নেতাজীর জীবনী ও বাণী/নেতাজীর অমরকীর্ত্তি
নেতাজীর অমরকীর্ত্তি
আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট ও আজাদ হিন্দ ফোজ।
জাপানীদের তাঁবেদার গভর্ণমেণ্টের চেষ্টা-১৯৪২ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী সিঙ্গাপুরের পতনের পর ব্রিটিশ বাহিনী দক্ষিণ-পূর্ব্ব এশিয়ায় (সিঙ্গাপুর, মালয়) জাপানের কাছে পরাজিত হইয়া পলাইয়া আসে। প্রায় ৩০ লক্ষ হতভাগ্য সামরিক ও বেসামরিক ভারতবাসিকে তাঁদের ভাগ্যের উপর পশ্চাতে ফেলিয়া আসে। এই সকল ভারতীয়গণকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কাজে লাগাইবার জন্য জাপানী মেজর ফুজিয়ারা কতকগুলি নেতৃস্থানীয় ভারতবাসীকে আমন্ত্রণ করেন। তাঁর গোপন উদ্দেশ্য ছিল যে ভারতীয়গণ দ্বারা একটি তাঁবেদার স্বাধীনতা সঙ্ঘ গঠন করা ও ভারত আক্রমণ করা। ভারতীয় নেতাগণ জাপানের তাঁবেদার হিসাবে কোন সমিতি গঠন করিতে অস্বীকার করেন। তাঁহারা কোন বৈদেশিক শক্তির ভারত আক্রমণের অধিকার স্বীকার করেন না। নূতন সাম্রাজ্য বাদের এই আবেদনে ভারতীয় নেতাগণ সাড়া দেন নাই। মুক্তিদাতা বাহিনী হিসাবে ভারতে প্রবেশের অধিকার একমাত্র ভারতীয় স্বাধীন বাহিনীরই আছে।
ভারতীয়ের সভা-রাসবিহারি বসুর নেতৃত্বে ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে ১০ই মার্চ সিঙ্গাপুরে ও ৩০শে মার্চ টোকিওতে প্রবাসী সমস্ত ভারতীয় প্রতিনিধিদের দুইটি সভা হয়। শেষোক্ত সভায় প্রস্তাব হয় যে:—(১) ভারতের পূর্ণস্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রবাসী ভারতীয়দের দ্বারা আজাদ হিন্দ সঙ্ঘ (Indian Independence League) নামক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হউক। ইহার অধীনে আজাদ হিন্দ ফৌজ থাকিবে। (আজাদ= স্বাধীন)। আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের কর্ম্ম পরিষদ জাপানের নিকট সামরিক রসদ চাহিতে পারিবেন। (২) স্বাধীন ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র রচনা করিবে ভারতীয় কংগ্রেস।
১৯৪২ সালের মাঝামাঝি ব্যংককে ভারতীয়দের বিরাট সভা হয়। ইহাতে স্থির হয় যে (১) আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের আদর্শ ও কার্যপ্রণালী ভারতীয় কংগ্রেসের অনুরূপ হইবে এবং কংগ্রেসের সঙ্গে সঙ্ঘের যোগ থাকিবে। (২) প্রবাসী বেসামরিক ও সামরিক ভারতীয়দের মধ্য হইতে সৈন্য সংগ্রহ করিয়া আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করিতে হইবে। (৩) সঙ্ঘের প্রতি জাপানীদের সুস্পষ্ট নীতি ঘোষণার দাবি জানাইতে হইবে।
