নূতনের সন্ধান/মেদিনীপুর জেলা যুব-সম্মেলন

—৩—

 “সর্ব্বদেশে তরুণ সমাজ অসন্তুষ্ট ও অসহিষ্ণু হইয়া পড়িয়াছে। তাহারা যাহা চায়, তাহা পায় না। যে আদর্শকে ভালবাসে সে আদর্শ বাস্তবের মধ্যে মূর্ত্ত করিয়া তুলিতে পারে না। তাই তাহারা বিদ্রোহী হইয়া উঠিয়াছে এবং যে মানুষ বা যে ব্যবস্থা তাহাদের কর্ম্মপথে অন্তরায় হইয়াছে তাহা অপসারিত করিবার জন্য তাহারা বদ্ধপরিকর হইয়াছে।”

 জ আপনারা মেদিনীপুর জেলার যুব-সম্মিলনীর আয়োজন করিয়াছেন এবং আমাকে সভাপতিপদে বরণ করিয়াছেন। আমিও সানন্দে আপনাদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়াছি। কিন্তু এই সম্মিলনীর আয়োজন যখন আপনারা করেন, তখন কি একবার ভাবিয়াছিলেন কেন আপনারা রাষ্ট্রীয় সম্মিলনের পরিবর্ত্তে যুব-সম্মিলনী আহ্বান করিতেছেন? আজকাল দেশ-বিদেশে এত প্রতিষ্ঠান ও আন্দোলন থাকিতে-যুব-আন্দোলন আবার আরম্ভ হইল কেন? ইহার কারণ নির্দ্দেশ করা খুবই সহজ। পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপ, বয়োজ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দের উপর বীতশ্রদ্ধ ভাব এবং নূতন কর্ম্মের ও নূতন সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা—এই সব কারণের সংমিশ্রণের ফলে যুব-আন্দোলনের উৎপত্তি।

 যুব-সমিতি গঠনের কাজে আজকাল অনেকে নিরত। কিন্তু যুব-আন্দোলনের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্ম্মপদ্ধতি বোঝেন কয় জন? যুব-সমিতিকে সেবাসমিতির নামান্তর বলিয়া মনে করিলে চলিবে না। কংগ্রেস কমিটির নাম ও label বদলাইয়া যুবসমিতি গঠন করিলেও চলিবে না। প্রকৃত পক্ষে যুব-আন্দোলন একটা স্বতন্ত্র আন্দোলন, ইহার বিশিষ্ট আদর্শ আছে—বিশিষ্ট কর্ম্ম প্রণালী আছে। সুতরাং কংগ্রেসের মধ্যে নেতৃত্ব বা মোড়লী করিবার আশা না থাকার দরুণ যাহারা অনন্যেপায় হইয়া সব-আন্দোলনের পাণ্ডা সাজেন তাহাদের দ্বারা যুব-আন্দোলনের কোনও সেবা বা উন্নতি হইবে না। এবং চোখের সম্মুখে নূতন একটা আন্দোলন গড়িয়া উঠিতেছে দেখিয়া যাহারা স্থির থাকিতে না পারার দরুণ মূব-আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক হইয়া পড়েন তাহাদের দ্বারাও কোনও বড় কাজ হইবে না।

 আমি আপনাদের জিজ্ঞাসা করিতেছি—বাঙ্গলার একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলুন, এই আন্দোলনে কয়জন খাঁটি কর্ম্মী আছেন—যাঁহারা প্রকৃত পক্ষে যুব-আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও সার্থকতা উপলব্ধি করিয়া নিষ্কাম ভাবে এই কর্ম্মে যোগদান করিয়াছেন? অবশ্য যুব-আন্দোলনের উদ্দেশ্য, অর্থ ও কর্ম্মপ্রণালী যতই প্রচারিত হইতেছে ততই আন্দোলন ক্রমশঃ প্রসার লাভ করিতেছে। কিন্তু গোড়ায় একটা কথা বারবার বলা প্রয়োজন সেটা এই যে, যুব-সমিতি কংগ্রেসের বা সেবা-সমিতির শাখা-বিশেষ নয়। যুব-আন্দোলনের উদ্দেশ্য—নূতনের সন্ধান আনা; নূতন সমাজ, নূতন রাষ্ট্র, নূতন অর্থনীতির প্রবর্ত্তন করা; মানুষের মধ্যে নূতন ও উচ্চতর আদর্শ উদ্বূদ্ধ করিয়া তাহাকে মনুষ্যত্বের উচ্চতর সোপানে লইয়া যাওয়া। এই আকাঙ্ক্ষা যার মধ্যে জাগিয়াছে, যে ব্যক্তি নূতনের জন্য, মহত্তর জীবনের জন্য পাগল হইয়াছে—সে বর্ত্তমান ও বাস্তবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী না হইয়া পারে না। এই অশান্ত, অসন্তুষ্ট, বিদ্রোহী মন যার আছে—যে ব্যক্তি বর্ত্তমান ও বাস্তবের অবগুণ্ঠন সরাইয়া মহত্তর জীবনের দৃষ্টি ও আস্বাদ পাইয়াছে— সেই ব্যক্তি যুব-আন্দোলনের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিয়াছে এবং যুবসমিতি গঠনের অধিকারী হইয়াছে।

