পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১২৭
শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবীকে লিখিত
পরম পূজনীয়া মা,
আপনার ১০ই জুলাই-র পত্র ১৩ই তারিখে আমি পেয়েছি। আমার কথা মত আপনাকে পত্র দিই নাই—আমারই দোষ—সুতরাং আমি ক্ষমার পাত্র। মানুষ কোনও সম্বন্ধ স্বীকার করে নিলে তার সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলি কর্ত্তব্য তার ঘাড়ে এসে পড়ে এবং সেগুলি সম্পাদন না করলে তার পক্ষে অন্যায় হয়। অতএব আমার যে ত্রুটি হয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই।
আপনি যে প্রায়ই বলে থাকেন এবং লিখেও থাকেন—“এ সংসারে আমার সাহচর্য্য আর কাহাকেও আনন্দ দান করিতে পারিবে না”—এ কথা মোটেই সত্য নয়। আপনি কি জানেন না—বাঙ্গলার তরুণ যুবকেরা (আর সকলের কথা না হয় তর্কের খাতিরে বাদ দিলাম) আজও আপনাকে কি চোখে দেখে? আপনি যদি তাদের একেবারে “পর” বলে ভাবেন—তবে কি তাহাদের প্রতি অবিচার করা হয় না? তারা কি তাদের হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য আপনার চরণে ঢেলে দেয়নি? তারা কত আশা করেছিল যে দেশবন্ধু যখন ইহলোক ত্যাগ করে গেলেন তখন আপনি এগিয়ে এসে তাদের নেতৃত্বভার গ্রহণ করবেন। সে আশা যখন পূর্ণ হ’ল না তখন তাহাদের হৃদয়ের অপরিসীম ব্যথা ও হতাশা রাখবার কি আর স্থান ছিল? দেশবন্ধু জীবদ্দশায় বলতেন যে আপনি তাঁহার জীবদ্দশায় জনহিতকর কাজে প্রকাশ্যভাবে সংশ্লিষ্ট না হলেও তাঁহার অনুপস্থিতিতে আপনি তাঁর পরিত্যক্ত স্থান পূরণ করবেন।
আপনি হয়তো বলবেন যে হিন্দু মহিলার কাজ পরিবারের মধ্যে, পর্দ্দার আড়ালে—public platform-এ নয়। আমি মা’র কর্ত্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দিবার ধৃষ্টতা রাখি না; কিন্তু আমার মনে হয় যে আজ আমাদের দেশের ও সমাজের সহজ অবস্থা নয়। আজ যে আমাদের ঘরে আগুন লেগেছে—মা। ঘরে আগুন লাগে যখন—তখন যিনি পর্দ্দানশীন তাঁকেও সাহস করে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হয়। সন্তানকে বাঁচাবার জন্য— আগুনের হাত থেকে মূল্যবান সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য— তাঁকেও পুরুষ-বিক্রমে পরিশ্রম করতে হয়। তাতে কি তাঁর মর্য্যাদার বা grace-এর হানি হয়?
বাঙ্গলার সাধনা প্রধানতঃ মাতৃমূর্ত্তির ভিতর দিয়ে প্রকট হয়েছে। কি ভগবান কি স্বদেশ—আমাদের আরাধ্য যা’ কিছু—আমরা তাহা মাতৃমূর্ত্তিরূপে কল্পনা করেছি। কিন্তু হায়! বাঙ্গলার পুরুষেরা আজ এত নির্ব্বীর্য্য ও কাপুরুষ হয়ে পড়েছে যে বাঙ্গলা দেশের জেলায় জেলায় স্ত্রীলোেকদের উপর যে অত্যাচার চলেছে তা প্রতিরোধ করতে অক্ষম। সে দিন (কয়েক মাস হ’ল) “সঞ্জীবনীতে” লিখেছিল—“আপনার মান রাখিতে জননী, আপনি কৃপাণ ধর গো।” কথাগুলি আমার প্রাণে বড় লাগল। আজ বাস্তবিক দেশের অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাই; শুধু তাহা নয়—বোধ হয় সন্তানের মান রাখতেও জননীকে অগ্রসর হতে হবে—দেশ এমনই হতশ্রী ও হীনবীর্য্য হয়ে পড়েছে।
আমার সময়ে সময়ে মনে হয় যে আপনি যদি বাহিরের পাঁচরকম জনহিতকর কাজে মন দিতে পারতেন—তা’ হ’লে বোধ হয় ভিতরের জ্বালাটা কিয়ৎপরিমাণেও কমত। পারিবারিক জীবনের সুখ-দুঃখের দ্বারা কি আমাদের জীবনটা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত? আপনি ছিলেন রাজরাজেশ্বরী—আজ আপনি পার্থিব দৃষ্টিতে রিক্তহস্তা। এ কথা যে ভাবে—তারই হৃদয়ে তীব্র জ্বালা না হয়ে পারে না। কিন্তু আমাদের সান্ত্বনা এই যে ভারতের নরনারী অনাদিকাল হ’তে রাজার ঐশ্বর্য্য অপেক্ষা সন্ন্যাসের গৌরবকে অধিকতর শ্লাঘ্য, শ্রেয় ও পূজ্য বলে মনে করে আসছে। সন্ন্যাসের গৌরবময় প্রভাবে আপনার দেশবাসীর হৃদয়ে আপনার স্থান যে কত উঁচুতে উঠেছে তা বোধ হয় আপনি জানেনও না। জানি না এ সব কথা বলা আমার পক্ষে চাপল্য হ’ল কি না কিন্তু আমার justification শুধু এই যে, যে তীব্র জ্বালা আপনাকে নিরন্তর দগ্ধ করছে তাহা অতি সামান্যভাবেও আমাকে সময়ে সময়ে পীড়া দেয়—এবং একথা বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে বাঙ্গলার অসংখ্য যুবককেও পীড়া দেয়।
