নূতনের সন্ধান/পঞ্জাব প্রাদেশিক ছাত্র-সম্মেলন

—৩—

 “আজিকার ছাত্র-আন্দোলন দায়িত্বহীন যুবক-যুবতীর একটা লক্ষ্যহীন অভিযান নহে। দায়িত্বশীল, কর্ম্মক্ষম যে সকল যুবক-যুবতী চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গঠিত করিয়া দেশের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করিতে চান, ইহা তাঁহাদের আন্দোলন।”

 “স্বাধীনতা বলিতে আমি বুঝি সমাজ ও ব্যক্তি, নর ও নারী, ধনী ও দরিদ্র সকলের জন্য স্বাধীনতা। ইহা শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় বন্ধনমুজি নহে—ইহা অর্থের সমান বিভাগ, জাতিভেদ ও সামাজিক অবিচারের নিরাকরণ ও সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতা ও গোঁড়ামির বর্জ্জনকেও সূচিত করে। এই আদর্শকে অবিবেচকেরা হয়ত অসম্ভব বলিবে—কিন্তু প্রাণের ক্ষুধাকে একমাত্র ইহাই শান্ত করিতে পারে।..সম্পূর্ণভাবে মুক্ত ভারতবর্ষের ধ্যানমুর্ত্তিই আমার হৃদয়কে অধিকার করিয়া রহিয়াছে।...জীবনের একটীমাত্র উদ্দেশ্য আছে তাহা হইতেছে সকল প্রকার বন্ধন হইতে মুক্তি। স্বাধীনতার জন্য উদগ্র আকাঙ্ক্ষাই হইতেছে জীবনের সুর।...জগতের সভ্যতার প্রতি ভারতবর্ষের একটা নব অবদান আছে।...স্বাধীনতাই জীবন—স্বাধীনতার সন্ধানে জীবনদানে আছে অবিনশ্বর গৌরব।”

পঞ্জাব-নিবাসী ভাই-ভগিনীগণ,  ঞ্চনদের পবিত্র ভূমিতে আমার এই প্রথম পদার্পণের দিনে আপনারা আমাকে যে সস্নেহ অভিনন্দন করিয়াছেন, তাহার জন্য আমার অন্তরের গভীরতম প্রদেশ হইতে ধন্যবাদ জানাইতেছি। আমি যে আপনাদের সম্মান ও অভ্যর্থনার যােগ্য নহি তাহা আমি জানি— তাই আজ আমার একমাত্র প্রার্থনা এই যে, এখানে যে সৌজন্য ও আতিথেয়তা আমি পাইয়াছি, তাহার কিছু যােগ্যতা যেন অর্জ্জন করিতে পারি।

 আপনাদের কাছে আমার মতামত ব্যক্ত করিবার জন্য আপনারা সুদূর কলিকাতা হইতে আমাকে আহ্বান করিয়াছেন। সেই আজ্ঞার বশবর্ত্তী হইয়াই আজ আমি আপনাদের সম্মুখে দাঁড়াইয়াছি। কিন্তু বিশেষ করিয়া আমাকেই আপনারা আহ্বান করিয়াছেন কেন? পূর্ব্ব ও পশ্চিম একত্র হইয়া তাহাদের সাধারণ সমস্যার সমাধান করিবে বলিয়াই কি? না, ইংরাজ কর্ত্তৃক সর্ব্বপ্রথমে বিজিত বঙ্গদেশ এবং ইংরাজের সর্ব্বশেষ অধিকার পঞ্চনদ —উভয়েই উভয়ের সাহায্য চায় বলিয়া? অথবা, আপনাদের ও আমার অন্তরে একই চিন্তা ও একই আশা জাগ্রত রহিয়াছে বলিয়া?

 ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বিতাড়িত ছাত্র আমি আজ লাহােরে ছাত্রদিগের মধ্যে বক্তৃতা করিতেছি, এ এক দৈবের কৌতুক! কোথা হইতে নূতন নূতন লােক একং নব নব ভাব আজ জগতে আদর পাইতেছে বলিয়া প্রবীণেরা যে বর্ত্তমান সময়কে দুঃসময় বলিয়া খেদ করিয়া থাকেন, তাহাতে আর আশ্চর্য্য হইবার কি আছে? আমার পূর্ব্ব ইতিহাস জানিয়া যদি আপনারা আমাকে আহ্বান করিয়া থাকেন, তবে আমি আজ কি বলিব, তাহা অনুমান করা আপনাদের পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন হইবে না।

