্ঞে সে লংকা নয়। হিন্দী নাম মিরচাই, ইংরেজী নামটা মনে আসছে না। রেড অ্যাণ্ড গ্রীন পড—হাঁ হাঁ মনে পড়েছে, চিলি, রেড পেপার, ক্যাপ্‌সিকম, ভেরি হট স্পাইস।

 লম্বা সাহেব তাঁর বন্ধুকে বললেন, ওহে ওআটসন, দেখছ তো, সায়েন্স অভ ডিডক্‌শন এই বেঙ্গলী জেণ্টলম্যান ভালই জানেন। নাঃ, এদেশে শারলক হোম্‌সের পসার হবে না।

 ওআটসন বললেন, মস্তৌফী বাবু আপনি কি ইয়োগা প্র্যাকটিস করেন?

 রাখাল বলল, যোগশাস্ত্র? না, তা আমার জানা নেই। আমার বাবা কবিরাজি করতেন—ইণ্ডিয়ান সিস্টেম অভ মেডিসিন, তাঁর কাছ থেকে আমি কিছু শিখেছি। সমস্ত লক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে কারণ অনুমান করা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।

 ওয়াটসন প্রশ্ন করলেন, কাল রাতে আমাদের ভাল ঘুম হয় নি তা বুঝলেন কি করে?

 শারলক হোম্‌স বললেন, এলিমেণ্টারি ওআটসন, অতি সহজ। আমাদের মুখে মশার কামড়ের দাগ রয়েছে। আমরা মশারির মধ্যে শুই নি, পাংখাপুলারও মাঝরাত্রে পালিয়েছিল। কিন্তু আর দুটো বিষয় টের পেলেন কি করে?

 রাখাল বলল, খুব সহজে। আপনি এসেই টুপি খুলে আমাকে ‘সার’ বললেন। অভিজ্ঞ সাহেবরা সামান্য নেটিভকে এত খাতির করে না। এতে বুঝলাম আপনি এই প্রথমবার বিলাত থেকে এসেছেন। ডক্টর ওআটসন টুপি খোলেন নি, আমাকে ‘বাবু’ বললেন, তাতে বুঝলাম ইনি পাক্কা সাহেব, নতুন আসেন নি, এদেশের দস্তুর জানেন।

 —লংকা খাওয়া জানলেন কি করে?

 —আপনার আঙুলে তামাকের রং ধরেছে, দেখেই বোঝা যায় আপনি খুব সিগারেট সিগার বা পাইপ টানেন। ডক্টর ওআটসনের সঙ্গে সিগারেট ছিল, কিন্তু আপনার ছিল না। আপনি মাঝে মাঝে জিবের ডগা বার করছিলেন, অর্থাৎ জিব জ্বালা করছে। অনভ্যস্ত লোকে লংকা খেলে এইরকম হয়, সিগারেট টানতে পারে না। ডক্টর ওআটসন পাকা লোক, লংকায় ওঁর কিছু হয় নি।

 হোম্‌স হেসে বললেন, চমৎকার। এই ওআটসনের কথা শুনেই কাল রাত্রে হোটেলে মাল্লিগাটানি সূপ, চিকেন কারি, আর বেঙ্গল ক্লার চাটনি খেয়েছিলাম, তিনটেই প্রচণ্ড ঝাল। আচ্ছা, আমাদের সঙ্গী এই মিস্টার খাঞ্জা সম্বন্ধে কিছু বলতে পারেন?

 বাঞ্ছারামকে নিরীক্ষণ করে রাখাল বলল, ইনি তো পুলিসের লোক, চুলের ছাঁট, গোঁফের তা, আর ড্রিলের কোট দেখলেই বোঝা যায়; তা ছাড়া থুতনির নীচে টুপির ফিতের দাগ রয়েছে।

 বাঞ্ছারাম খাঞ্জা মাতৃভাষায় বললেন, হঃ, তুমি খুব চালাক লোক বট হে। আর ভি কিছু শুনাও তো দেখি?

