নূতনের সন্ধান/সুর্ম্মা উপত্যকা ছাত্র-সম্মেলন

নূতনের সন্ধান

ছাত্র আন্দোলন

 “ছাত্র জীবনের উদ্দেশ্য শুধু পরীক্ষা পাশ ও স্বর্ণপদক লাভ নহে— দেশ সেবার জন্য প্রাণের সম্পদ ও যোগ্যতা অর্জ্জন করা। দেশমাতৃকার চরণে নিজেকে নিঃশেষে বিলাইয়া দিব—ইহাই একমাত্র সাধনা হওয়া উচিত; এই সাধনার আরম্ভ ছাত্র-জীবনেই করিতে হইবে।”


 ছাত্রমণ্ডলী যদি আমাকে তাদের মধ্যেই একজন বিবেচনা করিয়া সভাপতি করিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমি তাহাদের নিকট বাস্তবিকই কৃতজ্ঞ। আমি তাহাদের শ্রদ্ধা চাই না, কারণ শ্রদ্ধার যোগ্য আমি নই; আমি চাই তাদের ভালবাসা, আমি চাই তাদের আপন হতে। আমাকে আপন বোধ করিয়া তাহারা সভাপতি বরিয়া থাকিলে আমার এখানে আসা সার্থক হইয়াছে।

 আমি ছাত্রদের ভালবাসি। একথা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে তাহাদের মনোভাব, তাহাদের সুখ-দুঃখ, তাহাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা আমি বুঝি। ছাত্রজীবনে কি লাঞ্ছনা ও অত্যাচার সহিতে হয় তাহার অভিজ্ঞতা আমার আছে। তাই লাঞ্চিত। ছাত্র-সমাজের মর্ম্মের ব্যথা আমি উপলব্ধি করিতে পারি।

 যে সমাজে ছাত্রেরা শ্রদ্ধা ও সম্মান পায় না—যে সমাজে ছাত্রেরা শিশুবৎ, কেবল কৃপার ও উপদেশের পাত্র—সে সমাজে মনুষ্য সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। আমরা মুখে বলি—“প্রাপ্তে তু যোড়শবর্ষে পুত্রং মিত্র বদচিরেৎ”—কিন্তু ব্যবহারে বয়স্ক পুত্রকে শিশুজ্ঞান করিয়া থাকি, যদিও সে পুত্র সাবালক হইয়া বি, এ, এম্‌, এ, পাশ করিয়াছে। চল্লিশ বৎসর প্রাপ্ত হইয়াও পুত্র খোকার ন্যায় ব্যবহার পায়—এরূপ ঘটনা বিরল নয়। আর দুঃখের বিষয় এই, আমরা এরূপ ব্যাপারে লজ্জা বোধ না করিয়া গৌরব অনুভব করিয়া থাকি! প্রৌঢ়াবস্থা প্রাপ্ত হইয়া যাহাদের নাবালকত্ব ঘুচে না, তাহাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সাইমন কমিশন এদেশে আসিলে কি বিস্মিত হইবার কোনও হেতু আছে?

 হিন্দুজাতি ত গর্ব্ব করিয়া থাকে যে তাহারা মাতৃমূর্ত্তির ভিতর দিয়া ভগবানের আরাধনা করিয়া থাকে এবং তাহারা বাল-গোপাল রূপের মধ্যে ভগবানকে পাইয়াছে। কিন্তু আমি হিন্দুজাতিকে জিজ্ঞাসা করি, একবার বুকে হাত দিয়া বলুন—“আমাদের সমাজে বর্ত্তমান সময়ে ঘরে এবং বাহিরে আমরা মাতৃজাতির সম্মান রক্ষা করিতে পারিতেছি কিনা—এবং আমাদের সমাজে বালক ও যুবকেরা মনুষ্যোচিত ব্যবহার পায় কি না?”

 মাতৃজাতির সম্মান যদি আমরা রক্ষা করিতে পারিতাম তাহা হইলে বাঙ্গলার জেলায় জেলায় দিনের পর দিন নারী সমাজের উপর শত লাঞ্ছনা ও অত্যাচার ঘটিত না এবং ঘটিলেও আমাদের পুরুষ-সমাজ অম্লান বদনে ও নিশ্চিন্ত মনে তাহা সহ্য করিত না। আজ যদি বাঙ্গলা দেশে পুরুষ থাকিত তাহা হইলে মাতৃজাতির অসম্মান দেখিয়া তাহারা ক্ষিপ্তপ্রায় হইত এবং বীরশ্রেষ্ঠ খড়গ বাহাদুর সিংহের মত প্রাণের মায়া ত্যাগ করিয়া মাতৃজাতির সম্মান রক্ষার্থে কর্ম্ম-সমুদ্রে ঝাঁপ দিত।

