পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৭
পরম পূজনীয়া
শ্রীমতী মাতাঠাকুরাণী
শ্রীচরণেষু—
মা,
অনেকদিন হইল কলিকাতার কোন সংবাদ পাই নাই—আশা করি আপনারা সকলে ভাল আছেন—বােধ হয় সময়াভাবে পত্র দিতে পারেন নাই।
মেজদাদা কি রকম পরীক্ষা দিলেন। আপনি কি আমার চিঠির সমস্তটা পড়িয়াছেন? যদি না পড়িয়া থাকেন, তবে আমি বড় দুঃখিত হইব।
মা, আমার মনে হয় এ যুগে দুঃখিনী ভারত মাতার কি একজন স্বার্থত্যাগী সন্তান নাই—মা কি প্রকৃতই এত হতভাগ্যা! হায়! কোথায় সেই প্রাচীন যুগ! কোথায় সেই আর্য্যবীরকুল যাঁহারা ভারতমাতার সেবার জন্য হেলায় এই অমূল্য মানব জীবনটা উৎসর্গ করিতেন।
মা, আপনি ত মা, আপনি কি শুধু আমাদের মা? না মা আপনি ভারতবাসী মাত্রেরই মা—ভারতবাসী যদি আপনার সন্তান হয় তবে সন্তানদের কষ্ট দেখিলে মা’র প্রাণ কি কাঁদিয়া উঠে না? মা’র প্রাণ কি এতটা নিষ্ঠুর? না, কখনই হইতে পারে না—মা ত কখনও নিষ্ঠুর হইতে পারেন না। তবে সন্তানদের এই শােচনীয় দুরবস্থার সময়ে মা কি করিয়া স্থির হইয়া বসিয়া আছেন! মা, আপনি ত ভারতের সর্ব্বত্র ভ্রমণ করিয়াছেন—ভারতবাসীর অবস্থা দেখিলে এবং তাহাদের দুরবস্থার কথা ভাবিলে আপনার প্রাণ কি কাঁদে না? আমরা মূর্খ—আমরা স্বার্থপর হইতে পারি কিন্তু মা ত কখনও স্বার্থপর হতে পারেন না—মা’র জীবন যে সন্তানের জন্য! যদি তাহাই হয় তবে সন্তানের কষ্টের সময়ে মা কি করিয়া স্থির হইয়া বসিয়া আছেন! তবে কি মা স্বার্থপর! না, না, কখনই হতে পারে না—মা কখনও স্বার্থপর হতে পারে না।
মা, শুধু দেশের কি এরূপ শোচনীয় অবস্থা! দেখুন ভারতের ধর্ম্মের কি অবস্থা! কোথায় সেই পবিত্র সনাতন হিন্দুধর্ম্ম, আর কোথায় আমাদের অধঃপতিত ধর্ম্ম! কোথায় সেই পবিত্র আর্য্যকুল—যাঁহাদের পদধূলি লইয়া পৃথিবী পবিত্র হইয়াছে—আর কোথায় আমরা তাঁহাদেরই অধঃপতিত বংশধর! সে পবিত্র সনাতন ধর্ম্ম কি লোপ হইতে চলিল! দেখুন না চারিদিকে নাস্তিকতা অবিশ্বাস এবং ভণ্ডামী—তাই ত লোকেদের এত পাপ, এত কষ্ট, দেখুন না সেই ধর্ম্ম প্রাণ আর্য্যজাতির বংশধর এখন কিরূপ বিধর্ম্মী ও নাস্তিক হইয়া পড়িয়াছে! যাঁহার নাম, গুণগান ও ধ্যানই জীবনের একমাত্র কর্ত্তব্য ছিল তাঁহার নাম সমস্ত জীবনে ভক্তির সহিত একবার কয়জন লোক আজকাল ডাকে। মা, এসব দেখিলে এবং ভাবিলে, আপনার প্রাণ কি কাঁদে না, আপনার চক্ষে কি জল আসে না? সত্য সত্যই কি আপনার প্রাণ কাঁদে না—কখনই হইতে পারে না। মা’র প্রাণ ত কখনও নিষ্ঠুর হয় না।
মা, একবার চক্ষু খুলিয়া দেখুন, আপনার সন্তানদের কি দুরবস্থা! পাপে, তাপে, সর্ব্বপ্রকার কষ্টে, অন্নাভাবে, ভালবাসার অভাবে—এবং হিংসা ও স্বার্থপরতার জন্য এবং সর্ব্বোপরি ধর্ম্মের অভাবের জন্য তাহারা যেন নরকের অগ্নিকুণ্ডে অহোরাত্র জ্বলিতেছে। আর দেখুন, সেই পবিত্র সনাতন ধর্ম্মের কি অবস্থা! দেখুন, সেই পবিত্র ধর্ম্ম এখন লোপ পাইতে চলিল। অবিশ্বাস, নাস্তিকতা, এবং কুসংস্কারে আমাদের সেই পবিত্র ধর্ম্ম এখন কতদূর অধঃপতিত ও অপভ্রষ্ট হইয়াছে। তার উপর, আজকাল ধর্ম্মের নামেই যত অধর্ম্ম হইতেছে —তীর্থস্থানেই যত পাপ! দেখুন না পুরীর পাণ্ডাদের কি ভীষণ অবস্থা! ছি! ছি!! ছি!!! প্রাচীন কালের সেই পবিত্র ব্রাহ্মণকে দেখুন, আর আধুনিক কালের পাপী ব্রাহ্মণকে দেখুন। আজকাল যেখানে ধর্ম্মের নাম সেইখানেই যত ভণ্ডামী এবং যত অধর্ম্ম।
হায়! হায়!! আমাদের কি অবস্থা! আমাদের ধর্ম্মের কি অবস্থা!
