নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ/জীবনের ধারা (১)

অভী অভী হুংকার নাদিত প্রচণ্ড সংগ্রাম নৃত্যম বন্দে ভারত ভানু সুভাষম

জীবনের ধারা

 সূর্য ওঠে। শত ঝড়, শত ঝঙ্কা, শত অভিশপ্ত রাত্রির শেষে সূর্য ওঠে পূর্ব দিগন্তে। সূর্য ওঠে চিরলাঞ্ছিত, দুর্ভিক্ষপীড়িত এই বাঙ্গলার মাটিতে ভারতের পূর্ব সীমান্তে।

 রত্নগর্ভা এই দেশ। যুগে যুগে কত মানুষ-সূর্যের অভ্যুদয় হয়েছে এই দেশে, যারা সকল সন্ধিক্ষণে এসে দাড়িয়ে সমস্ত ভারতকে ডাক দিয়েছেন বৃহত্তর জীবনের দিকে, বৃহত্তর মানবতার পানে। শত দুর্ভিক্ষ শত মহামারীতেও যার ক্ষয় নেই, শেষ নেই। এ সেই বাঙ্গলার আকাশেই এক নতুন সূর্যের অভ্যুদয়—শতাব্দীর সূর্য, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।

 এবারের সূর্যের কিন্তু দক্ষিণায়নের পালা। তাই সে উঠলো একটু দক্ষিণ ঘেঁষে—কটকে। তারিখটা প্রত্যেক বাঙ্গালীরই মনে ১৮৯৭ সাল—বেলা দেড়টার সময় এক নতুন শিশু চোখ মেললো আলোর জগতে। সেই শিশুই যে একদিন ভারতের আঁধার আকাশে আলো দেখিয়ে নিয়ে যাবে উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের পানে, কে জানতো? কে জানতে এই কোমল শিশুর মধ্য দিয়ে একদা জন্ম নেবে বিপ্লবের সুর?

 সুভাষচন্দ্রের বাবা রায় বাহাদুর জানকীনাথ বস্তু উড়িষ্যার রাজধানী কটকে ওকালতি করতেন। তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও অসামান্য প্রতিভা বলে তিনি ওখানকার শ্রেষ্ঠ আইন ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলেন। তাছাড়া তিনি অনেক দিন পাব্লিক প্রসিকিউটর ও জিলা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান রূপে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সুভাষচন্দ্রের মহাভাগ্যবতী জননী প্রভাবতী দেবী অত্যন্ত সরলপ্রাণা ও ধর্মভাবপরায়ণ মহিলা। তার সংশিক্ষার গুণে সুভাষচন্দ্রের ভাই বোনেরা সহজ সরল ও অনাড়ম্বর পরিবেশের মধ্যে মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। বহু মহামানবের জীবনে যেমন দেখা গিয়াছে সুভাষচন্দ্রের জীবনেও তেমনি দেখা যায় যে তার এই বিরাট প্রতিভার পশ্চাতে রয়েছে তার মাতার স্নেহ, শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। এবং তাব মায়ের স্বভাবগুণেই সুভাষের জীবনের ওপর সাধারণ ধর্মভাব খুব প্রভাব বিস্তার করেছিল। আধুনিক জগতের বহু বিপ্লবী জননায়কের জীবনে যেমন দেখা যায যে তাদের জীবনে শুধু একটা দিকই বড় হয়ে দেখা দেয়,—বিপ্লব, কিন্তু সুভাষচন্দ্রের বাহিক জীবনের পশ্চাতে রয়ে গেছে একটা স্বভাব কোমল অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ একটি সহজ সুন্দর অধ্যায়। এই দিক থেকে সুভাষের জীবনের সঙ্গে অনেকে স্ট্যালিনের জীবনের মিল খুঁজে পেয়েছেন। স্ট্যালিনও অত্যন্ত ধর্মভাবের আবহাওয়ার মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার মায়ের কাছ থেকে তিনি ধর্মানুপ্রেরণা পেয়েছিলেন খুবই। এমন কি তার মায়ের ইচ্ছা ছিল যে স্ট্যালিন বড় হয়ে একজন ধর্মযাজক হবেন। কিন্তু এইখানেই স্ট্যালিনের মায়ের ও সুভাষের মায়ের মধ্যে প্রভেদ। সুভাষের মা কোনদিন চান নি যে সুভাস বড় হয়ে ধর্মনায়ক হয়ে উঠবে, তিনি চেয়েছিলেন তার কনিষ্ঠ পুত্র সুভাষ অন্যান্য কৃতী সন্তানদের মতই সকল দিকে সাফল্যলাভ করবে। তবে সমস্ত ব্যবহাবিক জীবনের পশ্চাতে এক সহজ সুন্দর ধর্মভাব আরও মহত্তর সার্থকতার দিকে মানুষকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়— -এই যে ভারতীয় সাধনার মূল নির্দেশ এইটেই তিনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন সুভাষের জীবনে। এবং সেই দিক থেকে সুভাষের জীবনে এই আদর্শের এতটুকুও ব্যতিক্রম দেখা যায় নি।

 সুভাষচন্দ্রের আরও ছয়জন ভাই—সকলেই তার থেকে বড়, জীবিত সকলেই জীবনে লব্ধ প্রতিষ্ঠ—কেউ আইন ব্যবসায়, কেউ চিকিৎসাবিদ্যায়। তাই কিশোর সুভাষ যখন প্রোটেষ্ট্যাণ্ট ইউরোপীয়ান স্কুলে গিয়ে ভর্তি হলেন তখন আর একটি সফলকাম জীবনের সম্ভাবনা দিবালোকের মত স্বচ্ছ হয়ে উঠলো। কিন্তু কেউ কি আশা করতে পেরেছিল এই কিশোরের জীবন সমস্ত ভারতীয় জীবনকে এক নতুন দিবালোকে উজ্জ্বল করে তুলবে?

 প্রোটেষ্ট্যাণ্ট ইউরোপীয়ান স্কুল খুব অভিজাত স্কুল ঐ অঞ্চলে। অত উচ্চস্তরের স্কুলে সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ছেলেদের পড়া সম্ভব নয়। কিন্তু সুভাষচন্দ্রেব বাবার অবস্থা সকল দিক দিয়েই খুবই অভিজাত। তাই তাকে ঐ স্কুলে থেকেই প্রথম জীবনেব লেখাপড়া সমাপন করতে হয়েছিল। সেই সময়ে তার মনে এই দিক দিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল কি না তা কিশোর জীবনে প্রকাশ পাওয়াব সুযোগ পায় নি। তবে কলেজ জীবনে তার আত্মপ্রকাশ আমরা পরে জানতে পারবো।

 এই স্কুলে সাত বছর পড়বার পর প্রাইমারী পড়া শেষ করে সুভাষচন্দ্র র‍্যাভেনশ কলোজিয়েট স্কুলে এসে ভর্তি হলেন। এবং এখান থেকেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন। এই সব বড়লোকের ইস্কুলে—বড়লোক ছেলেদের সঙ্গে পড়েও তাঁর এই কৃতিত্বে সকলে অবাক হয়ে গেল। কারণ এই রকম বিলাসী আবহাওয়ার মধ্যে সচরাচর এমনটা ঘটে না। তাছাড়া তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় পড়ার বই ছাড়া অন্যান্য নানা ধরণের বই পড়ে কাটত। সেই সব বইয়ের মধ্যে ধর্মপুস্তকের সংখ্যাই বেশী। গোড়ার দিকেই বলেছি তিনি ছোটবেলা থেকেই ধর্মভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। তার। পর স্কুলে এসে হেডমাষ্টার বেণীবাবুর সাহচর্যে তিনি আরও বেশী উৎসাহিত হযে উঠলেন। বেণীবাবুই তাকে প্রথম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন। তাছাড়া তার একটি সহপাঠী বন্ধু ছিল—যার নাম হেমন্ত। এই হেমন্ত তার চিরকালের সাথী হয়ে উঠেছিল পরবর্তী যুগে। কলেজী জীবনে যেমন দিলীপ রায়।

 একদিকে মা, অন্যদিকে বেণীবাবু আর সর্বদা বন্ধু হেমন্তের সাহচর্য, এই তিনের সমন্বয়ে তার জীবনের ধারা এগিয়ে চললল স্বাভাবিক বিকাশের দিকে। কিন্তু এ সবার পশ্চাতে আর একটি আদর্শ পুরুষ ধ্রুবতারকার মত স্থির ঔজ্জ্বল্য নিয়ে আপাত প্রচ্ছন্ন থেকে তাকে পথ দেখাতে লাগলেন। তিনি শুধু পুরুষ নন, তিনি পুরুষসিংহ বিবেকানন্দ। এই একটি মানুষ যিনি ধর্ম ও দেশপ্রেমকে এক অপূর্ব মিশ্রনের মধ্য দিয়ে এক বৃহত্তর পরিণতির দিকে জাগ্রত করে তুলেছিলেন। এই লোকটিকে প্রথম থেকেই অন্তরের সঙ্গে শ্রদ্ধা করতে শিখেছিলেন সুভাষচন্দ্র! প্রথমে তার প্রভাব প্রচ্ছন্ন হয়ে কাজ করতো, তারপর তিনি যখন ম্যাটিক পাশ করে ১৯১৩ সালে কোলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে এসে ভতি হলেন তখন থেকেই তিনি ভালভাবে বিবেকানন্দকে এবং রামকৃষ্ণপরমহংসকে জানতে সুরু করলেন। ফলে, তার মনের মধ্যে অদ্ভুত রকমের এক পরিবর্তন এল। মুক্তির পিপাসা জাগলো। এই বস্তুতান্ত্রিক জড়-জীবন থেকে এক মহত্তর সত্যের আস্বাদ পাবার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। এবং শেষে ১৯১৪ সালে শীতের সময় তিনি সমস্ত সম্পদ, সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে হিমালয়ের উদ্দেশ্যে বেরিষে পড়লেন বাড়ী ছেড়ে। কত ঋষি, সাধক হিমালয়ের দুর্গমে তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন, সত্য উপলব্ধি করেছেন, তাই তিনিও সঙ্কল্প করলেন হিমালয়ের নির্জনতাব মধ্যে সাধনা করতে হবে। তাছাড়া সেখান থেকেই কোন সাধককে বেছে নিয়ে গুরু করতে হবে। গুরু না হলে ত’ সাধনা সম্ভব নয়।

 এমনি করেই ভারতের ইতিহাসে আর এক বালক বৃদ্ধ সমস্ত ঐশ্বর্যকে হেলায় ত্যাগ করে সেই একমাত্র সত্যকে অর্জন করবার জন্যে যাত্রা করলেন। সুভাষচন্দ্রের বয়স তখন মোল বছর মাত্র।

 ভারতের আধুনিক রাজনৈতিক জগতের কোন জননায়কের জীবনে এমনটি দেখা যায়? এত অল্প বয়সে এতবড় আকাক্ষার ক্ষুধা - এতবড় সাধনার দুর্দমনীয় বল?

