নূতনের সন্ধান/হুগলী জেলা ছাত্র-সম্মেলন

—২—

“প্রত্যেক ব্যক্তির বা জাতির একটা ধর্ম্ম বা আদর্শ আছে। সেই আদর্শকে অবলম্বন ও আশ্রয় করিয়া সে গড়িয়া উঠে। সেই আদর্শকে সার্থক করাই তার জীবনের উদ্দেশ্য এবং সেই আদর্শকে বাদ দিলে তার জীবন অর্থহীন ও নিষ্প্রয়োজন হইয়া যায়।”

 *

 * *

 পনারা আজ কিসের জন্য এই ছাত্রসভায় আমায় আহ্বান করিয়াছেন তাহা আপনারাই জানেন। তবে এই সভায় আসিবার প্রবৃত্তি বা সাহস যে আমার হইয়াছে তার একমাত্র কারণ এই যে আমি মনে করি আমি আপনাদের মতই ছাত্র; “জীবন বেদ” আমি অধ্যয়ন করিয়া থাকি এবং বাস্তব জীবনের কঠিন আঘাতে যে জ্ঞানের উন্মেষ হয় সেই জ্ঞান আহরণে আমি এখন রত।

 প্রত্যেক ব্যক্তির বা জাতির একটা ধর্ম্ম বা আদর্শ (ideal) আছে। সেই ideal বা আদর্শকে অবলম্বন ও আশ্রয় করিয়া সে গড়িয়া উঠে। সেই idea কে সার্থক করাই তার জীবনের উদ্দেশ্য এবং সেই ideal বা আদর্শকে বাদ দিলে তার জীবন অর্থহীন ও নিষ্প্রয়োজন হইয়া পড়ে। দেশ ও কালের গণ্ডীর মধ্যে আদর্শের ক্রমবিকাশ বা অভিব্যক্তি এক দিনে বা একবৎসরে হয় না। ব্যক্তির জীবনে সাধনা যেরূপ বহুবৎসর ব্যাপী হইয়া থাকে, জাতির জীবনেও সেইরপ সাধনার ধারা পুরুষানুক্রমে চলিয়া আসে। তাই মনীষীরা বলিয়া থাকেন—আদর্শ একটা প্রাণহীন ও গতিহীন বস্তু নয়। তার বেগ আছে, গতি আছে, প্রাণসঞ্চারিণী শক্তি আছে।

 যে আদর্শ আমাদের সমাজে গত একশত বৎসর ধরিয়া আত্মবিকাশের চেষ্টা করিতেছে আমরা তার পরিচয় সব সময়ে না পাইতে পারি। যে চিন্তাশীল, যার অন্তর্দষ্টি আছে শুধু সে ব্যক্তি বাহ্য ঘটনা পরম্পরার অন্তরালে অন্তঃসলিলা ফল্গুনদীরূপা এই আদর্শের ধারাকে ধরিতে পারে। এই আদর্শই আমাদের যুগধর্ম্ম—the idea of the age. ইহার উপলব্ধি হইলে মানুষ বুঝিতে পারে তার পথ কি, তার পথ প্রদর্শক কে। কিন্তু এই উপলব্ধি সব সময়ে হয়না বলিয়া আমরা প্রায়ই ভ্রান্ত পথের দিকে আকৃষ্ট হই এবং ভ্রান্ত গুরু অনুবর্ত্তী হইয়া থাকি। হে ছাত্রমণ্ডলী, যদি জীবন গঠন করি চাও—তবে ভ্রান্ত গুরু ও ভ্রান্ত পথের প্রভাব হইতে আত্মরক্ষা কর এবং নিজে আত্মস্থ হইয়া জীবনের প্রকৃত আদর্শ চিনিয়া লও।

