নেতাজীর জীবনী ও বাণী/স্বাধীনতার যুদ্ধে বীর অধিনায়কগণ
স্বাধীনতার যুদ্ধে বীর অধিনায়কগণ
রাসবিহারি বসু
রাসবিহারী প্রথম অবস্থায় পূর্ব্ব এশিয়ায় ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনা করিয়াছিলেন। বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ১৯১২ সালে দিল্লীতে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের প্রতি বোমা নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। তাঁহার সহকর্মী অবোধবিহারী লাল ও মাষ্টার আমিরচাঁদ ১৯১৪-১৫ সালে দিল্লী ষড়যন্ত্র মামলায় প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিলেন। শ্রীযুত বসুকে গ্রেপ্তারের জন্য বার হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ইহার পর তিনি বারাণসী ও লক্ষ্ণৌ হইতে বিপ্লবাত্মক কার্য্যকলাপ পরিচালনা করেন। ১৯১৫ সালে তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করিয়া জাপানে গিয়াছিলেন। চীন হইতে তিনি ভারতবর্ষে অস্ত্র প্রেরণের চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু বৃটিশ পুলিশ উহার সন্ধান পাইয়া অস্ত্রগুলি বাজেয়াপ্ত করে। শ্রীযুত বসু অতঃপর আট বৎসর আত্মগোপন করেন। ইহার পর তিনি জাপানে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ পরিচালনা করেন। ভারতবর্ষ সম্পর্কে তিনি জাপানী ভাষায় পাঁচখানা গ্রন্থ লিখিয়াছেন। ভারতবর্ষ সম্পর্কে জাপানে অনেক আন্দোলন চালান। জাপানে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অর্থ সংগ্রহ করেন। তিনি বাস্তবিক নির্ব্বাসিতের জীবনযাপন করিতেছিলেন। তিনি এক জাপানী রমণীকে বিবাহ করেন। তাঁহার মৃত্যুতে একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বিপ্লবীর জীবনের অবসান ঘটিয়াছে।
রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ
রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ হাথরাসের রাজা হরনারায়ণ সিংহের পুত্র এবং সুরসানের রাজা বাহাদুর ঘনশ্যাম সিংহের দত্তক পুত্র। ১৮৮৬ সালে মহেন্দ্র প্রতাপের জন্ম হয়।
হাথরাসের রাজা অধিকাংশ সময় বৃন্দাবনে থাকিতেন। মহেন্দ্র প্রতাপ পিতার সহিত এই বৃন্দাবনেই বাল্যকাল অতিবাহিত করেন। বাল্যেই বীর পুরুষদের কাহিনী পড়িয়া তাহার মনে স্বাধীনতার আকাঙ্খা প্রবল হয়।
সাড়ে নয় বৎসর বয়সের সময়ে মহেন্দ্র প্রতাপের পিতার মৃত্যু হয় এবং সমস্ত রাজ্য এবং তাঁহার ভার কোর্ট ওব ওয়ার্ডসে চলিয়া যায়। মহেন্দ্র প্রতাপ আলিগড় কলেজ হইতে এফ এ পাশ করেন এবং বি এ শ্রেণীতে ভর্তি হন। পাঠ্যাবস্থায় তিনি সহপাঠীদের নায়ক ছিলেন। ১৬ বৎসরের সময় ঝিন্ধ রাজার ছোট ভগ্নীর সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। তিনি ১৮ বৎসর বয়সে স্ত্রীকে সঙ্গে লইয়া পশ্চিমের জ্ঞান আহরণের জন্য ইউরোপ ভ্রমণে বাহির হন। দেশে ফিরিয়া তিনি একসঙ্গে পুঁথিগত ও কারিগরী শিক্ষা দিবার জন্য বৃন্দাবনে তাহার পত্নীর নামানুসারে প্রেমমহা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
১৯০৯ সালের মে মাসে তিনি এই বিদ্যালয়ের জন্য প্রায় দশ লক্ষ টাকা মুল্যের পাঁচখানা গ্রাম এবং বৃন্দাবনের রাজপ্রাসাদ দান করেন। তারপর তাঁহার বাকী সম্পত্তির আয় হইতেও তিনি বিদ্যালয়কে সাহায্য করিতেন এবং গরীব বিদ্যার্থীকে পালন করিতেন। সময়ে সময়ে বনে জঙ্গলে পাহাড়ে গিয়া তাঁবু পাতিয়া তিনি ছেলেদিগকে প্রকৃতির সহিত পরিচয় করাইতেন।
