পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৮২
শ্রীযুক্ত এন সি কেলকারকে লিখিত এই পত্রখানা সেন্সর কর্ত্তৃক আটক করা হইয়াছিল এই যুক্তিতে যে, ইহাতে “গভর্ণমেণ্টের সমালোচনা করা হইয়াছে”।
প্রিয় মিঃ কেলকার,
গত কয়েক মাস যাবৎই আপনাকে পত্র লিখিয়া কয়েকটি খবর জানাইব বলিয়া ভাবিতেছিলাম যাহা আপনার কৌতূহল উদ্রেক করিতে পারে। জানি না আপনি অবগত আছেন কিনা যে গত জানুয়ারী মাস হইতে আমাকে এখানে আটক করিয়া রাখা হইয়াছে। বহরমপুর জেলে (বাঙ্গলা) থাকা কালে যখন জানুয়ারীর শেষাশেষি মান্দালয়ে বদলির হুকুম আসিল তখন আমার মনে হয় নাই, যে এই মান্দালয়ে জেলেই স্বর্গতঃ লোকমান্য তিলক তাঁহার দীর্ঘকালব্যাপী কারাবাসের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করিয়াছিলেন। এখানে আসিবার পূর্ব্ব মুহূর্ত্ত পর্য্যন্তও আমি ভাবিতে পারি নাই যে, এই জেলের চার দেওয়ালের মধ্যেই নানা প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও স্বর্গতঃ লোকমান্য তাঁহার বিখ্যাত গীতা-ভাষ্য লিখিয়াছিলেন যাহা, আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় তাঁহাকে শঙ্কর ও রামানুজের মত প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের সহিত একাসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে।
লোকমান্য যে ওয়ার্ডে বাস করিতেন উহা এখনও আছে; তবে উহাকে নব পরিকল্পনায় আরও বড় করা হইয়াছে। আমাদের ওয়ার্ডের মতই কাঠের বেড়া দ্বারা ইহা এমনভাবে তৈরী যে, গ্রীষ্মকালে তাপ ও রৌদ্র, বর্ষাকালে বৃষ্টি, শীতকালে শীত—এমন কি সারা বৎসর ধরিয়া যে ধূলার ঝড় বহে উহা হইতে আত্মরক্ষার কোনও উপায়ই নাই। এখানে আসিবার পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই ওয়ার্ডটি আমাকে দেখানো হইয়াছিল। ভারতবর্ষ হইতে আমার এই নির্ব্বাসনকে খুশী মনে গ্রহণ করিতে পারি নাই; তবু আমি ঈশ্বরকে এজন্য ধন্যবাদ জানাইয়াছিলাম যে, স্বদেশ ও স্বগৃহ হইতে মান্দালয়ে এই বাধ্যতামূলক নির্ব্বাসনের ফলে স্মৃতির ভাণ্ডার পরিপূর্ণ হইয়া উঠিবে যাহা আমার পক্ষে সান্ত্বনা ও প্রেরণাস্বরূপ হইবে। অন্যান্য জেলের মত এই জেলও নোংরা, একঘেয়ে ও বৈচিত্রহীন; তবু ইহা আমার কাছে এক পবিত্র তীর্থভূমি। কারণ এখানে ভারতবর্ষের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান একাদিক্রমে ছয় বৎসর কারাবাস করিয়া গিয়াছেন।