আজাদ হিন্দ সঙ্ঘ ও ফৌজ—অতঃপর গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে আজাদ হিন্দ সঙঘ গঠিত হয়। রাসবিহারী বসু সভাপতি হন। সিঙ্গাপুরে প্রধান কেন্দ্র ও অন্যান্য জায়গায় শাখা স্থাপিত হয়। এই সময়ে ভারতের ভিতরে গান্ধীজির নির্দ্দেশে ‘ভারত ত্যাগ কর' আন্দোলন আরম্ভ হয়। ইহাই বিখ্যাত আগস্ট আন্দোলন। এই আন্দোলনের ফলে মেদিনীপুরে জাতীয় গভর্নমেণ্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাপকভাবে হিংস ও অহিংস কার্যকলাপ চলিতে থাকে। (বিবরণ পরে দ্রষ্টব্য)
এই চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন মোহন সিংহের অধিনায়কত্বে সর্ব প্রথমে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হয়। ইহাতে জাপানের নিকটে আত্মসমর্পণকারী অনেক ভারতীয় সৈন্য যোগ দেয়।
জাপানের সহিত বিবাদ—ইহার পর আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের এক নূতন বিপদ দেখা দিল। জাপানীরা আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্য্যকলাপে হস্তক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিল। জাপানীরা তাহাদের নীতিও স্পষ্টভাবে ঘোষণা করিল না।
আজাদ হিন্দ সঙ্ঘও জাপানের কোন আদেশ মানিতে রাজি হইল না। ফলে উভয় দলে বাধিল সংঘর্ষ। জাপানীরা ১৯৪২ সালের ৮ই ডিসেম্বরে মোহন সিংকে গ্রেপ্তার করিল। ইহাতে অনেক আজাদি সৈন্য ব্যাজ ফিরাইয়া দিলেন এবং সঙ্ঘের অনেক সভ্য পদত্যাগ করিলেন। ১৯৪৩ সালের জানুয়ারীতে পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু জাপানীর একটি প্রতিদ্বন্দী তাঁবেদার ভারতীয় দল গঠন করেন এবং নানারূপ মিথ্যা রটনা শুরু করেন। জাপানীদের ষড়যন্ত্রে নানারূপ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। প্রথম আজাদি বাহিনী ভাঙ্গিয়া যায়। রাসবিহারি বসুর বিরুদ্ধে নানারূপ সমালোচনা হইতে থাকে এবং তাঁহার নেতৃত্বে সকলে আস্থাহীন হন। এইরূপ অবস্থায় সিঙ্গাপুরে একটি সম্মেলনে রাস বিহারি সুভাষচন্দ্রের আগমন বার্তা ঘোষণা করেন।
সুভাষচন্দ্রের আগমন ও নীতি ঘোষণা—১৯৪৩ সালে তিনি সিঙ্গাপুরে পৌঁছান। ৪ঠা জুলাই তিনি আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের সভাপতি নির্ব্বাচিত হন। রাসবিহারী পরামর্শদাতা থাকেন। ৫ই জুলাই আজাদি বাহিনীর কথা রেডিওতে জগতে ঘোষণা করা হয়। সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে সর্বত্র নবজীবনের সঞ্চার হয়। শ্রীমতী লক্ষ্মীর নেতৃত্বে রাণী অফ ঝান্সি নামক একটি নারী স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী গঠিত হয়। সুভাষচন্দ্র স্পষ্ট ঘোষণা করেন:—(১) আজাদি বাহিনী ভারতবর্ষের প্রতিনিধি মূলক জাতীয় বাহিনী। (২) জাপানীদের সহিত ইহার কোন সংস্রব নাই। আজাদি বাহিনী বিভিষণ বাহিনী (Quisling) নহে। (২) ভারতভূমিতে কোনরূপ বৈদেশিক কর্তৃত্ব বা আক্রমণ স্বীকার করা হইবে না। (৩) জাপানীরা ভারতভূমিতে পদার্পণ করিলে তাহাদের তাড়াইতে হইবে।
