নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ/দিল্লী চলো

দিল্লী চলো

ঝড়ের আগে

 বাঙ্গালীর মনে আছে ২৬শে জানুয়ারী ১৯৪১, কত বড় এক শুভদিন। সেদিন প্রথম ঘোষণা করা হল সুভাষবাবু তাঁর শয্যাগৃহ থেকে রহস্যজনক ভাবে অন্তর্ধান করেছেন। কিছুদিন ধরেই তিনি তৈরী হচ্ছিলেন এই বিরাট এক আদর্শের সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে পড়বার জন্যে। কিন্তু সে খবর কেউ জানতো না। তাই তাঁর এই রহস্যজনক অন্তর্ধানে সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেল। সকলের মুখে এক কথা প্রহরী বেষ্টিত গৃহ থেকে কি করে তিনি উধাও হয়ে গেলেন? শুধু তাঁর নিজের বাড়ী নয় যখন জানা গেল যে সমগ্র ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে জার্মান বা জাপানে তিনি গিয়ে হাজির হয়েছেন তখন শুধু ভারতবাসী নয় সমগ্র বিশ্বে একটা চাঞ্চল্য পড়ে গিয়েছিল; ব্যাপারখানা কি? ২৫০ বছরের দাসত্ব করার পর এরকম বিপ্লবী বীরের জন্ম হয় কোন শক্তির বলে? কেন হয়? আধুনিক বৈজ্ঞানিক জগতে যেখানে বিজ্ঞানবলে এক দেশের নিভৃত ষড়যন্ত্রও অন্যদেশে অতি সহজেই প্রকাশ পেয়ে যায় সেই জগতের ওপরেই এক দেশের মানুষ তার শত্রুপক্ষের দেশে গিয়ে হাজির হল, কেউ বাধা দিতে পারলো না, এ সম্ভব হয় কোন মন্ত্র বলে?

 এ কথা সত্যি ব্যাপারটা যাদু নয়, মন্ত্র বলও নয়। সত্যিকারের যে সাধক তার মনের মধ্যে সাধনার বলে এমন একটা শক্তি সুপ্ত হয়ে থাকে যে যখন তাকে জাগ্রত করা যায় তখন সে অসাধ্য সাধন করতে পারে। সুভাষবাবু নিজে মান্দালয় জেল থেকে লিখেছিলেন, যেদিন প্রস্তুত হব সেদিন এক মুহুর্তের জন্যও আমাকে কেহ আটকে রাখতে পারবে না। সুভাষবাবুর এই অন্তর্ধানের মূলে আছে এই প্রস্তুত হওয়ার সংকেত।

 একেবারে ছাত্রাবস্থা থেকেই আমরা দেখেছি সুভাষচন্দ্রের সংগঠনীশক্তি অসীম। যে কোন অবস্থাতেই হোক আর যে পরিমাণ সঙ্গতি নিয়েই হোক তিনি সব সময়েই কোন প্রতিষ্ঠান, কোন দল, বা কোন পরিকল্পনাকে গড়ে তুলতে পারতেন। তাই তিনি যে শত্রুপক্ষের সঙ্গে একটা যোগাযোগের ব্যবস্থা করে নিজের কার্যসিদ্ধি করতে পারবেন এ বিষয়ে খুব বেশী আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তবে চারিদিকে কড়া পাহারা, সেন্সার ও সামরিক বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে তিনি কি ভাবে যে সফলকাম হতে পারলেন সেইটিই সমস্ত জগতের সামনে সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। তবে স্পর্শমণি যা কিছুই স্পর্শ করে তা সোনা হয়ে যায়, এতে কোন ভুল নেই ৷

 তবু একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে সুভাষবাবু যে ভাবে এবং যে দেশেই গিয়ে থাকুন এদেশের তাঁর একান্ত বিশ্বাসী কয়েকজন সহচরের সাহায্য তাকে নিশ্চয়ই নিতে হয়েছিল, নতুবা এ কাজ একা সম্ভব নয়। অবশ্য, তাঁর অন্তর্ধানের পর সরকার পক্ষ থেকে বহু চেষ্টা হয়েছে এঁদের ধরবার। বহু ফরোয়ার্ড ব্লক কর্মী, সুভাষবাবুর বাড়ীর লোকেরা, যেমন শিশির বসু, অরবিন্দ বসু অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করেছেন জেলের মধ্যে, শরৎ বাবু অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারাবাস ভোগ করে তিলে তিলে স্বাস্থ্যক্ষয় করেছেন, এমন কি সৌম্যঠাকুর পর্যন্ত বাদ যান নি, কিন্তু তবু একথা গর্বের সঙ্গে বলা যেতে পারে যে সরকার পক্ষ তিলমাত্রও সফলকাম হতে পারেন নি। এতটুকু কোন সংবাদ কখনও কোনও অসতর্ক মুহূর্তেও সেই একনিষ্ঠ সেবকদের মুখ দিয়ে বার হয় নি। এইখানেই সুভাষবাবুর নেতৃত্বের ও জনপ্রিয়তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

