নেপালে বঙ্গনারী/গুর্খা বিজয়

গুর্খা বিজয়

 গুর্খারাজগণ উদয়পুরের রাজপুত বংশােদ্ভব বলিয়া আপনাদিগের পরিচয় দেন। মুসলমানদিগের অত্যাচারে উদয়পুর ত্যাগ করিয়া ইঁহাদিগের পূর্ব্বপুরুষগণ হিমালয়ের দুর্গম প্রদেশে রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন। পালপার নিকট গােরখালী নামক স্থানে বাস করিতেন বলিয়া, ইহারা আপনাদিগকে গােরখালি বা গুর্খা নামে অভিহিত করিতেন। গুর্খাগণ ক্রমে সপ্তগণ্ডকী দেশে রাজ্য বিস্তার করিল। গুর্খাগণ সর্ব্বদাই প্রতিবেশী রাজ্যসমূহে উৎপাত করিত। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে পৃথ্বীনারায়ণ নামে এক রাজা গুর্খার সিংহাসনে আরােহণ করেন। ইনি অতি ক্ষমতাশালী পুরুষ ছিলেন। সিংহাসনে আরােহণ করিয়া ইঁহার দেশজয় পিপাসা অত্যন্ত বলবতী হইয়া উঠিল। পৃথ্বীনারায়ণ নেপাল জয় করিয়া নেপালের সহিত গুর্খারাজ্য মিলিত করেন। অনেকদিন হইতে ইংরাজের সহিত নেওয়ারদিগের ব্যবসাগত সম্বন্ধের সূত্রপাত হইয়াছিল, সেই হেতু পৃথ্বীনারায়ণ যখন নেপাল আক্রমণ করিলেন তখন কাটমুণ্ডের মল্লরাজ ইংরাজদিগের সহায়তা ভিক্ষা করিয়াছিলেন। সেই সময় পাটনে একটী রােমান কাথলিকদের মিশন ছিল এবং সেখানকার অধ্যক্ষ ফাদার গায়সপি (Father Guesseope) গুর্খাবিজয় ব্যাপার স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছিলেন। তাঁহাদিগের বৃত্তান্ত হইতে সেই সময়কার অনেক ঘটনা জ্ঞাত হওয়া যায়। পৃথ্বীনারায়ণ যে সময় নেপাল আক্রমণ করেন
ভাট গাঁও।
তখন ভাটগাঁও, কাটমুণ্ড, পাটন প্রভৃতির রাজগণ গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। এই গৃহযুদ্ধ ব্যাপারে ভাটগাঁওয়ের রাজা পৃথ্বীনারায়ণের সহায়তা ভিক্ষা করেন। পৃথ্বীনারায়ণ অবিলম্বে সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হন। তখন ভাটগাঁও এর রাজা আপনার ভ্রান্তি জানিতে পারিয়া সকল গৃহবিবাদ বিস্মৃত হইয়া একতাসূত্রে আবদ্ধ হইয়া এই সাধারণ শক্রর বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হন। পৃথ্বীনারায়ণকে একে একে এই সকল রাজ্য পরাভূত করিতে হইয়াছিল। প্রথমে তিনি কীর্ত্তিপুর আক্রমণ করেন। তিনবার চেষ্টার পর সাতমাস অবরোধ সহ্য করিয়া বিশ্বাসঘাতক ব্রাহ্মণদিগের সহায়তায় পৃথ্বীনারায়ণ কীর্ত্তিপুর অধিকার করিতে সক্ষম হন। তিনি কীর্ত্তিপুরের আবাল বৃদ্ধের নাসা ও ওষ্ঠ ছেদন করিয়া স্বীয় কীর্ত্তি ঘোষণা করেন। কীর্ত্তিপুর নামের পরিবর্ত্তে ঐ সহরের নাম নাসাকাটাপুর রাখেন। ত্বরায় পাটনও হস্তগত করিলেন। ভাটগাঁওয়ের রাজা আত্মসমর্পণ করিয়া এই প্রকার নৃশংস আচরণ হইতে আপনাকে রক্ষা করিলেন। ১৭৬৮ খৃষ্টাব্দের ইন্দ্রযাত্রার দিন অতি আশ্চর্য্য উপায়ে পৃথ্বীনারায়ণ কাটমণ্ডু হস্তগত করিলেন। সেই দিন কটমণ্ডুবাসীগণ উৎসবে উন্মত্ত, পৃথ্বীনারায়ণ কতিপয় সৈন্য সমবিভ্যাহারে কখন যে লুকাইয়া সহরে প্রবেশ করিয়াছিলেন কেহই দেখিতে পায় নাই। ইন্দ্রযাত্রার সময় রথে উঠিয়া কুমারীগণ সহর প্রদক্ষিণ করিয়া রাজবাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইলে, রথের সম্মুখে রাজার গদি বিস্তৃত হইলে রাজা বা তাঁহার অনুপস্থিতে তাঁহার তরবারি তদুপরি রক্ষিত হয়। সেদিন রথ চতুর্দ্দিকে প্রদক্ষিণ করিয়া যেই রাজবাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইল, অমনি রাজার গদি তাহার সম্মুখে বিস্তৃত হইতেই স্বয়ং পৃথ্বীনারায়ণ সেই গদিতে উপবিষ্ট হইয়া বলিলেন, “আমিই এখন অধীশ্বর, আমিই রাজা, রাজা বলিয়া আমায় বরণ কর।” তখন এমন অবস্থা হইল, সমুদয় আনন্দ কোলাহল বিস্ময়ে পরিণত হইল। কাহারও আর বাক্যস্ফুর্ত্তি হইল না। বাধা দেয় এমন সাধ্য আর কাহারও রহিল না। বিনা রক্তপাতে কাটমণ্ডু পৃথ্বীনারায়ণের হস্তগত হইল।

 পৃথ্বীনারায়ণ পাটন অধিকার করিলে পর তথাকার রোমন কাথলিকগণ পৃথ্বীনারায়ণের এক পুত্রের সহায়তায় নির্ব্বিবাদে পাটন পরিত্যাগ করিয়া সদলে যাইবার অনুমতি প্রাপ্ত হন। তাঁহারা বিটওয়ার নিকট পুরী নামক স্থানে অদ্যাবধি বাস করিতেছেন। সেখানে নেওয়ার খৃষ্টানগণ অদ্যাপি বংশ পরম্পরায় বাস করিতেছে। পৃথ্বীনারায়ণ দৃঢ় চেষ্টায় এবং চক্রান্তকারী ব্রাহ্মণদিগের সহায়তায় এই সকল রাজ্য অধিকার করিলেন। নেওয়ারগণ, বিশেষতঃ কীর্ত্তিপুরের অধিবাসীগণ যে জাতীয় স্বাধীনতা লোপের সময় বীরের ন্যায় আত্মরক্ষ্মা করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, তাহা কেহই অস্বীকার করিতে পারেনা। এবং পৃথিনারায়ণ চক্রান্তকারী ও বিশ্বাসঘাতক ব্রাহ্মণদিগের সহায়তা না পাইলে কখনই সহজে কৃতকার্য্য হইতে পারিতেন না।



পাটন সহর