নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ/স্বরূপ

স্বরূপ

 লক্ষ্য কোন দিকে?

 স্বভাব-বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র জীবন-আদর্শের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ালেন। কংগ্রেসের প্রাসাদের সব কয়টি প্রবেশদ্বারই তাঁর সামনে বন্ধ হয়ে গেছে, যে সোশ্যালিষ্ট পার্টিকে এযাবৎ বরাবর সমর্থন করে এসেছেন, তাদের কণ্ঠেও আজ ভিন্ন সুর। কমিউনিষ্ট পার্টি তাঁর কাছে বরাবরই পরিত্যাজ্য, তাহলে স্বদেশের মধ্যে বসে লক্ষ লক্ষ অনুরাগী দেশবাসীর মধ্যেই তিনি নির্বাসিত হয়ে গেলেন?

 কিন্তু, তিনি জানতেন পথ খোলা আছে। তিনি জানতেন ভারতের বিরাট তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে উগ্রপন্থী বিপ্লবীদের কাছে তাঁর স্থান কোথায়? তিনি জানতেন কিষাণ মজুরদের মাঝখানে তাঁর প্রতিপত্তি কতখানি।

 এবং এই জানাজানির মধ্য থেকেই ফরওয়ার্ড ব্লকের শুভ আবির্ভাব।

 নাম থেকেই ধারণা করে নেওয়া যেতে পারে যে ফরওয়ার্ড ব্লক অর্থে যত অগ্রগামী দল আছে তাদের একটা সম্মিলিত প্রতিষ্ঠান! যতদিন তিনি রাজনীতি ক্ষেত্রে আছেন এবং বিশেষ করে দেশবন্ধুর পরলোক গমনের পর থেকে—তিনি সর্বদা কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী দলের একটা ব্লক খাড়া করে তুলতে যত্নবান।

বিশেষতঃ ইউরোপে প্রবাসের সময় বিঠলভাই প্যাটেলের সহযোগিতায় দক্ষিণপন্থী পরিচালিত কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যেভাবে আক্রমণ করে আসছেন তাতে এ বিষযে বিন্দুমাত্র সন্দেহ কারও থাকতে পারে না। কিন্তু ত্রিপুরী কংগ্রেসের এবং কোলকাতা কংগ্রেসের ট্রাজেডীর পরই ফরওয়ার্ড ব্লকের উৎপত্তি যখন সম্ভব হল তখন সহজেই প্রশ্ন ওঠে যে ফরওয়ার্ড ব্লক এই কোলকাতা কংগ্রেসেরই প্রতিক্রিয়া কি না!

 প্রতিক্রিয়া এ নয়। ফরওয়ার্ড্ ব্লক সুভাষচন্দ্রের জীবনের ক্রমবিকশিত স্বরূপের চরম অধ্যায় মাত্র। প্রতিক্রিয়া এই জন্য নয় যে প্রতিক্রিয়ার মধ্যে কোন ফিলজফি বা তত্ব থাকে না যা ফরওয়ার্ড ব্লকের মধ্যে পূরোমাত্রায় আছে। ফরওয়ার্ড্ ব্লকের ফিলজফি কি?

 মান্দালয় জেল থেকে মুক্তি পাবার পর থেকে কংগ্রেসের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের যে সংঘাত শুরু হয় সে সংঘাত কংগ্রেসের উদ্দেশ্য হিসেবে কোন রকম আপোষহীন পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী নিয়ে। লাহোর কংগ্রেসে এই পূর্ণ স্বাধীনতাই কংগ্রেসের আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত হয় এবং এই লাহোর কংগ্রেসের এই স্বীকৃতির দিনকেই স্বাধীনতা দিবস বলে প্রতি ২৬শে জানুয়ারী সারা ভারতবর্ষ জুড়ে—এবং প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যেও নিষ্ঠার সঙ্গে আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয়।

 পূর্ণ স্বাধীনতার আদর্শ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলেও কংগ্রেসের মধ্যে আপোষের ইচ্ছা একেবারেই লুপ্ত হয়ে যায় নি। বিশেষতঃ ১৯৩৩ সালের আন্দোলনের হঠাৎ পরিসমাপ্তিতে সুভাষচন্দ্রেব মনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় তার থেকেই কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় সংঘাতের সুরু। তারপর ইউরোপের সমস্ত বক্তৃতা সমস্ত রচনার মধ্যে কংগ্রেসের এই মনোভাবের বিরুদ্ধে তাঁর অসন্তোষ শুধু তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে এবং তিনি একটি মাত্র দলের সর্বাধিনায়কত্বে ভারতের ভাগ্যনিরূপণের পরিকল্পনা করেছেন। এ সব কথা আমরা আগেই শুনেছি। যাই হোক সর্বাপেক্ষ। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যতদিন তিনি ইউরোপে ছিলেন ততদিন তিনি এই একই দলের সর্বাধিনায়কত্বের ওপর জোর দিলেও কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে হরিপুরায় তিনি যে বক্তৃতা দিলেন তাতে ভিন্ন সুর শোনা গেল। তিনি বললেন কংগ্রেসের মধ্যে সোশ্যালিষ্ট পার্টি, লেফটিস্ট পার্টি প্রভৃতির স্থান আছে। তাঁর এই মত পরিবর্তনের কারণ এই যে তিনি কংগ্রেসের মধ্যে আসন্ন ভাঙ্গনকে প্রতিহত করবার জন্যে বদ্ধ পরিকর। অথচ, ভাঙ্গন এল বিপক্ষ দিক থেকেই! এবং এই ভাঙ্গনের মধ্য থেকেই যখন ফরওয়ার্ড ব্লকের উৎপত্তি তখন তার মধ্যে যে তাঁর সেই নব-পরিকল্পিত সুরের ধ্বনি আবার শোনা যাবে তাতে সন্দেহ কি?

