নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ/জীবনের ধারা (২)

জীবনের ধারা

(২)

 দুই ধরণের নদী আছে। এক ধরণের নদী যতটুকু শক্তি পায় উংসের গর্ত থেকে ঠিক ততটুকু শক্তি নিয়েই এগিয়ে চলে। চলতে চলতে যখন নিজের প্রাণের জোর আসে ফুরিয়ে তখন কাছাকাছি একটা বড় নদীর বুকের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ে বিকিয়ে দেয় নিজের স্বকীয় ধারাকে! এবং সেই বৃহৎ নদীর প্রবাহের সঙ্গে এক হয়ে কোনওগতিকে যখন সাগরের মোহনায় এসে পৌছায় তখন তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় বটে কিন্তু অনাব সত্বাকে জাগ্রত রেখে নয়। কিংবা এমনও কোন কোন নদী আছে যারা হাতের কাছে আত্মসমর্পণ করবার মত কোন বড় নদী না পেয়ে পথে যেতে যেতেই খানিকটা ব্যাপ্তির মাঝে মুখ লুকিয়ে চিরকালের মত থমকে দাড়িয়ে যায়।

 আর এক ধরণের নদী আছে, যে না সাগরের মোহনা পর্যন্ত না পৌছে আপনাকে হারাতে পারে না। যতদূর হোক, যত দুস্তর সে পথ হোক তবু সে আসবে, আপনার উন্মত্ত জীবন-প্রবাহে প্রধাবিত হয়ে আসবে সাগরের আশে। পাহাড়ের বুক কেটে প্রপাতের পর প্রপাত ডিঙ্গিয়ে, রাত্রির মত ঘন বন পেরিয়ে আবার ধূ-ধূ—করা রিক্তক্ষেত্র পার হয়ে সে ছুটে চলবে আপনার প্রাণশক্তির জোয়ারে।

 মানুষের জীবন ত নয় যেন এক একটা প্রবাহমান নদী। শুধু বাহ্যিক বা দৈহিক বেঁচে থাকার মধ্যে নয়, অন্তরে অন্তরে যে প্রাণশক্তি বন্যার মত বয়ে চলে, যে শক্তি আগিয়ে নিয়ে চলে দেহের যন্ত্রটাকে ঘটনার পর ঘটনার স্তুপ ঠেলে — সেই প্রাণশক্তির ধারা নদীর মতই উত্থান আর পতনের আবর্তে চিহ্নিত। এই ত জীবন! এই জীবনের মাঝেই কত ঢেউ—কত ওঠা আর পড়া—এবং এই ওঠা-পড়ার সমষ্টিগত একটা বেগে মানুষ এগিয়ে চলে—এগিয়ে চলে জীবন-নদী। সে নদী কোন কোন ক্ষেত্রে চলার পথেই হারায় আপন সত্বা আবার কোন কোন ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রাণশক্তির বলেই লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছয়।

 যাঁরা মহামানব তাঁদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের তুলনা এই দিক থেকে অতি সহজেই করা যেতে পাবে। কেবল এঁদের ক্ষেত্রে বৃহত্তর পরিবেশ আর বিশালতর বিস্তারের প্রশ্ন মাত্র—ধারা সেই এক।

 সুভাষচন্দ্রের জীবন এই শেষ পর্যায়ের নদী যার লক্ষ্যের মোহনায় ছুটে যাবার একটা প্রচণ্ড শক্তি আছে, যে শক্তি ভারতের মুক্তি সংগ্রামের উজ্জ্বল ইতিহাসের কূলে কূলে উচ্ছ্বসিত হয়ে বয়ে চলেছে—কখনও সঙ্গীতের মত মধুর সে প্রবাহের সুর, কখনও বা বন্যার গর্জনের মত প্রচণ্ড! এ নদীর পথে শুধু যে পাহাড় আর জঙ্গল আছে তা নয়, আছে অনেকগুলো প্রপাত। প্রথম প্রপাত মান্দালয়ের নির্বাসন আমরা দেখেছি, দ্বিতীয় প্রপাত ইউরোপের প্রবাস! প্রপাত অর্থাৎ দ্বিগুণতর প্রচণ্ডতা!

