পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৮৬
দিলীপকুমার রায়কে লিখিত
একথা কিছুতেই মনে কোরো না যে, আমার দৃষ্টি নিতান্তই সঙ্কীর্ণ। “Greatest good of the greatest number” এতে আমি যথার্থ-ই বিশ্বাস করি, কিন্তু সে “good” আমার কাছে সম্পূর্ণ বস্তুগত নয়। অর্থনীতি বলে, মানুষের সকল কাজ হয় “productive” নয় “unproductive”; তবে কোন্ কাজ যে “productive,” তা নিয়ে অনেক বাক্বিতণ্ডা হ’য়ে থাকে। আমি কিন্তু কারুকলা বা সে সংক্রান্ত কোন প্রচেষ্টাকে “unproductive” মনে করিনে, আর দার্শনিক চিন্তা বা তত্ত্ব-জিজ্ঞাসাকে নিষ্ফল বা নিরর্থক ব’লে অবজ্ঞা করিনে। আমি নিজে একজন আর্টিষ্ট না হতে পারি—আর সত্যি বলতে কি আমি জানি যে তা নই—কিন্তু সে জন্যে দোষী প্রকৃতি বা ভগবান যাই বল, আমি নই। অবশ্য যদি বল যে আর জন্মের কর্ম্মফল এ জন্মে ভোগ করছি, তা’হলে আমি নাচার। সে যাই হ’ক এ জন্মে যে আর্টিষ্ট হ’লুম না তার কারণ, হতে পারলুম না, আর আমার বিশ্বাস শিল্পী জন্মায়, তৈরী করা যায় না, এ কথা অনেকটা সত্য। কিন্তু নিজে আর্টিষ্ট না হলেই যে আর্ট উপভোগ করা যায় না, এমন কোন কথা নেই, আর কোনও কলার সমঝদার হ’তে গেলে তাতে নিজের যেটুকু পরিমাণ দখল থাকা দরকার, আমার মনে হয় তা প্রত্যেক শিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষেই সুলভ।
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ ক’রে এ আক্ষেপ কোরো না যে, সঙ্গীত নিয়ে তুমি সময়টা হেলায় কাটিয়ে দিচ্ছ, যখন শেক্ষপীয়রের কথায় বলতে গেলে “the time is out of joint”. বন্ধু, সারা দেশকে সঙ্গীতের বন্যায় প্লাবিত করে দাও, আর যে সহজ আনন্দ আমরা প্রায় হারিয়ে বসেছি, তা আবার জীবনে ফিরিয়ে আনে। যার হৃদয়ে আনন্দ নেই, সঙ্গীতে যার চিত্ত সাড়া দেয় না, তার পক্ষে জগতে বৃহৎ কি মহৎ কিছু সম্পাদন করা কি কখনও সম্ভব? কার্লাইল বলতেন্, সঙ্গীত যার প্রাণে নেই, সে করতে পারে না হেন দুষ্কার্য্যই নেই। এ কথা সত্যি হোক বা না হোক, আমার মনে হয় যার প্রাণে সঙ্গীতের কোন সাড়া নেই, সে চিন্তায় বা কার্য্যে কখনও মহৎ হ’তে পারে না। আমাদের প্রত্যেক রক্তকণিকায় আনন্দের অনুভূতি সঞ্চারিত হোক এই আমরা চাই, কারণ আনন্দের পূর্ণতাতেই আমরা সৃষ্টি করতে পারি। আর সঙ্গীতের মত আনন্দ আর কিসে দিতে পারে।
কিন্তু আর্ট ও তজ্জনিত আনন্দকে দরিদ্রতমের পক্ষেও সহজলভ্য করতে হবে। সঙ্গীতে বিশেষজ্ঞতার চেষ্টা অবশ্য ছোট ছোট গণ্ডীর মধ্যে চলবে, আর সে রকম চর্চ্চা হওয়াও উচিত; কিন্তু সঙ্গীতকে সর্ব্বসাধারণের উপযোগীও করে তুলতে হবে। বিশিষ্ট সাধনার অভাবে আর্টের উচ্চ আদর্শ যেমন ক্ষুণ্ণ হয়, তেমনি জনসাধারণের কাছে সুগম না হলেও আর্ট এবং জীবনে বিচ্ছেদ ঘটে, আর তাতে আর্ট নির্জ্জীব ও খর্ব্বই হয়ে যায়। আমার মনে হয় লোকসঙ্গীত ও নৃত্যের (folk music and dancing) ভিতর দিয়েই আর্ট জীবনের সঙ্গে যোগ রাখে। ভারতবর্ষে জীবন ও আর্টের মধ্যে এই যোগটি পাশ্চাত্ত্য সভ্যতা প্রায় ছিন্ন করে ফেলেছে, অথচ তার স্থানে নূতন কোন যোগসূত্র যে আমরা পেয়েছি, তাও নয়। আমাদের যাত্রা, কথকতা, কীর্ত্তন প্রভৃতি যেন কোন অতীত যুগের স্মৃতিচিহ্ন মাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুতঃ যদি আমাদের গুণী শিল্পীরা অচিরে আর্টকে পুনরায় জীবনের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত না করতে পারেন, তা হলে আমাদের চিত্তের যে কি দৈন্যদশা ঘটবে, তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। তোমার হয়ত মনে আছে তোমাকে আমি একবার বলেছিলাম যে, মালদার ‘গম্ভীরা’ গানের সৌন্দর্য্যে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাতে সঙ্গীত ও নৃত্য উভয়ই ছিল। বাঙ্গলার অন্যত্র ওরূপ জিনিষ কোথাও আছে ব’লেও আমি জানিনে, আর মালদাতেও ওর মৃত্যু শীঘ্রই অবশ্যম্ভাবী, যদি নতুন ক’রে প্রাণশক্তি ওতে সঞ্চারিত করবার চেষ্টা না হয়, আর বাঙ্গলার অন্যান্য স্থানেও ওর প্রচলন না হয়। বাংলা দেশে লোকসঙ্গীতের উন্নতিকল্পে মালদায় তোমার শীঘ্র যাওয়া উচিত। গম্ভীরার মধ্যে জটিল বা বিশাল বা মহৎ কিছুই নেই—তার গুণই এই যে সহজ, সাদাসিধে। আমাদের নিজস্ব folk music ও folk dancing একমাত্র এই মালদাতেই বেঁচে আছে, আর সেই হিসাবেই গম্ভীরার যা মূল্য। সুতরাং যাঁরা ও প্রকার সঙ্গীত ও নৃত্য পুনজ্জীবিত করতে চান, তাঁদের মালদা থেকে কাজ আরম্ভ করাই সুবিধা।
লোকসঙ্গীত ও নৃত্যের দিক থেকে বর্ম্মা এক আশ্চর্য দেশ। খাঁটি দিশি নাচ ও গান এখনও পুরোদমে এখানে চলেছে, আর সুদূর পল্লীতে পর্য্যন্ত লক্ষ লক্ষ লোককে আমোদ-আহ্লাদের খোরাক যোগাচ্ছে। ভারতীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলি অনুশীলন করার পর তুমি যদি ব্রহ্মদেশের সঙ্গীতের চর্চ্চা কর ত মন্দ হয় না। সে সঙ্গীত হয়ত তত সূক্ষ্ম বা উন্নত নয়, কিন্তু দরিদ্র ও অশিক্ষিতকেও প্রচুর আনন্দ দান করবার যে ক্ষমতা তার আছে, আপাততঃ আমি তাতেই আকৃষ্ট হয়েছি। শুনি নাকি এখানকার নাচও বড় সুন্দর। বর্ম্মায় জাতিভেদ না থাকাতে এখানকার শিল্পকলার চর্চ্চা কোন শ্রেণীবিশেষের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ নয়। ফলে বর্ম্মার আর্ট চারিদিকে ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে। বোধহয় এই কারণে, আর লোকসঙ্গীত ও নৃত্যের প্রচলন থাকার দরুন, ব্রহ্মদেশে ভারতবর্ষের চেয়ে জনসাধারণের মধ্যে সৌন্দর্য্যজ্ঞান অনেক বেশী পরিণতি লাভ করেছে। দেখা হলে এ বিষয়ে আরো কথা হবে।
দেশবন্ধুর সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে আমি একমত। আমিও সম্পূর্ণ মানি যে, অনেক সময়ে সমাজ বা রাষ্ট্রের বৃহৎ ক্ষেত্রের চেয়ে জীবনের ছোটখাটো ঘটনায় মানুষের মহত্ত্ব ঢের বেশী প্রকাশ পায়। দেশবন্ধুর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত হয়েছিলাম বলেই তাঁর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধাভক্তি, ভালবাসা জন্মেছিল— দেশনেতারূপে তাঁর অনুগামী ছিলাম বলে নয়। তাঁর বেশীর ভাগ ভক্তেরও ঠিক আমার মতই হয়েছিল। বস্তুতঃ তাঁর সহকর্ম্মী ও অনুচর ছাড়া তাঁর অন্য কোন পরিজন ছিল না বললেই হয়। আমি তাঁর সঙ্গে জেলে আটমাস একসঙ্গে ছিলাম—দু’মাস পাশাপাশি ঘরে, আর ছ’মাস একই ঘরে। এইরূপে তাঁকে সম্পূর্ণ ঘনিষ্ঠভাবে জানবার সুযোগ পেয়েছিলাম,—তাইত তাঁর পদতলে আশ্রয় নিয়েছিলাম।
