নূতনের সন্ধান/মধ্যপ্রদেশ ও বেরার ছাত্র-সম্মেলন

—8—

 “এই জরাজীর্ণ দেশের যৌবন ফিরাইয়া আনিতে হইলে—সমগ্র ভারতে একটী জাতিগঠন করিতে হইলে, ভাল ও মন্দ সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা এতদিন বদ্ধমূল হইয়া আছে, তাহার পরিবর্ত্তন করিতে হইবে।”

 *

 * *

 'ধ্য প্রদেশ এবং বেরারের ছাত্রগণের এই সম্মিলনে যোগদান করিতে সমর্থ হইয়াছি বলিয়া আজ আমি মনে মনে পরম আনন্দ উপভোগ করিতেছি। ইহা কেবল আনন্দের বিষয় নহে, এরূপ ছাত্র সম্মিলনে যোগদান করিতে পারা আমার পক্ষে পরম সৌভাগ্য —ইহাও বলিতে হইবে। আপনাদের মনস্তুষ্টির জন্যই আমি একথা বলিতেছি না—ইহা বাস্তবিকই আমার মনের কথা। ইহাতে একটুও অতিরঞ্জন নাই। কারণ, প্রকৃত পক্ষে ছাত্রদের সংস্পর্শে আসিলেই যেন আমার চিত্তবৃত্তির স্বতঃ বিকাশ হয়, সমস্ত দ্বিধা সঙ্কোচ কাটিয়া যায় এবং আমি আমার প্রাণের কথা অকপটে ব্যক্ত করিতে পারি।

 বিশ্ব-বিদ্যালয় ছাড়িয়া বাহির হইবার পর প্রায় ১০ বৎসর আমার কাটিয়া গিয়াছে। এখনও কিন্তু আমি নিজকে ছাত্র ছাড়া আর কিছুই মনে করিতে পারি না। তবে আমার এই বিশ্ব-বিদ্যালয় আপনাদের বিশ্ব-বিদ্যালয় হইতে একটু বড় এবং ব্যাপক। ইহাকে “জীবনের বিশ্ব-বিদ্যালয়” বলিলেই ঠিক হয়। আমি এখন জীবন সংগ্রামে ব্যাপৃত, নিত্য নূতন উপদেশ এবং অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করাই আমার বর্ত্তমান কাজ। তথাপি আমার মনে হয়, ছাত্র জীবনের আদর্শবাদ, কল্পনা ও ভাবুকতা একেবারে আমাকে ছাড়িয়া যায় নাই। সুতরাং আমার পক্ষে আপনাদের অভাব অভিযোগ, সুখ দুঃখ এবং আশা আকাঙ্ক্ষার কথা উপলব্ধি করা বোধহয় একান্ত অসম্ভব হইবে না।

 তথাপি আমার একটা সন্দেহ আছে—তাহা এই যে, ছাত্র সম্মিলনের সভাপতি হইবার যোগ্যতা আদৌ আমার আছে কিনা? কারণ, ছাত্র জীবনের “সচ্চরিত্রতার” দিক হইতে বিচার করিলে বলিতে হয়, আমার নিজের ছাত্র জীবন নিষ্কলঙ্ক ছিল না। এখনও সেদিনের কথা আমার স্পষ্টই মনে হইতেছে, যেদিন প্রিন্সিপাল সাহেব আমাকে ডাকাইয়া নিয়া আমার উপর দণ্ডাদেশ জারী করিয়াছিলেন, কলেজ হইতে আমাকে সস্‌পেণ্ড করিয়াছিলেন। তাঁহার কথাগুলি এখনও আমার কাণে বাজিতেছে। তিনি বলিয়াছিলেন—“কলেজের মধ্যে তুমিই সর্ব্বাপেক্ষা দুরন্ত ছেলে।”

 আমার জীবনের সেইটি একটি স্মরণীয় দিন। বলিতে গেলে, নানা দিক দিয়াই সেদিন হইতে আমার জীবনের সম্পূর্ণ নূতন অধ্যায়ের সূত্রপাত হইয়াছিল। সে দিন-ই আমি সর্ব্ব প্রথম অনুভব করিলাম—কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে নির্য্যাতন সহ্য করার মধ্যে একটা বিমল আনন্দ আছে। এই আনন্দের সহিত জীবনের আর কোন আমোদ প্রমোদেরই তুলনা হয় না। আর সমস্তই ইহার নিকট তুচ্ছ—অতি তুচ্ছ। ইতিপূর্ব্বেই আমি আদর্শের মধ্য দিয়া নীতিজ্ঞান ও স্বাদেশিকতার পরিচয় পাইয়া ছিলাম; কিন্তু সেই দিনই সর্ব্ব প্রথম এই সমস্তের পরীক্ষা—শুধু পরীক্ষা নয়, অগ্নি পরীক্ষা হইয়া গেল। এই গুরুতর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া আমি দেখিলাম—আমার ভবিষ্যৎ জীবনের গতি ও কর্ম্মপদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত হইয়া গিয়াছে।

