পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৫৯

◄  ৫৮
৬০  ►
৫৯

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে লিখিত

The Union Society
Cambridge
১৬ই ফেব্রুয়ারী। (১৯২১)

প্রণাম পুরঃসর নিবেদন,

 আপনি আমাকে বোধ হয় চিনেন না—কিন্তু আমার পরিচয় দিলে বোধ হয় চিনিতে পারিবেন। আপনাকে আমি খুব প্রয়োজনীয় কোন বিষয়ে এই পত্র লিখিতেছি—কিন্তু কাজের কথা আরম্ভ করিবার পূর্ব্বে আমাকে নিজের sincerity আগে প্রমাণ করিতে হইবে। সেই জন্য প্রথমে নিজের পরিচয় দিতেছি।

 আমার পিতা শ্রীজানকীনাথ বসু কটকে ওকালতি করেন এবং কয়েক বৎসর পূর্ব্বে সেখানকার গভর্ণমেণ্ট প্লিডার ছিলেন। আমার একজন দাদা শ্রীশরৎচন্দ্র বসু কলিকাতা হাইকোর্টের barrister। আপনি আমার পিতাকে চিনিলেও চিনিতে পারেন এবং আমার দাদাকে নিশ্চয়ই চেনেন।

 পাঁচ বৎসর পূর্ব্বে আমি কলিকাতায় প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়িতাম। ১৯১৬ সালের গোলমালের সময়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে expelled হই। দুই বৎসর নষ্ট হইবার পর আমি কলেজে পড়িবার অনুমতি পাই। তারপর ১৯১৯ সালে আমি বি-এ পাশ করি এবং Honours-এর প্রথম শ্রেণীতে স্থান পাই।

 ১৯১৯ সালের অক্‌টোবর মাসে এখানে আসিয়াছি। ১৯২০ সালের আগষ্ট মাসে আমি Civil Service পরীক্ষা পাশ করি এবং চতুর্থ স্থান অধিকার করি। এই বৎসর জুন মাসে আমি Moral Science Tripos পরীক্ষা দিব। সেই মাসে আমি এখানকার B. A. Degree পাইব।

 এখন কাজের কথা বলি। সরকারী চাকুরী করিবার আমার মোটেই ইচ্ছা নাই। আমি বাড়ীতে লিখিয়াছি বাবাকে এবং দাদাকে যে, আমি চাকুরী ছাড়িয়া দিতে চাই। আমি এখনও উত্তর পাই নাই। তাঁদের অনুমতি পাইতে হইলে, আমাকে দেখাইতে হইবে আমি চাকুরী ছাড়িবার পর কি tangible কাজ করিতে চাই। আমি অবশ্য জানি যে, চাকুরী ছাড়িয়া আমি যদি কোমর বাঁধিয়া দেশের কাজে অবতীর্ণ হই তাহা হইলে করিবার আমার অনেক আছে—যথা, জাতীয় কলেজে শিক্ষকতা, পুস্তক ও খবর কাগজ প্রণয়ন ও প্রকাশ, গ্রাম্য সমিতি স্থাপন, জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ইত্যাদি। কিন্তু আমি যদি এখন বাড়ীতে দেখাইতে পারি আমি কি tangible কাজ করিতে ইচ্ছা করি—তাহা হইলে বোধ হয় চাকুরী ছাড়া সম্বন্ধে অনুমতি সহজে পাইব। আমি যদি তাঁহাদের অনুমতি লইয়া চাকুরী ছাড়িতে পারি তাহা হইলে বিনা অনুমতিতে কোন কাজ করিবার আবশ্যকতা নাই।

 দেশের অবস্থা সম্বন্ধে আপনি সব চেয়ে ভাল জানেন। শুনিলাম আপনারা কলিকাতায় এবং ঢাকায় জাতীয় কলেজ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন এবং ইংরাজী ও বাংলায় “স্বরাজ” পত্রিকা বাহির করিতে চান। আমি আরও শুনিলাম বাঙ্গলা দেশের নানা স্থানে গ্রাম্য সমিতি প্রভৃতি স্থাপন করা হইয়াছে।

 আমি জানিতে ইচ্ছা করি আপনারা আমাকে এই স্বদেশ সেবার যজ্ঞে কি কাজ দিতে পারেন। আমার বিদ্যাবুদ্ধি কিছুই নাই—কিন্তু আমার বিশ্বাস যে, যৌবনোচিত উৎসাহ আমার আছে। আমি অবিবাহিত। লেখাপড়ার মধ্যে আমি Philosophyটা একটু পড়েছি কারণ কলিকাতায় আমার ঐ বিষয়ে Honours ছিল এবং এখানেও আমি ঐ বিষয়ে Tripos পড়িতেছি। Civil Service পরীক্ষার কৃপায় সর্ব্বাঙ্গীণ শিক্ষা খানিকটা হইয়াছে—যেমন Economics, Political Science, English and European History, English Law, Sanskrit, Geography ইত্যাদি।