 * * * *

 ১৯৩৩ সালের গোড়ার দিকে সুভাষবাবু ইউরোপ যাত্রা করলেন। যাত্রার আগে কর্তৃপক্ষ আদেশ দিলেন যে তিনি জার্মানীতে প্রবেশ করতে পারবেন না। জার্মাণীতে তখন হিটলারের অভ্যুদয় সূচিত হয়ে গেছে। এই নির্দেশের মূলে বোধ হয় তাই-ই ছিল।

 যাই হোক সুভাষবাবু প্রথমে ভিয়েনায় এসে নামলেন। অস্ট্রিয়ার নগরী তখম সোশ্যাল ডেমোক্রাটরা পরিচালনা করছে মিউনিসিপ্যালিটি তাদের হাতে। অথচ ফ্যাসিস্টরাও বিশেষ শক্তিশালী দল গঠন করে তুলেছে। সুভাষবার কোন বিশেষ দলের দিকে কোন বিশেষ অনুরাগ না দেখিয়ে দুইদলের মধ্যে বিশেষ আলাপ-আলোচনা শুরু করে দিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে দুই দলের কাছ থেকেই অনেক কিছু ভাল জিনিষ শেখবার ও গ্রহণ করবার আছে। তিনি নিজে দেশে থাকতে কর্পোরেশন বা মিউনিসিপ্যালিটির কর্ম-পদ্ধতির সঙ্গে বিশেষ জড়িত ছিলেন তাই ভিয়েনাতেও সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের সঙ্গে মিশে তাদের মিউনিসিপ্যালিটির কার্যকলাপ পরিদর্শন করতে লাগলেন, আধুনিকতম শাসনব্যবস্থা শিক্ষা করতে লাগলেন। ওদিকে ফ্যাসিস্টদের মধ্যে যে শৃঙ্খলা, দৃঢ়তা ও নিয়মানুবর্তিতা আছে যে সবও তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করতো। তাই ফ্যাসিস্টদের কুচকাওয়াজেও তাঁকে উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছে। এই সময় স্থানীয় মেয়র কার্ল সিয়েটুজের সাথে তাঁর খুব ঘনিষ্টত। হয়। তিনি সোশ্যালিস্টদের নাগরিক শাসন ব্যবস্থা দেখে অভিভূত হয়েছিলেন কিন্তু সোশ্যালিষ্ট পাটির মধ্যে নিজেকে এক করে ফেলেন নি।

 সুভাষবাবু যখন ভিয়েনায় এসে পৌঁছলেন তখন কেন্দ্রীয় পরিষদের ভূতপূর্ব সভাপতি বিঠলভাই প্যাটেল চিকিৎসার জন্য ওখানে অবস্থান করছিলেন। বিঠলভাই প্যাটেল তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সকল ক্ষেত্রে গান্ধীদের অনুগামী ছিলেন না, উপরন্তু কয়েকটা বিষয়ে তিনি সুভাষবাবুর অনুসৃত পন্থারই অনুরক্ত ছিলেন। বিঠলভাইকে পেয়ে সুভাষবাবু খুব উৎসাহিত বোধ করলেন। এবং এই দুই অসুস্থ নেতা সম্মিলিত ভাবে গান্ধীবাদের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য শুরু করে দিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল গান্ধীজীর ক্ষীয়মান প্রভাব থেকে দেশকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে একটা সক্রিয় কর্মপন্থার নির্দেশ দেওয়া এবং দ্বিতীয়তঃ ইউরোপে ভারতবর্ষের আন্তরিক অবস্থা সম্বন্ধে সঠিক একটা পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়া। এই মহৎ কার্যের জন্য বিঠলভাই প্যাটেল সুভাষবাবুর হাতে এক লক্ষ টাকা দান করলেন।

 প্রথমেই তাঁরা দুজনে এক যুক্তবিবৃতি বের করলেন। তাতে লেখা ছিল যে, অসহযোগ আন্দোলনের এই হঠাৎ অবসান গান্ধীজীর নেতৃত্বের ব্যর্থতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা স্পষ্টই ঘোষণা করছি যে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে গান্ধীজী ব্যর্থ হয়েছেন। গান্ধীজীর পূর্বেকার কর্ম-পদ্ধতির সহিত সামঞ্জস্যহীন এই যে বর্তমান কার্যনীতির একঘেয়ে পুনরাবৃত্তির চেষ্টা এ সব সম্পূর্ণ দূর করে কংগ্রেসকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে কংগ্রেস সম্পূর্ণ নতুন এবং সময়োপযোগী নেতার বিধান অনুযায়ী কোন সক্রিয় এবং মৌলিক পন্থা অবলম্বন করতে পারে।

 অন্যত্র সুভাষবাবু তাঁর ইংরাজী পুস্তক ‘ইণ্ডিয়ান স্ট্রাগলে’ লিখেছিলেন, গান্ধীজীর ব্যর্থতার কারণ এ নয় যে তিনি সমর্থন পাননি। বরঞ্চ অন্যান্য দেশে যে অল্পসংখ্যক লোক নিয়ে অন্যান্য দেশের নেতার। তাঁদের দেশকে মুক্ত করতে পেরেছেন গান্ধীজী তার থেকে অনেক বেশী সমর্থন পেয়েছেন। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না যে গান্ধীজী যেমন তাঁর নিজের দলের লোকদের চিনতে পেরেছিলেন সেই পরিমাণে তাঁর বিরুদ্ধ দলকে কিছুই বুঝতে চেষ্টা করেন নি। ভারতের ভবিষ্যত— যে সমস্ত বীর সৈনিকের দল নির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করে ত্যাগ ও নির্যাতনের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে, তাদের হাতের ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করছে।