তুমি শ্রী অরবিন্দ সম্বন্ধে যা লিখেছ, তার সবটা না হলেও বেশীর ভাগই আমি মানি। তিনি ধ্যানী— আর আমার মনে হয়, বিবেকানন্দের চেয়েও গভীর, যদিও বিবেকানন্দের প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রগাঢ়। আমিও তোমার কথায় সায় দিই যে, “নীরব ভাবনা, কর্ম্মবিহীন বিজন সাধনা” সময়ে সময়ে দরকার হয়, এমন কি দীর্ঘ কালের জন্যেও। কিন্তু আশঙ্কা এই যে, সমাজের বা দেশের জীবনস্রোত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলে মানুষের কর্ম্মের দিকটা পঙ্গু হয়ে যেতে পারে, আর তার প্রতিভার একপেশে বিকাশের ফলে সে সমাজবিচ্ছিন্ন অতিমানুষের মতন কিছু একটা হয়ে উঠতে পারে। অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন দু’চার জন প্রকৃত সাধকের কথা অবশ্য আলাদা, কিন্তু বেশীর ভাগ লোকের কর্ম্ম বা লোকহিতই সাধনার একটা প্রধান অঙ্গ। নানা কারণে আমাদের জাতির কর্ম্মের দিকটা শূন্য হয়ে এসেছে, তাই এখন আমাদের দরকার রজোগুণের “double dose”। সাধক বা তাদের শিষ্যদের মধ্যে অতিরিক্ত চিন্তার ফলে ইচ্ছাশক্তি অসাড় যদি না হয়ে যায়, তা হলে নির্জ্জনে ধ্যান যতদিনের জন্যে তারা করে করুক, আমি তাদের সঙ্গে ঝগড়া করতে যাব না। কিন্তু আমার যেন “sicklied oer with the pale cast of thought” না হয়ে পড়ি। সাধক নিজে হয়ত নিস্তেজকারী সকল প্রভাব এড়িয়ে চলতে পারে,— কিন্তু তার চেলারা? গুরুর সাধনপদ্ধতি কি সজ্ঞানে না হোক অজ্ঞানে তাদের কোন অনিষ্ট করবে না।
আমি এ কথা সম্পূর্ণ মানি যে, প্রত্যেকেরই নিজের ক্ষমতায় পূর্ণ বিকাশ করবার চেষ্টা করতে হবে। নিজের মধ্যে যা সর্ব্বোৎকৃষ্ট, তার দানই হচ্ছে প্রকৃত সেবা। আমাদের অন্তর প্রকৃতি, আমাদের স্বধর্ম্ম যখন সার্থকতা লাভ করে, তখনই আমরা যথার্থ সেবার অধিকারী হই। এমার্সনের কথায় বলতে গেলে, নিজের ভিতর থেকেই আমাদের গ’ড়ে উঠতে হবে; তাতে আমরা সকলেই যে এক পথের পথিক হব এমন কোন কথা নেই, যদিও একই আদর্শ হয়ত আমাদের অনুপ্রাণিত করবে। শিল্পীর সাধনা কর্ম্মযোগীর সাধনা থেকে ভিন্ন, তপস্বীর যে সাধনা বিদ্যার্থীর সে সাধনা নয়, কিন্তু আমার মনে হয় এ সকলের আদর্শ প্রায় একই। গোলাকার ব্যক্তিকে চতুষ্কোণ গর্ত্তের মধ্যে পুরতে আর যেই চা’ক না কেন, আমি কখনই চাইনে। নিজের প্রতি সত্য হ’লে বিশ্বমানবের প্রতি কেউ অসত্য হতে পারে না। তাই আত্মোন্নতি ও আত্মবিকাশের পথ নিজের প্রকৃতিই দেখিয়ে দেবে। প্রত্যেক ব্যক্তি যদি নিজের শক্তি ও প্রকৃতি অনুসারে নিজেকে সার্থক ক’রে তুলতে পারে, তাহলে অচিরেই সমগ্র জাতির নব-জীবন দেখা দেয়। সাধনার অবস্থায় হয়ত মানুষকে এমন ভাবে জীবন যাপন করতে হয়, যাতে তাকে বাইরে থেকে স্বার্থপর বা আত্মসর্ব্বস্ব মনে হতে পারে। কিন্তু সে অবস্থাতে মানুষ বিবেকবুদ্ধির দ্বারা চালিত হবে, বাইরের লোকের মতামতের দ্বারা নয়। সাধনার ফল যখন প্রকাশিত হবে, তখনই লোকে স্থায়ী বিচার করবে, সুতরাং আত্মবিকাশের সত্য পথ যদি অবলম্বন করা হয়ে থাকে, তা হ’লে লোকমত উপেক্ষা করা যেতে পারে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে তোমার সঙ্গে আমার মতের যে বিশেষ পার্থক্য আছে, তা নয়। ইতি—