 কিন্তু, ব্যর্থ হতে হল। অনেক ঘুরলেন তিনি। পাহাড়ে-পবতে বনে-জঙ্গলে, রাত্রির পর রাত্রি একা একা ঘুরলেন শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে, দিনের পর দিন কাটালেন সামান্য ফলমূল খেয়ে, তারপর ঘুরলেন তীর্থে তীর্থে,—গয়া, বৃন্দাবন, কাশী-কিন্তু কোথাও তাঁর মনের মানুষের সন্ধান পেলেন না। দেখলেন ধর্মগুরুর নামে কতগুলো লোক চারিদিক থেকে অন্যের ধন লুটে খাচ্ছে—কিছু দেবাব মত সম্বল ও সাহস কোনটাই তাদের নেই। সাধারণ মানুষ যাদের দুয়ার কাছে বিভ্রান্ত মন নিয়ে হাত পাতে, তারা সাধারণ মানুষের চেয়ে মনের সম্পদে মোটেই যে জড়-জীবনকে ত্যাগ করতে তিনি চেয়েছিলেন তার মধ্যে তাব। আরও বিজড়িত হয়ে ডুবে আছে। তাই দু'মাস পর তিনি ফিরে এলেন।

 যে সুভাষের ওপর তার মা-বাবা অনেক কিছু আশা করেছিলেন, আশ করেছিলেন তার অন্যান্য ভাইদের মত সুভাষচন্দ্রও একদিন বিদ্যায়, অর্থে যশী হয়ে উঠবেন, মস্ত বড় সরকারী পদে অধিষ্ঠিত হয়ে নিজের প্রতিষ্ঠা অর্জন করে নেবেন—সেই সুভাষ যখন বিবাগী হয়ে বেরিয়ে পড়লেন বাড়ী ছেড়ে তখন তার মা-বাবার মন যেন ব্যর্থতায় ভেঙ্গে গেল। এমনটি ত’ তারা প্রত্যাশা করেননি তার কাছ থেকে।

 একদিন তাঁরা বাড়ীর সকলে ড্রয়িং রুমে বসে আলাপ করছেন এমন সময়ে হঠাৎ তাদের মাঝখানে এসে হাজির হলেন সুভাষচন্দ্র। বহু ঝড়-তুফান ভয করে তরী এসে পাড়ে ভিড়লো। উৎসাহে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলেন সকলে। শোনা যায় সুভাষচন্দ্র যখন মাকে প্রণাম করলেন তখন তিনি তাকে জড়িযে ধরে বলেছিলেন, তুই আমায় মারবি সুভাষ!

 আত্ম-মুক্তির সন্ধানে বনজঙ্গল ঘুরে তিনি একদিন ফিরে এসেছিলেন মাবে কোলে। কিন্তু সমস্ত ভারতবাসীর মুক্তির সন্ধানে তিনি যে মহাপ্রস্থান করেছেন -সেই মহাপ্রস্থানের পরে আবার তিনি যবে ফিরবেন সেদিন আর তার স্নেহময়ী জননীর কোল তিনি পাবেন না। সেই কোল পাতবেন দেশজননী তার সোণব মাটির অঙ্গে অঙ্গে! সেদিন আর কতদূর? মুগ্ধ বাঙ্গালী তার দিন গুনছে!

 এতখানি অত্যাচার তাঁর শরীরে সইলো না। তাই ফিরে এসে কিছুদিন তিনি টাইফয়েডে ভুগলেন। সেরে উঠতে বেশ কিছুদিন লাগলো। তাই ১৯১৫ সালে সাধারণভাবে প্রথম বিভাগে তিনি এফ. এ. পাশ করলেন, প্রেসিডেন্সী থেকে।

 কিন্তু বি. এ. পড়বার সময় দুর্যোগ দেখা দিল। এ বাধা এল আর এক দিক থেকে। জীবনের গোড়া থেকে তিনি দু’দিক দিয়ে নিজেকে গড়ে তুলছিলেন। এক ধর্মের দিক, আর অপরটা হল দেশপ্রেম। ধর্মের দিক থেকে এক অধ্যায় হয়ে গেল এফ. এ. পড়বার সময়। দেশপ্রেমের দিক থেকে প্রথম আত্মঘোষণা দেখা গেল এইবার।

 সেই সময়ে প্রেসিডেন্সী কলেজে ওটেন নামে একজন ইউরোপীয় অধ্যাপক ছিলেন। অধ্যাপনার ক্ষেত্রেও যারা শাসক ও শাসিতের প্রভেদ ভুলতে পারে না তাদের নীচতা সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্র প্রথম সজাগ হয়ে উঠলেন এই ওটেনের ব্যবহারে। ওটেন সাহেব কি একটা কারণে একদিন শুধু গালাগাল নয়, একটি ছাত্রকে চড় মেরে বসলেন। ভাবটা তার এই যে, যারা পরাধীন তাদের আবার আত্মসম্মান কি, তারা ত’ চড় খাবেই। রুদ্ধ অপমানে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো ছাত্রের দল। কিন্তু এদের মধ্যেই ছিল একজন যে অদূর ভবিষ্যতে শুধু প্রতিবাদের দৃপ্তকণ্ঠে নয়, রীতিমত কামানের বজ্রনিনাদে সমস্ত অবিচার আর জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ঘঘাষণা করবে—বুকের রক্তের বন্যা দিয়ে ধ্বসিয়ে দেবে অন্যায়ের স্তৃপ! বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন সুভাষচন্দ্র। জাতির আত্মসম্মানের মূল্য তার কাছে সবচেয়ে বেশী। সেই আত্মসম্মানকে পদদলিত করতে তিনি দিতে পারেন না। এই ক্ষুদ্র ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত অপমান নয়, এ সমস্ত ছাত্রজাতির—সমস্ত ভারতবাসীর হতচেতন আত্মার সম্মান। এই অসম্মানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে।

 সকলে সাড়া দিলে এই আন্দোলনে। সুভাষের নেতৃত্বে সকলে গোপনে এসে জড় হল। ধর্মঘট চললো। এবং শেষে কলেজ কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে ছাত্রদের সঙ্গে মিটমাটের একটা ব্যবস্থা করলেন। ছাত্রদের স্বপক্ষেই তা হল। কিছুদিনের মত এই অধ্যাপকটি সাবধান হয়ে রইলেন। কিন্তু স্বভাব অত সহজে বদলায় না মানুষের। আর একদিন তিনি সেই পূর্ব ঘটনার পুনরভিনয় করে বসলেন। ফলে ছাত্ররা ওটেনকে ধরে বেশ করে প্রহার করলে। এবং সুভাষচন্দ্র এই বিদ্রোহের নেতা হিসেবে দু’বছরের জন্যে বহিষ্কৃত হলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার সঙ্গে আরও দু’জন ছাত্রের ওপর এই দণ্ডাজ্ঞা দেওয়া হল।

 মধ্যপ্রদেশ ও বেরার ছাত্র সম্মেলনের সভাপতিত্ব করবার সময় এই ঘটনার উল্লেখ করে সুভাষচন্দ্র বলেন—প্রিন্সিপাল আমাকে বলেছিলেন, তুমি কলেজের যত নষ্টের গোড়া। আমার জীবনে সে এক স্মরণীয় দিন। সেই প্রথম আমি একটা মহৎ কাজের জন্য লাঞ্ছনা ভোগের আনন্দ উপভোগ করি। এই আনন্দের কাছে অন্য আনন্দ নিষ্প্রভ হয়ে যায়।

 সামান্য দু’বছর বহিষ্কার দণ্ড। সামান্য এই বীজ থেকে ফুলেফুলে সমৃদ্ধ কতবড় মহীরুহ জন্ম নেবে পরবর্তীকালে, তার সুপ্ত সম্ভাবনা ঘুমিয়েছিল এর মধ্যে। তারপর আরও বিস্তৃত পরিধি—শুধু সীমাবদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নয়—ভারতের সীমানাবও বাইরে বছরের পর বছর নিবাসন।

 ১৯১৭ সালে স্যর আশুতোষের মধ্যস্থতায় তিনি আবার বি. এ. পড়বার জন্যে ভতি হলেন স্কটিশচার্চ কলেজে। সেখানে অবশ্য নিবিরোধেই তার পড়াশোনা চলেছিল। এবং ১৯১৯ সালে যথারীতি তিনি প্রথম শ্রেণীর অনার্স নিয়ে দর্শনশাস্ত্রে বি. এ. পাশ করলেন। প্রথম শ্রেণীতে তিনি দ্বিতীয় হয়েছিলেন। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় বাহিনীর উৎপত্তি হয়। তিনি এই বাহিনীতে যোগ দিয়ে স্বভাবসুলভ দক্ষতা দেখিয়েছিলেন।

 বাঙ্গলায় অগ্নিযুগ তখন সবেমাত্র শেষ হয়েছে। সবেমাত্র ঠিক বলা যায় না, তবুও সেই যুগ যে ইন্ধন জুগিয়েছিল—যে-ভাবে জাগিয়ে তুলেছিল সমস্ত দেশকে তারই রেশ নিয়ে সমস্ত দেশব্যাপী আন্দোলন আর বিক্ষোভ চলেছে শাসকের এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে। অসহায় নিরন্তু নরনারীর ওপর সশস্ত্র অত্যাচার চলেছে বৃটিশ শাসনের চরম কলঙ্ক রক্তের কর্দমে পঙ্কিল হয়ে উঠলো জালিওয়ান-ওয়ালাবাগের পটভূমিতে। এর সঙ্গে সঙ্গে চলেছে খিলাফৎ আন্দোলন। মহাযুদ্ধের কত শত ত্যাগ ও আত্মবলিদানের বিনিময়ে ভারত পেয়েছে রাওলাট বিল। বিভ্রান্ত মানুষ চিনতে শিখেছে ইংরাজ শাসকের স্বরূপকে। দেশের সমস্ত নেতা প্রায় কারারুদ্ধ। মুক্তির আহ্বানে জোয়ার জেগেছে সমস্ত যুবকের রক্তে। সেই অসম্ভব উন্মাদনার যুগে বিপ্লবী সুভাষের মনে যে জাগরণের ঢেউ উঠবে সেটা আন্দাজ করতে একটুও দেরী হয়নি তার অভিভাবকদের মনে। এই জাগরণের পরিণাম ও বিস্তার যে কত সুদূর প্রসারী সেটাও তারা আশঙ্কা করেছিলেন। তাই তারা সকলে মিলে সাব্যস্ত করলেন সুভাষকে এমন একটা পড়ায় ডুবিয়ে রাখতে হবে যাতে তিনি অন্য কোনদিকে মাথাঘামাবার অবসর না পান। শেষটা ঠিক হল বিলাতে পাঠিয়ে আই. সি. এস. পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করাই ভাল। আই. সি. এস. প্রায় কঠিনতম পরীক্ষা। তার ওপর বিলাতের আবহাওয়ার মধ্যে পড়লে, সেখানকার অবাধ স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসের পরিবেশের আস্বাদ পেলে আপনা থেকেই সুভাষের মন থেকে এই সব বিপ্লবের স্বপ্ন বিদায় নেবে, মিলিয়ে যাবে। তাদের এ ধরণের ধারণাটা নেহাৎ অসঙ্গত নয়। কারণ পাশ্চাত্য জীবনের বাহ্যিক আড়ম্বরের মধ্যে বহু লোকের জীবনে এরকম পরিবর্তন এসে থাকে। সেই ঐশ্বর্যের জৌলুসের এমনই একটা আকর্ষণী ক্ষমতা আছে।

 কিন্তু, সুভাষচন্দ্র তার সতর্ক বিবেক দিয়ে এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারলেন। এই বিলাস ও স্বাচ্ছন্দ্যের সামান্যতম আকর্ষণের ইঙ্গিত আসবার বহু আগে তার ডাক এসে গেছে আর একদিক থেকে—অনাড়ম্বর অন্তরের ধ্রুব দিক সে।

 তিনি জানতেন আই. সি. এস পাশ করে হাকিমের চাকরী নিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জনের লোভে নিজেকে বিদেশীর হাতে বিকিয়ে দেওয়া তার কাজ নয়। সে-পথ তার জন্যে নয়। সে-পথে পা বাড়ালে তার নিজের পথ থেকে বহুদূরে সরে দাঁড়াতে হবে, তখন হয়ত ফিরে আসবার সুযোগ আর থাকবে না। তাছাড়া এই দেশব্যাপী আন্দোলনের মাঝখানে তার প্রয়োজন আছে, তার স্থান আছে, শুধু স্থান নয়, তিনি বিশ্বাস করতেন বিশিষ্ট স্থান আছে।

 কিন্তু তবু তাঁকে যেতে হল। অভিভাবকদের পরামর্শ তিনি এড়াতে পারলেন। বন্ধুবর হেমন্ত বললে যে এই একটা বড় সুযোগ। এই সুযোগে তিনি জগতকে দেখে আসতে পারেন-স্বাধীন জগতের আসল পরিচয়...!