 সুভাষবাবুর এই সমালোচনা—গান্ধীবাদের ওপর এই আক্রমণ ইউরোপ খুব উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। চারদিক থেকে তাঁর লেখা পড়বার আগ্রহ দেখা গিয়েছিল। ইউরোপে থাকতেই তিনি তাঁর পুস্তক ‘ইণ্ডিয়ান স্ট্রাগ্‌ল্ সম্পূর্ণ করেন। এই বই ইংলণ্ডে প্রথম প্রকাশিত হবার পর সার সামুয়েল হোর ভারতে এই বইয়ের প্রচার আইনতঃ নিষিদ্ধ করে দিলেন। ইংলণ্ড সুভাষবাবুকে যে চোখেই দেখুক অন্যান্য ইউরোপীয় রাজ্য তাঁকে যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছিল। বিশেষ করে বল্কান রাজ্যগুলিতে তিনি সব চেয়ে বেশী উৎসাহ পেয়েছিলেন। বাঙ্গলা দেশের মত এই বল্কান রাজ্যগুলিতে অনেকবার সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হয়ে গিয়েছে। বোধ হয় সেইজন্যই বীর সৈনিক সুভাষচন্দ্রের মন এই দেশগুলির দিকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল। বেলগ্রেডে থাকতে সুভাষবাবুকে কেন্দ্র করে একটা মজার ঘটনা ঘটে। বেলগ্রেডের মুখপত্র ‘পলিটিক’ তাঁকে ভারতের অবস্থা সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখতে অনুরোধ করে। তারা বলে যে কিছুদিন আগে রামপুরের নবাব ভারতে বৃটিশ শাসনের প্রশংসা করে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তার প্রত্যুত্তরে জাতীয়তাবাদী কোন লেখকের মন্তব্য তারা প্রকাশ করতে চায়। সুভাষবাবু এই প্রবন্ধ লিখেছিলেন কিন্তু বৃটিশের মধ্যস্থতায় এই প্রবন্ধ ছাপাতে দেওয়া হয় নি। উপরন্তু রয়টার দেশবিদেশে খবর পাঠিয়ে দিলে যে বেলগ্রেডে সুভাষবাবু কিছুই সম্বর্ধনা পান নি ইত্যাদি। পরে অবশ্য সমস্ত ঘটনা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে সুভাষবাবু এক প্রবন্ধ লেখেন

 এমনি করেই ভারতে বৃটিশ শাসনের বর্বরতার বিরুদ্ধে ভারতীয় কণ্ঠে প্রতিবাদের স্তর প্রথম সুভাষবাবুর প্রচারকার্যের মধ্যেই ধ্বনিত হয়ে ওঠে। পরবর্তী যুগে অবশ্য জওহরলাল এবং আরও পরে অতি আধুনিক যুগে বিজয়লক্ষ্মী যথেষ্ট এ বিষয়ে সচেষ্ট হয়ে উঠেছেন কিন্তু সুভাষবাবুই যে এ পথের পথপ্রদর্শক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাঁর রাজনৈতিক মতামত নিয়ে যতই মতানৈক্য থাকুক না কেন এই দিক দিয়ে তাঁর অবিস্মরণীয় দান সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে নেবে। এবং এ বিষয়ে তাঁকে সকল বিষয়েই যিনি সাহায্য করেছিলেন সেই বিঠলভাই প্যাটেলকে সকলে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। ছাত্রাবস্থা থেকেই সুভাষবাবুর মনে যে আত্মমর্যাদা ও দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয়ে উঠেছিল ইউরোপে এসে তার আরও বিরাটতর রূপে আত্মপ্রকাশ দেখা গেল। জগতের রাজনৈতিক ইতিহাসের অধ্যায়ে সুভাষবাবুর নাম চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গেল।