 —পঞ্চকোটে বাড়ি। সম্প্রতি খুব মার খেয়েছিলেন, কাঁধে আর হাতে লাঠির চোট লেগেছিল। তার জড়ানো মির্জাপুরী লাঠি, তার ছাপ এখনও চামড়ার ওপর রয়েছে।

 —আমার গায়ের দাগটাই দেখলে হে? শালা বলদেও পানওয়ালাকে কি পিটান পিটাইছি তার খবর রাখ মাস্টর?

 হোম্‌স বললেন, মুস্তৌফী, আওআর ফ্রেণ্ড খাঞ্জার মুখ দেখে বুঝেছি এঁর সম্বন্ধেও আপনার অনুমান ঠিক হয়েছে। আচ্ছা, আপনি ও কি টোবাকো খাচ্ছিলেন? ভার্জিনিয়া টার্কিশ ম্যানিলা জাভা কিউবা কইম্বাটুর প্রভৃতি তেষট্টি রকম টোবাকো আমি ধোঁয়া শুঁখেই চিনতে পারি, কিন্তু আপনারটা বুঝতে পারছি না। স্মেল্‌স গুড।

 —এর নাম দা-কাটা তামাক, খুব সস্তা আর কড়া।

 —ড্যাকোটা? আমি যে শ্যাগ খাই তার চাইতে ভাল গন্ধ। কোথা পাওয়া যায়? আমি কিছু নিয়ে যেতে চাই।

 —আমিই আপনাকে দু-তিন সের দিতে পারি, আমার বাড়ির তৈরি। কিন্তু পাইপে খাওয়া চলবে না, এইরকম হাবুলবাবুল চাই, হুক্কা কিংবা গড়গড়া। তার কায়দা আপনাকে শিখতে হবে। বিউটিফুল সায়েণ্টিফিক ইনভেনশন সার, জলের মধ্যে দিয়ে ধোঁয়া রিফাইণ্ড হয়ে আসে, জিব জ্বালা করে না।

 —আপনার কাছ থেকে শিখে নেব। আচ্ছা, এখন কাজের কথা হক। আমাদের আসার উদ্দেশ্য বোধ হয় বুঝেছেন?

 আপনারাও পুলিসের লোক?

 —না, আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ, তবে দরকার হলে পুলিসকে সাহায্য করি বটে। আর আমার বন্ধু এই ডক্টর ওআটসন আমার সহকর্মী।

 —রূপচাঁদপুরের কুমার স্বর্ণেন্দ্রনারায়ণ আপনাকে পাঠিয়েছেন তো? আগেই বলে দিচ্ছি, আমি কিছু জানি না, আমার কাছে কোনও খবর পাবেন না।

 হোম্‌স বললেন, মিস্টার খাঞ্জা, আপনার সাহায্য দরকার হবে না, আপনি ওই গাড়িতে গিয়ে বসুন।

 বাঞ্ছারাম চোখ পাকিয়ে রাখালকে বললেন, ও মশয়, বেশী ফড়ফড় ক’রো না, তোমাকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, সাহেবদের কাছে যা জবানবন্দি করবে তাতে তুমিই ফাঁদে পড়রে।

 বাঞ্ছারাম চলে গেলে হোম্‌স বললেন, মুস্তৌফী, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার কিছুমাত্র অনিষ্ট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার চেষ্টার ফলে আপনার ভালই হবে।

 রাখাল বলল, কুমার বাহাদুর আপনার মারফত আমাকে ঘুষ দিয়ে সন্ধান নিতে চান নাকি?

 —তিনি ভাল মন্দ যে কোনও উপায়ে কার্যসিদ্ধি করতে চান, কিন্তু আমার পলিসি তা নয়। তাঁর স্বার্থ আর আপনার মঙ্গল দুইই আমি সাধন করতে চাই। আমি জানি, আপনি একজন সরলস্বভাব শিক্ষিত সুৎলোক, আপনার উপর অনেক পীড়ন হয়েছে। আমি আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী। আপনাকে কিছুই বলতে হবে না, এদেশে আসবার আগে আমি যা শুনেছি এবং এখানে এসে অনুসন্ধান করে যা জেনেছি, সবই আমি বলে যাচ্ছি, যদি কোথাও ভুল হয়, আপনি জানাবেন।