তিনি অহিংসায় বিশ্বাস করিতেন এবং তাঁহার অস্ত্রশস্ত্র সরকারকে ফিরাইয়া দিয়াছিলেন। আয়ুর্ব্বেদকে তিনি খুব উচ্চ স্থান দিতেন।
তিনি বিনাশর্তে বৃন্দাবন সহরের বাহিরের কয়েকটি বাগান ও জমি আর্যসমাজের গুরুকুলকে দান করেন। ঐ জমির মূল্য হইবে ১৫০০০ টাকা। তিনি অস্পৃশ্যতা ঘৃণা করিতেন। তিনি মেথরদের সহিত একত্র বসিয়া আহার করেন।
১৯১২ সালে দ্বিতীয়বার তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করিয়া দেশে ফিরিয়া আসিয়া প্রেমমহা বিদ্যালয়ের ভিতর দিয়া সংগঠনকার্য্য আরম্ভ করেন। ১৯৪৪ সালে তৃতীয়বার তিনি ইউরোপ যাত্রা করেন।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তিনি জার্ম্মাণীর কাইজারের নিকট এবং আফগানিস্থানে আমীরের নিকট আসেন। সেই হইতে ভারত সরকার মহেন্দ্র প্রতাপের ভারত আগমন বন্ধ করিয়া দেন। আফগানিস্থানের এজেণ্ট হিসাবে তিনি পৃথিবীর নানাদেশ পর্য্যটন করিয়াছিলেন।
বার্লিনে অবস্থানকালে World Federation নামক একখানা ইংরেজী কাগজ তিনি সম্পাদনা করিতেন। তিনি ভারতের নানা ইংরেজী কাগজে, Young India তে তিনি অনেক প্রবন্ধ লিখিয়াছেন। তিনি কংগ্রেসকে সমর্থন করিতেন।
এই যুদ্ধের পূর্ব্ব হইতে তিনি জাপানে ছিলেন। তিনি আফগানিস্থানের প্রজা বলিয়া নিজেকে বিবেচনা করেন। তিনি পৃথিবীর সমস্ত জাতিকে লইয়া একটি সমবায় গঠনের পরিকল্পনা করেন। জেনারেল ম্যাকআর্থার আর্য্যবাহিনী নামে পরিচিত ভারতীয়গণের সভাপতিরূপেই তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিবার আদেশ দিয়াছেন। দীর্ঘ এবং শীর্ণকায় রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের মুখমণ্ডল গুক্ষ ও শ্মশ্রু মণ্ডিত। তিনি চশমা পরিয়া থাকেন। বর্তমানে তাঁহার বয়স ৬০ বৎসর হইবে।
জগন্নাথ রাও ভোঁসলে
তিনি মহারাষ্ট্রের তিরোদ গ্রামে ১৯০৬ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ভারত গৌরব শিবাজীর বংশধর। তিনি দেরাদুনের প্রিন্স অফ ওয়েলস সামরিক বিদ্যালয়ে ও ১৯২৬ সালে ইংলণ্ডের ‘স্যাণ্ডহার্ষ্ট’ সামরিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা প্রাপ্ত হন। ১৯২৮ সালে ভোঁসলেজী কোয়েটাতে ল্যাঙ্কা-শায়ার রেজিমেণ্টে পরে মারহাট্টা পদাতিক দলে কাজ করেন।
১৯৩৭ সালে ভোঁসলে ক্যাপ্টেন হন এবং সম্রাটের মুকুটোৎসবে যোগ দেন। তিনি বীরত্বের জন্য একটি পদক পান। ভারতবাসীদের মধ্যে তিনিই সর্ব্বপ্রথম সেনাপতির কাজ শিক্ষা করিবার জন্য মনোনীত হন। পরে তাঁহাকে লেফটেন্যাণ্ট কর্ণেলরূপে সিঙ্গাপুরে পাঠান হয়।
সিঙ্গাপুরের দূরবস্থার পর ভোঁস্লে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করেন এবং সৈন্যাধ্যক্ষরূপে সর্বোচ্চ পদে তিনি অভিষিক্ত হন। তাঁহাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁহাকে দিল্লীর লালকেল্লায় আনা হইয়াছে।
জগন্নাথ রাও অভিজাত সর্দ্দার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার আত্মীয় স্বজন অনেকেই যোদ্ধা। ক্যাপ্টেন ভোঁসলে সিন্ধিয়ার বর্তমান শাসকের আত্মীয়। তাঁহার পত্নী চাঁদকিনোবাঈও অভিজাত পরিবার সম্ভূতা। জগন্নাথরাওএর তিনটি কন্যা সন্তান বর্তমান—জ্যেষ্ঠের বয়স ১১ বৎসর। তাঁহার স্ত্রী ও কন্যারা বর্ত্তমানে বরোদাতে বাস করিতেছেন। মহৎ চরিত্র ও সরল ব্যবহারের গুণে জগন্নাথরাও সকলের প্রিয়। তিনি একজন বিশিষ্ট ক্রীড়ামোদী। তাঁহার ৭৫ বৎসর বয়স্কা বৃদ্ধা মাতা বর্ত্তমান।
লেঃ কর্ণেল মিস্ লক্ষ্মী স্বামীনাথন