অস্থায়ী স্বাধীন ভারত গভর্ণমেণ্ট—পরে সঙ্ঘের সামরিক ও বেসামরিক কার্যকলাপ বাড়িতে লাগিল। সেইজন্য সুভাষচন্দ্র অস্থায়ী স্বাধীন ভারত গভর্ণমেণ্ট গঠন করেন। তিনিই এই রাষ্ট্রের অধিনায়ক বা নেতাজী নির্ব্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালে ২৩শে অক্টোবর এই গভর্ণমেণ্ট ইংলণ্ড ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। জাপান, জার্মান প্রভৃতি নয়টি রাষ্ট্র ইহাকে স্বীকার করে। সঙ্গের ও গভর্ণমেণ্টের কর্মস্থল রেঙ্গুনে স্থানান্তরিত হয়। আজাদি ফৌজ যে সকল অঞ্চল দখল করিত এই রাষ্ট্র তাহাই শাসন করিত। প্রথমে নেতাজি ভারতের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। তৎপরে মন্ত্রীগণ নেতাজি ও ভারতের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে শাসন চলিত। কাহারও খামখেয়ালি কার্য চলিত না। ভারতীয় ভাষায় অনেক খবরের কাগজ প্রকাশিত হইত। আজাদ সঙ্গের রেডিও স্টেশন ছিল। ফৌজদারি ও দেওয়ানী আদালতে বিধিবদ্ধ আইন অনুযায়ী বিচার হইত। গভর্ণমেণ্টের ১৯টি বিভিন্ন বিভাগ ছিল। প্রত্যেক বিভাগেই মন্ত্রী ছিল। রেকর্ড বুক্স, নথিপত্র রাখা হইত। ভারতীয়গণ এই রাষ্ট্রের নাগরিক ছিল। মালয়ে, যাভায়, ফিলিপাইনে, চীনে, জাপানে, সুমাত্রায় প্রভৃতি সব জায়গায় বহু শাখা ছিল; মালয়ে ৭০টি, বার্মায় ১০০টি, শ্যামে ২৪টি শাখা ছিল। সৈন্য ও বেসামরিক অফিসার সংগ্রহ করা হইত। হিন্দুস্থানীতে সব রাজকার্য্য চলিত। সামরিক শিক্ষাদানের নয়টি কেন্দ্র ছিল। এক মালয়ে ২০ হাজার সৈন্যকে সামরিক শিক্ষা দেওয়া হয়; একই সময়ে ৭০০০ লোককে সামরিক শিক্ষা দেওয়া হইত। নারীদিগকেও সামরিক শিক্ষা দেওয়া হইত। আর ভারতীয়গণই রাষ্ট্রের ও ফৌজের অর্থ যোগাইত। বার্মায় ১৫ কোটি টাকা সংগৃহীত হয়। মালয়ে ১৯৪৪সালের ‘নব বৎসর’ উৎসবে ৪০ লক্ষ টাকা উঠে। মালয়ে মোট ৫কোটি উঠে; সুভাষচন্দ্রের গলার মালা ১লক্ষ হইতে ১২লক্ষ টাকা মূল্যে বিক্রীত হইত। একবার একজন ধনী পাঞ্জাবী তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি দিয়া মালা ক্রয় করেন। এই সমস্ত অর্থ National Bank এ জমা হইত। ব্যাঙ্কে ৪০ কোটির উপর টাকা ছিল। রেঙ্গুণে নেতাজী তহবিল নামে একটা তহবিল ছিল। ফৌজ এই সকল টাকা হইতে যুদ্ধের সরঞ্জাম ক্রয় করিত। সমাজ সেবা—গভর্ণমেণ্ট সমাজ সেবায় অর্থব্যয় করিত। যুদ্ধ পীড়িত ও মজুরদিগের সাহায্যার্থে চিকিৎসালয়, ডাক্তার, ঔষধপথ্য প্রভৃতির জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করিত। কুয়ালালামপুরে বৃহৎ সাহায্য কেন্দ্র ছিল। ইহার মাসিক খরচ ৭৫ হাজার টাকা ছিল। বর্মা ও শ্যামেতেও অনেক চিকিৎসালয় ছিল। সঙ্ঘ মালয়ে জঞ্জল পরিষ্কার করিয়া প্রায় ২০০০ একর জমি বাসের উপযুক্ত করিয়াছিল। শিক্ষার জন্য সঙ্ঘ অনেক জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিয়া ছিল; এক বার্মাতেই ৬৫ টি জাতীয় বিদ্যালয় ছিল।
ভারত আক্রমণ ও সেনা সংস্থান
সুভাষচন্দ্রের দৃঢ় নীতির ফলেই জাপানীরা ভারত আক্রমণের নীতি পরিত্যাগ করে। বিরাট ভারত-অভিযানের মত ক্ষমতাও জাপানীদের ছিল না। অজাদি সৈন্য ভারতে প্রবেশ করিতে মনস্থ করে। ১৯৪৪ সালের ৪ঠা ফেব্রূয়ারী আক্রমণাত্মক কার্য্য সুরু হয়। আজাদি সৈন্য ১০ই মার্চ্চ ভারতভূমিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। আজাদি বাহিনীতে ছিল; (১) শানওয়াজের নেতৃত্বে ৩২০০ সৈন্য লইয়া গঠিত সুভাষ ব্রিগেড; (২) কিয়ানির নেতৃত্বে ২৮০০ সৈন্য লইয়া গান্ধী ব্রিগেড; (৩) মোহন সিংহের নেতৃত্বে ২৮০০ সৈন্য লইয়া আজাদ ব্রিগেড; (৪) গুরু বক্স সিংহের নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্য লইয়া নেহরু ব্রিগেড; (৫) রাণী ঝান্সি ব্রিগেড, (৬) বালসেনা (বালক বালিকা বিভাগ)-ইহারা আত্মঘাতী সেনা হিসাবে কাজ করিত। ইহারা মিত্রপক্ষের ট্যাঙ্কের নীচে পিঠে মাইন বাধিয়া পড়িয়া থাকিত। সুযোগমত টাঙ্ক উড়াইয়া দিত এবং নিজেরা মৃত্যুবরণ করিত। (৭) তিন শত বাহাদুর দলের ফৌজ। (৮) সাত শত সাহায্যকারী সৈন্য। ইহা ছাড়া ভারী কামান বাহিনী, সংবাদ সংগ্রাহক দল, চিকিৎসক বাহিনী, ইঞ্জিনিয়ার বাহিনী, হিন্দুস্থান ফিল্ড গ্রপ দল ছিল। সৈন্যদের আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার জন্য ব্যবস্থা কমিটী গঠিত হয়। ইহার প্রচার কার্যও চালাইত। সৈন্যগণ ব্রিটিশ ইউনিফরম পরিত। নেতাজী জাপানে ৪৫ জন বালককে সামরিক শিক্ষার জন্য পাঠান। তাহারা সম্প্রতি ভারতে ফিরিয়াছে।
গান্ধী ব্রিগেড পালেল টামু, এলাকায়, বসু ব্রিগেড কালাদান উপত্যকায়, ক্যাপ্টেন আজমীর সিংহের চারিটি দল কোহিমা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করিয়াছিল। গান্ধী ব্রিগেডের ৬টি কোম্পানী ও এস্ এস্ বাহিনীর সৈন্যগণ অগ্রগামী ছিল। তিনটি কোম্পানী রসদ সরবরাহের কার্যে নিযুক্ত ছিল। একটি কোম্পানি যোগদানের ঘাঁটি পাহারা দিত। কোহিমা অঞ্চলে কিকারী এজেন্সীর লোকজন গুপ্তচর হিসাবে সংবাদ সংগ্রহ করিত। ভারতীয় নাগ, বর্মী ও জাপানী অসামরিক লোক দিয়া এস, এস, বাহিনী গঠিত হইয়াছিল। সরবরাহের অসুবিধার জন্য আটার পরিবর্তে সৈন্যরা জৈ খাইত। সৈন্যদিগের ধ্বনি ছিল ‘জয় হিন্দ্' সৈন্যগণ ত্রিবর্ণ রঞ্জিত কংগ্রেস ব্যাজ এবং আজাদ হিন্দ নামাঙ্কিত পিতলের ব্যাজ পরিত। শেষোক্ত ব্যাজে ‘ভারতের মানচিত্র এবং ‘ইত্তিকাক, ইতমদ, কোরবাণী’ (সহযোগিতা, ন্যায়বিচার ও আত্মত্যাগ) এই তিনটি শব্দ থোদিত থাকিত। মরণ যজ্ঞে চরম আত্মাহুতির জন্য সৈন্যগণের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা দেখা দেয়, হয় তাঁহারা দিল্লী পৌঁছিবে না হয় শেষ শয্যা গ্রহণের পূর্ব্বে দিল্লীর পথ চুম্বন করিবে। ১৯৪৪ সালের মার্চের মাঝামাঝি নেতাজীর চিত্র মস্তকে ধারণ করিয়া সমর সঙ্গীত গাহিতে গাহিতে সৈন্যগণ বীরদর্পে ভারতভূমিতে প্রবেশ করে। ব্রিটিশের সৈন্য সংখ্যা অনেক বেশী ও খুব সুসজ্জিত থাকা সত্বেও আজাদি সৈন্যের নিকট প্রত্যেক যুদ্ধেই হারিতে লাগিল। মোরাই কোহিমা প্রভৃতি অনেক জনপদ দখল করিয়া আজাদি সৈন্য ইম্ফল অবরোধ করে। এই যুদ্ধে কোন বিমান সাহায্য ছিল না। ১৯৪৪ সালের আগষ্ট মাসে পাহাড়ী বর্ষার জন্য রসদ সরবরাহের অসুবিধা, সৈন্যদের মধ্যে ম্যালেরিয়া ও আমাশয় রোগের প্রকোপ ও ব্রিটিশ সৈন্যের নির্ব্বিচারে বোমা বর্ষণের জন্য যুদ্ধের অবস্থা সঙ্গীন হয়। প্রথমে ২৮জন আত্মসমর্পণ করে। কালাদান উপত্যকায় মেজর রাঠোরী বীর বিক্রমে মাত্র তিন কোম্পানী লইয়া বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করে। ব্রিটিশের হস্তে মিত্তিলার পতন হইল। ১৯৪৫ সালে ২৩শে এপ্রেল জাপানী সৈন্য রেঙ্গুন ত্যাগ করে এবং ২৪শে এপ্রেল স্বাধীন ভারত গভর্ণমেণ্ট রেঙ্গুন ত্যাগ করে। ভারতীয়দের রক্ষা করিবার জন্য জেনারেল লোকনাথম ছয় হাজার সৈন্য লইয়া রেঙ্গুনে থাকেন এবং জে,এন, ভাদুরী বর্মায় সঙ্ঘের সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে যখন ব্রিটিশরা বর্মা ত্যাগ করে তখন তথায় ভীষণ রাহাজানি, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ঘটে কিন্তু ১৯৪৫ সালে যখন আজাদি সৈন্য ও জাপানী সৈন্য বর্মা ত্যাগ করে তখন তথায় একটিও রাহাজানি হয় নাই।
১০মে ব্রিটীশ কর্ত্তৃপক্ষ National Bank অধিকার করে। ২৮শে মে ভাদুড়ীর গ্রেপ্তারের পর সঙ্ঘের কার্যকলাপ বন্ধ হয়। সঙ্ঘের কর্ম্মিগণ, আজাদ সৈন্য দলে দলে গ্রেপ্তার হয়। কতক সৈন্য ভারতের বিভিন্ন জেলে আটক আছেন, কতক কতক সৈন্য বর্মা ও মালয়ে আটক আছেন। ১০ জনের ফাঁসি হইয়া গিয়াছে। সর্দ্দার সিং ‘জয় হিন্দ, ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ বলিতে বলিতে ফাঁসি কাষ্ঠে আরোহণ করেন। ২০ বৎসর বয়স্ক যুবক রাম তেওয়ারীর ফাঁসি হইয়াছে। মহামান্য বড়লাট দয়া প্রদর্শন করিয়া কয়েক জনের ফাঁসি মকুব করিয়াছেন। অনেক সৈন্যকে মুক্তিও দেওয়া হইয়াছে। কয়েক জনের বিচার চলিতেছে।