 বিলেতে গিয়েও তিনি তার মনের দ্বন্দ্বকে জয় করতে পারেন নি। তিনি লিখতেন যে তিনি জোর করে মনকে রাজী করালেও অন্তর থেকে সায় দিতে পারেন নি। একদিকে পড়ে রইলো নিজের দেশ... আদর্শের জন্যভূমি...কর্মক্ষেত্র আর অন্যদিকে স্বাধীন দেশের মুক্ত হওয়া...মুক্ত জীবন। একদিকে দারিদ্র-পীড়িত...দুর্ভিক্ষ বিধ্বস্ত...ভগ্নস্বাস্থ্য নরনারীর দল অন্যদিকে আনন্দ ও জীবনের তরঙ্গে অবাধ ভেসে-যাওয়া পূর্ণস্বাস্থ্য মানুষের দল...!...একদিকে নিপীড়িত নির্যাতীত হৃতসর্বস্ব মানুষের কঙ্কাল আর অন্যদিকে শাসক-শ্রেণীর অপহৃত ধনে ভোগের বিচিত্র সমাবেশ!...

 এক নতুন দৃষ্টি দিয়ে চিনতে শিখলেন সুভাষ নিজের দেশকে। সে দৃষ্টি বুঝি অস্বচ্ছ হয়ে গেল চোখের জলে!

এই সময় থেকেই তাঁর মনে নানারকম সঙ্কল্পের উদয় হতে থাকে। তিনি ভাবতে আরম্ভ করেন তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার কথা। এবং বিলেতে যে আবহাওয়ার আকর্ষণে তার মন শান্ত হয়ে যাওয়ার কল্পনা তার অভিভাবকেরা করেছিলেন সেই আবহাওয়ার মধ্যে পড়েই তাঁর মনে বিদ্রোহের আগুন দ্বিগুণভাবে জ্বলে উঠলো। এই সময় তার ইংরাজবিদ্বেষ এমন বেড়ে গিয়েছিল যে তিনি লিখেছিলেন, যখন দেখি শ্বেতাঙ্গ লোকেরা আমার জুতো বুরুশ করছে তখন আমার সবচেয়ে বেশী আনন্দ হয়।’

 এই সময়ে লণ্ডনে শ্রীমতী রায় ও শ্রীমতী নাইডু খুব সুন্দর সব বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। সুভাষচন্দ্র এই সব বক্তৃতায় আকৃষ্ট হয়ে লিখেছিলেন, এসব শুনে মনে হয় যে-দেশে এই সব মহিলার জন্ম হতে পারে সে-দেশের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল হয়ে পারে না।

 লণ্ডনে থাকবার সময়ে তিনি খুব সংযতভাবে এবং যথাসম্ভব স্বল্পব্যয়ে থাকতেন। কিন্তু তার সাজসজ্জায় ও চালচলনে এতটুকুও কেতাদুরস্ততার অভাব দেখা যেত না। ১৯২৯ খৃষ্টাব্দে মাত্র নয় মাসের মধ্যেই তিনি আই. সি. এস. পরীক্ষায় খুব কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করে চতুর্থ স্থান অধিকার করলেন এবং ইংরাজীতে প্রথম হলেন। ইতিমধ্যে কেম্বি জ থেকে নীতি বিজ্ঞানে ট্রাইপোজ উপাধি লাভ করেছিলেন। এই দুটো সম্মানই যে কোন ভারতীয়ের পক্ষে গৌরবের বিষয়। কিন্তু তিনি নিজে আই. সি এস পরীক্ষার এই কৃতকার্যতায় হতাশ হয়ে পড়লেন। তিনি লিখলেন, আমার দুভাগ্য যে আমি এতে পাশ করেছি। সত্যি সত্যিই তার আশঙ্কা হয়েছিল যে শেষে বাধ্য হয়েই তাকে চাকরী নিতে হবে। তাই চাকরী পাওয়ার পর তিনি অনেক চেষ্টায় পদত্যাগ পত্র দাখিল করে সেটা মঞ্জুর করিয়ে নিলেন। তিনি লিখেছিলেন, একই সঙ্গে দু’জন মনিবের সেবা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দু’জন মনিব অর্থে—এক: ইংরাজ সরকার আর দুই: আমার দেশ।

 ভোগের উপচারকে ত্যাগ করে তিনি বরণ করে নিলেন আত্মত্যাগের ব্রত।

 দেরী করবার সময় নেই। তাই যেদিন জাহাজ এসে ভিড়লে বোম্বাই বন্দরে সেইদিনই বিকেলে (১৬ই জুলাই ১৯২১) সুভাষচন্দ্র দেখা করলেন মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে! বোম্বাই সহরে মণিভবনে গান্ধীজীর সঙ্গে সুভাষের এক ঘণ্টারও বেশী সময় আলোচনা চললো তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে। অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করবার, অনেক কিছু বোঝবার ছিল তার। গান্ধীজী তখন ভারতের একছত্র নেতা। তার আবির্ভাবে নতুন এক দ্বার খুলে গেছে স্বাধীনতার যুদ্ধের। নতুন পথ। সুভাষচন্দ্রের সেই পথ সম্বন্ধে অনেক কিছু পরিষ্কার করে বোঝাবার ছিল। কিন্তু অনেক আশা নিয়ে এলেও কথাবার্তার পর তিনি যখন বেরিয়ে এলেন গান্ধীজীর কাছ থেকে, তখন দেখা গেল তিনি হতাশ হয়েছেন। গান্ধীজীর উত্তরে তার মন আশ্বস্ত হয় নি একেবারে।

 সুভাষচন্দ্র ফিরে এলেন কোলকাতায়। ফিরে এসে দেখা করলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন তখন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা, শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বীর। ভারতের মুক্তি সংগ্রামের একমাত্র জ্বলন্ত প্রতীক। বাংলার মুকুটহীন সম্রাট! তাই সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীর কাছে হতাশ হয়ে দেখা করতে এলেন দেশবন্ধুর সঙ্গে। তরঙ্গমুখর নদী মোহনার মুখে এসে সাগরের সম্মুখে হাত পেতে দাড়ালো! চির যুবক দেশবন্ধু এই বিপ্লবী যুবকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

 এই মিলনের প্রয়োজন ছিল। কারণ গান্ধীজীর মতের সঙ্গে যখন সুভাষের মিল হল না তখন একমাত্র দেশবন্ধু ছাড়া আর এমন কোন লোক তখন ছিলেন যিনি সুভাষের মত বীরকে চালনা করতে পারেন। অবশ্য গান্ধীজীর মতবাদ তখন সারা ভারতবর্ষে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে কিন্তু বাঙ্গলাদেশে দেশবন্ধুর আদর্শই একমাত্র আদর্শ। তাছাড়া সুভাষচন্দ্র নিজে বলেছেন যে গান্ধীজীর কথাবার্তা তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। তার মনে হয়েছে গান্ধীজীর কর্মপন্থা যথেষ্ট নিদিষ্ট নয়। তার মধ্যে অনেক অস্পষ্টতা আছে এবং যার ফলে সেই পথে ভারত তার লক্ষ্যস্থলে পৌছতে পারবে না।

 কিন্তু দেশবন্ধুর আদর্শে তিনি সম্পূর্ণ অভিভূত হয়ে পড়লেন। তার মন অন্তর থেকে সাড়া দিয়ে উঠলো। সেইদিন থেকে সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুগামী। জীবনে একমাত্র দেশবন্ধু ছাড়া আর কারও নেতৃত্ব এমনভাবে তাকে বরণ করে নিতে দেখা যায় নি।

 সুভাষবাবু যখন রীতিমত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নামলেন, তখন দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। গান্ধীজীর ডাকে সমস্ত দেশ সাড়া দিয়ে উঠেছে। অনেক ডাক্তার, আইন ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। যে সব ছাত্রেরা বিতাড়িত হচ্ছে কলেজ থেকে তাদের নিয়ে অনেকগুলো প্রদেশে জাতীয় কলেজ স্থাপনা করা হয়েছে। বাঙ্গলাদেশে জাতীয় কলেজের ভার ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ওপর। চিত্তরঞ্জন দেখলেন সুভাষচন্দ্রের ওপর এই ভাব দেওয়া গেলে খুব ভাল কাজ হবে। কারণ সুভাষচন্দ্র বিলেতে থাকবার সময় ওখানকার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে খুব বেশীরকম জানবার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি জানতেন দেশে ফিরে গিয়ে তাকে কাজে নামতে হবে এবং কাজে নামতে হলে প্রথমেই দেশের যুবকদের আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষিত করে তোলা দরকার। তাই ওখানে নিজের ব্যক্তিগত পড়াশোনার চেয়ে তিনি জোর দিয়েছিলেন জাতিগঠনের মালমশলা সংগ্রহের দিকে। জাতীয় কলেজের ভার হাতে পেয়ে সুভাষবাবু খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। তিনি তার নিজের কর্মপন্থা অনুযায়ী দেশের যুবকদের গড়ে তুলতে লাগলেন। আর সবার পেছনে দেশবন্ধু নিজে সকল বিষয়ে তাঁর বিরাট অভিজ্ঞতা ও বিবেচনা শক্তির সাহায্যে প্রেরণা দিয়ে চললেন সুভাষবাবুকে। এই কলেজে শুধু পুথিগত বিদ্যা নয় ছাত্রের আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম ও চরিত্রনিষ্ঠার শিক্ষা পেতে আরম্ভ করলে। তাই সাধারণ কলেজ থেকে এই জাতীয় কলেজের ছাত্রেরা অনেক বিষয়ে উন্নততর হয়ে উঠতে লাগলো।

 যুবকদের নিয়ে জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হল। এই বাহিনীর পুরোভাগে রইলেন সুভাষচন্দ্র নিজে। সরকার পক্ষ এতদিন চুপ করে দেখছিলেন সুভাষচন্দ্রের কাজ কতখানি সম্ভব হতে পারে। কিন্তু ক্রমে ক্রমে সুভাষবাবুর দল যখন সংখ্যায় অত্যন্ত বেশী বেড়ে উঠতে লাগলো এবং তার তত্বাবধানে তারা অদ্ভুত বকমের শিক্ষিত হয়ে উঠতে লাগলো তখন কর্তৃপক্ষ বুঝলেন এখনই এই বাহিনী ভেঙ্গে দেওয়া দরকার। এবং তার সুযোগও এসে গেল।

