নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ/কংগ্রেসের সিংহাসনে

কংগ্রেসের সিংহাসনে

 আগেই দেখা গেছে যে সুভাষবাবু যখন ইউরোপে ছিলেন তখন ধীরে ধীরে গান্ধীজীর প্রভাব আবার বিস্তার লাভ করছে। অবশ্য গান্ধীজী প্রত্যক্ষভাবে কংগ্রেস থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এবং কার্যতঃ কংগ্রেসের কর্ণধারস্বরূপ হযে দাড়িয়েছেন আজাদ, রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও প্যাটেল। জন্‌ গান্থার এঁদের নাম দিয়েছিলেন—Zonal chieftains. এই তিনজন নেতা কংগ্রেস পার্লামেণ্টারী বোর্ডের কার্যভার তিনভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন। তাছাড়া কংগ্রেস তখন প্রাদেশিক মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেছে এবং যারা প্রধান মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করছেন তারা সকলেই গান্ধীবাদের ওপর বিশ্বাস করেন। এমন কি গান্ধীজী আদেশ দিলে তাঁরা তৎক্ষণাৎ মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছেন। এদিকে সোশ্যালিষ্ট দলও তাদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে কংগ্রেস হাই কমাণ্ডের সঙ্গে যোগ দিয়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করতে চেষ্টা করছে। তার কারণ সুভাষবাবুর অনুপস্থিতি। জওহরলাল ইতিমধ্যেই গান্ধীজীর কাছে আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছেন, জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং নরেন্দ্র দত্ত কাজ করলেও সমস্ত ভাবতবর্ষে একটা দল চালাবার মত সুযোগ সুবিধা অর্জন করতে পারেন নি। তাই সুভাষবাবু দ্বিতীয় বার ইউরোপ যাবার আগে যে কয়দিন এখানে ছিলেন তার মধ্যেই এই সোশ্যালিষ্ট দলের নেতা হয়ে দাঁড়ালেন। অবশ্য সোশ্যালিষ্ট দলের মধ্যে যে পরিবর্তনের পূর্বাভাষ দেখা যাচ্ছিল তিনি সেটা পছন্দ করতে পারেন নি। তাই তাঁর কর্মপন্থার দুটো বিভিন্ন দিক স্পষ্ট হয়ে উঠলো! এক: কংগ্রেস হাই-কম্যাণ্ড যাতে বৃটিশ প্রস্তাবিত ফেডারেশনে সম্মতি না দিয়ে বসে এবং দুই: সমস্ত বামপন্থীদের পক্ষ থেকে কংগ্রেসের অধীনে সমস্ত কিষাণ—মজুরদের স্বার্থ রক্ষা করা।

 এদিকে আন্দামানের রাজবন্দীদের অনশন-ধর্মঘট আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল এই সময়ে। জনসাধারণ, আশা করছিল কংগ্রেস এইবার বিরাট এক আন্দোলন চালিয়ে গভর্ণমেণ্টকে হার মানাতে বাধ্য করবে। পরিণামে হয়ত তাই হত কিন্তু কেন জানি না কংগ্রেস ব্যপারটা অত্যন্ত দেরী করে ফেলছিল। তাতে জনসাধারণ যে ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই সময়ে তাই সুভাষবাবুর মত বিপ্লবী নেতার প্রয়োজন খুবই অনুভূত হয়েছিল। এবং সুভাষবাবু এই সময়ে অত্যন্ত সহজে এবং অত্যন্ত বেশীরকমের জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন।

 কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্যে তাঁকে আবার ইউরোপ যেতে হল কিছুদিনের জন্য, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। এবং ইউরোপে গিয়ে তিনি আবার ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবীর প্রশ্ন নিয়ে বক্তৃতা ও প্রচারকার্য শুরু করে দিলেন। তখন কংগ্রেসের এই ত্রয়ী নেতার দল ভাল ভাবেই উপলব্ধি করতে পারলেন যে আর তাঁকে অবহেলা করা যাবে না। যে কোন উপায়েই হোক তাঁর সঙ্গে মিটমাট করে ফেলা দরকার। কংগ্রেসের মনোভাবের বিরুদ্ধে এই তীব্র বক্তৃতা, এ সমস্তই একেবারে চেপে গিয়ে তাঁরা স্বেচ্ছায় সুভাষবাবুকে কংগ্রেসের শ্রেষ্ঠ সম্মান দেবার জন্যে আমন্ত্রণ পাঠালেন। প্রস্তাবিত আজাদ, জওহরলাল ও গফুর খাঁর নাম বর্জন করে সুভাষবাবুকেই ১৯৩৮ সালের কংগ্রেস সভাপতির পদ দেওয়া হল! তাঁর স্বাস্থ্য খুব ভাল না থাকালেও ১৪ই জানুয়ারী ১৯৩৮ সালে তিনি বিমানপথে দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। করাচী বিমান ঘাঁটিতে তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জানানো হল। মহাত্মাজী থেকে আরম্ভ করে সমস্ত নেতা তাঁকে অভিনন্দিত করলেন।

 তাপ্তী নদীর ধারে হরিপুরায় নব নির্মিত কংগ্রেস নগর—বিঠলনগরে কংগ্রেসের অধিবেশন শুরু হল। কংগ্রেসের এই একান্নতম অধিবেশনে কংগ্রেস অধিবেশন মণ্ডপে ৫১টি তোরণ তৈরী হল, মণ্ডপের উন্নত-শীর্ষে উড়তে লাগলো ৫১টি জাতীয় পতাকা, ৫১টি জাতীয় সঙ্গীতে মুখর হয়ে উঠলো আকাশ বাতাস, আর ৫১টি বলদবাহিত রথে এলেন ভারতের মুকুটহীন সম্রাট দেশগৌরব সুভাষচন্দ্র বসু। আর এই বিরাট শোভাযাত্রার সম্মুখে রইলেন সুভাষচন্দ্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দী স্যার বল্লভভাই প্যাটেল। সব জড়িয়ে সে এক অপূর্ব পরিবেশ! বিশেষ করে সভাপতির শোভাযাত্রা নাকি এতই অপূর্ব হয়েছিল যে অনেকের মতে কংগ্রেসের ইতিহাসে এত বড় শোভাযাত্রা সে-পর্যন্ত হয় নি।