 বন্ধুগণ, আপনারা হয়ত মনে করিতেছেন যে, এই লোকটা বড়ই অদ্ভুত। কোথায় আমাদের কথা আলোচনা করিবে,—না তাহার পরিবর্ত্তে সে নিজের কথাই আলোচনা করিতে লাগিল। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, আমি এখানে কেন আসিয়াছি? আমার উদ্দেশ্য কি, তাহা আপনারা স্থির করিয়াছেন কি? নীতিজ্ঞান ও স্বাদেশিকতা সম্পর্কে লম্বা বক্তৃতা করিতে আমি এখানে আসি নাই; আমি আসিয়াছি আমার নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কয়েকটি জ্ঞানের কথা আপনাদের নিকট উপস্থিত করিতে। একথা কি সত্য নহে যে, কেবল সেই উপদেশেরই মূল্য আছে, যে, উপদেশ প্রকৃত পক্ষে নির্য্যাতন ও অভিজ্ঞতার সাহায্যে সংগৃহীত হইয়াছে?

 ভারতের সর্ব্বত্র আজ তোলপাড় আরম্ভ হইয়াছে। বিভিন্ন ভাব ও আদর্শের সংঘাত বাধিয়াছে। বহুসংখ্যক আন্দোলনের সূত্রপাত হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে কতকগুলি সংস্কারমূলক— বর্ত্তমান অবস্থার সংস্কার সাধনই তাহাদের লক্ষ্য। অপর কতক গুলি হইতেছে নির্ম্মূলকারী— বর্ত্তমান অবস্থার অবসান করিয়া নুতনের জন্মদান করাই তাহাদের উদ্দেশ্য। এই সমস্ত হট্টগোলের মধ্যেই আজ নূতন ভারতের জন্ম হইতেছে। এসময়ে ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি দিয়া ভাবী উন্নতি-অবনতির গতি নিয়ন্ত্রণ ও নির্দ্ধারণ করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে। যাহারা তরুণ, যাহাদের আদর্শ অতি মহান্ এবং অতিশয় উচ্চ, যাহাদের আত্মসম্বিৎ অতি প্রখর, সমগ্র জাতির ভাবধারার সহিত যাহারা নিজের ভাবধারা মিলাইয়া দিতে সমর্থ, যাহাদের ইতিহাস শিক্ষা ও উপদেশ লাভ সম্পূর্ণ হইয়াছে —কেবল তাহারাই একার্য্যের উপযুক্ত। কেবল তাহারাই এ সময়ে ভবিষ্যৎ উন্নতির পথ নির্দ্দেশ করিতে পারে।

 ভারতে এখন যে সমস্ত আন্দোলন দেখা দিয়াছে তাহাদের কথা একে একে বিশ্লেষণ করিতে হইলে এবং প্রত্যেকটির বিষয়ে আমার নিজের মতামত প্রকাশ করিতে হইলে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন,—এক দিনের বক্তৃতায় তাহা শেষ হইবে না। আমি তাই আজ সে চেষ্টা করিব না। তবে একটি কথা আমি বিশেষ জোর দিয়া বলিতে চাই,—তাহা এই যে, এই জরাজীর্ণ দেশের যৌবন ফিরাইয়া আনিতে হইলে—সমগ্র ভারতে একটি জাতি গঠন করিতে হইলে ভাল ও মন্দ সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা এতদিনে বদ্ধমূল হইয়াছে তাহার পরিবর্ত্তন করিতে হইবে। দার্শনিকের ভাষায় বলিতে গেলে, সামাজিকতা ও নৈতিকতার মাপ কাঠিতে যে জিনিষের যে মূল্য আমরা এখন দিয়া থাকি আবার নূতন করিয়া নূতনভাবে তাহার মূল্য নিরূপণ করিতে হইবে।