 এই রোমাঞ্চকর কাহিনী হয়ত শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অশ্রুতই রয়ে যেত জগতের কাছে, যদি না আকালী নেতা মাষ্টার তারা সিং সেদিনকার বিবৃতিতে কিছু কিছু সংবাদ প্রকাশ করে দিতেন সে কাহিনী যেকোনও জগতের রোমাঞ্চকর কাহিনীর চেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ। যে বাঙ্গালীর ভীরু, কাপুরুষ আর আরামপ্রিয় বলে বদনাম আছে এ সেই বাঙ্গালী জাতিব মধ্যেই এক আবাল্য ঐশ্বর্য-প্রতিপালিত যুবকের আত্মকাহিনী। হে জগতবাসী সুভাষচন্দ্রের মুখের দিকে—সংহত বাঙ্গালী যৌবনের দিকে চেয়ে সে কথা শোনো। অবশ্য বিশদ বিবরণ আমরা এর থেকে পাবো না কারণ বিশদ বিবরণ সুভাষবাবু নিজেই প্রকাশ করেন নি। তিনি নাকি বলেছিলেন—অবশ্য শোনা কথা—যে, এ পথ তাঁকে ভবিষ্যতে আবার হয়ত গ্রহণ করতে হতে পারে, তাই তিনি সমস্ত প্রকাশ করতে রাজী নন। যাই হোক শিখ নেতা তারা সিং যে খবর আমাদের দিয়েছেন তাই আপাততঃ শুনে আমাদের সন্তুষ্ট হতে হবে।[]

 তারা সিং বরাবরই সুভাষবাবুর মতের ওপর বিশ্বাসী এবং তিনি সুভাষবাবুকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন। তাই সুভাষবাবু যখন ছাড়া পেয়ে অসুস্থ অবস্থায় বাড়ীতে অবস্থান করছিলেন তখন তারা সিং তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। মনে মনে তাঁর তখন এই বিরাট স্বাধীনতা-যজ্ঞের পরিকল্পনা চলছিল। যাই হোক এই সময়ে তিনি তারা সিংএর কাছে বলেন যে এই হচ্ছে সুযোগ। একদিকে বৃটিশ যখন ধ্বংস হতে চলেছে অন্যদিকে শত্রুপক্ষ খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এই সময়ে তাদের সাহায্য নিয়ে যদি বৃটিশকে পরাজিত করতে পারা যায় তাহলে ভারতবর্ষ নিশ্চয়ই স্বাধীনতা লাভ করবে। ভারতবর্ষ বৈদেশিক শক্তির সাহায্য ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে না। তারা সিং এতে আপত্তি জানিয়েছিলেন এই বলে যে, ভারতবর্ষ হয়ত এই উপায়ে জয়লাভ করতে পারে কিন্তু ভবিষ্যতে হয়ত সেই বৈদেশিক শক্তি ভারতীয়দের নিজেদের হুকুম মত চালাতে সুরু করতে পাবে, তার ফলে স্বাধীনতা লাভ হবে না কেবল শাসকের পরিবর্তন হবে মাত্র। সুভাষবাবু জবাব দিলেন, বিপদ সব সময়েই থাকবে কিন্তু আমরা বিপদের ঝুঁকি নিতে কখনই কুণ্ঠিত হব না; আমরা আমাদের সঙ্কল্প সিদ্ধ করতে পারি। তারপর তারা সিংএর ওপর আস্থা দেখিয়ে বলেন, বৃটিশ সৈন্যবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত শিখ সৈন্যেরা আপনাকে শ্রদ্ধা করে এবং তারা সরাসরি আপনার অনুগত। শিখেরা বীর জাতি, আমি আশা করি ভবিষ্যতে যখন প্রয়োজন হবে, ডাক যখন আসবে তখন শিখেরা আমাকে সাহায্য করবে, আমার পাশে এসে দাঁড়াবে। উত্তরে তাবা সিং জানান যে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন, শিখেরা সববিষয়ে তাঁর আদেশ অনুসরণ করে যাবে।