 বন্ধুগণ, পঞ্জাব ও বিশেষ ভাবে পঞ্জাবের যুবকগণের প্রতি সশ্রদ্ধ ভাব আমার মনে জাগরূক রহিয়াছে, তাহার উল্লেখ যদি আজ সর্ব্বপ্রথমেই করি, আশা করি আপনারা আমাকে ক্ষমা করিবেন। যতীন্দ্রনাথ দাস ও অন্যান্য কারারুদ্ধ বাঙ্গালী দেশসেবকের জন্য তাঁহারা যেরূপ কষ্ট স্বীকার করিয়াছেন—বিচারে পক্ষ সমর্থনের ব্যবস্থা, প্রায়োপবেশনে সহানুভূতি, জীবিত ও মৃতাবস্থায় তাঁহাদের প্রতি সুগভীর স্নেহ ও সম্মান—বাঙ্গালীর হৃদয়কে মুগ্ধ করিয়াছে। শুধু তাই নয়, যতীন্দ্রের মৃতদেহ লইয়া বহু পাঞ্জাবী কলিকাতা পর্য্যন্তও গিয়াছিলেন। ভাবপ্রবণ জাতি আমরা—আপনাদের এই মহানুভবতা আমাদিগের ও আপনাদের মধ্যে এক অনির্ব্বচনীয় সখ্যতা আনিয়া দিয়াছে। ঘোর দুর্দ্দিনে একদিন পঞ্জাব বাঙ্গলার যে উপকার করিয়াছে, বাঙ্গালী তাহা কখনও বিস্মৃত হইবে না।

 বতীরে উল্লেখ করিয়া কলিকাতায় একদিন আপনাদের বিশিষ্ট নেতা ডাঃ আলম কথা-প্রসঙ্গে বলিয়াছেন যে, যতীন্দ্রের জীবন ও মৃত্যু যেন সূর্য্য ও চন্দ্রের বিপরীত গতির মত—জীবিতাবস্থায় কলিকাতা হইতে লাহোরে এবং মৃত্যুর পর লাহোর হইতে কলিকাতায়। মৃত্যুহত তাহার দেহ একটা নশ্বর মাংসপিণ্ডরূপে কলিকাতায় ফিরিয়া আসে নাই—আসিয়াছিল পবিত্র, মহৎ ও স্বর্গীয় একটা ভাবের প্রতীক হিসাবে। যতীন মরে নাই— ভবিষ্যৎবংশীয়দিগের পথ নির্দ্দেশ করিবার জন্য সে আকাশের তারকার মত উজ্জ্বল হইয়া জাতির জীবনে বাঁচিয়া আছে, তাঁহার আত্মত্যাগ ও দুঃখের মধ্য দিয়া সে অমর হইয়া আছে। ভাবমূত্তির মধ্যে, আদর্শের মধ্যে,—মানুষের ইতিহাসে যাহা কিছু মহৎ, যাহা কিছু পবিত্র,—তাহার মধ্যে সে দীপ্ত ভাস্বর হইয়া বিরাজ করিতেছে। আপনাকে বিসর্জজন দিয়া সে যে শুধু ভারতবর্ষের আত্মাটীকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছে, তাই নয়, দুইটী প্রদেশকে এক অচ্ছেদ্য শৃঙ্খলে বাঁধিয়া দিয়াছে।

 যতই আমরা ক্রমশঃ স্বাধীনতার নবপ্রভাতের দিকে অগ্রসর হইতেছি, ততই আমাদের দুঃখবেদনার পাত্র পূর্ণ হইয়া আসিতেছে। নিজেদের হাত হইতে রাজশক্তি প্রতিদিন অপসারিত হইতেছে দেখিয়া নির্দ্দয় হইয়া উঠা আমাদের শাসকদের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। আর, যদি ক্রমে ক্রমে সভ্যতার ভাণ ত্যাগ করিয়া, মনুষ্যত্বের ছদ্মবেশ ছাড়িয়া তাহারা অত্যাচারের ভীষণ স্বরূপ প্রকাশ করে, তাহাতেও আশ্চর্য্য হইবার কিছুই নাই। পঞ্জাব ও বাঙ্গলাদেশের উপরে আজকাল সকলের চেয়ে বেশী অত্যাচার করা হইতেছে। বস্তুতঃ, ইহা আনন্দের বিষয়; কারণ, এই অত্যাচারের মধ্য দিয়া আমরা স্বরাজের উপযুক্ত হইয়া উঠিতেছি। ভগৎসিংহ ও বটুকেশ্বর দত্তের মত বীরদের প্রাণশক্তিকে কখনও দমিত করিয়া রাখা যায় না; বরং, অত্যাচার ও দুঃখের মধ্য দিয়াই বীরের উদ্ভব হয়। তাই অত্যাচারকে আহ্বান করিয়া আনিতে হইবে এবং তাহার সম্পূর্ণ সুযোগ লইতে হইবে।

 আপনারা হয়ত জানেন না, বাঙ্গলা সাহিত্য পঞ্জাবের প্রাচীন ইতিহাসের কত ঘটনার বর্ণনা করিয়া নিজেকে সমৃদ্ধ করিয়াছে এবং পাঠকদের জ্ঞান বাড়াইয়াছে। রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বহু বিখ্যাত কবিই আপনাদের বীরগণের যশোগাথা গাহিয়াছেন। বাঙ্গলার ঘরে ঘরে তাঁহারা সুপরিচিত। আপনাদের সাধুসন্তগণের উপদেশাবলী আমাদের ভাষায় সুপ্রচলিত এবং বহু বাঙ্গালীকেই সান্ত্বনা ও শান্তি দিয়া থাকে। শুধু মানসিক যোগ নয়—রাজনীতির দিক দিয়াও আমরা পরস্পর সংযুক্ত। শুধু ভারতবর্ষের নয়, দূর ব্রহ্মদেশের কারাগারে এবং আন্দামান দ্বীপেও বাঙ্গলার স্বাধীনতা-পথের যাত্রীদের সঙ্গে পঞ্জাবের যাত্রীদের সাক্ষাৎ হইয়া থাকে।