 বিশেষ অভিনিবেশের দরকার নাই—দূর হইতে সাধারণভাবে লক্ষ্য করিলেও একটা কথা ধরা পড়ে। তাহা এই যে, বর্ত্তমান যুগের অধিকাংশ আন্দোলনই তেমন দূরপ্রসারী নহে; এগুলির প্রায় প্রত্যেকটিই একান্ত অগভীর। ইহারা সমগ্র জাতির অন্তরে সাড়া জাগাইতে পারে নাই,—কেবল আমাদের সমাজ ও জাতির বাহ্যিক অভাব অভিযোগের এক আধটু স্পর্শ করিয়াই ক্ষান্ত হইতেছে। এ সমস্ত আন্দোলন দ্বারা যে কোন কাজই হয় না বা হইতে পারে না—এ কথা বলিতেছি না। ইহাদের দ্বারা খুব সামান্য কাজই হইতে পারে। মোটের উপর সমগ্র জাতিকে জাগ্রত করিতে হইলে এরূপ অগভীর আন্দোলন দ্বারা বিশেষ কোন কাজ হইবে না, হইতে পারে না। আমরা চাই—জাতীয় জাগরণ, বাহ্যিক নহে—আন্তরিক জাগরণ। সমগ্র জাতির প্রাণে সাড়া জাগাইতে হইবে। অত্যল্প সময়ের মধ্যে তাহা কিরূপে সম্ভবপর—ইহাই আমাদের প্রধান সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান চাই।

 আমাদের এই দেশ বড়ই প্রাচীন। আমাদের এই সভ্যতাও খুবই পুরাতন; তথাপি ইহার আভ্যন্তরীন শক্তি ও বেগ একেবারে বিনষ্ট হয় নাই। জাতি হিসাবে আমরা বীরের মত অনেক ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করিয়াছি। সময় সময় ইহাতে অভিভূত হইবার সম্ভাবনা দেখা দিলেও আজ পর্য্যন্ত আমরা জাতি হিসাবে একেবারে নির্ম্মূল হই নাই। কখনও যদি আমরা শ্রান্ত, ক্লান্ত এবং অবসন্ন হইয়া থাকি তবে আশ্চর্য্যান্বিত হইবার কোনই কারণ নাই। কারণ জীবন রক্ষার জন্য মধ্যে মধ্যে নিদ্রা ও বিশ্রামের প্রয়োজন হইয়া থাকে। আজ আমরা অবসন্ন ও দ্বিধাগ্রস্ত হইয়া পড়িলেও জাতি হিসাবে আমাদের মৃত্যু হয় নাই। চিন্তায় ও কার্য্যে মৌলিক এবং সৃজনী শক্তিই জীবনের লক্ষণ। এই সমস্ত বিষয়ে জাতি হিসাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে গৌরব করিবার যথেষ্ট অধিকার আমাদের আছে। আমরা যদি বাঁচিয়া না থাকিতাম তাহা হইলে জাতীয় জাগরণের সমস্ত আশাই বিফল হইত। আমরা এখনও জীবিত আছি এবং জাতি গঠনের সমস্ত উপাদানই আমাদের রহিয়াছে। সেইজন্যই আজও আমরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিতেছি।

 অন্তরের দিক হইতে যে জাগরণ—সেই জাগরণই আমরা চাই। কেবল তাহাতেই আমাদের এই জীবনের আমূল পরিবর্ত্তন সম্ভবপর হইতে পারে। এখানে সেখানে এক আধটু সংস্কার দ্বারা কাজ হইবে না, বাহ্যিক প্রলেপ কার্য্যকরী হইবে না। সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তন—সম্পূর্ণ নূতন জীবন পরিগ্রহণই আমাদের বর্ত্তমানের প্রয়োজন। ইহাকে ইচ্ছা করিলে “সম্পূর্ণ বিপ্লব” আখ্যাও দেওয়া যাইতে পারে।

 “বিপ্লব” এই কথাটি শুনিয়া আপনারা চমকিত হইবেন না। বিপ্লবের ধারা সম্পর্কে আমাদের মধ্যে মতভেদ হইতে পারে। তবে এপর্য্যন্ত আমি এমন লোক একটিও দেখি নাই—যে কখনও বিপ্লবের কথায় বিশ্বাস করে না। মোটের উপর বিবর্ত্তন (Evolution) এবং বিপ্লব (Revolution)—এই দুইয়ের মধ্যে কোনও মজ্জাগত প্রভেদ নাই। অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ের মধ্যে, যে বিবর্ত্তন (Evolution) সম্পন্ন হয় তাহাই বিপ্লব (Revolution); পক্ষান্তরে দীর্ঘ সময় ব্যাপিয়া যে বিপ্লব সম্পন্ন হয় তাহাই বিবর্ত্তন। বিবর্ত্তন ও বিপ্লব এই উভয়েরই গোড়ার কথা হইল পরিবর্ত্তন। এই জগতে উভয়েরই স্থান আছে। প্রকৃতপক্ষে বিপ্লব ও বিবর্ত্তনের মধ্যে কোনটিকেই একেবারে বাদ দিয়া চলা যায় না।

