নেতাজীর জীবনী ও বাণী/আজাদ হিন্দ ফৌজের পরবর্ত্তী সংবাদ
আজাদ হিন্দ ফৌজের পরবর্ত্তী সংবাদ—(ক) আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা মনে রাখা দরকার:— (১) আজাদ হিন্দ ফৌজ পেশাদার রাজনীতিবিদ্ বা বিপ্লবী দিয়া গঠিত নয়। যে সব লোক ব্রিটিশ সৈন্যবিভাগে বিশ্বস্ত সৈনিক ছিল এবং যাহাদের আত্মীয় স্বজন এখনও ব্রিটিশের দাসত্ব করিতেছে সেই সব লোকই ফৌজে যোগ দেয়। (২) তাঁহার জাপানীদের তাঁবেদার বেতনভুক সৈন্য ছিল না। (৩) ১৯৪২ সালে এপ্রিলে জাপানীদের অপসারণের সময় ৫০০০ আজাদি সৈন্য রেঙ্গুণে আইন ও শৃঙ্খলা এবং ভারতীয়দের ধনসম্পত্তি রক্ষা করে। আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্টের অধীনে ভারতীয়গণকে পৃথক জাতি হিসাবে জাপানীরা গণ্য করিত। ভারতীয়গণ কতকগুলি ব্যবসায়ে একচেটিয়া অধিকার লাভ করে।
(খ) I. N. A. (Indian National Army) নাম বদলাইয়া আজাদ হিন্দ ফৌজ রাখা হয় কারণ ইংরাজরা I, N. A,কে Imperial Nippon army বলিতে আরম্ভ করে।
(গ) ফৌজে প্রায় তিন লাখ সৈন্য ভর্ত্তি হয় কিন্তু হাতিয়ার না থাকায় উহাদিগকে সজ্জিত করা হয় না। আজাদি সৈন্যদের মধ্যে কোন সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ছিল না। হিন্দু মুসলমান সব একসঙ্গে একই পাত্র থেকে এক পাত্রে চুমুক দিয়ে খেত। রান্না এক জায়গায় হত। ধর্ম্ম তাদের একত্র করে নাই। দেশকে স্বাধীন করবার উত্যুগ্র আকাঙক্ষা ধর্ম্মের ভেদকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। সাধারণ সৈন্যের সঙ্গে অফিসারের সঙ্গে কোন ভেদাভেদ ছিল না, একই সঙ্গে খাওয়া দাওয়া চলিত। অথচ সৈন্যদের মধ্যে নিয়মানুবর্ত্তিতা শৃঙ্খলা আদর্শ স্থানীয় ছিল।
(ঘ) আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের ও গভর্ণমেণ্টের মধ্যে সম্পর্ক—আজাদ হিন্দ সঙ্ঘ মূল প্রতিষ্ঠান। আজাদ গভর্ণমেণ্ট ও ফৌজ ইহার অধীনে ছিল। এই তিনটারই প্রেসিডেণ্ট ছিলেন নেতাজী। রাস বিহারী বসুর নেতৃত্বে সঙ্ঘের সদস্যদের মধ্যে বিবাদ আরম্ভ হয়। রাসবিহারী ও রাঘবন ছিলেন অসামরিক লোক সেইজন্য আজাদি ফৌজ তাহাদিগের নেতৃত্ব প্রথমে মানিতে চায় নাই। এইজন্য সঙ্ঘের ও ফৌজের কাজে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়। সুভাষ চন্দ্রের আগমনে এই সব গণ্ডগোল দূর হয়। তিনি সঙ্ঘ ও ফৌজের সম্পর্ক স্থির করিয়া দেন এবং আজাদি গভর্ণমেণ্ট গঠন করেন। সঙ্ঘই ফৌজ ও গভর্ণমেণ্টের জন্য অর্থ যোগাইত। ফৌজের জন্য অসামরিক ব্যক্তিগণকে স্বেচ্ছাসেবক শ্রেণীভুক্ত করিত। ফৌজের সমস্ত সমরোপকরণ মূল্য দিয়া ক্রয় করা হইত। সঙ্ঘই ফৌজের দ্রব্যাদি সরবরাহ করিত। সুভাষের আগমনে বহু অসামরিক ব্যক্তি ফৌজে যোগ দেন। গভর্ণমেণ্টের সৈন্য সরবরাহ, অর্থ, অর্থনৈতিক, প্রচার, মহিলা, সমাজ কল্যাণ, সংস্কৃতি, জ্ঞানানুশীল বিভাগ ছিল। সঙ্ঘ ও গভর্ণমেণ্ট একটি সুশাসিত নিয়মবদ্ধ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ছিল।
(ঙ) নেতাজীর জীবন নাশের চেষ্টা—১৯৪৪ ফেব্রুয়ারীতে নেতাজীর জীবন নাশের দুইবার চেষ্টা হয়। সিঙ্গাপুরে নেতাজীর বাড়ীতে দুইদল প্রহরী থাকিত। বাহাদুর গ্রুপের বিশম্ভর দয়াল রক্ষীদের নেতা ছিলেন। প্রাঙ্গনের বাহিরে পাঁচজন মুফতি পরিহিত প্রহরী থাকিত, ভিতরে আটজন পোষাক পরিহিত প্রহরী থাকিত। ঘণ্টায় ঘণ্টায় প্রহরীদের বদল হইত। একদিন রাত্রে একজন অজ্ঞাতনামা লোক প্রহরীদের দলের মধ্যে ঢুকিয়া যায়। রক্ষীর দলপতির সন্দেহ হওয়াতে প্রহরীদের লাইনে দাঁড় করান হয় এবং সকলে নাম ও নম্বর বলিতে বলা হয়। তখন নূতন লোকটি ধরা পড়ে। তাহার হাতে রিভলভার ছিল। তাহাকে আটক করা হয়। সে স্বীকার করে যে সে নেতাজীকে হত্যা করিতে আসিয়াছিল। নেতাজীর আদেশে তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়। আর একজন লোক একদিন নেতাজীকে সংবাদ দেয় যে রাসবিহারী বসু মোটরে তাঁহার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। কিন্তু সুভাষ জানিতেন যে রাসবিহারী বসু তখন সিঙ্গাপুরে আসিতে পারেন না, তিনি জাপানে ছিলেন। লোকটি ফিরিয়া আসিয়া দেখে প্রাঙ্গণ হইতে মোটর উধাও হইয়াছে।
