পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১২৯
প্রিয় সন্তোষবাবু,
প্রায় একই রূপ আর একটি বিষয়ে পুনরায় আপনাকে পত্র দিতেছি। আপনাকে কষ্ট দিতে হইতেছে বলিয়া আমি দুঃখিত; কিন্তু এমন লোকের সংখ্যা খুবই সামান্য যাহার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করা যায় এবং অন্য কোনও উপায় নাই।
বাবু অমূল্যচন্দ্র মুখার্জ্জী এই প্রদেশে সহকারী জেলার ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে যখন দলে দলে লোক কারাবরণ করিয়াছে তখন তিনি আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছেন। তিনি যখন প্রেসিডেন্সী জেলে ছিলেন—দেশবন্ধু, মিঃ শাসমল, আমি ও আরও অনেকে সেখানে ছিলাম। আমাদের মধ্যে অনেকেরই সেই সময় জেলের আইনকানুন সম্বন্ধে কোনও ধারণা ছিল না কিন্তু দেশবন্ধু ও অন্যান্য সকলকে নানাভাবে সাহায্য করিতে তিনি আগাইয়া আসিয়াছিলেন। ১৯২৪ সালে অসহযোগ আন্দোলনের পর তিনি হুগলীতে ছিলেন। আপনার হয়তো মনে থাকিতে পারে তারকেশ্বর মামলার বন্দীদের জন্যই হুগলী জেল তৈরী হইয়াছিল। অন্যান্য অনেকের সঙ্গে চিররঞ্জনও সেই সময়ে হুগলীতে (জেলে) ছিল। সেখানেও তিনি অনেক কাজ করিয়াছিলেন। ইহার পর কিছুদিন হুগলী জেলে ও পরে প্রেসিডেন্সী জেলে তিনি রাজবন্দীদের ভারপ্রাপ্ত হইয়া ছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময়ে রাজবন্দীদের প্রতি তাঁহার ব্যবহার ও মনোভাব C. I. D. ও জেল ডিপার্টমেণ্ট জানিতে পারিয়াছিল। এ সম্বন্ধে তাঁহার বিরুদ্ধে গোপনে কয়েকটি অভিযোগও আনা হইয়াছিল যাহার ফলে তাঁহার পদোন্নতি বন্ধ হইয়া যায়। পরে নিতান্তই সামান্য একটি কারণে তাঁহাকে বরখাস্তও করা হয়।
আমরা বরাবরই তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ বোধ করিয়াছি। দেশবন্ধুও উহা স্বীকার করিয়াছেন এবং আজ যদি তিনি জীবিত থাকিতেন তাহা হইলে তিনি নিশ্চয়ই তাঁহার জন্য কিছু করিতেন। তাঁহার সম্বন্ধে দেশবন্ধুর কিরূপ গভীর আগ্রহ ছিল উহা আমার অজানা নাই। সেই সময়ে অমূল্যবাবুর চাকুরী যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না; তাই আমরা তাঁহার ভাইকে (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বি-এ পাশ করিয়াছে) কর্পোরেশনে মোটামুটি ভাল একটি চাকুরী দিতে চাহিয়াছিলাম। অমূল্যবাবুর ভাই-এর দরখাস্ত তাঁহার কাছেই ছিল, আমাকে যদি হঠাৎ গ্রেপ্তার করা না হইত তাহা হইলে আমি তাঁহার জন্য কিছু করিতে পারিতাম বোধহয়।