 বৎসর পূর্ব্বে যে আদর্শ বাঙ্গলার ছাত্রসমাজকে অনুপ্রাণিত করিত তাহা স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ। সে আদর্শের প্রভাবে তরুণ বাঙ্গালী ষড়রিপু জয় করিয়া স্বার্থপরতা ও সকল প্রকার মলিনতা হইতে মুক্ত হইয়া আধ্যাত্মিক শক্তির বলে শুদ্ধ বুদ্ধ জীবন লাভের জন্য বদ্ধপরিকর হইত। সমাজ ও জাতি গঠনের মূল—ব্যক্তিত্ব বিকাশ। তাই স্বামী বিবেকানন্দ সর্ব্বদা বলিতেন “man making is my mission”—খাঁটি মানুষ তৈয়ারী করাই আমার জীবনের উদ্দেশ্য।

 কিন্তু ব্যক্তিত্ব বিকাশের দিকে এত জোর দিলেও স্বামী বিবেকানন্দ জাতির কথা একেবারে ভুলিয়া যান নাই। কর্ম্মবিহীন সন্ন্যাসে অথবা পুরুষকারহীন অদৃষ্টবাদে তিনি বিশ্বাস করিতেন না। রামকৃষ্ণ পরমহংস নিজের জীবনের সাধনার ভিতর দিয়া সর্ব্ব ধর্ম্মের যে সমন্বয় করিতে পারিয়াছিলেন তাহাই স্বামীজির জীবনের মূল মন্ত্র ছিল এবং তাহাই ভবিষ্যৎ ভারতের জাতীয়তার মূল ভিত্তি। এই সর্ব্ব-ধর্ম্ম-সমন্বয় ও সকল-মত-সহিষ্ণুতার প্রতিষ্ঠা না হইলে আমাদের এই বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে জাতীয়তা-সৌধ নির্ম্মিত হইতে পারিত না

 বিবেকানন্দ-যুগের পূর্ব্বে যখন আমাদের দেশে নবযুগ প্রথম আরম্ভ হয় তখন আমাদের পথ প্রদর্শক ছিলেন রাজা রামহেন রায়। ধর্ম্মের নামে যে সব অধর্ম্ম চলিতেছিল এবং যে সব আবর্জ্জনা ও কুসংস্কার ধর্ম্মের নামে সমাজ-দেহকে আচ্ছাদন করিয়াছিল এবং হিন্দু সমাজকে শতধা বিভক্ত করিয়াছিল, তাহা ধ্বংস করিবার জন্য রাজা রামমোহন কৃতসংকল্প হইয়াছিলেন। বেদান্তের সত্য প্রচারিত হইলে হিন্দু সমাজ-ধর্ম্মের বহিরাবরণ বর্জ্জন করিয়া সত্য ধর্ম্ম আশ্রয় করিতে পারিবে এবং ভেদজ্ঞান ভুলিয়া আবার একতাসূত্রে আবব্ধ হইতে পারিবে, এ বিশ্বাস তাঁহার ছিল। ধর্ম্মজগতে বিপ্লব আনিতে হইলে, আগে চিন্তাজগতে আলোড়ন উপস্থিত করা দরকার—তাই ভারতের চিন্তা-শক্তিকে জাগাইবার জন্য তিনি পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিয়াছিলেন।

 ভারতকে জাগাইবার জন্য মনোরাজ্যে যে বিপ্লব রামমোহন প্রবর্ত্তিত করিলেন, পরবর্ত্তী যুগে সে বিপ্লব সমাজের মধ্যে আসিয়া পড়িল। কেশবচন্দ্রের যুগে সমাজ সংস্কারের কাজ দ্রুতগতিতে চলিতে লাগিল। ব্রাহ্মসমাজের নূতন বাণীর ফলে সমগ্র দেশে নব জাগরণ আরম্ভ হইল। কিছুকাল পরে যখন ব্রাহ্ম সমাজ হিন্দুসমাজ হইতে পৃথক হইয়া পড়িল এবং হিন্দুসমাজের মধ্যেও জাগরণের সূচনা হইল তখন ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাব ক্রমশঃ হ্রাস পাইতে লাগিল।