 এই সময় কথা হল রাজপুত্র প্রিন্স অব ওয়েলস্ ভারত পরিভ্রমণে আসছেন। সরকার থেকে হুকুম দেওয়া হল তার জন্যে সমস্ত দেশ সজ্জিত করা হবে। কিন্তু মহাত্মাজী আদেশ দিলেন প্রিন্স অব ওয়েলসের আগমনে ভারতবাসীর পক্ষে আনন্দ জয়ধ্বনি করার কিছুই নাই। যে ইংরাজ মহাযুদ্ধে ভারতের অসামান্য ত্যাগের মর্যাদা দেয় নি সেই ইংরাজসিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীর আগমনে সর্বদেশব্যাপী হরতাল পালন করতে হবে। সরকার পক্ষ বললেন যে, রাজপুত্র আসছেন ভারতকে তার অসামান্য ত্যাগের জন্য ধন্যবাদ জানাতে। কিন্তু এ প্রবঞ্চনায় দেশবাসী বিভ্রান্ত হল না। প্রিন্স অব ওয়েলস যেদিন এসে নামলেন বোম্বাই বন্দরে সেদিন চতুর্দিকে হরতাল পালিত হল।

 ২৫শে ডিসেম্বর প্রিন্স অব ওয়েলসের কোলকাতা আসবার কথা। কোলকাতাও বোম্বাই সহরের পুনরভিনয়ের জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল। তাই সরকার তাড়াতাড়ি জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে বেআইনী বলে ঘোষণা করে দিলেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও খিলাফৎ দল প্রতিবাদ জানালো। ফলে বহু কংগ্রেস নেতা, দেশবন্ধু স্বয়ং, তার পুত্র, স্ত্রী, মৌলনা আবুল কালাম আজাদ ও সুভাষচন্দ্র গ্রেপ্তার হলেন। এবং তাদের বিভিন্ন পর্যায়ে কারাদণ্ড হল। শোনা যায় দেশবন্ধু গ্রেপ্তার হবার সময় বলেছিলেন, আমায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাতে কি হয়েছে? সমস্ত দেশ আজ কারারুদ্ধ! তার মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

 তাই হল বাস্তব ক্ষেত্রে। যেদিন প্রিন্স অব ওয়েলস এসে পৌছলেন কোলকাতায় সেদিন সহর শুদ্ধ হরতাল। পথ ঘাট লোকশূন্য। পতাকা উড়ছে বটে সৌধে সৌধে কিন্তু সে পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক নয়—সে পতাকা কৃষ্ণবর্ণের। এমনি করেই বাঙ্গলা দেশ অভ্যর্থনা জানালো তাদের ভবিষ্যৎ অধীশ্বরকে।

 ছয়মাস কারাদণ্ড হল সুভাষ বাবুর। এই প্রথম তার কারাবাস! তিনি আশা করেছিলেন ছয়মাসের বেশী কারাদণ্ড হয়ত তাকে ভোগ করতে হবে। কিন্তু কার্যত তা হয়নি দেখে তিনি বলেছিলেন, মাত্র ছ'মাস? আমি কি ছিঁচকে চোর নাকি?

 ছয়মাস পুরো কারাবাসের পর ১৯২২ সালে সুভাষবাবু আবার কর্মক্ষেত্রে এসে নামলেন। অবশ্য এবারে তার কর্মক্ষেত্র রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে গড়ে উঠলো না। এই সময়ে বাঙ্গলাদেশে বিরাট প্লাবনে বহু ঘরবাড়ী ভেসে গিয়েছিল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পরিচালনায় একটি সাহায্য সমিতি খুলে প্রায় ৪ লক্ষ টাকা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে সুভাষ বাবু জনসেবায় বাপিয়ে পড়লেন। এই সময় তার এই অক্লান্ত সেবা দেখে সকলেই বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছিল। লর্ড লিটন নিজে ব্যক্তিগতভাবে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন এবং তাঁর কাজের সুখ্যাতি করেছিলেন।

 এই রকম জনহিতকর কাজের দিকে বরাববই তার ঝোঁক দেখতে পাওয়া যায়। অনেক সময়ে দুর্ভিক্ষ বন্যা প্রভৃতি দুর্যোগে তাকে সেবা করতে দেখা গিযেছে। শুধু তাই নয় জেলে (মান্দালয়ে বা অন্যত্র) থাকাকালীন বন্ধুদের সহিত পত্রালাপের মধ্যে তিনি বারবার সমাজসেবা ও দুঃস্থ-সেবার প্রতি জোর দিতেন। এবং এ বিষয়ে তিনি কতদূর যে আগ্রহশীল ছিলেন তা তার চিঠিপত্রের ভাব ও ভাষার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পেত। শুধু সেবা নয়, তিনি চেয়েছিলেন প্রত্যেক দুঃস্থ নর-নারীকে স্বাবলম্বী করে তোলবার মত যথাসাধ্য কার্যকরী শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এই বিষয়ে জেলের মধ্য থেকেই সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা তিনি পাঠাতেন। এমন কি আজাদ হিন্দ ফৌজের ইতিহাস আলোচনার সময়েও আমরা দেখতে পাই যে, বাঙ্গলার দুর্ভিক্ষের সময়ে তিনি এক লক্ষ টন চাল পাঠাবার চেষ্টা করেছিলেন।

 এই এর পর ইতিহাসবিখ্যাত কংগ্রেসের গয়া অধিবেশন। এবং স্বরাজ পার্টির জন্ম। এই অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস। সাধারণ বাৎসরিক অধিবেশন হলেও এই গয়া কংগ্রেসের খুব বেশী রকম গুরত্ব ছিল। সভাতেই স্থির হয় যে কংগ্রেস ব্যবস্থাপক সভায় যোগদান করে সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করবে কিনা? চিত্তরঞ্জন জোর দিয়ে ঘোষণা করলেন যে ব্যবস্থাপক সভায় যোগ দিলে কংগ্রেস আরও সহজে তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবে, বয়কট করে শুধু অসহযোগ করে সে রকম ফল পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ দেখা গেল একদিকে গান্ধীর দল আর অন্যদিকে চিত্তরঞ্জন-সুভাষচন্দ্রের দল। এই ঘরোয়া বিবাদের ফলেই স্বরাজ পার্টির উৎপত্তি। চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্বে গঠিত এই দল স্থির করলে যে এইদল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবে। এবং এই দলের মুখপত্র স্বরূপ দেশবন্ধু নৃতন একখানা ইংরাজী দৈনিকপত্র বের করলেন। সেই কাগজের নাম হল ফরওয়ার্ড এবং এই কাগজের ভার পড়লো সুভাষচন্দ্রের ওপর।

 এখানে প্রশ্ন ওঠে সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীর বিরুদ্ধে এই স্বতন্ত্র দল গড়ে তুললেন কেন? তার উত্তরে বলা যায় যে বরাবরই তিনি গান্ধীজীর পন্থার ওপর আস্থা রাখতে পারেন নি। উপরন্তু এই অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার মূলে আছে গান্ধীজীর অস্বাভাবিক রকমের আত্মবিশ্বাস। তিনি হয়ত অন্যান্য নেতাদের মত নিলে ভাল করতেন। তবে একথা সুভাষবাবু বার বার স্বীকার করেছেন যে গান্ধীজীর দান অসামান্য। এবং কংগ্রেসের সমস্ত নেতা বা সাধারণ কর্মী প্রত্যেকেই মাথা নত করে গান্ধীজীর বিরাট ব্যক্তিত্ব শ্রদ্ধাভরে স্বীকার করবে। তবে প্রয়োজনের তাগিদে এমন দিন এসেছে যখন এই স্বরাজ পার্টি গান্ধীজীকে রাজনৈতিক জীবন থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য করবে।

 প্রকৃত পক্ষে হলও তাই। সমস্ত প্রদেশে স্বরাজ পার্টি প্রবল ও জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। এবং নির্বাচনে দেখা গেল কি কেন্দ্রীয় কি প্রাদেশিক সকল সভাতেই স্বরাজ পার্টি বিপুল জয়লাভ করেছে। এই জয়লাভের মূলে ছিলেন দেশবন্ধু নিজে এবং সুভাষ পরিচালিত পত্রিকা ফরওয়ার্ড। বাস্তবিক সুভাষবাবুর সুদক্ষ পরিচালনার গুণে এই কাগজ অতি অল্প দিনের মধ্যেই জনসাধারণের মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। স্বরাজ পার্টির জয় পরোক্ষে সুভাষচন্দ্রেরই জয়!

 এরপর ১৯২৪ সালে স্বরাজ পার্টি প্রথম কোলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করলো। ফলে দেশবন্ধু মেয়র এবং সুভাষচন্দ্র প্রধান কর্মকর্তার পদলাভ করলেন। এবং কোলকাতা কর্পোরেশনের দেখাদেখি অন্যান্য বড় বড় সহরেও এইরকম নির্বাচন চললে এবং স্বরাজ পাটি জয়লাভ করতে থাকলো।

 সুভাষচন্দ্রের কর্পোরেশনের প্রধান কর্মকর্তার পদগ্রহণ একটি স্মরণীয় ঘটনা। এর আগে এই পদের বেতন ছিল মাসিক তিন হাজার টাকা। সুভাষবাবু সেটা গোড়াতেই কমিয়ে দেড় হাজার করে নিলেন যাতে বাকী টাকাটা জনহিতকর কার্যে ব্যবহৃত হতে পারে। অবশ্য বাকী যে দেড় হাজার টাকা তিনি নিতেন সেই টাকার মধ্যে অধিকাংশই তিনি দান করে ফেলতেন। নিজের জন্যে প্রায় কিছুই থাকতো না বলতে গেলে। যাই হোক তিনি এবং দেশবন্ধু দু'জনে কর্পোরেশনের কর্মব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে ফেললেন। মুষ্টিমেয় শ্বেতাঙ্গদের হাত থেকে জনসাধারণের কর্পোরেশন জনসাধারণের হাতের মধ্যে এনে ফেললেন। সেদিন থেকেই ইংরাজ বুঝতে শেখে সুভাষচন্দ্রের শক্তি কতখানি। সুভাষবাবুর আদেশেই কর্পোরেশনের জনহিতকর কাজের পরিধি বেড়ে গেল। দরিদ্রদের জন্য অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডাক্তার খানা, দুগ্ধ-কেন্দ্র প্রভৃতি খোলা হতে লাগলো। কোলকাতার রাস্তাঘাট পার্ক প্রভৃতির নামকরণ হতে থাকলো দেশের নেতাদের নামে। বড় বড় নেতাদের সহরবাসীদের পক্ষ থেকে সম্বর্ধনার ব্যবস্থা হতে লাগলো। সব চেয়ে আনন্দের বিষয় এই যে কর্পোরেশনের অফিসের সাজপোষাক সমস্ত খদ্দরের হবে বলে স্থির করা হল। কর্পোরেশনের ইতিহাসে সে এক অভাবনীয় অধ্যায়। এই সব আশঙ্কা করেই বাঙ্গলা সরকার প্রথমে সুভাষবাবুকে এই পদে নিযুক্ত করতে চান নি। কিন্তু পরে জনসাধারণের ইচ্ছার চাপে করতে বাধ্য হন। যাই হোক সুভাষবাবু অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন।

