নেতাজীর জীবনী ও বাণী/মাতৃজাতির প্রতি সম্মান
সুভাষচন্দ্রের বক্তৃতার সারমর্ম্ম
মাতৃজাতির প্রতি সম্মান
হিন্দুজাতি গর্ব্ব করিয়া থাকে যে তাঁহারা মাতৃমূর্ত্তির ভিতর দিয়া ভগবানের আরাধনা করিয়া থাকে এবং তাঁহারা বাল-গোপাল রূপের মধ্যে ভগবানকে পাইয়াছে। কিন্তু আমি হিন্দুজাতিকে জিজ্ঞাসা করি—একবার বুকে হাত দিয়া বলুন—“আমাদের সমাজে বর্ত্তমান সময়ে ঘরে এবং বাহিরে আমরা মাতৃজাতির সম্মান রক্ষা করিতে পারিতেছি কিনা এবং আমাদের সমাজে বালক ও যুবকেরা মনুষ্যোচিত ব্যবহার পায় কিনা?”
আজ যদি বাঙ্গলা দেশে পুরুষ থাকিত তাহা হইলে মাতৃজাতির অসম্মান দেখিয়া তাহারা ক্ষিপ্ত প্রায় হইত এবং বীরশ্রেষ্ঠ খড়্গ বাহাদুর সিংহের মত প্রাণের মায়া ত্যাগ করিয়া মাতৃজাতির সম্মান রক্ষার্থে কর্ম্ম সমুদ্রে ঝাঁপ দিত।
ইংরাজকে তোমরা হয়ত ঘৃণা করিয়া থাক কিন্তু আমি বলি, ইংরাজ যেরূপ তাহার মাতৃজাতিকে সম্মান করিতে জানে সেইরূপ সম্মান করিতে ইংরাজের নিকট শিক্ষা কর। একজন ইংরাজ মহিলার উপর অত্যাচার হইলে সমস্ত ইংরাজ জাতি পাগলের মত হইয়া যায় এবং সমস্ত জাতি সেই অপমানের প্রতিশোধ লইবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়। ভারতের উত্তর পশ্চিম প্রদেশে মিস্ এলিস নামক ইংরাজ রমণীর পাঠান কর্ত্তৃক অপহরণের ঘটনা হয়ত আপনাদের স্মরণ আছে।
আমরা মুখে বলি “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী” কিন্তু সমস্ত প্রাণ দিয়া কি আমরা জননী ও জন্মভূমিকে ভালবাসি? জননীকে ভালবাসার অর্থ শুধু নিজের প্রসূতিকে ভালবাসা নয়। সমস্ত মাতৃজাতিকে ভালবাসা। বাঙ্গলা দেশ—বাঙ্গলার জল, বাঙ্গলার মাটি, বাঙ্গলার আকাশ, বাঙ্গলার বাতাস, বাঙ্গলার শিক্ষাদীক্ষা ও প্রাণধর্ম্ম বাঙ্গলার নরীজাতির মধ্যে মূর্ত্ত হইয়া উঠিয়াছে। যে ব্যক্তি বাঙ্গলার মাতৃজাতিকে শ্রদ্ধা করিতে জানে না সে বাঙ্গলা দেশকে কি করিয়া শ্রদ্ধা করিবে? যে ব্যক্তি বাঙ্গলা দেশকে অন্তরের সঙ্গে শ্রদ্ধা করে না—ভালবাসে না সে কি করিয়া মানুষ হইবে?
জীবনে যাহা কিছু পবিত্র যাহা কিছু সুন্দর যাহা কিছু কল্যাণকর সে সবের সমাবেশ আমরা করিয়া থাকি দেশ মাতৃকার অপরূপ রূপের মধ্যে এবং ত্রিলোেকজয়ী ভুবনমনোমহিণী মাতৃমূর্ত্তিতে। অতএব হে ভ্রাতৃমণ্ডলী, মায়ের আরাধনা করিতে শিখ, মাতৃজাতিকে ভক্তি কর, শ্রদ্ধা কর। নিজের দেশে মাতৃজাতির সম্মান অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য কৃত সঙ্কল্প হও।
মানে রাখিও সেই কথা যাহা বহুযুগ পূর্ব্বে মনু বলিয়াছিলেন:—
“যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে, রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতান্তু ন পূজ্যন্তে সর্ব্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।
শোচন্তি মাময়ো যত্র বিনশ্যত্যান্ত তৎকুলং।
শাচন্তি তু বত্রৈতা ববর্দ্ধতে তদ্ধি সর্ব্বদা॥”
যেখানে নারী পূজিতা হন তথায় দেবতারা আনন্দলাভ করিয়া থাকেন। যেখানে নারীর সম্মান নাই সে দেশে সমস্ত ক্রিয়া কাণ্ড একবারে বিফল। যে কুলে নারীরা শোক করিয়া থাকেন { বা উৎপীড়িতা হন) সে কুল অতি শীঘ্র বিনষ্ট হয় এবং যে কুলে তাহাদের কোনও দুঃখ, কষ্ট, শোক নাই—সে কুলের শ্রীবৃদ্ধি হইয়া থাকে। যে যুগে এদেশের নারীর সম্মান অক্ষুন্ন ছিল সে যুগে মৈত্রেয়ী গার্গীর মত ঋষিপত্নী জন্মিয়াছিল, সে যুগে খনা লীলাবতীর মত বিদূষীর আবির্ভাব হইয়াছিল, অহল্যাবাই ও ঝান্সির রাণীর মত বীর রমণীর অভ্যুদয় হইয়াছিল। এ সোনার বাঙ্গলায়ও আমরা একদিন রাণী ভবানী ও দেবীচৌধুরাণীর মত রমণী দেখিয়া ছিলাম। আমাদের মাতৃজাতিকে যদি শক্তিরূপিণী দেখিতে চাই তাহা হইলে বাল্য বিবাহ প্রথা উচ্ছেদ করিতে হইবে; স্ত্রীজাতিকে আজীবন ব্রহ্মচর্য্য পালনে অধিকার দিতে হইবে; উপযুক্ত স্ত্রীশিক্ষার আয়োজন করিতে হইবে, অবরোধ প্রথাদূর করিতে হইবে, বালিকাদের ও তরুণীদের স্বাস্থ্যরক্ষার নিমিত্ত ব্যায়াম শিক্ষার এবং আত্মরক্ষার নিমিত্ত লাঠি ও ছোরা খেলা শিক্ষার আয়োজন করিতে হইবে— এমন কি স্বাবলম্বী হইবার মত অর্থকরী শিক্ষা দিতে হইবে, এবং বিধবাদের পুনর্ব্বিবাহের অনুমতি দিতে হবে।
রাষ্ট্রীয় বিপ্লব করা বরং সহজ কিন্তু সামাজিক বিপ্লব বা সংস্কার সাধন করা তদপেক্ষা কঠিন, কারণ রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের সময়ে লড়াই করিতে হয় বাহিরের শত্রুর সঙ্গে। সমস্ত দেশবাসীর ভালবাসা ও সহানুভূতি লাঞ্ছিত সেবককে সঞ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করে। সামাজিক বিপ্লবের সমর লড়াই করিতে হয় দেশবাসীর সঙ্গে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে। নিজের ঘরে তাহাদিগকে দিবারাত্রি লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা সহিতে হয় এবং অখণ্ড সমাজের সহানুভূতি তাহারা কোনদিনও পায় না।