 শুধু রাজনৈতিক আত্মমর্যাদার প্রশ্ন নয়, বিদেশে বৃটিশজাতি ভারতবর্ষের সামাজিক ও নৈতিক জীবন নিয়ে যে সমস্ত মিথ্যা রটনা শুরু করেছিল—বিশেষ করে বৃটিশের স্বেচ্ছাকৃত দারিদ্র্য ও সর্বাঙ্গীন অভাব অনটনের সুযোগ নিয়ে যে সমস্ত পুস্তক ও সিনেমার ছবি প্রকাশিত ও প্রচারিত হত সুভাষবাবু সে সবের বিরুদ্ধে ভীষণভাবে আন্দোলন শুরু করে দেন। তাঁর চেষ্টাতেই ভারতে ইংরাজ শাসনের মিথ্যা গৌরবময় ঘটনার ছবি ‘বাঙ্গালী’ প্রদর্শন বন্ধ হয়। সুভাষবাবু জানিয়েছিলেন দেশকে যে ইউরোপে এমন ছবিও দেখানো হয়েছে যেখানে দেখা গেছে মহাত্মাজী হাঁটুর ওপর কাপড় পরে একটি ইউরোপীয় মহিলার হাত ধরে নৃত্য করছেন। চিত্র প্রদর্শনীতে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে যে সব ছবি দেখানো হয়েছে সেখানে স্থান পেয়েছে কুৎসিৎ কদাকার বুভুক্ষাপীড়িত কঙ্কালের ছবি, কোথাও বা সহমরণের বিবরণ, কোথাও বা বাল্যবিবাহের নগ্নতম রটনা ইত্যাদি। এই সব ছবি প্রদর্শনের উদ্দেশ্য এই যে ইংরাজ আমাদের এই সব অনাচারের হাত থেকে রক্ষা করেছে, সভ্য করেছে, মানুষ করেছে — সেই দিক থেকে তারা আমাদের ধন্যবাদার্হ!

 ইউরোপে তখন ফ্যাসিজম অব কমিউনিজমের জের চলেছে। প্রত্যেক রাজ্যেই এই দুই দল গড়ে উঠেছে, কম আর বেশী। সুভাষবাবুরও এদের সঙ্গে মিশে মিশে এই দুই দলের দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আশ্চর্য এই যে বাস্তবিকপক্ষে তিনি পুরোপুরিভাবে কোন বিশেষ দলের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন নি। উপরন্তু তিনি এই দুই মতবাদের সারাংশ— ভাল অংশগুলোর সামঞ্জস্য করে একটা নিজস্ব ও উদার মতবাদ সৃষ্টি করেছিলেন। এই মতবাদের নাম সমবাদীয় মতবাদ। এই মতবাদকে কেন্দ্র করে তিনি যে দল গঠন করার পরিকল্পনা করেছিলেন সেই দলের নাম সমবাদীয় সঙ্ঘ। লণ্ডনে আহুত নিখিলভারত সর্বদলীয় অধিবেশনে আমন্ত্রিত হয়ে সেখানেই প্রথম তাঁর এই নব পরিকল্পিত সঙ্ঘের উদ্দেশ্য প্রচার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লণ্ডনে প্রবেশ করবার অনুমতি না পাওয়ায় তাঁর অভিভাষণ ডাঃ ভাট পাঠ করে শোনান।

 এই সময়ে ভারতবর্ষে পণ্ডিত জওহরলাল কংগ্রেসের বৈদেশিক নীতি প্রচারের ওপর জোর দিচ্ছিলেন। বোধ হয় সুভাষবাবুর ইউরোপের জনপ্রিয়তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার উদ্দেশ্য কিছুটা প্রচ্ছন্ন হয়ে ছিল এর পেছনে। যাই হোক একদিকে যেমন সুভাষবাবু ফ্যাসিজমকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ না করে এবং কমিউনিজমকে অনেকক্ষেত্রে নিন্দা করে নতুন ধরণের মতবাদ গড়ে তুলছিলেন এবং জগৎ সমক্ষে প্রচার করবাব চেষ্টা করছিলেন, অপর দিকে তেমনি জওহরলাল বিশেষ করে নাৎসীবাদ ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে নিন্দা করে কমিউনিজমকে বিশেষভাবে গ্রহণ করবার ও অনুসরণ করবার নির্দেশ দিয়ে কংগ্রেসের বৈদেশিক নীতি প্রচার করতে তৎপর হয়ে উঠলেন। অবশ্য সুভাষবাবু নাৎসী ফ্যাসি বা সাম্রাজ্য কোন ‘বাদ’কেই গ্রহণ করেন নি কিন্তু তেমনি আবার কমিউনিজমকে ভীষণ আক্রমণ করেছেন।

 জওহরলালজী লিখলেন, আমি জোরের সঙ্গে বিশ্বাস করি যে জগতের মূল সমস্যা হয় কমিউনিজম নয় ফ্যাসিজমকে গ্রহণ করা এবং আমি সর্বতোভাবে কমিউনিজমের পক্ষপাতী। আমি ফ্যাসিজম সম্পূর্ণ অপছন্দ করি···কারণ ফ্যাসিজম পরোক্ষভাবে সেই ধনিকতন্ত্রের স্বার্থসিদ্ধির একটা ঘোরালো উপায় মাত্র। ফ্যাসিজম ও কমিউনিজমের মধ্যে কোন মধ্য পন্থা নেই। দু’টোর মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে এবং আমি কমিউনিষ্ট আদর্শকেই নেবো ইত্যাদি।