 বন্ধুগণ, যদি এই বক্তৃতায় আমি বহুলভাবে রাজনীতির আলোচনা করি, তাহার জন্য কোন কৈফিয়ৎ আমি দিতে চাহি না। এদেশের এক শ্রেণীর লোক—তাহার মধ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট লোকও আছেন—মনে করেন যে, বিজিত জাতির পক্ষে রাজনীতি নিরর্থক এবং বিশেষ করিয়া ছাত্রদের রাজনীতিতে যোগদান করা উচিত নহে। আমার নিজের দৃঢ় মত এই যে, বিজিত জাতির পক্ষে রাজনীতির অনুশীলন ছাড়া অপর কোনও কর্ত্তব্য নাই। পরাধীন দেশে যে কোন সমস্যার সমাধান করিতে গেলেই দেখা যাইবে তাহার মূলে রহিয়াছে রাজনীতি। দেশবন্ধু বলিতেন, জীবন একটা অখণ্ড সমগ্র সত্তা—কাজেই রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে বা এই উভয়ের ও শিক্ষানীতির মধ্যে একটা ভেদরেখা টানা সম্ভব নহে। মানুষের জীবনকে খণ্ড খণ্ড করিয়া দেখা যায় না। জাতির জীবনের প্রত্যেকটা প্রকাশ পরস্পর সম্বন্ধ এবং প্রত্যেক সমস্যাই পরস্পর গ্রথিত। ইহা যদি সত্য হয়, তবে স্পষ্টই বুঝা যাইবে যে, পরাধীন জাতির সকল অন্যায়, সকল ত্রুটিবিচ্যুতির কারণ একটী মাত্র— রাজনৈতিক দাসত্ব। সুতরাং, যে সমস্যার প্রতি ছাত্রেরা কোন ক্রমেই উদাসীন হইতে পারে না, তাহা হইতেছে এই—কেমন করিয়া রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অর্জ্জন করা যাইতে পারে তাহার উপায় উদ্ভাবন।

 সকল রকমের জাতীয় কর্ম্মের প্রতি নিযেধাজ্ঞা জারী না করিয়া বিশেষভাবে রাজনীতির অনুশীলনকে কেন নিষেধ করা হয়, তাহা আমি বুঝিতে পারি না। জাতীয় কর্ম্মমাত্রের উপরেই নিষেধাজ্ঞার অর্থ বুঝা যায়, কিন্তু কেবল রাজনীতির সম্বন্ধে নিষেধাজ্ঞার কোনও অর্থই হয় না। পরাধীন দেশের সকল সমস্যাই যদি মূলতঃ রাজনৈতিক হয়, তবে জাতীয় কাজমাত্রেই রাজনৈতিক কাজ। কোনও স্বাধীন দেশেই রাজনীতিতে যোগদান করা নিষিদ্ধ নয়—বরং, সেখানে ছাত্রদিগকে এ কাজে উৎসাহই দেওয়া হইয়া থাকে, কারণ, ছাত্রদের মধ্য হইতেই ভবিষ্যতের মনীষী ও রাষ্ট্রবিদ্‌গণের উদ্ভব হয়। ভারতবর্ষের ছাত্রেরা যদি রাষ্ট্রীয় কর্ম্মে যোগদান না করে, তবে কর্ম্মীই পাওয়া যাইবে কোথা হইতে এবং তাহাদের শিক্ষাই বা হইবে কোথায়? তারপর, ইহা দ্বারা যে চরিত্র ও মনুষ্যত্বের বিকাশ হয়, তাহা স্বীকার করিতেই হইবে। “কর্ম্মবিহীন বিজন সাধনা”-য় কখনও চরিত্রগঠন হয় না, তাই রাজনৈতিক, সামাজিক ও কলাবিষয়ক কাজে নিয়োজিত থাকা অতি আবশ্যক। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবলমাত্র গ্রন্থকীট, ভাল ছেলে ও আপিসের কেরাণী গড়িয়া তোলার চেষ্টা করিয়া চলা উচিত নহে—তাহাদের উচিত, এমন সব যুবক গড়িয়া তোলা, যাহারা জীবনের সকল দিকেই দেশের জন্য সম্মান অর্জ্জন করিয়া যশস্বী হইবে।