 ইতিপূর্বেই তরুণ-নেতা হিসাবে অনেকবাবই তিনি কংগ্রেসের অধিবেশনের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে তরুণদের নিয়ে এবং কিষাণ মজুরদের নিয়ে সভা আহ্বান করেছেন অধিবেশন চালিয়েছেন; জনসাধারণের ওপর সেই ক্ষমতা তাঁর বরাবরই ছিল। তার ওপর হরিপুরার অধ্যায়ের পর তিনি যেভাবে ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ভ্রমণ করে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তাতে তাঁর জনপ্রিয়তা অভাবনীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এবং তাঁর বক্তৃতার মধ্যে বামপন্থী দলের মনোভাব যে স্পষ্ট হয়ে উঠতো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। উপরন্তু তিনি প্রকাশ করে বলেছিলেন যে এই র‍্যাডিক্যাল দলগুলির মধ্যে যারা সোশ্যালিষ্ট পার্টি কিংবা কমিউনিষ্ট পার্টিতে যোগ দিতে রাজী নয় তাদের নিয়ে একটা দল গড়ে তুলতে হবে। এবং এইভাবেই দেশের মধ্যে মার্কসীয় দর্শনের ভিত্তি গড়ে উঠবে।

 ফরওয়ার্ড ব্লক উক্ত মনোভাবের আর একটি অখণ্ড প্রকাশ। যার ফলে এক বছরের মধ্যে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এই দল গড়ে উঠলো এবং বাঙ্গলা দেশে ফরওয়ার্ড ব্লকের শক্তির কাছে কংগ্রেস পঙ্গু হয়ে গেল।

 গোড়ার দিকে সুভাষচন্দ্র সমস্ত বামপন্থী দল যেমন, সোশ্যালিষ্ট, কমিউনিষ্ট, রায় গ্রুপ এবং সুভাষচন্দ্রের বামপন্থী জাতীয়তাবাদী বা লেফটিষ্ট ন্যাশানালিষ্টের দল—এই সবার সঙ্গে একটা মিলিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সোশ্যালিষ্ট পার্টির বিরুদ্ধতার জন্য এই আয়োজন সম্ভব হয় নি। দুর্ভাগ্যের কথা সন্দেহ নেই। সোশ্যালিষ্ট পার্টি বলেছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের ভবিষ্যৎ নীতির ওপর তাদের কোন আস্থা নেই। বিশেষ করে এর পররাষ্ট্র নীতি তারা মেনে নিতে পারছে না। যে সুভাষচন্দ্রকে একদিন তাদের নেতা বলে তারা গ্রহণ করেছিল তাদেরই এমন মনোভাবের কারণ কি? আমরা দেখেছি জওহরলাল নেহরু সোশ্যালিষ্ট পার্টির অন্যতম নেতা। কমিউনিজম্ ও ফ্যাসিজমের গুণাগুণ বিচার নিয়ে প্রবাসী সুভাষচন্দ্র ও ভারতের জওহরলালের সঙ্গে মনোমালিন্য শুরু হয়ে গিয়েছিল। এবং সুভাষবাবুর শারীরিক অনুপস্থিতির সময় জওহরলাল এদের উপর নিজের প্রভাব বেশ দৃঢ়ভাবেই বিস্তার কবে রেখেছিলেন। তাই ফরওয়ার্ড ব্লক সম্বন্ধে নেহরু স্পষ্টই বললেন যে এর মধ্যে নানারকম দল এসে ঢুকেছে—সুবিধাবাদী অর্থাৎ যাদের কংগ্রেসের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিবাদ আছে—তা ছাড়া আছে উগ্র জাতীয়তাবাদী দল যারা ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হলে জার্মানী ও ইটালীকে সাহায্য করতে উন্মুখ হবে কারণ জার্মানী ও ইটালীর কাছ থেকে তারা তাদের আদর্শ নিয়েছে।

 আবিসিনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার ফলে ইটালীর ওপর অর্থাৎ ফ্যাসিজমের ওপর সকলেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সুতরাং পণ্ডিত নেহরু যখন ফরওয়ার্ড ব্লককে ইটালীর অনুগ্রাহক বলে ঘোষণা করলেন তখন দেশের মধ্যে ফরওয়ার্ড ব্লকের বিরুদ্ধে একটা অসন্তোষ ঘনিয়ে উঠবে তাতে আর সন্দেহ কি? ওদিকে ফরওয়ার্ড ব্লকের তথা সুভাষচন্দ্রের কাজ হল কংগ্রেসের মধ্য থেকে ফ্যাসিবাদের যা কিছু উপকরণ আছে তাকে বিদূরিত করবার জন্য আন্দোলন করা। তাঁর মতে কংগ্রেসের কর্তৃপক্ষ গণতন্ত্রের পরিবর্তে ফ্যাসিবাদেরই অনুকরণ করে চলেছে। তিনি কংগ্রেস হাই কম্যাণ্ডকে হিটলারাইট বলে ঘোষণা করলেন। অথচ তাঁরই সৃষ্ট ফরওয়ার্ড ব্লকের নীতি হল এক নেতার নেতৃত্বে বিশ্বাস, এক পার্টির আধিপত্যে আস্থা, সামরিক শৃঙ্খলা ও যুব জাগরণ। এবং তিনি নিজের মুখে বললেন যে তাঁর নীতি ফ্যাসিজম নয় আবার সোশ্যালিজমও নয়—এ দুয়ের অভিনব মিশ্রণ!