 সুভাষবাবু জবাব দিলেন,—এইখানে লেখক যে মন্তব্য করেছেন তা আগাগোড়াই ভ্রমাত্মক। আমরা যতক্ষণ না বিবর্তনের শেষ পরিণতি পর্যন্ত অপেক্ষা করছি —অবশ্য বিবর্তনবাদকে একেবারেই বরবাদ যদি না করা হয়— তাহলে এই দু’টোর মধ্যেই আমাদের পছন্দ সীমাবদ্ধ ক’রে রাখবার কোন যুক্তি নেই। এমন দিন আসছে যেদিন জগতের ইতিহাসে কমিউনিজম ও ফ্যাসিজমের একটা মিশ্রনের সূত্রপাত হবে। আর ভারতেই যদি তার প্রথম সূত্রপাত হয় তাহলে আশ্চর্য হবার কিছু আছে কি?···জগৎ গান্ধীবাদের মত একটা নূতন পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে যদি এত উৎসাহিত হয়ে উঠতে পারে তাহলে সারা জগতের পক্ষে প্রযোজনীয় আর একটি পরীক্ষা ভারতে সুরু হবে তাতে আশ্চর্য হবার কি আছে?

 শুধু ব্যক্তিগত বাদানুবাদের উপর জোর না দিয়ে দুজনের বক্তব্য ও মতবাদের ওপর এখন জোর দেওয়া উচিত। অবশ্য জওহরলালজী যখন বলছেন যে কমিউনিজম মতবাদের উপর তিনি যথেষ্ট আস্থাবান (সম্পূর্ণ নয়) তখন সেদিকটা আলোচনা করবার বিশেষ কিছু নেই। কিন্তু সুভাষবাবুর মতবাদ সম্পূর্ণ অভিনব। তাই তাঁর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমাদের সঠিক ধারণা থাকা দরকার। যথা:—

 (১) এই দল কিষাণ, মজুর প্রভৃতিদের স্বার্থ রক্ষা করবে অর্থাৎ জমিদার, বণিক এবং মহাজন শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থের জন্যে নয়।

 (২) এই দল ভারতের জনসাধারণের সম্পূর্ণ অর্থ নৈতিক ও রাজ নৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করবে।

 (৩) ভারতের শেষ লক্ষ্য ফেডারেল গভর্ণমেণ্ট হিসাবে এই দল সংগ্রাম চালাবে তবে ভারতকে নিজের শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে কয়েক বছরের মেয়াদে একজন ডিক্টেটরের অধীনে এক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় গভর্ণমেণ্ট গঠনের ওপর বিশ্বাস রাখবে।

 (৪) দেশের শিল্প ও কৃষি জীবনের পূর্ণ সংস্কার সাধনের নিমিত্ত সুচিন্তিত পরিকল্পনার ওপর জোর দেবে।

 (৫) বিগত যুগের পঞ্চায়েত পরিচালিত গ্রাম্য সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তিতে নতুন ধরণের সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টা ও জাতিভেদ ও অন্যান্য সামাজিক বিধি নিষেধের উচ্ছেদ সাধনের চেষ্টায় রত থাকবে।

 (৬) আধুনিক জগতের গবেষণা মূলক ও কার্যকরী পদ্ধতি অনুযায়ী আধুনিক ধরণের মুদ্রা ও ঋণ ব্যবস্থার প্রবর্তনের চেষ্টা করবে।

 (৭) জমিদারী প্রথা রদ ও সমান হারের ভিত্তিতে জমিকর ব্যবস্থার চেষ্টা করবে।

 (৮) গণতন্ত্র বলতে মধ্য ভিক্টোরিয়ান যুগের গণতন্ত্রের ওপর বিশ্বাস রাখবে না, কিন্তু ভবিষ্যতে ভারত যখন নিজের প্রতিষ্ঠার ওপর স্বাধীনভাবে অধিষ্ঠিত হবে তখন একটা অন্তবিপ্লবের দৃষ্টি না হয়ে ভারত যাতে ঐক্যবদ্ধ থাকে তার জন্যে সামরিক শৃঙ্খল। প্রাপ্ত একটিমাত্র শক্তিশালী দলের ওপর শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ায় বিশ্বাস রাখবে।

 (৯) শুধু ভারতের মধ্যে নিবন্ধ রেখে নয়, এই দল ভারতের মুক্তি প্রশ্নকে আরও প্রাধান্য দেবাব জন্যে আন্তর্জাতিক প্রচারকার্যেরও আশ্রয় নেবে এবং বর্তমানের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করবে।

 (১০) এরা সমস্ত অগ্রগামী দলগুলিকে এক জাতীয় প্রতিষ্ঠানের অধীনে সঙ্ঘবদ্ধ করবার চেষ্টা করবে যাতে যখনই কোন কার্যকরী পন্থা গ্রহণ করা হবে তখন একই সঙ্গে সব ক্ষেত্রে সকল দিক থেকে কাজ শুরু হয়ে যেতে পারে।