 হে ছাত্রবৃন্দ, ইংরাজকে তোমরা হয় তো ঘৃণা করিয়া থাক-কিন্তু আমি বলি, ইংরাজ যেরূপ তাহার নারীজাতির সম্মান করিতে জানে, তাহা শিক্ষা কর ইংরাজের নিকট। তোমার দেশে তোমার মা ও ভগিনীর মর্য্যাদা রক্ষা হয় না—আর মুষ্টিমেয় ইংরাজ এই দেশে তেত্রিশ কোটি বিদেশীর মধ্যে ইংরাজ মহিলার সম্মান কি করিয়া রাখে? তাহার কারণ এই যে, একজন ইংরাজ মহিলার উপর অত্যাচার হইলে সমস্ত ইংরাজজাতি পাগলপ্রায় হয় এবং সে অপমানের প্রতিশোধ লইবার জন্য সমগ্র জাতি বদ্ধপরিকর হয়। ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে মিস্ এলিসের পাঠান কর্ত্তৃক অপহরণের ঘটনা হয় তো আপনাদের স্মরণ আছে।

 আমরা মুখে বলি, “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী”। কিন্তু সমস্ত প্রাণ দিয়া কি আমরা জননী ও জন্মভূমিকে ভালবাসি? জননীকে ভালবাসার অর্থ শুধু নিজের প্রসূতিকে ভালবাসা নয়সমস্ত মাতৃজাতিকে ভালবাসা। বাঙ্গলা দেশ-বাঙ্গলার জল, বাঙ্গলার মাটি, বাঙ্গলার আকাশ, বাঙ্গলার বাতাস, বাঙ্গলার শিক্ষাদীক্ষা ও প্রাণধর্ম্ম-বাঙ্গলার নারীজাতির মধ্যে মূর্ত্ত হইয়া উঠিয়াছে। যে ব্যক্তি বাঙ্গলার মাতৃজাতিকে শ্রদ্ধা করিতে জানে না—সে বাঙ্গলা দেশকে কি করিয়া শ্রদ্ধা করিবে? যে ব্যক্তি বাঙ্গলা দেশকে অন্তরের সঙ্গে শ্রদ্ধা করে না—ভালবাসে না—সে কি করিয়া মানুষ হইবে? মহান আদর্শকে যে ভালবাসে না—যে পাত্রে সেই আদর্শ মূর্ত্ত হইয়া উঠিয়াছে—সে পাত্রকে যে ভালবাসে না—সে ব্যক্তি কোনও দিন মানুষ হইতে পারিবে না। জীবনে যাহা কিছু পবিত্র, যাহা কিছু সুন্দর, যাহা কিছু কল্যাণকর—সে সবের সমাবেশ আমরা করিয়া থাকি, দেশমাতৃকার অপরূপ রূপের মধ্যে এবং ত্রিলোকজয়ী ভুবনমনােমােহিনী মাতৃমূর্ত্তিতে। অতএব হে ভ্রাতৃমণ্ডলী, মায়ের আরাধনা করিতে শিখ; মাতৃজাতিকে ভক্তি কর, শ্রদ্ধা কর; নিজের দেশে মাতৃজাতির সম্মান অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য কৃতসঙ্কল্প হও।

 মনে রাখিও সেই কথা—যাহা বহুযুগ পূর্ব্বে মনু বলিয়াছিলেন:—

“যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে, রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ॥
শােচন্তি মাময়াে যত্র বিনশ্যত্যাশু তৎকুলং।
ন শােচন্তি তু বত্রৈতা বিবর্দ্ধতে তদ্ধি সর্ব্বদা॥

 “যেখানে নারী পুজিতা হন তথায় দেবতারা আনন্দলাভ করিয়া থাকেন; যেখানে নারীর সম্মান নাই, সে দেশে সমস্ত ক্রিয়াকাণ্ড একেবারে বিফল। ষে কুলে নারীরা শোক করিয়া থাকেন (বা উৎপীড়িতা হইয়া থাকেন) সে কুল অতি শীঘ্র বিনষ্ট হয় এবং যে কুলে তাহাদের কোনও দুঃখ, কষ্ট শোক নাই—সে কুলের শ্রীবৃদ্ধি হইয়া থাকে।” যে যুগে এ দেশে নারীজাতির সম্মান অক্ষুন্ন ছিল, সে যুগে মৈত্রেয়ী, গার্গীর মত ঋষিপত্নী জন্মিয়াছিল, সে যুগে খনা, লীলাবতীর মত বিদূষীর আবির্ভাব হইয়াছিল, অহল্যাবাই ও ঝানসীর রাণীর মত বীর-রমণীর অভ্যুদয় হইয়াছিল। এ সোণার বাঙ্গলায়ও আমরা একদিন রাণীভবানী ও দেবীচৌধুরাণীর মত রমণী দেখিয়াছিলাম।

