নেপালে বঙ্গনারী/নেপালের পুরাবৃত্ত
নেপালের পুরাবৃত্ত
খ্রীষ্টীয় চতুর্দ্দশ শতাব্দীতে নেপালরাজ্য বর্ত্তমান সময়ের ন্যায় বিস্তীর্ণ প্রদেশ ছিল না। নেপালের বর্ত্তমান কাটমণ্ডু উপত্যকার চতুর্দ্দিকেই কেবল ইহার স্বাধীন রাজ্য বিস্তীর্ণ ছিল। এই স্থানে নেওয়ার নামধেয় মঙ্গোলীয় এবং হিন্দুজাতির সংমিশ্রিত এক শান্তস্বভাব,নিরীহ, পরিশ্রমী জাতির আবাস স্থান ছিল। নেওয়ারগণ বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী ছিল। কথিত আছে নীমুনি নামে জনৈক মহাত্মার নামে এই রাজ্যের নাম নেপাল হইয়াছে। নী+পাল— অর্থাৎ দেবতার আশ্রিত প্রদেশ। পশুপতিনাথ তীর্থের সহিত নেপালরাজ্যের ইতিহাস অতি দৃঢ়রূপে গ্রথিত। অতি প্রাচীন কালে নীমুনি এখানে গোপবংশের একজনকে রাজা করিয়া নেপালরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। উক্তবংশ এখানে বহুশতাব্দী রাজ্য করিবার পর আহীরবংশ কর্ত্তৃক তাড়িত হয়। নিম্নে যথাক্রমে নেপালের রাজবংশসমূহের তালিকা প্রদত্ত হইল।
১। গোপবংশ।
২। আহীরবংশ।
আহীরবংশের তিনজনমাত্র রাজা হইয়াছিলেন; যথা—
(১) বীর সিংহ।
(২) জয়মতি সিংহ।
(৩) ভবানী সিংহ।
৩। কিরাটীবংশ।
কিরাটীবংশ বহুদিন নেপালে রাজত্ব করেন। কথিত আছে কিরাটীবংশের ৪২ জন রাজা ৮০০ বৎসর নেপালে রাজ্য করিয়াছিলেন। কিরাটীবংশের চতুর্দ্দশ নৃপতি স্থানকোর রাজত্বকালে পাটলীপুত্রের রাজা অশোক সপরিবারে নেপালে আগমন করেন। কাটমণ্ডুর সন্নিকটে যে পাটন আছে তাহা ললিতপাটন নামে তাঁহাদ্বারাই নির্ম্মিত হয়। এখানে অদ্যাবধি অশোকের নির্ম্মিত অনেক বৌদ্ধমনির চৈত্য ও বিহার আছে। অশোক অনেকদিন নেপালে বাস করেন। এখানে তাঁহার কন্যা চারুতির সহিত নেপালরাজ দেবপালের বিবাহ হয়। চারুমতি অবশেষে ভিক্ষুনী হন। এবং ‘চারুবিহার’ নামে এক বিহার নির্ম্মাণ করেন। চারুমতিকে নেপালে রাখিয়া অশোক সপরিবারে দেশে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছিলেন।
কিরাটীবংশের পর যথাক্রমে
(৪) সোমবংশ—
(৫) সূর্য্যবংশ—
নেপালে রাজত্ব করেন।—সোমবংশের পঞ্চ নৃপতি নেপালে রাজত্ব করেন। সূর্য্যবংশের রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্যে শঙ্করাচার্য্যের জন্ম হয় তিনি তর্কযুদ্ধে সমুদয় ভারতবর্ষস্থিত বৌদ্ধদিগকে পরাজিত করিয়া নেপালে আগমন করেন। কিন্তু বৌদ্ধগণ কেহই তাঁহার সহিত তর্কযুদ্ধে জয়লাভ করিতে পারিলেন না। শঙ্করাচার্য্য নেপালে বৌদ্ধদিগের প্রতি অতিশয় নির্য্যাতন করেন, অনেক বৌদ্ধকে হত্যা করেন। তিনি বৌদ্ধদিগকে জীব হিংসা করিতে বাধ্য করেন। বিহার সকল ধ্বংশ করেন। বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুনীদিগের বিবাহ দেন। প্রায় ৮৪০০০ বৌদ্ধ গ্রন্থ ধ্বংশ করেন। দেব মন্দিরে বলি আরম্ভ হয়, নেপালে বৌদ্ধ ধর্ম্মের পরিবর্তে শৈব ধর্ম্ম প্রবর্ত্তিত হয়। ইহাও কথিত আছে বিক্রমাদিত্য তাঁহার শকাব্দ নেপালে প্রচলিত করিয়া, ভাটগাঁওএ সূর্য্য বিনায়ক নামে যে গণেশ মূর্ত্তি আছে তাহা তিনি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। শঙ্করাচার্য্যের পূর্ব্বে হর্ষবর্দ্ধন বা শিলাদিত্য নেপালে গমন করিয়াছিলেন এরূপ উক্ত আছে।—
সূর্য্যবংশের পর
৬। ঠাকুরী বংশ—
৭। রাজপুত বংশ—
৮। কর্ণটকী বংশ—
৯। মল্লরাজ বংশ।