 পূর্ব্বেকার সব আন্দোলনের দ্বারা যদি আমাদের অন্তরের ক্ষুধা মিটিত এবং জাতীয় জীবনের সব প্রয়োজন সিদ্ধ হইত তাহা হইলে যুব আন্দোলন কোনও দিন জন্মিত না। কিন্তু দৃষ্টির সঙ্কীর্ণতার দরুণই হউক অথবা প্রচেষ্টার অভাবের দরুণই হউক—তাহা হয় নাই। তরুণ প্রাণ বহুদিন যাবৎ অপরের স্কন্ধে আপনার ও আপনার জাতির সব দায়িত্ব চাপাইয়া যখন শেষে দেখিল—যে তাহার আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দেশ্য পূর্ণ হইল না, তখন সে আর নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিল না। সব ক্লৈব্য ত্যাগ করিয়া সে তখন স্থির করিল, একবার সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতে লইয়া দেখিবে ফলাফল কি হয়। এ বিশ্বাস তাহার হইল যে কল্যাণকৃৎ কখনও দুর্গতি প্রাপ্ত হইবে না (“নহি কল্যাণকৃৎ কশ্চিৎ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি”) এবং সঙ্গে সঙ্গে এ বিশ্বাসও তাহার হইল যে ভরসা করিয়া এই ভার গ্রহণ করিলে পরিণাম কখনও অশুভ হইবে না; জয়লাভ করিলে সে বসুন্ধরা ভোগ করিতে পারিবে এবং জয়ের পূর্ব্বে মৃত্যুমুখে পতিত হইলে স্বর্গরাজ্যে স্থান পাইবে— (হতো বা প্রাপ্‌স্যসি স্বর্গং, জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীং)।

 যুব-আন্দোলন—যুবক-যুবতীদেরই আন্দোলন। এ আন্দোলন মানুষকে, মনুষ্য-সমাজকে ও মনুষ্য-সভ্যতাকে জরা ও বার্দ্ধক্যের হাত থেকে রক্ষা করিতে চায় এবং মানুষের তারুণ্যকে অমর করিয়া রাখিতে চায়। প্রকৃতির বুকে যেরূপ evergreen পাদপ পাওয়া যায়—মানুষের প্রাণকেও তদ্রূপ নিত্য সবুজ করিয়া রাখা একান্ত প্রয়োজন। তাই যুগে যুগে তরুণের প্রাণ বার্দ্ধেক্যের বিরুদ্ধে, অনুকরণেচ্ছার বিরুদ্ধে, ভীরুতার বিরুদ্ধে, ক্লৈব্যের বিরুদ্ধে, অজ্ঞতার বিরুদ্ধে এবং সর্ব্বপ্রকার বন্ধনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়া আসিতেছে। আমি গত বৎসর নাগপুরে তরুণদের একটী সভায় বলিয়াছিলাম—The Voice of Krishna was the voice of immortal Youth—গীতার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের যে বাণীর ঝঙ্কার আমরা শুনিতে পাই, তাহা অমর তরুণাত্মারই বাণী।

 যাঁহারা মনে করেন যে যুব-আন্দোলন সাগর পারের সামগ্রী— তার জন্ম ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে এবং তার জন্মদাতা জার্ম্মানীর Karl Fisher (কার্ল ফিসার) তাঁহারা কিছুই জানেন না। এই পৃথিবীতে জরা বার্দ্ধক্য যত দিন আছে—যুব-আন্দোলনও ততদিন আছে। তবে বর্ত্তমান যুগে যুব-আন্দোলন বিরাট ও বিশিষ্ট রূপ ধারণ করিয়াছে এ বিষয় কোনও সন্দেহ নাই। যুব-আন্দোলনের পশ্চাতে একটা মহান আদর্শবাদ আছে। এ আদর্শবাদ নূতন হইলেও বহু পুরাতন; যুগে যুগে এই আদর্শবাদই মানুষের প্রাণকে সঞ্জীবনী সুধায় ভরপুর করিয়া নূতন জীবন ও নূতন শক্তি দান করিয়াছে। অতি প্রাচীন কালে আমাদের এই দেশে মানুষ “ধর্ম্ম-রাজ্যের” স্বপ্ন দেখিত। মানুষ তখন চাইত —তখনকার সমাজ ও রাষ্ট্র ভাঙ্গিয়া “ধর্ম্ম-রাজ্য” স্থাপন করিতে। প্রাচীন কালে গ্রীস্‌দেশে সেখানকার ঋষিরা স্বপ্ন দেখিত—Ideal Republicএর—আদর্শ প্রজাতন্ত্রমূলক সমাজের। তারপর যুগের পর যুগ কত দেশে কত মণীষী কত Utopiaর স্বপ্ন দেখিয়া আসিতেছেন। কেহ লিখিতেছেন new ageএর (নূতন যুগের) কথা—কেহ লিখিতেছেন great societyর (বৃহত্তর সমাজের) কথা—কেহ লিখিতেছেন millenium এর কথা—কেহ লিখিতেছেন অনাগত সত্য যুগের কথা—কেহ লিখিতেছেন Socialist State (সাম্যবাদমুলক রাষ্ট্রের) কথা। নানা দিক দিয়া, নানা ভাবে, নানা রূপের মধ্যে তরুণের প্রাণ যুগের পর যুগ একটা আদর্শসমাজের এবং আদর্শ-মানুষের স্বপ্ন দেখিয়া আসিতেছে এবং সাধ্যমত তাহা বর্ণনা করিবার চেষ্টা করিয়া আসিতেছে। বর্ত্তমান যুগে কি প্রাচ্যে কি পাশ্চাত্যে আমরা Superman (অতিমানুষ) এর কথা শুনিতে পাই। Supermanএর মতবাদ অনেকে উপহাস করিয়া উড়াইয়া দেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহা উপহাস করিবার বিষয় নয় কারণ ইহার মধ্যে একটা মহান্ সত্য নিহিত আছে। Supermanএর যে রূপ জার্ম্মাণ দার্শনিক Nietsche (নীট্‌স) দিয়াছেন অথবা ভারতের কোনও মনীষী দিবার চেষ্টা করিয়াছেন তাহা আপনারা অখণ্ড সত্য বলিয়া গ্রহণ না করিতে পারেন—কিন্তু তাঁদের উদ্দেশ্য যে সাধু ও মনুষ্য-জাতির পক্ষে কল্যাণকর এবং তাঁদের প্রচেষ্টা যে প্রশংসনীয় সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। যে জাতির শ্রেষ্ঠ মনীষিগণ Supermanএর (অতিমানুষের) স্বপ্ন দেখেন না—সে জাতির কি Idealism বা আদর্শবাদ আছে? এবং যে জাতির আদর্শবাদ নাই সে জাতি কি জীবন্ত—সে জাতি কি মহত্তর সৃষ্টির অধিকারী হইতে পারে?