 রামমোহনের যুগ হইতে বিভিন্ন আন্দোলনের ভিতর দিয়া ভারতের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ক্রমশঃ প্রকটিত হইয়া আসিতেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই আকাঙ্ক্ষা চিন্তারাজ্যে ও সমাজের মধ্যে দেখা দিয়াছিল কিন্তু রাষ্ট্রীয়ক্ষেত্রে তখনও দেখা দেয় নাই—কারণ তখনও ভারতবাসী পরাধীনতার মোহনিদ্রায় নিমগ্ন থাকিয়া মনে করিতেছিল যে, ইংরাজের ভারত-বিজয় একটা দৈব ঘটনা বা divine dispensation. ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে স্বাধীনতার অখণ্ড রূপের আভাস রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের মধ্যে পাওয়া যায়। “Freedom, freedom is the song of the soul”, এই বাণী যখন স্বামীজির অন্তরের রুদ্ধ দুয়ার ভেদ করিয়া নির্গত হয় তখন তাহা সমগ্র দেশবাসীকে মুগ্ধ ও উন্মত্তপ্রায় করিয়া তোলে। তাঁর সাধনার ভিতর দিয়া—আচরণের ভিতর দিয়া কথা ও বক্তৃতার ভিতর দিয়া—এই সত্যই বাহির হইয়াছিল।

 স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে যাবতীয় বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া খাঁটি মানুষ হইতে বলেন এবং অপর দিকে সর্ব্ব-ধর্ম্মসমন্বয় প্রচারে ভারতের জাতীয়তার ভিত্তি স্থাপন করেন। রামমোহন রায় মনে করিয়াছিলেন যে, সাকারবাদ খণ্ডন করিয়া এবং বেদান্তের নিরাকারবাদ প্রতিষ্ঠার দ্বারা তিনি জাতিকে একটা সার্ব্বভৌমিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাইতে পারিবেন। ব্রাহ্ম সমাজও সেই পথে চলিয়াছিল কিন্তু ফলে হিন্দু সমাজ যেন আরও দূরে সরিয়া গেল। তার পর বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ মূলক বা দ্বৈতাদ্বৈতবাদ মূলক সত্য প্রচারের দ্বারা এবং সকল-মতসহিষ্ণুতার, শিক্ষা দিয়া রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ জাতিকে একসূত্রে গাঁথিবার চেষ্টা করিলেন।

 যে স্বাধীনতার অখণ্ড রূপ বিবেকানন্দের মধ্যে আমরা দেখিতে পাই তাহা বিবেকানন্দের যুগে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে প্রবেশ করে নাই। অরবিন্দের মুখে আমরা সর্ব্বপ্রথমে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার বাণী শুনিতে পাই। অরবিন্দ যখন “বন্দেমাতরম্‌” পত্রিকায় লিখিলেন—“We want complete autonomy free from British control” —তখন স্বাধীনতাকামী তরুণ বাঙ্গালী বুঝিল যে, এত দিন পরে সে মনের মত মানুষ পাইয়াছে। ভাবপ্রবণ বাঙ্গালী স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখিয়া বিভোর হইল। এখনও কাণে বাজে সেই বাণী যাহা অরবিন্দ কলিকাতার মুক্ত প্রাঙ্গনে দাঁড়াইয়া একদিন বলিয়াছিলেন:—

 “I should like to see some of you becoming great; great, not for your own sake, but to make India great—so that she may stand up with head erect among the free nations of the world.”

