নেতাজীর জীবনী ও বাণী/ছাত্রদিগের আদর্শ স্বাধীনতা

ছাত্রদিগের আদর্শ স্বাধীনতা

 ছাত্রদিগের চক্ষের সম্মুখে এমন একটি নরসমাজের চিত্র ধরিতে হইবে, যাহাতে তাহারা ঐ আদর্শকে জীবনে বাস্তবে পরিণত করিতে চেষ্টা করে এবং এই সঙ্গে এমন একটি কর্ম্ম তালিকা তাহাদিগকে দিতে হইবে যাহাতে তাহারা যতদূর সম্ভব পালন করিবে। ছাত্রদের পক্ষে নির্ভীক ও আত্মনির্ভরশীল হইয়া চিন্তায় ও কর্ম্মে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে।......একটা তিমির যুগ পার হইয়া ভারতীয় সভ্যতা আর নব জীবনের পথে চলিয়াছে।......আবার নূতন করিয়া বাঁচিতে হইলে আমাদিগকে চিন্তাজগতে একটা ভাববিপ্লব আনিতে হইবে এবং জীবজগতে নররক্তের সংমিশ্র করিতে হইবে।......

 ভাবজগতে বিপ্লব আনিতে হইলে আমাদিগকে এমন একটি আদর্শকে চোখের সম্মুখে আনিয়া ধরিতে হইবে যাহা বিদ্যুতের মত আমাদিগের শক্তিকে উন্মুখ করিয়া তুলিবে, সে আদর্শ হইতেছে স্বাধীনতা।......সমাজ ও ব্যক্তি, নর ও নারী, ধনী ও দরিদ্র সকলের জন্য স্বাধীনতা। ইহা শুধু রাষ্ট্রীয় বন্ধন মুক্তি নহে ইহা অর্থের সমান বিভাগ, জাতিভেদ ও সামাজিক অবিচারের নিরাকরণ ও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা ও গোড়ামি বর্জ্জন সূচিত করে। এই আদর্শকে অবিবেচকরা হয়ত অসম্ভব বলিবে কিন্তু প্রাণের ক্ষুধাকে একমাত্র ইহাই শান্ত করিতে পারে।......সত্যকার স্বাধীনতার অর্থ কেবলমাত্র ব্যক্তির অন্য নহে—সমগ্র সমাজের জন্যও সকল প্রকার বন্ধন হইতে মুক্তি। এ যুগের আদর্শ তাহাই—সম্পূর্ণভাবে মুক্ত ভারতের ধ্যানমুর্ত্তি আমার হৃদয়কে অধিকার করিয়া রহিয়াছে।

 স্বাধীনতা অর্জ্জনের একমাত্র উপায় হইতেছে স্বাধীন ব্যক্তির ন্যায় চিন্তা ও অনুভব করা। অন্তরে একটা পূর্ণ বিপ্লবের বন্যা বহিয়া যাউকএবং স্বাধীনতার মদিরা প্রবাহ আমাদের শিরায় শিরায় বহিয়া যাউক। স্বাধীন হইবার ইচ্ছা যখন আমাদের মধ্যে জাগ্রত হইবে তখন কর্ম্মের একটা অভ্রান্ত প্রবাহ আমাদের হৃদয়ে স্থান পাইবে। ভীরুর সাবধান বাণী আমাদের নিবৃত্ত করিতে পারিবে না—সত্য ও কর্মের আহ্বান আমাদিগকে তখন লক্ষ্যে পৌছিয়া দিবে।......

 ......জীবনের একটা মাত্র উদ্দেশ্য আছে তাহা হইতেছে সকল প্রকার বন্ধন হইতে মুক্তি। স্বাধীনতার জন্য উদগ্র আকাঙ্ক্ষাই হইতেছে জীবনের মূল সুর। সদ্যোজাত শিশুর ক্রন্দন ধ্বনিই ত বন্ধনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা।

 ভারতবর্ষ স্বাধীন হইবেই তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। রাত্রির পর দিন যেমন আসিবে তেমনি ইহাও আসিবে। ভারতবর্ষকে বাঁধিয়া রাখিতে পারে এমন কোনও শক্তি পৃথিবীতে আজ নাই, কিন্তু আসুন, এমন মহীয়সী ভারতের ধ্যানচিত্ত আজ আমরা গড়িয়া তুলি যাহার জন্য জীবন-সর্ব্বস্বধন বলি দিয়া আমরা ধন্য হইতে পারি। স্বাধীন ভারতবর্ষ তাহার মুক্তিবাণী জগতের দিকে দিকে ঘোযণা করুক।......জগতের সাধনা ও সভ্যতার প্রায় প্রতি রূপেই ভারতবর্ষের একটা নব অবদান দিবার আছে।

 ...সত্য, ন্যায় ও সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এই আদর্শকে আমরা এখনই ত্যাগ করিতে পারি না। অপর কেহ আমাদিগের সঙ্গে যদি যোগ না দেয় তবে আমাদিগকে এখনই চলিতে হইবে। কিন্তু একথা নিশ্চিত যে, লক্ষ লক্ষ লোক এই স্বাধীনতার পথে যাত্রায় যোগ দিবে। বন্ধন, অন্যায় ও অসাম্যের সঙ্গে যুদ্ধের বিরতি হইতেই পারে না। দেশের সকল স্বাধীনতাকামীরই সংঘবদ্ধ হইয়া স্বাধীনতার সৈনিকশ্রেণী গঠন করিবার সময় আসিয়াছে। ইহারা কেবল স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিবে না। স্বাধীনতার বাণী প্রচার করিবার জন্য দিকে দিকে প্রচারক প্রেরণ করিবে। আপনাদের মধ্য হইতে এই প্রচারক ও সৈন্যদলের সৃষ্টি করিতে হইবে। বিস্তৃত ও অন্তব্যাপী প্রচার ও দেশব্যাপী স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন আমাদের কর্ম্মতালিকার অন্তর্ভুক্ত হইবে। আমাদের প্রচারক চাষী ও কারখানার মজুরদের মধ্যে গিয়া নব বাণীর কথা প্রচার করিবে। তাহার যুবকদের ও তাদের সমস্ত দিকে অনুপ্রাণিত করিবে। দেশের সমগ্র নারীজাতীকে উদ্ব‌ুদ্ধ, করিবে—কারণ আজ নারীকে সমাজে ও রাষ্ট্রে পুরুষের সমান অধিকার লইয়া দাড়াইতে হইবে।...যদি আমরা শ্রমিক, চাষী, তথাকথিত নিম্নজাতি যুবকবৃন্দ, ছাত্রগণ ও নারীদিগকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্ব‌ুদ্ধ করিয়া তুলিতে পারি তবে কংগ্রেস অসীম শক্তিমান হইয়া দেশের মুক্তি আনয়ন করিতে পারিবে।

 স্বাধীনতার কোন সহজ নির্ব্বিঘ্ন পথ নাই। স্বাধীনতার পথে যেমন আঘাত বিপদ আছে তেমনি গৌরব ও অমরত্ব আছে। প্রাচীনের যাহা কিছু শৃঙ্খলের মত আমাদের চলাকে প্রতিপদে প্রতিহত করিয়া আসিতেছে আজ তাহাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তীর্থযাত্রীর মত দলে দলে স্বাধীনতার লক্ষ্য পথে যাত্রা করিতে হইবে। স্বাধীনতাই জীবন, স্বাধীনতার সন্ধানে জীবন দানে অবিনশ্বর গৌরব।