পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৭৭

◄  ৭৬
৭৮  ►
৭৭
Mandalay Central Jail
10.7.25

মা,

 এত দিন পত্র দিবার চেষ্টা করি নাই, কলমে ভাষা আসছিল না— হাত অবশ হয়ে যাচ্ছিল। প্রথমে যখন খবর কাগজে দেখি—তখন বিশ্বাস করিতে পারি নাই। তারপর যখন সমস্ত কাগজে একই কথা দেখলাম—তখন বাস্তবের কাছে মাথা নোয়াতে হ’ল। তিনি নিজে আমাকে লিখেছিলেন যে ২।৩ মাসের মধ্যে আরোগ্য লাভ করে আবার কর্ম্মের মধ্যে ঝাঁপ দিবেন। সকলেই আশা করেছিল যে তাঁর অসমাপ্ত কাজ তিনি সমাপ্ত করবেনই। কিন্তু এর মধ্যেই বজ্রপাত! বজ্রপাতে লোকের শরীর-মন অল্পক্ষণের জন্য অবসন্ন থাকে—কিন্তু এ হেন অশনিপাতে অবসন্নতা সহজে দূর হয় না।

 প্রথম কথা মনে হ’ল—আজ আমি যে সুদূর ব্রহ্মদেশে! হৃদয়ের প্রেরণা অনুযায়ী কাজ করবার সুযোগ হইতে বঞ্চিত। এ দুঃখ আমার পক্ষে ভোলবার নয়। কারাগৃহ—কারার লৌহকপাট—কারার অসংখ্য গারদগুলি ইহার পূর্ব্বে কখনও এত বিষময় বলিয়া বোধ হয় নাই। ইচ্ছা হ’ল টেলিগ্রাম করে প্রাণের একটা কথা অন্ততঃ বলে পাঠাই—কিন্তু Conventional হয়ে যাবে—এই আশঙ্কায় তাহা করলাম না।

 তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয় আলিপুর জেলে। তখন আমি সংবাদ পেয়েছি যে বহরমপুরে বদলি হ’ব। বিদায়ের সময়ে আমি তাঁর পায়ের ধূলা নিয়ে বললাম, “আপনার সঙ্গে বোধ হয় অনেকদিন দেখা হবে না।” তিনি উত্তরে হেসে বললেন, “না আমি তোমাদের বেশীদিন জেলে থাক্‌তে দিচ্ছি না।” হায়! তখন কি আমি জানি যে আমার কথা এত বেশী সত্য হয়ে দাঁড়াবে—অদৃষ্টের কি পরিহাস!

 আমি ৬ই জুনে তাঁর নিকট একখানি পত্র দিই—সে পত্র কি তিনি পেয়েছিলেন? তাঁর শেষ পত্র আমি এইখানেই পাই। সেই চিঠি এবং সেই চিঠির ভাষা তাঁহার ভালবাসার শেষ নিদর্শন। আমি সেই চিঠির উত্তরে ৬ই জুনে দার্জ্জিলিং-এর ঠিকানায় পত্র দিই।

 কয়েকদিন হ’ল আপনার নিকট ১৪৮নং ঠিকানায় আমরা সকলে মিলে একটা Joint চিঠি দিয়েছি। সে চিঠি পেলেন কিনা তা জানবার জন্য আমরা একটু উদ্বিগ্ন আছি। আপনার মনের অবস্থা যদি সে রকম না হয়—তা’ হলে লৌকিকতার দরুন কোনও উত্তর দেবার প্রয়োজন নাই। প্রাপ্তি সংবাদ পেলেই আমাদের যথেষ্ট হবে।

 তাঁর বন্ধুবান্ধব ও followerদের মধ্যে কেহ কেহ তাঁহার appreciation লিখেছেন বা লিখিতেছেন। কিন্তু appreciation লিখবার ক্ষমতা আমাদের নাই। আমরা তাঁর এত নিকটে বাস করেছি এবং তাঁহার প্রাণের গভীরতা ও বিস্তৃতি এতটা অনুভব করেছি যে সেই অনুভূতি-জনিত বিহ্বলতার মধ্যে কিছু লেখা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়।

 সান্তনা দিবার ভার যাঁদের উপর—আশা করি তাঁহারা সে কর্ত্তব্য পালন করেছেন। আমার কি সান্ত্বনা দিবার শক্তি আছে? আমারই যে সান্ত্বনার প্রয়োজন। তাই বলি আপনাকে ভগবানই শক্তি ও সান্ত্বনা প্রেরণ করুন।

 ভোম্বলকে পত্র দিয়েছিলাম—তার উত্তর পেয়েছি। প্রত্যুত্তর আগামী সপ্তাহে দিব।

 আমি বাহিরে থাকিলে আমার সেবার কোনও ফল হত কিনা জানি না। আমার সেবার প্রয়োজন হ’ত কিনা—তা’ও জানি না। কিন্তু সেবার সুযোগ যে থাকত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। আজ যে সেবার সুযোেগ আমার নাই—এই কথা যেন ঘুরে ফিরে মনের মধ্যে উদয় হচ্ছে। এবং ব্যর্থ বাসনা ও ততােধিক ব্যর্থ প্রয়াস যেন বারে বারে বদ্ধ দুয়ারের গায়ে আঘাত খেয়ে ফিরে আসছে। যেখানে মানুষ সামর্থ্যহীন—সেখানে ইচ্ছায় হউক অনিচ্ছায় হউক ভগবানের শরণাপন্ন হয়। তাই আমি আবার প্রার্থনা করি তিনিই আপনাকে সান্ত্বনা ও শক্তি দিন। আমার ক্ষুদ্র হৃদয়ের ভক্তির অর্ঘ্য গ্রহণ করিয়া আমায় ধন্য করুন।

ইতি 

আপনার সেবক 
শ্রীসুভাষ 
(C/o D.I.G., IB, C.I.D. 
13, Elysium Row 

Calcutta) 
Mrs. C. R.Das

2, Beltala Road

Calcutta.