 পরিপূর্ণ স্বাধীনতার প্রেরণা পাইয়া বাঙ্গালী জাতি ঝড় তুফান অগ্রাহ্য করিয়া, বিপ্লবের ঝঞ্ঝার ভিতর দিয়া ছুটিয়া আসিয়াছে।

 ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে আমরা যখন আসিয়া পৌঁছিলাম তখন অসহযোগের বাণীর সাথে সাথে আমরা আর একটা কথা শুনিলাম মহাত্মা গান্ধীর মুখে—“জনসাধারণকে বাদ দিলে এবং তাহাদের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা না জাগাইতে পারিলে, স্বরাজ লাভ হইতে পারে না।” অসহযোগের পন্থা ভারতে বা বাঙ্গলা দেশে নূতন কিছু নয়। সে দিনও যশোহর জেলাবাসী এই পন্থা অবলম্বন করিয়া নীলকরের অত্যাচার হইতে আত্মরক্ষা করিয়াছিল। কিন্তু যে “গণবাণী” মহাত্মা গান্ধীর মুখে শোনা যায়, তাহা ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নূতন কথা।

 এই বাণী আরও পরিস্ফুট হইয়াছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের জীবনে। তিনি তাঁহার লাহোরের বক্তৃতায় অতি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে, যে স্বরাজ তিনি লাভ করিতে চান—তাহা মুষ্টিমেয় লোকের জন্য নহে—তাহা সকলের জন্য, জন সাধারণের জন্য। “Swaraj for the masses”—এই আদর্শ তিনি নিখিল ভারতীয় শ্রমিক সভায় দেশবাসীর সম্মুখে উপস্থিত করেন।

 আর একটা বাণী আমরা দেশবন্ধুর জীবনে পাই—সেটা এই যে মানুষের জীবন—জাতির এবং ব্যক্তির জীবন—একটা অখণ্ড সত্য। এই জীবনকে দ্বিধা বা বহুধা বিভক্ত করা যায় না। মানুষের প্রাণ যখন জাগে তখন তাহা সব দিক দিয়া জাগরণের পরিচয় দেয় এবং সর্ব্বক্ষেত্রে নবজীবনের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বজগৎ—তথা মানুষজীবন—বৈচিত্র্যপূর্ণ। এই বৈচিত্র্যের লোপ সাধন করিলে জীবনের বিকাশ হইবে না—বরং আমরা মরণের বা ধ্বংসের নিকটবর্ত্তী হইব। তাই বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়া, “বহুর” মধ্য দিয়া ব্যক্তির এবং জাতির বিকাশ সাধন করিতে হইবে।

 বর্ত্তমান যুগে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ আধ্যাত্মিক জগতে “এক” এবং “বহুর” মধ্যে যে সমন্বয় স্থাপন করিয়াছিলেন—সে সমন্বয় দেশবন্ধু জাতির জীবনে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে করিয়াছিলেন বা করিতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন। দেশবন্ধু “শিক্ষার মিলনে” যেরূপ বিশ্বাস করিতেন “শিক্ষার বিরোধে” ও তদ্রূপ বিশ্বাস করিতেন —এক কথায় তিনি Federation of Cultures এ বিশ্বাস করিতেন এবং ভারতের মৌলিক একতায় প্রগাঢ় বিশ্বাসী হইলেও বাঙ্গলার বৈশিষ্ট্যেও বিশ্বাসবান্ ছিলেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি ভারতবর্ষের পক্ষে Centralised State অপেক্ষা Federal State বেশী পছন্দ করিতেন।

 যে সর্ব্বাঙ্গীন বিকাশে দেশবন্ধু এত বিশ্বাসী ছিলেন তাহাই এই যুগের সাধনা। এই সাধনা সার্থক করিতে হইলে স্বাধীনতার অখণ্ড রূপ আগে দর্শন করা চাই। আদর্শের পরিপূর্ণ উপলব্ধি হইলে মানুষ কর্ম্মক্ষেত্রে কখনও জয়যুক্ত হইতে পারে না। তাই আজ সারা ভারতকে এবং বিশেষ করিয়া ভারতের তরুণ সমাজকে বলিয়া দিতে হইবে যে, যে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন আমরা দেখি—সে রাজ্যে সকলে মুক্ত, ব্যক্তি মুক্ত, সমাজও মুক্ত, সেখানে মানুষ রাষ্ট্রীয় বন্ধন হইতে মুক্ত, সামাজিক বন্ধন হইতে মুক্ত এবং অর্থের বন্ধন হইতে মুক্ত। রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতি—এই ত্রিতাপ হইতে আমরা মানব জাতিকে— দেশবাসীকে মুক্ত করিতে চাই।