 বিঠল নগরের চারদিকে নেতাদের কুটির। বিশেষ করে সুভাষচন্দ্র ও জওহরলালজীর কুঞ্জের চারপাশে দর্শনব্যাকুল তরুণ সম্প্রদায়ের ভীড়। তাছাড়া প্রত্যেক ঘরে ঘরে নেতাদের, বিভিন্ন প্রদেশের প্রতিনিধিদের, মন্ত্রিদের এবং দর্শক ও সাংবাদিকদের, ঘরোয়া বৈঠক বসে গেছে। নানারকম আলোচনা চলছে। এবারে কংগ্রেস অধিবেশন সত্যিই নানা দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমতঃ বামপন্থী নেতা সুভাষচন্দ্র এবার সর্ববাদি সম্মত সভাপতি। তার ওপর ইউরোপের যুদ্ধ যেরকম দ্রুত ঘনিয়ে আসছে তার প্রভাব সম্বন্ধেও একটা কিছু সঠিক ধারণা হওয়া প্রযোজন। সর্বোপরি রাজবন্দীদের মুক্তি প্রশ্ন নিয়ে বিহার এবং যুক্তপ্রদেশের শ্রীকৃষ্ণ সিংহ ও গোবিন্দ বল্লভ পন্থের মন্ত্রীমণ্ডলী যে পদত্যাগ করেছেন সেটাও একটা বড় বিবেচ্য বিষয়। বামপন্থীদল চেষ্টা করছে যাতে উক্ত দুই নেতাদের মত অন্যান্য প্রদেশের প্রধান মন্ত্রীরাও অনুরূপ পন্থা অবলম্বন করেন এবং সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ তোলেন।

 সুভাষচন্দ্র ১৩ই ফেব্রুয়ারী এসে পৌঁছেছিলেন। ১৪ই তারিখে ওয়ার্কিং কমিটি বা কার্যকরী সমিতির অধিবেশন বসলো। ১৬ তারিখে বিদায়ী সভাপতি জওহরলাল নেহরু সুভাষবাবুর হস্তে কংগ্রেসের সভাপতিত্বের গুরুদায়িত্ব তুলে দিলেন। সেদিন কি কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল যে এক বছর পরেই এই একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিককে অপমান করে বের করে দিতে হবে ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতীয় প্রতিষ্ঠান—কংগ্রেসের থেকে?

 এবং তারপর এই লাঞ্ছিত সূর্য কোন মহাদুর্যোগের সাগরপার থেকে সমস্ত জগতের সামনে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ও একমাত্র নেতারূপে আবার ভাস্বর হয়ে উঠবে। কোন দলগত সভাপতিত্বের হাত বদল নয়—কোন মিটিং করে নেতৃত্ব গ্রহণ নয়—প্রতি ভারতবাসীর মনে স্বতঃস্ফূর্ত চেতনার মত একটি নাম উজ্জ্বল হয়ে উঠবে—নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু! তুচ্ছ ৫১ নয় — শুধু ৫১ কেন লক্ষ বলদ-বাহিত রথেও নয়—কোটি কোটি ভারতবাসীর জাগ্রত দেশপ্রেমের উচ্ছসিত ফল্গুধারায় বাহিত—প্রবাহিত হয়ে ফিরবে এই নাম হিমালয় থেকে কুমারীকা পর্যন্ত!

 বিপুল জয়ধ্বনির মধ্যে দাঁড়িয়ে ১৯শে ফেব্রুয়ারী সুভাষবাবু বিঠলনগরের বুকে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন। দিকে দিকে জয়ধ্বনি উঠলো — ‘বঙ্গ-কেশরী কি—জয়’। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি দরবার গোপাল দাস এবং সর্দার প্যাটেল সুভাষবাবুকে অভ্যর্থনা জানালেন। গোপাল দাস এই মর্মে খুব সুন্দর একটি বক্তৃতা দিয়ে সুভাষবাবুর অসীম ত্যাগ ও অসাধারণ দেশপ্রেমের ভূয়সী প্রশংসা করলেন।

 সভাপতি হিসেবে সুভাষবাবুব সেদিনকার অভিভাষণ বিশেষ আকর্ষণীয় হয়েছিল। তাঁর বক্তৃতার মধ্যে তাঁর নতুন মতবাদের কোন ইঙ্গিত ছিল না এমন কি গান্ধীবাদের পরিবর্তে কোন নতুন দলের উদ্ভবের কোনও সম্ভাবনার কথাও তিনি বলেন নি। কেন না তিনি অনুভব করেছিলেন যে কংগ্রেসের মধ্যে স্পষ্টতঃ কোন রকম দলাদলি করার সময় এখন নয়। তিনি যখন কংগ্রেসের সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করেছেন তখন ধীরে ধীরে তাঁর মতবাদকে কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করাই যুক্তিযুক্ত, মৌখিক ঝগড়া-বিবাদের মধ্য দিয়ে নয়।

 প্রথমেই ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদকে নিন্দা করে তিনি তাঁর বক্তৃতার উদ্বোধন করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, ইংরাজের এই বিরাট সাম্রাজ্য ধ্বংসের মুখে চলেছে। সমগ্র ইংরাজ জাতির মুক্তির পথ সমাজতন্ত্রবাদের ওপর নির্ভর করছে এবং সমাজতন্ত্রবাদ গ্রহণ করতে গেলে সমস্ত সাম্রাজ্যকে স্বাধীনতা দান করতে হবে। ইংরাজের ভবিষ্যৎ, ইতিহাসের অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী জাতিসমূহের ভবিষ্যতেরই পুনরাবৃত্তি মাত্র। পরিত্রাণের পথ নেই। ভারতকেও তার জগতের মধ্যে প্রকৃত আসন গ্রহণ করবার ক্ষমতা দিতে হবে। সে ক্ষমতা বর্তমানের অবস্থার মধ্যে সম্ভব নয়। সে ক্ষমতা আমাদের অর্জন করে নিতে হবে। ভারতের বিপুল জনসাধারণের মধ্যে বিরাট এই জাগ্রত অনুপ্রেরণা ও দেশপ্রেমকে সুনির্দিষ্ট পথের মধ্য দিয়ে পরিচালিত করতে হবে। কিন্তু আমাদেব কি এর জন্যে প্রকৃত-শিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আছে? তাদের উপযুক্ত ভাবে শিক্ষিত করে তোলবার মত নেতা আছে কি? কেন নেই? কেন আমাদের তরুণ নেতাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা নেই? এই ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। আধুনিক জগতের রাজনৈতিক দলের যে সমস্ত প্রয়োজন আছে আমাদেরও সেই সব ব্যবস্থা থাকা দরকার। জগতের সমস্ত দেশে তরুণদের এই জাতীয় শিক্ষা দেওয়ার যে ব্যবস্থা আছে আমাদেরও সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সেদিক দিয়ে জার্মাণীর কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি।

