পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৭৫
শ্রীহরিচরণ বাগচীকে লিখিত পত্রাংশ
তোমার তিনখানা পত্র আমি যথা সময়ে পাইয়াছি। উত্তর দিবার সুযোগ পাই নাই; তা ছাড়া শরীর ভাল নাই। কোনও প্রকার কাজ করিতে (এমন কি লেখাপড়া করিতে) মন লাগে না। পূর্ব্বে মাত্র দুইখানি পত্র সপ্তাহে লিখিতে পারিতাম—এখন একখানা লিখিতে পারি। ফলে দু’তিন মাসের চিঠি জমা হইয়া থাকে—উত্তর দিবার সুযোগ পাই না বলিয়া।
Social Service বিভাগের প্রধান উদ্দেশ্য—গরীবকে সাহায্য করিয়া তাহার দ্বারা কাজ করানো, শুধু দান করা Organised Charity-র উদ্দেশ্য হইতে পারে না। প্রতিদান না দিলে দান গ্রহণ করা আত্মসম্মানের পক্ষে হানিকর—এই ভাবটা গরীব সাহায্যপ্রার্থীদের মনে জাগান উচিত। সুতরাং যদি কেহ সাহায্য গ্রহণ করিয়া কাজ করিতে প্রস্তুত না হয়—তবে তাহার সাহায্য বন্ধ করা ভাল। তবে এক্ষেত্রে দু একটি কথা বিবেচনা করা উচিত—
(১) যে সাহায্য গ্রহণ করে তার কাজ করিবার অবসর থাকা উচিত। অর্থাৎ যদি কোনও বিধবা সাহায্য গ্রহণ করে এবং গৃহস্থালী কাজ করিয়া তাহার যদি অন্য কাজ করিবার অবসর না থাকে তাহা হইলে সে ক্ষেত্রে কাজ করাইবার জন্য জিদ করা উচিত নয়। আমাদের শুধু দেখা চাই যে, সাহায্য গ্রহণ করিয়া কেহ আলস্যে সময় কাটাইতেছে কি না। এই জন্য inspection বা স্থানীয় তদন্ত করিয়া সংবাদ লওয়া উচিত। সময় বা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যাহারা কাজ করে না তাহাদের সাহায্য করিয়া আলস্যের প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।
(১) যাহাদের শারীরিক সামর্থ্য নাই ও যাহাদের সংসারে অন্য কোন কার্য্যক্ষম লোক নাই তাহাদের কাজ করাইবার জন্য জিদ করা উচিত নয়।
(৩) কাজকরাইতে হইলে Variety of Choice থাকা চাই; কারণ সব লোকের দ্বারা সব রকম কাজ হয় না। আগে সহজ কাজ লইয়া আরম্ভ করিবে, যেমন পুরাতন খবরের কাগজ দিয়া ঠোঙা প্রস্তুত করান—তারপর কঠিন কাজ শিখাইবে।
(৪) যাহাদের কাজ করাইতে চাও তাহাদের কাজ শিখাইবার ব্যবস্থা করা চাই। অনেক কাজ আছে যাহা মানুষে ভয় করে— না শেখা পর্য্যন্ত সে ক্ষেত্রে প্রথমে জিজ্ঞাসা করিলে তাহারা কাজ করিতে রাজী হইবে না, কিন্তু একবার কাজ শিখিলে তাহারা ক্রমশঃ কাজে মন দিবে।
আমরা ভিক্ষুকের জাতে পরিণত হইয়াছি, সুতরাং ভিক্ষুকের মনোভাব একদিনে পরিবর্ত্তিত হইবে না। যদি তোমরা আশা কর যে, একদিনে ভিক্ষুকের প্রবৃত্তি বদলাইবে তাহা হইলে তোমরা হতাশ হইবে। Social Service-এ অসীম ধৈর্য্য দরকার।
