পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১০৫
শ্রীযুক্ত ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখিত
প্রিয়বরেষু,—
আপনার ২।৫।২৬ তারিখের পত্র পাইয়া আমি আনন্দিত হইয়াছি। উত্তর দিতে বিলম্ব হইল বলিয়া ক্ষমা করিবেন—আমি এখন অনেক বিষয়ে নিজের মালিক নহি—তা ত বুঝিতেই পারিতেছেন। আপনার পত্রে ভবানীপুরের সকল সমাচার অবগত হইয়া একসঙ্গে সুখী ও দুঃখিত না হইয়া পারি নাই। আজ বাঙ্গলার সর্ব্বত্রই কেবল দলাদলি ও ঝগড়া এবং যেখানে কাজকর্ম্ম যত কম, সেখানে ঝগড়া তত বেশী। ভবানীপুরের কাজকর্ম্ম কিছু হইতেছে, তাই ঝগড়া-বিবাদ অপেক্ষাকৃত কম—তবুও যা আছে তাহাতে নিরপেক্ষ লোক ম্রিয়মাণ না হইয়া পারে নাই। আমি শুধু এই কথা ভাবি—ঝগড়া করিবার জন্য এত লোক পাওয়া যায়——কিন্তু মিলাইতে পারে, মীমাংসা করিয়া দিতে পারে—এ রকম একজন লোকও কি আজ সারা বাঙ্গলার মধ্যে পাওয়া যায় না? এই দলাদলির জন্য বাঙ্গলা আজ শ্রীযুক্ত অনিলবরণ রায়ের মত স্বদেশসেবক হারাইয়াছে—আরও কয়জনকে হারাইবে তা কে বলিতে পারে? বাঙ্গালী আজ অন্ধ, কলহ-বিবাদে নিমগ্ন, তাই একথা বুঝিয়াও বুঝিতেছে না। নিঃস্বার্থ আত্মদানের কথা আর তো কোথাও শুনিতে পাই না। অত বড় একটা প্রাণ নিজেকে নিঃশেষে বিলাইয়া মহাশূন্যে মিশিয়া গেল; আগুনের ঝলকার মত ত্যাগ মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া বাঙ্গালীর সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করিল; সেই দিব্য আলোকের প্রভাবে বাঙ্গালী ক্ষণেকের জন্য স্বর্গের পরিচয় পাইল; কিন্তু আলোকও নিবিল, বাঙ্গালীও পুরাতন স্বার্থের গণ্ডীতে আশ্রয় লইল। আজ বাঙ্গলার সর্ব্বত্র কেবল ক্ষমতার জন্য কাড়াকাড়ি চলিতেছে। যার ক্ষমতা আছে—সে ক্ষমতা বজায় রাখিতেই ব্যস্ত। যার ক্ষমতা নাই সে ক্ষমতা কাড়িবার জন্য বদ্ধপরিকর। উভয় পক্ষই বলিতেছে, “দেশোদ্ধার যদি হয়, তবে আমার দ্বারাই হউক, নয় তো হইয়া কাজ নাই।” এই ক্ষমতালোলুপ রাজনীতিকবৃন্দের ঝগড়া বিবাদ ছাড়িয়া, নীরবে আত্মোৎসর্গ করিয়া যাইতে পারে, এমন কর্ম্মী কি বাঙ্গলায় আজ নাই?