 মানুষের সমস্ত প্রাণ যদি উদ্বুদ্ধ করিতে হয়—তাহার প্রত্যেক রক্তবিন্দুর মধ্যে যদি মৃতসঞ্জীবনী সুধা ঢালিতে হয়—তাহার অন্তর্নিহিত সমস্ত শক্তির স্ফুরণ যদি ঘটাইতে হয়—তাহা হইলে একটা মহত্তর আদর্শের আস্বাদ তাহাকে দেওয়া চাই। খ্রীষ্টীয়দের “বাইবেলে”এ (Bible) একটা কথা আছে—men do not live by bread alone—শুধু উদর পূরণের দ্বারা মানুষ বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। তার জীবন ধারণে জন্য অন্য রকম খোরাকেরও প্রয়োজন আছে। মানুষ জানিতে চায় তার জীবনের উদ্দেশ্য—সে কেন বাঁচিয়া আছে—তার জীবন ধারণের সার্থকতা কিসে। এ প্রশ্নের উত্তর সে যদি ঠিকমত না পায়—তাহা হইলে সে জীবনের শক্তি পায় না—নিজের জীবন ব্যর্থ বলিয়া মনে করে—এবং অন্তরের সব শক্তির উন্মেষ সাধন করিতে পারে না। কিন্তু এ আদর্শের অনুভূতি ও আস্বাদ জোর করিয়া কেহ দিতে পারে না। অনুভূতি ও আস্বাদ নিজে যে পায় নাই—সে অপরকে তাহা কি করিয়া দিবে?

 স্বপ্ন অনেক ছিল, অনেকের আছে। আমাদের স্বর্গীয় নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মহাশয়েরও একটা স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্ন ছিল তাঁর শক্তির উৎস; তাঁর আনন্দের নির্ঝর। তাঁর স্বপ্নের উত্তরাধিকারী আজ আমরা হইয়াছি। আমাদেরও তাই একটা স্বপ্ন আছে; এই স্বপ্নের প্রেরণায় আমরা উঠি, বসি, চলা-ফেরা করি, লিখি ও বলি এবং কাজকর্ম্ম করি। সে স্বপ্ন বা আদর্শ কি? আমি চাই একটা নুতন সর্ব্বাঙ্গীন-মুক্তি-সম্পন্ন সমাজ এবং তার উপরে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র; যে সমাজে ব্যক্তি সর্ব্বভাবে মুক্ত হইবে এবং সমাজের চাপে আর নিষ্পিষ্ট হইবে না—সে সমাজে জাতিভেদের অচলায়তন আর থাকিবে না—যে সমাজে নারী মুক্ত হইয়া, সমাজে এবং রাষ্ট্রে, পুরুষের সহিত সমান অধিকার ভোগ করিবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সেবায় সমান ভাবে আত্মনিয়োগ করিবে, যে সমাজে অর্থের বৈষম্য থাকিবে না, যে সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তি শিক্ষা ও উন্নতির সমান সুযোেগ পাইবে, যে সমাজে শ্রমের এবং কম্মের পূর্ণ মর্য্যাদা থাকিবে এবং অলসের ও নিষ্কর্ম্মার কোনও স্থান থাকিবে না; যে রাষ্ট্র বিজাতীয় প্রভাব ও প্রতিপত্তির হস্ত হইতে সর্ব্ব-বিষয়ে মুক্ত হইবে, যে রাষ্ট্র আমাদের স্বদেশী সমাজের যন্ত্রস্বরূপ হইয়া কাজ করিবে; সর্ব্বোপরি যে সমাজ ও রাষ্ট্র ভারতবাসীর অভাব মোচন করিয়া বা ভারতবাসীর আদর্শ সার্থক করিয়া ক্ষান্ত হইবে না পরন্তু বিশ্বমানবের নিকট আদর্শ সমাজও আদর্শ রাষ্ট্র বলিয়া প্রতিভাত হইবে—আমি সেই সমাজ ও সেই রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়া থাকি। এই স্বপ্ন আমার নিকট নিত্য এবং অখণ্ড সত্য; এই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সব কিছু করা যায়; সর্ব্বপ্রকার ত্যাগ বরণ করা যায়; সর্ব্বপ্রকার কষ্ট স্বীকার করা যায় এবং এই স্বপ্ন সার্থক করিবার চেষ্টায় প্রাণ বিসর্জ্জন করিলেও “সে মরণ স্বরগ-সমান।” হে তরুণ ভ্রাতৃমণ্ডলী! তোমাদের দিবার মত সম্পদ আমার কিছু নাই—আছে শুধু এই স্বপ্ন—যাহা আমাকে অসীম শক্তি ও অপার আনন্দ দিয়াছে, যাহা আমার ক্ষুদ্র জীবনকেও স্বার্থক করিয়াছে। এই স্বপ্ন আমি তোমাদের উপহার-স্বরূপ দিতেছি— গ্রহণ কর।