পূর্ব্ব পত্রে আপনি লিখেছিলেন—“অভিশপ্ত জীবনের সব কাজই শেষ হইয়া গিয়াছে, এখন শুধু শেষ প্রতীক্ষায় নীরবে বসিয়া থাকা ছাড়া আর কিছু খুঁজিয়া পাই না। জানি না কত যুগ-যুগান্তরে আমার অভীষ্ট মিলিবে।”
আমার আশঙ্কা হয় যে অত্যধিক brooding-এর ফলে আপনি সময়ে সময়ে ভুলে যান যে দেশের বুকে— এবং আমাদের বুকে আপনার আসন কোথায়। তা যদি বিস্মৃত না হতেন তবে নিজের জীবনকে ভীষণ পারিবারিক দুর্ঘটনা সত্ত্বেও “অভিশপ্ত” বলতে পারতেন না। ভগবানের নিকট যিনি প্রিয় তাঁর উপরেই বারে বারে দুঃখ ও বিপদ বর্ষিত হয়—এ কথা কি একেবারে মিথ্যা? আর, মানুষের হৃদয় যত বড় হয় তার দুঃখও তত বেশী জোটে—একথাও কি একেবারে মিথ্যা? আমাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষা আপনি পূরণ করুন— আপনার আসন চিরকাল দেশের বুকে অটুট থাকবে। যে ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালবাসা আপনার চরণে দেশের লোক ঢেলে দিয়েছে, দিচ্ছে এবং দিবে—তার দশমাংশও কি কোনও তথাকথিত ভাগ্যবান লোক পেতে পারেন? কত আশা-আকাঙ্ক্ষা বুকে করে নিয়ে দেশবন্ধু আমাদের ফেলে চলে গেলেন। তাঁর সেই সব স্বপ্নই তার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ Legacy। যে Legacy আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আপনিও পেয়েছেন। সুতরাং আপনি কি বাস্তবিকই অন্তরের সহিত বলিতে পারেন—আপনার কাজ শেষ হয়েছে এবং যাবার সময় হয়েছে? বললে ধৃষ্টতা হয় কিন্তু তবুও বলতে ইচ্ছা হচ্ছে যে আপনার যিনি ইষ্ট তিনি কখনও এ বিষয়ে আপনার কথা সমর্থন করবেন না— বরং আমার কথাই সমর্থন করবেন।
আপনি লিখেছেন—“জড় প্রকৃতির সাথে এখানেই আমার অন্তরপ্রকৃতির যথার্থ মিলন। এই ঘন ঘোর অন্ধকার আমার বেশ লাগে।” আপনার হয়তো সব সময়েই অন্ধকার আজকাল ভাল লাগতে পারে— কিন্তু সকলেরই অন্ততঃ মধ্যে মধ্যে অন্ধকার ভাল লাগে। অন্ধকারকে ভালবাসলে তার বুকে যে আলো লুকান আছে—তাকে কি ভালবাসতে নাই? সে বেচারীর অপরাধ কি? সে তো সকলকে সুখী করতে চায়, আলো ও আনন্দ দিতে চায়।
আপনি হয় তো কোনও বন্ধনের মধ্যে আসতে চান না—সে বন্ধন কাজেরই হউক বা মানুষেরই হউক। কিন্তু আমাদের তো কোন উপায় নাই। যে দিন “মা” বলেছি সে দিনই সম্বন্ধ স্বীকার করে নিয়েছি। এ সম্বন্ধ তো অন্ততঃ ইহজীবনে ছিন্ন হবার নয়। সংসারের প্রাচীর আছে—বাধা আছে— লােকাচার আছে—কিন্তু এ সব সত্ত্বেও অন্তরের সম্বন্ধ তো মিথ্যা হতে পারে না।
মানুষ জীবনে এমন একটি স্থান চায় যেখানে তর্ক থাকবে না— বিচার থাকবে না—বুদ্ধি-বিবেচনা থাকবে না—থাকবে শুধু Blind Worship। তাই বুঝি “মা”-র সৃষ্টি। ভগবান করুন যেন আমি চিরকাল এই ভাব নিয়ে মাতৃপূজা করে যেতে পারি।
আমার শরীর পূর্ব্বাপেক্ষা ভাল। কতকটা জোর পেয়েছি—ঘুম ভাল হচ্ছে—(বােধ হয় একটু বেশীই হচ্ছে) এবং হজমের গােলমাল মােটের উপর কমেছে। ওজন বােধ করি বেড়েছে, তবে ওজন নেওয়া হচ্ছে না বলে সঠিক বলতে পারছি না। হজমের আরও একটু উন্নতি হলে তাড়াতাড়ি শরীর সারবে। বৃষ্টি বেশ হচ্ছে—সব সময়ে বৃষ্টি ভাল লাগে না। সংসারে অবিরাম ক্রন্দনটা সত্য, কিন্তু হাসিটাও বােধ হয় সত্য। তাই জ্যোৎস্নার আলােক পেলে যে সুখী হই না তা নয়।
অনেকটা চপলতা প্রকাশ করেছি—ক্ষমা পাব তা জানি—এই ভরসায়। ওখানকার কুশল সংবাদ চাই। আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করবেন। ইতি—
সুভাষ
পুনঃ-“সেবা সদনে”র List of Donors আমার সঙ্গে চলে এসেছে। আমি ২।১ দিনের মধ্যে Register করে পাঠিয়ে দিব।
সুভাষ