 ইউরোপে থাকতে তিনি একটি মাত্র দলের সার্বভৌম কর্তৃত্বের ওপর জোর দিতেন কিন্তু হরিপুরায় তিনি ভিন্ন মত প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, স্বাধীনত লাভ করবার পরও কংগ্রেসের অস্তিত্বের যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। তখন কংগ্রেসকে শাসনভার এবং সংস্কার ও পুনর্গঠনের ভার গ্রহণ করতে হবে। যুদ্ধোত্তর ইউরোপে আমরা দেখছি যে, যে দেশে রাজনৈতিক দল বা পার্টি দেশের শাসনভা ও পুনর্গঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে সে দেশেই শৃঙ্খলা এবং ক্রমোন্নতি দেখ যাচ্ছে। তবে এইরকম একটি দলের কর্তৃত্বের ফলে দেশের মধ্যে একটি মাত্র দলেরই একাধিপত্য গড়ে ওঠে যেমন জার্মানীতে নাৎসী দলের ব্যাপারে দেখ যাচ্ছে। কিন্তু আমার মতে একটি দলের উপর দায়িত্ব থাকলেও অন্যান্য দলেরও অস্তিত্বের সমান দাবী আছে, তাহলেই প্রকৃত গণতন্ত্রের ভিত্তিতে কাজ চালানো যেতে পারে। উপরন্তু গণতন্ত্রের ফলে দেশের সর্বনিম্ন সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে নেতৃনির্বাচন চলতে পারে সমাজের শুধু উপরের স্তর থেকে নয়।······কংগ্রেসের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক দলের উদ্ভব নিয়ে খুব বাদানুবাদ চলছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই দলের সভ্য নই তবে একথা বলা ভাল যে গোড়া থেকেই এর মূল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমার সমর্থন আছে। আপনারা একে কোন দল বলুন, পার্টি বলুন, লীগ বলুন, আর গ্রুপই বলুন আমার মতে সমস্ত বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কংগ্রেসের পতাকা তলে কংগ্রেসের অনুশাসনের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাজ করা উচিৎ—সে অধিকার তাদের আছে।······ সমাজতন্ত্রবাদই আমাদের সম্মুখ সমস্যা নয়—দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশকে সমাজতন্ত্রবাদ অনুযায়ী পরিচালনা করবার জন্যে এখন থেকেই খানিকটা প্রচারকার্য করা মাত্র।

 দেখা যাচ্ছে সোশ্যালিষ্ট দলকেও তিনি সমর্থন করছেন অথচ কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়। তাঁর নিজস্ব মতবাদ একটি মাত্র দলের কর্তৃত্ব সম্বন্ধেও যেমন তিনি জোর দেন নি তেমনি আবার কংগ্রেসের মধ্যে বহু দলের ঐক্যের ব্যাপারেও তিনি উদাসীন ন’ন। এমন কি সর্বশেষে তিনি গান্ধীজীকে যেভাবে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানালেন তাতে সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। পরিশেষে তিনি বললেন, ভারতবর্ষে এখনও বহুদিন গান্ধীজীর প্রয়োজন আছে। আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ রাখবার জন্যে তাঁকে প্রয়োজন। আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে সমস্ত হিংসা ও বিবাদ থেকে মুক্ত রাখবার জন্যে তাঁকে আমাদের প্রয়োজন। ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধের জন্যে তাঁকে আমরা চাই। সর্বোপরি সমস্ত মানবজাতির কল্যাণের জন্য তাঁকে প্রয়োজন। আমাদের সংগ্রাম শুধু বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নয় সমগ্র জগতের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে।·····ভারতের স্বাধীনতা সমস্ত মানবজাতির রক্ষা কবচ! বন্দেমাতরম্!

 দারুণ উৎসাহ উত্তেজনার মধ্য দিয়ে হরিপুরার কংগ্রেস শেষ হয়ে গেল। সমস্ত কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে নতুন জীবনের স্পন্দন জেগে উঠলো তাতে সকলেই বিশেষ উৎসাহিত বোধ করতে লাগলেন। রাজবন্দীরা মুক্তি পাওয়ায় বিহার এবং যুক্ত প্রদেশের মন্ত্রীরা আবার কার্যভার গ্রহণ করলেন। সুভাষবাবু তাঁর অসুস্থ দেহ নিয়েও চারিদিকে বক্তৃতা দিয়ে কংগ্রেসের ভাব প্রচার করে বেড়াতে লাগলেন। কিন্তু সেই পার্লামেণ্টারী বোর্ডের ক্ষমতা একেবারেই খর্ব হয়ে যায় নি। তাঁরা তখনও উগ্রপন্থী নেতাদের কর্তৃত্ব সহ্য করতে পারছিলেন না। তাই গোঁড়া জাতীয়তাবাদী নরীম্যান ও খারের সঙ্গে তাঁদের মতানৈক্য শুরু হল। আগে হলে সুভাষবাবু এঁদের সমর্থন করে কংগ্রেস হাই কমাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ঘোষণা করতেন। কিন্তু এখন তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ—যে কোন উপায়ে একটা ঘরোয়া আপোষের চেষ্টা— অবলম্বন করেছেন, তাই তিনি কিছু বলতে পারলেন না। নরীম্যান ও খারে কংগ্রেসের অফিস থেকে বিতাড়িত হলেন। কিন্তু এই সামান্য ঘটনা কতবড় একটা দুর্যোগের পূর্বসূচনার ইঙ্গিত দিয়েছিল তখন কেউ তা সন্দেহ করতে পারে নি।

 হরিপুরার পর ত্রিপুবীর অধিবেশন অবিশ্বাস্য হলেও নিষ্ঠুর রকমের সত্য!