মা, এ সব কথা যখন আপনার হৃদয়ে প্রবেশ করে তখন কি আপনার প্রাণকে আকুল করিয়া ফেলে না? আপনার প্রাণ কি কাঁদে না?
আমাদের দেশের অবস্থা কি দিন দিন এইরূপ অধঃপতিত হইতে থাকিবে—দুঃখিনী ভারতমাতার কোন সন্তান কি নিজের স্বার্থে জলাঞ্জলি দিয়া মা-এর জন্য নিজের জীবনটা উৎসর্গ করিবে না?
মা, আমরা আর কয়দিন ঘুমাইয়া থাকিব? আর কয়দিন আমরা পুতুল লইয়া খেলিতে থাকিব? দেশের ক্রন্দন কি আমাদের কর্ণে আস্ছে না? আমাদের লুপ্তপ্রায় সনাতন ধর্ম্ম কাঁদিতেছে— তাহার ক্রন্দন কি প্রাণকে অস্থির করিতেছে না?
বসিয়া ২ আর কয়দিন দেশের এবং ধর্ম্মের এই অবস্থা দেখিব? আর বসা চলে না—আর ঘুমান চলে না—এখন নিদ্রা ত্যাগ করিয়া আলস্য ত্যাগ করিয়া কর্ম্মসাগরে ঝাঁপ দিতে হইবে, কিন্তু হায়! এ স্বার্থপর যুগে নিজের স্বার্থে জলাঞ্জলি দিয়া কয়জন স্বার্থত্যাগী সন্তান মা-এর জন্য কর্ম্মসাগরে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত? মা, আপনার এ সন্তান কি প্রস্তুত নহে?
৮৪ জনমের পর আমরা এই দুর্ল্লভ মনুষ্যজন্ম পাইয়াছি—বুদ্ধি, বিবেক, আত্মা প্রভৃতি পাইয়াছি কিন্তু এ সমস্ত পাইয়াও যদি পশুর ন্যায় আহার নিদ্রায় পরিতুষ্ট থাকি—পশুর ন্যায় ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব স্বীকার করি—পশুর ন্যায় স্বার্থ লইয়া ব্যস্ত থাকি—পশুর ন্যায় যদি ধর্ম্মহীন জীবন অতিবাহিত করি তবে কেন এই মনুষ্য জঠরে আমাদের জন্ম? পরের জন্য জীবনই প্রকৃত জীবন!
মা, এসব আপনাকে কেন লিখিতেছি—জানেন? আর কাহাকেই বা বলিব? কে বা শুনিবে? কে বা এ সমস্ত হৃদয়ে পোষণ করিবে? যাহাদের জীবন স্বার্থময়—তাহার ত এ সমস্ত কথা ভাবিতে পারে না—বা ভাবিবে না—কারণ তাহাতে তাহাদের স্বার্থের হানি হইবে কিন্তু মার জীবন ত স্বার্থময় নহে! মার জীবন ত সন্তানদের জন্য—দেশের জন্য! যদি ভারতের ইতিহাস পড়েন ত দেখিবেন কত ২ মা, ভারত মাতার সেবার জন্য জীবন যাপন করিয়াছেন এবং উপযুক্ত সময়ে প্রাণও দিয়াছেন। দেখুন অহল্যাবাঈ, মীরাবাঈ, দুর্গাবতী, —আর কত আছেন—আমার নাম মনে নাই। আমরা মাতৃস্তন্যে পুষ্ট—সুতরাং মাতৃউপদেশ এবং মাতৃশিক্ষা আমাদের যত উপকার ও উন্নতি করিতে পারে—আর কিছুতেই তত হয় না।
মা যদি সন্তানকে বলেন—“তুই স্বার্থ লইয়া বসিয়া থাক”—তবে আর কি! বুঝিব সন্তানই হতভাগ্য! তাহা হইলে বুঝিতে হইবে এ কলিযুগে ভাল লোকের আর আবির্ভাব নাই। বুঝিতে হইবে ভারতের যাহা কিছু ছিল সবই নষ্ট হইয়াছে—আর কিছুই নাই! আর কিছু হবে না। চারিদিকে নৈরাশ্য! যদি তাহাই হয়—যদি প্রকৃতই আর কোন উন্নতির আশা নাই—যদি বসিয়া কেবল অধঃপতন ও অবনতি দেখিতে হইবে—তবে এত কষ্ট কেন? তবে যদি এ জীবনে আর কিছু করিতে পারিব না—তবে এ জীবনে আর কাজ কি?
আমি যেন চিরকালই সকলের সেবক হয়ে থাকিতে পারি। আশা করি ওখানকার কুশল। এখানে সব মঙ্গল। আপনি আমাদের প্রণাম জানিবেন। পত্রের উত্তর দিবেন। এ পত্রের উত্তর দিবেন। ইতি—
চিরস্নেহাধীন
সেবক