পঞ্চনদের তীরে/নবম পরিচ্ছেদ

নবম পরিচ্ছেদ

আনন্দের অশ্রুজল

 “সেনাপতি, এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে আপনাকে আর আমাদের সঙ্গে কষ্ট ক’রে আসতে হবে না! আমরাই আপনার আদেশ পালন করতে পারবো।”

 —“না বসুমিত্র, ব্যাপারটাকে তোমরা সামান্য মনে কোরো না। আমরা শৃগাল মারতে নয়, যাচ্ছি সিংহ শিকার করতে! আমরা একবার বিফল হয়েছি আবার বিফল হ’লে আমার মান আর রক্ষা পাবে না। ঘোড়ায় চড়ো, অগ্রসর হও।”

 একশোজন সওয়ার চালিয়ে দিলে একশো ঘোড়াকে! একশো ঘোড়ার খুরের শব্দে রাজপথ যেন জীবন্ত হয়ে উঠল—নিবিড় মেঘের মতো ধূলায় ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল চতুর্দিক এবং সৈনিকদের বর্মে বমে জ্বলতে লাগল শত সূর্যের চমক!

 অরণ্যের বক্ষ ভেদ ক’রে চ’লে গিয়েছে প্রশস্ত সেই পথ। মাঝে মাঝে গ্রাম। সৈনিকদের ঘোড়া এত দ্রুত ছুটেছে যে মনে হচ্ছে, গ্রামগুলো যেন কৌতূহলের আগ্রহে কাছে এসেই আবার সশস্ত্র সওয়ারদের দেখে ভয়ে দূরে পালিয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি!

 প্রায় ক্রোশ-তিনেক পরে পথটা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তিন দিকে চ’লে গিয়েছে! বসুমিত্র যাঁকে সেনাপতি ব’লে সম্বোধন করেছিল হঠাৎ তিনি ঘোড়ার লাগাম টেনে ধ’রে হাত তুলে চেঁচিয়ে বললেন, “সবাই ঘোড়া থামাও!”

 একশো ঘোড়া দাঁড়িয়ে পড়ল।

 সেনাপতি বললেন, “দেখো বসুমিত্র, তিনটে পথই কুরুক্ষেত্রের মহাপ্রান্তরের তিনদিকে গিয়ে পড়েছে। পঁচিশজন সওয়ার ডানদিকে যাক্, আর পঁচিশজন যাক্ বাম দিকে। বাকি পঞ্চাশজনকে নিয়ে আমি যাবে। সাম্‌নের পথ ধ’রে। গুপ্তচরের খবর যদি ঠিক হয়, তাহ’লে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরেই আমাদের শিকারকে ধরতে পারবো। সে ধূ-ধূ- প্রান্তরের মধ্যে কেউ আমাদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না।”

 বসুমিত্র সেনাপতির হুকুম সকলকে জানালে। তখনি সওয়াররা তিন দলে বিভক্ত হয়ে আবার গন্তব্য পথে অগ্রসর হ’ল। পাঠকদের সঙ্গে আমরাও যাই সেনাপতির সঙ্গে!