 এই দুটি ঘোষণা—একদিকে কংগ্রেস থেকে ফ্যাসিজমের মূলোৎপাটন এবং অন্যদিকে ফ্যাসিজমের সঙ্গে মিশ্রণ করে দল গত নীতির উদ্বর্তন, পরস্পর বিরোধী মনে হলেও এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে যে কার্যতঃ তিনি ফ্যাসিষ্ট নন। তাঁর আজীবনের আদর্শ দেশকে এক অদ্ভুত চেতনায় জাগ্রত করে তোলা, দেশের জনসাধারণের মধ্যে সুপ্ত শক্তিকে সামরিক শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে পুনরায় উজ্জীবিত করে তোলা। এই আদর্শকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে গেলে এক নেতার—এক পার্টির কঠোর শাসন ও একাধিপত্যের প্রয়োজন। এবং সেই দিক থেকে বিচার করলে ফরওয়ার্ড ব্লকের মূলনীতির যথেষ্ট যাথার্থ্য আছে। এবং সেইজন্যেই বলি ফরওয়ার্ড ব্লকের উৎপত্তি সুভাষচন্দ্রের স্বরূপ বিকাশের শেষ অধ্যায়!

 অপরদিকে, যদি জনসাধারণকে জাগ্রত করে তোলাই উদ্দেশ্য হয় তাহলে গান্ধীবাদের স্থান কোথায়? বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহামানব মহাত্মা গান্ধী প্রবর্তিত অহিংসা মতবাদের কি কোনও মূল্য নেই? বিষয়ের গুরুত্বেব দিক থেকে বিবেচনা করলে এই আলোচনা আমাদের পক্ষে ধৃষ্টতা হলেও এই আলোচনার ব্যর্থ প্রচেষ্টারও একটা মূল্য আছে বলে মনে হয়। তাই এই যুক্তির অবতারণা।

 মহাত্মা গান্ধী এবং সুভাষচন্দ্রের জীবনের রাজনৈতিক আদর্শের তুলনা করতে গেলে—অন্তর্নিহিত মূল বৈষম্যের সঠিক ধারণা করতে গেলে সবচেয়ে সহজ উপায় তাঁদের ধর্মগত জীবনের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করা। এঁরা দুজনেই ধর্মে বিশ্বাস করেন। শুধু বিশ্বাস করা নয় ধর্মকেই এঁরা জীবনের মেরুদণ্ড বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। আজকের দিনে গান্ধীজী শুধু রাজনৈতিক নেতা নন তিনি ধর্মেরও উপদেষ্টা তেমনি সুভাষচন্দ্রের বৈপ্লবিক জীবনের পশ্চাতে আছে এই ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা। নির্জন কারাপ্রাচীরের পশ্চাতে কিংবা মুখর রণক্ষেত্রে সুভাষচন্দ্রেব প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যে ভগবানকে স্মরণ এবং ধ্যানধারণার একটা বিশিষ্ট ও নির্দিষ্ট স্থান আছে। এমন কি যে কেহ তাঁর সংস্পর্শে এসেছে, তার নিকট জীবনের আদর্শসম্বন্ধে উপদেশ নিতে এসেছে তিনি তাকে ধর্মের গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়ে ছেড়েছেন।

 একদিকে যেমন ধর্ম অন্য দিকে তেমনি ব্রহ্মচর্যের ওপর দুজনেই সমান জোর দিয়েছেন। আজীবন ব্রহ্মচারী থেকে মানুষ কি অমিত বীর্যের অধিকারী হতে পারে শুধু বক্তৃতার মধ্য দিয়ে নয়, নিজের জীবন দিয়ে সুভাষচন্দ্র তা প্রমাণ করে গেছেন। বিবাহের কথা দূরে থাক তিনি কোনদিন কোনও স্ত্রীলোককে মাতৃভাবে বা ভগিনীভাবে ছাড়া অন্য কোন ভাবে চিন্তা পর্যন্ত করেন নি। তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তিনি বিবাহ করেন নি কেন? তার উত্তবে তিনি বলেছিলেন, যে জীবনে তিনি বিবাহ করবার অবসর পান নি। এবং অন্যত্র এই একই প্রশ্নের উত্তরে একজন জাপানী উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে পরিহাস কবে বলেছিলেন, বহুদিন আগেই ভারতবর্ষের সঙ্গে আমার বিবাহ হয়ে গেছে। তিনি একবার লিখেছিলেন, কামজয়ের প্রধান উপায় সকল স্ত্রীলোকের মধ্যে মাতৃরূপ দেখা ও মাতৃভাব আরোপ করা এবং স্ত্রী-মূর্তিতে (যেমন দুর্গা কালী) ভগবানের চিন্তা করা। স্ত্রী-মূর্তিতে ভগবানের বা গুরুর চিন্তা করিলে মানুষ ক্রমশঃ সকল স্ত্রীলোকের মধ্যে ভগবানকে দেখিতে শিখে। সে অবস্থায় পৌঁছিলে মানুষ নিষ্কাম হইয়া যায়। এইজন্য মহাশক্তিকে রূপ দিতে গিয়া আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা স্ত্রী-মূর্তি কল্পনা করিয়াছিলেন। ব্যবহারিক জীবনে সকল স্ত্রীলোককে ‘মা’ বলিয়া ভাবিতে ভাবিতে মন ক্রমশঃ পবিত্র ও শুদ্ধ হইয়া যায়।