 এইবার ভারতের দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক। একদিকে যেমন ইউরোপ থেকে সুভাষবাবুব বক্তৃতা, ভাষণ, লেখা, প্রচার পত্র প্রভৃতি আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ছে দেশের খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়—মানুষ সমস্ত প্রাণের আগ্রহ নিয়ে শুনছে জগতে নতুন এক আদর্শ নতুন এক মতবাদের পূর্ব সূচনা অন্যদিকে তেমনি দেশের মধ্যে থেকে জওহরলালজী সোশ্যালিজম ও কমিউনিজমকে সমর্থন করে আর ফ্যাসিজমকে নিন্দা করে বক্তৃতা দিচ্ছেন, লোককে আকর্ষণ করছেন এবং কংগ্রেস সোশ্যালিষ্ট পার্টিকে শক্তিমান করে তুলছেন। সুভাষবাবুর অবর্তমানে জওহরললেই ভারতের তরুণ সম্প্রদায়ের, অগ্রগামী সম্প্রদায়ের একমাত্র কর্ণধার! তাহলে গান্ধীজীর প্রভাব কি একেবারেই খর্ব হয়ে গেল? না, কথাটা অত সহজেই উড়িয়ে দেবার মত নয়।

 গান্ধীজী প্রত্যক্ষভাবে কংগ্রেসের সংশ্রব ত্যাগ করলেও সবার পশ্চাতে ধ্রুবতারকার মত উজ্জ্বল ও একদর্শী হয়ে পথ নির্দেশ করছেন। তাঁর তিনটি প্রধান সহায় সর্দার প্যাটেল, মৌলানা আজাদ এবং রাজেন্দ্রপ্রসাদ! সর্দার প্যাটেল কংগ্রেসের সভাপতি এবং সর্বেসবা—প্রকৃতপক্ষে ডিমোক্রাসীর পরিবর্তে কংগ্রেস প্যাটেলের ডিক্টেটরশিপ বা একাধিপত্যের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। সেদিক থেকে প্যাটলের জনসাধারণকে চালনা করবার ও তাদের ওপর কর্তৃত্ব করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এ কথা সকলেই স্বীকার করবে। কংগ্রেসের অবস্থা তখন অনেকটা জার্মানীর নাৎসী পার্টির মতই। এখানেও ডিক্টেটরশিপের পূর্বাভাষ দেখা দিচ্ছে। মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও কার্যতঃ কংগ্রেসের ক্রিয়াকলাপ বিপরীত দিকে চলতে বসেছে। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে সুভাষবাবুকে ফ্যাসিষ্টপন্থী বলে তাঁর মতবাদকে যে ডিক্টেটরশিপের জয়গান বলে কংগ্রেস মিথ্য। আক্রমণ করবার চেষ্টা করছে কংগ্রেস অপর দিকে পরোক্ষভাবে সেই ডিক্টেটরশিপের দিকেই এগিয়ে চলেছে।

 গান্ধী-অনুপ্রাণিত কংগ্রেসের এই দলীয় প্রভাব খুব শক্তিশালী হয়ে উঠলেও কংগ্রেস সোশ্যালিষ্ট পার্টি বা সমাজতান্ত্রিক কংগ্রেস দলের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা একেবারে অগ্রাহ্য করবার মত নয়। সুভাষবাবু যদিও সকল বিষয়ে এদের সঙ্গে একমত ছিলেন না তবু তিনি লিখেছিলেন, বর্তমানে সমাজ তান্ত্রিক দল যে পন্থা অবলম্বন করছে তাতে তারা বিশেষ অগ্রসর হতে পারবে না। দলের সংগঠন বিসদৃশ উপদানের সংমিশ্রন মাত্র এবং কয়েকটা মত আবার একালের উপযুক্ত নয়। কিন্তু এই দল গঠনের মূলে আছে যে প্রেরণা তা সম্পূর্ণ যুক্তি সঙ্গত। এই বামপন্থী দল থেকেই পরিশেষে এমন একটি নতুন পূর্ণবিকশিত দল বেরিয়ে আসবে যার স্পষ্ট আদর্শ এবং নির্দিষ্ট কর্মসূচী ও পদ্ধতি জানা আছে।...তবে তাদের সাহায্য করবার মত অনেক লোকের সাহচর্য থেকে তারা এখন বঞ্চিত। যখন তাদের সাহচর্য তারা পাবে তখন তারা আরও প্রবল ভাবে অগ্রসর হতে পারবে।

 পরবর্তীকালে, সুভাষবাবু সম্পূর্ণ মুক্তি পাবার পর (১৯৩৭) থেকে এই সমাজ তান্ত্রিক দল আদর্শের দিক থেকে অনেক বিষয়ে পরস্পর বিরোধী হলেও সুভাষবাবুর সঙ্গে সাহচর্য বজায় রেখে চলেছিল। বস্তুত পক্ষে এই সমাজতান্ত্রিক দলের নেতারা—যথা, জয়প্রকাশ নারায়ণ, নরেন্দ্র দত্ত প্রভৃতি—কখনও সুভাষবাবু আবার কখনও জওহরলালের পথ অনুসরণ করে আসছেন।