 আমি বিশ্বাস করি যে, আমি যদি নিজে এই কাজে নামিতে পারি তাহা হইলে আমি এখানকার ২।১ জন বাঙ্গালী বন্ধুকে এই কাজে টানিতে পারিব। কিন্তু আমি নিজে যতক্ষণ এই কাজে না নামিতেছি, ততক্ষণ কাহাকেও টানিতে পারিতেছি না।

 এখন আমাদের দেশে কোন্ কোন্ বিষয়ে কাজ আরম্ভ করিবার সুবিধা আছে তাহা এখান থেকে বুঝিতে পারিতেছি না। আমার মনে হইতেছে যে, দেশে ফিরিলে আমি কলেজে অধ্যাপনা এবং পত্রিকায় লেখা—এই দুই কাজে হাত দিতে পাবিব। আমার ইচ্ছা—Clear-Cut Plans লইয়া চাকুরী ছাড়িতে। তাহা করিতে পারিলে চাকরী ছাড়ার পর আমাকে চিন্তায় সময় ব্যয় করিতে হইবে না এবং আমি চাকুরী ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্ম্মক্ষেত্রে নামিতে পারিব।

 আপনি আজ বাঙ্গলা দেশে স্বদেশ সেবা যজ্ঞে প্রধান ঋত্বিক—তাই আপনার নিকট এই পত্র লিখিতেছি। আপনারা ভারতবর্ষে যে আন্দোলনের বন্যা তুলিয়াছেন তার তরঙ্গ চিঠি ও খবরকাগজের ভিতর দিয়া এখানে আসিয়া পঁহুছিয়াছে। এখানেও তাই মাতৃভূমির আহ্বান শুনা গিয়াছে। Oxford থেকে একজন মাদ্রাজী ছাত্র তাঁর লেখাপড়া আপাতত স্থগিত রাখিয়া দেশে ফিরিয়া যাইতেছে— সেখানে গিয়া কাজ আরম্ভ করিবার জন্য। Cambridge-এ এ-পর্য্যন্ত কাজ কিছু হয় নাই যদিও “অসহযোগিতা” সম্বন্ধে আলোচনা খুব বেশী রকম চলিতেছে। আমার বিশ্বাস, যদি কেহ পথ দেখাইতে পারে তাহা হইলে সেই পথ অনুসরণ করিবার লোক এখানে আছে।

 আপনি বাঙ্গলাদেশে আমাদের সেবা যজ্ঞের প্রধান ঋত্বিক্—তাই আপনার নিকট আমি আজ উপস্থিত হইয়াছি—আমার যৎসামান্য বিদ্যা, বুদ্ধি, শক্তি ও উৎসাহ লইয়া। মাতৃভূমির চরণে উৎসর্গ করিবার আমার বিশেষ কিছুই নাই—আছে শুধু নিজের মন এবং নিজের এই তুচ্ছ শরীর।

 আপনাকে এই পত্র লেখার উদ্দেশ্য— শুধু আপনাকে জিজ্ঞাসা করা আপনি আমাকে এই বিপুল সেবা যজ্ঞে কি কাজ দিতে পারেন। আমি তাহা জানিতে পারিলে বাড়ীতে—বাবাকে এই দাদাকে সেইরূপ লিখিতে পারিব এবং নিরে মনকেও সেইভাবে প্রস্তুত করিতে পারিব।

 আমি এখন একরকম সরকারী চাকর। কারণ আমি এখন I. C. S. Probationer। আপনাকে চিঠি লিখিতে সাহস করিলাম না পাছে চিঠি Censored হয়। আমার জনৈক বিশ্বাসী বন্ধু শ্রীপ্রমথনাথ সরকারকে আমি এই চিঠি পাঠাইতেছি—তিনি আপনার হাতে এই চিঠি দিয়া আসিবেন। আমি যখনই আপনাকে পত্র দিব—তখন এই ভাবেই দিব। আপনি অবশ্য আমাকে চিঠি লিখিতে পারেন কারণ এখানে চিঠি Censored হইবার ভয় নাই।

 আমার এখানকার মতলব সম্বন্ধে আমি কাহাকেও জানাই নাই—শুধু, বাড়ীতে বাবাকে এবং দাদাকে লিখিয়াছি। আমি এখন সরকারী চাকর—সুতরাং আশা করি যে আমি যে পর্য্যন্ত চাকুরী না ছাড়িতেছি সে-পর্য্যন্ত আপনি কাহাকেও এ বিষয়ে কিছু বলিবেন না। আমার আর কিছু বলিবার নাই। আমি আজ প্রস্তুত— আপনি শুধু কর্ম্মের আদেশ দিন।

 আমার নিজের মনে হয় যে, আপনি যদি “স্বরাজ” পত্রিকা ইংরাজীতে আরম্ভ করেন তাহা হইলে আমি সেই পত্রিকার Subeditorial Staff-এ কাজ করিতে পারি। তা ছাড়া “জাতীয় কলেজের” নিম্ন শ্রেণীতে অধ্যাপনা করিতে পারি।