 আমার ছাত্রবন্ধুরা হয় তো আশ্চর্য্য হইতেছেন যে, ছাত্র সম্মিলনীতে আমি এ সব কথার অবতারণা কেন করিতেছি? কিন্তু বড় ব্যথা পাইয়া একথা আমি আজ বলিতে বাধ্য হইয়াছি। নারী সমাজ যে পর্য্যন্ত বীর-প্রসু না হইতেছে, সে পর্য্যন্ত আমরা জাতি হিসাবে মনুষ্যত্ব লাভ করিতে পারিব না। কিন্তু যে পর্য্যন্ত আমরা ঘরে ও বাহিরে মাতৃ-জাতিকে সম্মান ও গৌরবের আসনে না বসাইতেছি, সে পর্য্যন্ত এ দেশের নারী-জাতি বীর প্রসবিনী হইতে পারেন না। আমাদের মাতৃজাতিকে আমরা যদি শক্তিরূপিণী করিতে চাই তাহা হইলে বাল্য-বিবাহ প্রথা উচ্ছেদ করিতে হইবে; স্ত্রীজাতিকে আজীবন ব্রহ্মচর্য্য পালনের অধিকার দিতে হইবে; উপযুক্ত স্ত্রী শিক্ষার আয়োজন করিতে হইবে; অবরোধ প্রথা দূর করিতে হইবে; বালিকা ও তরুণীদের ব্যায়াম শিক্ষার এবং লাঠি ও ছোরা খেলা শিক্ষার আয়োজন করিতে হইবে—এমন কি স্বাবলম্বী হইবার মত অর্থকরী শিক্ষাও দিতে হইবে, এবং বিধবাদের পুনর্ব্বিবাহের অনুমতি দিতে হইবে।

 যদি এই সব নীতি কার্য্যে পরিণত করিতে হয় তাহা হইলে সে ভার যুবকদের গ্রহণ করিতে হইবে। কারণ বহুযুগ সঞ্চিত কুসংস্কার বশতঃ যাহারা ধর্ম্ম ও লোকাচারকে অভিন্ন জ্ঞান করেন, সেই সব প্রাচীন পন্থীরা হয় তো এ কাজে বিশেষ বাধা প্রদান করিবেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখিতে পাওয়া যায় যে, রাষ্ট্রীয় বিপ্লব করা বরং সহজ কিন্তু সামাজিক বিপ্লব বা সংস্কার সাধন করা তদপেক্ষা কঠিন। কারণ রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের সময়ে লড়াই করিতে হয় শত্রুর সঙ্গে এবং এই কার্য্যে পাওয়া যায় জাতি ও মত নির্ব্বিশেষে সমগ্র দেশবাসীর সহানুভূতি। মধ্যে মধ্যে কারাযন্ত্রণা ও অন্যান্য অত্যাচার সহিতে হয় বটে কিন্তু সমগ্র দেশবাসীর ভালবাসা ও সহানুভূতি লাঞ্ছিত সেবককে সঞ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করে। সামাজিক বিপ্লবের চেষ্টা যাহারা করে তাহাদের বিপদ অন্য প্রকার। তাহদের লড়াই করিতে হয়—দেশবাসীর সঙ্গে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে, আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে। নিজের ঘরে তাহাদিগকে দিবারাত্রি লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা সহিতে হয় এবং অখণ্ড সমাজের সহানুভূতি তাহারা কোনও দিন পায় না। আত্মীয় স্বজনের সহিত, গুরুজনের সহিত বিবেক-প্রণোদিত হইয়া বিরোধ করিতে অনেক সময়ে মানুষের অবস্থা কুরুক্ষেত্র প্রাঙ্গনে অৰ্জ্জুনের অবস্থার মত হইয়া দাঁড়ায়। সুতরাং এরূপ সংগ্রামে অপূর্ব্ব শক্তি, সাহস ও তেজ চাই। হে বন্ধুগণ, সে শক্তির সাধনা তোমরা কর।

 আমি গোড়ায় বলিয়াছি যে আমাদের দেশে এখনও যুবক-সমাজ ও ছাত্র-সমাজ তাহার যোগ্য আসন পায় নাই। অভ্যাসের দরুণ আমরা আমাদের অবস্থা উপলব্ধি করি না। কিন্তু স্বাধীন দেশে আমরা যখন যাই তখন সেখানকার অবস্থার সহিত নিজের অবস্থা তুলনা করিয়া আমাদের চক্ষু উন্মীলিত হয়। স্বাধীন দেশের ছাত্রসমাজ অভিভাবকদের নিকট, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ত্তৃপক্ষের নিকট, পুলিশের নিকট, গবর্ণমেণ্টের নিকট এবং সমাজের নিকট যে সমাদর—এমন কি শ্রদ্ধা পাইয়া থাকে তাহা আমাদের অনেকের কল্পনার বাহিরে। আর আমাদের ছাত্রেরা নিজেদের ঘরে কৃপার পাত্র, বিদ্যালয়ে উপদেশের ও শাসনের পাত্র, সমাজে নাবালকের তুল্য এবং পুলিশ ও গবর্ণমেণ্টের নিকট নিত্য অবিশ্বাসের পাত্র। এই অবিশ্বাস, অশ্রদ্ধা ও শাসনের ভিতর মনুষ্যত্বের উদ্বোধন কি করিয়া সম্ভব? স্বাধীন দেশের ছাত্র-সমাজ যে সমাদর ও শ্রদ্ধা পায় তাহার ফলে তাহাদের দায়িত্ববোধ ফুটিয়া উঠে, কর্ত্তব্য-বুদ্ধি জাগরিত হয় এবং তাহাদের অন্তর্নিহিত দেবত্বের স্ফুরণ হয়। আমাদের সমাজের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ এই যে আমাদের ছাত্রেরা যেরূপ ব্যবহার পাইয়া থাকে তাহা মনুষ্যত্ব বিকাশের সহায়ক বা অনুকূল নয়।