 আজকাল রাজনীতি ক্ষেত্রে আমরা অনেক প্রকার গালাগালি ও অনেক মজার সমালোচনা শুনিতে পাই—তার মধ্যে একটা অভিযোগ এই যে, আমরা নাকি “যুব সমিতি”গুলি Capture বা দখল করিবার চেষ্টা করিতেছি। এ অভিযোগ শুনিয়া হাসি পায়। যাহারা কোনও প্রতিষ্ঠান বা আন্দোলনের সহায়তা করিয়া আসিতেছে—তাহাদের বিরুদ্ধে Captureএর অভিযোগ হাস্যাস্পদ বটে। আমি জিজ্ঞাসা করি, যুব-সমিতির ও ছাত্র আন্দোলনের এই নবাগত বন্ধুরা এতদিন কোথায় ছিলেন? যাহারা গোড়া হইতে এই আন্দোলনের সৃষ্টি ও ক্রমোন্নতির সহায়তা করিয়া আসিতেছে তাহারা আজ Capture-অপরাধে অপরাধী এবং যাহারা প্রারম্ভ হইতে আজ পর্য্যন্ত কিছুই করেন নাই এবং এখন Capture করিবার জন্য বদ্ধপরিকর হইয়াছেন —তাহারা হইলেন নিঃস্বার্থ হিতৈষী! গত কলিকাতার কংগ্রেসের পর বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রসমিতির সাধারণ সভায় আমি এই বৎসরের জন্য আমাদের কর্ম্মপদ্ধতি নির্দ্দেশ করি। সেই বিস্তৃত কর্ম্মপদ্ধতির মধ্যে একটা বিষয়ের উল্লেখ ছিল—“To assist students' movement, youth movement and physical culture movement”—অর্থাৎ “ছাত্র-আন্দোলন, যুব-আন্দোলন ও ব্যায়াম সমিতি প্রতিষ্ঠার সহায়তা করিতে হইবে।” এই কর্ম্মপদ্ধতি সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল এবং প্রত্যেক জেলা কংগ্রেস কমিটীর নিকট পাঠানো হইয়াছিল। তখন কোনও আপত্তি শোনা যায় নাই; বরং সকলে অনুমোদন করিয়াছিলেন। কিন্তু বৎসর শেষে যখন দলের স্বার্থপোষণের জন্য অপরকে গালাগালি দেওয়া দরকার হইল, তখন এই অভিযোগ আবিষ্কৃত হইল যে, আমরা নাকি যুব-সমিতিগুলি অধিকার করিবার চেষ্টা করিতেছি! আমাদের যদি কোনও অপরাধ হইয়া থাকে তাহা এই যে আমরা যুব-আন্দোলনের যথেষ্ট সেবা ও সহায়তা করি নাই! ফলে নিখিল বঙ্গীয় যুবসমিতি নামে যে প্রতিষ্ঠান আছে তাহা দিন দিন নিষ্কর্ম্মা হইয়া পড়িতেছে। বাঙ্গলার অনেক জেলায় স্থানীয় যুব-সমিতিগুলি যথেষ্ট কাজ করিতেছে কিন্তু যাহারা এই যুব-আন্দোলনের কর্ণধার বলিয়া পরিচয় দেন—সেই নিখিল বঙ্গীয় যুব-সমিতির কর্ত্তৃপক্ষেরা—এ কয় বৎসর যাবৎ কি করিলেন? বঙ্গীয় যুব-সমিতির মধ্যে কেহ কেহ অবশ্য যুব-আন্দোলনের বিষয়ে অনেক প্রোপাগাণ্ডা (propaganda) করিয়াছেন এবং তাঁদের সম্বন্ধে আমার এই উক্তি প্রযুজ্য নয়। কিন্তু অধিকাংশ সভ্যেরা কি করিয়াছেন? কোনও কোনও প্রদেশে সেখানকার প্রাদেশিক যুব-সমিতি খুব কর্ম্মঠ ও উৎসাহ-পরায়ণ, কিন্তু বাঙ্গলাদেশে যুব-আন্দোলনের উৎসের মুখে যেন বাধা পড়িয়াছে। এবং এই উৎস হইতে মধ্যে মধ্যে যে বাণী নির্গত হয় তাহা অনেক সময়ে কংগ্রেসের অথবা প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির বিরোধী।

 আর একপ্রকার, সমালোচনা আমরা মধ্যে মধ্যে শুনিতে পাই—আমরা না কি অপরকে কাজ করিবার সুযোগ দিই না। কাজ করিবার সুযোগ কে কাকে দেয়? আমাদেরই বা কাজ করিবার সুযোগ কে দিয়াছে? যার ভিতরে মনুষ্যত্ব আছে সে নিজ শক্তিবলে কর্ম্মক্ষেত্র সৃষ্টি করিয়া লয়; মাতা যেরূপ শিশুর মুখে অন্ন তুলিয়া দেন—তার জন্য সেরূপ কর্ম্মক্ষেত্র সৃষ্টি করিয়া দিতে হয় না। কিন্তু আমরা সময়ে সময়ে রাজনৈতিক নাবালক সাজিয়া বলি যে আমরা কাজ করিবার সুযোগ পাইতেছি না—আমাদের কর্ম্মক্ষেত্র কেহ আমাদের জন্য সৃষ্টি করিয়া দিতেছে না। যে ব্যক্তি ক্রমাগত অভিযোগ করে যে, সে কাজ করিবার সুযোগ অথবা কর্ম্মক্ষেত্রে পাইতেছে না—সে কস্মিন্ কালেও তাহা পাইবে না। এবং যে ব্যক্তি অভিযোগ না করিয়া কর্ম্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয় তাহার সুযোগ বা কর্ম্মক্ষেত্রের অভাব কোনও দিন হয় না। বাঙ্গলার যুব-আন্দোলনের কর্ণধাররূপে যাহারা গত কয়েক বৎসর যাবৎ দায়িত্ব লইয়া বসিয়া আছেন তাঁহারাও কি কাজ করিবার সুযোগ, সুবিধা ও কর্ম্মক্ষেত্র পান নাই?