নিজেদের intellectual ও spiritual উন্নতি অবহেলা করিয়া যাহারা জনসেবায় আত্মনিয়োগ করিয়াছে তাহারা যে এই সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কলহবিবাদে সকলকে মত্ত দেখিয়া নিতান্ত নিরাশ হইয়া রাজনীতি ক্ষেত্র হইতে সরিয়া পড়িবে, ইহাতে আর আশ্চর্য্য কি? নিজেদের মানসিক ও পারমার্থিক কল্যাণকে তুচ্ছ করিয়া যাহারা জনহিত ব্রতে ব্রতী হইয়াছে তাহারা কি শেষে এই ক্ষুদ্র ঝগড়া-বিবাদের মধ্যে নিজেকে ডুবাইয়া দিবে? জনসেবার আশায় নিরাশ হইলে তাহারা যদি পুনরায় নিজেদের পারমার্থিক কল্যাণে মনোনিবেশ করে তাহা হইলে কি তাহাদিগকে দোষ দেওয়া যায়? আমি আজ স্পষ্ট বুঝিতেছি যে, সমাজের বর্ত্তমান অবস্থা যদি চলে, তবে বাঙ্গলার বহু নিঃস্বার্থ কর্ম্মী ক্রমে ক্রমে অনিলবরণের পন্থা অবলম্বন করিতে বাধ্য হইবে।
আজ বাঙ্গলার অনেক কর্ম্মীর মধ্যে ব্যবসাদারী ও পাটোয়ারী বুদ্ধি বেশ জমিয়া উঠিয়াছে। তাহারা এখন বলিতে আরম্ভ করিয়াছে, “আমাকে ক্ষমতা দাও—নতুবা আমি কাজ করিব না।” আমি জিজ্ঞাসা করি—নরনারায়ণের সেবা ব্যবসাদারীতে, Contract-এ কবে পরিণত হইল? আমি তো জানিতাম সেবার আদর্শ এই—
“দাও দাও ফিরে নাহি চাও
থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।”
যে বাঙ্গালী এত শীঘ্র দেশবন্ধুর ত্যাগের কথা ভুলয়াছে—সে যে কতদিনের আগেকার স্বামী বিবেকানন্দের ‘বীরবাণী’ ভুলিবে—আর বিচিত্র কি?
দুঃখের কথ, কলঙ্কের কথা ভাবিতে গেলে বুক ফাটিয়া যায়। প্রতিকারের উপায় নাই—করিবার ক্ষমতা নাই— তাই অনেক সময় ভাবি—চিঠিপত্র লেখা বন্ধ করিয়া বাহ্য জগতের সহিত সকল সম্বন্ধ শেষ করিয়া দিই। পারি তো দেশবাসীর পক্ষ হইতে আমরা লোকচক্ষুর অন্তরালে তিলে তিলে জীবন দিয়া প্রায়শ্চিত্ত করিয়া যাইব। তারপর মাথার উপরে যদি ভগবান থাকেন, পৃথিবীতে যদি সত্যের প্রতিষ্ঠা হয়, তবে আমাদের হৃদয়ের কথা দেশবাসী একদিন না একদিন বুঝিবেই বুঝিবে। দেশের নামে এতবড় একটা প্রহসনে অভিনয় দেখিব—বিংশ শতাব্দীর বাঙ্গলা দেশে যে ‘Nero is fiddling while Rome is burning’ কথার একটা নূতন দৃষ্টান্ত চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিবে—কোনও দিন ভাবি নাই।
অনেক কথা বলিয়া ফেলিলাম—হৃদয়ের আবেগ চাপিয়া রাখিতে পারিলাম না। আপনাদের নিতান্ত আপনার বলিয়া মনে করি তাই এত কথা বলিতে সাহস করিলাম। আপনারা গঠনমূলক কাজে ব্যাপৃত—আশা করি, আপনারা এই দলাদলির পঙ্কিল আবর্ত্তে আকৃষ্ট হইবেন না।
