পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৮৭
শ্রীসন্তোষকুমার বসুকে লিখিত
প্রিয়বরেষু—
সন্তোষবাবু,
আপনার পত্র না পাওয়ায় আমিও আপনাকে আর কোনও পত্র দিই নাই। বিশেষ গুরুতর একটা কারণ না ঘটিলে এ পত্রও হয়তো লিখিতাম না; এবং লিখিবার পূর্ব্বে আমাকে বেশ কিছুটা ইতস্ততঃ করিতে হইয়াছে।
আপনি নিশ্চয়ই আয়ুর্বেদ্দ সমন্বয় কমিটির ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে অবগত আছেন। যখন শ্যামাদাস বাচস্পতির বৈদ্যশাস্ত্রপীঠকে সাহায্য দানের প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তখন জনৈক সদস্য (বাবু নৃপেন্দ্র নাথ বসু বোধহয়) কলেজগুলিকে একত্র করিবার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি নিয়োগ করার জন্য পাল্টা প্রস্তাব আনিয়াছিলেন। আসলে কবিরাজ যামিনীভূষণ রায়ই এ প্রস্তাবের পশ্চাতে ছিলেন এবং নৃপেনবার, রমাপ্রসাদ ও অন্যান্য সকলে তাঁহার নির্দ্দেশেই চালিত হইতেছিলেন। যামিনী কবিরাজ আশা করিয়াছিলেন যে, যদি তিনটি কলেজ মিলিয়া এক হইয়া যায় তাহা হইলে তিনি স্বভাবতঃই উহার সর্ব্বোচ্চ পদ অধিকার করিতে পারিবেন। তাঁহার প্রশংসা করিতে হয় যে, তিনি নিজে এ বিষয়ে কর্পোরেশনের প্রায় প্রত্যেক সদস্যের নিকট প্রচারকার্য্য চালাইয়াছেন এবং কাউন্সিলরদিগকে প্রভাবিত করার জন্য এমন কোনও কৌশল নাই যাহা তিনি গ্রহণ করেন নাই। বাবার সহিত তাঁহার পূর্ব্বেই পরিচয় ছিল; এবং তাঁহার মারফৎ আমাকেও বলিয়াছিলেন। আপনি জানেন আমি সোজা কথার লোক এবং প্রচার করিয়া বেড়ানোটা অপছন্দ করি, বিশেষতঃ উহা যদি আবার ঘুরাইয়া করা হয়।
যদি কলেজ তিনটির একত্রীকরণ সম্ভব হয় তাহা হইলে কেহ না কেহ উহার সর্ব্বোচ্চ পদ পাইবেনই। এক্ষেত্রে প্রশ্ন এই যে, এই গুরুত্বপূর্ণ পদটি কাহাকে দেওয়া হইবে? যামিনী কবিরাজ সম্বন্ধে তিনটি কারণে আমার আপত্তি আছে। প্রথমতঃ, আয়ুর্ব্বেদশাস্ত্র সম্বন্ধে তাঁহার জ্ঞান খুব বেশী নয়। এরূপ অগভীর জ্ঞান লইয়া কাহারও পক্ষে প্রাচীন আয়ুর্ব্বেদ-চিকিৎসার পুনরুন্নতি ঘটানো সম্ভব হইতে পারে না। এমন কি আয়ুর্ব্বেদে সত্যই তাঁহার আন্তরিক কোনও বিশ্বাস আছে কিনা সে সম্বন্ধেও আমার সন্দেহ আছে। দ্বিতীয়তঃ, একজন চিকিৎসক হিসাবে তিনি স্পষ্টবাদী নন এবং ইহা হইতেই তাঁহার চরিত্র স্পষ্ট বুঝা যায়। তাঁহার মত একজন প্রধান চিকিৎসককে এখনও যখন পসারের জন্য ভাড়াটিয়া লোকদের উপর অধিকাংশ সময় নির্ভর করিতে হয় তখন তাঁহার উপর আস্থা স্থাপন করা যায় না। চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি আয়ুর্ব্বেদ ও এলোপ্যাথির এক “অদ্ভুত সংমিশ্রণ” ঘটাইয়াছেন। তৃতীয়তঃ, তিনি ভণ্ড—যে কৌশল তিনি গ্রহণ করিয়াছেন তাহাতে একেবারে ভণ্ড ছাড়া তাঁহাকে আর কিছু বলা যায় না। তিনি নিজেই একটি চক্রান্তের নায়ক—অষ্টাঙ্গ-আয়ুর্ব্বেদ গোষ্ঠী একটি নূতন কলেজ প্রতিষ্ঠা করিয়া উহার কর্ত্তৃত্ব দখল করিতে চাহিতেছেন। উহার দ্বারা তাঁহাদের তিন প্রকারে লাভ হইতে পারে। (১) তাঁহারা সহজেই একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবেন, যাহার ব্যয়ভার বেশীর ভাগ কর্পোরেশনকেই বহন করিতে হইবে। (২) তাঁহারা ঐ কলেজটির কর্ত্তৃত্ব দখল করিয়া