পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৮০

◄  ৭৯
৮১  ►
৮০

বিভাবতী বসুকে লিখিত

শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়

মান্দালয় জেল
৭।৮।২৫

পূজনীয়া মেজবৌদিদি,

 আমি অনেকদিন হ’ল আপনাকে কোন পত্র দিই নাই। এ সপ্তাহে মেজদাদাকে লেখবার মত কিছু নাই, তাই আপনাকে লিখতে বসেছি। আপনাকে কাজের সম্বন্ধে লেখবার প্রয়ােজন নাই, তাই ঘরকন্না সম্বন্ধে লিখিব।

 আমাদের শাস্ত্রে একটা কথা আছে—মধ্বভাবে গুড়ং দদ্যাৎ। অর্থাৎ যেখানে মধুর অভাব, সেখানে গুড় দিয়ে মধুর কাজ সারা উচিত, তাই ছােট ছেলেপুলের অভাব এখানে বেরালছানা দিয়ে মেটান হয়। আমি ছােট ছেলেমেয়ে খুব পছন্দ করি কিন্তু বেরালছানা আমার ভাল লাগে না—বিশেষত যেখানে সব কয়টা বেরালই বদরঙের। তা’ আমার কথা কেহ শুনতে চায় না। আমাদের মধ্যে কেহ কেহ বেরাল ভালবাসে—আর যে সব গরীব কয়েদীরা আমাদের গৃহস্থালীর কাজ করে তারাও বেরাল ও বেরালছানাকে আদর করে। এইসব লােকের বেরাল প্রীতির ফলে এখানে বেরালের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখানে বেরাল সবচেয়ে ভালবাসে যে লােকটি মেথরের কাজ করে—তাকে সবাই “ময়লা-লু” বলে, তার আসল নাম “লবানা”। আর ময়লা সাফা করে বলে তার নাম সবাই রেখেছে “ময়লালু”—বর্ম্মা ভাষায় “লু” মানে “লােক” বা “মানুষ”। সে ময়লা সাফা করে অতএব তার নাম “ময়লালু”। “ময়লালু” কথাটা ভাল লাগে না বলে “মলয়ালু”—তার থেকে ভাল নাম দাঁড়িয়ে গেছে “মলয়”। আমাদের “মলয়” যখন শােয়—তখন তার মাথার কাছে বেরাল, বুকের উপর বেরাল, পায়ের কাছে বেরাল। চতুর্দ্দিকে বেরালের পরিবারের দ্বারা পরিবৃত হয়ে সে ঘুমোয়। নিজের খাবারের অংশ থেকে সে খাবার বাঁচিয়ে বেরালকে খাওয়ায় আর আমাদের কাছ থেকে দুধ চেয়ে নিয়ে বেরালছানাকে দুধ খাওয়ায়। আর সে যখন একবার তু বলে ডাক দেয় রাজ্যের বেরাল তার কাছে ছুটে আসে। ইতি বেরাল কাহিনী সমাপ্ত।

 আমাদের গৃহস্থালী নেহাৎ ছোট নয়। পরিবারের সংখ্যা ৯ জন। তবে বলা বাহুল্য যে সকলেই পুরুষ। চাকরটাকর নিয়ে মোট ২০ জনের বেশী বই কম নয়। জেলের মধ্যে আর একটি ক্ষুদ্র জেলে আমরা বাস করি। এখানকার লোকেরা কি বাবু কি চাকর—জেলের অন্যান্য কয়েদীদের সঙ্গে মিশতে পায় না। আমাদের সংসারের মধ্যে বাবুর্চী, মশালচী, মেথর, ঝাড়ুদার ইত্যাদি সবরকম লোক আছে। বসতবাটী ছাড়া এই ক্ষুদ্র জেলের মধ্যে রান্নাঘর,পুখুর, খেলবার জন্য টেনিস কোর্ট প্রভৃতি আছে। স্নানের ঘর গত ৬ মাস ধরে তৈয়ারী হচ্ছে। কবে তৈয়ারী শেষ হবে তা শ্রীভগবান ভিন্ন আর কেউ বোধ হয় বলতে পারে না।

 বুঝতেই পারছেন যে এই বৃহৎ সংসারে সকলেই কয়েদী—কেহ দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদী আর কেহ আমার মত বিনাবিচারে সরকারের হুকুমে কয়েদী। আপনারা চোর-ডাকাতের নাম শুনে বোধ হয় নাক সিঁটকোবেন, কিন্তু এখন জেলের কয়েদীদের উপর আমার আর ঘৃণার ভাব নাই। এদের মধ্যে অনেকেই বিপদে পড়ে অথবা বাধ্য হয়ে অন্যায় করে এবং অনেকেই বিনা অপরাধে দণ্ডিত হয়। তাদের মধ্যে অনেকেরই হৃদয় আছে এবং ভাল অবস্থায় পড়লে তারা যে ভাল হতে পারে এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নাই।