 এতদিন দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী দলের মধ্যে যে মতানৈক্য চলছিল সেটা সাধারণের মধ্যে খুব বেশী প্রকাশ্য হয়ে ওঠে নি। উপরন্তু সুভাষবাবুর সভাপতিত্বের সময়ে তিনি মিটমাট করবার যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তার ফলে দুই দলের সম্বন্ধ অনেকটা সহজ হয়ে এসেছিল। তবে একটা প্রশ্ন নিয়ে মনে মনে খুবই মতদ্বৈধ চলছিল তখনও, সেটা হল ফেডারেশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের সমর্থন নিয়ে। সুভাষবাবু বরাবরই উগ্রপন্থী, তিনি কোন দিক দিয়েই বৃটিশের সঙ্গে সামান্যতম আপোষেরও পক্ষপাতী ন’ন। এদিকে দক্ষিণ পন্থী আপাততঃ ফেডারেশন ব্যবস্থা মেনে নিতে চায়। দক্ষিণ পন্থী নেতাদের জানা ছিল যে সুভাষবাবু যতদিন সভাপতি থাকবেন ততদিন তিনি এর বিরুদ্ধে সব রকম উপায়ে বাধা দেবেন। এবং তাঁর সঙ্গে অধিকাংশ প্রদেশই যে যোগ দেবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ বর্তমানে তিনি অভাবনীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তাই আবার যখন নির্বাচনের সময় এল তাঁরা প্রস্তাবিত সুভাষবাবুর নামের সঙ্গে আরও দুজনের নাম প্রস্তাব করলেন যথা— মৌলানা আজাদ এবং পট্টভী সীতারামীয়া···। মৌলানা আজাদের প্রশ্ন ভিন্ন কিন্তু সীতারামীয়ার নাম সুভাষবাবুর সঙ্গে একই সঙ্গে উঠতে পারে না। তবু তাঁরা জানতেন যে এমন একজনকে সভাপতি করা দরকার যিনি তাঁদের কথা মত চলবেন। আজাদ তাঁর নাম প্রত্যাহার করলেন স্বাস্থ্যের অজুহাত দেখিয়ে। কিন্তু তিনি যে বিবৃতি দিলেন তাতে স্পষ্ট বোঝা গেল যে আসলে ভেতরে ভেতরে একটা কিছু ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি বললেন, ডাঃ পট্টভী সীতারামীয়ার নামও প্রস্তাব হয়েছে শুনে আমি খুব আনন্দ বোধ করছি। আমি অমার নাম প্রত্যাহার করবো না মনে করে তিনি তাঁর নাম প্রত্যাহার করতে মনস্থ করেছেন; তবে আমি আনন্দের সঙ্গে বলছি যে আমি তাঁকে তা না করতে রাজী করেছি। তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বহু পুরাতন সভ্য এবং অক্লান্ত বর্মী। আমি নির্বাচনের জন্য তাঁর নাম প্রতিনিধিদের সামনে উপস্থাপিত করছি, এবং আশা করি তিনি সবসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হবেন।

 সুভাষবাবু প্রত্যুত্তর দিলেন,— আর কোনরকম বিনয় প্রকাশের অবকাশ নেই। এবার রীতিমত নির্বাচন!···যদি মৌলানা আজাদের মত নেতাদের কথামত লোকে আমার বিরুদ্ধে ভোট দেয় তাহলে আমি অতি সাধারণ বাধ্য কর্মীর মত কংগ্রেসের কাজ করে যাবো।

 দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তরুণ সম্প্রদায় ও জাতীয়তাবাদী দল সুভাষবাবুর দিকে আর অপরদিকে মুষ্টিমেয় নেতার দল। কিন্তু এই নেতারা জানতেন ব্যক্তিগত প্রভাবের জোরে সুভাষবাবুর দল কোনও রকম প্রচার কার্য না চালালেও ভারী হয়ে উঠবে। তাই তাঁরা সকলে মিলে এক যুক্ত বিবৃতি বের করে নিজেদের ব্যক্তিগত প্রভাবে জনসাধারণের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলবার চেষ্টা করলেন। তাঁদের বিবৃতি:—আমরা বিশ্বাস করি ডাঃ পট্টভী কংগ্রেসের সভাপতির পদের জন্য সম্পূর্ণ উপযুক্ত। তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির প্রাচীনতম সদস্যদের অন্যতম এবং তাঁর জীবন বহুদিনের নিরবচ্ছিন্ন জনসেবায় সম্বৃদ্ধ। আমরা তাই আগামী নির্বাচনে কংগ্রেস প্রতিনিধিদের সম্মুখে তাঁর নাম অনুমোদন করছি।

 এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করলেন, বল্লভভাই প্যাটেল, আচার্য কৃপালনী, শঙ্কররাও দেও, রাজেন্দ্র প্রসাদ, ভুলাভাই দেশাই ও দৌলতরাম।

 এমনকি ডাঃ সীতারামীয়া নিজে এক বিরাট বিবৃতি বের করে নিজেকেই নিজে সমর্থন করলেন। তাঁর বক্তব্য এই যে, আমি বহুদিন কংগ্রেসের সেবা কবে আসছি আমার নাম প্রস্তাব তারই স্বীকারোক্তি··· ইত্যাদি।