 তবে আশার কথা এই যে, এখনকার ছাত্রেরা আর নিশ্চেষ্ট নয়। সমাজের অপেক্ষায় বসিয়া না থাকিয়া তাহারা নিজেদের উদ্ধার-সাধনে ব্রতী হইয়াছে। তাই আজ সমগ্র বঙ্গদেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন আমরা দেখিতে পাইতেছি। ছাত্র-সমাজ নিজেদের উদ্ধার সাধন করিয়া নূতন সমাজ সৃষ্টি করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছে। আমি আশা করি ও বিশ্বাস করি যে, যে সমাদর ও শ্রদ্ধা স্বাধীন দেশের ছাত্রসমাজ সমস্ত দেশের নিকট পাইয়া থাকে, সে সমাদর ও শ্রদ্ধা এ দেশের ছাত্রসমাজও ক্রমশঃ অর্জ্জন করিবেন—নিজের শক্তি, সাধনা ও যোগ্যতার বলে; শ্রীযুক্ত খড়্গ বাহাদুর সিংহের মত ছাত্র আজ সমস্ত দেশে সকল শ্রেণীর নিকট শ্রদ্ধা ও ভক্তি অর্জ্জন করিয়াছে নিজের সাহস ত্যাগ ও শক্তির বলে। ঠিক এমনই ভাবে বাঙ্গলার ছাত্রসমাজ ক্রমশঃ আত্ম-প্রতিষ্ঠা লাভ করিবে।

 মানুষের উন্নতির পথে সর্ব্বাপেক্ষা বড় অন্তরায় ভ্রান্ত আদর্শ। মানুষ যখন কোনও সৎ বা অসৎ কাজ করে, তখন সে কোন নীতির দোহাই দিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিতে চায়। বর্ত্তমান ছাত্রসমাজ কতকগুলি ভ্রান্ত আদর্শ গ্রহণ করিয়া তারই সাহায্যে অন্যায় আচরণ করে এবং অন্যায় আচরণের প্রশ্রয় দেয়। উদাহরণস্বরূপ আমি একটি কথার উল্লেখ করিতে পারি যাহা আমরা প্রায়ই শুনিয়া থাকি—“ছাত্রাং অধ্যয়নং তপঃ”—অধ্যয়নই ছাত্রজীবনের তপস্যা। এই বচনের দোহাই দিয়া ছাত্রদিগের দেশসেবার কার্য্য হইতে নিরস্ত রাখিবার চেষ্টা অনেকেই করিয়া থাকেন।

 অধ্যয়ন কোনও দিন তপস্যা হইতে পারে না। অধ্যয়নের অর্থ কতকগুলি গ্রন্থ পাঠ ও কতকগুলি পরীক্ষা পাশ। ইহার দ্বারা মানুষ স্বর্ণপদক লাভ করিতে পারে—হয় তো বড় চাকুরী পাইতে পারে—কিন্তু মনুষ্যত্ব অর্জ্জন করিতে পারে না। পুস্তক পাঠ করিয়া আমরা উচ্চভাব বা আদর্শ শিক্ষা করিতে পারি—এ কথা সত্য কিন্তু সে সব ভাব যে পর্য্যন্ত আমরা উপলব্ধি ও হৃদয়ঙ্গম করিয়া কার্য্যে পরিণত না করিতেছি সে পর্য্যন্ত আমাদের চরিত্র গঠন হইতে পারে না। তপস্যার উদ্দেশ্য সত্যকে উপলব্ধি করা—শ্রবণ, মনন নিদিধ্যাসন প্রভৃতি উপায়ে তদ্‌ভাবভাবিত হইয়া সত্যের সহিত মিশিয়া যাওয়া। সে অবস্থায় মানুষ যখন পৌঁছায় তখন তাহা জীবনের রূপান্তর হয়। সে তখন জীবনের প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্য বুঝিতে পারে এবং অন্তর্লব্ধ নূতন শক্তি ও আলোকের দ্বারা সে নূতন পথে নূতন ভাবে তাহার জীবন নিয়ন্ত্রিত করে। এরূপ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিতে হইলে অল্প বয়স হইতেই কাজ আরম্ভ করা আবশ্যক। যখন মানুষের অদম্য শক্তি ও উৎসাহ আছে, অফুরন্ত কল্পনা-শক্তি ও ত্যাগস্পৃহা আছে, নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষ যখন ভালবাসিতে পারে —তখনই সে আদর্শের চরণে আত্মবলিদান করিতে পারে—অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করিয়া ভাবের তরঙ্গে জীবনতরী ভাসাইয়া দিতে পারে।