 বর্ত্তমান কালের একটা সুলক্ষণ দেখিতে পাইতেছি এই যে, ভারতবর্ষের সকল স্থানেই একটা সত্যকার ছাত্র-আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছে। এই আন্দোলনকে আমি ব্যাপকতর যৌবন-আন্দোলনের একটী অংশ বলিয়া মনে করি। আজকালকার ছাত্র-সম্মিলনী এবং দশ বৎসর পূর্ব্বের ছাত্র-সম্মিলনীর মধ্যে প্রচুর প্রভেদ আছে। সে সময়কার ছাত্র-সম্মিলনীগুলি সাধারণতঃ সরকারের উদ্যোগেই অনুষ্ঠিত হইত এবং তাহার প্রবেশদ্বারেই লিখিত থাকিত— “রাজনীতি সম্বন্ধে কথা বলা নিষিদ্ধ।” একদিক দিয়া, সেই সকল সম্মিলনীর পূর্ব্বকালের কংগ্রেসের সঙ্গে তুলনা দেওয়া যাইতে পারে— সেখানে প্রথম প্রস্তাবেই রাজার প্রতি বাধ্যতা জানান হইত। ভারতবর্ষের জাতীয় কংগ্রেসে ও ছাত্র আন্দোলনে উভয় ক্ষেত্রেই আমরা সে-অবস্থা অতিক্রম করিয়া আসিয়াছি। আজ আমাদের চিন্তা ও আলোচনার পথ অনেক বেশী মুক্ত হইয়া গিয়াছে।

 আজিকার ছাত্র আন্দোলন দায়িত্বহীন যুবক-যুবতীর একটা লক্ষ্যহীন অভিযান নহে। দায়িত্বশীল, কর্ম্মক্ষম যে-সকল যুবকযুবতী চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব সুগঠিত করিয়া দেশের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করিতে চান, ইহা তাঁহাদের আন্দোলন। ইহার দুইটী কর্ম্মধারা আছে অথবা থাকা উচিত। প্রথমতঃ, যে-সব সমস্যা বিশেষভাবে ছাত্রদিগের নিজস্ব, তাহার সমাধানের চেষ্টা করা এবং শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক দিক্ দিয়া একটা নবজীবন আনয়ন করার চেষ্টা করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়তঃ, ছাত্রেরা ভবিষ্যতের দেশবাসী একথা স্মরণ করিয়া তাহাদিগকে জীবনের সংগ্রামক্ষেত্রের জন্য উপযুক্ত করিয়া গড়িয়া তোলা এবং সংসারে যে সকল সমস্যা ও বিরুশদ্ধক্তির সম্মুখীন হইতে হইবে, তাহার পূর্ব্বাভাষ এখন হইতেই তাহাদিগকে দেওয়া প্রয়োজন।

 আজকালকার যৌবন-আন্দোলনের বিশেষত্ব হইতেছে—একটা চঞ্চলতার ভাব, বর্ত্তমান অবস্থার প্রতি একটা অসহিষ্ণুতা এবং নূতনতর ও উৎকৃষ্টতর মানব-সমাজ স্থাপনা করিবার জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা। দায়িত্বজ্ঞান ও আত্মনির্ভরের ভাব এই আন্দোলনের মূলনিহিত। যৌবন আজ আর প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের ঘাড়ে সকল ভার চাপাইয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া থাকিতে চায় না—তাহারা মনে-প্রাণে অনুভব করে যে দেশ এবং দেশের ভবিষ্যৎ তাহাদের উপরেই নির্ভর করে, তাই সে দায়িত্বটীকে তাহারা অবশ্য কর্ত্তব্য বলিয়া গ্রহণ করে এবং তাহা রক্ষা করিবার উপযোগী হইবার সাধনা করে। যৌবন-আন্দোলনের অংশীভূত এই ছাত্র-আন্দোলন এক ভাব ও আদর্শের দ্বারাই অনুপ্রাণিত।

 যে দুইটী কর্ম্মধারার নির্দ্দেশ আমি করিয়াছি, তাহার প্রথমটী হয়ত সাধারণভাবে কর্তৃপক্ষের ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে পড়িতে না পারে, কিন্তু অপরটী নিষিদ্ধ হইবারই সম্ভাবনা বেশী। প্রথমটির দিক্ দিয়া আপনারা কি করিবেন, তাহার বিস্তৃত বিবরণ দিতে যাওয়া আমার পক্ষে উচিত বা বাঞ্ছনীয় হইবে না। আপনাদের বিশেষ বিশেষ প্রয়োজন ও সে সকল পূর্ণ করিবার উদ্দেশ্যে শিক্ষা-কর্ত্তারা কিরূপ ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহার উপর ইহা নির্ভর করে। প্রত্যেক ছাত্রেরই বল ও স্বাস্থ্য, উন্নত চরিত্র, জ্ঞানবত্তা এবং উচ্চ শক্তিসম্পন্ন আদর্শ থাকা অবশ্য প্রয়োজনীয়। যদি শিক্ষা-কর্ত্তাদের ব্যবস্থায় এই সকল প্রয়োজন সিদ্ধ না হয়, তবে আপনাদিগকেই তাহার ব্যবস্থা করিয়া লইতে হইবে। ইহাতে যদি তাঁহাদের ও গুরুজনদের উৎসাহ পান, তবে তো সে ভালই; যদি তাঁহারা প্রতিকূলচরণ করেন— তবে তাহা অগ্রাহ্য করিয়া আপনার পথে অগ্রসর হউন। আপনাদের জীবন আপনাদেরই—এবং তাহার উৎকর্ষের দায়িত্ব ও শেষ পর্য্যন্ত আপনাদেরই।