 এই দুটি বিবৃতি ছাড়া আরও বহু বিবৃতিতে ও রচনায় সংবাদ পত্রের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে উঠতে লাগলো। দেশময় দারুণ উৎকণ্ঠার তরঙ্গ! সুভাষবাবু দেখলেন তাঁর পক্ষেও এইবার কিছু প্রচার কার্য চালানো দরকার আর না হয়ত নাম প্রত্যাহার করতে হয়। কিন্তু নাম প্রত্যাহার করা তাঁর স্বভাব নয় তাই তিনিও বীরের মত তাঁদের সেই অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে দিলেন। তাঁর বিবৃতি যা বেরুলো তাকে প্রচার বলা যেতে পারে না। সেটা সত্য ঘটনার সহজ প্রকাশ মাত্র। তিনি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিলেন দক্ষিণপন্থী দলের আসল উদ্দেশ্য কি? তিনি বললেন, এটা অনেকেই বিশ্বাস করেন যে আগামী বছরে কংগ্রেস দক্ষিণপন্থী দলের সহিত বৃটিশের ফেডারাল স্কিম নিয়ে একটা আপোষ মীমাংসার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই দক্ষিণপন্থী দল চাননা একজন বামপন্থী নেতা সভাপতি হয়ে, এই বোঝাপড়ার ব্যাপারে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করেন।

 এর প্রত্যুত্তরে সর্দার প্যাটেল এক বিবৃতি বের করে সত্য ঘটনাকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু সফল হলেন না। অনেকটা সেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার ব্যাপার।

 বাদানুবাদ চলতে লাগলো। কিন্তু এটা কারও বুঝতে বাকী রইল না যে বিশিষ্ট নেতাদের যুক্ত বিবৃতিব সাহায্যে কোন বিশেষ লোককে নির্বাচিত করা শুধু অসম্ভব নয়—অন্যায়। উপরন্তু সুভাষবাবুর যুক্তিমূলক বিবৃতি এবং পক্ষপাতিত্ব দোষহীন নিঃস্বার্থ কর্মপ্রচেষ্টা সকলকে মুগ্ধ করছে। স্থভাষবাবু বললেন, আমি ব্যক্তিগত স্বার্থ-সিদ্ধির জন্যে একথা বলছি না। এ আমি আমার দলগত আদর্শের মর্যাদা রক্ষার জন্যে বলছি। ‘আমার পরিবর্তে আচার্য নরেন্দ্র দেও’র মত একজন ফেডারেশন-বিরোধী বিশিষ্ট কর্মীর নাম প্রস্তাব করা যেতে পারে। আমার নাম উঠেছে বলে আমি অনুতাপ করছি।

 তিনি এমন পর্যন্ত বললেন, যে এখনও এই সঙ্ঘর্ষ প্রতিরোধ করার সময় আছে যদি দক্ষিণপন্থীদল তাঁদের মধ্য থেকেই এমন কোন নেতাকে নির্বাচিত করেন যাঁর ওপর বামপন্থীদল সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারে।

 কিন্তু দক্ষিণপন্থী এ প্রস্তাবেও কর্ণপাত করলে না।

 এর পর সম্মুখ সমর ছাড়া আব গত্যন্তর নেই।

 আর হলও তাই! ভোটের ফলাফল বেরোতে দেখা গেল, সুভাষবাবুর পক্ষে ভোট ১৫৮০ আর সীতারামীয়ার পক্ষে ১৩৭৭।

 নেহাৎ সামান্য নয় রীতিমত ২০৩ ভোটের তফাং!

 মুকুটহীন সম্রাট সুভাষচন্দ্র কোন এক অপার্থিব সাম্রাজ্য জয় করে এসে বসলেন সিংহাসনে। পুনর্বার!

 এতবড় জয়লাভে সুভাষবাবু এতটুকুও অধীর হয়ে উঠলেন না আনন্দে বা উত্তেজনায়। তিনি স্থির মস্তিষ্কে এই জয়বার্তা গ্রহণ করলেন। বললেন, আনন্দে আত্মহারা হবার সময় এখন নয়। এখন আমাদের দৃষ্টি শুধু আগামী কালের দিকে। আগামী কালের দিকে চেয়ে আমাদের কাজ করতে হবে, ব্রত গ্রহণ করতে হবে। এই প্রতিযোগিতার ফলাফল আমরা মাথা নত করে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে যেন গ্রহণ করতে পারি। ···পাছে ভারতের মুক্তি সংগ্রামের শত্রুরা মনে করে যে কংগ্রেসে ভাঙ্গন ধরেছে তাই আমি স্পষ্ট করে ঘোষণা করছি যে কংগ্রেস আগের মতই এখনও সঙ্ঘবদ্ধ আছে। কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে কয়েকটা ব্যাপারে মতানৈক্য থাকতে পারে কিন্তু যখনই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রশ্ন ওঠে তখন সকলেই একমত, একতাবদ্ধ!

 কোলকাতায় এক সম্বর্ধনা সভায় ঠিক এই কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি। উপরন্তু বললেন, এই জয়লাভের দিনে এমন কোন কথা বলা বা কাজ করা উচিৎ নয যাতে অন্যের মনে আঘাত লাগে অথবা কোন ব্যক্তি বিশেষের ওপব কোন প্রতিক্রিয়া আসে।

 কিন্তু তিনি এতবার সাবধান করে দিলেও সাধারণ লোকের অনেকেই এত উচ্চ মন নিয়ে একে গ্রহণ করতে পারলে না। সমস্ত দেশময় একটি কথা শুধু ছড়িয়ে পড়লো—একটি প্রশ্ন—দক্ষিণ পন্থীদের দিন কি ফুরিয়ে এল? গান্ধীবাদের এই কি শেষ? অনেক সংবাদপত্রে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হল যে সত্যিই গান্ধীজীর দিন ফুরিয়ে এসেছে। গান্ধীবাদ আজকের দিনে অচল, ইত্যাদি। কিন্তু সুভাষবাবু এই ধরণের প্রচার কার্যের বরাবরই বিপক্ষে ছিলেন। তিনি বললেন, সর্বদাই আমার লক্ষ্য হবে তাঁর (মহাত্মাজীর) বিশ্বাস অর্জন করা কারণ আমি জানি যে যদি আমি ভারতের শ্রেষ্ঠ মানুষের মনই না জয় করতে পারি তাহলে অপর সকলের বিশ্বাস অর্জন করা বিড়ম্বনা মাত্র।