ঠাকুরী রাজা গুণ কর্ম্মদেবের রাজত্ব সময়ে একদা তিনি মহালক্ষীর পূজা করিতেছিলেন, এমন সময় স্বপ্নে দেবী তাঁহাকে দেখা দিয়া বলিলেন, বাঘমতী এবং বিষ্ণুমতী নদীর সঙ্গম স্থলে এক সহর নির্ম্মাণ করিতে হইবে, পুরাকালে এই স্থলে নীমুনি তপস্যা করিয়াছিলেন। এই নূতন সহরের আকৃতি দেবীর খড়্গের ন্যায় হইল। রাজা ইহার নাম কান্তিপুর রাখিলেন। শুভ লগ্নে রাজা পাটন হইতে কান্তিপুরে রাজধানী পরিবর্ত্তিত করিলেন। সহরে ১৮০০০ গৃহ নির্ম্মিত হইল। লক্ষ্মী প্রতিজ্ঞা করিলেন যতদিন না ঐ সহরে দিন লক্ষ টাকার কারবার হয়, ততদিন সেখানেই অধিষ্ঠান করিবেন। রাজা দেবীর কৃপায় সুবর্ণ ধারা নির্ম্মাণ করেন। তিনি রক্ষাকালী ও নবদুর্গা প্রতিষ্ঠা করেন। এইরূপে বর্ত্তমান কাটমণ্ডু সহরের প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল। নেপালে বর্ম্ম উপাধীধারী ক্ষত্রিয় রাজ বংশই মল্লরাজ বংশের পূর্ব্বে রাজত্ব করিয়াছিল। এই বর্ম্ম রাজগণের শেষ দুইজন নৃপতির অব্যবহিত পূর্ব্বের রাজা, তিনটী পুত্র রাখিয়া গতাসু হন। তাঁহার তিনটী পুত্র যথাক্রমে নেপালে রাজত্ব করেন। কিন্তু তাঁহাদের কোন পুত্র ছিল না। একজনের সত্যনায়িকা দেবী নামে কেবল এক কন্যা ছিল। এই কন্যাটী নেপালের রাজ্ঞী হন। বারানসীর রাজা হরিশ্চন্দ্র দেবের সহিত নেপালের এই রাণীর বিবাহ হয়। ইঁহাদের রাজলক্ষ্মী নামে এক মাত্র কন্যা জন্মে। সত্যনায়িকা দেবীর মৃত্যুর পর রাজলক্ষ্মী নেপালের সিংহাসনে আরােহণ করিলেন। কিন্তু কতিপয় দিবসের মধ্যে জয়দেব নামে একজন জ্ঞাতি কর্ত্তৃক সিংহাসনচ্যুত হন। ১৩২২ খৃষ্টাব্দে মিথিলার অধিপতি হরিসিংহ দেব মুসলমানগণ কর্ত্তৃক রাজ্যভ্রষ্ট হইয়া নেপালে আশ্রয় লাভ করেন। এই হরিসিংহ দেব নেপালে জয়দেবকে পরাজিত করিয়া নেপালের সিংহাসন অধিকার করেন। ইঁহাদের উপাধি মল্ল ছিল। পৃথ্বীনারায়ণের নেপাল আক্রমণের সময় পর্য্যন্ত এই রাজবংশই কাটমণ্ডুর উপত্যকায় রাজত্ব করিতে ছিলেন।
১৬৩৯ খৃষ্টাব্দে এই বংশেরই রাজা প্রতাপমল্ল কাটমুণ্ডের সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি অতি পণ্ডিত এবং শাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন। ইনি মহামারী নিবারণের জন্য রাজ বাড়ীর সম্মুখে হনুমানের এক বিগ্রহ স্থাপন করেন। পশুপতিনাথের মন্দির সংস্কার করেন এবং পশুপতির মস্তকে সুবর্ণ ছত্র নির্ম্মাণ করাইয়া দেন। প্রতাপমল্লের কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুর পর তাঁহার পত্নী শোকে অতিশয় কাতর হন। রাজা রাণীকে সান্ত্বনা দিবার জন্য এক দীঘি খনন করিয়া তন্মধ্যে গৃহ দেবতার প্রতিষ্ঠা করেন। নানা তীর্থ হইতে পবিত্র বারি আনিয়া এই পুষ্করিণীটী পূর্ণ করেন। এই পুষ্করিণী অদাপি রাণীপোখরি নামে অভিহিত হইয়া থাকে। ইহার তীরে হস্তি পৃষ্ঠে রাজা ও রাণীর মূর্ত্তি এখন পর্য্যন্ত দণ্ডায়মান আছে। ইতিপূর্ব্বে হরি সিংহের অধঃতম ৭ম পুরুষ অক্ষমল্লের ১৫৬৮ খৃষ্টাব্দে মৃত্যু হয়। অক্ষমল্ল তিন পুত্র ও এক কন্যাকে আপনার সমুদয় রাজ্য বণ্টন করিয়া দেন। জ্যেষ্ঠ পুত্রকে ভাঁতগাঁও, ২য় কে বেনীপার উপত্যকা, ৩য় কে কাটমণ্ডু, কন্যাকে পাটন। প্রতাপমল্ল এই তৃতীয় পুত্রেরই বংশধর ছিলেন। ইহার ২০০ বৎসর পরে গুর্খা রাজা পৃথ্বীনারায়ণ যখন নেপাল রাজ্য আক্রমণ করেন তখন তিনি এই তিন রাজ্য পৃথক দেখিতে পান, এবং পৃথকভাবে ইহাদিগকে পরাভূত করেন।