 আমি বলিয়াছি যে, ভালমন্দ সম্পর্কে এখন আমাদের যে সমস্ত ধারণা আছে তাহার অনেকগুলিই পরিবর্ত্তন করিতে হইবে। আমি ইহাও বলিয়াছি যে, আমাদের বর্ত্তমান গতানুগতিক জীবনের একটা আমূল পরিবর্ত্তন আবশ্যক। জাতি হিসাবে বড় হইতে হইলে এবং জগতের সভ্য জাতিসমূহের মধ্যে গৌরবের আসন অধিকার করিতে হইলে ইহাই আমাদের একমাত্র পথ। সেই জীবনেরই একমাত্র সার্থকতা আছে, মূল্য আছে এবং অর্থ আছে —যে জীবনের সম্মুখে একটা বৃহত্তর ও মহত্তর আদর্শ রহিয়াছে। যে জাতি উন্নতি করিতে চায় না, বিশ্বসভায় বিশেষত্ব লাভ করিতে চায় না সে জাতির পক্ষে বাঁচিবার কোনই প্রয়োজন নাই— এমন কি, বাঁচিবার কোন অধিকারই তাহার নাই। আমি একথা বলি না যে, কোনও স্বার্থগত উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যই এক একটা জাতির পক্ষে উন্নতির চেষ্টা করা দরকার। সমগ্র মানব সমাজকে উদার ও মহৎ করিয়া তুলিবার জন্যই প্রত্যেক জাতিকে উন্নত হইতে হইবে। যাহাতে পরিশেষে এই বিশ্বজগৎ মানব জাতির বসবাসের পক্ষে অধিকতর সুখকর ও কল্যাণকর হয় তাহারই চেষ্টা করিতে হইবে।

 একটা জাতিকে উন্নতিশীল করিতে হইলে যে সমস্ত উপাদানের প্রয়োজন হয় তৎসমস্ত উপাদানই ভারতের আছে। কি জাগতিক, কি আধ্যাত্মিক,কি নৈতিক কোনও রূপ উপাদানেরই অভাব এখানে নাই। ভারতবর্ষ যে কত প্রাচীন তাহা এখনও নির্দ্ধারিত হয় নাই; তথাপি সে মরে নাই; এখনও ভারতবর্ষ জীবিত আছে। কেন সে বাঁচিয়া আছে? তাহাকে আবার মহান হইতে হইবে, আবার তাহাকে উন্নত হইতে হইবে। জগতকে মহত্তর ও বৃহত্তর কিছু দান করিবার জন্যই ভারতবর্ষ আজও বাঁচিয়া আছে।

 ভারতের লক্ষ্য কি? তাহার কর্ত্তব্য কি? প্রথমতঃ নিজকে বাঁচাইতে হইবে এবং তারপর জগতের সভ্যতার ভাণ্ডারে কিছু না-কিছু দান করিতে হইবে। অর্দ্ধ শতাধিক অসুবিধার মধ্যে থাকিয়াও ভারতবর্ষ আজ যাহা দিয়াছে তাহা নিতান্ত তুচ্ছ নহে। এখন একবার কল্পনা করুন দেখি, ভারতবর্ষ যদি তাহার নিজ অভিপ্রায় অনুসারে, নির্ব্বিবাদে ও স্বাধীন ভাবে নিজকে বিকশিত করিতে পারিত তাহা হইলে মানব জাতির শিক্ষা ও সভ্যতার ভাণ্ডারে তাহার দান আরও কত বেশী হইত?

 আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, এ জাতির মধ্যে অক্লান্ত কর্ম্ম প্রেরণা জাগাইতে পারিলে ভারতবর্ষ অসাধ্য সাধন করিতে পারে—দুনিয়ার সমস্ত জাতিকে চমৎকৃত করিতে পারে। আমি একথাও বিশ্বাস করি যে, একবার এই ঘুমন্ত জাতির নিদ্রা ভঙ্গ হইলে এযুগের সর্ব্বাপেক্ষা উন্নতিশীল পাশ্চাত্য জাতি সমূহকেও ছাড়াইয়া যাইতে পারি। আজ আমাদের সেই যাদুকরের দণ্ডেরই প্রয়োজন —যে দণ্ড সঞ্চালনে আমাদের সমাজের সর্ব্বত্র সাজ সাজ রব উঠিবে। ফরাসী দার্শনিক বার্গসন elan vital অর্থাৎ প্রেরণাদায়িণী শক্তির কথা বলিয়াছেন। এই শক্তিই সমগ্র জগতকে কর্ম্মের পথে, উন্নতির পথে সঞ্চালিত করে। আমাদের জাতীয় জীবনের প্রেরণাদায়িণী শক্তি কি? স্বাধীনতার জন্য, সম্প্রসারণের জন্য, আত্ম-বিকাশের জন্য যে ঐকান্তিক আগ্রহ—তাহাই এই প্রেরণাদায়িণী শক্তি। আত্ম-বিকাশের এই যে ঐকান্তিক ইচ্ছা, তাহার অপর দিকই হইল বন্ধনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। আপনারা যদি স্বাধীন হইতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আপনাদের চতুর্দ্দিকে যে বন্ধন রহিয়াছে তাহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিতে হইবে। এই বিদ্রোহ যদি সার্থক হয় তাহা হইলে আপনাদের স্বাধীনতালাভ অবশ্যম্ভাবী।

 আত্ম-সম্মান-জ্ঞান যাহাদের একেবারে বিলুপ্ত হইয়াছে তাহাদের কথা ছাড়িয়াই দিলাম। ইহারা ছাড়া আর সকলেই দাসত্বের জ্বালা ও অপমান কিছু না কিছু অনুভব করেন। এই অনুভূতি যখন প্রখর হইয়া উঠে তখন দাসত্বের বন্ধন আর সহ্য হয় না; মানুষ তখন এই বন্ধন ছিন্ন করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠে, তাহার ব্যাকুলতা আরও বৃদ্ধি পায় তখনই যখন সে কোন-না-কোন উপায়ে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করিতে পারে। স্বাধীন দেশের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দ্বারা কি স্বাধীন আবহাওয়া হইতে উৎপন্ন সুখকর অবস্থার কথা পাঠ ও কল্পনা দ্বারা সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়া থাকে। দেশকে স্বাধীন করিবার জন্য কঠোর তপস্যার প্রয়োজন। এই তপস্যা কি? জাতীয় অপমান এবং বর্ণগত বৈষম্য প্রভৃতির অনুভূতি প্রখর হইতে প্রখরতর করিতে হইবে, স্বাধীনতা লাভের জন্য যে আগ্রহ তাহাকে ক্রমে ক্রমে প্রবল হইতে প্রবলতর করিতে হইবে। প্রকৃত পক্ষে দেশকে মুক্ত করিতে হইলে এই তপস্যরই প্রয়োজন। ইতিহাস পাঠ করিয়া, আমাদের বর্ত্তমান অবনতি লক্ষ্য করিয়া, জীবনের আদর্শের কথা অনুধ্যান করিয়া এবং সর্ব্বোপরি স্বাধীন দেশের অবস্থার সহিত পরাধীন দেশের অবস্থার তুলনা করিয়াই আমরা জাতীয় মুক্তির জন্য প্রেরণা লাভ করিতে পারি।

 আমি মনে করি—Baptism, Initiation ও দীক্ষা প্রভৃতির একটি মাত্র মানে হয়; তাহা এই যে, স্বাধীনতার বেদীতে জীবন উৎসর্গ করা। সম্পূর্ণ আত্মোৎসর্গ এক দিনে সম্ভবপর হইবে না। আমরা যতই স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল হইব ততই আমরা আনন্দের অনুভূতি পাইব। এই আনন্দের কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমরা ততই বুঝিতে পারিব যে, জীবনের একটা মহান্ অর্থ ও উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে। তখনই বিপ্লব উপস্থিত হইবে— আমাদের চিন্তা, আমাদের অনুভূতি এবং আমাদের আশা ও আকাঙ্খা এই সমস্তই তখন পরিবর্ত্তিত হইয়া নূতন মুর্ত্তি পরিগ্রহ করিবে। তখন আমাদের নিকট কেবল একটি জিনিষই মূল্যবান বলিয়া মনে হইবে; আমরা কেবল স্বাধীনতারই উপাসনা করিব। আমাদের মনোবৃত্তিও তখন পরিবর্ত্তিত হইবে এবং সেই আদর্শেরই অনুগামী হইবে। এই ক্রমিক পরিবর্ত্তনের অনুভূতি যে কিরূপ তাহা বর্ণনা করা যায় না। এই পরিবর্ত্তন যখন সম্পূর্ণ হইবে, তখন আমাদের পুনর্জ্জন্ম হইবে; আমরা তখন প্রকৃত “দ্বিজ” হইব। অতঃপর আমরা কেবল স্বাধীনতার কথাই চিন্তা করিব, স্বাধীনতার স্বাদ-ই উপলব্ধি করিব এবং স্বাধীনতার কাহিনী-ই স্বপ্নে দেখিব। আমাদের সমস্ত কাজ কর্ম্মের মধ্য দিয়া তখন একটি মাত্র অভিপ্রায় প্রকাশ পাইবে—সেইটি হইবে স্বাধীনতা লাভের ঐকান্তিক আগ্রহ। এক কথায় বলিতে গেলে, আমরা তখন স্বাধীনতার নেশায় মত্ত হইব—স্বাধীনতাই তখন আমাদের জীবনের সর্ব্বস্ব বলিয়া পরিগণিত হইবে।