 সুভাষবাবু ব্যাপারটাকে এত উদার ভাবে গ্রহণ করলে কি হবে অন্যান্য কংগ্রেস নেতারা বিষয়টা এত সরলভাবে নিতে পারলেন না — এমন কি গান্ধীজী এই সম্বন্ধে যে মতামত দিয়েছিলেন তা শুধু বিস্ময়কর নয়—সমস্ত কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরাট এক ভাঙ্গনের সহায়ক মাত্র! গান্ধীজী বললেন, আমি স্বীকার করছি এই পুনর্নির্বাচনের গোড়া থেকেই আমি কয়েকটা কারণে,— যে কারণ এখন আমি বলার প্রয়োজন বোধ করি না—এর বিরুদ্ধে যেহেতু আমিই ডাঃ সীতারামীয়াকে নাম প্রত্যাহার করতে বিরত করার নিমিত্ত মাত্র সেইহেতু তাঁর পরাজয় আমাকেই বেশী আঘাত করেছে। সংখ্যালঘিষ্ট দল সংখ্যাগরিষ্ঠের কর্মপন্থার সর্ববিধ সাফল্য কামনা করবে। যদি তারা এই কর্মপন্থার সহিত সামঞ্জস্য না রাখতে পারে তাহলে তারা কংগ্রেস ত্যাগ করে চলে আসবে। যদি তারা পারে তাহলে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের শক্তিবৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। সংখ্যালঘিষ্ঠরা কোন মতেই কোন প্রতিবন্ধকের সৃষ্টি করবে না। যখনি তারা সাহায্য করতে পারবে না তখনই তারা নিজেদের সরিয়ে রাখবে।

 এই বিবৃতির পর সাধারণের মধ্যে কারও আর বুঝতে বাকী রইল না যে অন্তরে অন্তরে মহাত্মাজী সুভাষবাবুর ওপর সমস্ত সহানুভূতি হারিয়েছেন। এই মতামত পরোক্ষে প্যাটেল-আজাদ-রাজেন্দ্রপ্রসাদের দলের মতামতেরই পরিভাষা মাত্র। এর পর কংগ্রেসের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রশ্ন নিরর্থক। সকলেই স্পষ্ট উপলব্ধি করলে নির্বাচনে জিতলেও সুভাষবাবুর নিজস্ব মতের স্বাধীনতাকে গান্ধীজী পর্যন্ত অন্তর থেকে সমর্থন করতে পারেন নি। অথচ অপরপক্ষে আমরা দেখেছি, এতবড় বিজয় আনন্দের মধ্যেও সুভাষবাবু এতটুকুও শ্রদ্ধা হারান নি গান্ধীজীর ওপর, উপরন্তু গান্ধীজীর শ্রেষ্ঠত্ব শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করে নিয়েছেন। গান্ধীজী যখন ভাঙ্গনের সামান্যতম ইঙ্গিত দিয়েছেন সুভাষবাবু জোর দিয়ে কংগ্রেসের এক নীতি এক প্রাণের কথা ঘোষণা করেছেন।

 সুভাষবাবু দেখলেন ভাঙ্গন আসন্ন। দূর থেকে ব্যক্তিগত মতামতের সঙ্ঘর্ষ চালিয়ে, এক অপরকে জয় করার প্রবৃত্তি নিয়ে কখনও এ ভাঙ্গন রোধ করা যাবে না। দূর থেকে আপোষের চেষ্টা নিরর্থক। তাই তিনি স্বয়ং ওয়ার্ধা যাত্রা করলেন গান্ধীজীর সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনা করবার জন্যে। তিন ঘণ্টা ধরে আলোচনা চললো তাঁদের মধ্যে। আলোচন। শেষ করে সুভাষবাবু বেরিয়ে এসে বললেন যে যদিও তাঁদের মধ্যে কোন নির্দিষ্ট উপসংহারে তাঁরা এসে পৌঁছতে পারেন নি তবুও তাঁদের আলোচনা যথেষ্ট আশাপ্রদ হয়েছে এবং গান্ধীজী তাঁকে আগের মতই যথেষ্ট হৃদ্যতার সঙ্গে সম্ভাষণ জানিয়েছেন।

 এই সংবাদ সত্যই যে আশ্বাসপূর্ণ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। যদিও সুভাষ বাবু সাবধান করে দিয়েছিলেন যে ইতিমধ্যেই এসম্বন্ধে কোন মতামত দেওয়া খুব বেশী যুক্তি সঙ্গত হবে না তবুও সুভাষ বাবুর এই আশার বাণীতে যখন গান্ধীজীর সমর্থন আছে জানা গেল, তখন সত্যই সাধারণ লোকে বিশেষ আশান্বিত হয়ে উঠলো। কিন্তু এর পরেই এল গান্ধীজীর বাণী। তিনি স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে বললেন, যে অধিকাংশ প্রতিনিধির দল যখন গান্ধীবাদের বিরুদ্ধে তখন তাঁর পরামর্শ নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। সুভাষ বাবু যে মতে বিশ্বাস করেন সেই মতবাদে বিশ্বাসী নেতাদের নিয়ে তিনি যেন কংগ্রেসের মন্ত্রিসভা গঠন করেন; কার্যকরী সমিতিতে দক্ষিণ পন্থী নেতাদের অংশ গ্রহণ করার কোন প্রয়োজন নেই।

 শুধু এই বিবৃতি নয়, এর সঙ্গে বারোজন দক্ষিণ-পন্থী নেতার যুক্ত তার এলো যে তাঁরা সকলেই পদত্যাগ করতে প্রস্তুত। তার পাবার পরই সুভাষ বাবু তাঁদের কাছে থেকে একখানা যুক্তপত্রও পেলেন। সেই বারোজন নেতাই তাতে স্বাক্ষর করেছেন— তাঁরা হলেন—সর্দার প্যাটেল, মৌলানা আজাদ, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, সরোজিনী নাইডু, পট্টভী সীতারামিয়া, আচার্য্য কৃপালনী, ভুলাভাই দেশাই, হরেকৃষ্ণ মহাতাব, আবদুল গফুর খাঁ, শেঠ যমুনালাল বাজাজ, জয়রামদাস, দৌলতরাম এবং আরও একজন। সেই চিঠিতে লেখা ছিল— যারা নিজেদের যুক্তিবাদী ও অগ্রগামী বলে মনে করেন তাঁরা আমাদের কার্যের সমালোচনায় সন্তুষ্ট না থেকে নিজেরাই যেন সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বহুদিন এই অবস্থা সহ্য করা হয়েছে, এখন যখন বামপন্থী দলের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে তখন তাঁদেরই কংগ্রেসকে স্বাধীনভাবে চালনা করবার সুযোগ দেওয়া উচিত। যদি তাঁরা ব্যর্থ হন তাহলে দেশ মস্ত বড় একটা প্রয়োজনীয় শিক্ষা পাবে।