নিজেদের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি বিস্তার করিতে পারিবেন এবং চিকিৎসক হিসাবে তাঁহাদের আয়ও বৃদ্ধি পাইবে। (৩) কর্পোরেশনের উৎসাহ ও সর্ব্ববিধ আনুকূল্য লাভ করিয়া তাঁহারা যে সকল প্রতিষ্ঠান তাঁহাদের কলেজের সহিত মিশিয়া গিয়া যামিনী এণ্ড কোম্পানীর কর্ত্তৃত্ব স্বীকার করিয়া না লইবে ঐগুলিকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করিয়া দিবে। ইহা হইতেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, যদি কর্পোরেশন নূতন কোনও প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিতে চায় তাহা হইলে ঐ জাতীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে প্রদত্ত সাহায্য বন্ধ করিয়া দিতে হইবে; তাহার ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে।
প্রকৃতপক্ষে যামিনী এণ্ড কোম্পানীর দ্বারাই এই একত্রীকরণের প্রস্তাব আনীত হইয়াছে; যাহার উদ্দেশ্য অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানকে নিশ্চিহ্ন করা ও একটি নূতন কলেজ প্রতিষ্ঠা করিয়া ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার করা। এবং এই লোকগুলিই অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে দেশবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানাইয়াছিলেন।
বৈদ্যশাস্ত্রপীঠ দেশবন্ধুর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আমার মনে হয়, সংগঠনমূলক কাজের নিদর্শন হিসাবে ইহার মূল্য ও কার্য্যকারিতা অনেকখানি। এই কলেজের অধ্যক্ষ কবিরাজদিগের মধ্যে একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। নোংরা ব্যবসাবুদ্ধি তাঁহার নাই এবং পসারের জন্য ভাড়াটিয়া লোকদের মুখাপেক্ষী হইয়াও তাঁহাকে থাকিতে হয় না। তিনি একজন ‘খাঁটি’ কবিরাজ এবং প্রাচীন রীতির চিকিৎসায় পারদর্শী; তবে আধুনিক চিন্তাধারা সম্বন্ধেও তিনি কম সচেতন নন। ভবিষ্যতের কবিরাজদিগের জন্য তাঁহার মত একজন সরল, ধার্ম্মিক ও নির্ম্মল চরিত্রের শিক্ষক অপেক্ষা আর কোনও ভাল শিক্ষকের কথা আমি চিন্তাও করিতে পারি না। তবে আত্মপ্রচার ও খোসামোদের ধার ধারেন না বলিয়াই যামিনী এণ্ড কোম্পানীর বেশ কিছুটা সুবিধা হইয়া গিয়াছে।
শ্যামাদাস কবিরাজ এখনও পর্য্যন্ত নিজে অর্থসাহায্য করিয়া কলেজটিকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন। কিন্তু জনসাধারণ অথবা কর্পোরেশন যদি সাহায্যের জন্য না আগাইয়া আসেন তাহা হইলে কলেজটিকে চালানো তাঁহার পক্ষে কষ্টকর হইবে। স্বভাবতঃই তিনি এই একত্রীকরণের প্রস্তাবে রাজী হইতে পারেন না, কারণ তাহা হইলে যামিনী এণ্ড কোম্পানীর ক্ষমতা ও আধিপত্য বৃদ্ধি পাইবে। এই নূতন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালন ব্যবস্থায় যদি তাঁহাদের কোনও ক্ষমতাই না থাকে, তবে তিনি উহাতে কিছুতেই রাজী হইবেন না।
আমাদের মধ্যে যাঁহারা দেশবন্ধুর অনুগত ছিলেন তাঁহাদের উপরই তাঁহার কাজ এবং তিনি যে কলেজ প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছেন উহার দায়িত্বভার ন্যস্ত হইয়াছে। কাউন্সিলরগণ তাঁহাদের এই দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন আছেন কি?