 যাহারা মনে করে যে, রাষ্ট্রীয় বন্ধন হইতে তাহারা দেশকে মুক্ত করিবে কিন্তু সমাজের পূর্ব্বাবস্থা বজায় রাখিবে—অথবা যাহারা মনে করে যে সামাজিক বন্ধন সব চূর্ণ করিবে কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কোনও বিপ্লব আনিবে না—তাহারা সকলেই ভ্রান্ত। বস্তুতঃ শরীরে স্বাস্থ্য ফিরিয়া আসিলে প্রত্যেক অঙ্গে যেরূপ অপূর্ব্বশ্রী ফিরিয়া আসে তেমনি মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যখন জাতির অন্তরে জাগিয়া উঠে তখন তাহা সব দিক দিয়া ফুটিয়া বাহির হয়। জাতি যখন সমস্ত বন্ধন হইতে মুক্ত হইতে চায় তখন কেহ বলিতে পারে না— Thus far and no further.

 আমাদের এই শত ছিদ্র-যুক্ত, পূতিগন্ধময় সমাজের দ্বারা পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ কোনও দিন হইবে না। পূর্ণ স্বাধীনতা (Complete Independence) লাভ করিতে হইলে সমস্ত জাতিকে মুক্তিলাভের জন্য ক্ষিপ্তপ্রায় হইতে হইবে। কিন্তু যে ব্যক্তি সামাজিক অত্যাচারে নিষ্পিষ্ট অথবা অর্থনীতিক বৈষম্যে ভারাক্রান্ত, সে ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য পাগল হইবে কেন? যার কাছে সামাজিক ও অর্থনীতিক অত্যাচারই সব চেয়ে বড় সত্য—সে ব্যক্তি এই সব অত্যাচার হইতে মুক্ত না হইতে পারিলে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা লাভের জন্য উদগ্রীব হইবে কেন?

 আজ এই কথাটা আমি খুব বড় করিয়া এখানকার ছাত্র সমাজের মধ্যে বলিতে আসিয়াছি—যে যুগে আপনারা জন্মিয়াছেন সে যুগের ধর্ম্ম—পরিপূর্ণ ও সর্ব্বাঙ্গীন মুক্তিলাভ। স্বাধীন দেশে, স্বাধীন আবহাওয়ার মধ্যে আমাদের জাতি জন্মিতে চায়—বর্দ্ধিত হইতে চায় এবং মরিতে চায়। “পুরুষ অবরুদ্ধ আপন দেশে, নারী অবরুদ্ধ নিজ নিবাসে”—এ অবস্থা আর কত দিন চলিবে? আর আমাদের নারী সমাজের বর্ণনা করিবার সময়ে আমরা কত দিন আর বলিব—

“সচল হয়েও অচল সে যে
বস্তার চেয়েও ভারী,
মানুষ হয়েও সংএর পুতুল
বঙ্গদেশের নারী।”

