পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১৩১

শ্রীযুক্তা বাসন্তীদেবীকে লিখিত

১৩১
Kelsall Lodge
Shillong
৩০।৭।২৭

পরম পুজনীয়া মা,

 শ্রীচরণেষু—

 পূর্ব্বের পত্রে আমি ধৃষ্টতাবশতঃ আপনার কর্ত্তব্য সম্বন্ধে আপনাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম। আপনি আমার সে চাপল্য স্নেহগুণে ক্ষমা করিয়াছেন। ধৃষ্টতা আমার অনেক আছে—তাহা না হইলে অসাধ্য সাধনের আকাঙ্ক্ষা আমরা কোথা হইতে পাইব? আমরা যে লক্ষ্মীছাড়ার দল।

 আমরা যে মা-র মুখপানে এধনও তাকাইয়া আছি, এটা আমাদের আত্মবিশ্বাসের অভাবের দরুন নয়। আত্মবিশ্বাস আমাদের যথেষ্ট আছে—বোধ হয় একটু বেশীই আছে। তবুও আমরা মা-কে চাই কেন? তার কারণ এই যে মা-কে বাদ দিয়া কোনও পূজাই হয় না। আমাদের সমাজের ইতিহাসে যখনই বিপদ-আপদ জুটিয়াছে তখনই মা-র আবাহন আমরা করিয়াছি। আমাদের অন্তরে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ যাহা কিছু পাইয়াছি তাহা লইয়াই মাতৃমূর্ত্তি রচনা করিয়াছি। ‘বন্দে মাতরম্’ গান লইয়া আমাদের জাতীয় অভিযান শুরু হইয়াছে। তাই আজ এমনভাবে মা-কে ডাকিতেছি—কিন্তু পাষাণীর হৃদয় কি গলিবে না?

 সন্তান বলিয়া যখন নিজের কাছে নিজের পরিচয় দিতেছি তখন যেন আমার দ্বারা মা-র নাম কলঙ্কিত না হয় সেই আশীর্ব্বাদই করুন। মা-র উপযুক্ত সন্তান হইব—এত বড় স্পর্দ্ধা আমার নাই।

 যে কণ্টকময় পথে চলিয়াছি শেষ পর্য্যন্ত যেন এমনই ভাবে চলিয়া যাইতে পারি—সেই আশীর্ব্বাদ করুন। সন্ন্যাসের শূন্যতার মধ্যে যেন জীবন শুকাইয়া না যায়; এই শূন্যতার মধ্যে যে অমৃত লুক্কায়িত আছে তার সংস্পর্শে যেন জীবনটা মঙ্গলের দিকে ফুটিয়া উঠে—সেই আশীর্ব্বাদ চাই। আপনার আশীর্ব্বাদের মূল্য আমার কাছে কত— তাহা কি বলিতে হইবে?

 একদিকে আমার ধৃষ্টতার যেমন অবধি নাই, অপরদিকে নিজের অযোগ্যতার চিন্তা আমাকে নিরন্তর দগ্ধ করে। এই Conflictটা কাল্পনিক নয়—বাস্তব সত্য। ভগবানের নিকট সর্ব্বদা প্রার্থনা করি “তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।” তবুও সময়ে সময়ে আশঙ্কা হয়, ভয় হয়— বুঝি, দেশ যা চায় তাহা দিতে পারিব না। বুঝি, বামন হইয়া চন্দ্রমা স্পর্শের চেষ্টায় মাঝ গঙ্গায় ভরাডুবি হইয়া মরিব। মা, তুমি কি আমায় অভয় বাণী শুনাবে?

 আর একটা কথা বলিব—অনেকদিন বলিব বলিব করিয়া বলিতে পারি নাই। সন্তানের একটা কর্ত্তব্য আছে—একটা অধিকার আছে। সেবা-র অধিকারে কি চিরকাল বঞ্চিত হইব? চিরকাল কি ‘পর’ হইয়া থাকিব? এই অসীম বিশ্বের মধ্যে মানুষের গড়া ক্ষুদ্র সংসারটাই কি সবচেয়ে বড় সত্য?

