পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১৩৬
শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়
* * *
ছেলেরা এখানে থাকলে বোধ হয় শরীরটা আর একটু সারতো। তবে গিয়ে ভালোই হয়েছে—পড়াশুনার ক্ষতি হবে না। আমার শুধু মনে হয় যে এই যে এত টাকা ব্যয় হচ্ছে এখানকার জন্যে এর আরও একটু সদ্ব্যবহার হ’লে ভাল হ’ত—অন্ততঃ তাতে আমি একটু সুখী হতুম। নিজের জন্য এত টাকা ব্যয় হবে এই চিন্তা আমাকে কাঁটার মত বিঁধে—হয় তো এটা আমার দুর্ব্বলতা। কিন্তু স্বভাব তো সহজে বদলান যায় না।
সারাভাইরা (অম্বালাল সারাভাই) ১৭ তারিখে রওনা হয়েছেন ষ্টীমারে। বোধ হয় পঁচিশে নাগাদ পৌঁছাবেন। যদি তাঁদের একবার চা-এ নিমন্ত্রণ করতে পারেন তা’ হলে ভাল হয়। তাঁরা বোধ হয় ২।১ দিনের বেশী থাকবেন না। আমি বিধানবাবুকে বলেছি যেন একবার সেবাসদনটা তাঁদের দেখান।
ছেলেদের সকলকে কাশীরাম দাসের মহাভারত ও কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়তে দিবেন। যোগীনবাবুর সংস্করণগুলি বোধ হয় সবচেয়ে ভাল। তিনি আধুনিক বাঙ্গলা ভাষায় কাশীরাম দাস ও কৃত্তিবাসের প্রাচীন ভাষা তর্জ্জমা করেছেন এবং কবিতার আকারে লিখে গেছেন— সুতরাং ছেলেদের পক্ষে পড়া খুব সহজ। মহাভারত ও রামায়ণ আমাদের সভ্যতার মূলভিত্তি, একথা আমি যত বড় হচ্ছি তত বুঝতে আরম্ভ করেছি। দুঃখের বিষয় যে মহাভারত ও রামায়ণ আগাগোড়া ভাল করে কোনও দিন পড়লাম না।
অশোককে আমি বলেছি যে কতকগুলি বই যাহা আমার দরকার— যেন আলাদা করে রাখে। কোনও লোক মারফৎ পাঠানর যদি সুবিধা কখনও হয় যেন পাঠিয়ে দেয়। সেই বইগুলির মধ্যে বাঙ্গলা অভিধান (যা আমি রেঙ্গুন থেকে এনেছি) ও Shakespeare's Works যেন রেখে দেয়। ছোট Type-এর একটা বইতে Shakespeare-এর Complete Works আছে—আমি সেই বইটা চাই। বোধ হয় বইটা বড় বাড়ীতে আছে।
আপনার “Mother” কি পড়া শেষ হ’ল? কেমন লাগল?
আপনারা সকলে হঠাৎ চলে যাওয়াতে একটু মুস্কিলে পড়েছিলুম। খালি বাড়ীটা খাঁ খাঁ করতে লাগল—মনটা কেমন করে উঠল—দৈনন্দিন জীবনের খেইগুলো যেন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল— একটু কষ্ট হয়েছিল বল্লে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। বহুকাল এরূপ ভাব আমার মনে স্থান পায় নাই। আমি মনে করতুম যে আমি মায়া-মমতার বাহিরে। তাই একটু ঘা দিয়ে প্রকৃতি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে এখনও একেবারে মমতাহীন হতে পারিনি। এটা দুঃখের কথা কি সুখের কথা তার বিচার এখন করব না।
প্রথম আঘাতটার পর আমি চিন্তা করতে লাগলুম কেন আমার এরূপ মনের অবস্থা হ’ল। সে চিন্তা এখনও চলছে। আমার মত অবস্থা যাদের—তারা যদি একেবারে মমতাহীন হতে না পারে তবে তাদের ভাগ্যে কষ্টই বেশী জুটবে। তিন বৎসর পূর্ব্বে কারার আহ্বান যখন আসে এবং আমি শয্যা ত্যাগ করে আলীপুর জেলের দিকে রওনা হই— তখন তো একবারের তরে মন কেমন করেনি—বেশ নির্ব্বিকার ভাবে চলে গেলুম এবং আড়াই বৎসরও বেশ নির্ব্বিকার ভাবে কাটিয়ে দিলুম। এই সময়ে জীবনের প্রতি মমতা একরকম ত্যাগ করেছিলুম। কিন্তু তার জন্যও তো কোন কষ্ট হয়নি। তবে এ অবস্থা আমার কেন হল? এটা কি মনের দুর্ব্বলতা, না বয়সের প্রভাব, না বহুকাল বাড়ী ছাড়া হওয়ার পরিণাম?
এখন আবার মনটা বসতে আরম্ভ করেছে। অবশ্য Company-র অভাব বোধ করি। কিন্তু তাতে আমার বিশেষ অসুবিধা হয় না। নীল আকাশ, সবুজ মাঠ, চারিদিকে পাহাড়ে শ্রেণী, বন-জঙ্গলের মধ্যে আলোছায়ার লুকোচুরি—ঝরনার অবিরাম কলকল নাদ—এ সব নিয়ে বেশ আছি। তাতে শরীর ও মন বেশ স্নিগ্ধ হয়। আকাশ যখন একটু পরিষ্কার হয় তখন বাহিরে বেরিয়ে পড়ি এবং প্রকৃতির নীরব ভাষা আমার অন্তরে প্রবেশ করে—আর মনে পড়ে সেই কবির কথা—
And this our life, exempt from public haunt,
Finds tongues in trees, books in the running brook,
Sermons in stones, and good in every thing.
বহুলোকের মাঝে থাকলে এ অনুভূতিটা হয়তো পেতুম না। প্রকৃতির সৌন্দর্য্যের মধ্যে নিজের প্রাণকে মিশিয়ে দেওয়া, মনটাকে সংযত করে প্রকৃতির ভাষা বুঝবার চেষ্টা করা—এটা অবশ্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তথাপি সামান্য ভাবেও তাহা করতে পারলে প্রাণটা আনন্দে ভরে যায়।
যাক্ অনেক বাজে কথা বক্লুম—কিছু মনে করবেন না। ইংরেজের সঙ্গে ঝগড়া-ঝাঁটি ও একত্র ঘর করে আমার মত মুখচোরা লোকও বাধ্য হয়ে বাচাল হয়েছে।
কাউন্সিলের সময়ে কি করব এখনও স্থির করি নাই। আপনাদের পূজার ছুটির Programme যখন স্থির হবে তখন আমাকে জানাবেন।
আপনার শরীর এখন কেমন আছে? রাত্রে ঘুম ভাল হয়—না আগেকার মতই অনিদ্রা? যন্ত্রণা গেছে তো?
আর অধিক কি লিখব। আপনারা আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানবেন। ছেলেদের ভালবাসা দিবেন। ইতি—
সুভাষ
চিঠিটা (খামটা নয়) সূতায় বেঁধে Seal করে দিচ্ছি। Seal কি অবস্থায় পান জানাবেন।