 এই সম্পর্কে একটা কথা আমি বলিতে চাই। আমার মনে হয়, ছাত্রসংঘগুলি এক একটী যৌথ স্বদেশী ভাণ্ডার (Co-operative Swadeshi Store) খুলিয়া ছাত্রদের বহু উপকার করিতে পারেন। ছাত্রেরা যদি সুচারুভাবে এই সকল ভাণ্ডার চালাইতে পারেন, তাহা হইলে দুইটী উদ্দেশ্য সাধিত হইবে। একদিকে, ছাত্রেরা অল্পমূল্যে স্বদেশী জিনিষ ব্যবহার করিতে পারিবে এবং বহু গৃহশিল্পের উৎসাহ বর্দ্ধন করা হইবে। অপর দিকে, চৌথ কারবার চালাইবার অভিজ্ঞতা অর্জ্জন করিয়া লভ্যাংশ ছাত্রসমাজের কল্যাণে ব্যয় করা যাইবে।

 ছাত্রদের কল্যাণের জন্য ব্যায়াম সমিতি, ব্যায়ামাগার, পাঠচক্র, আলোচনা-সমিতি, মাসিক পত্র পরিচালনা, সঙ্গীত সমাজ, পাঠাগার, সমাজকল্যাণ-সংঘ ইত্যাদি স্থাপনা করিতে হইবে।

 অপর দিক্‌টী সম্ভবতঃ ইহার চেয়ে বেশী প্রয়োজনীয়। সে হইতেছে ভবিষ্যতের দেশবাসী হইবার শিক্ষা গ্রহণ। এই শিক্ষা চিন্তা ও কার্য্য উভয় দিক্ দিয়াই হইবে। ছাত্রদিগের চক্ষের সম্মুখে এমন একটী আদর্শ নরসমাজের চিত্র ধরিতে হইবে, যাহাতে তাহারা ঐ আদর্শকে জীবনে বাস্তবে পরিণত করিতে চেষ্টা করে এবং এই সঙ্গে এমন একটী কর্ম্ম তালিকা তাহাদিগকে দিতে হইবে, যাহাকে তাহারা যতদূর সম্ভব পালন করিবে। এই কর্ম্মে তাহারা হয়ত কর্ত্তাদের নিকটে অনেক বাধা পাইবে। যদি দুর্ভাগ্যক্রমে এই বিরোধ ঘটে, তবে ছাত্রদের পক্ষে নির্ভীক ও আত্মনির্ভরশীল হুইয়া চিন্তায় ও কর্ম্মে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হওয়া ছাড়া আর উপায় নাই।

 যে আদর্শকে আমরা সযত্নে পোষণ করিব, তাহার সম্বন্ধে আমার ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করিবার পূর্বে আমি একটী কথা বলিতে চাই। ইউরোপের পদানত শৃঙ্খলিত এশিয়ার অবস্থা প্রত্যেক এশিয়াবাসীরই মনে দুঃখ ও অপমান বহিয়া আনে। কিন্তু একথা ভাবিলে ভুল করা হইবে যে, এশিয়ার অবস্থা চিরদিনই এরূপ ছিল। ইতিহাসের সাক্ষ্য হইতে জানা যায় যে, প্রাচীন কালে এশিয়া ইউরোপের বহু অংশ জয় করিয়া সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়াছিল। সে দিন ইউরোপ এশিয়ার নামে ভয়ে কম্পিত হইয়া উঠিত। সে অবস্থার আজ পরিবর্তন হয়ত হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে নিরাশার কারণ কিছুই নাই। আজ এশিয়া তাহার দাসত্ব-শৃঙ্খল মোচনের উদ্যোগ করিতেছে এবং অদূর ভবিষ্যতে একদিন শক্তি ও গৌরবে ভাস্বর হইয়া স্বাধীন জাতি সমূহের মধ্যে তাহার নির্দিষ্টস্থানে আসন গ্রহণ করিবে।

 পাশ্চাত্যের ব্যস্তবাগীশগণ কখনও কখনও এই প্রাচীন প্রাচ্যকে “অপরিবর্ত্তনশীল” বলিয়া নিন্দা করিয়া থাকে—যেমন কিছুদিন পূর্ব্বেও তাহারা তুরষ্ককে “ইউরোপের অসুস্থ জাতি” বলিয়া অভিহিত করিত। কিন্তু এই নিন্দা এসিয়া বা তুরষ্ক কাহারও পক্ষে সত্য নয়। সমস্ত প্রাচ্যদেশ আজ নব জাগরণের বিপুল শক্তিতে টলমল। সর্ব্বত্রই পরিবর্ত্তন, উন্নতি এবং সমাজব্যবস্থার সঙ্গে বিরোধ জাগিয়া উঠিয়াছে। যতদিন ইচ্ছা প্রাচ্য অবশ্য অপরিবর্ত্তনশীল থাকিতে পারে, কিন্তু একবার পরিবর্ত্তন আরম্ভ করিলে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের বহু সম্মুখে অগ্রসর হইতে পারে। আজ এসিয়ায় তাহাই ঘটিতেছে।

