নেতাজীর জীবনী ও বাণী/বাঙ্গালার হলদীঘাট—মেদিনীপুর
বাংলার হলদিঘাট-মেদিনীপুর
আগষ্ট আন্দোলনের ইতিহাসে তেজস্বী দেশপ্রেমিক দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথের কর্ম্মভূমি মেদিনীপুর একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়াছে। মেদিনীপুরের বিশেষতঃ তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় আন্দোলন এমন ব্যাপকভাবে ছড়াইয়া পড়ে যে কয়েক মাসের মধ্যে কয়েকটী স্থানে কয়েক মাসের জন্য বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং জাতীয় গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দুই মহকুমায় ঝঞ্ঝা ও প্লাবণ, মহামারী ও দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত হইলে ও মহকুমা বাসীগণ মহাত্মাজীর আহ্বানে একপ্রাণ হইয়া অভূতপূর্ব্ব সাড়া দেয়। ভারতের আর কোথাও এত ব্যাপকভাবে আগষ্ট আন্দোলন সাফল্য লাভ করে নাই।
তমলুক মহকুমা
তমলুক—মেদিনীপুর জেলার একটা মহকুমা। উহার এলাকায় ছয়টী থানা আছে। যথা:—সূতাহাটা, নন্দিগ্রাম, মহিষাদল, তমলুক ময়না ও পাঁশকুড়া। এই মহকুমার মধ্যে কেবল তমলুক সহরেই মিউনিসিপ্যালিটী আছে। সহরের লোক সংখ্যা ১২ হাজার। তমলুক মহকুমায় ৭৬টী ইউনিয়ন আছে এবং ১২৪৬টী গ্রাম আছে। সমগ্র মহকুমায় ১,৪২,২০০টা পরিবারে মোট ৭,৫৩,১৫২জন লোক বাস করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার বহুপুর্ব্বে মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেস কমিটী অধীনে তমলুকে একটা মহকুমা কংগ্রেস কমিটী ও ছয়টি থানা কংগ্রেস কমিটী ছিল। প্রাথমিক কংগ্রেস কমিটীগুলি প্রতিটা ইউনিয়নে স্থাপিত ছিল। ৪টী থানা কংগ্রেস কমিটীর নিজস্ব অফিস ঘর ছিল। অপর দুইটী থানা কংগ্রেস কমিটীর কার্যালয় ভাড়া করা বাড়ীতে ছিল।
আগষ্ট আন্দোলনের পর তমলুক মহকুমায় দুই বৎসর যাবৎ জাতীয় গভর্ণমেণ্ট (জাতীয় সরকার) প্রতিষ্ঠিত ছিল। ১৯৪২সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর রাত্রিতে তমলুক ও কাঁথি মহকুমার যোগাযোগ রক্ষার ব্যবস্থার শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ বিনষ্ট করা হইয়াছিল, এবং পরের দিন শুধু তমলুক মহকুমায় ৪০ হাজার নিরস্ত্র ও অহিংসা জনতা আক্রমণ চালাইবার জন্য কয়েকটী থানায় সমবেত হয়।
জাতীয় গভর্ণমেণ্টের কার্য্যকলাপ প্রধাণতঃ সুতাহাটা, নন্দীগ্রাম মহিষাদল এবং তমলুক এই ৪টা থানার ভিতর সীমাবদ্ধ ছিল। এই ৪টী থানা দখলের জন্য ৭বার আক্রমণ করা হইয়াছিল।