 সুতরাং কৈশোর ও যৌবনই সাধনার প্রকৃষ্ট সময়। টাট্‌কা বাঙ্গা খুলেই দেবীর আরাধনা হইয়া থাকে, পুরাণো বাসি ফুলের দ্বারা সে পূজার কাজ সমাধা হইতে পারে না। তাই বলি হে আমার তরুণ ভাইসব, তোমাদের হৃদয় যখন পবিত্র, শক্তি যখন অফুরন্ত, উৎসাহ যখন অদম্য এবং ভবিষ্যৎ জীবন যখন আশার রক্তিম-রাগে রঞ্জিত, সেই শুভ সময়ে জীবনের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের চরণে আত্মোৎসর্গ কর।

 সে আদর্শ কি——যাহার প্রেরণায় মানুষ অমৃতের সন্ধার পায়, বিপুল আনন্দের আস্বাদ পায়, অসীমাশক্তির পরিচয় পায়? সে আদর্শ কি—যাহার পুণ্যপরশে দেশে দেশে যুগে যুগে মহাপুরুষের সৃষ্টি হইয়া থাকে? তোমরা হয়তো মনে কর যে মহাপুরুষেরা বড় হইয়াই জন্মায়—তাঁহাদিগকে চেষ্টা করিয়া, পরিশ্রম করিয়া বা সাধনা করিয়া বড় হইতে হয় না। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। মহাপুরুষেরা মহত্ত্ব লাভের সম্ভাবনা লইয়াই জন্মগ্রহণ করেন সন্দেহ নাই; কিন্তু সাধনা ব্যতীত তাহারা সে মহত্ত্বের বিকাশ সাধন করিতে পারেন না বা সর্ব্বসম্মতিক্রমে মহাপুরুষের আসন গ্রহণ করিতে পারেন না। যত পুরুষ এ পৃথিবীতে আজ পর্য্যন্ত জন্মগ্রহণ করিয়াছেন তাহাদের জীবনী যদি বিশ্লেষণ কর তাহা হইলে দেখিবে যে প্রত্যেকের জীবনে আছে অসীম অধ্যবসায়, অক্লান্ত চেষ্টা, গভীর সাধনা ও অবিরত পরিশ্রম। তোমরা যদি সেরূপ চেষ্টা ও সাধনা করিতে পার তাহা হইলে তোমরাও একদিন মহাপুরুষের আসনে বসিতে পারিবে। তোমাদের প্রত্যেকের মধ্যে ভষ্মাচ্ছাদিত বহ্নির ন্যায় অসীম শক্তি আছে। সাধনার দ্বারা সে ভষ্মরাশি অপনীত হইবে এবং অন্তরের দেবত্ব কোটী সূর্য্যের উজ্জ্বলতার সহিত প্রকাশিত হইয়া মনুষ্যসমাজকে মুগ্ধ করিবে।

 যে আদর্শকে আশ্রয় করিয়া বাঙ্গলার তরুণ ছাত্রসমাজকে ঊদ্বুদ্ধ হইতে হইবে তাহার উল্লেখ রবীন্দ্রনাথের নব বর্ষের গানের মধ্যে পাওয়া যায়। তাই কবির ভাষায় বলি—

“হে ভারত, আজি নবীন বরষে—
শুন এ কবির গান
তোমার চরণে নবীন হরষে
এনেছি পূজার দান।
এনেছি মোদের দেহের শকতি
এনেছি মোদের মনের ভকতি
এনেছি মোদের ধর্ম্মের মতি
এনেছি মোদের প্রাণ।
এনেছি মোদের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য
তোমারে করিতে দান।”

 দেশমাতৃকার চরণে নিজেকে নিঃশেষে বিলাইয়া দিব—ইহাই একমাত্র সাধনা হওয়া উচিত। এই সাধনার আরম্ভ ছাত্রজীবনেই হওয়া উচিত। দান করিবার মত সম্পদ, অর্জ্জ‌ন ও সঞ্চয় করিতে হইবে ছাত্রজীবনেই। শরীরে যাহার বল আছে, মনে যাহার সাহস ও তেজ আছে, শিক্ষা দীক্ষা যে পাইয়াছে, ব্রহ্মচর্য্য সাধনে যে ব্রতী হইয়াছে—সে ব্যক্তির দিবার মত সম্বল আছে। যে ভিক্ষুক, যে নিতান্ত দীন হীন, তাহার দানের কোনও অর্থ নাই; সে নিজেই কৃপার পাত্র। ছাত্রজীবনে শারীরিক বল সঞ্চয় করিতে হইবে ও চরিত্র গঠন করিতে হইবে এবং জ্ঞান আহরণ করিতে হইবে; এক কথায় শরীর, মন ও হৃদয় এই তিন দিক দিয়া জীবনের বিকাশ সাধন করিয়া মনুষ্যত্ব অর্জ্জ‌ন করিতে হইবে।