 কিন্তু বাঙ্গালীর দুর্ভাগ্য যে বেশীদিন তারা সুভাষবাবুকে তাদের মধ্যে আর পেলে না। সুভাষবাবু সরকারের কোপদৃষ্টিতে পড়লেন। পড়া স্বাভাবিক কেন না দেশের এই সর্ববিধ উন্নতির চেষ্টা সহ্য করা আমাদের ইংরাজ শাসকদের ধর্ম নয়। তাই ২৫শে অক্টোবর ভোরবেলা অতর্কিতে পুলিশে সুভাষবাবুর বাড়ী ঘেরাও করলে। এবং তিনি স্পেশ্যাল অডিনান্সের বলে গ্রেপ্তার হলেন।

 দেশময় তুমুল আন্দোলন চললো। দেশবন্ধু কর্পোরেশনের তরফ থেকে প্রতিবাদ জানাতে লাগলেন। তিনি ঘোষণা করলেন বিনা বিচারে এমনিভাবে আটক রাখা সম্পূর্ণ বেআইনী। দেশশুদ্ধ লোক তাকে সমর্থন করতে লাগলো বিক্ষোভ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। এদিকে ষ্টেটম্যান আর ইংলিশম্যান এই দুখানা শ্বেতাঙ্গ-মুখপত্র সুভাষবাবুর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহী হিসেবে লেখালিখি সুরু করলে। তার ফলে জনসাধারণ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। কংগ্রেসের তরফ থেকে এই বিষয়ে ষ্টেটসম্যানের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা আনা হল। ষ্টেটম্যান লণ্ডনের ইণ্ডিয়া অফিসের শরনাপন্ন হল। ফলে কোনও রকম প্রতিকার হল না। এদিকে আন্দোলন উত্তরোত্তর বাড়তে লাগলো। এমনি সময়ে হঠাৎ একদিন বাঙ্গলা সরকার রাত্রের অন্ধকারের মধ্যে এ্যাসিসট্যাণ্ট ইন্সপেক্টর জেনারল অব পুলিশ মিষ্টার ললাম্যানের অধীনে একদল বন্দুকধারী পুলিশের পাহারায় সুভাষবাবুকে আরও সাত জন বন্দীর সঙ্গে মান্দালয় জেলে চালান করে দিলেন।

 শোনা যায় এই খবর শুনে সুভাষবাবুর বাবা বলেছিলেন—আমরা সুভাষের জন্যে গর্ব অনুভব করি।

১৭  মান্দালয়! বৃটিশ বর্বরতার শেষ পরিচয়। যার অন্ধকার কুঠুরীর মধ্যে কত মহাপ্রাণ তিলে তিলে জীবনের শেষ সম্বলটুকু ক্ষয় করে এসেছেন অন্যাযের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পুরস্বাব স্বরূপ! এই সেই মান্দালয় যেখানে লোকমান্য তিলকের মত লোককে বছরের পর বছর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হযেছিল। সুভাষবাবু নিজে লিখেছেন—“কিন্তু, এ বিষয়েও আমার নিশ্চিত ধাবণা যে মান্দালয় জেলে ছ’বছর বন্দী হয়ে থাকাটাই তার অকাল মৃত্যুর কারণ। তব অন্য স্থানে সুভাষবাবু বলেছিলেন, আমার স্পষ্ট মনে পড়ে যে এ সেই স্থান যেখানে তিলককে ছ'বছর কাটাতে হযেছিল আর লাজপত রায়কে এক বছর। এই ভেবেই আমরা সান্তনা পেয়েছিলাম যে যাই হোক আমরা তাদেব পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চলেছি, সে বিষয়ে আমরা গর্ব করতে পারি।

 ছাত্রবয়সে তাঁর বিদ্রোহী মনকে শান্ত করবার জন্যে তার অভিভাবকেরা তাকে বিলাত পাঠাতে চেয়েছিলেন। এবং পরে প্রমাণিত হল সে দিক দিযে তাদের ভুল হয়েছে। তবে তার থেকেও বড় ভুল করলেন ভারত সরকার তাকে মান্দালয়ে নির্বাসন দিয়ে। সুভাষবাবু এতদিন একনিষ্ঠ সেবকেব মত দেশবন্ধুকে অনুসরণ করে আসছিলেন। তিনি যে দিক থেকে দেশের মুক্তিব সম্ভাবনা চিন্তা করেছিলেন দেশবন্ধুর আদর্শ ছিল তদ্রুপ। তাই দেশবন্ধুর স্ববাজ পাটিতে কাজ কববার সময় সুভাষচন্দ্র স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন কর্মপন্থার পরিকল্পনা করবার মত যথেষ্ট অবসর পান নি। কিন্তু মান্দালয় জেলের নির্জনতা তাকে সেই সুযোগ এনে দিল। তিনি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন।

 প্রথমে জেলে গিয়ে জেলের মধ্যেই তিনি এক আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিলেন। তারা চেয়েছিলেন জেলের মধ্যে দুর্গা পূজা করবেন। দুর্গাপূজা বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ পর্মানুষ্ঠান কাজেই সরকারের বাধা দেওয়ার কোন অর্থ হয় না। কিন্তু তবু তারা যখন অনুমতি পেলেন না তখন তারা অনশন ব্রত সুরু করলেন। এই অনশনের সংবাদ দেশের মধ্যে কি ভাবে যেন ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই নিয়ে আবার দেশজোড়া আন্দোলন চললো। এদিকে দেশের জনসাধারণ ব্যাবস্থাপক সভার নির্বাচনে সুভাষবাবুকে মনোনীত করে বসল। তখন বাধ্য হয়ে সরকার পক্ষ অনশন ব্রতীদের সঙ্গে একটা সম্মানজনক করলেন।

 এর পর থেকে সুভাষবাবুর মনে ধীরে ধীরে একটা পরিবর্তন আসতে শুরু হয়। তিনি আরও গভীর ভাবে নিজেকে দেশের সঙ্গে সংযুক্ত রেখে চিন্তা কবতে আরম্ভ করেন। যদিও জেলের অনাচার অত্যাচারের মধ্যে তার শরীর ভেঙ্গে আসছিল তবু তার মনের বল যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময় তার লেখা কয়েকটা চিঠির কিছু কিছু অংশ উদ্ধৃত করে দেওয়ার প্রয়োজন বেধ করি। তাহলে তাঁর এই মনের পরিবর্তন ঠিকমত অনুধাবন করা যাবে।

 ‘আজ চৌদ্দমাস আমি জেলে। এর মধ্যে এগারো মাস কাটলো সুদৃব ব্রহ্মদেশে। সময়ে সময়ে মনে হয় যে, দীর্ঘ চৌদ্দমাস দেখতে দেখতে গেল, কিন্তু অন্য সময়ে মনে হয় যেন কত যুগ ধরে এখানে রয়েছি। ঘরবাড়ী; কারাগারের বাহিরের কথা যেন স্বপ্নের মত, প্রহেলিকার মত বোধ হয়; যেন ইহজগতে একমাত্র সত্য হচ্ছে লৌহের গারদ ও প্রস্তরের প্রাচীর। বাস্তবিক এ একটা নূতন বিচিত্র রাজ্য। আবার সময়ে সময়ে মনে হয়, যে জেলখানা দেখে নাই সে জগতের কিছুই দেখে নাই। তার কাছে জগতের অনেক সত্য প্রত্যক্ষীভূত হয় নাই। আমি নিজের মনকে বিশ্লেষণ করে দেখেছি যে, এইরকম চিন্তা ঈর্ষা প্রসূত নয়। আমি প্রকৃতপক্ষে জেলখানায় এসে অনেক শিখেছি; অনেক সত্য যাহা একসময় ছায়ার মত ছিল, এখন আমার নিকট সুস্পষ্ট হয়েছে, অনেক নুতন অনুভূতিও আমার জীবনকে সবল ও গভীর করে তুলেছে। যদি ভগবান কোনও দিন সুযোগ দেন ও মুখে ভাষা দেন-তবে সে সব কথা দেশবাসীকে জানাবার আকাঙ্ক্ষা ও স্পর্ধা আছে।

 ‘জেলে আছি—তাতে দুঃখ নেই। মায়ের জন্য দুঃখভোগ করা সে ত, গৌরবের কথা! Suffering-এর মধ্যে আনন্দ আছে, একথা বিশ্বাস করুন। তা না হলে লোক পাগল হয়ে যেত, তা না হলে কষ্টের মধ্যে লোক হৃদয়ের আনন্দে ভরপুর হয়ে হাসে কি করে? যে বস্তুটা বাহির থেকে Suffering বলে বোধ হয়—তার ভিতর থেকে দেখলে আনন্দ বলেই বোপ হয়।

 ‘আমার শুধু দুঃখ এই যে, চৌদ্দমাস কাল অনেকটা হেলায় কাটিয়েছি। হয়ত বাঙ্গলার জেলে থাকলে এই সময়ের মধ্যে সাধনার পথে অনেকটা এগুতে পারতুম। কিন্তু তা হবার নয়! এখন আমার প্রার্থন। শুধু এই, তোমার পতাকা যারে দাও তরে বহিবারে দাও শকতি। যখনই খালাসের কল্পনা করি তখন আনন্দ যত হয়, তাব চেবে বেশী ভয় হয়। ভয় হয পাছে প্রস্তুত হতে না হতেই কর্তব্যের অন এসে পৌছায়। তখন মনে হয়, প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত যেন খালাসের কথা না উঠে। আজ আমি অন্তরে বাহিরে প্রস্তুত নই, তাই কর্তব্যের আহ্বান এসে পৌছায় নাই। যেদিন প্রস্তুত হব সেদিন এক মূহুর্তের জন্যও আমাকে কেহ আটকে রাখতে পারবে না।

 ‘আমি যখন ধীরভাবে চিন্তা করি, তখন আমার নিঃসংশয় ধারণা জন্মে যে, আমাদের সমস্ত দুঃখ কষ্টের অন্তরে একটা মহত্তর উদ্দেশ্য কাজ করছে। যদি আমাদের জীবনের সকল মূহুর্ত ব্যাপে এই ধারণাটা প্রসারিত হয়ে থাকতে তাহলে দুঃখে কষ্টে আর কোন যন্ত্রণা থাকতো না এবং তাইতেই ত’ আত্মা ও দেহের মধ্যে অবিরাম দ্বন্দ্ব যুদ্ধ চলেছে।

 ‘সাধারণতঃ একটা দার্শনিক ভাব বন্দীদশায় মানুষের অন্তরে শক্তির সঞ্চার করে। আমিও সেইখানেই আমার পাঁড়াবার ঠাই করে নিয়েছি এবং দর্শন-বিষযে যতটুকু পড়া শশানা করা গেছে সেটুকু এবং জীবন সম্বন্ধে আমার যে ধারণা আছে তাও আমার বেশ কাজে লেগেছে। মানুষ যদি তার নিজের অন্তরে ভেবে দেখবার মত যথেষ্ট বিষয় খুজে পায়, বন্দী হলেও তার কষ্ট নেই, যদি তার স্বাস্থ্য অটুট থাকে; কিন্তু আমাদের কর্ম ত’ শুধু আধ্যাত্মিক নয়—সে যে শরীরেরও কষ্ট এবং প্রস্তুত থাকলেও, দেহ যে সময় সময় দুর্বল হয়ে পড়ে।......