 বাঙ্গলা দেশে আজকাল তুমুল বাদ-বিসম্বাদ, ভোটাভুটি ও ঝগড়া বিবাদ লাগিয়াছে। বর্ত্তমান দলাদলি যে নিতান্ত শোচনীয় ব্যাপার সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। এই দলাদলিতে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ভুগিয়া থাকি আমরা, কারণ সহানুভূতির জন্য, অর্থ সাহায্যের জন্য, আমাদের বার বার জনসাধারণের দ্বারস্থ হইতে হয়। ঝগড়া বিবাদ থাকিলে আমরা সাধারণের নিকট সহানুভূতি পাই না—অর্থ তো পাই-ই না—পাই শুধু অনাবিল গালাগালি। বিবাদ কলহ যতদিন চলিবে ততদিন আমাদের কাজকর্ম্ম একরকম বন্ধ থাকিবে—এ কথা অত্যুক্তি নয়। সুতরাং বিবাদ মিটাইবার আগ্রহ আমাদেরই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক। অথচ কেহ কেহ মনে করিয়া থাকেন যে, আমাদের পেশা বুঝি ঝগড়া করা এবং আমরা কাজকর্ম্ম ফেলিয়া ইচ্ছা করিয়াই কোমর বাঁধিয়াছি ঝগড়া করিতে। কংগ্রেস একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান— কংগ্রেস Social Service Leagueএর নামান্তর নহে। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন আদর্শ থাকা স্বাভাবিক এবং কর্ম্ম-পদ্ধতি-সম্বন্ধে বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন মত থাকা অনিবার্য্য। মত ভিন্ন হইলে অনেক সময়ে পথও ভিন্ন হইয়া থাকে। অতএব ব্যক্তিগত ঝগড়া না থাকিলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে মতানৈক্য প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়। মতান্তর অনেক সময়ে মনান্তরে পরিণত হয় এবং তার উপর যখন ব্যক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়া উঠে তখন দলাদলি আরও তিক্ত ও বিষাক্ত হইয়া উঠে। কিন্তু দলাদলির জন্য প্রকৃত পক্ষে কে দায়ী তাহা অনুসন্ধান করিয়া কাহারও উপর দোষারোপ করা ঠিক নয়—ঝগড়া বিবাদের জন্য যাহারা দায়ী নয়—তাহাদের অনর্থক বদ্‌নামের ভাগী করা কাহারও উচিত নয়। রাজনীতিক্ষেত্রে মধ্যে মধ্যে মতান্তর হওয়া অনিবার্য্য এবং মতান্তরের জন্য ঝগড়া বিবাদ হওয়াও বোধ হয় তদ্রূপ অনিবার্য্য। কিন্তু মতান্তর যেন মনান্তরে পরিণত না হয় এবং ব্যক্তিগত নিন্দা ও গালাগালি যেন আমাদের অস্ত্র না হইয়া দাঁড়ায়—এ বিষয়ে আমাদের সাবধান ও সতর্ক হওয়া উচিত। তারপর গণ-আন্দোলনে যোগদান করিয়া আমরা যদি এতটা অসহিষ্ণু হইয়া পড়ি যে, ভোটের পরিবর্ত্তে লাঠি ও ছোরা ব্যবহার করিতে আমরা দ্বিধাবোধ করি না, তাহা হইলে দেশের দুর্দ্দিন আসিয়াছে বুঝিতে হইবে। সেদিন কলিকাতায় এক ছাত্র-সভার কাজ পণ্ড করিবার জন্য বাহিরের লোক ও কতিপয় ছাত্র যেরূপ ভাবে আসিয়া আক্রমণ করিয়াছিল তাহা অতীব নিন্দনীয়। তার পূর্ব্বে চট্টগ্রামে যে শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটিয়াছিল, যার ফলে শ্রীমান্ সুখেন্দূবিকাশ দত্তের মত চতুর্দ্দশবৎসর বয়সের আদর্শ বালককে নিজের জীবন দিতে হইল—তাহা ভুলিবার নয়। এসব গুণ্ডামির জন্য দায়ী কে, তাহা আমাদের অনুসন্ধান করা উচিত এবং অনুসন্ধানের পর আমাদের কর্ত্তব্য স্থির করা উচিত। যেখানে এরূপ পাশবিকতা দেখা দিয়াছে সেখানে একতার নামে এ সব ব্যাপার ধামাচাপা দিয়া কোনও লাভ নাই। সমাজের দেহে গলদ যাহা আছে, তাহা শোধন করিয়া ফেলা উচিৎ।


 দুঃখের বিষয় এই যে, যাহারা গুণ্ডামির আশ্রয় লয়—তাহারা একবার ভাবিয়াও দেখে না যে ইহার পরিণাম কি। প্রথমতঃ যে ব্যক্তি অপরের উপর গুণ্ডামি করে তার জানা উচিত যে একদিন তাহারা উপরও গুণ্ডামি হইতে পারে কারণ সব মানুষ সমানভাবে সহিষ্ণু ও অহিংস নয়। তার পর আর একটী কথা তার মনে রাখা উচিত যে, দেশের জনসাধারণ এ গুণ্ডামি অনুমোদন করে না—সুতরাং গুণ্ডামি যে করিবে সে যে সাধারণের সহানুভূতি ও ভালবাসা হারাইবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। সুতরাং গুণ্ডামি আপনাকেই ব্যর্থ করিয়া থাকে।


 আজকাল যুব-আন্দোলন সম্বন্ধে যত লেখা বাহির হয় তার মধ্যে কখনও কখনও কেবল সমালোচনাই পাওয়া যায়—পথ নির্দ্দেশ পাওয়া যায় না। ফলে, তরুণ-সমাজের মধ্যে একটা অর্থহীন বিশৃঙ্খলার ভাব যেন আসিয়া পড়িয়াছে। মানুষ সবের মধ্যে কেবল দোষ এবং খুঁত দেখিতে শেখে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট কোনও নির্দ্দেশ পায় না—কোন্ পথে চলা উচিত বা কাহাকে অনুসরণ করা উচিত। এ সম্পর্কে ‘দাদা কোম্পানীর’ খুব উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। আমি নিজে এই কোম্পানীর সভ্য কোনও দিন ছিলাম না—আশা করি কোনও দিন হইব না। কিন্তু আমি বুঝিতে পারি না যে, যাহারা একদিন এই কোম্পানীর সভ্য ছিলেন তাহারা কেন দাদা কোম্পানীর প্রতি এত বিরূপ হইয়াছেন? তাঁদের নিজেদের কোম্পানী এখন Liquidationএ গেছে অথবা তাঁরা এখন promotion লাভ করিয়া ঠাকুর-দাদার সােপানে উঠিয়াছেন—ইহাই কি তাঁহাদের অসন্তোষের কারণ? তাহা যদি হয় তবে তার জন্য দায়ী কে?