 দেশসেবার জন্য প্রাণের সম্পদ ও যোগ্যতা অর্জ্জ‌ন করা যদি ছাত্রজীবনের উদ্দেশ্য হয় তাহা হইলে পরীক্ষা পাশ ও স্বর্ণপদক লাভের মূল্য যে কতটা তাহা আপনার সহজে অনুমান করিতে পারেন। আজকাল স্কুল ও কলেজে “ভাল ছেলে” নামে একশ্রেণীর দেখিতে পাওয়া যায়; আমি তাহাদিগকে কৃপার চক্ষে দেখিয়া থাকি। তাহারা গ্রন্থকীট-পুঁথির বাহিরে তাহদের অস্তিত্ব নাই এবং পরীক্ষার প্রাঙ্গণে তাহদের জীবন পর্য্যবসিত হয়। ইহাদের সহিত তুলনা করুন—“বকাটে” রবার্ট ক্লাইভকে। এই “বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো” ছেলে সাত-সমুদ্র তের নদী পার হইয়া অজানার সন্ধানে ভ্রমাণ করিতে করিতে ইংরাজ জাতির জন্য সাম্রাজ্য জয় করে! ইংলণ্ডের ভাল ছেলেরা যাহা করিতে পারে নাই, করিতে পারিত না তাহা সম্পন্ন করিল, “বকাটে” রবার্ট ক্লাইভ। ইংরাজ জাতি মনুষ্যত্বের মর্য্যাদা রাখিতে জানে তাই তাহারা সর্বোচ্চ সন্মান ক্লাইভকে কৃতজ্ঞচিত্তে অৰ্পণ করিল। “বকাটে” রবার্ট শেষ জীবনে হইল লর্ড ক্লাইভ!

 ইংরাজ—তথা পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত জাতি যত দিক দিয়া যত উন্নতি করিয়াছে তাহার কারণ যদি বিশ্লেষণ করেন, তাহা হইলে দেখিবে যে তাহদের দুইটী অপূর্ব্ব গুণ আছে যাহার বলে তাহারা সকল জাতির মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করিতে পারিয়াছে।

 প্রথমতঃ তাহারা আপন দেশকে অন্তরের সঙ্গে ভালবাসে এবং দ্বিতীয়তঃ তাহাদের spirit of adventure আছে। নূতনের আকর্ষণে তাহারা গতানুগতিক পন্থা ত্যাগ করিতে পারে। বাহিরের টানে তাহারা ঘর ছাড়িতে পারে; সংসারে আকর্ষণে তাহারা চিরাচরিত রীতি ও প্রথা বর্জ্জ‌ন করিতে পারে। এই নির্ভী‌কতা, গতিশীলতা ও “সুদূরের পিয়াস” আছে বলিয়াই ইংরাজ আজ এত উন্নত; ইহার অভাবে আমরা আজ এত দীন, হীন ও পঙ্গু।

 কিন্তু চিরকাল আমাদের এমন অবস্থা ছিল না। আমরাও একদিন উত্তাল তরঙ্গমালাস সঙ্কুল সমুদ্র পার হইয়া দেশদেশান্তরে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছি, জ্ঞানালোক বিকীরণ করিয়াছি এবং শিল্পসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় করিয়াছি। সে ছিল আমাদের সম্প্রসারণের যুগ, আত্মবিকাশের যুগ, উত্থানের যুগ। তারপর আসিল সঙ্কোচনের যুগ, আত্মসুপ্তির যুগ, পতনের যুগ। আজকাল আবার জীবনের স্পন্দন আমরা অনুভব করিতেছি; পতনের পর আবার উত্থান আরম্ভ হইয়াছে; তাই সুপ্তিভঙ্গের ও নব-জাগরণের সমস্ত লক্ষণ চারিদিকে ফুটিয়া উঠিয়াছে। জিজ্ঞাসা-প্রবৃত্তি আবার জাগিয়া উঠিয়াছে, বাহির হইতে জ্ঞান ও সম্পদ আহরণের জন্য আমরা উৎসুক হইয়াছি, সঙ্গে সঙ্গে ঘরে সম্পদ যাহা কিছু আছে তাই বিশ্বদরবারে নিবেদন করিবার জন্য আমরা পাগল হইয়াছি। তাই কবি গহিয়াছিলেন:—

আমি ঢালিব করুণা ধারা
আমি ভাঙ্গিব পাষাণ কারা
আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
আকুল পাগল-পার।