 ‘একথা আমাকে বলতেই হবে যে, জেলের মধ্যে যে নির্জনতায় মানুষকে বা হয়ে দিন কাটাতে হয় সেই নির্জনতাই তাকে জীবনের চরম সমস্যাগুলি তলিয়ে বুঝবার সুযোগ দেয়। আমার নিজের সম্বন্ধে একথা বলতে পারি যে, আমাদেব ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত জীবনের অনেক জটিল প্রশ্নই বছর খানেক আগের চেে এখন যেন অনেকটা সমাধানের দিকে পৌছচ্ছে। যে সমস্ত মতামত এক সম নিতান্ত ক্ষীণভাবে চিন্তা বা প্রকাশ করা যেত, আজ যেন সেগুলো স্পষ্ট পরিব হয়ে উঠছে। অন্য কারণে না হলেও শুধু এই জন্যেই আমার মেয়াদ শেষ হয়। পর্যন্ত আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে, অনেকখানি লাভবান হতে পারব।’...

 ঠিক এমনি সময়েই বাঙ্গলার ভাগ্যাকাশে সবচেয়ে বড় দুর্যোগ ঘনিয়ে এল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন হঠাৎ পরলোক গমন করলেন। বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতই আঘাত করলে সমস্ত বাঙ্গালীজাতিকে এই নিদারুণ দুর্ঘটনা। বিশেষ করে আঘাত পেলেন সুভাষ চন্দ্র নিজে। তিনি প্রথম বোধ করলেন যে, তিনি-তথা বাঙ্গলাদেশ অভিভাবকহীন হল। তিনি বুঝ এবার সত্যিকারের নেতৃত্ব তার ওপর এসে পড়বে। বাঙ্গলার মধ্যে দলাদলি শুরু হবে। গান্ধী পন্থীর দল যাব এতদিন দেশবন্ধুর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের পাশে ম্লান হয়ে গিয়েছিল তারা আবার ক্ষমত। অধিকার করবার জন্যে মাথা তুলে দাঁড়াবে। এখন হয় স্বরাজ পার্টি ভেঙ্গে দিতে হবে আর না হয়ত যোগ দিতে হবে সেনগুপ্তের দলে। কোনটাই তার পক্ষে যুক্তি সঙ্গত নয়। অথচ যদি স্বরাজ পার্টিকে বজায় রাখতে হয় তাহলে তাকে নিজেকে ব্যবস্থা পরিষদে গিয়ে কাজ করতে হবে যা আজ পর্যন্ত তিনি করেননি।) মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত এসব প্রশ্ন ওঠে না তা তিনি জানতেন তাই সবার চেযে যেটা তাকে বেশী পীড়া দিতে লাগলো সে হল দেশবন্ধুর মৃত্যুতে বাঙ্গলার বিসে করে তার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি। দেশবন্ধুর কাছেই তিনি প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক জীবনের দীক্ষা নিয়েছিলেন। বহুদিন একসঙ্গে থেকেছেন এমন কি জেলের মধ্যেও আটমাস তারা একত্র ছিলেন এবং শেষ অক্ষরে অক্ষরে তিনি তার আদেশ পালন করে এসেছেন। যদিও, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত এক পত্রে তিনি লিখেছিলেন, অনেকে মনে করে সে, আমবা অন্ধের মত তাকে অনুসরণ করতুম। কিন্তু তার প্রধান চেলাদের সঙ্গে ছিল তার সব চেয়ে ঝগড়া। নিজের কথা বলতে পারি যে, অসংখ্য বিষয ত'র সঙ্গে ঝগড়া হত। কিন্তু আমি জানতুম যে, যত ঝগড়া করি না কেন—আমার ভক্তি ও নিষ্ঠা অটুট থাকবে—আর তাঁর ভালবাসা থেকে আমি কখনও বঞ্চিত হব না। তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, যত বড় ঝঞ্চা আসুক না কেন—তিনি আমাকে পাবেন তাঁর পদতলে। আমাদের সকল ঝগড়ার মিটমাট হত মার (বাসন্তী দেবীর) মধ্যস্থতায়। কিন্তু হায় “রাগ করিবার অভিমান করিবার জায়গাও আমাদের ঘুচে গেছে।’

 “আমি বোধ হয় খুব বেশীদিন এখানে থাকবো না। কিন্তু খালাস হবার তেমন আর আকা এখন আর নাই। বাহিরে গেলেই যে শ্মশানের শূন্যতা আমাকে ঘিরে বসবে—তার কল্পনা করলেই হদয়টা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। এখানে সুখে দুঃখে স্মৃতি ও স্বপ্নের মধ্যে দিনগুলি একরকম কেটে যাচ্ছে। পিঞ্জরের গরদের গায়ে আঘাত করে যে জাল। বোধ হয়—সে জ্বালার মধ্যেও যে কোনও এ পাওয়া যায় না—তা আমি বলিতে পারি না। যাকে ভালবাসি—যাকে অন্তরের সহিত ভালবাসার ফলে আমি আজ এখানে তাকে বাস্তবিক ভালবাসি এই অনুভূতিটা সেই আলার মধ্যেই পাওয়া যায়। তাই বোধ হয়, বদ্ধ দুষারের গরাদের গায়ে আছাড় খেয়ে হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত হলেও—তার মধ্যে একটা সুখ একটা শান্তি-একটা তৃপ্তি পাওয়া যায়। বাহিরের হতাশা বাহিরের শূন্যতা এবং বাহিরের দায়িত্ব,—এখন আর মন যেন চায় না।”

 দেশবন্ধুর অবর্তমানে বাঙ্গলা দেশে যে দলাদলি সুরু হয়ে গিয়েছিল জেলে থাকতে সুভাষবাবু সে খবর পেয়েছিলেন। এর জন্যে তাঁর মন অশান্তিতে ভরে উঠেছিল। তিনি একবার লিখেছিলেন, ‘বাঙ্গালী আজ অন্ধ, কলহ বিষাদে নিমগ্ন, তাই এই কথা বুঝিয়াও বুঝিতেছে না। নিঃস্বার্থ আত্মদানের কথা আর ত’ কোথাও শুনিতে পাই না। অত বড় একটা প্রাণ নিজেকে নিঃশেষে বিলাইয়া মহাশূন্যে মিলিয়া গেল; আগুণের ঝলকার মত ত্যাগ মূর্তি পরিগ্রহ করিয়া বাঙ্গালীর সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করিল; সেই দিব্য আলোকের প্রভাবে বাঙ্গালী ক্ষণিকের জন্য স্বর্গের পরিচয় পাইল; কিন্তু আলোকও নিভিল, বাঙ্গালীও পুরাতন স্বাথের গণ্ডীতে আশ্রয় লইল। আজ বাঙ্গলার সবত্র কেবল ক্ষমতার জন্য কাড়াকাড়ি চলিতেছে। যার ক্ষমতা আছে—সে ক্ষমতা বজায় রাখিতেই ব্যস্ত। যার ক্ষমত। নাই সে ক্ষমত। কাড়িবার জন্য বদ্ধপরিকর। উভয় পক্ষই বলিতেছে, ‘দেশোদ্ধাব যদি হয়, তবে আমার দ্বারাই হউক, নয় তো হইয়া কাজ নাই। এই ক্ষমতালোলুপ রাজনীতিকবৃন্দের ঝগড়া বিবাদ ছাড়িয়া, নীরবে আত্মোৎসর্গ করিযা যাইতে পারে, এমন কর্মী আজ কি বাঙ্গলায় আর নাই?’

 তবে, এই মানসিক দুশ্চিন্তার সুফল যে কিছু ছিল না, তা নয়। এর ফলেই তিনি দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বিশেষ করে চিন্তা করতে আরম্ভ করেন। এবং তিনি কিষাণ-মজুর-ও-ছাত্র আন্দোলনের পরিকল্পনা করতে শুরু করেন।

 ইতিপূর্বেই তার স্বাস্থ্য ভাঙ্গতে শুরু হয়েছিল। ১৯২৭ সালের এপ্রিল মাস বরাবর তিনি একেবারে প্রায উত্থান-শক্তি-রহিত হয়ে পড়লেন। তিনি ব্রঙ্কোনিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন এবং এবং তার চলিশ পাউণ্ড ওজন হ্রাস পেয়েছিল। এই সময়ে তার শারীরিক অবস্থা গুরুতর দেখে সরকার থেকে তাঁকে রেঙ্গুণে স্থানান্তরিত করা হল এবং তার দাদা ডাঃ সুনীল বস্তু ও লেফটন্যাণ্ট কর্ণেল কেলসাল সাহেবকে পাঠানো হল তাকে ভালভাবে পরীক্ষা করবার জন্যে। তাঁরা দুজনেই মত দিলেন যে তাঁকে সুইটজারলণ্ডে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার। তাঁদের যুক্ত সুপারিশ অনুয়ায়ী সরকার পক্ষ বললেন যে তিনি নিজের ব্যয়ে সুইটজারলণ্ডে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পাবেন তবে সরাসরি রেঙ্গুণ থেকেই তাঁকে যাত্রা করতে হবে, ভারতবর্ষে ফিরতে পারবেন না। সুভাষবাবু উত্তর দিলেন যে এই জেলের মধ্যে তিনি মতে প্রস্তুত আছেন তবু এই সর্তে তিনি রাজী হতে পারবেন না। এই মর্মে তিনি তার দাদা শরৎচন্দ্র বসুকে যে চিঠি লিখেছিলেন তা সত্যিই প্রণিধানযোগ্য। তর শেষাংশ উদ্ধৃত করে দেওয়া গেল।

 ‘বর্তমান ঘটনার সর্বাপেক্ষা মন্দ ফল কি হইতে পাবে, তাহাও আমি চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি, কিন্তু তথাপি আমি মনে স্থির করিয়াছি, জন্মভূমি হইতে চিরকালের জন্য নির্বাসন অপেক্ষ। জেলে থাকি মৃত্যু বরণ করাই শ্রেযঃ। এই অশুভ ভবিষ্যতের কথা ভাবিযাও আমি নিরুৎসাহ হই নাই। কারণ, কবিব উক্তিতে আমি বিশ্বাস কবি:—গৌরবের পথ শুধু মৃত্যুর দিকে লইয়া যায়। মুক্তিলাভের পূর্বে আমাদিগকে ব্যক্তিগতভাবে ও সঙ্ঘবদ্ধভাবে অনেক কষ্ট সহ করিতে হইবে। ভগবানকে ধন্যবাদ দিই যে আমি নিজে শান্তিতে আছি এবং সম্পূর্ণ নির্বিকার ভাবে সকল অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হইবার জন্য প্রস্তুত আছি। আমাদের সমগ্র জাতির কৃত পাপের জন্য আমি প্রায়শ্চিত্ত করিতেছি-ইহাতেও আমাদেব তৃপ্তি। আমাদের চিন্তা ও আদর্শ অমর হইয়া থাকিবে।

 ‘আমাদের মনোবৃত্তি জাতির স্মৃতি হইতে কখনও মুছিয়া যাইবে না, ভবিষ্যৎ বংশধরগণ আমাদের প্রিয় কল্পনার উত্তরাধিকারী হইবেন, এই বিশ্বাস লইয়া আমি চিরদিন সকল প্রকার বিপদ ও অত্যচার হাসিমুখে বরণ করিয়া লইয়া কাল কাটাইতে পারিব।’...

 এর পর সরকার ‘বাহাদুর’ আর তাকে আটক রাখতে সাহস করলেন না। ১৬ই মে ১৯২৭ সালে তিনি সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ করলেন।

 কিন্তু এই কি সেই সুভাষ? ভগ্নস্বাস্থ্য—শীর্ণদেহ—যৌবনের সেই দীপ্তি অনেক খানি ম্লান হয়ে এসেছে-সাম্রাজ্যবাদীর নিষ্ঠুর নির্যাতনে তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে আসছে জীবনীশক্তি।...