 ঘণ্টা-দুই পরেই পথ গেল ফুরিয়ে এবং আরম্ভ হ’ল পবিত্র কুরুক্ষেত্রের ভয়াবহ প্রান্তর। হাঁ, এ প্রান্তর পবিত্র এবং ভয়াবহ! মহাভারতের অমর আত্মা একদিন এখানে যত উচ্চে উঠেছিল, নেমেছিল আবার ততখানি নীচে! ভারতের যা-কিছু ভালো, যা-কিছু মন্দ এবং যা-কিছু বিশেষত্ব, কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের মধ্যেই করেছিল আত্মপ্রকাশ। নরের সঙ্গে নারায়ণের মিতালি, শ্রীকৃষ্ণের মুখে গীতার বাণী, ভীমার্জুনের অতুলনীয় বীরত্ব, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের মানবতা, কুরু-পাণ্ডবের ভ্রাতৃবিরোধ, অন্যায় যুদ্ধে ভীষ্মের, দ্রোণের ও অভিমন্যুর পতন প্রভৃতির শত শত কাহিনী যুগ-যুগান্তরকে অতিক্রম ক’রে আজও ভারতের জীবন-স্মৃতির ভিতরে দুলিয়ে দিচ্ছে বিচিত্র ভাবের হিন্দোলা! মানুষ যে কখনো দেবতা হয় এবং কখনো হয় দানব, কুরুক্ষেত্রেই আমাদের তা দেখিয়ে দিয়েছে। বহুকাল আগে আমি একবার দাঁড়িয়েছিলুম গিয়ে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে। কিন্তু সেখানে গিয়েই মনে হ’ল, এ তো প্রান্তর নয়,—এ-যে রক্তে রাঙা সমুদ্র! কুরুক্ষেত্রের প্রত্যেক ধূলিকণাকে ভারতের মহাবীররা স্মরণাতীত কাল আগে যে রক্তের ছাপে আরক্ত ক’রে গিয়েছিলেন, বিংশ-শতাব্দীর সভ্যতাও তা বিলুপ্ত করতে পারে নি। আর আমরা যে-যুগের কথা বলছি সে-যুগে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে কুরু ও পাণ্ডব পক্ষের যুদ্ধে-মৃত লক্ষ লক্ষ বীরের কঙ্কাল ধূলায় ধূলা হবারও সময় পায় নি! সে বিপুল প্রান্তরে রাত্রে তখন কোনো পথিকই চলতে ভরসা করত না।......এ-যুগেও সেখানে গিয়ে আমি প্রাণের কানে শুনেছি, শত পুত্রের শোকে দেবী গান্ধারীর কাতর আর্তনাদ, অভিমন্যুর শোকে বিধবা উত্তরার কান্না এবং শর-শয্যায় শায়িত ভীষ্মের দীর্ঘশ্বাস!

 কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরের তিন দিকে ছুটছে তিন দল অশ্বারোহী। খানিক অগ্রসর হয়েই তারা দেখতে পেলে, দূরে মৃদু-কদমে ঘোড়া চালিয়ে যাচ্ছে একজন সওয়ার।

 সে আমাদের বন্ধু—ভারতের বন্ধু সুবন্ধু। কেউ যে তার পিছনে আসছে এটা সে অনুমান করতে পারে নি, তাই তার ঘোড়া অগ্রসর হচ্ছে ধীরে ধীরে। সন্দেহ করবার কোন হেতু ছিল না কারণ উত্তর-পশ্চিম ভারত আজ যবন গ্রীক দিগ্বিজয়ীর কবলগত, মহারাজা হস্তীর পতন হয়েছে এবং আলেকজাণ্ডারের প্রধান শত্রু মহারাজা পুরু আজ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শক্তিহীন। ভারতের তরবারি কোষবদ্ধ!

 আচম্বিতে পিছনে বহু অশ্বের পদশব্দ শুনে সুবন্ধু ঘোড়া থামিয়ে ফিরে দেখলে। কিন্তু তখনো সে আন্দাজ করতে পারলে না যে, ওরা অসছে তাকেই ধরবার জন্যে! ভাবলে, এই ভারতীয় সওয়ারের দল যাচ্ছে অন্য কোন কাজে।

 খানিক পরেই সওয়ারের দল যখন খুব কাছে এসে পড়ল তখন সে বিস্মিত নেত্রে দেখলে, সকলকার আগে আগে আসছে ভারতের কুপুত্র, আলেকজাণ্ডারের অন্যতম সেনাপতি ও পথ-প্রদর্শক শশীগুপ্ত।

 সুবন্ধুর মনে কেমন সন্দেহ হ’ল। সে তাড়াতাড়ি নিজের অশ্বের গ্রীবায় করাঘাত ক’রে বললে, “চল্ রে রাজার ঘোড়া, বিশ্বাসঘাতকের ছায়া পিছনে ফেলে হাওয়ার আগে উড়ে চল্!”