 আপনার দিবার অনেক কিছু আছে—দেশ এখনও তার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছে। এটা আমার মনগড়া কথা নয়—দেশের প্রাণের কথা। তবে আপনার দেয় আপনি দিবেন কি না—তার মীমাংসা আপনার হাতে। দেশ যাহা আশা করিতেছে তাহা যদি না পায় তবে দেশেরই দুর্ভাগ্য—এ ছাড়া আর কি বলিব।

 আপনি লিখেছেন—“নবীনের প্রবীণের চিন্তাসূত্র—কর্ম্মধারা এক নয়।” এ কথা সত্য কিন্তু তথাকথিত নবীনদের মধ্যে অনেক বৃদ্ধ পাওয়া যায়—এবং তথাকথিত বৃদ্ধদের মধ্যে অনেক তরুণ পাওয়া যায়। তরুণেরা যদি আপনাকে তাদেরই একজন মনে করে—যদি তাদের নেতৃত্বের ভার আপনাকে দেয়, তবে তাতে আপনার আপত্তির কারণ কি আছে?

 আমি কলিকাতায় আপনাকে যে প্রশ্ন করিয়াছিলাম—তার মীমাংসা হইয়া গিয়াছে। তার মীমাংসা এই যে আপনি যদি আমাদের নেতৃত্বের ভার গ্রহণ না করেন তবে বাঙ্গলাদেশে এমন কেহ এখন নাই যাকে আমরা অন্তরের সহিত নেতা বা নেত্রী বলিয়া গ্রহণ করিতে পারি। কোনও সভায় সভাপতির কাজ চালাইবার জন্য কাহাকেও বরণ করিলে তাঁহাকে নেতা বলিয়া স্বীকার করা হয় না। তেমন নেতা বাঙ্গলাদেশে অনেক আছেন কিন্তু প্রকৃত নেতা—যাঁর কাছে হৃদয় সহজেই ভক্তিতে আনত হইয়া পড়ে—আজ বাঙ্গলাদেশে বিরল। যদি আপনাকে আমরা না পাই তবে এই লক্ষ্মীছাড়ার দলকেই আত্মপ্রতিষ্ঠার রাস্তায় চলতে হবে। আপনার আশীর্ব্বাদ আমাদের নিকট অমূল্য সম্পদ সন্দেহ নাই কিন্তু আমরা তদপেক্ষা বেশী কিছু চাই।

 আমরা এখানে একপ্রকার ভাল আছি। আমার বোনের শরীর পূর্ব্বাপেক্ষা ভাল। মা একরকম ভালই আছেন। আমার শরীর ক্রমশঃ সুস্থ হইতেছে—তবে weight তেমন বাড়িতেছে না। অবশ্য আমি ওজন বাড়াটা চাই না— কিন্তু ডাক্তারদের তার উপর খুব ঝোঁক। প্রত্যহ বৈকালের দিকে বেড়াতে যাই—এবং হাঁটাও হয়।

 শ্রীযুক্তা অপর্ণা দেবীর শরীর খুব খারাপ দেখেছিলাম। তিনি এখন কেমন আছেন? মিনু-রা ভাল আছে তো? অন্যান্য সকলের কুশল সংবাদ দিবেন। জষ্টিস্ দাস কেমন আছেন?

 আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানিবেন। ইতি—

আপনাদের সেবক 
সুভাষ 

 পুনঃ—সেদিন মা-র কাছে শুনিলাম আপনি স্বপ্নে একটা ঔষধ পেয়েছিলেন— আমার অসুখের জন্য— অথচ আপনি আমাকে সে ঔষধ দেন নাই বা সে সম্বন্ধে কিছু বলেন নাই। শুনে আমার খুব রাগ হয়েছে। চিরকাল কি পর করে রাখবেন? আপনি জানেন যে, যে কোনও ঔষধ আপনি দিলে আমি সাগ্রহে এবং ভক্তির সহিত তাহা গ্রহণ করিতাম।