 তারপর তাঁদের মধ্যে অনেকক্ষণ ধবে আলোচনা চলে। শেষে সুভাষ বাবু জানান যে তাঁর কাছে এক বাঙ্গালী ভদ্রলোক সুভাষবাবুর বাণী বহন করে নিয়ে আসবে এবং ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ এই সাঙ্কেতিক শব্দ উচ্চারণ করলেই তাঁকে বিশ্বাস করে আদেশ মত কাজ যেন তিনি করেন। এবং তারা সিং একথাও জানিয়েছেন যে তারপর সুভাষবাবু যখন কাবুলের পথে ভারত ত্যাগ করছিলেন সেই সময়ে সত্যিই এক ভদ্রলোক ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ বলে তাঁর কাছে এসেছিলেন।

 সম্প্রতি সুভাষবাবুর পলায়ন সংস্পর্শে থাকার দরুণ একজন ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁর কাছে অনেক খবর পাওয়া গেছে। তার মতে আসলে ১৯৪০ সালের ১৩ই ডিসেম্বর সুভাষবাবু কোলকাতা পরিত্যাগ করেন। তিনি প্রথমে মোটর যোগে বর্ধমান পর্যন্ত যান সেখান থেকে পাঞ্জাব মেলে একখানা সেকেণ্ড ক্লাস রিজার্ভ কামরা করে পাঞ্জাবে গিয়ে হাজির হন। কি অসম্ভব কাণ্ড! সুভাষবাবু আপনার আমারই মত পাঞ্জাব মেলে চড়ে ‘যুদ্ধ’ করতে চলেছেন! কিন্তু তাঁকে চেনবার জো নেই একেবারে। মুখে তাঁর বিরাট দাড়ি গোঁফ, মাথায় পাগড়ী—দেখলে মনে হবে বিবাট এক পাঠান চলেছে বুঝি! যাই হোক পেশোয়ারে গিয়ে তিনি ছ’দিন ছিলেন খান আব্বাসখানের আশ্রয়ে। পেশোয়ার থেকে একজন দেহরক্ষীর সঙ্গে তিনি কাবুল যাত্রা করলেন। পাঁচ মাইল পর্যন্ত পেশোয়ারী টোঙ্গায় আর তারপর বাকী রাস্তা পায়ে হেঁটে তিনি কাবুল এসে পৌঁছলেন। কাবুলে পৌঁছে কিন্তু তিনি বিপদে পড়েন। হঠাৎ তিনি আমাশয় রোগে পড়েন এবং সেই অসুস্থ অবস্থায় একজন গোয়েন্দার পাল্লায় পড়েন। শেষে দশটা টাকা ও তাঁর সঙ্গের ফাউণ্টেন পেনটা তাকে দিয়ে তবে উদ্ধার পান। যুদ্ধ জয় করতে হলে ছল বল কৌশল এ তিনেরই আশ্রয় নিতে হয়, শুধু বলে সব ক্ষেত্রে চলে না।

 কাবুল থেকে তিনি রাশিয়ায় যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু রাশিয়া সরকার জানান যে, রুশ-জার্মাণ চুক্তি ভাঙ্গতে চলেছে এবং শীঘ্রই বৃটিশের সঙ্গে তাদের চুক্তি হবে সুতরাং বৃটিশের পক্ষে ক্ষতিকর কোন কাজ তারা করতে পারে না। এর পর তিনি একজন জার্মানের সংস্পর্শে আসেন, এবং তিনি ভারতের বাইবে যেতে চাইছেন জেনে সেই জার্মান ভদ্রলোক বার্লিনের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেন। এবং সুভাষবাবু রাশিয়ার সীমানার ওপর দিয়ে বিমান পথে বার্লিনে গিয়ে পৌঁছান।

 এই হল মোটামুটি ইতিহাস। আমরা পূর্ণ বিবরণ না পেলেও যে সব ভাগ্যবান দেশ প্রেমিকের দল যারা সুভাষবাবুকে এই ব্যাপারে সর্বদিক দিয়ে সাহায্য করেছেন সেই অখ্যাতনামা বন্ধুদের আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই।