যাঁহারা জেলে ছিলেন ও সেখানকার কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার নির্দ্দয় নির্য্যাতন ভোগ করিয়াছেন তাঁহারাই শুধু বুঝিতে পারিবেন যে, অমূল্যবাবুর এই সাহায্য কতখানি মূল্যবান ছিল এবং কি পরিমাণ ঝুঁকি ও বিপদের দায়িত্ব লইয়া তাঁহাকে উহা করিতে হইয়াছে। আপনি বোধহয় জানেন যে, সামরিক শৃঙ্খলার মতই জেলের আইনকানুনও অত্যন্ত কঠোর; সেখানে কেহ যদি রাজবন্দীদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে বা তাহাদের কোনও কাজ করিয়া দেয় তাহা হইলে তাহাকে চরম শাস্তি ভোগ করিতে হয়। অমুল্যবাবু নিজের কাজে অবহেলা ঘটাইয়া দেশের কাজে যাঁহারা দণ্ড ভোগ করিতেছিলেন তাঁহাদের সাহায্য করিতে গিয়া সরকারের কোপদৃষ্টিতে পড়িয়াছিলেন। তাঁহার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হইয়াছিল উহা খুবই সামান্য—এবং এ অপরাধে কাহাকেও শাস্তি দেওয়া হয় না বা চাকুরী হইতে বরখাস্ত করা হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে কারণটা ছিল রাজনৈতিক—গোপন পুলিস ও বিভাগীয় রিপোর্টের দরুনই তাঁহার ভাগ্য এভাবে নির্দ্ধারিত হইয়াছে।
আমি—এবং সম্ভবতঃ আরও শত শত রাজবন্দী—অমূল্যবাবুর প্রতি শ্রদ্ধা ও কর্ত্তব্যবোধে তাঁহার এই দুঃসময়ে কিছু করা প্রয়োজন বোধ করিতেছি। নিম্নলিখিত উপায়ে তাঁহাকে সাহায্য করা যাইতে পারে:—
(১)মাসিক ১৫০৲ টাকা মাহিনায়—২০০৲ টাকা হইলেই ভাল হয়—কর্পোরেশনে তাঁহাকে একটি চাকুরী দেওয়া যাইতে পারে।
|
অমূল্যবাবুকে যখন বরখাস্ত করা হয় তখন ১৩৫৲ টাকা মাহিনা ছাড়াও তিনি বিনামূল্যে বাসস্থান, তরিতরকারি ও ভৃত্য পাইতেছিলেন। তিনি যােগ্যতার সহিত ১৫ বৎসর চাকুরী করিয়াছেন। উপরােক্ত বিষয়গুলি বিবেচনা করিলে সব মিলাইয়া তাঁহার মাহিনা মাসিক প্রায় ২২৫৲ টাকার মতই ছিল।
তাঁহার ভাই খুলনায় Forest Overseer-এর একটি অস্থায়ী চাকুরী গ্রহণ করিয়াছে। যতদিন না ভাল চাকুরী জোগাড় হয় ততদিন সে সাময়িকভাবে উহা করিবে—ইহাই তাহার ইচ্ছা। দেশবন্ধুর মহাপ্রয়াণ ও আমার গ্রেপ্তারের দরুন সে খুব হতাশ হইয়া পড়িয়াছে। কর্পোরেশনে চাকুরী না হইলে সাব-রেজিস্ট্রার বা সার্কেল-অফিসারের পদের জন্য সে চেষ্টা করিতে চায়। প্রথমটি Minister-in-Charge মিঃ চক্রবর্ত্তী ও দ্বিতীয়টি চীফ সেক্রেটারী বা তাঁহার ডেপুটির হাতে আছে। এখন ডেপুটি চীফ সেক্রেটারী মিঃ এস, এন, রায়। মিঃ চক্রবর্ত্তীকে ধরিতে হইলে মিঃ আই, বি, সেন অথবা মিঃ বি, কে, লাহিড়ী মারফৎ উহা করিতে হইবে। কর্পোরেশনের মিঃ সুকুমার লাহিড়ী এ ব্যাপারে কোনও সাহায্য করিতে পারেন কি?