 প্রাণের মধ্যে একবার স্বাধীনতা লাভের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হইলে ইহাকে চরিতার্থ করিবার জন্য উপযুক্ত উপায় অবলম্বন করিতে হইবে। এই উদ্দেশ্যে আমাদের সমস্ত শক্তি—শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক শক্তি সমূহ নিয়োগ করিতে হইবে। আমরা যে সমস্ত বিষয় লিখিয়াছি তাহার অনেকটা ভুলিতে হইবে এবং যাহা কখনও আমাদিগকে শিখান হয় নাই এমন অনেক বিষয় আমাদিগকে সর্ব্বপ্রথম শিক্ষা করিতে হইবে। স্বাধীনতা লাভের যে গুরু কর্ত্তব্যভার ইহাকে বহন করিবার জন্য শরীর ও মনকে নূতন করিয়া গঠন করিতে হইবে, নূতন শিক্ষায় শিক্ষিত করিতে হইবে, আমাদের জীবনের বাহ্যিক আবরণ দূর করিতে হইবে, বিলাসিতা এবং আমোদ-প্রমোদ বর্জ্জন করিতে হইবে, পুরাতন অভ্যাস পরিত্যাগ করিতে হইবে এবং নূতন জীবন-যাত্রা প্রণালী অবলম্বন করিতে হইবে এইভাবেই আমাদের সমগ্র জীবন পরিপূর্ণ এবং পবিত্র হইয়া স্বাধীনতা লাভের যোগ্যতা অর্জ্জন করিবে।

 মোটের উপর মানুষ একটা সামাজিক জীব। সমাজের অবশিষ্ট অংশ হইতে তাহাকে বিচ্ছিন্ন করিলে তাহার আত্মবিকাশ হইতে পারে না। জীবনে সর্ব্বাঙ্গীন উন্নতি, পরিণতি ও পরিপুষ্টির জন্য ব্যক্তিকে বহুল পরিমাণে সমাজের উপর নির্ভর করিতে হয়। পক্ষান্তরে সমাজও ব্যক্তিকে বাদ দিয়া চলিতে পারে না। তারপর ইহাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, সমগ্র সমাজের উন্নতি না হইলে একমাত্র ব্যক্তির উন্নতি দ্বারা বিশেষ ফল হয় না; এরূপ ব্যক্তিগত উন্নতির খুব বেশী মূল্য থাকে না। যোগী সন্ন্যাসীর যে আদর্শ তাহা আমাদের সমাজের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নহে। সামাজিক জীবনের মধ্যে যাহার স্থান নাই, সেই আদর্শের খুব বেশী মূল্য আছে বলিয়া আমি মনে করি না। সুতরাং স্বাধীনতাকেই যদি আমাদের জীবনের মূলনীতি বলিয়া গ্রহণ করিতে হয়, ইহাকেই যদি আমাদের সমস্ত কর্ম্ম-প্রচেষ্টার প্রেরণাদায়িনী শক্তি বলিয়া মনে করিতে হয়, তাহা হইলে আমাদের সমাজ সংস্কারের ভিত্তিও এই স্বাধীনতার উপরই প্রতিষ্ঠিত করা আবশ্যক। তাহা হইলে আমরা দেখিতে পাইব যে, এই স্বাধীনতার নীতি মোটের উপর সামাজিক বিপ্লব ছাড়া আর কিছুই নহে।