 তার ঘোড়ার গতি বাড়তেই পিছন থেকে শশীগুপ্ত চেঁচিয়ে বললে, “ঘোড়া থামা ও সুবন্ধু! আর পালাবার চেষ্টা ক’রে লাভ নেই! ডানদিকে চেয়ে দেখো, বাঁ-দিকে চেয়ে দেখো! তোমাকে আমরা প্রায় ঘিরে ফেলেছি!”

 সত্য কথা! হতাশ হয়ে সুবন্ধু একটা বড় গাছের তলায় গিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়ল।

 শশীগুপ্তও ঘোড়া থেকে নেমে প’ড়ে বললে, “বসুমিত্র, সুবন্ধুকে বন্দী করো!”

 সুবন্ধু বললে, “যুদ্ধের পালা শেষ হয়েছে, আলেকজাণ্ডার দেশের পথে ফিরে গেছেন! সেনাপতি, এখন আমাকে বন্দী ক’রে আপনাদের কি লাভ হবে?”

 মৃদু হাস্য ক’রে শশীগুপ্ত বললে, “কি লাভ হবে? তুমি কি জানো না, সম্রাট আলেকজাণ্ডারের অনুগ্রহে আমি এক বিস্তীর্ণ প্রদেশের শাসনকর্তার পদ পেয়েছি? ভারতে গ্রীক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে কোথায় কে কোন্ চক্রান্ত করছে, সেদিকেও দৃষ্টি রাখা হচ্ছে আমার আর এক কর্তব্য।”

 সুবন্ধু বললে, “সেনাপতি শশীগুপ্তের কাছে যে যবনের অন্ন-জল অত্যন্ত পবিত্র, এ-সত্য আমার অজানা নেই। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি?”

 শশীগুপ্ত ক্রুদ্ধ স্বরে বললে, “কার অন্ন-জল পবিত্র, সে কথা আমি এক নগণ্য সৈনিকের মুখে শুনতে ইচ্ছা করি না।”

 সুবন্ধু হাসতে হাসতে বললে, “আমি যে নগণ্য সৈনিক মাত্র, সেসত্যও আমার অজানা নেই। কিন্তু নগণ্য সৈনিককে বন্দী করবার জন্যে আপনার মতো গণ্যমান্য মহাপুরুষকে সসৈন্যে আসতে হয়েছে কেন সে-কথাটা আমাকে স্পষ্ট ক’রে বললে খুসি হবো।”

 —“কোথায় যাচ্ছ তুমি?”

 —“মগধে।”

 —“কেন?”

 —“যবন-সাম্রাজ্যে সুবন্ধু বাস করে না!”

 —“তোমার উত্তর সত্য নয় সুবন্ধু! গ্রীকদের বিরুদ্ধে তুমি মহারাজা হস্তীকে আর মহারাজা পুরুকে উত্তেজিত করেছিলে। এইবারে তুমি মগধে গিয়েও বিদ্রোহ প্রচার করতে চাও।”

 —“সেনাপতি শশীগুপ্ত, বিদ্রোহ আমাকে আর প্রচার করতে হবে না। আলেকজাণ্ডার এখনো ভারতের মাটি ছাড়েন নি, এরি মধ্যে তো চারিদিকেই উড়ছে বিদ্রোহের ধ্বজা! পুষ্কলাবতীর গ্রীক শাসনকর্তা নিকানর নিহত হয়েছে, কান্দাহারও করেছে বিদ্রোহ ঘোষণা! আপনার অবস্থাও নিরাপদ নয়, তাই আপনি গ্রীক সম্রাটের কাছে সৈন্য-সাহায্য প্রার্থনা করেছেন! কিন্তু নূতন গ্রীক সৈন্য আর আসবে না সেনাপতি, আলেকজাণ্ডার এখন নিজেই কাবু হয়ে পালিয়ে যাবার জন্যে ব্যতিব্যস্ত!”

 —“ও-সব কথা আমি তোমার মুখে শুনতে ইচ্ছা করি না। আমি জানি, মহারাজা পুরু যুদ্ধে হেরেছেন বটে, কিন্তু আজও পোষ মানেন নি। তিনি খাপ্ থেকে আবার তরবারি খুলতে চান, আর সেই খবর দেবার জন্যেই তুমি ছুটেছ মগধে! কিন্তু তোমার বাসনা পূর্ণ হবে না।”

 সুবন্ধু আবার হাসির ঢেউ তুলে বললে, “আপনি আমাকে বন্দী করতে পারবেন?”