 এ যেন মানুষ নয়, দেশমাতৃকার চরণে অঞ্জলি বদ্ধ প্রাণের অর্ঘ্য মাত্র।

 বহুদিন পর বহু সরস শ্যামল উর্বর মাঠ পার হয়ে প্রত্যাশিত পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘ যখন মরুভূমির ওপরের আকাশকে সমাচ্ছন্ন করে ঘনিয়ে এল, তখন অনেক জল তার মরে গেছে। অনেক মেঘ তার ঘূর্ণি বাতাসে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে গেছে। আহত, স্তব্ধ মরুর মাটি তাব হলুদ তৃষ্ণার সমুদ্র নিয়ে চেয়ে রইলো সেই মেঘের পানে নিনিমেষ মিনতি নিয়ে।

 তবু, দু’চার ফোঁটা লেবও প্রয়োজন আছে মরুর বুকে।

 প্রয়োজন আছে ক্ষয়গ্রস্ত সুভাষের সামান্যতম কম প্রচেষ্টার। ‘বন্ধু’হারা বাঙ্গালীর প্রয়োজন আছে সত্যিকারের কল্যাণকামীর!

 আন্দোলন শুরু করে দিলেন সুভাষচন্দ্র। এবারের আন্দোলন কিষাণ মজুর আর ছাত্রদের নিযে। এব আগে কিষাণ-মজুরদেব নিয়ে আন্দোলন করে নি কংগ্রেস। ১৯১৮ সালে মহাত্মাজী অবশ্য আহমেদাবাদে মজুরদের নিয়ে একবার আন্দোলন করবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সে আন্দোলন বেশীদিন স্থায়ী হয় নি। তারপর সুভাষবাবুর বন্দীজীবনের সময়ে কমিউনিষ্ট ও এম এন রায়েব দল আন্দোলন চালাবার চেষ্টা কবেছিল বটে কিন্তু সে আন্দোলন ঠিক ভারতের জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যোগ ছিল না। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুও কিছুটা আন্দোলন করবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তার আলোচনা ও মতবাদ এত জটিল ও সূক্ষ্ম যে সাধারণে তা সহজে গ্রহণ করতে পারেনি। তাই এই সময়ে সুভাষবাবুর প্রয়োজন ছিল। তিনিই প্রথম কংগ্রেসের পতাকাতলে কিষাণ মজুরদের জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে তুললেন। দলে দলে তার আন্দোলনে যোগ দিতে লাগল সকলে।

 এই বছর সুভাষবাবু জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে কংগ্রেসের যুগ্ম-সম্পাদকরূপে নিযুক্ত হলেন।

 এর পর ১৯২৮ সাল। এই বৎসর লাক্ষ্ণৌতে সর্বদলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল নেহরুর কমিটি অনুমোদিত রিপোর্টটি মেনে নেওয়া। এই রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছিল যে কংগ্রেসের লক্ষ্য হবে ডোমিনয়ান স্টেটাস বা ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন তবে এর বিরুদ্ধে যে সব দল পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করবেন তারাও তাদের মত অনুযায়ী কংগ্রেসের দলভুক্ত থেকেই কাজ করতে পারবেন। সুভাষচন্দ্র এই নেহরু কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ করলেন। তার সঙ্গে এসে দাড়ালেন পণ্ডিত জওহরলাল ও শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার। এই তিনজনে যে একটা দল গঠন করলেন তার নাম হল Independence League বা স্বাধীনতা সঙ্ঘ।

 তাছাড়া এই বছরেই সাইমন কমিশন প্রেরিত হয়। কংগ্রেস ঠিক করলেন কৃষ্ণ পতাকা উত্তোলন ও বয়কট দিয়ে তারা দেশব্যাপী প্রতিবাদ জানাবেন এই কমিশনের বিরুদ্ধে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র চাইলেন শুধু বয়কট নয়, নিষ্ক্রীয় কর্মপন্থা নয়—এই সুযোগ নিয়ে দেশব্যাপী বিপ্লব শুরু হোক। তিনি গান্ধীজীকে অনুরোধ করলেন সকলের পুরোভাগে দাড়িয়ে এই আন্দোলন পরিচালনা করতে। সুভাষবাবু সেদিন ঠিকই অনুমান করেছিলেন যে এই হচ্ছে বিপ্লব সুরু করার সুবর্ণ সুযোগ। পরবর্তীকালে সেই আন্দোলন ১৯৩০ সালে গান্ধীজী সুরু করেছিলেন কিন্তু সুভাষবাবুর পরামর্শ মত কাজ করতে পারলে ৯২৮ সালেই সেই আন্দোলন শুরু হয়ে যেতে। তাতে আমাদের মুক্তি সংগ্রাম আরও দুই বছরের জন্যও এগিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হল না। সুভাষবাবু গান্ধীজীর মত পেলেন না। অথচ সেই বছর ক্রমান্বয়ে, মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক সম্মেলন, নিখিল-বঙ্গ ছাত্র সম্মেলন, নিখিল-ভারত যুব-কংগ্রেস প্রভৃতি এতগুলো সভা সমিতিতে যোগ দিয়ে বক্তৃতা দিয়ে সুভাষবাবু অনেকটা জনসাধারণের মনের অবস্থা সম্বন্ধে জানতে পেরেছিলেন। তিনি বার বার উপলব্ধি করেছিলেন যে জনসাধারণ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। তাছাড়া তিনি ঐসময়ে জনসাধারণের সামনে তাঁর নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত কর্মপন্থার কথাও ভাল করে তুলে ধরেছিলেন। তিনি জানতেন সকলে সে পন্থা গ্রহণ করবে। সেই সময়েই তিনি প্রথম গান্ধীবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন সক্রিয় কর্মপন্থা চাই, পণ্ডিচেরী আশ্রমের অরবিন্দ ঘোষ এবং সবরমতি আশ্রমের গান্ধীজীব নিচ্ছিয় প্রতিবাদের পন্থা দিয়ে আর চলবে না।

 কিন্তু তবু গান্ধীজী বললেন যে দেশ আন্দোলনের জন্য তৈরী নেই।

 যাই হোক এর পর কোলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনের দিন ঘনিয়ে আসছে। কংগ্রেস নেতারা অনুমান করেছিলেন এইখানে হয়ত বামপন্থীদের সঙ্গে সত্যিই বোঝাপাড়া করতে হবে। তাই গান্ধীজী বললেন যে বামপন্থীদের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী মেনে নেওয়া হবে তবে সবটা নয়, তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বললেন কোনও রকম সত না দিয়েই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী মেনে জওহরলালও খুব জোরালো বক্তৃতা দিয়ে সমর্থন করলেন। ফলে গান্ধীজীর হঁটাই প্রস্তাব ভোটে অগ্রাহ্য হয়ে গেল। গান্ধীজী এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতাবা বামপন্থীদের শক্তি সম্বন্ধে যথেষ্ট সজাগ হয়ে উঠলেন।

 এরপর কথা উঠলে কংগ্রেসের আগামী সভাপতি নির্বাচন নিয়ে। সকলেই বোধ করেছিলেন যে এই সময় এমন একজন সভাপতির প্রয়োজন যিনি দক্ষতা ও বিচক্ষণব সঙ্গে কংগ্রেসের মধ্যে এই দলাদলির মীমাংসা করতে পারবেন। সেইজন্য গান্ধীজীর নাম প্রস্তাব করা হল। কিন্তু গান্ধীজী এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজী হলেন না। কারণ তিনি অত্যন্ত কূটনৈতিক নেতা। তিনি তার দূরদৃষ্টির বলে জানতে পারলেন এই সময়ে পণ্ডিত জওহরলালকে সভাপতি করতে পারলে বামপন্থীদের মধ্যে অনেকটা ভাঙ্গন এসে যাবে। হলও তাই আসলে। সভাপতি নির্বাচিত হবার পর পণ্ডিতজী বামপন্থীদের আদর্শ ত্যাগ করে দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে একটা মিটমাটের চেষ্টা করতে লাগলেন। শুধু তাই নয়, এই ১৯২০ সাল থেকে বরাবর জওহরলাল গান্ধীজীর একনিষ্ঠ অনুগামী হয়ে আছেন।

 ডিসেম্বার মাসে লাহোর অধিবেশন হবার কথা হল। কিন্তু তার আগেই বড়লাট আরুইন গোল টেবিল বৈঠকের কথা ঘোষণা করলেন। তাছাড়া আরও বললেন যে ১৯১৭ সালের ঘোষণা অনুযায়ী সহজেই প্রতীয়মান হয় যে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত শাসনই ভারতের শাসন ব্যবস্থার চরম পরিণতি।

 এই ঘোষণা শুনে দিল্লীতে সর্বদলীয় সম্মিলনের নেতারা মিলিত হলেন এবং বড়লাটের নিকট এই মর্মে এক স্মারকলিপি:পাঠালেন যে তারা ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন করার বিষয়ে সরকার পক্ষের সহিত সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছেন। জওহরলালও তাতে সই করলেন। এদিকে সুভাষবাবু একটা বিরুদ্ধ ঘোষণাপত্র তৈরী কবে পাঠালেন। তবু শেষ পর্যন্ত গান্ধীজী, মতিলাল নেহরু এবং ভি, জে, প্যাটেল আরুইনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে গেলেন। কিন্তু তাদেব ফিরতে হল ভগ্নমনোরথ ও শূন্য হাত নিয়ে। মহাত্মাজী নাহোর কংগ্রেসে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী নিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন কবলেন কিন্তু তার সঙ্গে আর একটি লাইন যুক্ত করে দিলেন এই মর্মে যে, মহামান্য বড়লাট বাহাদুর যে দৈবক্রমে বোমাব আঘাত থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন তাতে কংগ্রেস তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। সেই সময় আইনের ট্রেণে বোমা মার। হয়েছিল কিন্তু তিনি দৈবক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। যাই হোক গান্ধীজীর এই প্রস্তাবে সুভাষবাবু পরিচালিত উগ্র জাতীয়তাবাদী তরুণের দল অত্যন্ত রুষ্ট হযে উঠলো। জোর প্রতিবাদ জানানো সত্বেও গান্ধীজীর এ প্রস্তাব গৃহীত হয়ে গেল।

 এদিকে সুভাষচন্দ্র আর একটি প্রস্তাব তুললেন। তিনি বললেন যে কংগ্রেস যে শুধু পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করছে তা নয় কংগ্রেস সঙ্গে সঙ্গে সিন ফিনের আদর্শ অনুযায়ী এক স্বাধীন গভর্ণমেণ্ট গঠন করবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশের কিমাণ মজুর ও যুব সম্প্রদায়কে জাগিয়ে তুলবে। কিন্তু কংগ্রেস তার এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে দিলে। তাইতে তিনি বলেছিলেন যে, কংগ্রেস আজ যে কথার মর্ম বুঝলো না তার মর্ম সে আরও এক বছর পর উপলব্ধি করতে পারবে। কিন্তু তার জন্যে যতখানি সময় নষ্ট হয়ে যাবে তা আমাদের সংগ্রামের পক্ষে অমূল্য।

 কংগ্রেস এর প্রত্যুত্তর দিয়েছিল। বাক্যে নয় কার্যে। পণ্ডিত জওহরলালের নেতৃত্বে কংগ্রেস সুভাষচন্দ্র ও নিবাস আয়েঙ্গারকে কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটি থেকে বহিষ্কৃত করে দিলে।