 সমগ্র সমাজের জন্য স্বাধীনতা বলিতে নারী ও পুরুষ—এই উভয়েরই স্বাধীনতা বুঝিতে হইবে। ইহাতে বুঝিতে হইবে— কেবল উচ্চ শ্রেণী নয়, অনুন্নত শ্রেণীকেও স্বাধীনতা দিতে হইবে। ধনী-দরিদ্র, যুবা-বৃদ্ধ, সকল সম্প্রদায়, সংখ্যায় লঘিষ্ঠ এবং সংখ্যায় গরিষ্ঠ সমাজ এবং সকল শ্রেণী ও সকল ব্যক্তিকেই স্বাধীনতা দিতে হইবে। এই দিক হইতে বিচার করিলে মনে হয়, স্বাধীনতা মানেই সাম্য এবং সাম্য মানেই ভ্রাতৃত্ব।

 সমাজকে বন্ধন-মুক্ত করিতে হইলে সামাজিক ব্যাপারে এবং আইনসঙ্গত বিষয়ে মহিলাদিগকে সমান অধিকার দিতে হইবে। যে সামাজিক বিধান দ্বারা, নিম্নবংশে জন্ম গ্রহণের জন্য, কোন কোন ব্যক্তি ও শ্রেণীকে ছোট করিয়া রাখা হইয়াছে সেই বিধান নির্ম্মমভাবে বিনষ্ট করিতে হইবে। ধনী ও দরিদ্রের পদমর্য্যাদার মধ্যে যে প্রভেদ তাহা দূর করিতে হইবে। যে সমস্ত প্রতিবন্ধক সামাজিক উন্নতির পথে বিঘ্ন উৎপাদন করে তৎসমস্তই বর্জ্জন করিতে হইবে। প্রত্যেককেই শিক্ষা ও আত্ম-বিকাশের জন্য সমান সুযোগ দিতে হইবে। যুবককে যুবক বলিয়া উপেক্ষা করিলে চলিবে না। সমাজ-সংস্কার এবং দেশ শাসনের ভার যুবক ও যুবতীদের উপরই ন্যস্ত করিতে হইবে। সমাজে, রাজনীতিক্ষেত্রে, আর্থিক ব্যাপারে—সর্ব্বত্র এবং সর্ব্ব বিষয়ে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সমান অধিকার দিতে হইবে—ইহাতে বৈষম্য রাখিলে চলিবে না। আমরা যে নূতন সমাজ গড়িয়া তুলিতে চাই সেই সমাজের গোড়ার কথা হইবে—সকলের জন্য সমান অধিকার, সমান সুযোগ, ঐশ্বর্য্যের উপর সকলের সমান অধিকার, বৈষম্যমূলক সামাজিক বিধান প্রত্যাহার, জাতিভেদ প্রথার বিলোপ এবং বৈদেশিক শাসন হইতে মুক্তি।

 বন্ধুগণ, আপনারা হয়ত আমার এই কল্পনাকে আকাশ-কুসুম বলিয়া মনে করিতেছেন। কেহ কেহ হয়ত ভাবিতেছেন—আমি এক জন স্বপ্নবিলাসী; বাস্তব জগতের সহিত আমার কোনই সম্পর্ক নাই। যদি ইহাই আপনাদের মনে হয়, তাহা হইলে আমি নাচার; দোষ স্বীকার ভিন্ন আমার আর উপায় নাই। আমি নিজকে স্বপ্নবিলাসী বলিয়া স্বীকার করিতেছি। তবে আমি এই স্বপ্নই ভালবাসি। আমার নিকট কিন্তু এই সমস্ত স্বপ্নই কঠোর বাস্তব সত্য বলিয়া মনে হয়। এই স্বপ্ন হইতেই আমি উদ্দীপনা লাভ করি, কাজ করিবার শক্তি আমার প্রাণে জাগে। এই সমস্ত স্বপ্ন না থাকিলে আমার পক্ষে জীবন ধারণ করাই অসম্ভব; কারণ তাহা হইলে জীবনের আর কোন মাধুর্য্যই থাকে না। এই সমস্ত স্বপ্ন ছাড়া সমগ্র জীবনই আমার নিকট ব্যর্থ বলিয়া মনে হয়।