 —“সে বিষয়েও তোমার সন্দেহ আছে নাকি? চেয়ে দেখো, আমরা একশোজন!”

 —“হিন্দুকুশের ছায়ায় আমার দুই বন্ধু ক’জন গ্রীককে বাধা দিয়েছিল, এরি মধ্যে সে কথা ভুলে গেলেন নাকি?”

 —“আমি ভুলি নি। কিন্তু তুমিও ভুলে যেয়ো না, শেষ পর্যন্ত তাদের মরতেই হয়েছিল!”

 —“হাঁ, সেই কথাই বলতে চাই। জানি আমিও মরবো। কিন্তু শশীগুপ্ত, আমি আত্মসমর্পণ করবো না।”

 সুবন্ধু অশ্রদ্ধাভরে তাকে নাম ধ’রে ডাকলে ব’লে অপমানে শশীগুপ্তের মুখ রাঙা হয়ে উঠল। চীৎকার ক’রে বললে, “বসুমিত্র! সুবন্ধুকে বন্দী করো।”

 —“আমি তো মরবোই, কিন্তু তার অনেক আগেই ঘরের শত্রু বিভীষণকে বধ করবো!” চোখের নিমেষে সুবন্ধু বাঘের মতন লাফ মেরে একেবারে শশীগুপ্তের গায়ের উপরে গিয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে তার জ্বলন্ত অসি কোষমুক্ত হয়ে শশীগুপ্তের মাথার উপরে করলে বিদ্যুৎ-চিত্রের সৃষ্টি।

 কিন্তু বসুমিত্রের সাবধানতায় শশীগুপ্ত সে-যাত্রা বেঁচে গেল প্রাণে প্রাণে। বসুমিত্র জাগ্রত ছিল, সে তৎক্ষণাৎ নিজের তরবারি তুলে সুবন্ধুর তরবারিকে বাধা দিলে।

 শশীগুপ্ত সভয়ে পিছিয়ে গেল। কিন্তু তারপরেই নিজেকে সামলে নিয়ে বিষম রাগে প্রায় অবরুদ্ধ স্বরে বললে, “বধ করো-বধ করো! ওকে কুচি কুচি ক’রে কেটে ফ্যালো!”

 একশো ঘোড়ার সওয়ারের হাতে হাতে অগ্নিবৃষ্টি করলে এক শত তরবারি! সুবন্ধু দুই পা পিছিয়ে এসে গাছের গুড়ির উপরে পৃষ্ঠরক্ষা ক’রে তরবারি তুলে তীব্র স্বরে বললে, “হাঁ! আমাকে বধ করো! কিন্তু বন্দী আমি হবো না! নিজে মরবো শত্রু মারবো।”

 বসুমিত্র কিন্তু সেনাপতির হুকুম তামিল করবার জন্যে কোনো আগ্রহই দেখালে না। প্রান্তরের এক দিকে চিন্তিত ভাবে তাকিয়ে সে বললে, “সেনাপতি, পূর্বদিকে চেয়ে দেখুন।”

 পূর্বদিকে চেয়েই শশীগুপ্ত সচকিত স্বরে বললে, “ও কারা বসুমিত্র? ঘোড়া ছুটিয়ে আমাদের দিকেই আসছে? ওদের পোষাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ওরা এ-অঞ্চলের কোনো দেশের সৈন্য নয়! ওরা কারা, বসুমিত্র?”

 বসুমিত্র উৎকণ্ঠিত স্বরে বললে, “কিছুই তো বুঝতে পারছি না! একটা অগ্রবর্তী দল আসছে, গুণ্‌তিতে চার-পাঁচশোর কম হবে না! কিন্তু ওদের পিছনে, আরো দূরে তাকিয়ে দেখুন সেনাপতি, পূর্বদিকে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তর ভ’রে গিয়েছে সৈন্যে সৈন্যে! সংখ্যায় ওরা হাজার-কয় হবে! পূর্ব-দক্ষিণ-প্রান্তের বনের ভিতর থেকেও বেরিয়ে আসছে কাতারে কাতারে আরো সৈন্য!”