 ঐ একই ব্যক্তির কাছ থেকে খবর পাওয়া গেছে যে সুভাষবাবু ১৯৩৯ সালে নাকি একবার ভারত থেকে পলায়ন করবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কৃতকার্য হন নি। এবং তাঁর কারামুক্তির পর নভেম্বর মাসে কোলকাতার নাম করা সাংবাদিক— ‘দেশ দর্পণ’ সম্পাদক সর্দার নিরঞ্জন সিং তালিবের নিকট তাঁর রাশিয়া যাওয়ার সঙ্কল্পের কথা প্রকাশ করেন। তালিব বলেন আচারসিং চিন্না এই বিষয়ে বেশী সাহায্য করতে পারবেন। চিন্না তখন ফতেওয়াল হত্যা মামলায় আত্মগোপন করে বেড়াচ্ছেন। তারপর সুভাষ-তালিব-চিন্না বৈঠকের একটা আয়োজন হয়েছিল। এই বৈঠকে স্থির হয় চিন্না ও তালিব পাঞ্জাবে গিয়ে আকালী ও কমিউনিষ্টদের মধ্যে একটা ঐক্যের চেষ্টা করবেন। তাঁরা দুজনেই পাঞ্জাবে গেলেন এবং কমিউনিষ্ট ও আকালীদের মধ্যে কথাবার্তা চালাতে লাগলেন। স্থির হল কমিউনিষ্টরা সুভাষবাবুকে রাশিয়ায় পাঠাবার ব্যবস্থা করবে আর আকালীরা পাঞ্জাবের গুরুদ্বারের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপাবে কমিউনিষ্টদের আস্থা স্থাপনের যোগ্য হয়ে উঠবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই পরিকল্পনা কার্যে পরিণত হয় নি। ইতিমধ্যে সুভাষবাবু অন্তর্ধান করলেন। এবং এই ব্যাপারে পাঞ্জাবই তাঁকে নানাদিক দিয়ে সাহায্য করলো।

 সত্য মিথ্যা বিচার এবং প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটনের সময় এখনো আসে নি, কিংবা সময এলেও সুযোগ এখনও ঘটেনি তবে সুভাষবাবুর অন্তর্ধান বিষয়ে এই হল একমাত্র খবর। জানা গেছে অধুনা মুক্ত উত্তমচাঁদও নাকি এই ব্যাপারে জড়িত আছেন। তবে একথা অনুমান করা অযৌক্তিক নয় যে সুভাষবাবু স্থলপথে এবং কাবুলের পথেই ভারত ত্যাগ করেছিলেন। আগামী দিনের স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সেই জয়যাত্রার পথের মানচিত্র স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত থাকবে।

 এ ত গেল যাত্রাপথের বিচ্ছিন্ন ও প্রক্ষিপ্ত কাহিনী। এবার লক্ষ্যের কথা, যাত্রাস্থানের কথা। ১৯৪১ সালের ১০ই নভেম্বর ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব স্মিথ্ ঘোষণা করলেন সুভাষচন্দ্র বার্লিন বা রোমে অবস্থান করছেন। ১৭ তারিখে অক্ষশক্তি পক্ষের বেতারে জানা গেল সুভাষবাবু জার্মাণীতে এসে জার্মান সরকারের সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন। ২৭ তারিখে ভারত-সচিব আমেরী বললেন সুভাষবাবুর সঠিক অবস্থান সম্বন্ধে জোর দিয়ে কিছু বলা চলে না।

 সুভাষবাবুর গৃহ পরিত্যাগের পর তাঁর শয্যাগৃহে বাঘছাল ও গীতা পাওয়া গেল। তাছাড়া কিছুদিন ধরে তিনি নির্জনে দিন কাটাচ্ছিলেন, ফলের রস ছাড়া কিছু খেতেন না, সব সময়েই ধ্যানে কাটাতেন। সুতরাং লোকে মনে করেছিল যে তিনি হয়ত রাজনৈতিক জীবনে বীতরাগ হয়ে শ্রীঅরবিন্দের মত ধর্ম জীবনের পথে যাত্রা করেছেন। এমন ধারণা করা খুব বিসদৃশ নয় কেন না বরাবরই তাঁর মনে ধর্ম ভাবের প্রাবল্য খুব বেশী। তাই লোকে প্রথমটা বিশ্বাস করে পারে নি যে, তিনি জার্মানীতে গিয়ে হিটলারের সঙ্গে কোন গোপন ষড়যন্ত্র করছেন। কিন্তু সরকার পক্ষ থেকে হঠাৎ খুব প্রচার চলতে লাগলো এই ষড়যন্ত্রের। বিশেষ করে স্টেট্‌স্‌ম্যান প্রমুখ সংবাদপত্রে লেখা হতে লাগলো যে সুভাষচন্দ্র ফিফ্‌থ্ কলমিষ্ট, শত্রুপক্ষের দালাল, ফ্যাসিস্ত, দেশদ্রোহী ইত্যাদি। এমন কি তারা লিখলে যে, সুভাষবাবু বরাবরই ফ্যাসিস্ত ডিক্টেটরদের কাছ থেকে ভারতে ফিফ্‌থ কলম বা পঞ্চম বাহিনী গঠন করবার জন্যে অর্থ সাহায্য পেয়ে আসছেন। আচার্য কৃপালনী এই মিথ্য। দোষারোপের বিরুদ্ধে এক বিবৃতি দিয়েছিলেন।