 অন্যত্র, চরিত্রগঠনের উপযোগিতা সম্বন্ধে লিখেছিলেন,—মানুষের দৈনন্দিন কাজ করেই সন্তুষ্ট বোধ করলে চলবে না। এই সব কাজ-কর্মের যে উদ্দেশ্য এবং আদর্শ অর্থাৎ আত্মবিকাশ সাধন সে কথা ভুললে চলবে না। কাজটাই চরম উদ্দেশ্য নয়, কাজের ভিতর দিয়ে চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হবে এবং জীবনের সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন করতে হবে মানুষকে অবশ্য নিজের ব্যক্তিত্ব ও প্রবৃত্তি অনুসারে একদিকে বৈশিষ্ট্য লাভ করতে হবে, কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যের মূলে (Specialisation) একটা সর্বাঙ্গীন বিকাশ চাই। যে ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন উন্নতি হয় নাই সে অন্তরে কখনও সুখী হতে পারে না; তার মনের মধ্যে সর্বদা একটা শূন্যতা বা অভাববোধ শেষ পর্যন্ত রয়ে যায়। এই সবার্ঙ্গীন বিকাশের জন্য চাই — (১) ব্যায়াম চর্চা (২) নিয়মিত পাঠ (৩) দৈনিক চিন্তা বা ধ্যান।

 এই দিক থেকে রামকৃষ্ণ পরমহংস এবং তদীয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ সুভাষচন্দ্রের গুরু। সুভাষচন্দ্রের জীবন স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ জীবন পরিকল্পনার চূড়ান্ত প্রতিফলন মাত্র। সুভাযচন্দ্র নিজে বলেছিলেন, রামকৃষ্ণ পরমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দ একই শক্তির দুটি অখণ্ড প্রকাশ মাত্র। আমার জীবনকালে স্বামীজী যদি জীবিত থাকতেন তাহলে আমি আগে গিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতাম।

 তাছাড়া যখনই কোন উপদেশ প্রার্থী তাঁর নিকট চরিত্রগঠনের উপায় সম্বন্ধে জানতে চেয়েছেন তখনই তিনি বলেছেন বিবেকানন্দের রচনাবলী দৈনিক পাঠ করতে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত। বিবেকানন্দের রচনাবলীর মধ্যে তিনি ‘বিবেকবাণী, ‘পত্রাবলী’ ও ‘বক্তৃতাবলীর’ ওপরই বিশেষ জোর দিতেন। দেশবন্ধু—তাঁর জীবনের রাজনৈতিক গুরুর মহাপ্রয়াণের পর দেশের মধ্যে যখন তীব্র দলাদলি চলেছে তখন তিনি মান্দালয় জেল থেকে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন—আমি ত’ জানিতাম সেবার আদর্শ এই— ‘দাও দাও ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল’। যে বাঙ্গালী এত শীঘ্র দেশবন্ধুর ত্যাগের কথা ভুলিয়াছে—সে যে কতদিনের আগেকার স্বামী বিবেকানন্দের ‘বীরবাণী’ ভুলিবে— ইহা আর বিচিত্র কি?

 হে হতভাগ্য বাঙ্গালী সুভাষচন্দ্রের এই ক্ষোভ মেটাবার দায়িত্ব কি তোমার এখনও আসে নি?

 বিবেকানন্দের শিষ্য সুভাষচন্দ্র যে মহাশক্তির উপাসক হবেন তাতে আর বিচিত্র কি? যিনি ভারতের শক্তিকে সুষুপ্তির তমসা থেকে মহান আলোকের পানে জাগ্রত করবার ব্রত নিয়েছিলেন তিনি নিজের আত্মার শক্তিকে জাগ্রত করবার জন্য মহাশক্তির আরাধনা করবেন সেইটেই স্বাভাবিক। তিনি লিখেছেন—জগতের মূল সত্য আদ্যাশক্তি, যাহা হইতে সৃষ্টি, স্থিতি প্রলয় অথবা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর—সেই আদ্যাশক্তিকে সাধক মাতৃরূপে আরাধনা ও পূজা করে থাকে। বাঙ্গালীর উপর তন্ত্রশাস্ত্রের প্রভাব খুব বেশী বলিয়া বাঙ্গালী জাতিহিসাবে মায়ের অনুরক্ত এবং ভগবানকে মায়ের রূপে আরাধনা করিতে ভালবাসে।·····বাঙ্গালী যে ভগবানকে— শুধু ভগবানকে কেন, বাঙ্গালা দেশকে এবং ভারতবর্ষকে মাতৃরূপে কল্পনা করিতে ভালবাসে—এ কথা সর্বজনবিদিত।