যাতায়াত ও যোগাযোগ রক্ষার ব্যবস্থা বিপর্য্যস্ত করিবার জন্য যে সংগ্রাম আরম্ভ করা হইয়াছিল তাহার ফলে ৩০ টী সেতু ধ্বংস করা হয়, ২৭ মাইল লম্বা টেলিগ্রাফের তার কাটা হয়, ১৯৪টী টেলিগ্রাফের থাম ভাঙ্গিয়া ফেলা হয়, এবং গাছ ফেলিয়া ৪৭টা রাস্তা অবরুদ্ধ করা হয়।
যে সমস্ত স্থান দখল করিয়া রাখা যায় নাই, সে সমস্ত স্থান সম্পর্কে “পোড়া মাটীর” নীতি অনুসরণ করা হয়। ইহার ফলে নিম্নলিখিত প্রকারের “শত্রু শিবির” গুলি ভস্মীভূত হয়। ২টা থানা ২টী সাব রেজেষ্ট্রী অফিস, ১৩টী ডাকঘর, ১টী খাস মহল অফিস, ১৭টা আবগারী দোকান এবং ১২টা ডাক বাংলা, এতদ্ব্যতীত ২৪টা জমিদারী কাছারী ১৬টী পঞ্চায়েত বোর্ড ৯টী ইউনিয়ন বোর্ড এবং জেলা বোর্ডের ১৭টী অফিসও ভস্মীভূত হয়।
১৩জন গভর্ণমেণ্ট অফিসারকে গ্রেপ্তার করিয়া পরে ছাড়িয়া দেওয়া হয়। ধৃত সরকারী কর্ম্মচারীদের উপর খুব সদয় ব্যবহার করা হয় এবং বাড়ীতে ফিরিয়া যাইবার জন্য তাঁহাদিগকে পথ খরচ দেওয়া হয়। সুতাহাটা থানা দখলের সময় ৬টী বন্ধুক ও ২খানি তরবারি হস্তগত করা হইয়াছিল; কিন্তু ঐ সমস্ত অস্ত্র শস্ত্র কখন ও ব্যবহার করা হয় নাই। এইগুলি নষ্ট করিয়া ফেলা হয়।
১৯৪২সালে ৭ই ডিসেম্বর তারিখে জনসাধারণ তমলুক মহকুমায় একটা ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ নামে জাতীয় গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠিত করেন। এই গভর্ণমেণ্টের অধীনে তাঁহাদের নিজেদের ৫টী থানা অফিস এবং ৬টী ইউনিয়ন পঞ্চায়েত অফিসও ছিল।
মহকুমা কংগ্রেস কমিটী কর্ত্তৃক নিয়োজিত একজন ডিক্টেটর তমলুক মহকুমা জাতীয় গভর্ণমেণ্টের প্রধান কর্মকর্ত্তা (ডিক্টেটর) হন। ডিরেক্টর তাঁহার পরবর্ত্তী ডিরেক্টরকে মনোনীত করিতে পারিতেন। এই মনোনয়ন মহকুমা কংগ্রেস কমিটীর অনুমোদন সাপেক্ষ ছিল। তমলুক মহকুমায় একাদিক্রমে ৪জন ডিক্টেটর নিযুক্ত হইয়াছিল। চতুর্থ ডিক্টেটর মহাত্মাজীর নির্দ্দেশক্রমে বৃটিশ গভর্ণমেণ্টের নিকট আত্ম সমর্পণ করেন।
একটী মন্ত্রীসভার সাহায্যে ডিক্টেটর জাতীয় গভর্ণমেণ্টের কাজ কর্ম্ম নির্ব্বাহ করিতেন। মন্ত্রিসভা এবং ডিক্টেটর মহকুমা কংগ্রেস কমিটীর নিকট দায়ী ছিলেন। মন্ত্রিসভার সমর, স্বরাষ্ট্র, প্রচার, শিক্ষা, অর্থ, বিচার, সাহায্য ও পুনর্গঠন প্রভৃতি কয়েকটী দপ্তর ছিল।
জাতীয় গভর্ণমেণ্টের বিচারালয় (কোর্ট) ছিল। লোকে মামলা মোকর্দ্দমা করিতে ইংরাজদের আদালতে যাইত না। জাতীয় গভর্ণমেণ্টের আপীল কোর্ট পর্য্যন্ত ছিল। জাতীয় গভর্ণমেণ্টের রেজিষ্ট্রী অফিস ছিল। মামলার সাধারণ ফি ১৲ টাকা ও জরুরী ফি ২৲ টাকা ছিল। জাতীয় গভর্ণমেণ্টের বিচারালয় সমূহে ২৯০৭টী মামলা দায়ের করা হইয়াছিল। তন্মধ্যে ১৮৮১টী মামলা