 স্বাধীনতার নামে অনেকের অতিঙ্ক উপস্থিত হয়। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার কথা ভাবিলে অনেকে স্বপ্ন দেখেন রক্ত-গঙ্গার এবং ফাঁসিকাষ্ঠের এবং সামাজিক স্বাধীনতার কথা ভাবিলে অনেকে দর্শন করেন উচ্ছৃঙ্খলার বিভীষিকা। কিন্তু আমি উচ্ছৃঙ্খলার ভয়ে ভীত নহি। মানুষের মধ্যে যদি ভগবান বিরাজ করেন, অথবা মানুষের মধ্যে যদি মানবতা থাকে, যদি ভগবান সত্য হন—যদি মানুষ সত্য হয়—তবে মানুষ চিরকাল পথভ্রষ্ট বা ভ্রান্ত হইতে পারে না। স্বাধীনতার মদিরা পান করিয়া যদি আমরা কিছু সময়ের জন্য অপ্রকৃতিস্থ হই তাহা হইলেও অচিরে আমরা আত্মস্থ হইব। আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির যে দাবী—তাহা ভুলভ্রান্তি করিবার অধিকারের দাবী বই আর কিছু নয় (the right to make mistakes). অতএব উদ্ধৃঙ্খলার বিভীষিকা না দেখিয়া মুক্তিপথে আগুয়ান হও; নিজের মানবতায় বিশ্বাসী হইয়া মনুষ্যত্ব লাভের চেষ্টায় সর্বদা নিরত হও।

 আজ দেশের মধ্যে তিনটী বড় সম্প্রদায় একপ্রকার নিশ্চেষ্ট হইয়া পড়িয়া আছে—নারী সমাজ, উপেক্ষিত তথাকথিত অনুন্নত সমাজ এবং কৃষক ও শ্রমিক সমাজ। ইহাদের নিকট গিয়া বল—তোমরাও মানুষ, মনুষ্যত্বের পূর্ণ অধিকার তোমরাই পাইবে। অতএব ওঠো, জাগো, নিশ্চেষ্টতা পরিহার করিয়া নিজের অধিকার কাড়িয়া লও।

 হে বাঙ্গলার ছাত্র ও তরুণ সমাজ! তোমরা পরিপূর্ণ ও অখণ্ড মুক্তির উপাসক হও। তোমরাই ভবিষ্য ভারতের উত্তরাধিকারী; অতএব তোমরাই সমস্ত জাতিকে জাগাইবার ভার গ্রহণ কর। তোমাদের প্রত্যেকের মধ্যে আছে—অনন্ত, অপরিসীম শক্তি। এই শক্তির উদ্বোধন কর এবং এই নবশক্তি অপরের মধ্যে সঞ্চারিত কর; তোমাদের নিকট নূতন স্বাধীনতা মন্ত্রে দীক্ষিত সমস্ত জাতি আবার বাঁচিয়া উঠুক।

 যে দিন ভারত পরাধীন হইয়াছে—সেই দিন হইতে ভারত সমষ্টিগত সাধনা (Collective Sadhana) ভুলিয়া ব্যক্তিত্ব বিকাশের দিকে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিয়াছে। ফলে কত শত মহাপুরুষ এই দেশে আবির্ভূত হইয়াছেন অথচ তাঁহাদের আবির্ভাব সত্ত্বেও জাতি আজ কিরূপ শোচনীয় অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছে! জাতিকে আবার বাঁচাইতে হইলে সাধনার ধারা আবার অন্য দিকে পরিচালিত করিতে হইবে। জাতিকে বাদ দিয়া ব্যক্তিত্বের সার্থকতা নাই—একথা আজ সকলকে হৃদয়ঙ্গম করিতে হইবে।

 আমাদের জাতির বহুলোক—পুরুষানুক্রমে বহু জ্ঞান ও সম্পদ আহরণ করিয়া আসিতেছে। এতদিন পর্য্যন্ত সমস্ত জাতি সে জ্ঞান ও সে সম্পদের অধিকারী হইতে পারে নাই। আজ হইতে তাহাকে উহার অধিকারী করিয়া দিতে হইবে। সকলকে বুঝাইয়া দিতে হইবে যে, ভারতের প্রতিষ্ঠা আমরা করিতে চাই—সেখানে জাতিধর্ম্ম নির্ব্বিশেষে সকলের সমান অধিকার, সমান দাবী ও সমান সুযোগ থাকিবে। যে দিন সমস্ত দেশ এ কথা বুঝিবে সে দিন সমস্ত সমাজ মুক্ত হইবার জন্য অধীর ও উন্মত্ত হইবে।