 মাঝে মাঝে কেহ প্রশ্ন করেন—আজ এসিয়া, বিশেষ করিয়া ভারতবর্ষে যে চাঞ্চল্য দেখিতেছি, তাহা কি সত্য সত্যই জীবনের চিহ্ন, না বাহিরের উত্তেজনার একটা প্রতিক্রিয়া মাত্র? আমি মনে করি, নব নব সৃষ্টিই জীবনের লক্ষণ। যখন দেখিতে পাই যে, বর্ত্তমান আন্দোলনে একটা নূতন পথ কাটিয়া নব নব সৃষ্টির উদ্যম পূর্ণ বেগে চলিতেছে, তখনই বুঝিতে পারি যে, সত্য সত্যই জাতির নবজাগরণ আসিয়াছে, এবং ইহা সত্য সত্যই অন্তরের মধ্য দিয়া পুনঃ চেতনার গভীর আলোড়ন।

 ভারতবর্ষে আজ আমরা একটা ভাবধারার ঘূর্ণাবর্ত্তের মাঝখানে রহিয়াছি। তাহার চারিদিক দিয়া বহু অনুকুল ও প্রতিকূল স্রোত বহিয়া চলিয়াছে। এই তুমুল মিশ্রণের অব্যবস্থার মধ্যে সাধারণ লোক ভালমন্দ ন্যায় অন্যায়ের মধ্যে প্রভেদ করিতে পারে না। কিন্তু আজ যদি আমাদিগকে জাতির লুপ্ত শক্তিকে ফিরাইয়া আনিয়া তাহাকে লক্ষ্যপথে চালাইতে হয়, তবে আমাদের লক্ষ্য কি এবং কেমন করিয়া সেই লক্ষ্যে পৌঁছান যায়, তাহার সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণ। করিতে হইবে।

 একটা তিমির-যুগ পার হইয়া ভারতবর্ষের সভ্যতা আজ নবজীবনের পথে চলিয়াছে। ফিনিসীয়া ও ব্যাবিলনের সভ্যতার মত এই সভ্যতা স্বাভাবিকভাবে বিলুপ্ত হইবে কি না, একদিন সেই ভাবনা ছিল, কিন্তু আবার তাহা কালের অত্যাচার কাটাইয়া উঠিয়াছে। আবার নূতন করিয়া বাঁচিতে হইলে আমাদিগকে চিন্তাজগতে একটা ভাব-বিপ্লব আনিতে হইবে এবং জীবজগতে নব-রক্তের সংমিশ্রণ করিতে হইবে। ইতিহাসের এবং মনীষিগণের মত মানিতে হইলে স্বীকার করিতে হইবে যে, এই এক উপায়েই প্রাচীন জীর্ণ সমাজকে শক্তিমান্ করিয়া তোলা সম্ভব। আমার কথায় বিশ্বাস না হইলে আপনারা সভ্যতার উত্থান-পতনের নিয়মটী নিজের চেষ্টায় আবিষ্কার করুন। এই নিয়মটী আবিষ্কার করিতে পারিলেই আমরা দেশবাসীকে পরামর্শ দিতে পারিব, উন্নতিশীল, শক্তিধর জাতি সৃষ্টি করিতে হইলে কি পথ অবলম্বন করিতে হইবে।

 ভাবজগতে বিপ্লব আনিতে হইলে আমাদিগকে এমন একটী আদর্শকে চোখের সম্মুখে আনিয়া ধরিতে হইবে, যাহা বিদ্যুতের মত আমাদের শক্তিকে উন্মুখ করিয়া তুলিবে। সে আদর্শ হইতেছে স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতার অর্থ সকলে এক বুঝেন না; আমাদের দেশেও স্বাধীনতার অর্থের একটা ক্রম পরিবর্ত্তন হইতেছে। স্বাধীনতা বলিতে আমি বুঝি সমাজ ও ব্যক্তি, নর ও নারী, ধনী ও দরিদ্র সকলের জন্য স্বাধীনতা, ইহা শুধু রাষ্ট্রীয় বন্ধন-মুক্তি নহে, ইহা অর্থের সমানবিভাগ, জাতিভেদ ও সামাজিক অবিচারের নিরাকরণ ও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামি বর্জ্জনও সূচিত করে। এই আদর্শকে অবিবেচকেরা হয়ত অসম্ভব বলিবে—কিন্তু প্রাণের ক্ষুধাকে একমাত্র ইহাই শান্ত করিতে পারে।