নিষ্পত্তি করা হইয়াছিল। জাতীয় গভর্ণমেণ্ট ২৫১টী স্থানে থানাতল্লাসী করিয়াছিলেন। ২৭৮জন লোককে গ্রেপ্তার করিয়া মুক্তি দেওয়া হইয়াছিল। জাতীয় গভর্ণমেণ্টের বিচারালয়গুলি ৫২৩জন লোককে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করিয়া তাহাদের নিকট হইতে মোট ৩৩৯৩৭৸৶৹ জরিমানা আদায় করিয়া ছিলেন। অন্যান্য শান্তির মধ্যে বেত্রাঘাত আসামীকে সাবধান করিয়া দেওয়া এবং আদালতের কাজ না শেষ হওয়া পর্যন্ত তাহাদিগকে আটক করিয়া রাখার ব্যবস্থা বহুল পরিমাণে প্রচলিত ছিল। জরিমানা হিসাবে যে টাকা আদায় করা হইত তাহা সাহায্য বিতরণের কার্য্যে ব্যয় করা হইত।
সমর বিভাগ, বিচারকার্য্য পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অবাধ্য লোকদিগকে জাতীয় গভর্ণমেণ্ট মানিতে বাধ্য করার জন্য এবং জাতীয় গভর্ণমেণ্ট পরিচালনার জন্য বিদ্যুৎ বাহিনী নামে একটী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ছিল।
জাতীয় গভর্ণমেণ্টের প্রচার বিভাগ হইতে “বিপ্লবী” নামে সাইক্লোষ্টাইলে ছাপা একটা বুলেটিন জাতীয় গভর্ণমেণ্টের কার্য্যকলাপ সহ রীতিমত বাহির হইত, এবং নিজেদের ডাক বিভাগ ও পোষ্ট অফিস ছিল। ঝড়ের পরে এবং দুর্ভিক্ষের সময় জাতীয় গভর্ণমেণ্টের সাহায্য বিভাগ হইতে সাহায্য দান করিতে আরম্ভ করেন। অভাব গ্রস্থ লোকদিগকে খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র, ঔষধ, পথ্য এবং দুগ্ধ দান করা হইত, সাহায্য কার্য্যে জাতীয় গভর্ণমেণ্ট মোট ১৫৮৮৪৫৷৶৹পাই ব্যয় করিয়াছিলেন।
জাতীয় অভ্যূথানকে ইংরাজেরা কখনও ভালোর চোখে দেখিতে পারে না। ফলে আরম্ভ হইল নিদারুণ অত্যাচার। মোটামুটি ক্ষতির বিবরণ দেওয়া হইল। ১৯৪২সালের আগষ্ট হইতে ১৯৪৪ সালের আগষ্ট মাসের মধ্যে পুলিশ ও সৈন্যদল মোট ২২টী স্থানে গুলি চালাইয়া ৪৪জনকে নিহত, ১৯৯জনকে আহত এবং ১৪২জনকে সামান্য আহত করিয়াছিল। এই সময়ের মধ্যে ৭৩জন স্ত্রীলোকের উপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়। এতদ্ব্যতীত ৩১জন স্ত্রীলোকের উপর পাশবিক অত্যাচারের চেষ্টা করা হয় এবং ১৫০ জন স্ত্রীলোককে প্রহার ও শ্লীলতা হানী করা হয়। ৫০৭৬জন লোককে “বে আইন ভাবে” আটক করিয়া রাখা হয়। এতদ্ব্যতীত ৯জন লোককে ভারত রক্ষা নিয়মাবলী অনুসারে আটক রাখা হয়, এবং ৪০১জন লোককে স্পেশাল কনেষ্টবল হিসাবে কাজ করিবার জন্য নিযুক্ত করা হয়। পুলিশ ও সৈন্যদল ১২৪টী গৃহস্থের বাড়ী ভস্মীভূত করে এই সমস্ত অগ্নিকাণ্ডের ফলে ১,৩৯,৫০০৲ টাকা ক্ষতি হইয়াছে। ইহা ছাড়া ৪৯ খানা বাড়ী ভাঙ্গিয়া ৮০৫৭৲ টাকা ক্ষতি করা হইয়াছে। ১০৪৪খানা বাড়ী হইতে ২,১২,৭৯৫৲ টাকা মুল্যের সম্পত্তি লুণ্ঠিত হইয়াছিল ১৩৭৩০ খানি বাড়ীতে তল্লাসী করা হয় এবং ২৭খানি বাড়ী দখল করা করা হইয়াছিল। মোট ৫৯টী পরিবারের ২৫,৩৬৫৲ টাকা মূল্যের সম্পত্তি ক্রোক করা হইয়াছিল। ৪২টী ইউনিয়নে মোট ১,৯০,০০০৲ টাকা, পাইকারী জরিমানা ধার্য করা হয়।