 আমি যে স্বপ্ন ভালবাসি—সে হইতেছে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন; আপনার প্রভায় গৌরবান্বিত সমুজ্জ্বল ভারতের স্বপ্ন। আমি চাই— এই ভারত তাহার নিজ সংসারের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হউক; তাহার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার তাহারই হস্তগত হউক। আমি চাই—এদেশে একটা স্বাধীন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হউক, তাহার সৈন্য, তাহার নৌবল, তাহার বিমানপোত তাহার সমস্ত-ই স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র হউক। আমি চাই—পৃথিবীর স্বাধীন দেশসমূহে স্বাধীন ভারতের দূত প্রেরণ করা হউক। আমি দেখিতে চাই—প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যাহা কিছু মহত্তর তৎসমস্তেরই গৌরবে গৌরবান্বিত হইয়া এই ভারতমাতা, সমগ্র জগতের সমক্ষে ষড়ৈশ্বর্য্যশালিনীরূপে দণ্ডায়মান হউক। আমি চাই—এই ভারত দেশে দেশে পরিপূর্ণ সত্যের বাণী, সর্ব্বাঙ্গীন স্বাধীনতার বাণী প্রেরণ করুক।

 ছাত্র-বন্ধুগণ, আজ আপনারা ছাত্র হইলেও আপনারাই জাতির ভবিষ্যৎ আশা, ভারতের মঙ্গল। এদেশের ভবিষ্যৎ আপনাদের উপরই নির্ভর করিতেছে। আপনারাই স্বাধীন ভারতের ভাবী বংশধর হইতে চলিয়াছেন। আমি তাই আপনাদিগকে সাদরে আহ্বান করি—আপনারা আমার আশা আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নাবলীর কিছু কিছু অংশ গ্রহণ করুন। ইহা ছাড়া আমার আর কিছুই নাই; আর কিছুই আমি আপনাদিগকে দান করিতে পারি না। আমার এই দান আপনার গ্রহণ করিবেন কি? আপনার বয়সে তরুণ, আপনাদের হৃদয় আশায় ভরপুর। আপনাদের সম্মুখেই বৃহত্তর ও মহত্তর আদর্শের স্থান হওয়া উচিত। এই আদর্শ যতই উচ্চতর হইবে ততই আপনাদের সুপ্ত শক্তি জাগ্রত হইবে। অতএব হে ছাত্রগণ, উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত। জীবিকার্জ্জনের জন্য শিক্ষানবিশী করাই কেবল ছাত্র জীবনের কর্ত্তব্য নহে; তদপেক্ষা মহত্তর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রস্তুত হওয়াই ছাত্র জীবনের কর্ত্তব্য। কারণ কেবল অন্নবস্ত্র পাইলেই মানুষ জীবন ধারণ করিতে পারে না। আমি আপনাদের সম্মুখে ভবিষ্যতের একটি চিত্র উপস্থিত করিয়াছি। এই অনাগত যুগের জন্য আপনাদিগকে কিছু না কিছু কাজ করিতে হইবে, কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার করিতে হইবে এবং নির্য্যাতন ভোগের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। ভবিষ্যৎ জীবনের উপযোগী করিয়া আপনাদের দেহ ও মনকে গঠন করিতে হইবে। আপনাদের শিক্ষা দীক্ষা সমস্তই এই লক্ষ্য অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত করিতে হইবে।

 আমি যে জীবনের চিত্র আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছি তাহাতে দুঃখ কষ্ট এবং নির্য্যাতন আসিতে পারে—একথা অস্বীকার করি না। তবে একথায় বিশ্বাস করুন যে, ইহাতে আনন্দও কম পাইবেন না। আমি যে পথের কথা বললাম তাহা কণ্টকাকীর্ণ হইতে পারে। কিন্তু এই পথই কি একমাত্র গৌরবের পথ নহে? আমি তাই আপনাদিগকে আহ্বান করি,—আসুন আপনারা, আমরা সকলে এক দলে মিলিত হইয়া হাত ধরাধরি করিয়া গন্তব্য পথে যাত্রা করি। তাহা হইলেই আমাদের মানব জীবন ধন্য হইবে। দুঃখ-কষ্ট, নির্য্যাতন ও নিরাশার অন্ধকারের মধ্যে পা ফেলিয়া আমাদিগকে চলিতে হইবে বটে; তবে শেষ পর্য্যন্ত আমরা অবশ্যই চরম লক্ষ্যে পৌঁছিতে পারিব, পরমানন্দ এবং অমরত্ব লাভ করিতে পারিব। —বন্দেমাতরম।[১]

  1. ১৯২৯ সালের ১লা ডিসেম্বর তারিখে অমরাবতীতে মধ্যপ্রদেশ ৪ বেরারের ছাত্ত্র সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণ। ইংরাজী হইতে অনুদিত।