বীরত্বের কাহিনী—আজাদি সৈন্যগণের অভূতপূর্ব্ব বীরত্ব ও সাহস, চরম সহনশীলতা, আদর্শ শৃঙ্খলতা, অপূর্ব সংগঠন শক্তি, উদ্দেশ্যের প্রতি একনিষ্ঠতা, দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার উত্যুগ্র আকাঙ্খার কাহিনী জগতের বীরগণের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে। বীরত্বের দু’একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিম্নে দেওয়া হল।
(১) ইম্ফল রণাঙ্গনে ব্রিটিশ সৈন্যের সংখ্যা খুব বেশী ছিল, তাহার কামান, বিমান, ও অন্যান্য সাজসরঞ্জামে সজ্জিত ছিল। আজাদি সৈন্যের বিমান ছিল না। সাজসরঞ্জামও কম ছিল। তা সত্ত্বেও তাহার ব্রিটিশদের প্রত্যেক যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিল। তাহাদের সামরিক শিক্ষা, শৃঙ্খলা, ভারতের মুক্তির জন্য অনমনীয় প্রতিজ্ঞা তাহাদের অভাবনীয় সাফল্যের কারণ।
(২) ১৪২৩ ফুট উচ্চ একটি পাহাড়ের আড়ালে ব্রিটিশ সৈন্য কামানশ্রেণী সাজাইয়াছে। পাহাড়ের কিছুদূরে একটি গুরুত্ব পূর্ণ স্থানে জ্ঞান সিংহের অধীনে মাত্র ৯৮ জন সৈন্য ব্রিটিশ সৈন্যের অগ্রগতিতে যে কোন মূল্য দিয়া বাধা দিবার জন্য পরিখার মধ্যে অবস্থান করিতেছিল। ইহাদের সঙ্গে কোন মেসিনগান ছিল না। কেবল অতি পুরাতন রাইফেলই একমাত্র অস্ত্র ছিল। দুইদিন শত্রুর কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। ১৬ মার্চ্চ ভোর হইতে বেলা ১১টা পর্যন্ত শত্রু বিমান ক্রমাগত বোমা নিক্ষেপ করিল। তৎপর পাহাড় হইতে কামানদাগা সুরু হল এবং সঙ্গে সঙ্গে ১৩টি ট্যাঙ্ক, ১১টি কামান সজ্জিত গাড়ী, ১০টি ট্রাকের একটি যান্ত্রিক বাহিনী কামানের গোলার আড়ালে অগ্রসর হইতে লাগিল। অগ্রসরমান কামানের গাড়ী হইতে অনবরত গোলা নিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল। ইহাতেও আজাদি সৈন্য আত্মসমর্পণ করিল না দেখিয়া তাহারা ভারী ট্যাঙ্ক ও কামানের গাড়ী পরিখার নিকটে চালাইয়া দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে কামানগুলি চারিদিক হইতে ভীষণ ভাবে অগ্নিবর্ষণ করিতে লাগিল। জ্ঞানসিংহ দেখিলেন পরিখার মধ্যে মৃত্যু কিংবা বন্দী হওয়া নিশ্চিত। মরিতে যখন হবে তখন শত্রুকে না মেরে মরা হবে না এই ভাবিয়া তিনি হুকুম দিলেন “আক্রমণ কর”।
তখন পরিখার মধ্য হইতে ৯৮জন সৈন্য এক মাত্র সম্বল “নেতাজি কি জয়” ‘দিল্লা চলো’ ধ্বনি করিতে করিতে পরিখা হইতে উঠিয়া ভারতের নাম লইয়া শত্রুকে আক্রমণ করিল। দুই ঘণ্টা হাতাহাতি যুদ্ধে ৪০জন আজাদি ও তদপেক্ষা বেশী শত্রু সৈন্য নিহত হইল। আজাদি সৈন্যের দ্বারা আক্রান্ত হইয়া শত্রু পশ্চাৎ হটিল। জ্ঞান সিংহ হঠাৎ একটি গুলির আঘাতে নিহত হন।