 জাতীয় জীবনের যত দিক দিয়া প্রকাশ হইতে পারে স্বাধীনতার আংশিক রূপ ততগুলিই। কেহ কেহ স্বাধীনতা বলিতে স্বাধীনতার একটী বিশেষ দিকের কথাই বুঝেন। স্বাধীনতার এই সঙ্কীর্ণ সংজ্ঞাটাকে কাটাইয়া উঠিয়া ব্যাপক অর্থটী গ্রহণ করিতে আমাদের বহু বৎসর লাগিয়াছে। যদি স্বার্থের মুখ না চাহিয়া স্বাধীনতার জন্যই স্বাধীনতাকে আমরা ভালবাসিতে চাই, তাহা হইলে একথা বুঝিবার সময় আসিয়াছে যে, সত্যকার স্বাধীনতার অর্থ কেবল মাত্র ব্যক্তির জন্য নয়, সমগ্র সমাজের জন্যও সকল প্রকার বন্ধন হইতে মুক্তি। এযুগের আদর্শ তাহাই—সম্পূর্ণভাবে মুক্ত ভারতবর্ষের ধ্যানমূর্ত্তিই আমার হৃদয়কে অধিকার করিয়া রহিয়াছে।

 স্বাধীনতা অর্জ্জনের একমাত্র উপায় হইতেছে স্বাধীন ব্যক্তির ন্যায় চিন্তা ও অনুভব করা। অন্তরে একটা পূর্ণ বিপ্লবের বন্যা বহিয়া যাউক এবং স্বাধীনতার মদিরপ্রবাহ আমাদের শিরায় শিরায় বহিয়া যাউক। স্বাধীন হইবার ইচ্ছা যখন আমাদের মধ্যে জাগ্রত হইয়া উঠিবে, তখন কর্ম্মের একটা অশ্রান্ত প্রবাহ আমাদের হৃদয়ে যাইবে। ভীরুর সাবধান বাণী তখন আমাদিগকে নিবৃত্ত করিতে পারিবে না—সত্য ও কর্ম্মের আহ্বান আমাদিগকে তখন লক্ষ্যে পৌঁছিয়া দিবে।

 বন্ধুগণ, জীবনের লক্ষ্য হিসাবে আমি যাহা চিন্তা ও অনুভব করি এবং যাহা আমার সকল কর্ম্মের পশ্চাতে ইঙ্গিত স্বরূপ রহিয়াছে, সেই আদর্শের কথা আপনাদিগকে বলিবার চেষ্টা করিয়াছি। আপনাদিগের মনে ইহা ভাল লাগিবে কি না তাহা আমি জানি না। কিন্তু আমি জানি, যে, জীবনের একটীমাত্র উদ্দেশ্য আছে, তাহা হইতেছে সকলপ্রকার বন্ধন হইতে মুক্তি। স্বাধীনতার জন্য উদগ্র আকাঙ্ক্ষাই হইতেছে জীবনের মূল সুর—সদ্যোজাত শিশুর প্রথম ক্রন্দন ধ্বনিই তো বন্ধনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা। আপনাদের নিজেদের প্রাণে এবং দেশবাসীর প্রাণে স্বাধীনতার এই তীব্র আকাঙ্ক্ষাটী জাগাইয়া তুলুন—তাহা হইলে ভারতবর্ষ অল্পদিনের মধ্যেই স্বাধীনতা লাভ করিবে।

 ভারতবর্ষ স্বাধীন হইবেই, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। রাত্রির পর দিন যেমন আসিবেই, তেমনি ইহাও আসিবে। ভারতবর্ষকে বাঁধিয়া রাখিতে পারে, এমন কোনও শক্তি এ পৃথিবীতে আজ নাই। কিন্তু আসুন, এমন মহীয়সী ভারতের ধ্যানচিত্র আজ আমরা গড়িয়া তুলি, যাহার জন্য জীবন-সর্ব্বস্বধন বলি দিয়া আমরা ধন্য হইতে পারি। আমি ভারতবর্ষের যে মূর্ত্তি কল্পনা করিয়াছি, তাহা আপনাদিগকে বলিয়াছি। স্বাধীন ভারতবর্ষ তাহার মুক্তিবাণী জগতের কাছে দিকে দিকে ঘোষণা করুক।

 আমি বলিতে চাই, ভারতবর্ষের একটা বিশেষ বাণী আছে এবং জগতকে তাহা শুনাইবার জন্যই ভারতবর্ষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া বাঁচিয়া আছে। জগতের সাধনা ও সভ্যতার প্রায় প্রতি রূপেই ভারতবর্ষের একটা নব অবদান দিবার আছে। এই হীনতা ও পরাধীনতার মধ্যেও তাহার দান বড় নগণ্য নয়। আপনার প্রয়োজন মত আপনার পথে চলিবার স্বাধীনতা পাইলে সে-দান কত বৃহৎ ও মূল্যবান হইবে, তাহা একবার চিন্তা করিয়া দেখুন।

 দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিও হয়ত স্বাধীনতার এই বিস্তৃত ব্যাখ্যা গ্রহণ করিবেন না। তাঁহাদিগকে সন্তুষ্ট করিতে অসামর্থ্য অবশ্যই দুঃখের বিষয়; কিন্তু সত্য, ন্যায় ও সাম্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত এই আদর্শকে আমরা এখনই ত্যাগ করিতে পারি না। অপর কেহ আমাদিগের সঙ্গে যদি যোগ না দেয় তবে আমাদিগকে একাই চলিতে হইবে—কিন্তু একথা নিশ্চিত যে লক্ষ লক্ষ লোক এই স্বাধীনতার পথে যাত্রায় যোগ দিবে। বন্ধন, অন্যায় ও অসাম্যের সঙ্গে যুদ্ধের বিরতি হইতেই পারে না।

 দেশের সকল স্বাধীনতাকামীরই সংঘবদ্ধ হইয়া স্বাধীনতার সৈনিক শ্রেণী গঠন করিবার সময় আসিয়াছে।

 ইহারা কেবলমাত্র স্বাধীনতার সংগ্রামে যোগ দিবে না— স্বাধীনতার বাণী প্রচার করিবার জন্যও দিকে দিকে প্রচারক প্রেরণ করিবে। আপনাদের মধ্য হইতেই এই প্রচারক ও সৈন্যদলের সৃষ্টি করিতে হইবে। বিস্তৃত ও অন্তর্ব্যাপী (intensive) প্রচার ও দেশব্যাপী স্বেচ্ছাসেবকদল গঠন আমাদের কর্ম্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত হইবে। আমাদের প্রচারকগণ চাষী ও কারখানার মজুরদের মধ্যে গিয়া নব বাণীর প্রচার করিবে। তাহারা যুবকদের এবং তাহাদের সংঘগুলিকে অনুপ্রাণিত করিবে। পরিশেষে তাহারা দেশের সমগ্র নারীজাতিকে উদ্বুদ্ধ করিবে—কারণ, আজ নারীকে সমাজে ও রাষ্ট্রে পুরুষের সমান অধিকার লইয়া দাঁড়াইতে হইবে।

 বন্ধুগণ, আপনাদের মধ্যে অনেকেই এখন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দলভুক্ত হইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন। জাতীয় কংগ্রেসই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ জাতীয় প্রতিষ্ঠান। জাতির সকল আশা ভরসা ইহার উপর ন্যস্ত। কিন্তু শক্তি ও প্রতিষ্ঠার জন্য ইহার শ্রমিক আন্দোলন, যৌবন আন্দোলন, চাষী আন্দোলন, নারী আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলনের উপরে নির্ভর করিতে হয় এবং আমার মতে, করা উচিত। যদি আমরা শ্রমিক, চাষী, তথা-কথিত নিম্নজাতি, যুবকবৃন্দ, ছাত্রগণ ও নারীদিগকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করিয়া তুলিতে পারি, তবে কংগ্রেস অসীম শক্তিমান হইয়া দেশের মুক্তি আনয়ন করিতে পারিবে। সুতরাং, যদি আপনারা সার্থকভাবে কংগ্রেসের সেবা করিতে চাহেন, তাহা হইলে এই সকল আন্দোলনকেও আপনাদের জাগাইয়া তুলিতে হইবে।

 আমাদের ঘরের পাশেই চীনদেশ—তাহার ইতিহাসের একটী যুগ পর্য্যবেক্ষণ করুন—দেখিতে পাইবেন মাতৃভূমির জন্য চীনের ছাত্রেরা কি করিয়াছেন। ভারতবর্ষের জন্য আমরা কি সেটুকু করিতে পারি না? আধুনিক চীনের নবজাগরণ তো ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্যই সম্ভবপর হইয়াছে। একদিকে তাহারা গ্রামে গ্রামে সহরে সহরে কারখানায় গিয়া স্বাধীনতার নূতন বাণী প্রচার করিয়াছে, অপর দিকে একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত দেশকে তাহারা সংঘবদ্ধ করিয়াছে। ভারতবর্ষে আমাদেরও তাহাই করিতে হইবে। স্বাধীনতার কোনও সহজ নির্ব্বিঘ্ন পথ নাই। স্বাধীনতার পথে যেমন আঘাত-বিপদ আছে, তেমনি গৌরব ও অমরত্ব আছে। প্রাচীনের যাহা কিছু শৃঙ্খলের মত আমাদের চলাকে প্রতিপদে প্রতিহত করিয়া আসিতেছে, আজ তাহাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তীর্থযাত্রীর মত দলে দলে স্বাধীনতার লক্ষ্যপথে যাত্রা করিতে হইবে। স্বাধীনতাই জীবন, স্বাধীনতার সন্ধানে জীবনদানে অবিনশ্বর গৌরব। আসুন আজ আমরা সম্মিলিত হইয়া স্বাধীনতা লাভ করিতে প্রাণপণ চেষ্টা করি—সেই উদ্যমে জীবনপাত করিয়া আমরা মৃত্যুজয়ী যতীন্দ্রনাথের স্বদেশবাসী হইবার উপযুক্ত হই! বন্দে মাতরম্‌।

(বিগত ১৯শে অক্টোবর ১৯২৯ লাহোরে পঞ্জাব ছাত্র সম্মিলনীর সভাপতির অভিভাষণ। ইংরাজী হইতে অনুদিত।)