 আজ বাঙ্গলার রাষ্ট্রীয় রঙ্গমঞ্চে দলাদলি ভীষণ আকারে দেখা দিয়াছে—ইহাতে দুঃখিত ও ব্যথিত হয় নাই এমন মানুষ বাঙ্গলাদেশে নাই। যদি কেহ থাকে তবে সে মনুষ্যপদবাচ্য নয়। কিন্তু ইহাতে হতাশ হইবার কোনও কারণ আমি দেখি না। আমার গত ৮।৯ বৎসরের অভিজ্ঞতার ভিতরে তৃতীয়বার এই দলাদলি বাঙ্গলার রাষ্ট্রীয়-গগণ কালিমাময় করিয়া তুলিয়াছে। প্রথম ধাক্কা স্বয়ং দেশবন্ধুকে খাইতে হইয়াছিল; আমরা অবশ্য তাঁর পার্শ্বে ও পশ্চাতে ছিলাম এবং ধাক্কা খানিকটা আমাদের গায়েও লাগিয়াছিল। তখন শুনিতে হইয়াছিল দেশবন্ধুর শত্রুপক্ষের মুখে, যে মাসিক ৫০০০০৲ টাকার আয় পরিত্যাগ করিয়া তিনি পাঁচ হাজারি মন্ত্রীত্ব গ্রহণের জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন; এবং এ কথাও শুনিতে হইয়াছিল যে চিত্তরঞ্জনকে তাঁহারা দেশছাড়া করিবেন। দেশছাড়া তাঁহারা চিত্তরঞ্জনকে করিয়াছেন এ বিষয় সন্দেহ নাই—কারণ দেশবাসীর সঙ্গে লড়াই করিতে করিতে তাঁহাকে অকালে ইহলোক ত্যাগ করিতে হইল।

 দ্বিতীয় ধাক্কা খাইয়াছিলেন শ্রীযুক্ত সেনগুপ্ত প্রমুখ নেতৃবর্গ। তখন আমরা অনেকে কর্ম্মক্ষেত্র হইতে বহুদূরে; কিন্তু প্রাচীরের অন্তরালে থাকিয়াও আমরা যে ফলাফলের জন্য অত্যন্ত ঔৎসুক্যের সহিত প্রতীক্ষা করিতেছিলাম এ বিষয় কোনও সন্দেহ নাই। ফলে কংগ্রেসের জয় হইল। এবার তৃতীয় ধাক্কা আমরা নিজেরা সামনা-সামনি ভাবে খাইতেছি। ফল যে পূর্ব্ববৎ হইবে এবং কংগ্রেসের জয় যে অবশ্যম্ভাবী সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। তবে দুঃখের বিষয় এই যে বিরোধের মীমাংসা হইবার পূর্ব্বে অনেক গালাগালি আমাদের খাইতে হইবে এবং অনেক কষ্ট আমাদের সহিত হইবে। এই বিরোধের মূলে যদি তৃতীয় পক্ষের কোনও হাত না থাকিত তাহা হইলে আমরা এত কষ্ট পাইতাম না।

 আর একটা তীব্র সমালোচনা মধ্যে মধ্যে আমাদের কাণে অসে—সেটা এই যে কংগ্রেস এতদিন ঝগড়া বিবাদ ছাড়া আর কি করিল? আমাদের দেশে যাঁহারা political-minded— যাঁহাদের রাষ্ট্রীয় বুদ্ধি আছে—তাঁহারা কিন্তু এ প্রশ্ন করেন না। এই প্রশ্ন করেন তাঁহারা, যাঁহারা মনে করেন যে দেশসেবার একমাত্র উদ্দেশ্য— হাঁসপাতাল নির্ম্মাণ করা, সেবাসমিতি গঠন করা এবং বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সময়ে আর্ত্তের সেবা করা! তাঁহারা হাঁসপাতালের জন্য ১ লক্ষ টাকা দিবেন কিন্তু স্বরাজ-লাভের জন্য ১৩০৲ টাকাও সানন্দে দিবেন না। তাঁহারা বলেন ওমুক হাঁসপাতালে এতগুলি bed হইয়াছে, এতগুলি রোগীর চিকিৎসার আয়োজন হইয়াছে—কিন্তু তোমাদের কংগ্রেসে কি হইয়াছে? এরূপ প্রশ্ন শুনিলে কাহার ক্ষমতা আছে যে তাঁহাদের বুঝাইতে পারে যে কংগ্রেসের উদ্দেশ্য সকল রোগের মূলে যে মহাব্যাধি (—যে মহাব্যাধির বিরাম না হইলে অন্য কোনও রোগ নির্ম্মূল হইতে পারে না) সেই মহাব্যাধি নিরাকরণ করা? আমাদের যাবতীয় দুর্দ্দশার মূল কারণ যদি আমাদের পরাধীনতা হয় তাহা হইলে যে পর্য্যন্ত আমরা পরাধীনতা ঘুচাইতে না পারিব সে পর্য্যন্ত আমরা সুস্থ, সবল ও কর্ম্মঠ জাতি হইতে পারিব না। অতএব আমাদের সমস্ত শক্তি, উদ্যম, সম্পদ ও সময় স্বাধীনতা লাভের জন্য ব্যয় করা উচিত। কিন্তু মুস্কিল এই যে আমরা শক্তি ও সম্পদ ব্যয় করিয়া স্বাধীনতার পথে কতদূর অগ্রসর হইতে পারিলাম তাহা বাহিরের কোনও মাপকাঠির দ্বারা অপরকে বুঝান যায় না। হাঁসপাতালের বা বিদ্যালয়ের উন্নতি যত সহজে অপরকে বুঝান যায়, রাষ্ট্রীয় উন্নতির কথা সেভাবে বুঝানো যায় না—তাই বিষয়াত্মিকা বুদ্ধি যাঁহাদের, তাঁহারা মনে করেন যে আমরা, স্বরাজীরা, কেবল অর্থের অপব্যয় করি এবং বাজে কাজে সময় নষ্ট করিয়া থাকি। জাতির মধ্যে আদর্শবাদ আরও সঞ্চারিত না হইলে রাষ্ট্রীয় বুদ্ধি জাগিবে না—রাষ্ট্রীয় বুদ্ধি না জাগিলে রাষ্ট্রীয় সংগ্রামের অর্থ তাঁহারা বুঝিবেন না—রাষ্ট্রীয় সংগ্রামের সার্থকতা উপলব্ধি না করিলে তাঁহারা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য অকাতরে অর্থ ও সময় ব্যয় করিবেন না এবং সর্ব্বস্ব পণ করিতে না পারিলে জাতি কোনও দিন স্বাধীন হইবে না।