 —বেশ, আপনি বলে যান।


শারলক হোম্‌স বলতে লাগলেন।—রূপচাঁদপুরের কুমারের এজেণ্ট মিস্টার গ্রিফিথ লণ্ডনে মাস খানিক আগে আমার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বললেন, লেট রাজা রোপেণ্ডর—

 রাখাল বলল, রৌপ্যেন্দ্রনারায়ণ।

 —হাঁ হাঁ। ওই চোয়াল ভাঙা নামটা উচ্চারণ করা শক্ত, আমি শুধু রাজা বলব। গ্রিফিথ আমাকে যা জানিয়েছিলেন তা এই।—এক বৎসর হল রাজা মারা গেছেন। দ্যাট ওল্ডম্যান এক স্ত্রী থাকতেই আর একটি ইয়ং গার্ল বিবাহ করেছিলেন। নূতন রানীকে খুশী করবার জন্য তিনি তাঁকে বিস্তর অলংকার দিয়েছিলেন, তার মধ্যে সব চেয়ে দামী হচ্ছে একটি প্রকাণ্ড স্টার স্যাফায়ারের ব্রোচ।

 রাখাল বলল, তার নাম নীল তারা, ব্লু স্টার। অতি মহামূল্য রত্ন, যার কাছে থাকে তার অশেষ মঙ্গল হয়। রাজার এক পূর্বপুরুষে দশ বৎসর আগে এক পোর্তুগীজ বোম্বেটের কাছ থেকে কিনেছিলেন। ও রত্নটি নাকি সীলোনের কোনও মন্দির থেকে লুট হয়েছিল।

 —দ্যাট্‌স রাইট। আপনি সে রত্ন দেখেছেন?

 —না, শুধু বর্ণনা শুনেছি। তার পর?

 —দ্বিতীয় বিবাহের কয়েক মাস পরেই পড়ে গিয়ে রাজার পা আর কোমরের হাড় ভেঙে যায়, প্রায় আট বৎসর শয্যাশায়ী থেকে তিনি মারা যান। তার পর হঠাৎ একদিন নূতন রানী নিরুদ্দেশ হলেন। রাজার যিনি উত্তরাধিকারী—কুমার বাহাদুর, বিস্তর খোঁজ করেছেন, কিন্তু নীল তারা পান নি, পলাতক রানীরও কোনও খবর পান নি। কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে— রানী ফিরে আসুন, তিনি সসম্মানে রাজবাড়িতে নিজের মহলে থাকবেন, প্রচুর বৃত্তিও পাবেন। কিন্তু তাতে কোনও ফল হয় নি, এদেশের পুলিসও কোনও সন্ধান পায় নি। ঠিক হচ্ছে মুস্তৌফী?

 —ওই রকম শুনেছি বটে। কিন্তু রাজার বিবাহের ব্যাপারটা আরও জটিল।

 —তা আমি জানি, সব রহস্যের আমি সমাধান করেছি। তার পর শুনুন। কুমার বাহদুর তাঁর বিমাতার জন্য কিছু মাত্র চিন্তিত নন, তিনি শুধু রত্নটি উদ্ধার করতে চান। নীল তারা নূতন রানীর হাতে যাওয়ার কিছুকাল পরেই ওল্ড রাজা জখম হলেন, অনেক বৎসর কষ্টভোগ করে মারা গেলেন। তার পর নূতন রানী নিরুদ্দেশ হলেন। এস্টেটে নানারকম অমঙ্গল ঘটছে, ফসল হয় নি, খাজনা আদায় হচ্ছে না, তিনটে বড় বড় মকদ্দমায় হার হয়েছে, প্রজারা দাঙ্গা করছে, কুমার ডিসপেপসিয়ায় ভুগছেন। তাঁর বিশ্বাস, সবই নীল তারার অন্তর্ধানের ফল।

 —আপনি তা মনে করেন না?