ডাঃ কুমারী লক্ষ্মী স্বামীনাথন ১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজ হইতে ডিক্রি লাভ করেন। অতঃপর ১৯৪০ সালে তিনি চিকিৎসা ব্যবসা করিবার জন্য সিঙ্গাপুরে গমন করেন। তিনি সিঙ্গাপুরের পতনের পর আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করিয়া উহার অন্তর্ভূক্ত নারীবাহিনী গঠন করেন। তিনি লেঃ কর্ণেল পদে উন্নীত হইয়া “ঝাঁসীর রাণী” বাহিনীর অধিনায়কত্ব করেন। তাহারা অস্ত্র প্রয়োগের কৌশল শিক্ষা করেন।
শ্রীমতী লক্ষ্মী কিছুকাল কালেওয়ায় চিকিৎসক হিসাবে কাজ করেন। তিনি বৃটিশ কর্ত্তপক্ষের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াছেন। বর্তমানে স্বামীনাথনের বয়স ৩২ বৎসর। তাঁহার পিতা মাদ্রাজের একজন বিখ্যাত ব্যারিষ্টার ছিলেন এবং তাঁহার মাতা শ্রীযুক্তা আম্মু স্বামীনাথন সুপরিচিত। ইনি সম্প্রতি ভারতীয় কেন্দ্রীয় পরিষদে সদস্যা নির্ব্বাচিত হইয়াছেন। এই বীরাঙ্গনার বাল্যে নানারূপ বিদ্যার ও কলার্চ্চার প্রতি অনুরাগ ছিল। তিনি বিশিষ্ট ক্রীড়ামোদী এবং অসামান্যা রূপবতী। তিনি বিমানচালক জনৈক ব্রাহ্মণযুবকের সহিত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইতে মনস্থ করেন। কিন্তু গার্হস্থ্য-জীবনের আকর্ষণ তাঁহার কাছে নিষ্প্রভ হইয়া যায়। তিনি অবিবাহিত থাকিতেই মনস্থ করেন। বহুগুণবিভূষিতা শ্রীমতী লক্ষ্মীর কংগ্রেসানুরাগ সুবিদিত ছিল।
ক্যাপ্টেন শাহনওয়াজ
পাঞ্জাবের এক প্রসিদ্ধ বংশে ক্যাপ্টেন শাহ নওয়াজ খানের জন্ম হয়। তিনি ১১ তম পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের অফিসার ছিলেন। তাঁহার পরিবারের ৬২ জন লোক বৃটিশ ভারতীয় বাহিনীতে চাকুরী করেন। আজাদ হিন্দ ফৌজে তিনি কর্ণেলের পদে উন্নীত হন। জানা গিয়াছে যে, তিনিই সর্ব্বপ্রথম ভারতভূমিতে মণিপুরে ভারতের জাতীয় পতাকা উড্ডীন করেন। তাঁহার পরিচালিত ডিভিসনের সৈন্যরা স্বতন্ত্রভাবে সংগ্রাম করিতেছিল—জাপানীদের নির্দেশে নহে। ১৯৪৫ সালের ১৭ই মে পেগু রণাঙ্গনে তিনি ধৃত হন।
ক্যাপ্টেন পি কে সাইগল
সাইগল বৃটিশ ভারতীয় বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ১০ম বেলুচি রেজিমেণ্টের অফিসার ছিলেন। তিনি লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি মিঃ অচ্ছুরামের পুত্র। আজাদ হিন্দ ফৌজে তিনি কর্ণেলের পদে উন্নীত হন; তিনি উহার অফিসারদের শিক্ষা দিয়াছেন বলিয়া জানা গিয়াছে।
গুরুবক্স সিং ধীলন
ধীলন জাতিতে শিখ, দেখিতে গৌরবর্ণ মধ্যমাকৃতি। তাঁহার পরিবারের অনেকেই সেনাবাহিনীতে কাজ করিয়াছেন। তিনি ১৯১৬ সালে লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৭ সালে তাঁহার সৈন্য বাহিনীতে তলব পড়ে। তিনি দেরাদুন ও নবাবগঞ্জ সামরিক বিদ্যালয় হইতে সম্মানের সহিত উত্তীর্ণ হইয়া ১।১৪ পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের অন্তভূর্ক্ত হন। ১৯৩৯ সালে যুদ্ধ বাধিলে তাঁহাকে এবং তাঁহার রেজিমেণ্ট মালয়ে পাঠান হয়। মালয়ের যুদ্ধে তিনি অসীম সাহস ও রণনৈপুণ্য দেখান। আত্মসমর্পণের পর তিনি মেজর মোহন সিং কর্ত্তৃক গঠিত ভারতীয় জাতীয় বাহিনীতে যোগদান করেন।
ক্যাপ্টেন ধীলন বিবাহিত কিন্তু তাঁহার কোন সন্তানাদি নাই। তাঁহার পিতা পশু চিকিৎসক হিসাবে সেনাবাহিনীতে ২২ বৎসর কাজ করিবার পর বর্ত্তমানে অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহার আরও দুই ভাই সেনাবাহিনীতে কাজ করিতেছেন এবং চতুর্থ ভ্রাতা ডেপুটি-ফরেষ্ট রেঞ্জারের পদে নিযুক্ত আছেন।