(চ) ব্যাঙ্ক ও আয়—একটি সভায় নেতাজীর মুহূর্ত্তের আবেদনে রেঙ্গুনের একজন মুসলমান বণিক নিজেই এক কথায় ৩০ লক্ষ টাকা দান করেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে ২০ লক্ষ টাকা তুলিয়া দেন। আজাদ National ব্যাঙ্ক বর্মার আইনানুসারে রেজিষ্টারি হয়। এই ব্যাঙ্কের মারফত ব্যবসায়ী কারবার চালাইত। এই ব্যাঙ্কের চেক নোটের মত গণ্য হইত। সাধারণে ইহার ঐরূপ মূল্য দিত। পনর দিনের মধ্যে ব্যাঙ্কের তিনটি শাখা খোলা হইয়াছিল। ব্রহ্মে বহু কারবারী কালাবাজারে বিস্তর অর্থ উপার্জ্জন করে। নেতাজী তাহাদিগের মূলধনের উপর কর ধার্য্য করিয়াছিলেন। ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দের এপ্রিলের বিশৃঙ্খলার সময় আজাদ ব্যাঙ্ক বাজারের চলতি মূল্যে সকলকে জিনিষপত্র যোগাইত।
(ছ) নেতাজীর প্রতি ভক্তি-নেতাজীকে লোকে কত ভক্তি করিত তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ একটি ঘটনা বিবৃত করিতেছি। একদিন নেতাজীকে রেঙ্গুন হইতে সিঙ্গাপুরে উড়োজাহাজে উঠিবার সময়ে খুব বিষন্ন দেখাইতেছিল। উড়োজাহাজ ছাড়িবার মাত্র দশ মিনিট দেরী আছে। একজন চেটিয়ার মাদ্রাজী বণিক তার বিষন্নতার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। নেতাজী তদুত্তরে বলেন “কারণ কি রেঙ্গুনের লোক দূর করিতে পারিবে। আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য আমার ২০ লক্ষ টাকা এখুনি দরকার”। আশ্চর্য্য! চেটিয়ার বণিক দশ মিনিটের মধ্যে ২০লক্ষ টাকা তুলিয়া দিলেন।
(জ) নেতাজীকে সোনায় ওজন—বর্মী, ভারতীয় ও মালয়ের অধীবাসি নেতাজীকে চার বার সোনা দিয়া ওজন করেন এবং সেই সোনা আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য ব্যয়িত হয়। নেতাজীর ওজন আন্দাজ দুই মণ হইবে।
(ঝ) জার্মানীতে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন— নেতাজী জার্ম্মাণিতে পোঁছিবার পর ১৯৪২ সালে ২৬শে জানুয়ারী ১৫০০ জন ভারতীয় সৈন্য দিয়া জার্ম্মাণিতে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হয়। জার্ম্মাণিরা ইহাকে ‘ফ্রীজ ইণ্ডিয়ান’ বলিত। ক্রমশঃ বহু লোক ইহাতে যোগ দেয়। এই সকল সৈন্য লইয়া একটি ব্রিগেড গঠিত হয়। ব্রিগেডটি ১৫টা কোম্পানীতে বিভক্ত হয়। মোট সৈন্য সংখ্যা ৩৫০০ জন ছিল। ইহাদের মধ্যে স্মল আর্মস, ‘হেভী আর্মস’, ‘স্যাপার্স’, ‘মাইনার্স, হেভী এণ্টিট্যাঙ্ক গানস, ইনফ্যাণ্ট্রি গান্স, ইণ্ডিয়ান আর্টিলারি কোম্পানি ছিল। ইহাদিগকে হল্যাণ্ডে প্রথম ডিফেন্স লাইনে, দক্ষিণ ফ্রান্সে বোর্দো অঞ্চলে ও লারোসেলে নিয়োজিত করা হয়। ইহারা আত্মসমর্পণ করে। লেঃ যশোবন্ত সিংহের অধীনে এক ব্যাটালিয়ান ইটালিতে নিয়োজিত হয়। নেতাজীর নির্দ্দেশে জার্ম্মান গভর্নমেণ্ট ইহাদিগকে রণ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সুশিক্ষিত করে এবং ইহাদিগকে রুশিয়ার বিরুদ্ধে নিয়োজিত করা হয় না। ইহারা হিটলারের ঠিক তাঁবেদার ছিল না। আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট জার্ম্মানিতে নিজস্ব নীতি অনুসারে কাজ করিতেন। এখানে আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। মিঃ হাসদান, মিঃ হামিল খাঁ, মিঃ গুরুচরণ সিং, লেঃ আলী খাঁ প্রভৃতি গভর্ণমেণ্টের বিশিষ্ট সদস্য।