 —না। নীল তারা যতই দামী হক, একটা পাথর মাত্র, অ্যালুমিনার পিণ্ড, তার শুভাশুভ কোনও প্রভাবই থাকতে পারা না। আমাদের দেশেও রত্ন সম্বন্ধে অন্ধ সংস্কার আছে। কুমারের লণ্ডন এজেণ্ট গ্রিফিথ আমাকে বলেছিলেন, নীল তারা ছোট রানীর ডাউরি বা স্ত্রীধন নয়, ও হল রাজবংশের সম্পত্তি, এয়ারলুম, পাগড়িতে পরবার অলংকার। যিনি রাজা হবেন তিনিই এর অধিকারী। কুমার বাহাদুর শীঘ্র রাজা খেতাব পাবেন, সেজন্য নীল তারা তাঁরই প্রাপ্য। ছোট রানী তা চুরি করে নিয়ে পালিয়েছেন।

 রাখাল বলল, মিছে কথা। সমস্ত সম্পত্তি নিজের ইচ্ছামত দান বিক্রয়ের অধিকার বৃদ্ধ রাজার ছিল, তিনি ছোট রানীকে যা দিয়েছেন, তা স্ত্রীধন।

 —আমি এখানকার অ্যাডভোকেট জেনারেলের মত নিয়েছি। তিনিও মনে করেন স্ত্রীধন, তবে শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টে আর প্রিভিকাউনসিলের বিচারে কি দাঁড়াবে বলা যায় না। যাই হক, নীল তারা উদ্ধারের জন্য কুমার বাহাদরে আমাকে নিযুক্ত করেছেন।

 —কুমার আমার কাছেও লোক পাঠিয়েছিলেন, ভয়ও দেখিয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস আমি ছোট রানীর সন্ধান জানি। আপনি এদেশে এসে কিছু জানতে পেরেছেন?

 —আমি এসেই রূপচাঁদপুরে গিয়েছিলাম। সেখানে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আমাদের লেট ল্যামেণ্টেড রাজা বাহাদউর একটি স্কাউনড্রেল ছিলেন, যেমন লম্পট তেমনি নেশাখোর, আর ঘোর অত্যাচারী। দশ বৎসর আগে তাঁর এস্টেটে রামকালী রায় নামে একজন কাজ করতেন। তাঁর সন্তান ছিল না, সাবিত্রী নামে একটি অনাথা ভাগনীকে পালন করতেন। মেয়েটি অসাধারণ সুন্দরী, তখন তার বয়স আন্দাজ ষোল। রূপচাঁদপুরেরই একটি ভাল পাত্রের সঙ্গে তার বিবাহ স্থির হয়েছিল। পাত্র আর পাত্রীর পরিবারের মধ্যে একটা দূর সম্পর্ক ছিল, কাছাকাছি বাসের ফলে ঘনিষ্ঠতাও হয়েছিল। পাত্রের কাছে পাত্রী লেখাপড়া শিখত। বিবাহের কথা হচ্ছে জেনে রাজা মেয়ের মামা রামকালীকে বললেন, খবরদার, অন্য কোথাও চেষ্টা করবে না, আমিই তোমার ভাগনীকে বিবাহ করব। মামা সাহসী লোক, রাজার কথা শুনলেন না, যার সঙ্গে সম্বন্ধ স্থির হয়েছিল তার সঙ্গেই বিবাহের আয়োজন করলেন। বরপক্ষ কন্যাপক্ষ উপস্থিত, কন্যার মামা সম্প্রদানের জন্য প্রস্তুত, পরোহিত মন্ত্রপাঠের উপক্রম করছেন, এমন সময় রাজা সদলবলে উপস্থিত হলেন। কেউ কোনও বাধা দিতে সাহস করল না, কারণ রাজার দোর্দণ্ড প্রতাপ, আর তাঁর সঙ্গে পুলিসের দারোগাও শান্তিরক্ষা করতে এসেছিল। রাজার অনুচরেরা মেয়ের মামা আর বরের হাত পা বেঁধে তাদের সরিয়ে ফেলল, বরপক্ষ কন্যাপক্ষ ভয়ে ছত্রভঙ্গ হল। তখন রাজা বরের আসনে বসলেন, তাঁর নিজের পরোহিত মন্ত্র পড়ল, রাজার এক মোসাহেব কন্যার খুড়ো সেজে অচৈতন্য সাবিত্রীকে সম্প্রদান করল। বিবাহের পর রাজা তাঁর নতুন পত্নীকে রাজবাড়িতে নিয়ে গেলেন। মামা দেশত্যাগী হলেন, আর পাত্রটি তার মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে গেল।

 —সেই পাত্রের পরিচয় আপনি জানেন?