 *  *  *  *



শিখর হইতে শিখরে ছুটিব
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব
হেসে খল খল, গেয়ে কল কল
তালে তালে দিব তালি।

তটিনী হইয়া যাইব বহিয়া
নব নব দেশে বারতা লইয়া
হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া
গাহিয়া গাহিয়া গান।

 ব্যক্তিগত যোগ্যতার দিক দিয়া ভারতবাসী আমরা পৃথিবীর অন্য কোনও জাতি অপেক্ষা কোনও বিষয়ে নিকৃষ্ট নহি; বরং আমরা অনেক বিষয়ে শ্রেষ্ঠ। আমাদের পরাধীনতা ও বর্ত্তমান দুর্দ্দশা সত্ত্বেও আমাদের কবি, আমাদের সাহিত্যিক, আমাদের শিল্পী, আমাদের বৈজ্ঞানিক, আমাদের কর্ম্মী, আমাদের বণিক, আমাদের যোদ্ধা, আমাদের খেলোয়াড়, আমাদের কুস্তিগীর পালোয়ান— পৃথিবীর অন্য কোনও জাতি অপেক্ষা হীন নয়। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমরা বার বার আমাদের যোগ্যতা প্রতিপন্ন করিয়াছি।

 কিন্তু আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন দিক দিয়া পৃথিবীর সমক্ষে গৌরব ও সম্মান লাভ করিলেও একথা স্বীকার করিতেই হইবে যে, আমরা জাতি হিসাবে এখনও অধঃপতিত। জনসাধারণকে আমরা যেদিন শিক্ষার দ্বারা মানুষ করিয়া তুলিতে পারিব সে দিন আমাদের সম্মুখে অন্য কোনও জাতি প্রতিযোগিতায় দাঁড়াইতে পারিবে না। জনসাধারণকে জাগাইতে হইলে সে ভার শিক্ষিত তরুণ সমাজকে গ্রহণ করিতে হইবে। প্রকৃত দেশাত্মবোধ যেদিন আমাদের মধ্যে জাগিবে সেদিন আমরা জনসাধারণের সহিত প্রাণে প্রাণে মিশিতে পারিব। দেশাত্মবোধ লাভ করিতে হইলে হৃদয়ের উদারতা চাই এবং চিন্তার সকল বন্ধন ও গণ্ডী অতিক্রম করা চাই। স্বাধীন চিন্তার শক্তি ও হৃদয়ের অপরিসীম উদারতা যাহাতে তরুণসমাজ লাভ করিতে পারে তার জন্য ছাত্রজীবন হইতেই সাধনা করা চাই।

 মনুষ্যত্ব লাভের একমাত্র উপায় মনুষ্যত্ব বিকাশের সকল অন্তরায় চূর্ণ বিচূর্ণ করা। যেখানে যখন অত্যাচার, অবিচার ও অনাচার দেখিবে সেইখানে নির্ভীকহৃদয়ে শির উন্নত করিয়া প্রতিবাদ করিবে এবং নিবারণের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিবে। বর্ত্তমান যুগে আত্মরক্ষার জন্য এবং জাতির উদ্ধারের জন্য যে শক্তি আমরা চাই তাহা বনে জঙ্গলে বা নিভৃত কন্দরে তপস্যা করিলে পাইব না—পাইব নিষ্কাম কর্ম্মযোগের দ্বারা—পাইব অবিরাম সংগ্রামের ভিতর দিয়া। অত্যাচার দেখিয়াও যে ব্যক্তি তাহা নিবারণ করিবার চেষ্টা করে না সে নিজের মনুষ্যত্বের অপমান করে এবং অত্যাচারিত ব্যক্তির মনুষ্যত্বেরও অপমান করে। যে ব্যক্তি অত্যাচার নিবারণের প্রচেষ্টায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিপন্ন হয়, কারারুদ্ধ হয়, অথবা লাঞ্ছিত হয়—সে সেই ত্যাগ ও লাঞ্ছনার ভিতর দিয়া মনুষ্যত্বের গৌরবময় আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই আজি তোমাদের মতই একজন ছাত্র খড়্গ বাহাদুর সিংহ মাতৃজাতির সম্মান রক্ষার পুরস্কারস্বরূপ বরেণ্য বীররূপে ভারতপুজ্য হইয়াছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রতি বৎসর যে সব Gold Medalist ছাত্র বাহির হইতেছে সেইরূপ এক হাজার ছাত্র একত্র করিলেও একজন খড়্গ‌ বাহাদুর তৈয়ারী হইবে না।

 স্কুলে, কলেজে, ঘরে, বাহিরে, পথে, ঘাটে, মাঠে যেখানে অত্যাচার, অবিচার বা অনাচার দেখিবে সেখানে বীরের মত অগ্রসর হইয়া বাধা দাও—মুহূর্ত্তের মধ্যে বীরত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত হইবে—চিরকালের জন্য জীবনের স্রোতে সত্যের দিকে ফিরিয়া যাইবে—সমস্ত জীবনটাই রূপান্তরিত হইবে। আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে শক্তি কিছু যদি সংগ্রহ করিয়া থাকি তাহা শুধু এই উপায়েই করিয়াছি।