গভর্ণমেণ্ট ২২টী প্রতিষ্ঠানকে বে-আইনি বলিয়া ঘোষণা করেন। অহিংস বিদ্রোহীগণ সুতাহাটা থানা অধিকার করিলে সরকারী বিমান সমূহ হইতে তাহাদের উপর বোমা বর্ষণ করা হয়।
যাঁহারা মারা গিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে ৭৩ বৎসর বয়স্কা শ্রীযুক্তা মাতঙ্গিনী হাজরা নামে মহিয়সী মহিলা ছিলেন। ইনি বহুবৎসর যাবৎ কংগ্রেস কর্ম্মী হিসাবে কাজ করিতেছিলেন। তমলুক সহরে ‘বানপুকুর’ পাড়ে শোভাযাত্রা পরিচালনা করিবার সময় তাঁহার উপর তিনবার গুলি বর্ষণ করা হইয়াছিল। ১২ হইতে ১৬ বৎসর বয়স্ক ৬টী বালক ও নিহত হইয়াছিল। একটা শিশুর একখানি পা বুট জুতার নিষ্পেষণে চূর্ণ হইয়া গিয়াছিল।
পোট্রোল এবং কেরোসিন সহযোগে চালাঘর ও ইমারত সমূহেও অগ্নিসংযোগ করা হইয়াছিল। একজন বিশিষ্ট কংগ্রের কর্ম্মীর বাড়ীতে ৫টী গরু সমেত মোট ১২টী গৃহপালিত পশু জীবন্ত অবস্থায় দগ্ধ হইয়া মারা যায়। ধৃতব্যক্তিগণকে ২ ঘণ্টা হইতে ৩ দিন পর্য্যন্ত আটক করিয়া রাখা হয়। আটক থাকা কালে তাহাদিগকে নির্ম্মমভাবে প্রহার করা হয়। ঐ সময়ে তাহাদিগকে কিছু খাইতে দেওয়া হইত না। তমলুক সাব জেলে সাধারণতঃ যত কয়েদী রাখা হয় ঐ সময়ে তাহার চতুর্গুণ লোক রাখা হইয়াছিল। ইহার প্রতিবাদ কল্পে আটক ব্যক্তিদের মধ্যে একব্যক্তি ২০দিন পর্যন্ত অন্নশন ধর্ম্মঘট করিয়াছিলেন।
অমানুষিক নির্য্যাতনের মধ্যে বহু গ্রামবাসীকে দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করিতে বাধ্য করা হয়। তাহাদের খাইতে দেওয়া হয় নাই। দুরন্ত শীতের রাতে অধিবাসীদের পুষ্করিণীর শীতল জলে ডুবাইয়া রাখা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তাহাদের উলঙ্গ করিয়া পুষ্করিণীতে রাখা হইয়াছিল। বহু ব্যক্তিকে এমনভাবে প্রহার করা হয় যে যে পর্য্যন্ত তাহারা অজ্ঞান না হইয়া পড়িয়াছেন সে পর্য্যন্ত তাহাদের প্রহার বন্ধ করা হয় নাই। বহু ব্যক্তিকে এমনভাবে প্রহার করা হইয়াছিল যে তাহাদের প্রস্রাব নালী হইতে রক্ত বাহির হইতে থাকে। আর এক নূতন ধরণের অত্যাচার হয় যে, প্রহার করিয়া অজ্ঞান করিবার পরিবর্ত্তে নির্যাতিতের গুহদেশে একখণ্ড রুল ঢুকাইয়া ঘুরাইতে থাকিত, উহার ফলে নির্য্যাতিত ব্যক্তি যন্ত্রণায় ছটফট করিতে থাকিত।
কাঁথি মহকুমা