 এই নিয়ে বাদানুবাদ চলছে এমন সময় ২৮শে মার্চ ১৯৪২ রয়টার লণ্ডন থেকে ঘোষণা করলেন যে, টোকিওর সংবাদে প্রকাশ সুভাষবাবু জাপানের সমুদ্রতীরে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। সুভাষবাবু নাকি টোকিওতে স্বাধীন কংগ্রেসে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর কয়েকজন পার্শ্বচরও নিহত হয়েছেন।

 এই মর্ম্মান্তিক সংবাদে সমস্ত দেশ সচকিত হয়ে উঠলেও মর্মাহত হল না। কারণ, সুভাষবাবুর এই মৃত্যু-সংবাদ অন্তর থেকে কেউ বিশ্বাস করতে পারে নি।

 ৯ই এপ্রিল স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস্ ঘোষণা করলেন যে সুভাষবাবু অক্ষশক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন এবং ইউরোপে অবস্থানকালে আজাদ হিন্দ ফৌজের শাখা গঠন করেছেন।

 মোট কথা এ কথাটা স্পষ্ট করে জানা গেল যে সুভাষবাবু অক্ষশক্তির সঙ্গে যোগ দিয়ে বিরাট একটা পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দিতে চেষ্টা করছেন।

 স্বাধীনতার জাহ্নবীধারাকে অপার্থিব স্বপ্ন-রাজ্যের স্বর্গ থেকে বাস্তবের মাটিতে—শৃঙ্খলিত ভারতভূমিতে নামিয়ে আনতে কোন দুর্গমে তপস্য। সুরু করেছে বিংশ শতাব্দীর ভগীরথ—!

 ১৯৪৩ সালের মে/জুন মাসে সম্ভবতঃ সাবমেরিণযোগে সুভাষবাবু জাপানে প্রেরিত হন। ৭ই জুলাই চুংকিং সংবাদে তাঁর সিঙ্গাপুবে অবস্থানের কথা প্রথম ঘোষিত হয়।

 এর পর থেকেই আজাদ-হিন্দ ফৌজের গৌরবময় ইতিহাসের শুরু। কিন্তু সে ইতিহাসের গর্বিত অধ্যায়ের আগে আমাদের তদানীন্তন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা সম্বন্ধে খানিকটা ধারণা থাকা দরকার। কারণ এই প্রপীড়িত হতভাগ্য ভাবতীয়দের এবং অন্যান্য স্থানীয় অধিবাসীদের নির্মম জীবনকাহিনীর মসীলিপ্ত পটভূমিকাতেই স্বপ্নোজ্বল সূর্যোদয় সম্ভব হয়েছিল।

 কিছুক্ষণের জন্য অতীতের সেই কালো ইতিহাসে আমরা নেমে চলি। সেই কালো ইতিহাসের পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘেই ত বিপ্লবের ঝড় উঠবে!

 এত অল্পদিনের মধ্যে এতবড় একটা কাহিনী যে গড়ে উঠতে পারলো তার মূলে আছে সুভাষবাবুব অসাধারণ কর্মক্ষমতা এবং যারা যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের অতুলনীয় আত্মত্যাগ সন্দেহ নেই, কিন্তু তার মূলে আছে আরও একটি বড় বস্তু যার ফলে এই অভিযান এত সহজে সম্ভব হতে পেরেছিল। সে বস্তুটি হল মালয় ও ব্রহ্মদেশের প্রবাসী ভারতীয়দের ঐকান্তিক সহযোগিতা। এই যে আন্তরিক সহযোগিতা এরও আবার মূলে আছে একটি বস্তু যার ভার জগদ্দল পাথরের মত সম অংশে চাপ দিয়ে আছে ভারতে এবং এই দেশে—সে হল শ্বেত বর্বরতা। আমাদেরই মত স্থানীয় ভারতীয়েরা বৃটিশের অত্যাচারে নিপীড়িত নিষ্পেষিত। জাপানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হবার আগে এবং যুদ্ধের প্রথম বৎসরে অকথ্য নির্যাতন এদের সহ্য করতে হয়েছে বৃটিশের হাতে। এখানে খনিজ এবং উদ্ভিজ্জ উৎপাদনের ব্যবসায়ে শ্বেতাঙ্গদের যথেষ্ট স্বার্থ আছে এবং সেইজন্যেই সকলরকম উপায়ে তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে এই দেশকে হাতের মুঠোর মধ্যে বাখতে হয়। তাই ভারতীয়দের একহাতে সমস্ত সম্পদ তুলে দিতে হয় এই বর্বর শাসকদের হাতে আর অন্য হাতে গ্রহণ করতে হয় নির্যাতন ও অত্যাচারের ক্লেশ। এদিকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ এসে পৌছেছে এদের মনে। এদেরও মনে বহুদিনকার ঘুমিয়ে-পড়া আশার সূর্য আবার জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। তাই তারা যে সুযোগ বুঝে আজাদ-হিন্দ ফৌজে এসে যোগ দেবে—সহায়তা করবে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