 কংগ্রেসের বিষয়ে আমার মনে অনেক প্রস্তাব আছে। আমার মনে হয় যে, কংগ্রেসের একটা স্থায়ী আড্ডা চাই। তার জন্য একটা বাড়ী করা চাই। সেখানে একদল research Student থাকিবেন—যাঁহারা আমাদের দেশের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা লইয়া গবেষণা করিবেন। আমি যতদূর জানি Indian Currency and Exchange সম্বন্ধে আমাদের কংগ্রেসের কোনও definite Policy নাই। তারপর Native Statesদের প্রতি কংগ্রেসের কিরূপ attitude হওয়া উচিত তাহা বোধ হয় স্থির করা হয় নাই। Franchise (for men and women) সম্বন্ধে কংগ্রেসের কি রকম মত তাহাও বোধ হয় জানা নাই। তারপর Dpressed Classesদের লইয়া আমাদের কি করা উচিত তাহাও বোধ হয় কংগ্রেস ঠিক করে নাই। এই বিষয়ে (অর্থাৎ Depressed Classes সম্বন্ধে) কোন কাজ না করার দরুন মাদ্রাজে আজ সব Non-Brahmin-এরা Pro-Government এবং anti-nationalist হইয়াছে।

 আমার নিজের মনে হয় যে Congress-এর একটা Permanent Staff রাখা দরকার। ইহারা কে একটা সমস্যা (Problem) লইয়া গবেষণা করিবে। প্রত্যেকে নিজ নিজ বিষয়ে up-to-date facts and figures সংগ্রহ করিবে। এই সব facts and figures সংগৃহীত হইলে Congress Committee প্রত্যেক বিষয়ে (Problem এ) একটা Policy formulate করিবে। আজ অনেক জাতীয় Problem সম্বন্ধে কংগ্রেসের কোন definite Policy নাই। আমার সেই জন্য মনে হয় যে, কংগ্রেসের একটা স্থায়ী বাড়ী চাই এবং স্থায়ী Staff of research Students চাই।

 তা ছাড়া Congress এর একটা Intelligence Department খোলা দরকার। Intelligence Department-এ দেশের সম্বন্ধে up-to-date সব খবর facts and fgures যাহাতে পাওয়া যায়, সেইরূপ ব্যবস্থা করিতে হইবে। Propaganda Department থেকে প্রত্যেক প্রাদেশিক ভাষায় ছোট ছোট পুস্তক প্রকাশিত হইবে এবং জনসাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হইবে। এতদ্ব্যতীত জাতীয় জীবনের এক একটা সমস্যা লইয়া Propaganda Department থেকে এক একটি বই প্রকাশিত হইবে। সেই পুস্তকে কংগ্রেসের Policy বুঝান হইবে এবং কি কি কারণের নিমিত্ত কংগ্রেসের এইরূপ Policy হইয়াছে তাহাও লেখা থাকিবে। আমি অনেক লিখিয়া ফেলিলাম। আপনার কাছে এই সব কথা পুরাতন! আমার কাছে খুব নূতন বলিয়া মনেহইতেছে বলিয়া আমিনা লিখিয়া থাকিতে পারিলাম না। আমার মনে হইতেছে যে কংগ্রেস সংক্রান্ত বিপুল কাজ আমাদের সম্মুখে পড়িয়া আছে। আপনার ইচ্ছা করিলে আমি এ বিষয়েও বোধ হয় কিছু করিতে পারি।

 আপনার মতের জন্য আমি অপেক্ষা করিতেছি। আপনি কি কি কাজে আমাকে নিযুক্ত করিতে পারিবেন, তাহা জানিবার জন্য আমি ব্যগ্র আছি। যদি আপনাদের অভিপ্রায় থাকে কাহাকেও বিলাতে পাঠাইতে Journalism শিখিতে তাহা হইলে আমি সে কাজের ভার লইতে পারি। আমাকে যদি সে ভার দেন তাহা হইলে passage এবং outfit-এর খরচ বাঁচিয়া যাইবে। অবশ্য এ কাজের ভার লইবার পূর্বে আমি চাকুরী ত্যাগ করিব, অবশ্য আমার থাকা ও খাওয়ার খরচ দিবেন—কারণ চাকুরী ছাড়ার পর বাড়ী থেকে টাকা লওয়া বোধ হয় যুক্তিসঙ্গত হইবে না।

 আমার নিজের ইচ্ছা যে যদি চাকুরী ছাড়ি তাহা হইলে জুন মাসেই রওনা হইব। তবে প্রয়োজন হইলে আমি নিজের ইচ্ছা পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত আছি।

 আমার বহুভাষিতা ক্ষমা করিবেন। আশা করি যথাশীঘ্র উত্তর দিবেন। আমার প্রণাম জানিবেন।

ইতি— 
 আমার ঠিকানা—
প্রণত 
Fitz William Hall
শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু 
Cambridge.