লোকমান্যের এই ছয় বৎসরব্যাপী কারাবাসের কথা আমরা সকলেই জানি কিন্তু যে দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়া তাঁহার দিনগুলি অতিবাহিত হইয়াছিল সে খবর আমরা খুব কমসংখ্যক লোকই রাখি একথা আমি জোর করিয়া বলিতে পারি। ভাবের আদানপ্রদান চলিতে পারে এমন কোন সঙ্গী তাঁহার ছিল না—ফলে তাঁহাকে একেবারে নিঃসঙ্গ অবস্থায় দিন কাটাইতে হইত। এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ যে, তাঁহাকে আর কোনও বন্দীর সঙ্গে মেলামেশা পর্য্যন্ত করিতে দেওয়া হইত না। বই-ই ছিল তাঁহার একমাত্র সঙ্গী এবং একাকী একটি ঘরে তাঁহাকে বাস করিতে হইত। এখানে অবস্থানকালে তাঁহাকে দুই তিনবারের বেশী কাহারও সহিত সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়া হয় নাই। এমন কি যে কয়বার তাঁহাকে অনুমতি দেওয়া হইয়াছিল তাহাতেও পুলিস ও জেল কর্ত্তৃপক্ষ সম্মুখে উপস্থিত ছিলেন যাহার ফলে সহজ ও খোলাখুলিভাবে তিনি কোনও আলাপ আলোচনা চালাইতে পারেন নাই।
তাঁহাকে পত্রিকা পড়িতে দেওয়া হইত না। তাঁহার মত একজন বিশিষ্ট ও মর্য্যাদাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতাকে বহির্জ্জগৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ রাখার চেষ্টা নির্য্যাতন ছাড়া আর কিছু নয় এবং এ যন্ত্রণা যে ভোগ করিয়াছে সে-ই শুধু আমার কথার সত্যতা অনুধাবন করিতে পারিবে। উপরন্তু তাঁহার কারাবাসের অধিকাংশ সময় ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল এবং যে উদ্দেশ্যে তিনি লড়িয়াছিলেন তাঁহার অবর্ত্তমানে উহা সাফল্যের পথে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে—এমন কোনও সান্ত্বনাও তিনি খুঁজিয়া পান নাই।
তাঁহার দৈহিক যন্ত্রণার বিষয়ে যত কম বলা যায় ততই ভাল। তিনি পেনাল কোডের ধারানুযায়ী অভিযুক্ত হইয়াছিলেন এবং এখনকার রাজনৈতিক বন্দীদের অপেক্ষা অনেক বেশী কঠোর বিধিনিষেধ তাঁহাকে মানিয়া চলিতে হইত। ঐ সময়ে তিনি বহুমূত্র রোগে ভুগিতেছিলেন। এখন মান্দালয়ের জলবায়ু যেরূপ, লোকমান্য যখন এখানে ছিলেন তখনও উহা অবশ্যই সেরূপ ছিল। তার যদি এখনকার যুবকেরাও স্বীকার করেন যে, উহা লোককে দুর্ব্বল করিয়া ফেলে, অজীর্ণতা ও বাতরোগ ডাকিয়া আনে এবং প্রাণশক্তি ধীরে ধীরে নিশ্চিতরূপে ধ্বংস করিয়া দেয় তাহা হইলে লোকমান্যের মত একজন পরিণতবয়স্ক ব্যক্তিকে কি যন্ত্রণাই না ভোগ করিতে হইয়াছে!
জেলের মধ্যে লোকমান্য নীরবে যে কষ্ট সহ্য করিয়াছেন তাহার কতটুকুই বা আমরা জানি! যে সকল যন্ত্রণা একজন বন্দীর জীবনকে মাঝে মাঝে দুঃসহ করিয়া তোলে সে সম্বন্ধে কয়জনই বা খবর রাখে! গীতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন বলিয়াই তিনি হয়তো এ সকল যন্ত্রণার উর্দ্ধে উঠিতে পারিয়াছিলেন এবং এ সম্বন্ধে কখনও তিনি কাহাকেও কিছু বলেন নাই।