 শাস্ত্রে বলে —“গৃহিণী গৃহং উচ্যতে” অর্থাৎ গৃহিণী না থাকলে গৃহ নাকি গৃহই নয়। আমাদের এখানে গৃহ আছে কিন্তু গৃহিণী নাই। গৃহিণীর অভাবে আমাদের একজন ম্যানেজার বাবু নিযুক্ত করা হয়েছে—বলা বাহুল্য যে ম্যানেজার বাবু আমাদের মত একজন বিনা বিচারে কয়েদী। তিনি হিসাবপত্র রাখেন; দৈনিক বাজারের ফর্দ্দ তৈয়ারী করে দেন এবং গৃহস্থালীর কাজ সম্বন্ধে তিনি সর্ব্বেসর্ব্বা, আমাদের এই বিশাল সংসার তাঁর অঙ্গুলি চালনায় চলে। খাওয়াপরার জন্য তাঁকে আমরা দায়ী করি এবং খাওয়া খারাপ হলে তাঁকে গালাগালি দিতে ছাড়ি না। আমাদের এই সংসারের নাম রাখা হয়েছে—অমুক বাবুর হোটেল।

 এখানকার খাওয়াদাওয়া সাধারণতঃ মন্দ নয়—তবে অঙ্গ কয়েকদিন হ’ল খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার নিয়ে কর্ত্তৃপক্ষের সঙ্গে গোল বেঁধেছে। ব্যাপারটা কতদূর গড়াবে তা এখন বুঝতে পারছি না। বাঙ্গালীর মিষ্টান্ন বাদে এখানে জিনিষপত্র মন্দ পাওয়া যায় না—তবে জিনিষপত্রের দাম বড় বেশী। ম্যানেজার বাবুর কৃপায় এখানে আমাদের উঠানের এককোণে মুরগীশালা খোলা হয়েছে—সেই ঘরের মধ্যে কতকগুলি মোরগ ও মুরগী স্থান পেয়েছে। সকাল সন্ধ্যা এই সব পক্ষবিশিষ্ট জীবের “কক্কর কোঁ” শব্দে আমি অস্থির হয়ে উঠি——কিন্তু এই মধুর রব না শুনলে ম্যানেজার বাবুর নাকি ঘুম হয় না।

 উঠানের মধ্যে একটা ছোট পুখুর আছে। তাতে আমাদের নাক পর্য্যন্ত জল ধরে। সেই পুকুরের জল পরিষ্কার থাকলে আমরা লম্ফঝম্ফ করে, একটু সাঁতার কাটবার চেষ্টা করি। অবশ্য যেখানে ডোববার ভয় নাই—সেখানে সাঁতার ভাল হয় না। কিন্তু আমি গোড়ায় বলেছি মধুর অভাবে লোকে গুড় খায়—আমরাও নদীর অভাবে বড় চৌবাচ্চায় সাঁতার দিয়ে মনকে প্রবোধ দিই।

 ম্যানেজার বাবুর চেষ্টায় এই উঠানের মধ্যে কতকগুলি ফুলের গাছ লাগান হয়েছে। তবে তার মধ্যে গন্ধহীন সূর্য্যমুখী ফুলই বেশী, এ রাজ্যে সুগন্ধি ফুল পাওয়া সহজ নয়। জানি না এটা দেশের গুণ কি জেলের গুণ। জেলের মধ্যে যে সব রজনীগন্ধা ফুল ফোটে সেগুলোর সুগন্ধি নাই বলে মনে হয়।

 আমার কাহিনী আজ এখানেই অসমাপ্ত রাখতে হবে—তা না হলে এ সপ্তাহের ডাক যাবে না। কাহিনী সকলকে পড়ে শোনাবেন, মেজদাদাকেও। আমি প্রত্যেক সপ্তাহে বাড়ীতে পত্র দিই। যদি কোনও সপ্তাহে আমার পত্র না পান তবে এখানকার সুপারিণ্টেণ্টেকে পত্র বা টেলিগ্রাম দিয়ে আমার খবর নেবেন।

 আপনারা সকলে কেমন আছেন—এবং আমার কাহিনী ভাল লাগল কিনা জানাবেন। যদি ভাল লাগে তা হলে আমি আরও লিখতে পারি। আমার প্রণাম জানবেন।

ইতি— 
সুভাষ