 অন্যত্র—

 ভয় জয় করার উপায় শক্তিসাধনা। দুর্গা কালী প্রভৃতি মূর্তি শক্তির রূপবিশেষ। শক্তির যে কোন রূপ মনে মনে কল্পনা করিয়া তাঁহার নিকট শক্তি প্রার্থনা করিলে এবং তাঁহার চরণে মনের দুর্বলতা ও মলিনতা বলিস্বরূপ প্রদান করিলে মানুষ শক্তি লাভ করিতে পারে। আমাদের মধ্যে অনন্ত শক্তি নিহিত রহিয়াছে, সেই শক্তির বোধন করিতে হইবে। পূজার উদ্দেশ্য—মনের মধ্যে শক্তির বোধন করা। প্রত্যহ শক্তিরূপ ধ্যান করিয়া শক্তিকে প্রার্থনা করিবে পঞ্চেন্দ্রিয় ও সকল রিপুকে তাঁহার চরণে নিবেদন করিবে। পঞ্চপ্রদীপ অর্থাৎ পঞ্চেন্দ্রিয়। এই পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে মায়ের পূজা হইয়া থাকে। আমাদের চক্ষু আছে তাই আমরা ধূপ গুগ্‌গুল্ প্রভৃতি সুগন্ধি জিনিষ দিয়া পূজা করি ইত্যাদি। বলির অর্থ রিপুর বলি— কারণ ছাগই কামের রূপবিশেষ।

 শাক্ত সুভাষচন্দ্র ও বৈষ্ণব গান্ধীজীর জীবনের আদর্শের মূল বৈষম্য এইখানেই। আসলে সুভাষচন্দ্র ও গান্ধীজীর একই বৃন্তের দুটি ফুল—একই শক্তির দুই অখণ্ড প্রকাশ।

 সুভাষচন্দ্রের রহস্যজনক অন্তর্ধানের পর ইংলণ্ডের নিউজ রিভিয়ু মহাত্মাজী ও সুভাষচন্দ্রকে তুলনা করে লিখেছিল— ‘Plump, amiable Subhas Chandra Bose, ex-president of the Congress, later Leader of the Swarajya (Self rule) Party, had a programme which was as different from the mild Mahatma as chalk from cheese.

 প্রধান প্রধান যুক্তি—

 (১) সুভাষচন্দ্রের দাবী বৃটনের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা (গান্ধীজী আপোষে রাজী আছেন)।

 (২) জাতীয় আন্দোলনের অবারিত গতি। গান্ধী স্থগিত রাখতে চেয়েছেন)।

 (৩) ব্যাপক শিল্পের প্রসার বা Progressive industrialisation (গান্ধীজী তাঁর প্রিয় খেয়াল বশতঃ এর বিরোধী এবং কুটিরশিল্পের প্রসারে যত্নবান)।

 এখানে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে সুভাষচন্দ্রই জাতীয় পরিকল্পনার বা national planningএর প্রবর্তক।


 সর্বশেষে গান্ধীসম্বন্ধে লিখিত সুভাষচন্দ্রের কয়েকটি কথার উল্লেখ করি— গান্ধীজীর মধ্যে এমন কিছু আছে যা ভারতীয় জনসাধারণকে আকৃষ্ট করে। অন্য দেশে জন্মালে তিনি হয়তো একেবারেই বাতিল হয়ে যেতেন··· যেখানেই তিনি যান দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতম ব্যক্তিও বুঝতে পারে যে তিনি ভারতের মাটিতেই গড়া—অস্থিতে এবং মজ্জাতে। তিনি যখন কথা বলেন তা এমন ভাষায় বলেন যার মর্ম তারা বুঝতে পারে—এবং সে ভাষা হার্বার্ট স্পেন্সার বা এডমণ্ড বার্কের নয়— যেমন ধরুন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ব্যবহার করতেন—সে ভাষা ভগবদ্‌গীতা এবং রামায়ণের ভাষা।

 আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের আদর্শ বা ফিলজফি সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান সঞ্চয় করা। কিন্তু আলোচনার খাতিরে আমব। বহুদূরে এসে পৌঁছে গেছি। এখন পুনরায় আমাদের আসলের বক্তব্যের দিকে ফিরে যাওয়া যাক। সুভাষচন্দ্র নিজে ফরওয়ার্ড ব্লকের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তারই সারাংশটুকুর উল্লেখ করলেই মনে হয় আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। যথা—

 ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতের মৃত্তিকা-উদ্ভূত এক আন্দোলনের প্রতীক। কংগ্রেসের উন্নতি ও শক্তিবৃদ্ধি আভ্যন্তরীণ তাগিদের ফল; এই আভ্যন্তরীণ তাগিদের ফলেই ফরওয়ার্ড ব্লকের জন্ম হয়েছে। কোন ব্যক্তিগত ব্যাপার কিংবা আকস্মিক ঘটনার ফলে ভারতীয় বাজনীতিতে এই নূতন বস্তুর সৃষ্টি হয় নি। কংগ্রেস তার বিবর্তনের পথে নূতন অবস্থায় প্রবেশ করবে বলে ফরওয়ার্ড ব্লকের আবির্ভাব হয়েছে।··· প্রগতি একপথগামী কিংবা সর্বদা শান্তিপূর্ণ নয়। অনেক সময় বিরোধের মধ্য দিয়েই প্রগতি ঘটে!