 শশীগুপ্ত তাড়াতাড়ি নিজের ঘোড়ার উপরে চ’ড়ে বললে “বসুমিত্র! অগ্রবর্তী-দল আমাদের খুব কাছে এসে পড়েছে! ওরা ভেরী বাজিয়ে আমাদের থামতে বলছে। কিন্তু দেখছ, ওদের পতাকায় কি আঁকা রয়েছে?”

 বসুমিত্র বললে, “পতাকায় আঁকা রয়েছে, ময়ূর!”

 —“হাঁ, মৌর্যবংশের নিদর্শন! বসুমিত্র, ওরা মগধের সৈন্য, আমাদের শত্রু! সংখ্যায় ওরা দেখছি অগণ্য। এখন আমাদের পক্ষে এ-স্থান ত্যাগ করাই উচিত।...সৈন্যগণ, পশ্চিম দিকে ঘোড়া ছোটাও।”

 সুবন্ধু শূন্যে তরবারি নাচিয়ে হেঁকে বললে, “সে কি শশীগুপ্ত? আমি তো মরতে প্রস্তুত! তোমরা আমাকে বধ করবে না?”

 শশীগুপ্ত তার দিকে অগ্নি-উজ্জ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ ক’রে নিজের ঘোড়া চালিয়ে দিলে পশ্চিম দিকে।

 বসুমিত্র এক লাফে ঘোড়ার পিঠে উঠে বললে, “সুবন্ধু, এ-যাত্রাও তুই বেঁচে গেলি।”

 সুবন্ধু হা-হা ক’রে অট্টহাসি হেসে বললে, “মরতে আমি ভালোবাসি, আমি তো মরতে ভয় পাই না তোদের মতে!! ওরে ভারতের কুসন্তান, ওরে বিশ্বাসঘাতকের দল! স্বদেশের জন্যে প্রাণ দিতেও যে কত আনন্দ, সে কথা তোরা বুঝবি কেমন ক’রে?”

 কিন্তু তার কথা তারা কেউ শুনতে পেলে না, কারণ তখন তাদের ঘোড়া ছুটেছে ঊর্ধ্বশ্বাসে।

 —“হাঁ সুবন্ধু, ঠিক বলেছ! স্বদেশের জন্যে প্রাণ দেওয়ার মতন আনন্দ আর নেই!”

 শত শত ঘোড়ার খুরের আওয়াজ হঠাৎ থেমে গেল সুবন্ধুর কাণের কাছে। চমকে সে ফিরে দেখলে, তার সামনেই তেজীয়ান এক অশ্বের পৃষ্ঠদেশে ব'সে আছেন সহাস্যমুখে চন্দ্রগুপ্ত! সুবন্ধু সবিস্ময়ে তাঁর দিকে ফিরে তাকিয়েই, ভূতলে জানু পেতে ব’সে বিস্মিত স্বরে বললে, “মহারাজা চন্দ্রগুপ্ত! এ যে স্বপ্নেরও অগোচর!”

 প্রথম যৌবনের নৃত্যচঞ্চল ভঙ্গিতে এক লাফে ঘোড়ার পিঠ ছেড়ে নীচে নেমে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, “রাজবংশে জন্ম বটে, কিন্তু এখনো মহারাজা হ’তে পারি নি, সুবন্ধু।”

 প্রথম সম্ভাষণের পালা শেষ হ’লে পর সুবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “কিন্তু মহারাজ, কোথা থেকে দেবদূতের মতন অকস্মাৎ আপনি এখানে এলেন? আপনার সঙ্গে এত সৈন্যই বা কেন? আপনি কি মগধের সিংহাসন অধিকার করেছেন?”