 আর একটী কথা বলিয়া আমার আজিকার বক্তব্য আমি শেষ করিব। ছাত্র সমাজকে সঙ্ঘ‌বদ্ধ করিতে হইবে। তাহারা যে ভবিষ্যতের উত্তরাধিকারী, দেশের উদ্ধার যে তাহাদেরই করিতে হইবে এবং উদ্ধার করিবার শক্তি ও সামর্থ্য যে তাহদের আছে—একথা ভাল করিয়া বুঝাইয়া দিতে হইবে। ছাত্রসমাজকে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়া পাইতে হইবে। নিজের উপর বিশ্বাস এবং জাতির উপর বিশ্বাস না পাইলে মানুষ কোনও বড় কাজ করিতে পারে না। বাঙ্গলার তরুণসমাজের উপর, ছাত্রসমাজের উপর আমার বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা অপরিসীম, আমি তাদের অন্তরের সঙ্গে ভালবাসি—তাই তারাও আমাকে ভালবাসে। ছাত্রবন্ধুগণ! তোমাদের মধ্যে কি অসীম শক্তি নিহিত আছে তাহার সংবাদ তোমরা না রাখিলেও আমি রাখি। তোমাদের আত্মবিস্মৃতি যে দিন ঘুচিবে, তোমরা আত্মবিশ্বাস যে দিন ফিরিয়া পাইবে, সাধনার দ্বারা তোমরা যে দিন মরণজয়ী হইবে, সে দিন তোমরা অসাধ্য সাধন করিতে পরিবে।

 আমি ইচ্ছা করিয়াই এই অভিভাষণের মধ্যে বিদেশের ছাত্র আন্দোলন সম্বন্ধে কিছু বলিলাম না। নানা পুস্তকে ও পত্রিকায় সে সব সংবাদ পাইবে। আমি এখানে শিক্ষকের কাজ করিতে আসি নাই। আমি আসিয়াছি আমার হৃদয়ের অনুভূতি ও জীবনের অভিজ্ঞতা তোমাদের সম্মুখে নিবেদন করিতে। নিজেদের মধ্যে esprit d'corps বা সঙ্ঘবদ্ধতার অনুশীলন করিতে হইবে—ছাত্রগণের সময়োপযোগী গান বাধিতে হইবে, পত্রিকা প্রণয়ন করিতে হইবে, পতাকা সৃষ্টি করিতে হইবে এবং সাহিত্য সৃষ্টি করিতে হইবে। ছাত্রদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী নব্য প্রণালীতে গঠন করিতে হইবে—যেমন কলিকাতা কংগ্রেসের সময় করা হইয়াছিল। Volunteer Organisationএর সাহায্যে ছাত্রেরা নির্ভীক ও শ্রমসহিষ্ণু হইবে এবং শিক্ষা করিবে শৃঙ্খলা ও আজ্ঞানুবর্ত্তিতা। এই সব উপায়ে ছাত্রসমাজে প্রীতি ও সহযোগিতার ভিতর দিয়া সংহতশক্তির উদ্ভব হইবে এবং class patriotismএর সৃষ্টি হইবে। এখন আমাদের ছাত্রদলের মধ্যে এই class patriotismএর আবশ্যকতা হইয়াছে। ভারতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত ছাত্রদের প্রাণ এক সুরে বাঁধিতে হইবে। এই সংহত ছাত্রশক্তির সম্মুখে কোনও বাধা বিঘ্ন দাঁড়াইতে পারিবে না। জাগ্রত ছাত্রশক্তি সকল বন্ধন হইতে স্বজাতিকে মুক্ত করিয়া স্বাধীন ভারত সৃষ্টি করিবে এবং বিশ্বের দরবারে ভারতবাসীর জন্য গৌরবময় আসন লাভ করিবে।

 ভ্রাতৃবৃন্দ! আমার বক্তব্য শেষ হইয়াছে। আমি ছাত্র ছিলাম এখনও ছাত্র আছি। আমি তোমাদেরই একজন। আমার অন্তরের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা তোমরা গ্রহণ কর!

 গত ১৩ই বৈশাখ শুক্রবার, ১৩৩৬ শ্রীহট্টে সুর্ম্মা উপত্যকা ছাত্র সম্মিলনের অধিবেশনে শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসু মহাশয় সভাপতি নির্বাচিত হইয়াছিলেন, কিন্তু অনিবার্য কারণে তথায় গমন করিতে না পারিয়া তিনি তাঁহার লিখিত অভিভাষণ তথায় পাঠাইয়া দেন; সম্মিলনের সভাপতি তাহা সম্মিলনে পাঠ করিয়াছিলেন। উপরে তাহা প্রকাশিত হইল।