যদি সম্মানজনক সর্ত্তে একত্রীকরণ সম্ভব না হয় তাহা হইলে যতদিন না যুক্তি ও ন্যায়াদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয় ততদিন তিনটি কলেজকে আলাদাভাবে অর্থসাহায্য দেওয়াই বরং সঙ্গত হইবে।
যামিনী কবিরাজ বলিয়া বেড়াইতেছেন যে, তিনি নূতন কলেজের জন্য ৫০০০০ টাকা চাঁদা দিয়াছেন। বৈদ্যশাস্ত্রপীঠ চালাইবার জন্য ইতিমধ্যে শ্যামাদাস কবিরাজকেও তাঁহার নিজের বহু অর্থ ব্যয় করিতে হইয়াছে—অবশ্য যদি অর্থের প্রশ্নটাই এক্ষেত্রে মুখ্য বিবেচ্য হয়। আমার মনে হয় না যে, অর্থসাহায্যের ব্যাপারে তাঁহার দানও খুব সামান্য।
যদি আমার কথায় আপনার কোনও সন্দেহ থাকে, তবে যে কোন দিন বৈদ্যশাস্ত্রপীঠে গিয়া আপনি দেখিয়া আসিতে পারেন। শ্যামাদাস কবিরাজকে টেলিফোনে খবর দিয়া গেলে তিনি খুশী হইয়া সব কিছু আপনাকে ঘুরাইয়া দেখাইবেন। শ্যামাদাস নিজে যদিও একজন প্রাচীনপন্থী কবিরাজ তবু বৈদ্যশাস্ত্রপীঠের পাঠ্যসূচীতে তিনি পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শারীর-বৃত্ত ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করিয়াছেন। আমি জানি, আপনি কোনও ব্যাপারে দায়িত্ব লইলে সে সম্বন্ধে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করিয়া থাকেন এবং উহার একটা ফয়সালা না হওয়া পর্য্যন্ত নিশ্চিন্ত হইতে পারেন না। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে শ্যামাদাসের পত্রগুলি পড়িয়া আমি খুব বেদনা বোধ করিয়াছি এবং আমার ধারণা যে, আপনি যদি এ বিষয়ে দৃষ্টি দিতেন তাহা হইলে কিছু সুফল হয়তো ফলিত।
আশা করি আপনারা সকলে ভাল আছেন। আমার খবরও মোটামুটি একপ্রকার। বিজয়ার আলিঙ্গন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করিবেন।
আপনার স্নেহবদ্ধ
পুনঃ—এ বিষয়ে আপনি ব্রজবাবুকে বলিতে পারেন—public health com-র তিনি চেয়ারম্যান।
আমার লেখায় যদি তীব্র সমালোচনা প্রকাশ পাইয়া থাকে, উহার জন্য অনুগ্রহ করিয়া ক্ষমা করিবেন।
(ইংরাজী হইতে অনূদিত)