 অবিশ্বাস্য হলেও একথা সত্য। একথা সত্য যে কংগ্রেস নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে বিতাড়িত করে দিয়েছিল তাদের কর্ম পরিষদ থেকে।

 কিন্তু ভারতের যুব সম্প্রদায় তাকে মাথা নত করে গ্রহণ করেছিল সেই তরুণ সম্প্রদায় তাকে নেতার আসনে বসিয়ে যে সম্মান দেখিয়েছিল তার কাছে অন্যান্য সমস্ত কংগ্রেসী নেতার জনপ্রিয়তা ম্লান হয়ে গিয়েছিল, ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেবে। নওজোয়ান ভারত সভার যুব সম্মিলনের সামনে দাড়িয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, যে ভারতের যুব সম্প্রদায় দিয়েই ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হবে। তিনি বরাবরই তরুণের পূজারী। তাই তিনি বলেছিলেন, তরুণের মধ্যে যে শক্তি আছে যে প্রাণ আছে তার উচিৎ মর্যাদা দিতে হবে। প্রবীন রাজনৈতিকদের পদতলে আমাদের নবীন প্রাণের বুদ্ধি বিবেচনাকে সমর্পণ করা আমি কোন দিন সহ্য কববো না।

 এই ডাকে সাড়া দিয়েছিল সারা ভারত ব্যাপী তরুণের দল।

 শুধু ভারতে নয়, বাঙ্গলা দেশেও ভীষণ দলাদলি সুরু হয়ে গিয়েছিল। যদিও দেশবন্ধুর অবর্তমানে সুভাষবাবুই ছিলেন বাঙ্গলার অবিসংবাদী নেত তবু, তিনি যখন ভারতের বাইরে নির্বাসিত ছিলেন সেই অবসরে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের দল বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। যতীন্দ্রমোহন একাধারে স্বরাজ পার্টির নেতা ও কর্পোরেশনের মেয়র নিবাচিত হয়ে ছিলেন। যতীন্দ্রমোহন দেশবন্ধুর অনুগামী হলেও তিনি দেশবন্ধুর মতবাদের সঙ্গে গান্ধীবাদের একটা অসম্ভব রকমের মিশ্রণ করতে চেয়েছিলেন। সে ভাবধারা একমাত্র সুভাষবাবুব অবর্তমানেই কিছুটা চল হয়েছিল কিন্তু সুভাষবাবুর মুক্তির পর তার বিরাট ব্যক্তিত্ব ও আত্মত্যাগের পাশে দাড়াতে পারে নি। তবে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীদল যতীন্দ্রমোহনকে সাহায্য করতো। আশা ছিল তাহলে সুভাষবাবুর প্রভাব খর্ব হয়ে যাবে। যাই হোক সুভাষবাবু মান্দালয় থেকে ফেরবার পর সমস্ত বাঙ্গলাদেশ যখন সুভাষবাবুর মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়লো তখন অনন্যোপায় হয়ে যতীন্দ্রমোহন লাহোর কংগ্রেসে বাঙ্গলার প্রাদেশিক নির্বাচনে বৈধতা অবৈধতা সম্বন্ধে প্রস্তাব তুললেন। কংগ্রেস মতিলাল নেহরুকে ব্যাপারটা পর্যালোচনা করবার জন্যে বাঙ্গলায় পাঠালেন। তিনি সমস্ত অনুসন্ধান করে সুভাষবাবুর পক্ষেই রায় দিয়ে গেলেন। কিন্তু যতীন্দ্রমোহনের দল তাতেও ক্ষান্ত না হয়ে পাশাপাশি আর একটা প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি গঠন করলে। এবং সমস্ত নির্বাচনে এমন কি মেয়রের নির্বাচনেও যতীন্দ্রমোহন সুভাষবাবুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নামলেন। কিন্তু আসলে যতীন্দ্রমোহনের কোন প্রভাব ছিল না জনসাধারণের ওপর। তাই ভোটে প্রতি পদে যতীন্দ্রমোহনকে পরাজয় বরণ করে নিতে হল। এর পর থেকে যতীন্দ্রমোহনের দল আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে নি। তবে বাঙ্গলার এই দলাদলির ইতিহাস বাঙ্গলার রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা মস্ত বড় কলঙ্কের অধ্যায় সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বাঙ্গলার বীর নেতা সুভাষচন্দ্র যখন সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে দক্ষিণপন্থী, সেকেলে আপোষপরায়ণ কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চালাচ্ছেন—দেশকে আবও বৃহত্তর'ত্যাগ ও সংগ্রামের দিকে চালনা করতে চেষ্টা করছেন—তাঁর একমাত্র লক্ষ্য যখন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা তখন তারই প্রদেশে সামান্য ক্ষমতার লোভে তাকে এমনভাবে বিব্রত করা মোটেই দেশভক্তির পরিচয় নয়। সুভাষবাবুর আদর্শ সক্রিয় সংগ্রামের আদর্শ, জ্বলন্ত দেশপ্রেম ও অপূর্ব ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত সে পথ। তার পাশে জনজাগরণের যুগে অন্য কোন আদর্শ স্থান পেতে পারে না। যে আদর্শ মানুষকে স্বতঃই উদ্বুদ্ধ করে তোলে, বৃহত্তর কর্মপ্রেরণায় চঞ্চল করে তোলে তাকেই বলি আদর্শ। দল করে বা অন্য কোন নেতার সুনাম ও জনপ্রিয়তার দোহাই দিয়ে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সুভাষবাবুকে জয়তিলক পরিয়ে সেদিন বাঙ্গলা দেশ এই কথারই কাযত পরিচয় দিয়েছিল। এবং যারা সেই পরিচয় দিয়েছিল তারা আমাদের দেশে অতি সাধারণ শ্রেণীর মানুষ—সেই কিষাণ ও মজুরের দল আর তাদের সাথে সাথে ছিল যুগে যুগে সমস্ত দেশের সমস্ত সংগ্রামের যারা অগ্রদূত সেই তরুণ ছাত্র সম্প্রদায়। সুভাষবাবুর জয় বাঙ্গালীর প্রাণের জয়।

 এর পর ১৯৩০ সাল। অসহযোগ আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি। প্রতি বাবে যেমন হয়ে থাকে এবারেও বাঙ্গলা দেশ সুভাষবাবুর নেতৃত্বে এগিয়ে এলো। আন্দোলনের পুরোভাগে। সুভাষবাবু, যতীন্দ্রমোহন প্রভৃতি সকলেই কারারুদ্ধ হলেন। এই সময় আলীপুর জেলে ওয়ার্ডারদের অভদ্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে পাঠান বক্ষীদেব হাতে সুভাষবাবু তার সঙ্গীদের নিয়ে লাঞ্ছিত হলেন। লাঠির আঘাতে এক ঘণ্টারও বেশী সময় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। বিক্ষোভের বঙ্গে সমস্ত দেশ উদ্বেল হয়ে উঠলো। থেকে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু সফল হল না। দেশব্যাপী প্রতিবাদ ও প্রতিকারের দাবী জানিয়ে আন্দোলন চলতে লাগলো। সমযের মধ্যেই আবার কোলকাতার অধিবাসী সুভাষবাবুকে মেয়র নির্বাচিত সরকার করলেন।

 কিছুদিনের জন্য তিনি মুক্তি লাভ করলেন এবং এই সময়ে মজুরদের পক্ষ থেকে তিনি নিখিল ভাবত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। কিন্তু বেশীদিন আর জেলের বাইরে তার থাকা হল না। ২৮শে জানুয়ারী স্বাধীনতা দিবসের এক শোভাযাত্রা পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি গ্রেপ্তার হলেন। শুধু গ্রেপ্তার নয়, শোভাযাত্রার ওপর পুলিশ লাঠি চালনা করায় অনেকের সঙ্গে তিনিও আহত হয়েছিলেন। কিন্তু এবারেও তাকে বেশীদিন জেলে থাকতে হয় নি। কারণ এই সময় জগৎ বিখ্যাত গান্ধী আইন চুক্তি সম্পাদিত হয়, এবং তার ফলে তিনি মুক্তিলাভ করেন।

 আরুইনের সাথে চুক্তির ফলে গান্ধীজী হঠাৎ অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করে দেবার আদেশ তার ফলে দেশবাসী বিশেষ করে তরুণ সৈনিকের দল অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে এবং গান্ধীজীর ওপর শ্রদ্ধা হারাতে থাকে। তাছাড়া গান্ধীজী আরুইনের সঙ্গে পরামর্শ করার আগে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ফাসির অপরাধে দণ্ডিত ভগত সিংহের ফাসি তিনি নাকচ করবার সাধ্যমত চেষ্টা করবেন। অথচ আইনকে এই বিষয়ে মোটেই তিনি রাজী করাতে পারলেন না, এদিকে আন্দোলনও হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। উপরন্তু ২৩শে মার্চ যেদিন করাচীতে কংগ্রেসের অধিবেশন বসবে ঠিক সেইদিনই ভগত সিংহ সুখদেব এবং রাজগুরুর ফাসি হয়ে গেল। সমস্ত তরুণ সমাজ একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো এই খবর পেয়ে। গান্ধীজী যখন করাচীতে এসে পৌঁছলেন তখন কৃষ্ণ পতাকা দিয়ে তাকে সম্বর্ধনা জানানো হল। এমন কি কেউ কেউ ঢিল পর্যন্ত ছুড়লো। এদিকে আবার সুভাষবাবুর নেতৃত্বে একই সময়ে কংগ্রেস অধিবেশনের পাশাপাশি যুব সম্প্রদায়ের অধিবেশন শুরু হয়ে গেল। সুভাষবাবু প্রকাশ্য সভায় গান্ধীজীর নীতির নিন্দা করলেন। তিনি বললেন গান্ধী-আইন চুক্তি দেশবাসীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। তাছাড়া তিনি বললেন যে আগামী গোল-টেবিল বৈঠকে একমাত্র গান্ধীজীই ভারতের সঠিক প্রতিনিধি হতে পারেন না।

 সমস্ত উগ্রপন্থীরা এই অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন বটে কিন্তু ওদিকে কংগ্রেস মণ্ডপে গান্ধীজীকেই একমাত্র প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করে দেওয়া হল। এমন। কি ভগত সিংহের বাবা কিষেণ সিংহও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলে। গান্ধীজীরই জয় হল করাচীতে।

 যাই হোক, গোল টেবিল বৈঠকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আগে ১৯৩২ সালে গান্ধীজী বোম্বাইতে এক মিটিং ডাকলেন। সুভাষবাবু ওয়াকিং কমিটির সদস্য থাকলেও তাঁকে বিশেষ আমন্ত্রণ পাঠানো হল একটা মীমাংসা করবার জন্যে।

কিন্তু বোম্বাইতে যাবামাত্র তিনি গ্রেপ্তার হলেন। একেই ত মান্দালয় জেলে তার শরীরে যক্ষ্মার পূর্বাভাস দেখা গিয়েছিল, এবারে জেলের মধ্যে তার শরীর একেবারে ভেঙ্গে গেল। কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার জন্য তাকে ইউরোপে পাঠাবার সঙ্কল্পে ১৯৩৩ সালে তাকে মুক্তি দিলেন। তবে এই সতরইলো যে সরাসরি জেল থেকেই তাকে ইউরোপ যাত্রা করতে হবে, মধ্যে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না।