 তাই আমার অনেক সময়ে মনে হয় যে আমাদের দেশবাসীর মধ্যে political mentalityর বড়ই অভাব। এই রাষ্ট্রীয় মনোভাব বা রাষ্ট্রীয় বুদ্ধি সৃষ্টি করাই কংগ্রেসের অন্যতম উদ্দেশ্য। জাতির মধ্যে সূক্ষ্ম বুদ্ধি ও সূক্ষ্ম বিচার শক্তি না আসিলে সে জাতি বহু বৎসর ধরিয়া সর্ব্বস্ব বিলাইয়া আদর্শের পশ্চাতে ছুটিবার সামর্থ্য পাইবে না। এই বুদ্ধি ও বিচারশক্তি আনিবার একমাত্র উপায়, সেই জাতির মধ্যে আদর্শবাদ সঞ্চার করা। এই আদর্শবাদ সঞ্চার করিতে হইলে জাতির প্রাণের অন্তরতম প্রদেশে আঘাত করিতে হইবে—তাহার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা—আত্মবিকাশের স্পৃহা জাগাইতে হইবে। স্বাধীনতার জন্য তীব্র ক্ষুধা জাগিলে সে জাতি তখন জীবনপণ করিয়া সাধনায় প্রবৃত্ত হইবে। আপ্রাণ চেষ্টা ও ব্যাকুল সাধনা জাতি যেদিন করিতে পারিবে, জাতি সেদিন মুক্ত হইবে।

 জনৈক বন্ধু আমাকে সেদিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন—গত দুই বৎসর ধরিয়া আপনি কি করিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হইলে সঙ্গে সঙ্গে একটু তুলনা করা দরকার গত দুই বৎসরের আগের দুই বৎসর কি হইয়াছিল এবং গত দুই বৎসর অন্য় প্রদেশেই বা কি কাজ হইয়াছে। গত দুই বৎসর বেশী কাজ হউক আর না হউক—এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই যে রাষ্ট্রীয় সংগ্রাম বলিতে যাহা বুঝা যায় তাহা যদি ভারতবর্ষে কোথাও থাকে তবে আছে বাঙ্গলায় ও পাঞ্জাবে। এবং গত দুই বৎসর বাঙ্গলাদেশে জোরের সঙ্গে একটা আন্দোলন যদি না চলিয়া থাকিত তাহা হইলে আজ বাঙ্গালী সরকার বাহাদুরের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করিত না।

 তথাপি এ কথা কৈফিয়ত স্বরূপ আমি বলিতে চাই না যে আমরা গত দুই বৎসর যাহা করিয়াছি তার জন্য আমরা খুব প্রশংসার্হ। আমি শুধু বলিতে চাই এই কথা যে, যে-অবস্থায় আমরা কংগ্রেস হাতে লইয়াছিলাম তাহা বিবেচনা করিলে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করিলে স্বীকার করিতে হইবে যে আমরা সাধ্যমত কর্ত্তব্য সম্পাদন করিবার প্রয়াস পাইয়াছি। ১৯২৭ সালে বাঙ্গলার কংগ্রেস কমিটীর অবস্থা ছিল ভাঙ্গা-হাটের মত। একে সমগ্র ভারতবর্ষে তখন অসহযোগের স্রোতে ভাঁটা পড়িয়াছে— তার উপর আবার বাঙ্গলা দেশে ভীষণ দলাদলির ফলে তখন কংগ্রেস কমিটি নির্জ্জীব হইয়া পড়িয়াছে। দেশের বহু কর্ম্মী তখনও কারারুদ্ধ। এই দুর্য্যোগের মধ্যে আমরা অবতীর্ণ হই এবং ধীরে ধীরে আবার উৎসাহ ও শক্তি সঞ্চার করিবার চেষ্টা করি।

