নেতাজীর জীবনী ও বাণী/আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারালয়

আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার

 বিচাৱালয়—দিল্লীর ইতিহাস-প্রসিদ্ধ লাল কেল্লার দ্বিতল হল ঘরে গত ৫ই নভেম্বর প্রথম সামরিক আদালত বসে। কেল্লার দক্ষিণ প্রান্তে ইহা অবস্থিত। নিম্নতলে একটি অংশে সাংবাদিকগণের কক্ষ (Press room) নির্দ্দিষ্ট হইয়াছিল। হলটির দৈর্ঘ্য ৬০ ফুট ও বিস্তৃতি ২৫ ফুট। হলটির তিন দিকে প্রশস্ত বারান্দা আছে।

 মঞ্চে বিচারকগণের আসন নির্দ্দিষ্ট হইয়াছিল। আসামী পক্ষের কৌসুলিগণ মঞ্চের সম্মুখে বসেন। দড়ি দ্বারা ঘেরা স্থানে সংবাদিকগণ বসেন। হলের বাকি অংশ দর্শকগণের জন্য বন্দোবস্ত করা হইয়াছিল। কেল্লায় প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ ছিল।

 পাশ ব্যতীত বিচারের সহিত সংশ্লিষ্ট স্পেশাল ব্যক্তিদের ছাড়া অন্য কেহ কেল্লায় প্রবেশ করিতে পারিবেন না। বাহিরের লোকের জন্য দুই শত আসনের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। একটি এমপ্লিফায়ারের ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। প্রথম দিন সকলের ফটো নিয়া হয়।

 বিচারক ও উকিল—কংগ্রেস কর্ত্তৃক যে আসামী পক্ষসমর্থনকারী কমিটি গঠিত হয় তাহাতে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, স্যার তেজবাদুর সপ্রু, লাহোর হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি কুনোয়ার স্যার দিলীপ সিংহ, শ্রীযুক্ত ভুলাভাই দেশাই, মিঃ আসফ আলী, রায় বাহাদুর বদ্রীদাস, পাটনা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মিঃ পি কে সেন এবং শ্রীযুক্ত রঘুনন্দন শরণ ছিলেন। স্যার তেজবাহাদুর সপ্রু, শ্রীযুক্ত ভুলাভাই দেশাই আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পক্ষ সমর্থন করেন। জওহরলাল ২২ বৎসর পরে ব্যারিষ্টারের পোষাক পরিলেন। ভারতীয় বাহিনীর সাতজন অফিসার লইয়া সামরিক আদালত গঠিত হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে চার জন ইউরোপীয় এবং তিন জন ভারতীয় ছিলেন যথা মেজর জেনারেল এ বি ব্ল্যাক্সল্যাণ্ড, ব্রিগেডিয়ার এ জি এইচ হার্ক, লেঃ কর্ণেল সি আর স্কট, লেঃ কর্ণেল টি আই স্টিভেনসন, লেঃ কর্ণেল নাসির আলীখাঁন, মেজর বি প্রীতম সিংহ এবং মেজর বনোয়ারীলাল। সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করিলেন এডভোকেট জেনারেল স্যার এন, পি, ইঞ্জিনিয়ার ও মিলিটারি প্রসিকিউটর মেজর ওয়াল‍্স।

 বিচারকগণের শপথ গ্রহণ করিতে প্রায় অর্ধঘণ্টা সময় লাগে। তাঁহারা এ শপথও করেন যে কর্ত্তৃপক্ষ প্রকাশ না করা পর্যন্ত তাঁহারা এই সামরিক আদালতের রায় প্রকাশ করিবেন না এবং কোন সামরিক আদালতে সাক্ষ্যদানের প্রয়োজন ছাড়া অন্য কারণেও তাহার এই সামরিক আদালতের কোন বিচারকের কেন মতামত বা ভোট প্রকাশ করিবেন না।

 আসামী—ক্যাপ্টেন নওয়াজ, ক্যাপ্টেন পি, কে, সাইগল এবং লেঃ গুরুচরণ সিং ধীলন, আবদুল রসিদ (১।১৪’শ পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট), সুবেদার শিঙ্গারা সিংহ (৫।১৪ শ’ পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট), জমাদার ফতে খাঁ (৫।১৪’শ পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট)। ইঁহাদের শেষোক্ত তিনজনকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২৭নং এবং ৩২৯নং ধারা অনুসারেও (সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য লোককে বাধ্য করিবার উদ্দেশ্যে গুরুতর আঘাত করা) অভিযুক্ত করা হইয়াছে। ইহাদের বিচার দ্বিতীয় আদালতে অন্যত্র হইতেছে। প্রথম আদালতে বিচারকগণ মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন, মঞ্চের পাদদেশে প্রথম তিন জন আসামী সারি দিয়া দাঁড়ান। আসামীদের পরিধানে ইউনিফরম ছিল। কিন্তু পদের বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক নিদর্শন খুলিয়া লওয়া হইয়াছিল। জিজ্ঞাসিত হইলে আসামীগণ বিচারক ও সরকারী রিপোর্টারের বিরুদ্ধে কোন আপত্তি করেন না।

সরকারী অভিযোগ

 ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২১ ধারা অনুযায়ী প্রথম তিনজন আসামীকেই রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিবার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হইয়াছে। ইহা ছাড়া ১৯৪৫ সালের অনুমান ৬ই মার্চ তারিখে ব্রহ্মের পোপাপাহাড়ের নিকটে হরি সিংহ, দুলিচাঁদ, দারে দারিপ সিংহ এবং ধরম সিংহকে হত্যার অভিযোগও লেঃ ধীলনের বিরুদ্ধে উপস্থিত করা হইয়াছে। এই ব্যক্তিদের হত্যাকার্য্যে লেঃ ধীলনকে সহায়তা করিবার অভিযোগও ক্যাপ্টেন সেহগলের বিরুদ্ধে আনীত হইয়াছে। আর গোলন্দাজ মহম্মদ হোসেনের হত্যাকার্য্যে খাজিনশাই এবং আয়া সিংহকে সাহায্য করিবার অভিযোগেও ক্যাপ্টেন শাহ নওয়াজ অভিযুক্ত হইয়াছেন। বিদাদারী, সেলেতার, ক্রাঞ্জি ক্যাম্পে যে সকল ভারতীয় যুদ্ধ বন্দী ছিল তাহাদিগকে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করিতে বাধ্য করিবার জন্য অত্যাচার ও নির্যাতন করার অভিযোগও আছে।

 বিচারের ফল—প্রায় দুই মাস বিচার চলিবার পর সকল আসামীই রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্থ হন। মহামান্য জঙ্গীলাট আসামীদিগকে ছাড়িয়া দেন; কেবল তাঁহাদের বাকী বেতন ও ভাতা বাজেয়াপ্ত করেন।