 জীবিত কিংবা প্রগতিশীল প্রত্যেক আন্দোলনেই একটা অদৃশ্য বামশাখা বা বিরোধী দল থাকে। সময় হলে এই অদৃশ্য বামশাখা সুস্পষ্ট হয় এবং তার সাহায্যে আন্দোলনের আরও পুষ্টিলাভ এবং উন্নতি ঘটে। অনেক সময় এরূপ ঘটে যে, বামশাখা দক্ষিণ শাখার সঙ্গে আপোস ও সহযোগিতা করে শক্তিসঞ্চয় এবং প্রভাব বিস্তার করে। ভিন্নরূপ অবস্থায় তীব্র মতভেদের সৃষ্টি অপরিহার্য হতে পারে, ঐ মতভেদ সাময়িক ভাবে ব্যথাদায়ক হলেও প্রকৃতপক্ষে প্রগতির সহায়ক। কোনও প্রতিষ্ঠানের উন্নতির পক্ষে বামশাখার পুষ্টি ও আবির্ভাব একান্ত আবশ্যক।···১৯২০ সালে গান্ধীপন্থীরা কংগ্রেসে বামপন্থী ছিলেন; তার মানে এ নয় যে বর্তমান সময়েও তাঁরা বামপন্থী। ইতিহাসের পুনরাবর্তনক্রমে নিশ্চয়ই নতুন এক বামশাখার উদ্ভব হয়ে পরিণামে পূর্বের বামপন্থীদের বিতাড়িত করে দেবে।

 কোলকাতা কংগ্রেসে দেখা গেল দক্ষিণপন্থীরা বামপন্থীদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অসম্মত হয়েছেন। এখন ঐক্যের খাতিরে আমরা বামপন্থীরা যদি তাঁদের নিকট বশ্যতা স্বীকার করি, তবে সেটা কি সঙ্গত হবে? যদি তাঁদের কোন সক্রিয় কর্মপন্থা থাকতো তবে এইরূপ করা চলতো। কিন্তু গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আমার যে সব পত্র-বিনিময় হয়েছে দুর্ভাগ্যক্রমে তার থেকে স্পষ্ট দেখা গেছে যে তিনি আর আসন্ন সংগ্রামের কথা চিন্তা করছেন না। মন্ত্রিমণ্ডলী এবং তাঁদের যে সমস্ত পরিচালক কংগ্রেসের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে আছেন, তাঁরাও সংগ্রামের কথা চিন্তা করেন না। এই রকম অবস্থায় দক্ষিণপন্থীদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে বাইরে ঐক্যের ঠাট বজায় রাখলে প্রকৃত প্রস্তাবে কংগ্রেসের ভিতরে গতিহীনতা এবং সংস্কার বিমুখতাকে চিরস্থায়ী করা হবে। আমরা এরকম করতে পারি ন!—আমাদের এরকম করা উচিতও নয়। সুতরাং বর্তমানে বামপন্থীদের পক্ষে দক্ষিণপন্থীদের থেকে পৃথক হয়ে নিজেদের শক্তি সংহত করবার সময় এসেছে। এই কাজটি সমাধা হলেই বামপন্থীরা কংগ্রেসের ভিতর সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে জাতীয় কংগ্রেসের নামে পুনরায় স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবৃত্ত হতে পারবেন। এইটেই আজ বামপন্থীদের কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনের জন্যই ফরওয়ার্ড ব্লকের সৃষ্টি হয়েছে।

 ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসের পর থেকে সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। এই বছরেই আগষ্ট মাসে কংগ্রেসের কর্তৃপক্ষ এই মর্মে এক বিবৃতি প্রকাশ করেন—

 কংগ্রেস কার্যকরী সমিতি এই সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন যে তাঁর বিধি বহির্গত আচরণের জন্য ১৯৩৯ সালের আগষ্ট মাস থেকে তিন বর্ষকাল পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র বসু বঙ্গীয় কংগ্রেস সমিতির সভাপতি বা যে কোন নির্বাচিত কংগ্রেস সমিতির সভ্য হিসাবে অনুপযুক্ত বিবেচিত হলেন।

 ওয়ার্ধা থেকে এই সংবাদ যখন তাঁর কাছে পৌঁছলো শোনা যায় তিনি বলেছিলেন—আর কিছু নেই?

 সত্যিই আরও কিছু ছিল।

 দক্ষিণপন্থী প্রভাবান্বিত কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ তাঁকে যে চোখেই দেখুক না কেন বাঙ্গালী কোনদিন তাঁকে দেশের শীর্ষস্থান থেকে একচুলও নড়াতে পারে নি। তাই কংগ্রেস অবৈধ বলে ঘোষণা করলেও বাঙ্গলা দেশ সুভাষচন্দ্রকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির সভাপতিরূপে বরণ করে নিলে। ফলে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি অবৈধ বলে ঘোষিত হল কংগ্রেস হাই কমাণ্ডের তরফ থেকে এবং শরৎচন্দ্র বসু তাঁর সঙ্গীগণ সহ কংগ্রেস পার্লামেণ্টারী পাটি থেকে বহিষ্কৃত হলেন।

 ইতিমধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় কংগ্রেস ও তার বৈদেশিক নীতির কিছুটা সংস্কার মানসে ওয়ার্কিং কমিটির এক অধিবেশনে সুভাষচন্দ্রকে বিশেষ অতিথি হিসাবে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র সেখানে গিয়ে ব্যর্থ মনোরথে সভা ত্যাগ করে চলে এলেন। তাঁর আশা ছিল এই সুযোগে কংগ্রেস বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে চরম আঘাত হেনে একবারে চিরতরে বিধ্বস্ত করে দেবে। কিন্তু তাঁর মত এই অধিবেশনে গ্রাহ্য হল না। সদ্য চীন প্রত্যাগত জওহরলাল নেহরুই জয়ী হলেন।

 সুভষচন্দ্র সভা ত্যাগ করে এসেছিলেন বলে অনেকে তাঁর বিরুদ্ধ সমালোচনা করে। কিন্তু যারা বিরুদ্ধ সমালোচনা করে তারা জানে না নিজের মতবাদের ওপর সুভাষচন্দ্রের নিষ্ঠা কত গভীর। শুধু বাহ্যিক ও রাজনৈতিক জীবনে নয় ব্যক্তিগত জীবনেব তুচ্ছ ঘটনার মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্যটুকু সহজেই চোখে পড়ে। নিজের মনের জোর এবং মতের জোর অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য তিনি জীবনে ধূমপান করেন নি।

 ১৯৪০ সাল কর্মবীর সুভাষচন্দ্রের জীবনের একটি কর্মবহুল অধ্যায়। এই বছর জানুয়ারী মাসে তিনি কোলকাতায় কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে একখানি বাড়ী নির্মাণ করবার পরিকল্পনা করেন। বিরাট এক জনতার সম্মুখে চিত্তরঞ্জন এভেনিউতে রবীন্দ্রনাথ এই সৌধের ভিত্তিস্থাপনা করেন এবং নাম দেন মহাজাতি সদন। পরে অবশ্য পুলিশ এই বাড়ীর যাবতীয় অর্থভাণ্ডার এবং দলিল পত্র বাজেয়াপ্ত করে নেয়। তারপর শরৎ চন্দ্র বসু এই নিয়ে মামলা সুরু করেন সরকারের বিরুদ্ধে। যাই হোক এই মহাজাতি সদন এখনও অসম্পূর্ণ অবস্থায় বাঙ্গালীর আগামী দিনের সমস্ত আশা ভরসার প্রতীক স্বরূপ দাঁড়িয়ে আছে।

 এই সময় তিনি কিছুদিনের জন্য যুক্তপ্রদেশ শফর করে বেড়ান। এবং মার্চ মাসে কংগ্রেস অধিবেশনের পাশাপাশি রামগড়ে আপোষ বিরোধী মহাসম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। এপ্রিল মাসে তিনি কর্পোরেশনের অল্ডারম্যান নির্বাচিত হন এবং কর্পোরেশনের মধ্যে মুশ্লিম লীগের সঙ্গে একটা মীমাংসায় এসে পৌঁছান। মাসে পর পর ২৪ পরগণা জেলা যুব সম্মেলনে এবং ঢাকায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগদান করেন। জুন মাসে নাগপুরে নিখিল ভারত ফরওয়ার্ড্ ব্লক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। এবং ঐ মাসে ২০ তারিখে ওয়ার্ধায় মহাত্মাজীর সঙ্গে এবং ২২ তাবিথে জিন্না ও সাভারকারের সঙ্গে দেখা করেন। ২৯শে জুন থেকে তিনি কোলকাতাস্থিত হলওয়েল মনুমেণ্ট অপসারণ নিয়ে তুমুল আন্দোলন শুরু করেন। দলে দলে ছাত্র হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এই আন্দোলনে যোগ দেয় এবং শেষ পর্যন্ত সমগ্র বাঙ্গালী জাতিব মিথ্যা অপবাদের স্তম্ভ স্বরূপ হলওয়েল মনুমেণ্ট অপসারিত হয়। জুলাই মাসের ২ তারিখে এপ্রিল মাসে মহম্মদ আলি পার্কে প্রদত্ত এক বক্তৃতা ও ফরওয়ার্ড ব্লক পত্রিকায় (ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠনের সঙ্গে সঙ্গে এই পত্রিকার তিনি সম্পাদনা শুরু করেন) প্রকাশিত ‘The Day of Reckoning’ নামক এক প্রবন্ধের অজুহাতে ভারতরক্ষা বিধানে তিনি গ্রেপ্তার হন। কারাবাসের মধ্যেই অক্টোবর মাসে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা পরিষদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তারপর নভেম্বর ২৯ তারিখ থেকে তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন, যার ফলে কর্তৃপক্ষ ডিসেম্বর ৫ তারিখে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। অনশন-ধর্মঘট শুরু করবার আগে বাংলার লাট এবং মন্ত্রীমণ্ডলীর নিকট একখানি স্মরণীয় পত্র প্রেরণ করেন। সেই পত্রে তিনি লিখেছিলেন—

 আমার নিজের সম্বন্ধে আমার যা কিছু বক্তব্য এখানে বলবো এবং কেন আমার জীবনের চরম পথে পা বাড়াচ্ছি তারও যুক্তিগুলো কাগজে কলমে একে একে প্রকাশ করবো।