 চন্দ্রগুপ্ত দুঃখিত ভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “না সুবন্ধু, মগধের সিংহাসনে বসবার যোগ্যতা এখনো আমার হয় নি। ধন-নন্দের বিপুল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমি পরাজিত হয়েছি।”

 —“হা ভগবান, আমি যে আপনার উপরে অনেক আশা করেছিলুম!”

 —“আশা করেছিলে?”

 —“আজ্ঞে হাঁ মহারাজ! আমি যে মহারাজা পুরুর প্রতিনিধি রূপে বিজয়ী মহারাজা চন্দ্রগুপ্তকে আহ্বান করবার জন্যে মগধে যাত্রা করেছিলুম! পথের মধ্যে আমাকে বন্দী বা বধ করবার জন্যে এসেছিল শশীগুপ্ত —"

 —“তারপর আমাদের দেখে তারা শেয়ালের মতন পালিয়ে গেল? কেমন, এই তো? বুঝেছি। কিন্তু আশ্বস্ত হও সুবন্ধু, একবার পরাজিত হ’লেও আমি হতাশ হই নি! বিশাল মগধসাম্রাজ্য একদিনে জয় করা যায় না। মগধের সিংহাসন অধিকার করবার জন্যেই আমি যাচ্ছি সীমান্তের দিকে!”

 সুবন্ধু বিস্মিত ভাবে চন্দ্রগুপ্তের দিকে তাকিয়ে বললে, “মহারাজ, ক্ষমা করবেন। আপনার কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছি না। সীমান্তের দিকে যতই অগ্রসর হবেন মগধের সিংহাসন থেকে তো ততই দূরে গিয়ে পড়বেন!”

 মৃদু হাস্যে ওষ্ঠাধর রঞ্জিত ক’রে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, “ঠিক কথা। গুরু বিষ্ণুগুপ্ত (চাণক্য) একটি চমৎকার উপমা দিয়ে আমার প্রথম বিফলতার কারণ বুঝিয়ে দিয়েছেন। শিশুর সামনে এক থালা গরম ভাত ধ’রে দাও। শিশু বোকার মতো গরম ভাতের মাঝখানে হাত দিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলবে। কিন্তু সে যদি বুদ্ধিমানের মতো ধার থেকে ধীরে ধীরে ভাত ভাঙতে সুরু করে, তাহ’লে তার হাত পুড়বে না। তাই গুরুদেবের সঙ্গে পরামর্শ ক’রে আমি স্থির করেছি, সীমান্ত থেকে রাজ্যের পর রাজ্য জয় করতে করতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হবো পাটলিপুত্রের দিকে। আমি নির্বোধ, তাই প্রথমেই রাজধানী আক্রমণ করতে গিয়ে শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিলুম।”

 সুবন্ধু উৎফুল্ল কণ্ঠে ব’লে উঠল, “মহারাজা চন্দ্রগুপ্তের জয় হোক! মহাপুরুষ বিষ্ণুগুপ্ত ঠিক পরামর্শ দিয়েছেন! তাহ’লে প্রথমেই আপনি কোথায় যাবেন স্থির করেছেন?”

 —“পঞ্চনদের দেশে সব-চেয়ে শক্তিশালী পুরুষ হচ্ছেন মহারাজা পুরু। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, একবার পরাজিত হ’লেও মহারাজ। পুরু স্বাধীন হবার সুযোগ কখনো ত্যাগ করবেন না। আমি প্রথমেই তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করবো।”

 —“আপনি প্রার্থনা করবেন কি, আপনার সাহায্য প্রার্থনা করবার জন্যেই তো মহারাজা পুরু আমাকে মগধে যেতে আদেশ দিয়েছেন! মহারাজের বিশ্বাস, মগধের রাজা এখন আপনি।”

 —“তবেই তো সুবন্ধু, তুমি যে আমায় সমস্যায় ফেললে! মহারাজা পুরু যখন শুনবেন, যুদ্ধে আমি পরাজিত, তখন আর কি আমার সঙ্গে যোগ দিতে ভরসা করবেন?”