 আমরা আজ যে যুগসন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আছি সে অবস্থায় যদি কাহাকেও কংগ্রেসের দায়িত্ব গ্রহণ করিতে হয়, তবে একদিকে তাহাকে জোড়াতালি দিয়া পুরাণ প্রোগ্র্যাম অনুসারে কাজ করিয়া যাইতে হইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য এবং ভবিষ্যতের সংগ্রামের জন্য দেশকে প্রস্তুত করিয়া যাইতে হইবে। যে প্রোগ্র্যাম লইয়া ১৯২১ সাল হইতে এত দিন আমরা চলিয়াছি, সে প্রোগ্র্যাম যথেষ্ট নয়। আমরা এ কয় বৎসরের চেষ্টার ফলে যত লোকের অন্তরে জাতীয় ভাব উদ্বুদ্ধ করিতে পারিয়াছি তাহাও যথেষ্ট নয়। এখন আমরা নূতন প্রোগ্র্যাম চাই—কিন্তু নূতন প্রোগ্র্যাম চাইবার পূর্ব্বে চাই নূতন মানুষ—যাহারা নূতন প্রোগ্র্যাম গ্রহণ করিতে পারিবে। এখনকার কংগ্রেসে আপনি নূতন প্রোগ্র্যাম লইয়া যান—কেহ তাহা গ্রহণ করিবে না—গ্রহণ করিলেও তাহা কাজে লাগাইবে না—অর্থাৎ অন্তরের সহিত গ্রহণ করিবে না। আমাদের মধ্যে একদল লোক আছেন যাঁহারা “প্রোগ্র্যাম, প্রোগ্র্যাম” বলিয়া কেবল চীৎকার করেন কিন্তু তাঁহারা তলাইয়া দেখেন না যে নূতন মানুষ তৈয়ারী না করিলে সে প্রোগ্র্যামের মূল্য বুঝিবে কে?

 ১৯২৭ সাল হইতে এই প্রশ্নই আমার চিত্তকে আলোড়িত করিয়া আসিতেছে। নূতন প্রোগ্র্যাম আমারও একটা আছে—কিন্তু সে প্রোগ্র্যাম দিবার সময় এখনও আসে নাই—আসিবে সেইদিন, যেদিন নূতন মানুষ প্রস্তুত হইবে, যাহারা সেই কর্ম্মপদ্ধতি গ্রহণ করিয়া তাহা কাজে লাগাইতে পারিবে। নূতন মানুষ তৈয়ারী করিবার চেষ্টায় আমি এখন নিরত। তাই গত দুই বৎসর ধরিয়া আমি ছাত্র আন্দোলন, যুব-আন্দোলন, নারী আন্দোলন প্রভৃতি বিষয়ে এত জোর দিয়া বলিয়া আসিতেছি। এই সব আন্দোলনের সাহায্যে যদি নূতন মানুষ—পুরুষ ও নারী—প্রস্তুত হয়,তখন নূতন প্রোগ্র্যাম দিলে তার সার্থকতা হইবে।

 এই সব আন্দোলনের ভিতর প্রাণ সঞ্চার করিতে হইলে নূতন আদর্শ চাই। আমার আদর্শ—দেশের ও সমাজের সর্ব্বাঙ্গীন মুক্তি। সর্ব্বাঙ্গীন মুক্তির বাণী গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে, ঘরে ঘরে প্রচার করিতে হইবে। স্বাধীনতার প্রকৃত স্বরূপ কি তাহা সকলকে বুঝাইয়া দিতে হইবে। স্বাধীনতার অখণ্ড রূপ আমরা অনেকেই আজও উপলব্ধি করি নাই। অখণ্ডরূপের উপলব্ধি জাতির মানস ক্ষেত্রে একদিনে আসে না। বহুদিনের সাধনার ফলে এবং বহু বৎসর খণ্ড খণ্ড রূপ দেখিবার পর আমরা আজ অখণ্ড-রূপের উপলব্ধি পাইতেছি। সমগ্র জাতিকে এখন বুঝাইয়া দিতে হইবে স্বাধীনতার অখণ্ড-রূপ কি। যে দিন জাতি এই অখণ্ড-রূপের উপলব্ধি লাভ করিবে সেই দিন জাতি পূর্ণভাবে মুক্ত হইবার জন্য পাগল হইয়া উঠিবে।

 পূর্ণ সাম্যবাদের উপর নূতন সমাজকে গড়িয়া তুলিতে হইবে। জাতিভেদের অচলায়তনকে একেবারে ধূলিসাৎ করিতে হইবে; নারীকে সর্ব্বভাবে মুক্ত করিয়া সমাজে ও রাষ্ট্রে পুরুষের সহিত সমান অধিকার ও দায়িত্ব প্রদান করিতে হইবে; অর্থের বৈষম্য দূর করিতে হইবে এবং বর্ণ-ধর্ম্ম-নির্ব্বিশেষে প্রত্যেকে (কি পুরুষ কি নারী) যাহাতে শিক্ষার ও উন্নতির সমান সুযোগ্য ও সুবিধা পায় তার ব্যবস্থা করিতে হইবে। সমাজতন্ত্রমূলক সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র যাহাতে স্থায়ী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় তার জন্য সচেষ্ট হইতে হইবে।

 এক কথায় আমরা চাই ভারতের পূর্ণ ও সর্ব্বাঙ্গীন স্বাধীনতা। এই নূতন স্বাধীন ভারতে যাহারা জন্মিবে তাহারা মানুষ বলিয়া জগৎ সভায় পরিগণিত হইবে। ভারত আবার জ্ঞানে, বিজ্ঞানে―ধর্ম্মে কর্ম্মে―শিক্ষায় দীক্ষায়―শৌর্য্যে বীর্য্যে জগৎ-বরেণ্য হইবে।

 আমাদের কর্ত্তব্য কি তাহা আর খুলিয়া বলার প্রয়োজন নাই। আমরাই তো নূতন ভারতের স্রষ্টা। অতএব এসে আমরা সকলে মিলিয়া এই পবিত্র মাতৃযজ্ঞে যোগদান করি। মা আমাদের আবার রাজরাজেশ্বরীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইবেন। এখনকার কাঙ্গালিনী মাকে ষড়ৈশ্বর্য্যসম্পন্না দশভূজারূপে দেখিয়া আমাদের চক্ষু সার্থক হইবে, জীবন ধন্য হইবে। অতএব এসো ভ্রাতৃবৃন্দ! আর মুহূর্ত্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া সর্ব্বস্ব বলিদানের জন্য মাতৃচরণে সমবেত হই!