 দেখা যাচ্ছে সুভাষবাবু কংগ্রেস হাই কমাণ্ডকে যতদূর আক্রমণ করেছেন তার তুলনায় সমাজতান্ত্রিক দলকে একটু যেন সমর্থনই করে আসছিলেন। কিন্তু কমিউনিজমের বিরুদ্ধে তিনি রীতিমত বিষোদ্গার করে এসেছেন। তিনি যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কেন কমিউনিজম আমাদের দেশে চলতে পাবে না। যথা—(১) কমিউনিজমের মধ্যে জাতীয়তাবাদের সমর্থন নেই। অথচ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শ জাতীয়তাবাদ। (২) বর্তমান সময়ে রাশিয়ার সর্বদেশীয় বিপ্লবের কোন চেষ্টা নেই বরং সে ধনতন্ত্রবাদ রাজ্যদের সঙ্গে চুক্তি করছে আদান প্রদান করছে। (৩) ভারতবর্ষে ধর্মের সঙ্গে বিরোধিতা অসম্ভব। রাশিয়ায় অধার্মিকতা ও নাস্তিকতা যে রকম বিস্তার লাভ করছে ভারতবর্ষে সেরকমটা আশা করা যুক্তি সঙ্গত নয়। (৪) যদিও এক শ্রেণীর লোক ভারতে কমিউনিষ্ট প্রচারিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস করবে তবু আর সকলে এমন কি এই শ্রেণীর লোকেরাও বস্তুতন্ত্রবাদকে সমর্থন করতে পারবে না। (৫) যদিও পরিকল্পনাদি অর্থনৈতিক ব্যাপারে কমিউনিজম যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়েছে তবু মুদ্রা সংক্রান্ত বিষয়ে তা মোটেই কোন নতুন পথের ইঙ্গিত দিতে পারে নি যাতে এ বিষয়ে সুব্যবস্থা হতে পারে।

 সুভাষবাবুর কমিউনিজমের বিরুদ্ধে এই সব মতামতের ফলে ইং ১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের অধিবেশনে কমিনটার্ণ সমস্ত জগতের কমিউনিষ্ট দলদের এই জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধাচরণ করতে আদেশ দেয়। এর ফলে কংগ্রেসের মধ্যেও কমিউনিষ্টদের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু, সে কথা বর্তমানে অবান্তর।

 সুভাষবাবুর ইউরোপে থাকাকালীন তাঁর জীবনে দুটি দুর্যোগ ঘটে। প্রথম হল তাঁর প্রবাসজীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু ও সহায়ক বিঠলভাই প্যাটলের পরলোক গমন। গোড়া থেকেই তাঁর শরীর অসুস্থ ছিল তারপর ১৯৩৩ সালের মাঝামাঝি তিনি পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃতদেহ ভারতে পাঠানো হয়। সুভাষবাবু মার্সেল্‌স্ বন্দর পর্যন্ত মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন।

 দ্বিতীয় দুর্যোগ সুভাষবাবুর পিতৃবিয়োগ। অসুখের সংবাদ পেয়েই তিনি কোলকাতা যাত্রা করলেন। ঠিক যেদিন তিনি এসে পৌঁছলেন সেদিনই তাঁর বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। তিনি তাঁর বাবার শেষকৃত্যে যোগ দিতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত। শ্রাদ্ধাদি করবার জন্যে তিনি একমাস এখানে থাকবার অনুমতি চেয়েছিলেন কিন্তু এক সপ্তাহের বেশী তাঁকে থাকতে দেওয়া হোল না। তাও এই সাতদিন কড়া পুলিশ নজরে তাঁকে থাকতে হয়েছিল। তবু তিনি লিখেছিলেন, ‘বিদেশে স্বাধীনভাবে বিচরণ করার চেয়ে দেশে আবদ্ধ থাকা অনেক ভাল।’ কিন্তু তবু তাঁকে রাখা হল না। যাবার আগে সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলে গেলেন, দেশে এখন রাজনৈতিক পঙ্কিলতা চলছে, আমাদের সমস্যা এখন জনসাধারণের মনে অনুপ্রেরণা চির জাগ্রত রাখা।

