পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৯০

◄  ৮৯
৯১  ►
৯০
মান্দালয় জেল

 আপনি পূর্ব্বে যে সব কাগজ পাঠাইয়াছিলেন, (মহাত্মাজীর অভার্থনা-পত্র, দেশবন্ধুর স্মৃতিভাণ্ডারের জন্য যে সম্মিলনী হইয়াছিল তাহার কার্য্যসূচী ইত্যাদি) তাহা যথা সময়ে পাইয়াছিলাম। গতকাল আবার আপনার প্রেরিত লাইব্রেরীর পুস্তক-তালিকা (Variety Entertainment-এর কার্য্যসূচী ইত্যাদি) পাইয়াছি। সমিতির কাজ যে দিন দিন প্রসার লাভ করিতেছে, তাহাতে আমি যে কিরূপ আনন্দিত হইয়াছি তাহা লিখিয়া জানাইতে পারি না।

 * * *

 আপনারা যে খরচ বাদে এত টাকা পাইয়াছেন, তাহা জানিয়া সুখী হইলাম। চরকা সূতা কাটা প্রভৃতি বিষয়ে আপনি যাহা লিখিয়াছেন সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ একমত। তবে এখনও চেষ্টা ত্যাগ করিলে চলিবে না। আপনি পূর্ব্ব পত্রে লিখিয়াছিলেন যে, তুলার চাষ করতে পারিলে এক ভদ্রলোক আশী বিঘা জমি ছাডিয়া দিতে পারেন। সেরূপ জমি পাইবার যদি সম্ভাবনা থাকে, তবে তুলার চাষের বেশী খরচ অগ্রিম লাগিবে না। দু’একজন মালীর বেতন ও তুলার বীজের দাম জোগাইতে পারিলে আমরা এক বৎসরের মধ্যে ফল পাইতে পারি। জমিটা পতিত হইলে চাষোপযোগী করিবার জন্য বেশী খরচ লাগিতে পারে। অবশ্য কৃষি-বিভাগের (Agricultural Department) সহিত পরামর্শ করিয়া স্থির করিতে হইবে কোন্ জাতীয় তুলার বীজ লাগান উচিত। যে সব কুটীর-শিল্প আরম্ভ করিয়াছেন (যেমন ঠোঙা তৈরী করা) সেগুলিতে যদি লোকসান না হয়, তবে অল্প লাভ হইলেও চালাইবেন। পরে অপেক্ষাকৃত লাভজনক শিল্প চালাইতে পারিলে আমরা ঐগুলি বর্জ্জন করিব। এখন যাহারা সাহায্য গ্রহণ করে, তাহাদিগকে অন্ততঃ যে-কোনও প্রকারের কাজ করান দরকার। ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়িয়া তাহারা যখন কাজ করিতে শিখিবে তখন লাভজনক শিল্পে তাহাদিগকে লাগাইয়া দিতে পারিলে খুব ভাল ফল পাওয়া যাইবে। এখনকার কুটীর-শিল্পগুলি যদি financial success না হয় তবে কর্ম্ম প্রবৃত্তি ও dignity of labour জাগাইয়া তুলিলেও সমাজের প্রভূত কল্যাণ হইতে পারে। কুটীর-শিল্প সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত মদনমোহন বর্ম্মণ মহাশয়ের অনেক রকম ধারণা আছে। আপনি যদি এই বিষয় সম্পর্কে তাহার সহিত একবার দেখা করিতে পারেন তাহা হইলে লাভ হইতে পারে।

 বড়ী, আচার, চাটনী প্রভৃতি তৈরী করিতে পারিলে না চলিবার কোনও কারণ নাই। স্ত্রীলোকেরা, বিশেষতঃ বিধবারা এ কাজ ভাল করিতে পারিবে। কিন্তু শিখাইবার লোক পাইবেন কি? বাজারে চালাইতে গেলে এই জিনিষগুলি খুব ভাল হওয়া চাই। যদি ভাল জিনিষ প্রস্তুত করাইবার সম্ভাবনা থাকে তবে এ বিষয়ে experiment করিতে পারেন। Raw materials আপনারা supply করিয়া তৈয়ারী মাল পাইতে পারেন—(বিক্রি করার ভার আপনাদের অবশ্য) অথবা তাহারা নিজেরাই Raw materials কিনিয়া এবং মাল প্রস্তুত করিয়া আপনাদের নিকট বিক্রয় করিয়া যাইতে পারে। কাজ আরম্ভ করিবার পূর্ব্বে দোকানদারদের সহিত কথা বলা প্রয়োজন—তাহারা আমাদের মাল চালাইতে পারিবে কিনা, Raw materials ভাল হইলে অবশ্য জিনিষ ভাল হইতে পারে কিন্তু অপর দিকে চুরির সম্ভাবনা খুব বেশী। যাহারা এই কাজ করিবে তাহার গরীব সুতরাং আম, লেবু, তেল, লঙ্কা প্রভৃতি পাইলে যে তাহারা সংসারের কাজে লাগাইবে না তা কে বলিতে পারে? অপর দিকে তাহারা যদি Raw materials ক্রয় করিয়া মাল তৈরী করিয়া supply করে তবে খারাপ উপাদানে (যেমন তেল) মাল তৈয়ারী হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ সব বিষয়ে আপনি স্বপক্ষের ও বিপক্ষের কথা চিন্তা করিয়া কর্ত্তব্য স্থির করিবেন। আর একটি কথা, এই সব বস্তুর বাজারের চাহিদা কি রকম তা জানা দরকার। আমার নিজের মনে হয় যে খুব Conscientious recipients না পাইলে এ বিষয়ে কৃতকার্য্য হওয়ার ভরসা কম। গরীব ভদ্র পরিবারদের দ্বারা এ কাজ চলিতে পারে। মাল তৈয়ারী হইয়া আসিলে সঙ্গে সঙ্গে তার দাম অথবা পারিশ্রমিক চুকাইয়া দিতে হইবে এবং বিক্রয় না হওয়া পর্য্যন্ত মালগুলি আমাদের ভাণ্ডারে রাখিতে হইবে।