 আর একটী কথা বলিয়া আমার বক্তব্য শেষ করিব। জাতির রক্তস্রোত যেন ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে—এখন চাই নূতন রক্ত। ভারতের ইতিহাস পড়িয়া দেখ—বহুবার রক্ত সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে। এই রক্ত সংমিশ্রণের ফলে ভারতীয় জাতি বার বার মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া পুনর্জ্জীবন লাভ করিয়াছে। যাঁহারা বর্ণশঙ্করের ভয় করেন তাঁহারা আমাদের জাতির ইতিহাস জানেন না এবং তাঁহারা মানববিজ্ঞান (anthropology) সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। আজ অসবর্ণ বিবাহ অনুমোদন করিয়া রক্ত-সংমিশ্রণের সহায়তা করিতে হইবে। এখন এই রক্তসংমিশ্রণ ঘটাইবার জন্য বিদেশের উপর নির্ভর করিবার প্রয়োজন নাই। আমাদের দেশে অসবর্ণ বিবাহ বহুকাল নিষিদ্ধ ছিল বলিয়া আমার মনে হয় যে, অসবর্ণ বিবাহ প্রবর্ত্তনের দ্বারা যথেষ্ট রক্তসংমিশ্রণ ঘটিবে এবং এই রক্ত সংমিশ্রণের ফলে জীবনীশক্তি আমরা ফিরিয়া পাইব।

 ভ্রাতৃমণ্ডলী! আজ আমার বক্তব্য এইখানে শেষ করিব। সাম্যবাদ ও স্বাধীনতা মন্ত্র প্রচার করিবার জন্য তােমরা গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া পড়। স্বাধীন ভারতের যে দৃশ্য আজ তােমাদের সম্মুখে ধরিলাম তাহা সমগ্র দেশবাসীর সম্মুখে ধর। স্বাধীনতার পুর্ব্বাস্বাদ নিজের অন্তরে পাইলে সকলেই পাগল হইয়া উঠিবে। এই আস্বাদ—এই অনুভূতি নিজের অন্তরে আগে অবশ্য পাওয়া চাই। নিজের অন্তরে এই আলােক জ্বালাে—সেই দীপ হস্তে লইয়াই দেশবাসীর দ্বারস্থ হও। যাও চীনা ছাত্রদের মত—রুষ তরুণদের মত—চাষীর পর্ণকুটীরে ও মজুরদের আবর্জ্জনাপূর্ণ ভগ্ন গৃহে। তাহাদের জাগাও। আর যাও—মাতৃজাতির সমীপে। যাঁরা শক্তিরূপিনী অথচ সমাজের চাপে আজ যাঁরা হইয়াছেন— “অবলা”—তাঁদেরও জাগাও—বল—

“আপনার মান রাখিতে জননী,
আপনি কৃপাণ ধর।”

সর্ব্বোপরি যাও দলে দলে বাঙ্গলার উপেক্ষিত সমাজের কাছে। বল—“ভাই এতদিন পরে এসেছি তােমাদের কাছে নূতন মন্ত্র নিয়ে তােমাদের মুক্ত করতে—মনুষ্যত্বের পূর্ণ অধিকার তােমাদেরও প্রাপ্য এই কথা তোমাদের বলতে। তোমরা ওঠো, জাগো—এ বীরভোগ্যা বসুন্ধরা তোমাদেরও ভোগ্যা।”

জিজ্ঞাসা করি—একাজ করতে পারবে? হাঁ পারবে, অবশ্য পারবে। তোমরা পারবে এ কাজ করতে—এ কথা আমি আজ বলতে এসেছি। এগিয়ে চলো—জয়লাভ তোমাদের অবশ্যম্ভাবী। তোমাদের সাধনা সিদ্ধ হউক—ভারত আবার মুক্ত হউক— তোমাদের জীবনও সার্থক হউক।

[হুগলী জেলা ছাত্র সম্মেলন—সভাপতির অভিভাষণ; ২১শে জুলাই, ১৯২৯