তমলুক মহকুমার ন্যায় কাঁথিও মেদিনীপুর জেলার একটা মহকুমা। ইহার এলাকায় ছটী থানা আছে। যথা:—রামনগর, কাঁথি, ভগবানপুর পটাশপুর, খেজুরী, ও এগ্রা। এই মহকুমার লোক সংখ্যা প্রভৃতি প্রায় তমলুক মহকুমার ন্যায়। এই মহকুমাতেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভের পূর্ব্বে প্রতি ইউনিয়নে প্রতি থানাতে কংগ্রেস কমিটী ছিল।
আগষ্ট আন্দোলন কাঁথি ও তমলুকে সমানভাবেই চলিয়াছিল। আন্দোলনের ফলে খেজুরী, পটাশপুর ও রামনগর প্রভৃতি থানায় কিছুদিনের জন্য বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়াছিল।
কাঁথি মহকুমাতে ছাব্বিশটি ডাকঘর, তিনটি, সাবরেজেষ্টারী অফিস চল্লিশটি খাসমহল অফিস, চল্লিশটি ইউনিয়ন বোর্ড অফিস, ছাব্বিশটি অন্যান্য অফিস, আটাশটি সেতু, সাতটি মদের দোকান, বারটি ডাকবাংলা ভস্মীভূত বা ধ্বংস করা হয়। উপরোক্ত প্রত্যেক অফিসের জিনিষ পত্র ধ্বংস করা হয়। খেজুরী থানায় সমস্ত টেলিগ্রামের থাম অপসারিত করা হয়। অন্যান্য থানায়ও এইরূপ করা হয়। জাতীয় গভর্ণমেণ্ট বহু সরকারী অফিসার, থানার কর্ম্মচারী, দারোয়ান, কনেষ্টবলকে গ্রেপ্তার করে। বহু মেল বাস নষ্ট করা হয়, নানা স্থানে রাস্তা কাটা হয়, বহু পয়ঃপ্রনালী নষ্ট করা হয়, তেরটি বন্ধুক কাড়িয়া লওয়া হয়। তমলুকও কাঁথী মহকুমার বড় নেতারা সব গ্রেপ্তার হওয়া সত্ত্বেও এই দুই মহকুমার সর্বত্র প্রতি গ্রামে অসংখ্য সভা ও শোভাযাত্রা হয়। কয়েক দিনেই আনুমানিক ষোল হাজার লোক স্বেচ্ছাসেবক শ্রেণীভুক্ত হয়। সংগঠনের উদ্দেশ্যে প্রতি ইউনিয়নে শিবির স্থাপন হয়। সমস্ত স্কুল বন্ধ হইয়া যায়। ছাত্ররা দলে দলে স্বেচ্ছাসেবক হয়। অনেক শিক্ষক ও কর্ম্মত্যাগ করেন। যুদ্ধ তহবিলে টাকা দেওয়া বন্ধ হইল। কাঁথি বাজারে নিত্য ব্যবহার্য্য দ্রব্য বিক্রয় বন্ধ হইল। ফলে তিন সপ্তাহ সহর জন শূন্য হইল। সরকারী কর্ম্মচারীদের দুর্দ্দশার চরম হইল। আদালত সম্পূর্ণভাবে বর্জ্জিত হইল। কেহই মামলা করিতে আসিল না। বহু চৌকিদার ও দফাদার স্বেচ্ছায় চাকুরিতে ইস্তাফা দিয়া এই আন্দোলন পরিচালনা করিবার জন্য সমর পরিষদ গঠিত হয়।
ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ প্রচণ্ড আকার ধারণ করিবার পর জনসাধারণের নামে শাসন ব্যবস্থা প্রবর্ত্তিত হয়। সমর পরিষদগুলি কিছুদিন পর্য্যন্ত আন্দালন পরিচালনা করিয়াছিল। কিন্তু সরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ আংশিকভাবে কিম্বা সম্পূর্ণরূপে অচল হইবার পর কোন না কোন নামে জাতীয় গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। কাঁথি মহকুমায় পটাসপুর এবং খেজুরী থানায় প্রায় এক মাস