 সমিতির পক্ষে আর একটি কাজে হাত দেওয়া বিশেষ দরকার।

 কলিকাতায় দুইটি জেল আছে, প্রেসিডেন্সি ও আলিপুর সেণ্ট্রাল। জেলের হাসপাতালে কোনও হিন্দু কয়েদী মারা গেলে আর তার যদি আত্মীয়স্বজন কলিকাতায় কেহ না থাকে তবে তার উচিতমত সৎকার হয় না, পয়সা দিয়া ডোম বা মেথর শ্রেণীর লোক দিয়া সৎকারের ব্যবস্থা করিতে হয়। এদিকে মুসলমানদের Burial Association আছে এবং মুসলমান কয়েদী মারা গেলে তার খবর পাওয়া মাত্র সৎকারের ব্যবস্থা করে। এরূপ একটা Organization হিন্দু কয়েদীদের জন্য করা প্রয়োজন। এ কাজের ভার কি সেবক-সমিতি লইতে পারে? যদি আপনাদের মত হয় তবে বসন্তবাবুকে দিয়া জেল সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকে পত্র দিতে পারেন যে, সেবা-সমিতি এ কাজের ভার লইতে প্রস্তুত আছে। আপনারা যদি এখন ব্যবস্থা না-ও করিতে পারেন তবে আমি বাইরে গেলে নিজে এ বিষয়ে চেষ্টা করিব। আমি নিজে লোকাভাব ঘটিলে অনেক সৎকার করিয়াছি, সুতরাং এরূপ কাজে আমি স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করিতে স্বয়ং প্রস্তুত।

 * * *

 কুটীর-শিল্প যদি চালাইতে চান তবে একটা কাজ করা দরকার। একটি উপযুক্ত যুবককে কাশীমবাজার Polytechnic অথবা ঐ জাতীয় কোন প্রতিষ্ঠানে কিছু কাজ শিখিয়া লইতে হইবে। কাশীমবাজারের স্কুলে মাটির পুতুল ও দেবদেবীর মূর্ত্তি খুব সুন্দর তৈয়ারী হয়। এইরূপ শিল্প যদি সমিতির সাহায্যপ্রার্থীদের মধ্যে চালাইতে পারেন তবে তাহাদের প্রস্তুত মাল বাঙ্গলার সর্ব্বত্র (বিশেষতঃ মেলা ও উৎসবের সময়) বিক্রয় হইতে পারে। আর একটি শিল্পের প্রচার এদেশে আছে—রঙীন কাগজ হইত নানা প্রকার ফুল, তোড়া ও ফুলসমেত গাছ এবং Chinese lantern তৈয়ারী করা। জিনিষগুলি এত সুন্দর হয় যে, হঠাৎ দেখিলে চিনিবার উপায় থাকেনা যে, এগুলি কাগজের তৈয়ারী। ভদ্র ঘরের ছোট ছেলেমেয়েরাও এ কাজ খুব সুন্দর করিতে পারে।

 ঢাকার বোতাম তৈয়ারী কুটীর-শিল্প হিসাবে চলিতেছে। অনেকের ধারণা যে ঢাকার বোতাম বুঝি ফ্যাক্টরীতে তৈয়ারী হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা হয় না। পল্লীগ্রামের ঘরে ঘরে অবসর সময়ে, এমন কি রান্নার ফাঁকের মধ্যে মেয়েরা এই কাজ করিয়া থাকে—সইজন্য এত সস্তায় জিনিষ পাওয়া যায়। বোতামের শিল্প কলিকাতায় প্রচার করা সম্ভব কিনা সে বিষয়ে একটু চিন্তা করিবেন। হয় তো কি ভাবে এই শিল্প কুটীরে কুটীরে চলিতেছে তাহা দেখিবার জন্য কাহাকেও ঢাকা জেলায় পাঠাইতে হইবে।

 স্বাস্থ্যবিষয়ক বক্তৃতা এবং ছায়াচিত্রের বন্দোবস্ত ভবানীপুর অঞ্চলে করিতে পারিলে ভাল হয়। যেখানে গরীবদের বস্তী—বক্তৃতা হওয়া বেশী দরকার সেখানে। যদি সম্ভব হয় তবে সেবক-সমিতির জন্য একটা ম্যাজিক লণ্ঠনের আসবাব ও ছবি কিনিবার চেষ্টা করিবেন। ছায়াচিত্রের সাহায্যে স্বাস্থ্যসম্বন্ধীয় বক্তৃতা দিলে ঢের বেশী কাজ হইবে। ছবিগুলি না কিনিয়া কোন স্থানীয় চিত্রকরকে দিয়া আঁকাইয়া লইলে বোধহয় লাভ হইবে। ইতি—