 আপনাদের কাছে সুব্যবহার প্রত্যাশা করবার আর কোন আশা নাই। তাই আমি দুটি অনুরোধ জানাচ্ছি—এদের মধ্যে দ্বিতীয়টি পত্রের শেষে জানানো হবে। আমার প্রথম অনুরোধ এই যে দয়া করে সরকারের দপ্তরে এই পত্রখানি রেখে দেবেন যাতে আপনাদের পরে আমার দেশবাসিগণের মধ্যে যাঁরা স্থলাভিষিক্ত হবেন তাঁরা এ পত্র পড়তে পারেন।

 আমার প্রতি প্রকাশ্য অবৈধ ও অন্যায় ব্যবহার করা হয়েছে। এই অদ্ভুত ব্যবহারের একটি মাত্র ব্যাখ্যা আমার মনে লেগেছে যে সরকার আমার সঙ্গে স্পষ্টতই কোন দুর্বোধ্য কারণে শত্রুর মত প্রতিহিংসামূলক ব্যবহার করছেন।

 আমার কি বর্তমান অবস্থা নীরবে সহ্য করে যা ঘটে তা গ্রহণ করবার জনে বসে থাকা উচিত— না যা আমার কাছে অসঙ্গত, অন্যায় এবং অবৈধ তাব বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে উঠবো? অনেক পর্যালোচনার পর আমি স্থির করেছি যে এই অবস্থার নিকট আত্মসমর্পনের প্রশ্ন অবান্তর। অন্যায়কে চলতে দেওয়ার থেকে অন্যায়কে মেনে নেওয়া আরও বেশী পাপ। সুতরাং বিদ্রোহ আমি করবোই।

 বর্তমান সময়ে যখন চারিদিকে প্রতিবাদ চলছে তখন সাধারণ পথ শেষ হয়ে গেছে। একটিমাত্র পথ শুধু বাকি—বন্দীব হাতে শেষ অস্ত্র—অনশন!

 বর্তমান অবস্থায় জীবন আমার কাছে দুঃসহ। অন্যায় ও অধর্মের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জীবনের পরমায়ু ক্রয় করে নেওয়া আমার প্রতিটি অণু পরমাণুর বিরুদ্ধে। আমি এই মুল্য দেওয়ার পরিবর্তে জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। সরকার জোর করে আমায় জেলের মধ্যে আবদ্ধ কবে রাখতে চান তাহলে তার জবাবে আমি বলবো—আমায় ছেড়ে দাও আর না হয় আমি কিছুতেই বাঁচবো না— আমি বাঁচবো কি মরবো সেটা সম্পূর্ণ আমার হাতে।

 এই মর জগতে সবই ধ্বংস হবে—কেবল আদর্শ, কল্পনা আর স্বপ্ন ধ্বংস হয় না। একটা আদর্শের জন্য একজন মানুষের মৃত্যু হতে পারে—কিন্তু তার মৃত্যুর পর সেই আদর্শ হাজার হাজার লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।

 আদর্শের জন্য বেঁচে থাকা এবং মৃত্যু বরণ করার চেয়ে আরও শান্তির বিষয় আর কি আছে?... এর থেকেই বলা যায় যে ত্যাগ ও সহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে মানুষ কখনও হারায় না। এই জগতে যদি সে কিছু হাবায় তাহলে তার পরিবর্তে সে অমর জীবনের অধিকারী হতে পারবে।

 এই হল আত্মার কৌশল। দেশ যাতে বাঁচতে পারে তার জন্যে এক একজন মানুষ প্রাণ দেবে। ভারতবর্ষ যাতে বাঁচতে পারে এবং স্বাধীনতা ও গৌরবের অধিকারী হতে পারে তার জন্য আজ আমি প্রাণ বিসর্জন দোব।

 আমি আমার দেশবাসিদের বলছি—ভুলো না যে পরাধীন থাকা সবচেয়ে বড় অভিশাপ। অন্যায় এবং অধর্মের সঙ্গে আপোষ —তার থেকে বড় পাপ আর নেই।

 আজকের সরকারকে আমি বলছি তোমার সাম্প্রদায়িক এবং অন্যায় পথের উন্মত্ততা এখনও থামাও। তোমার ফিরবার সময় এখনও আছে। ব্যুমেবাং এর আশ্রয় নিয়ো না যেটা তোমার ওপরই ফিরে আসবে।

 আমার শেষ হয়েছে। আমার দ্বিতীয় ও শেষ অনুরোধ আমার শান্তিপূর্ণ শেষ জীবনে আপনারা জোর করে বাধা দেবেন না। ম্যাকসুইনী, যতীন দাস, মহাত্মাগান্ধী ও ১৯২৬ সালে আমাদের বেলায় সরকার অনশন ভঙ্গ করতে চেষ্টা করেন নি। আমি আশা করি এবারেও তাঁরা তাই করবেন। যদি না করেন তাহলে আমাকে জোর করে খাওয়াবার সামান্যতম চেষ্টাও আমার পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিহত হবে— যদিও তার ফলাফল আরও বিষময় এবং আরও ভয়ানক হতে পারে—যা হোত না। ২০শে নভেম্বর ১৯৪০ থেকে আমি অনশন আরম্ভ করবো।

* * * * *

 এর পর জীবন নয়, শুধু স্বপ্ন