বার বার আমি গভীরভাবে চিন্তা করিয়াছি যে, কি অবস্থার মধ্যে লোকমান্য তাঁহার মূল্যবান জীবনের দীর্ঘ ছয় বৎসর কাল অতিবাহিত করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। এবং বার বার নিজেকে প্রশ্ন করিয়াছি,—“যদি যুবক বন্দীদেরই এরূপ কষ্ট ভোগ করিতে হয় তাহা হইলে লোকমান্যের মত একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে তাঁহার সময়ে কত বেশী কষ্টই না সহ্য করিতে হইয়াছে যাহা তাঁহার দেশবাসীর নিকট অজ্ঞাত ছিল।” ঈশ্বর এই পৃথিবীর স্রষ্টা কিন্তু জেলগুলি মানুষ তৈরী করিয়াছে। ইহা এক পৃথক জগৎ এবং সভ্য সমাজের ধ্যান-ধারণার দ্বারা ইহা চালিত হয় না। আত্মার মৃত্যু ঘটাইয়া এই বন্দীজীবনের সহিত মানাইয়া চলা সহজ ব্যাপার নয়। পুরনো অভ্যাস সমস্তই ত্যাগ করিতে হইবে—অথচ স্বাস্থ্য ও শক্তিও নষ্ট করা চলিবে না; জেলের আইন-কানুন মানিয়া চলিতে হইবে আবার হার স্বীকার না করিয়া মনের প্রফুল্লতা ও শান্তিটুকুও বজায় রাখিতে হইবে। এই যন্ত্রণা ও পরাধীনতার মধ্যেও কারাবাসের অমানুষিক প্রতিক্রিয়া তুচ্ছ করা এবং মানসিক স্থৈর্যয় বজায় রাখিয়া গীতা-ভাষ্যের মত একটি বিরাট যুগসৃষ্টিকারী পুস্তক রচনা করা—এ শুধু লোকমান্যের মত অসাধারণ ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন একজন দার্শনিকের পক্ষেই সম্ভব।
যদি কেহ জানিতে ইচ্ছুক হন যে, এরূপ প্রতিকূল, ক্লান্তিকর ও নিরুৎসাহব্যঞ্জক পরিস্থিতির মধ্যেও লোকমান্যের গীতা-ভাষ্যের মত একটি বিরাট ও মহৎ গ্রন্থ রচনা করিতে হইলে পাণ্ডিত্য ছাড়াও কি পরিমাণ ইচ্ছাশক্তি, গভীর সাধনা ও সহনশীলতার প্রয়োজন তাহা হইলে তাহার কিছুদিন জেলে বাস করা উচিত। আমি আমার নিজের কথা বলিতে পারি, এ বিষয়ে যতই আমি চিন্তা করি ততই শ্রদ্ধায় ও ভক্তিতে অভিভূত হইয়া যাই। আশা করি দেশবাসী লোকমান্যের মহত্ত্বের পরিমাপ করিবার কালে এ সকল বিষয় মনে রাখিবেন। তিনি বহুমূত্রের রোগী হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘকালব্যাপী কারাবাসের সেই দুঃসহ মুহূর্ত্তগুলিতে নিজ প্রতিভা ও অবিচল সংগ্রামের আদর্শের দ্বারা মাতৃভূমিকে এরূপ একখানি অমূল্য গ্রন্থ উপহার দিয়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের সম্মুখের সারিতে স্থান পাইবার যোগ্যতা অর্জ্জন করিয়াছেন।
কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম অলঙ্ঘ্য; লোকমান্য তাঁহার কারাবাসকালে উহা অস্বীকার করিয়াছিলেন বলিয়াই প্রকৃতি তাঁহার উপর প্রতিশোধ লইয়াছিল। এবং আমার মনে হয়, সত্য কথা বলিতে গেলে আলিপুর সেণ্ট্রাল জেলেই যেরূপ দেশবন্ধুর মৃত্যুর সূচনা হইয়াছিল সেরূপ মান্দালয় জেল হইতে মুক্তি পাইবার কালেই লোকমান্যের মৃত্যু আসন্ন হইয়া উঠিয়াছিল। ইহা নিঃসন্দেহে খুবই পরিতাপের বিষয় যে, এভাবেই আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদিগকে হারাইব; অথচ আশ্চর্য্য হইয়া ভাবি যে, এই শোকাবহ ঘটনার পুনরাবৃত্তি যদি কোনও প্রকারে রোধ করা যাইত।
গভীর শ্রদ্ধা জানিবেন। ইতি—
(ইংরাজী হইতে অনূদিত)