 তাদের ওপর এই জুলুম এবং তার পরিবর্তে তাদের ক্ষুব্ধ মনের আন্দোলন সম্বন্ধে একটা সুস্পষ্ট ছবি আমরা দেখতে পাবো ১৯৪১ সালের শ্রমিক আন্দোলনে। এ আন্দোলন সম্পূর্ণ অহিংস ভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শ্রমিকদের দাবী ছিল— (১) জীবনযাত্রার অতিরিক্ত ব্যয়বৃদ্ধির জন্য চীনাদের সহিত সমান হারের মাহিনা। (২) সংবাদপত্র পড়ার স্বাধীনত। (৩) আমন্ত্রিত ভারতীয় নেতাদের অধীনে সভা আহ্বানের স্বাধীনতা (৪) বাইবের থেকে আত্মীয়বন্ধুদের বাড়ীতে আনবার অধিকাব (৫) সমস্ত তাড়ির দোকানের উচ্ছেদসাধন (৬) উপযুক্ত শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা (৭) এমন সব সংস্থার ব্যবস্থা করা যাতে জগতের লোক জানতে পারে তারাও মানুষ (৮) উচ্চপদে নিয়োগ..... ইত্যাদি।

 বৃটিশ শাসক এর প্রত্যুত্তর দিয়েছিল। ভাষায় নয় কার্যে। যথা — (১) ধর্মঘটীদের ওপর গুলীবর্ষণ (২) নারীদের বলপূর্বক উলঙ্গ করে রাস্তায় রাস্তায় তাড়া করে বেড়ানো (৩) নারীদের ওপর পাশবিক অত্যাচার (৪) প্রায় ৫০০০০ শ্রমিককে গৃহহীন করা (৫) সমস্ত জল আলো বন্ধ করে দেওয়া···ইত্যাদি। অথচ, সেন্সারের এমনই কড়া ব্যবস্থা ছিল যে, জগতের কোথাও এ খবর গিয়ে পৌঁছতে পারে নি।

 এদিকে জাপানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছলো। ভেতরে ভেতরে সমস্ত শ্বেতাঙ্গ অধিবাসিদের সরাবার ব্যবস্থা হতে লাগল। ১৯৪১ সালের শেষ দিকে সমস্ত বৃটিশই পালিয়ে গেল মালয় ছেড়ে।[] আর জাপানীদের সমস্ত আক্রমণের সমস্ত চাপ বহন করবার জন্যে রইল অরক্ষিত হতভাগ্য ভারতীয়েরা। উপরন্তু জল ও আলোর সমস্ত ব্যবস্থা ধ্বংস করে গিয়েছিল বৃটিশেরা। সুতরাং ভারতীয়দের দুর্দশা অবর্ণনীয় রকমের মর্মান্তিক সন্দেহ নাই। কিছু কিছু ভারতীয় সৈন্যও এখানে ছিল।

 জাপানীরা ১৯৪২ সালের ১৫ই জানুয়ারীর মধ্যে সমস্ত মালয় দখল করে বসে। তারা কিন্তু ভারতীয় অধিবাসী ও সৈন্যদের ওপর কোনরকম খারাপ ব্যবহার করেনি! উপরন্তু ভারতের স্বাধীনতার জন্য দল গঠনে সবরকম সাহায্য করেছিল ও সুযোগ সুবিধা দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। এমন কি তারা সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্ত করে দেয়।

 এদিকে জাপানে রাসবিহারী বসু ভারত স্বাধীনতা সঙ্ঘ বা Indian Independence League গঠন করে বিবাট এক আন্দোলন কয়েক বৎসর যাবৎ চালনা করছিলেন। এই আই. আই. এলএর অনুকরণে মালয়েতেও লীগ গড়ে উঠলো। জাপানের সহযোগিতায় তাদের শক্তিও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। তবে সকলেই যে এতে যোগ দিয়েছিল তা নয়। বৃটিশের গুপ্ত সহযোগিতায় গুপ্তচরদের নিয়ে এবং পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে অন্যান্য সাধারণ লোককে নিয়ে এক জাপ-বিরোধী বাহিনীও গড়ে উঠলো। জাপানীরা এদেরও কোন বাধা দেয়নি। এ বিষয়ে জাপানের মনোভাব সত্যিই বিস্ময়কর। এদের সংখ্যাও নেহাৎ কম ছিল না। তারা রীতিমত মিত্র শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ বেখে কাজ করতো।