 সর্বাপেক্ষা অনুশোচনার বিষয় এই যে যখন তাঁরা এই পত্র পাঠালেন তখন সুভাষ বাবু ১০৩ ডিগ্রি জ্বরে শয্যাগত। শুধু শয্যাগত বললে ভুল হবে তিনি রোগের প্রকোপে প্রায় জ্ঞানশূন্য! অথচ যাঁরা এই পত্র পাঠালেন তাঁরা মুক্তিসংগ্রামের এক একটি মহারথ, যারা বহু নির্যাতন ও যন্ত্রণা ভোগের সময় সমস্ত নেতাদের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছেন, ভাগ করে সমস্ত লাঞ্ছনা ভোগ করেছেন, অপরের দুঃখে অন্যের হৃদয় সমবেদনায় আপ্লুত হয়ে উঠেছে····। তাঁদের কাছ থেকে এই অবস্থায় এমন ব্যবহার দেশ কি আশা করতে পেরেছিল?

 সুভাষবাবু বীরের মত স্থির ভাবে এই পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করলেন। তিনি জানতেন এই পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করার দায়িত্ব কতখানি। এর ফলে কংগ্রেস পার্লামেণ্টারী বোর্ড ভেঙ্গে যাবে, ওয়ার্কিং কমিটিও ভেঙ্গে যাবে, এমন কি সম্পাদক পর্যন্ত পদত্যাগ করেছেন। অর্থাৎ সমস্ত কার্যভার তাঁকে এই অসুস্থ শরীর নিয়েই বহন করতে হবে। কিন্তু তবু তিনি এতটুকুও বিচলিত হলেন না। পদত্যাগপত্র স্বীকার করে নিয়ে সমস্ত বিরুদ্ধ সম্ভাবনার বিরুদ্ধে নিজের সমস্ত নিষ্ঠার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেন।


 এদিকে ত্রিপুরী অধিবেশনের দিন ঘনিয়ে আসছে। ডাঃ নীলরতন সরকার সুভাষবাবুকে পরীক্ষা করে এই মর্মে এক বুলেটিন দিলেন যে বর্তমানে তাঁর শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে অধিবেশন এক পক্ষ কাল স্থগিত রাখা হোক না হলে বিশেষ সঙ্কট উপস্থিত হতে পারে।

 এই বুলেটিনের পর হয় অধিবেশন স্থগিত রাখতে হয় আর না হয় ত সুভাষবাবুর পক্ষে পদত্যাগ পত্র দাখিল করা ছাড়া আর উপায় নেই। সকলেই আশা করেছিল হয় ত অধিবেশন স্থগিত রাখা হবে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হল না। এবং যদিও গান্ধী ভাবাপন্ন বহু কংগ্রেস কর্মী চারিদিক থেকে দাবী জানাতে লাগলেন যে যদি সুভাষ বাবু দক্ষিণ পন্থী নেতাদের বিরুদ্ধে তাঁর মতামত প্রত্যাহার না করেন তাহলে তাঁরা তার উপর অনাস্থা প্রস্তাব আনবেন, সুভাষ বাবু এতেও বিচলিত হলেন না। তিনি শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে প্রস্তুত আছেন, তবু অন্যায় দাবীর সামনে মাথা হেঁট করতে পারবেন না।

 ফলে, নির্দিষ্ট দিনেই ত্রিপুরীব অধিবেশন শুরু হল। সভাপতিও উপস্থিত হলেন ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে! এর আগে হরিপুরার কংগ্রেসে যে সভাপতিকে অভূতপূর্ব শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে আনা হয়েছিল সেই সভাপতিই আজ এক রকম উত্থানশক্তি রহিত অবস্থায় এ্যাম্বুলেন্স যোগে সভাক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হলেন। এই দুই দৃশ্য সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর মনে চিরজাগরূক থাকবে। মিথ্যা আত্মমর্যাদা ও নেতৃত্বের আশঙ্কা মহৎ ব্যক্তিকেও হিংসা ও কূট বুদ্ধির নিম্ন স্তরে নামিয়ে নিয়ে যায়। ত্রিপুরী কংগ্রেস তারই জ্বলন্ত নিদর্শন।

 তা যদি না হত তাহলে যাঁরা সম্পূর্ণভাবে কংগ্রেসের সমস্ত দায়িত্ব সুভাষবাবুর স্কন্ধে চাপিয়ে দিলেন এবং বিনা বাধায় তাঁর নিজস্ব মতামতের উপর নির্ভর করেই কংগ্রেসকে পরিচালনা করবার হুমকি দিলেন তারাই আবার তাঁকে অপদস্থ করবার জন্যে সমবেত হলেন ত্রিপুরী কংগ্রেসে, তাঁদের সমস্ত কূটবুদ্ধিকে জাগ্রত রেখে। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে গোবিন্দবল্লভ পন্থ এই প্রস্তাব তুললেন যে, এতদিন কংগ্রেস যে গান্ধীবাদের অনুসরণ করে আসছে এই কমিটি সেই গান্ধীবাদের ওপরই পুনর্বার তাদের অবিচলিত শ্রদ্ধা ও নির্ভরতা অর্পণ করছে। এই পদ্ধতির কোন পরিবর্তন তারা মানবে না। বর্তমান পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে এই কমিটি মনে করে যে গান্ধীজীর ওপরই কংগ্রেসের নেতৃত্ব অর্পণ করা হোক। সেইজন্য কংগ্রেসের কর্তৃপক্ষ যেন আগামী সভাপতি নির্বাচনে গান্ধীজীর ইচ্ছার ওপরই আশ্রয় করেন।

 এই হল গোবিন্দবল্লভের প্রস্তাবের সারমর্ম। অবশ্য সভাপতি এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করলেন না। কোন রকম সংশোধনও করা হল না। ফলে গান্ধীপন্থী দলেরই জয় সুনিশ্চিতভাবে নির্ধারিত হয়ে গেল।