গভর্ণমেণ্টের নিকট পুনর্ব্বিবেচনার আবেদন পাঠাইবার জন্য আমি অমূল্যবাবুকে পরামর্শ দিয়াছি— কিন্তু তিনি উহা করিতে চান না। যে কারণে Inspector General of Prisons তাঁহাকে বরখাস্ত করিয়াছেন উহা নিতান্তই সামান্য এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দ্বারা উহা প্রমাণ করাও সম্ভব নয়। তবু রাজনৈতিক কারণেই (যাহা গঠিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয় নাই) তাঁহার পুনর্নিয়োগ আশা করা যাইতে পারে। যাহা হউক, এক্ষেত্রে ফল কতদূর কি হইবে জানি না; তবু গভর্ণমেণ্টকে প্রকৃত কারণ প্রকাশ করিতে বাধ্য করিতেই হইবে। তাছাড়া তাঁহার বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ করা হইয়াছে তাহার সহিত জেলারকেও জড়ানো উচিত ছিল—অমূল্যবাবু তাহার অধস্তন কর্ম্মচারী ছাড়া আর কিছু নন। আমি জানি, জেল বিভাগে যখনই কোনও ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটে তখন অধস্তন কর্ম্মচারীকে না ধরিয়া জেলারকেই ধরা হয়। তাছাড়া টাকাকড়ির ব্যাপারে জেলারই সব কিছু দেখাশুনা করিয়া থাকেন—অধস্তন কর্ম্মচারীরা কিছু করেন না। অমূল্যবাবুকে এ্যাকাউণ্ট্যাণ্ট জেনারেল অফিসের এক বন্ধু বলিয়াছেন, তাঁহারা এ বিষয়টি তুলিবার জন্য দাবী (অথবা প্রস্তাব) করিবেন যে, জেলারের কাছেও কৈফিয়ৎ চাওয়া হউক। আমি খবর পাইয়াছি যে, Inspector General of Prisons-এর Personal Assistant এই জেলারের আত্মীয়; আর সেইজন্যই তাহাকে রেহাই দেওয়া হইয়াছে।
সে যাহাই হউক, অমূল্যবাবু যখন কর্পোরেশনে চাকুরীর জন্য চেষ্টা করিতেছেন তখন এখানকার গভর্ণমেণ্টের নিকট এ ধরনের একটি আবেদন পাঠাইতে দোষ কিছু নাই। তাঁহার বরখাস্তের হুকুম কোনও ক্রমে রদ করাইতে পারিলে তাঁহার নামে যে অপবাদ দেওয়া হইয়াছে উহা অন্ততঃ মুছিয়া যাইবে।
আমি জানি আজকাল কর্পোরেশনে চাকুরী জোগাড় করা কি কঠিন ব্যাপার—তাই ইহার সহিত যদি রাজনৈতিক কারণ জড়িত না থাকিত তাহা হইলে কোনও প্রার্থীর জন্য এরূপ আগ্রহ আমি প্রকাশ করিতাম না। অতএব অমূল্যবাবুর বিষয়টি সম্বন্ধে C. G. O-কে বার বার বলার জন্য আপনাকে অনুরোধ করিতেছি যতদিন না কিছু একটা ব্যবস্থা হয়।
আপনি এ বিষয়ে মেয়র বা সুকুমারবাবু কিংবা কর্পোরেশনে আমাদের ঘনিষ্ঠ মহলের যে কোনও সদস্যের উপর আস্থা রাখিতে পারেন। যদি দরকার মনে করেন মেজদাদাকেও বলিতে পারেন। যদি মনে করেন যে, এ বিষয়ে কাহাকেও পত্র লিখিয়া আমি কিছু করিতে পারি তাহা হইলে অনুগ্রহ করিয়া আমাকে জানাইবেন। অমূল্যবাবু সম্বন্ধে আমাকে কোনও পত্র লিখিতে হইলে উহা সীল করা রেজেস্ট্রিকৃত খামে পাঠানােই শ্রেয়; কারণ এখানে মাঝে মাঝে আমার পত্র খুলিয়া দেখা হইতেছে।
পরিশেষে আমি এই আশা প্রকাশ করিতেছি যে, আপনি এ বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহ লইয়া যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন। ইতিপূর্ব্বে দক্ষিণ কলিকাতা সেবক সমিতির বাবু অনিলচন্দ্র বিশ্বাস সম্বন্ধে আপনাকে লিখিয়াছি।
এখন অপেক্ষাকৃত ভাল আছি এবং শরীর ধীরে ধীরে সারিয়া উঠিতেছে। আপনি মাঝে মাঝে আমাকে পত্র লেখেন না কেন? বর্ত্তমানে কর্পোরেশনের সহিত আমার প্রায় একরূপ কোনও যােগাযােগই রাখা সম্ভব হইতেছে না।
আপনার সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ হইবে তখন অমূল্যবাবু সম্বন্ধে— তিনি কিরূপে আমাদের সাহায্য করিয়াছিলেন—সব কথাই খুলিয়া বলিব। কিন্তু পত্রে ইহার অধিক আর কিছু লেখা সম্ভব নয়। যদি আপনি আমাকে সাধারণ ডাকে পত্র দেন, তাহা হইলে অমূল্যবাবুর বিষয়টি Second Case ও অনিল বিশ্বাস প্রথম—অনুগ্রহ করিয়া এই ভাবে উল্লেখ করিবেন।
অনুগ্রহ করিয়া এই পত্রের বিষয় কিছু প্রকাশ করিবেন না। আশা করি সকলে ভাল আছেন। ব্রজবাবুর সংবাদ কি?
গভীর শ্রদ্ধা জানিবেন। ইতি—
সুভাষচন্দ্র বসু
(ইংরাজী হইতে অনূদিত)