বিদ্যালয়ের কথা পড়িয়া বিশেষ আনন্দিত হইলাম। বাড়ীর কথা শুনিয়া অবশ্য দুঃখিত না হইয়া পারিলাম না। তবে এ কথা আমি পূর্ব্ব হইতে জানি এবং চণ্ডীবাবু প্রভৃতি বন্ধুদিগকে কয়েক বৎসর পূর্ব্বেই বাড়ীটির পরিণামের কথা বলিয়াছিলাম। আমার সর্ব্বদা মনে হইত যে স্কুলের কর্তৃপক্ষরা unbusinesslike ভাবে জমির “লিজ” লইয়া বাড়ী নির্ম্মাণ আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং তার ফলে পরিণামে জমিদারেরই লাভ হইবে। যাক্, এখন ত “গতস্য শোচনা নাস্তি।” আপনারা যে কিছুমাত্র নির্ভরসা না হইয়া ‘গৃহ নির্ম্মাণ’ ভাণ্ডার সংগ্রহ করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছেন, ইহা খুব আশাপ্রদ। আপনাদের চেষ্টা যে সফল হইবে সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নাই, কারণ
“নহি কল্যাণকৃৎ কশ্চিৎ দুর্গতিং তাত! গচ্ছতি।”
সমিতির সকল সংবাদ পাইয়া বিশেষ সুখী হইলাম। আপনারা যদি মেথর মুচি প্রভৃতি তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর বালকদের জন্য একটি বিদ্যালয় করিতে পারেন তবে বড় ভাল হয়। এ বিষয়ে অমৃতের সহিত পরামর্শ করিবেন—আমি অনেক দিন হইল তাহার পত্র পাইয়াছি, দুঃখের বিষয় উত্তর দিয়া উঠিতে পারি নাই। কুলদাকে দিলাম—আশা করি আগামী সপ্তাহে অমৃতকে লিখিতে পারিব।
বলা বাহুল্য আমি থাকিলে আপনাদের আলাদা হইতে দিতাম না। অবশ্য ভিন্ন শাখা গঠনের সহায়তা আমি করিতাম কিন্তু একেবারে ভিন্ন নাম দিয়া নূতন প্রতিষ্ঠান করিতে দিতাম না। যাক্, এখন আর উপায় নাই। যাহা হইয়াছে ভালই হইয়াছে—এই বলিয়া কাজে লাগিতে হইবে। আপনারা Constitution করিয়া ভালই করিয়াছেন।
আশা করি চাউল ও চাঁদা গ্রহণ লইয়া বালক সমিতির সহিত আপনাদের গণ্ডগোল হইবে না। এক জায়গায় যদি অনেক সমিতি চাঁদা ও চাউল গ্রহণ আরম্ভ করে তবে গৃহস্থেরা উত্ত্যক্ত হইয়া ওঠে, সুতরাং সে বিষয়ে একটু দৃষ্টি রাখা দরকার।
আমার মনে হয় যে, আপনারা যাদ ২।১ জন কর্ম্মী বা শিক্ষককে কাশীমবাজার পলিটেকনিক (Cossimbazar Polytechnic) স্কুলে শিখাইয়া লইতে পারেন তবে technical শিক্ষার খুব সুবিধা হইবে। আমি একবার কাশীমবাজার স্কুলে গিয়াছিলাম। আমার বেশ ভালই লাগিয়াছিল—তাহারা কয়েকটী নূতন জিনিস শেখায় যাহা সাধারণ স্কুলে হয় না—যেমন বেতের কাজ, clay modelling, পুতুল নির্ম্মাণ, কামারের কাজ, সেলাই, electroplating ইত্যাদি। আমি যখন যাই তখন electroplating-এর জন্য machinery-র আমদানি হইতেছে। আপনার প্রেরিত বিদ্যালয় ও সমিতির Constitution আমি পাইয়াছি।
স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ ভাল হইতেছে না—ইহা দুঃখের বিষয়। এর কারণ এই যে জনসাধারণকে ঠিকভাবে ডাকা হয় নাই। ডাকার মত ডাকিতে পারিলে তাহারা সাড়া না দিয়া পারিবে না। তাহাদের মধ্যে intuition ও কর্ম্ম-প্রেরণা জাগানই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্দেশ্য দাতব্য চিকিৎসালয়ের উদ্দেশ্য হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। তাহাদের মধ্যে কর্ম্ম-প্রেরণা জাগাইতে হইলে তাহাদিগকে ভালবাসার দ্বারা আপনার করিতে হইবে।