 ১৩ই মার্চ সাধারণ অধিবেশন। কিন্তু তার আগে সুভাষবাবুর শরীর অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল। ডাক্তারেরা পরামর্শ দিলেন জব্বলপুর হাসপাতালে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হোক। কিন্তু সুভাষবাবু তাতে রাজী হলেন না। পণ্ডিত জওহরলালও তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু তিনি বললেন, আমি হাসপাতালে যাবার জন্যে এখানে আসি নি। এখানকার অধিবেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে স্থানান্তরিত হওয়ার চেয়ে মৃত্যুকে বরণ করা শ্রেয়ঃ মনে করি।

 অধিবেশন শুরু হল। সুভাষবাবুর পরিবর্তে তাঁর একখানা ফটো ৫২ হাতী বাহিত রথে শোভাযাত্রা করে নিয়ে আসা হল মণ্ডপে। যাই হোক সাধারণ অধিবেশনেও তাঁকে পরাজয় স্বীকার করতে হল। এমনকি সোশ্যালিষ্ট পার্টিও তার বিরুদ্ধাচরণ করতে দ্বিধাবোধ করলে না। কিন্তু সুভাষবাবু পদত্যাগ করলেন না। উপরন্তু সকলের নির্দেশ মত স্বাস্থ্যের একটু উন্নতি হলেই গান্ধীজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সম্মত হলেন। এর মধ্যে তিনি কোলকাতায় ফিরে এলেন।

 কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্য এতই ভেঙ্গে পড়েছিল যে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠলো। বিরূদ্ধ দল বলতে লাগল যে ইচ্ছে করেই তিনি দেখা করছেন না। তাই তিনি গান্ধীজীকে অনুরোধ করলেন কোলকাতায় এসে দেখা করতে। কিন্তু কোন ফল হল না। অগত্যা সুভাষবাবু যখন দেখলেন মীমাংসার কোন পথ নেই তখন কোলকাতায় তিনি এ, আই, সি, সির এক জরুরী অধিবেশন ডাকলেন। এই কোলকাতায় কত বড় বড় সংগ্রামের প্রথম উদ্ভব সম্ভব হয়েছে, কত বীর নেতা নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন এই কোলকাতা নগরীর বুকের উপর দাঁড়িয়ে। এবারেও সুভাষবাবু তাঁর চরম বিচারের পটভূমি হিসাবে কোলকাতারই নাম প্রস্তাব করলেন। অনেকে মন্তব্য করলেন যে বাঙ্গলাদেশে অর্থাৎ কোলকাতায় এ মীটিং হলে বাঙ্গলার উগ্রপন্থী—সুভাষপন্থী তরুণের দল হয়ত ত্রিপুরীর অপমানের প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে। তাঁরা মনে করলেন কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের হয়ত মর্যাদা হানি হতে পারে। কিন্তু সুভাষবাবু তাঁদের এই মিথ্যা আশঙ্কার প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, যাঁরা এইরকম আশঙ্কা করতে পারেন তাঁদের বাঙ্গলা সম্বন্ধে কোন জ্ঞান নেই। এ, আই, সি সি’র মীটিং করার সুবিধা পাওয়া যে কোন প্রদেশের পক্ষে সৌভাগ্য, সম্মান ও বহু ঈপ্সিত সুযোগের বস্তু। এই ক্ষেত্রে বাঙ্গলার অধিবাসীবৃন্দ বিশেষ করে কোলকাতাবাসিরা সমস্ত ভারতের আতিথ্য গ্রহণ করবে। আমি নিশ্চিত জানি যে দেশ প্রেম ও আতিথেয়তার গর্ব বাঙ্গালী বস্তুতই করতে পারে সেই ঐতিহ্য বজায় রাখবার জন্য আমাদের অতিথিদের যতদূর সম্ভব হৃদ্য অভ্যর্থনা জ্ঞাপন ও আমাদের রীতি অনুযায়ী অতিথেয়তা প্রদর্শন করা হবে।

 এই উক্তির পর বিরুদ্ধ মন্তব্যের আর কোন সুযোগ রইল না। ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে কোলকাতায় ওয়েলিংটন স্কোয়ারে মীটিং বসলো। এবং কার্য-ক্ষেত্রে দেখা গেল সত্যিই বাঙ্গলা দেশ রাজকীয় সম্মান ও সম্বর্ধনা দেখিয়েছে তার অতিথিদের। তবে দু’একটা বিসদৃশ ও অবাঞ্ছিত ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়। রাজেন্দ্র প্রসাদের দিকে এক পাটি জুতোও ছোঁড়া হয়েছিল। সকলক্ষেত্রে দেখা গেছে সুভাষবাবু স্বয়ং সবার আগে দাঁড়িয়ে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নেতাদের সম্মান রক্ষা করেছেন এবং ঐ দুর্ঘটনার জন্য তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন।

 দক্ষিণপন্থী দল তাঁদের সব শক্তি নিয়েই এসেছিলেন। ত্রিপুরীতে একবার যে জয় তাঁদের হয়েছে সেই জয়ের রেশ তাঁদের বজায় রাখতেই হবে। এদিকে বাঙ্গলার তরফ থেকেও যথেষ্ট চেষ্টা হয়েছে আসন্ন ভাঙ্গন থেকে এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে পরিত্রাণ দেবার জন্যে। কিন্তু তাঁরাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছেন যাঁদের আপাতঃ উদ্দেশ্য শুধু জয়ী হওয়া মাত্র—জাতীয় ঐক্য নয়। তাই একান্ত বাধ্য হয়েই এযাবৎ সুভাষচন্দ্র যা করতে বিরত ছিলেন তাই করতে বাধ্য হলেন।

কোলকাতা কংগ্রেসের কলঙ্কিত অধ্যায়ের শেষ যবনিকা পড়লো সুভাষচন্দ্রের পদত্যাগ ঘোষণা করে।

 ত্রিপুরীর মত, ভারতের আর একটি শ্রেষ্ঠ সন্তান জওহারলাল এবারেও এসে ছিলেন তাঁকে নিবৃত্ত করতে।

 কিন্তু, তীর তখন ছোঁড়া হয়ে গেছে লক্ষ্যের দিকে।