 কোলকাতা থেকে ফিরে তিনি রোমে কিছুদিন ছিলেন। এই রোমে থাকবার সময় তাঁর মনের মধ্যে আবার একটা পরিবর্তন আসে, আবার একটা প্রচণ্ড শক্তিব উৎসদ্বার খুলে যায়। তিনি রোমে মুসোলিনীর সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর কর্মপদ্ধতি, শৃঙ্খলা ও শাসন ব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হন! মুসোলিনীর রোম সাম্রাজ্যের স্বপ্ন ইটালীর তরুণ সম্প্রদায়ের মনে দোলা জাগিয়েছিল। তরুণের সম্রাট সুভাষচন্দ্র এই বিরাট পরিকল্পনায় যে অভিভূত হবেন তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তবে এর কারন সাম্রাজ্যলিপ্সা নয়,—এই একটি জাতি সাম্রাজ্যবাদী বৃটেন ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যে মাথা তুলে দাঁড়াবার কল্পনা করে — বৃটেনের স্বভাবশত্রু সুভাষচন্দ্র তাতে উৎসাহিত বোধ না করে পারেন কি? তিনি কল্পনা করতেন তাঁর নিজের দেশের তরুণের দল এমনি ভাবে সামরিক শিক্ষা পাবে, শক্তি সঞ্চয় করবে, এগিয়ে যাবে। যেখানে বীর্য আর শৌর্যের প্রশ্ন সেখানেই বীর নেতা সুভাষচন্দ্রের মন আকৃষ্ট, অভিভূত।

 রোমে থাকতে আফগানিস্থানের দেশপ্রেমিক রাজা আমানুল্লার সাথে সুভাষবাবুর পরিচয় হয়। আমানুল্লা ভারতের কংগ্রেস-আন্দোলন ব্যাপারে অত্যন্ত সহৃদয়তা ও উৎসাহের সঙ্গে সুভাষবাবুর সঙ্গে আলাপ করেন। সুভাষবাবু আমানুল্লার সঙ্গে মিশে যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছিলেন।


 এদিকে ১৯৩৬ সালের কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনের দিন এগিয়ে আসছে। নির্বাচিত-সভাপতি জওহরলাল নেহরু সুভাষবাবুকে এই অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে আমন্ত্রণ জানালেন। সুভাষবাবুরও খুব ইচ্ছা ছিল ভারতে ফিরবার। কিন্তু ভারত সরকার জানিয়ে পাঠালেন যে সুভাষবাবু ভারতে পদার্পণ করলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে।

 সুভাষবাবুর সম্মুখে দুটি প্রশ্ন, এক, দেশের ডাকে সাড়া না দিয়ে শাসকের অন্যায় হুমকী মাথা নীচু করে মেনে নেওয়া আর দুই, দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে কারাবরণ করা।

 এই দ্বিতীয় পথে পা বাড়াতে তিনি একটুও দ্বিধা করলেন না। এবং যাবাব আগে এই বিষয়ে ম্যাঞ্চেষ্টার গার্ডেন পত্রিকায় এক জোরালো প্রবন্ধ লিখলেন।

 এগারোই এপ্রিল ১৯৩৬। হাজারে হাজারে নরনারী এসে সমবেত হয়েছে সমুদ্র সৈকতে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে সম্বর্ধনা জানাতে। কিন্তু মাটিতে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে সুভাষবাবু গ্রেপ্তার হলেন। বৃটিশ আর যাই হোক সাধারণ ভদ্রতা জ্ঞান তার আছে, সে কথা রাখতে জানে।

 বহুদিনের অনশনক্লিষ্ট আর্তের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে গেল নির্লজ্জ বঞ্চক।

 যাবার আগে, বহু দুর্যোগের পরে প্রথম সূর্যালোকের মত তাঁর বাণী ধ্বনিত হয়ে উঠলো—Keep the flag of freedom flying!—স্বাধীনতার ধ্বজা চির-উড্ডীন করে রাখো।

 সে রক্তের ডাকে রক্তিম হয়ে উঠলো ভারতের হৃদয়-আকাশ!

 সারা ভারতবর্ষ জুড়ে বৃটিশের বর্বর আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের তুফান তুললো। সেই ঝড়ের ছোঁওয়া গিয়ে পৌঁছলো হাউস অব কমন্‌সে পর্যন্ত! ভারত-সচিব বললেন সুভাষচন্দ্র হিংস-আন্দোলনের সহিত যুক্ত আছেন।

 কিন্তু, কোন-অজুহাত টিকলো না। শেষ পর্যন্ত সরকার পক্ষ ১৯৩৭ সালে সুভাষচন্দ্রকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলেন।

 কারামুক্তির পর কিছুদিন কোলকাতায় থাকবার পর স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য তিনি কিছুদিন ডালহৌসীতে গিয়ে রইলেন। এরপর কিছুদিনের জন্যে তিনি আবার ইউরোপ যাত্রা করলেন। লণ্ডনে তাঁকে বিরাট এক সম্বর্ধনা সভায় অভিনন্দিত করা হল। তিনি ইউরোপের চারদিকে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে লাগলেন। বক্তৃতার উদ্দেশ্য ১৯৩৭ সালের শাসন সংস্কারের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ চালানো।