 ধীরে ধীরে যখন পূর্ব-এশিয়া জাপানীরা জয় করে ফেললে তখন সারা পূর্ব-এশিয়া জুড়ে ভারত-স্বাধীনতা সঙ্ঘ গড়ে উঠেছে। এই দলের ব্রহ্ম, শ্যাম, মালয়, সাংহাই, ফিলিপিন, কোরীয়া, মাঞ্চুরিয়া, আন্দামান, হংকং, নানকিং ও জাপানের প্রতিনিধিদের নিয়ে রাসবিহারী বসুর সভাপতিত্বে ব্যাংককে এক অধিবেশন বসলো। এই অধিবেশনে সমস্ত পূর্ব-এশিয়া সঙ্ঘের একটা কার্যতালিকা ও কার্যনিবাহক সমিতি গঠন করা হল। সভাপতি হলেন, রাসবিহারী বসু, এবং চারজন সভ্য হলেন: এন, রাঘবন, কে, পি, কে, মেনন, ক্যাপ্টেন মোহন সিং ও কর্ণেল জিলানী। মোহন সিংয়ের ওপর ভার পড়লো সংগঠনের। তিনিই প্রথম আজাদ-হিন্দ-ফৌজ বা জাতীয় সেনা বাহিনী বা Indian National Army গঠন করেন।

 এই দিক দিয়ে এই পাঁচজন বীর সন্তান— আধুনিক যুগের পঞ্চ-পাণ্ডব আমাদেব শ্রদ্ধা ও প্রণামের পাত্র!

 অবশ্য এই বাহিনীর অস্তিত্ব বেশী দিন ছিল না। ওঁরা দেখলেন জাপানের উদ্দেশ্য এই সৈন্যদের দিয়ে তাদের কার্যসিদ্ধি করা। ফলে মোহন সিং ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে এই বাহিনী ভেঙ্গে দিলেন এবং ওঁদের কার্যনির্বাহক সমিতিও ভেঙ্গে গেল। কিন্তু রাসবিহারী বসু তখনও হাল ছাড়েন নি। তিনি একাই শেষপর্যন্ত লীগেব কাজ চালাতে লাগালেন এবং কর্ণেল ভোঁসলে নতুন করে জাতীয়-সেনাবাহিনী গঠন করতে আরম্ভ করলেন।

 ঠিক এই সময়েই সুভাষবাবু জার্মানী থেকে এসে উদয় হলেন টোকিওয়। সূর্য উদয়ের দেশে সূর্য উদিত হলেন পশ্চিম পার হয়ে। সেই সূর্য ক্রমশঃ গড়িয়ে চললো মধ্যাহ্নের দিকে।

 টোকিও থেকে সিঙ্গাপুর!

 পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের স্তূপে ঝলসে উঠলো বিদ্যুৎ।


 টোকিও রেডিও থেকে প্রথম যে বেতার বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন, তাতে বলেছিলেন, আমার এ কথায় বিশ্বাস করুন যে আমি ভারতেরই উদ্দেশ্যে একজন ভারতীয়। পার্থীদের মধ্যে কাক হল সবচেয়ে ধূর্ত ও নিষ্ঠুর, পশুদের মধ্যে শৃগাল আর মানুষের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ জাতি। এই বৃটিশ যদি আমাকে প্রলোভিত করতে না পেরে থাকে তাহলে জগতে আর কোনও শক্তি নেই যে তা পারে। তাহলেও আপনাদের মনের সন্দেহের কথা আমি অনুভব করি। আমি পূর্ব-এশিয়ার ভারতীয়দের ডাক দিয়ে বলছি আপনারা আমাদের মাতা হিন্দুস্থানের স্বাধীনতা উদ্ধারের মহৎ কার্যের উদ্দেশ্যে একই পতাকার তলে সমবেত হন। ভারতবর্ষ এক দেশ। ভারতবাসী এক জাতি। আমাদের একমাত্র পতাকা ত্রিবর্ণ পতাকা। আমাদের একমাত্র শত্রু বৃটেন। দিল্লীর দিকে এগিয়ে চলুন এবং লাল কেল্লার ওপর ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলন করুন। আমি আশা করি আপনারা হিন্দুস্তানের শৌর্য ও বীর্যের ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখবেন।


 ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসের চার তারিখে সিঙ্গাপুরের ক্যাথে বিল্ডিং অপূর্বভাবে সজ্জিত হল। প্রায় পাঁচ হাজার প্রতিনিধি এসে মিলিত হলেন এই প্রাসাদে! একজন ভারতীয় প্রায় এক লক্ষ টাকা দিয়ে একখানা আসন সংগ্রহ করলেন।

 লক্ষ লক্ষ ভারতীয় ও অভারতীয় নরনারী জড় হলেন অট্টালিকার চারদিকে। তাঁদের উদ্দেশ্য একটিবার মাত্র দর্শন করবেন এই রহস্যময় লোকটিকে! কে এই বিপ্লবী বীর? কোথাকার ভারতবর্ষের কোন এক গৃহ হতে বার হয়ে পশ্চিম প্রদক্ষিণ করে কোন সে সাহসী যুবক এসে দাঁড়িয়েছে স্বাধীন ভারতের প্রথম উদয় তীর্থে?

 এই অগণিত জনতার সম্মুখে দুঃখিনী বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ রত্ন বঙ্গবীর সুভাষচন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন, যেমন করে কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগে পশ্চিমের সমস্ত দুর্যোগের সামনে প্রহরীর মত বুক পেতে দাঁড়িয়ে উঠেছিল হিমশীর্ষ হিমালয়।

 চিত্তজয়ী স্বরে বলে উঠলেন তিনি,— ইতিহাস বিখ্যাত বীর ভারতীয়ের বংশধর আপনারা। আপনারা আর দাস নন। আমি চাই আপনারা মাথা উঁচু করে কথা বলুন। আমাদের শ্রেষ্ঠ নেতা গান্ধীজীর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি বলছি অস্ত্র দিয়ে অস্ত্রকে ঠেকাতে হবে। ভীরু দাসত্বের জীবনের চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়! আমরা যদি এক লক্ষ প্রাণ বলিদান দিতে পারি তাহলে আমরা আমাদের চল্লিশ কোটি ভাই বোনদের বৃটিশের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে পারবো।

 তারপর আবার ৭ই জুলাই তিনি ঘোষণা করলেন,—কেন, কিসের আহ্বানে সব রকম বিপদসঙ্কুল পথে ঘর ছেড়ে আমি বেরিয়ে পড়লুম সে কথা আমি প্রকাশ করে বলতে চাই। অপানারা জানেন ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী পার হওয়ার পর থেকেই আমি স্বাধীনতার যুদ্ধে রত আছি। গত বিশ বৎসর পূর্বে সমস্ত অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে আমি বরাববই জড়িত আছি। তার ওপর হিংস হোক আর অহিংস হোক, যে কোন রকমের গোপন বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে আমি যুক্ত আছি এই সন্দেহে বার বার বিনা বিচারে আমি কারাবাসে পতিত হয়েছি।

 এই অভিজ্ঞতার ফলে আমি এই উপসংহারে এসে পৌঁছেছি যে, ভারতের মধ্যে যত শক্তিই আমরা প্রয়োগ করি না কেন তা দিয়ে বৃটিশকে তাড়ানো যাবে না। যদি গৃহের সংগ্রাম আমাদের দেশবাসীর স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে যথেষ্ট হত তাহলে বোকার মত এই অপ্রয়োজনীয় বিপদ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে আমি ঝাঁপিয়ে পড়তাম না।

 সহজ ভাষায় বলতে আমার ভারত ত্যাগের কারণ দেশের ভেতরকার সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী করে তোলবার জন্যে বাইরে থেকে সাহায্য করা! এই বৈদেশিক সাহায্য—যা আমাদের দেশের জরুরী প্রয়োজন আছে সেই সাহায্য ব্যতিরেকে ভারতের স্বাধীনতা অসম্ভব। অপরপক্ষে এই সাহায্য—দেশ যার প্রয়োজন বোধ করছে তার প্রয়োজন প্রকৃতপক্ষে অতি সামান্য। কারণ অক্ষশক্তি বৃটিশকে যেভাবে পরাজিত করেছে তাতে বৃটিশের শক্তি এবং সম্মান এমনই শিথিল হয়ে গেছে যে, আমাদের কাজ আগের তুলনায় যথেষ্ট সহজ হয়ে এসেছে।

 এমনি করেই চললো বাণীর পর বাণী, ডাকের পর ডাক!

 এর পর—ঝড়!—

* * * *

  1. এরপর উত্তমচাঁদের কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।
  2. পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।