পর্য্যন্ত সরকারী কর্ত্তৃত্বের কোনরূপ চিহ্ন ছিল না। এবং এই দুইটি থানায় পূর্ণ কর্ত্তৃত্বশীল জাতীয় গবর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এতদ্ব্যতীত রামনগর এবং ভগবানপুর থানাতেও জাতীয় গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। জাতীয় গবর্ণমেণ্টের কর্তা হিসাবে একজন সভাপতি অথবা ডিক্টেটর থাকিতেন। সভাপতি অথবা ডিক্টেটরের অধীন একটি মন্ত্রণা পরিষদ অথবা মন্ত্রিসভা থাকিত। মন্ত্রীদের অধীনে স্বরাজ বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, বিচার বিভাগ প্রভৃতি দপ্তর থাকিত। জাতীয় গবর্ণমেণ্টের শাসনাধীন সমগ্র অঞ্চল (থানা) কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকায় বিভক্ত করা হইয়াছিল। এই সমস্ত এলাকায় জনসাধারণ কর্ত্তৃক নির্ব্বাচিত পঞ্চায়েৎ বোর্ড শাসনকার্য্য নির্ব্বাহ করিত। এখানেও নিদারুণ অত্যাচার আরম্ভ হইল। সেই অত্যাচারের বিস্তৃত বিবরণ এই ক্ষুদ্র পুস্তকে দেওয়া সম্ভব নয়। মোটামুটি কাঁথির ক্ষতির হিসাব দেওয়া গেল:—গুলিতে মৃত্যু—৩৯, গুলিতে আহত— ১৭৫, নারীধর্ষণ পুলিশ বা মিলিটারি দ্বারা—২২৮, গৃহদাহ—৯৬৫, গৃহদাহে ক্ষতি—৫৷৷৹ লক্ষ টাকা, গ্রেপ্তারের সংখ্যা—১২,৬৮১, দণ্ডিতের সংখ্যা-৬৭২, লুষ্ঠিত গৃহের সংখ্যা-২০৫৯, লুঠতরাজের (পুলিশ দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ ৩৷৷৹লক্ষ টাকা, লাঠিতে আহত—৬৬৮৫, পাইকারী জরিমানা ৩০০০০৲ টাকা। একজন অফিসার দিনে দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের সাহায্য করিতেন। রাত্রে সৈন্যদের সাহায্যে জনসাধরণের গৃহে হানা দিতেন। প্রভাতকুমার কলেজের মাসিক আড়াই শত টাকা সাহায্য বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। বিনানুমতিতে বাস চালান বন্ধ হয়। সমগ্র মহকুমায় পাঁচ শত সৈন্য মোতায়েন হয়। পুলিশ ও মিলিটারির কার্য্যকলাপের যাহাতে ফটো না লওয়া হয় সেজন্য গভর্নমেণ্ট যে-সামরিক লোক ও ব্যবসায়ীদের নিকট ক্যামেরা কাড়িয়া লয়। আর সকলের কাছ থেকে বন্দুকও কাড়িয়া লওয়া হয়। ১৯৪২ সালে জুন মাসে বঞ্চনা নীতি কার্যকরী করার সময় সমস্ত সাইকেল ও নৌকা অপসারণ করা হয়। খেজুরী থানায় লোকদিগের মনোবল দমন করিবার জন্য ভদ্রলোকগণকে চৌকিদারী ট্যাক্স দিবার ছল করিয়া তাকাইয়া আনিয়া ভয় দেখাইয়া পূর্ব্ব চিহ্নিত পাঁচ গজ স্থানে নাক খত দেওয়ান হয়। তা’ছাড়া বহুলোককে বেত্রাঘাত, মারপিট করা হয়, বিনা বিচারে বহুলোককে আটক রাখা হয়।
প্রলয়ঙ্কর বন্যা ও ঝটিকা