 —তার সঙ্গেই কথা বলছি। নাম রাখাল মুস্তৌফী, স্কুল মাস্টার, নিজেকে খুব বড় কবি মনে করে, যদিও তার একটা কবিতাও এ পর্যন্ত ছাপা হয় নি।

 —নিজেকে বড় মনে করা কি দোষের?

 —বোকা লোকের পক্ষে দোষের, তোমার আর আমার মতন বুদ্ধিমানের পক্ষে দোষের নয়।

 —তার পর বলে যান।

 —নূতন রানী সাবিত্রী বহুদিন পীড়িত ছিলেন। তাঁকে খুশী করে বশে আনবার জন্য রাজা চেষ্টার ত্রুটি করেন নি, বিস্তর অলংকার মায় নীল তারা দিয়েছিলেন, বাসের জন্য আলাদা মহল আর অনেক দাসদাসীও দিয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষার জন্য মিশন স্কুলের সিস্টার থিওডোরাকে বাহাল করেছিলেন। কিন্তু বিবাহের পাঁচ মাস পরেই রাজা মাতাল অবস্থায় পড়ে গিয়ে জখম হয়ে শয্যা নিলেন। নূতন রানী তাঁর টীচারের সঙ্গেই সময় কাটাতে লাগলেন।

 —সাবিত্রী এখন কোথায় আছে তাই বলুন।

 —ব্যস্ত হয়ো না, সব কথা একে একে বলছি। রাজার মৃত্যুর পর নূতন রানীর উপর কড়া পাহারা বসল। তিনি খুব বুদ্ধিমতী, সিস্টার থিওডোরার সঙ্গে পরামর্শ করে পালাবার ব্যবস্থা করলেন। একদিন দুপুর রাত্রে চুপি চুপি রাজবাড়ি ত্যাগ করলেন, সঙ্গে নিলেন কিছু টাকা আর অলংকার এবং একজন বিশ্বস্ত দাসী। নীল তারা নিয়ে যাবার ইচ্ছা তাঁর ছিল না, কিন্তু থিওডোরার সনির্বন্ধ অনুরোধে তাও নিলেন। তার পর কলকাতায় এসে মিস সিসিলিয়া ব্যানার্জি নামে এক বাঙালী খীষ্টান মহিলার বাড়িতে উঠলেন। থিওডোরাই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

 —সাবিত্রীর সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে?

 —হয়েছে। রানী বললেন, আমি রাজবাড়ি থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন হয়েছি, এখানে এক মেয়ে স্কুলে চাকরিও যোগাড় করেছি। নীল তারা আমি রাখতে চাই না, আপনি নিয়ে যান, কুমারকে দেবেন। আমি বললাম, বিনামূল্যে দেবেন কেন, আপনার আর মুস্তৌফীর উপর যে অত্যাচার হয়েছে তার খেসারত আদায় করে তবে দেখেন। রানী বললেন, আমার কিছু স্থির করবার শক্তি নেই, মামা মামীও বেঁচে নেই যে তাঁদের উপদেশ নেব। আপনি মুস্তৌফীর সঙ্গে কথা বলবেন, তিনি যা বলবেন তাই হবে। মুস্তৌফী, তোমার উপর তাঁর খুব শ্রদ্ধা আছে, গ্রেট রিগার্ড।

 —তিনি কি খ্রীষ্টান হয়েছেন?