মোটর উপর তোমাদের কাজের প্রোগ্রাম এই —raw materials (যেমন খবরের কাগজ, তুলা অথবা ঝিনুক) তোমরা যোগাইবে, যাহারা সাহায্য গ্রহণ করে তাহারা সাহায্যের বিনিময়ে raw materials হইতে জিনিষ প্রস্তুত করিয়া দিবে। সে জিনিষগুলি বিক্রয় করিবার ভার তোমাদের এবং সেই উদ্দেশ্যে ভিন্ন ভিন্ন দোকানের সঙ্গে তোমাদের বন্দোবস্ত করা উচিত যাহাতে তোমাদের জিনিষ তাহারা ক্রয় করিয়া লয়। এই সব জিনিষ তাহারা বিক্রয় করিয়া খরচ খরচা বাদে যে লাভ থাকিবে তাহা হইতে সাহায্য দানে (অন্ততঃ আংশিক ভাবে) খরচ উঠিয়া যাইবে। Public charity-র উপর চিরকাল নির্ভর না করিয়া সমিতির একটা স্বতন্ত্র আয়ের ব্যবস্থা তোমাদের করা উচিত। অবশ্য সমস্ত ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ ও আয়াস-সাধ্য।
লাইব্রেরীর জন্য টাকা খরচ করিয়া বই না কিনিয়া author এবং অন্যান্য ভদ্রলোকেদের নিকট হইতে বই সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিও।
অনিলবাবুকে বলিও যে, লাইব্রেরীর জন্য haphazardly কতকগুলো বই সংগ্রহ না করিয়া একটা method অনুসারে বই সংগ্রহ যেন করেন। অবশ্য বিনা খরচে যে সব বই পাইবে— সেগুলিও গ্রহণ করিবে। কিন্তু তথাপি একটা প্রণালী থাকা উচিত। সর্ব্বাগ্রে বাঙ্গলা ইংরাজী এবং ইউরোপীয় (Continental) সাহিত্যের নামকরা বই সংগ্রহ করিবে। তারপর ভারতের ইতিহাস, ইংলণ্ডের ইতিহাস এবং পৃথিবীর সকল দেশের ইতিহাসের বই সংগ্রহ করিবে। তারপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় পুস্তক এবং মহাপুরুষদের জীবনী সংগ্রহ করিও। সঙ্গে সঙ্গে অর্থ ও রাজনীতি, কৃষি ও বাণিজ্য সম্বন্ধীয় বই সংগ্রহের চেষ্টা করিও। যদি একসঙ্গে সব রকম বই সংগ্রহ করিতে পার তাহা হইলে ভাল হয়। মোট কথা, প্রত্যেক বিষয়ের অন্ততঃ কতকগুলি বই রাখা চাই—যাহাতে যে কোনও রুচির লোক আসুক না কেন সে পড়িবার বই পাইবে। বাজে উপন্যাস রাখার প্রয়োজন নাই—তবে ভাল ভাল উপন্যাস রাখা উচিত। অল্পের মধ্যে একটা আদর্শ লাইব্রেরী করা চাই।
* * *
দূরদেশে যদি সূতা কিনিতে হয় তাহা হইলে তোমরা weaving depot বেশীদিন রাখিতে পারিবে না। যাহাদের সাহায্য করিবে তাহাদের ঘরে এবং সমিতির সভ্যদের ঘরে সূতা উৎপাদনের চেষ্টা করা চাই, যদি অন্ততঃ খানিকটা সূতা ভবানীপুরে কিংবা তার আশে পাশে তৈয়ারী না হয় তবে তোমাদের পরিশ্রম ব্যর্থ। আর একটি কথা তোমাদের মনে রাখা উচিত। যদি স্থানীয় লোকেদের মধ্যে সূতা প্রস্তুত হয়— তবে জানিবে যে, প্রতিষ্ঠানের প্রতি স্থানীয় লোকদের প্রকৃত সহানুভূতি আছে। স্থানীয় সহানুভূতির অভাবে কোনও প্রতিষ্ঠান বেশী দিন চলিতে পারে না।
স্থানীয় লোকদের মধ্যে এমন লোক পাইবে যাহারা সূতা কাটিবে অথচ সূতা বিক্রয় করিবে না। তাহাদের সূতায় যদি ধূতি বা শাড়ী প্রস্তুত করিয়া দিতে পার—তবে তাহারা সূতা কাটিতে পারে। পূর্ব্বে অনেক লোক এইভাবে সমিতিতে ধুতি ও শাড়ী প্রস্তুত করাইত। এখানকার অবস্থা আমি জানি না, তবে আমার মনে হয় যে, সমিতিতে সূতা লইয়া ধূতি শাড়ী প্রস্তুত করিবার একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত। সভ্যদের বাড়ীতে বাড়ীতে যাহাতে সূতা প্রস্তুত হয় সেদিকে একটু দৃষ্টি রাখিবে। ইতি—