 সুবন্ধু উত্তেজিত স্বরে ব’লে উঠল, “ভরসা করবেন না? তাহ’লে আপনি চেনেন না মহারাজ পুরুকে! সিংহ কবে শৃঙ্খলে বন্দী হ’তে চায়? আলেকজাণ্ডার আমাদের মহারাজকে বিশ্বাস করেন না। তিনি ভালো ক’রেই জানেন, পুরুষ-সিংহ পুরুর তরবারি গ্রীকদের রক্তপাত করবার আগ্রহে অধীর হয়ে আছে! তাই নিহত নিকানরের জায়গায় তিনি সেনাপতি ফিলিপকে নিযুক্ত ক’রে আদেশ দিয়েছেন যে, মহারাজা পুরুর উপরে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখতে। গ্রীকদের দাসত্ব করা মহারাজার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। কিন্তু তিনি একা কি করতে পারেন? উত্তর-ভারত ছেয়ে গেছে গ্রীকে গ্রীকে। ভারতের সোনার ভাণ্ডার লুণ্ঠন করবার জন্যে নিত্য নূতন গ্রীক এসে এখানে বাসা বাঁধছে! তারা খেলার পুতুলের মতন নাচাচ্ছে তক্ষশীলা আর অভিসারের রাজাকে। তাঁরা যবনদের সেবা ক’রেই খুসি হয়ে আছেন! কিন্তু উত্তর-ভারতের অন্যান্য ছোট ছোট রাজারা বিদ্রোহের জন্যে প্রস্তুত —কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তবে এ বিদ্রোহ সফল হবে না, যদি কোনো নেতা এসে সবাইকে একতার বাঁধনে বাঁধতে না পারে।”

 চন্দ্রগুপ্ত আচম্বিতে তাঁর অসি কোষমুক্ত ক’রে ঊর্ধ্বে তুলে পরিপূর্ণ স্বরে বললেন, “তাহ’লে নেতার পদ গ্রহণ করবো আমি সুবন্ধু, আমি নিজেই! আলেকজাণ্ডারকে আমি দেখাতে চাই, ভীমার্জুনের স্বদেশে আজও বীরের অভাব হয় নি!”

 সুবন্ধু বিষণ্ন ভাবে মাথা নেড়ে বললে, “জানি মহারাজ, ভারতে আপনার মতো দু-চারজন বীরের তরবারিতে এখনো মর্চে পড়েনি! কিন্তু দু’চারজনের তরবারি কি ভারতের শৃঙ্খল ভাঙতে পারবে?”

 চন্দ্রগুপ্ত প্রান্তরের পূর্বদিকে অসি খেলিয়ে দৃঢ়স্বরে বললেন, “দু-চারজন বীর নন সুবন্ধু, ওদিকে দৃষ্টিপাত করো! আমি পরাজিত বটে, কিন্তু আজ আর সম্বলহীন নই! চেয়ে দেখো, আমি কত বীর নিয়ে ভারতকে স্বাধীন করতে চলেছি!”

 এতক্ষণ সুবন্ধু ওদিকে তাকাবার অবসর পায় নি। এখন ফিরে তাকিয়ে সবিস্ময়ে দেখলে, কুরুক্ষেত্রের বিপুল প্রান্তরের পূর্বপ্রান্ত পরিপূর্ণ হয়ে গেছে অগণ্য সৈন্যে সৈন্যে! হাজার হাজার সৈন্য প্রান্তরের উপরে এসে দাঁড়িয়েছে এবং আরো হাজার হাজার সৈন্য এখনো অরণ্যের ভিতর থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসছে—যেন তাদের শেষ নেই!

 চন্দ্রগুপ্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “আমাদের সঙ্গে যদি যোগ দেয় মহারাজা পুরুর সৈন্যদল, তাহ’লে কি আমরা ভারতকে আবার স্বাধীন করতে পারবো না?”

 সুবন্ধু জানু পেতে আবার চন্দ্রগুপ্তের পদতলে ব’সে প’ড়ে অভিভূত স্বরে চীৎকার ক’রে উঠল, “জয়, স্বাধীন ভারতের জয়! জয়, মহারাজ চন্দ্রগুপ্তের জয়!”

 তার দুই চোখ ভ’রে গেল বিপুল আনন্দের অশ্রুজলে!