 —সিস্টার থিওডোরা তার জন্য চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু রানী মোটেই রাজী হন নি।

 —রানী বলবেন না, বলুন সাবিত্রী দেবী।

 —ভেরি ওয়েল, সাবিত্রী দেবী, দি গডেস সাবিত্রী। দেখ ওআটসন, প্রেমে পড়লে নজর খুব উঁচু হয়, মনের ম্যাগনিফাইং পাওআর বেড়ে যায়। তোমার বিবাহের আগেও এই রকম দেখেছিলাম।

 হোম্‌স তাঁর পকেট থেকে একটি বাক্স বার করে খুলে দেখালেন—সোনার ফ্রেমে বসানো নীল তারা, সুপারির মতন গড়ন, কিন্তু আরও বড়, ফিকে ঘোলাটে নীল রং, ভিভরে উজ্জ্বল তারার মতন একটি চিহ্ন, তা থেকে ছ দিকে ছটি রশ্মি বেরিয়েছে।

 হোম্‌স বললেন, বহু কোটি বৎসর পূর্বে ভূগর্ভে তরল উত্তপ্ত অ্যালুমিনা ধীরে ধীরে জমে গিয়ে এই রত্ন উৎপন্ন হয়েছিল। এর বাজার দর খুব বেশী হবে না, বড় জোর দশ হাজার টাকা। কিন্তু কুমার যখন এর অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করেন আর ফিরে পাবার জন্য লালায়িত হয়েছেন তখন তাঁকে চড়া দাম দিতে হবে। মুস্তৌফী, বল কত টাকা আদায় করব?

 রাখাল বলল, আমার মাথা গুলিয়ে গেছে, যা স্থির করবার আপনিই করুন।

 —কবিদের বিষয়বুদ্ধি বড় কম, অবশ্য অনারেবল এক্সেপ্‌শন আছে, যেমন লর্ড টেনিসন। শোন মুস্তৌফী, আমি চার লাখ আদায় করব, সাবিত্রী দেবীর দুই, তোমার দুই। এর বেশী চাইলে কুমার ভড়কে যেতে পারেন। তা ছাড়া আমাদের এদেশে আসার খরচ আর পারিশ্রমিকও তাঁকে দিতে হবে। ব্যাংক অভ বেঙ্গলে সাবিত্রীর অ্যাকাউণ্ট আছে, কুমার সেখানে চার লাখ জমা দিলেই তাঁকে নীল তারা সমর্পণ করব। আজ সন্ধ্যায় তিনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন।

 —সাবিত্রীর ঠিকানা কি?

 —তিন নম্বর কর্নওআলিস থার্ড লেন। মুস্তৌফী, আজই বিকালে তাঁর কাছে যেও। আশা করি তোমার কুসংস্কার নেই, বিধবা হলেও বাগ্‌দত্তা পাত্রীকে বিবাহ করতে রাজী আছ?.. তবে আর ভাবনা কি, go, woo and win her। কাল সকালে হোটেলে আমার সঙ্গে দেখা ক’রো। গুড বাই।

 ওআটসন বললেন, এক্সিকিউজ মি মুস্তৌফী বাবু দাড়িটা কামিয়ে ফেলো। গুড বাই।


রাখাল বিকালে চারটের সময় সাবিত্রীর কাছে গিয়ে রাত সাড়ে আটটায় ফিরে এল। তার ছাত্র নারান বারান্দায় বসে ছিল। রাখাল বলল, কে ও নারান নাকি? হ্যারিকেনটা উসকে দে।

 আলো বাড়িয়ে দিয়ে নারান বলল, একি মাষ্টার মশায়, আপনাকে যে চেনাই যায় না।

 —দাড়িটা কামিয়ে ফেলেছি। এত রাত্রে তুই যে এখানে?

 —বাঃ ভুলে গেছেন! আপনি যে বলেছিলেন, আজ সন্ধ্যে বেলা ব্যাট্‌ল অভ সেজমুর পড়াবেন।

 —দুত্তোর সেজমুর, ও আর এক দিন হবে। আজ ট্রামে আসতে আসতে কি একটা বানিয়েছি শুনবি?—বরষে ধারা, ভূমি শীতল, তাপিত তরু পেয়েছে জল; টানিছে রস তৃষিত মূল, ধরিবে পাতা ফুটিবে ফুল। তোদের হেম বাঁড়ুজে নবীন সেন পারে এমন লিখতে?

১৩৬১