১৯৪২ সালের ১৬ই অক্টোবরের প্রলয়ঙ্কর বন্যা ও ঝটিকার দিন ও পরেও মেদিনীপুর জেলায় উপরোক্ত প্রকারের নৃশংস কায্যকলাপ সমানভাবে গভর্ণমেণ্ট চালাইতে থাকে। এমন কি তমলুকের মহকুমা হাকিম কলিকাতা হইতে ঘুর্ণিবার্ত্তার সম্ভাব্যতা সম্পর্কিত তিন খানি টেলিগ্রাম পাওয়া সত্বেও তিনি তৎসমন্ধে জনসাধারণকে সাবধাণ করা এবং এই সংবাদ প্রচার করিবার জন্য কোনরূপ ব্যবস্থাই অবলম্বন করেন নাই। অধিবাসীবৃন্দের তরফ হইতে সেই দুর্যোগ-ঘন-রাত্রির জন্য সাময়িক ভাবে সান্ধ্য আইন প্রত্যহারের দাবী জানালে তিনি তাহাতে কর্ণপাত করেন নাই।
এই বন্যা ও ঝড়ের সংবাদ এবং ইহার ফলে যে সমস্ত ক্ষতি হয় তৎসংক্রান্ত সমুদয় সংবাদই চাপিয়া রাখা হয়। গাছের মাথায় ও ঘরের চালায় আশ্রয় লইয়া যাহারা জলোচ্ছ্বাসের হাত হইতে কোনমতে আত্মরক্ষা করিয়াছিল, তাহাদের নিরাপদ স্থানে পৌছিয়া দিবার জন্য নিষিদ্ধ এলাকায় নৌকা চলাচল পর্য্যন্ত করিতে দেওয়া হয় নাই। যথাযথ সাহায্যের অভাবে যখন শত শত গ্রামবাসী মরিতেছিল তখন সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরিয়া কোনরূপ সরকারী সাহায্যের ব্যবস্থা তো করা হয় নাই, এমন কি বে-সরকারী সাহায্য-প্রতিষ্ঠানগুলিকে পর্য্যন্ত মাসখানেক যাবত কোনরূপ কাজ করিবার অনুমতি দেওয়া হয় নাই। মাড়োয়ারী রিলিফ লোসাইটীর জনৈক কর্ম্মী সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা নির্দ্ধারণের জন্য আনিলে তাঁহাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং দুর্গতদের সাহায্য দানের জন্য তিনি চাউল এবং অন্যান্য জিনিষ সঙ্গে আনিয়াছিলেন তাহা কর্তৃপক্ষ কর্ত্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়।
জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট বলেন যে, মেদিনীপুরের বিদ্রোহীগণ যে সমস্ত রাজনৈতিক দুষ্কর্ম্মকে প্রশ্রয় দিয়াছে তজ্জন্য তাহাদের এই দুর্ভোগ ভুগিতে হইবে।
জনমতের চাপে পড়িয়া অবশেষে জেলার কর্ত্তৃপক্ষ সরকারী সাহায্য বিতরণ কেন্দ্র খুলিতে এবং বেসরকারী সাহায্য সমিতিগুলিকে সাহায্য কার্য চালাইতে দিতে বাধ্য হন। যে সমস্ত লোক নিজেরাই সরকারী সাহায্যের বেশীর ভাগ অংশ গ্রহণ করিত তাহাদের দ্বারাই সরকারী সাহায্য বিতরণের কার্য্য পরিচালিত হইত। সাহায্যের জন্য যে সমস্ত জিনিষপত্র দেওয়া হইত আত্মসাৎ করাই এই সমস্ত লোকের প্রধান কাজ ছিল। সাধারণতঃ সরকারী গুপ্তচর, গভর্ণমেণ্টের সমর্থক, সরকারী কর্মচারী, গভর্ণমেণ্টের প্রতি অনুকূল মনোভাবাপন্ন ব্যক্তগণই এই সমস্ত সরকারি কেন্দ্র হইতে সাহায্য লাভ করিত। কিন্তু যাহারা প্রকৃতপক্ষে অভাবগ্স্থ ও অসহায় ছিল তাহা দিগকে উপেক্ষা করা হইত।
-“বন্দেমাতরম”—
—জয়হিন্দ—