পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১২৬

সত্যেন্দ্রচন্দ্র মিত্রকে লিখিত

১২৬
কেলসল লজ
শিলং
২৫শে জুন, ১৯২৭
সেন্সর কর্ত্তৃক পরীক্ষিত

স্বাক্ষর অস্পষ্ট
ডি. আই. জি., আই. বি.,
 সি. আই. ডি, বেঙ্গল।

২৮।৬।১৯২৭

প্রিয়বরেষু সত্যেনবাবু,

 ১২ই তারিখে আমি এখানে পৌঁছিয়াছি। শিলং জায়গাটি বেশ স্বাস্থ্যকর এবং এখানে জলবায়ুও এখন বেশ শীতল—একমাত্র বর্ষা ছাড়া বেশ আরামদায়ক। তবে আমি এখনও পর্য্যন্ত আমার পরিপাক শক্তির কোন প্রকার উন্নতি দেখিতে পাইতেছি না। জ্বর সমানে আছে, তবে দৈনিক তাপবৃদ্ধি এখন অনেক কমিয়া গিয়াছে, বক্ষে বেদনা, কষ্টকর কাশি প্রমুখ লক্ষণগুলি এখন কমিয়াই গিয়াছে, মোটের উপর একমাস পূর্ব্বে আমার স্বাস্থ্যের যে অবস্থা ছিল সে তুলনায় এখন যথেষ্ট পরিমাণে ভালই আছি। তবে এই আবহাওয়া ঠিক আমার বর্ত্তমান স্বাস্থ্যের পক্ষে দুর্ভাগ্যবশতঃ অনুকুল নয়, তারপর অজীর্ণজনিত অস্বাচ্ছন্দ্য তো আছেই—এই সকল প্রতিবন্ধকতাগুলি না থাকিলে, আমার বিশ্বাস আমার স্বাস্থ্যের আরও বহুল পরিমাণ উন্নতি ঘটিত। যাহাই হউক সর্ব্বোত্তমের জন্যই আশা রাখা যাক্।

 আমি যখন ইনসিনে ছিলাম সেই সময় পণ্ডিচেরী হইতে অনিলবাবু আমাকে পত্র লিখিয়া গত ২১শে মার্চ্চের সরকারী প্রস্তাবটি গ্রহণ করিতে বলেন। ঐ পত্রে তিনি আমাকে আপনার অভিমতটিও (তাঁহারই মতের অনুরূপ) জ্ঞাপন করেন। ম্যাণ্ডেলে হইতে প্রত্যাবর্ত্তনের পর লেঃ কঃ তারাপোরেও আমার সহিত ইনসিনে সাক্ষাৎ করেন এবং আপনার মতামত সম্বন্ধে আমাকে অবহিত করেন। আমি আশা করি যে আমরা সকলেই এ বিষয়ে একমত যে “যাহার শেষ ভাল তাহার সব ভাল।”

 ইনসিন হইতে ৩৮/১ এলগিন রোড পর্য্যন্ত আমার যাত্রার খুঁটিনাটি বিবরণসহ একটি বর্ণনা লিপিবদ্ধ করাব প্রবল বাসনা মনের মধ্যে ছিল, কারণ সেই বিবরণ আপনাদের পক্ষে আনন্দদায়ক হাটত বলিয়াই আমার ধারণা। কিন্তু আমি দেখিলাম যে সংবাদপত্রগুলি এ সম্বন্ধে প্রায় সব কিছুই প্রকাশ করিয়াছে; সে সম্বন্ধে কেবল একটি বিষয়ের উল্লেখ প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে করি। দণ্ডিত ওয়ার্ডার গফুর আমার পরিচারক হিসাবে এই যাত্রায় আমার সহচর ছিল। সে খাদি পোষাক পরিহিত ছিল। আউটরাম ঘাটে অবতরণের পর ইংলিশম্যানের সংবাদদাতা তাহাকে সরকারী কয়েদী বলিয়া অনুমান করিয়া লইলেন। সংসদীয় সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে আপনার ভ্রাতাকে আপনি যে পত্র লিখিয়াছিলেন এবং আপনার প্রতি মিঃ প্যাটেলের উত্তর পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত হইয়াছে। বঙ্গীয় পরিষদের সভাপতির উদ্দেশ্যে লিখিত আমার পত্রটিও কয়েকদিন পূর্ব্বে পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে। কলিকাতা ত্যাগের কয়েকদিন পূর্ব্বে উহা আমি প্রেরণ করিয়াছিলাম।

 আপনারা সকলে কারাগারে আবদ্ধ হইয়া থাকিবেন—আর আমি একা মুক্তির আলোকধারায় স্নাত হইব—ইহা ভাবাও আমার পক্ষে বেদনাদায়ক। ভাবিলে মন ভারাক্রান্ত হইয়া উঠে। বর্ত্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী এই অবস্থাকে সহজভাবে গ্রহণ করা আমার পক্ষে সহজসাধ্য নয়।

 কারাভ্যন্তরবাসী আমার কোন বন্ধুকে মুক্তি সম্বন্ধে আমি অন্ততঃ কোন আশা বা আশ্বাস দিতে চাই না, তাহার কারণ আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, যতক্ষণ পরিপূর্ণরূপে কারাগার হইতে মুক্ত না হওয়া যায়—ততক্ষণ সে সম্বন্ধে কোন সুস্পষ্ট আশা পোষণ করা চলে না। এই ধারণায় আমি সাধারণভাবে এইটুকুমাত্র বলিতে পারি যে ভবিষ্যৎ আশাপ্রদ।

 আপনাদের কারাগারে থাকাকালীন আমি যদি জেলের বাইরে থাকি, সে হেন সময়ে যদি আপনাদের যে কোন একজনেরও আমার কোনরূপ সেবার প্রয়োজন হয় তাহা হইলে সে বিষয়ে আমাকে জানাইতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিবেন না। আমার ক্ষমতার আয়ত্তে যে কোন কাজ আপনাদের জন্য সর্ব্বদা করিব জানিবেন।

 যদি কোন পুস্তক আমি ফেলিয়া আসিয়া থাকি এবং আপনারও যদি তাহার কাজ মিটিয়া গিয়া থাকে তাহা হইলে অনুগ্রহপূর্ব্বক আপনার সুবিধা অনুযায়ী বইটি এখানে পাঠাইয়া দিলে সুখী হইব; এখানে আমার পিতৃদেব ও মাতৃদেবী আছেন এবং আমাদের পরিবারের আরও কয়েকজন আছেন তাঁহাদের সকলেরই কুশল জানিবেন।

 কৃপাপূর্ব্বক এই পত্রখানি আমাদের সুহৃদবর্গের প্রত্যেককেই দেখাইবেন। কারণ আজ আমি আর কাহাকেও লিখিতেছি না, পত্রিকায় দেখিলাম সুরেনবাবু পুনর্ব্বার তাঁহার পুরাতন সহচর আমাশয় এবং অজীর্ণের কবলিত হইয়াছেন। এ সংবাদে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন আছি জানিবেন। তিনি এখন আছেন কিরূপ?

 সকলের উদ্দেশ্যে প্রীতির অর্ঘ্য নিবেদন করি।

আপনার গুণমুগ্ধ
সুভাষচন্দ্র বসু
সত্যেন্দ্রচন্দ্র মিত্র মহাশয়, এম-এল-এ,

অবধারক: ডি আই জি, আই বি,
 সি আই ডি, বেঙ্গল

১৩ ইলিসিয়াম রো, কলিকাতা।

(ইংরাজী হইতে অনূদিত)