আপনারা হয়তো জানেন না যে দক্ষিণ কলিকাতা সেবাশ্রমের ত্রুটির জন্য আমি প্রধানতঃ দায়ী। বাহিরে থাকিতে আমি ভাল রকম organise করিতে পারি নাই। তারপর হঠাৎ আমার গ্রেপ্তার। যখন সেবাশ্রম কালীঘাটে ছিল তখন বাড়ী ভাড়া ও সহকারী সম্পাদকের বেতন আমি নিজে দিতাম। শুধু বালকদের ভরণপোষণের খরচ সাধারণের দেওয়া চঁদা হইতে নির্ব্বাহিত হইত। সেবাশ্রম সম্বন্ধে আমার clear conscience আছে, কারণ Public-এর দেওয়া টাকার একটী পয়সারও আমি অসদ্ব্যবহার করি নাই। আমার গ্রেপ্তারের পর আমার দেয় অংশ আমার দাদা (শরৎবাবু) দিয়া আসিতেছেন। সম্প্রতি খরচ কমিয়াছে এবং আয় বাড়িয়াছে বলিয়া তাঁহাকে আর পূর্ব্বেকার মত টাকা দিতে হয় না। আমি যখন মাসে মাসে দুই শত টাকা করিয়া সেবাশ্রমের জন্য ব্যয় করিতাম, তখন অনেক বন্ধু বলিয়াছিলেন যে, আমি বৃথা ছয়-সাতটি বালকের জন্য এত অর্থ ব্যয় করিতেছি। এ টাকার সদ্ব্যবহার অন্য ভাবে হইতে পারে। কিন্তু তাঁহারা জানেন না যে, আমি খেয়ালের বশবর্ত্তী হইয়া সেবাশ্রমের কার্য্যে হস্তক্ষেপ করি নাই। আজ প্রায় ১২।১৭ বৎসর ধরিয়া যে গভীর বেদনা তুষানলের মত আমাকে দগ্ধ করিতেছে, তাহ দূর করিবার জন্য আমি এই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছি। আমি কংগ্রেসের কাজ ছাড়িতে পারি—তবুও সেবাশ্রমের কাজ ছাড়া আমার পক্ষে অসম্ভব। “দরিদ্র নারায়ণের” সেবার এমন প্রকৃষ্ট সুযোগ আমি কোথায় পাইব। এই সেবাশ্রমের পেছনে কত ইতিহাস লুক্কায়িত আছে— কবে এই চিন্তা আমার মধ্যে প্রবেশ করে এবং কেন প্রবেশ করে—কি করিয়া আমি চিন্তারাজ্য ছাড়িয়া কর্ম্ম রাজ্যে প্রবেশ করি— সে কথা অন্য সময় বলিব। পত্রে লিখিবার চেষ্টা করিলে গ্রন্থ হইয়া যাইবে।
অনেক কথা লিখিলাম, এখন শেষ করি। আমার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, কি উত্তর দিব? রবিবাবুর একটী কবিতা আমার খুব ভাল লাগে। কবির ভাষায় উত্তর দিলে কি ধৃষ্টতা হইবে? কবির এত আদর এইজন্য যে আমাদের অন্তরের কথা কবিরা আমাদের অপেক্ষা স্পষ্টতর ও স্ফুটতর ভাবে ব্যক্ত করতে পারেন। তাই বলি—
“এখনো বিহার কল্প জগতে
জেলখানা (অরণ্য) রাজধানী,
এখনো কেবল নীরব ভাবনা
কর্ম্মবিহীন বিজন সাধনা
দিবানিশি শুধু বসে বসে শোনা
আপন মর্ম্মবাণী।
* * *
মানুষ হতেছি পাষাণ কোলে
* * *
গড়িতেছি মন আপনার মান
যোগ্য হতেছি কাজে
* * *
কবে প্রাণ খুলি বলতে পারিব
‘পেয়েছি আমার শেষ!’
তোমরা সকলে এস মোর পিছে
গুরু তোমাদের সবারে ডাকিছে
আমার জীবনে লভিয়া জীবন
জাগরে সকল দেশ!”
শরীর তত ভাল নাই, তবে তার জন্যে চিন্তাও নাই। আমার ভালবাসা ও প্রীতি সম্ভাষণ জানিবেন। অমৃত প্রভাত ভাইরা কেমন আছেন? আপনাদের কুশল সংবাদ পাইলে অত্যন্ত সুখী হইব। তবে কাজের সময় নষ্ট করে পত্র লিখিবার প্রযোজন নাই। আমার প্রতিপূর্ণ নমস্কার গ্রহণ করিবেন। ইতি—