পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৯১

◄  ৯০
৯২  ►
৯১

শ্রীসন্তোষকুমার বসুকে লিখিত

মান্দালয়
৪।১২।২৫

প্রিয়বরেষু—

 শ্রীযুক্ত বসু,

 আপনার পত্র পড়িতে ও উহার উত্তর লিখিতে আমি খুব আনন্দ বোধ করিয়া থাকি। আপনার এ পত্রখানি পাইয়া আমি যে কিরূপ আনন্দিত হইয়াছি তাহা প্রকাশ করিতে পারিব নাআ বর্ত্তমান পরিস্থিতিতে কর্পোরেশনে আপনি যে সকল কাজ করিয়া যাইতেছেন যতদূর সম্ভব উহা লক্ষ্য করিয়া যাইতেছি। আশা করি রাস্তার কুকুরের উৎপাত বন্ধ করিবার জন্য উহাদের মারিয়া ফেলার যে ব্যবস্থা করা হইতেছে উহাতেই কাজ হইবে।

 গেজেটের বার্ষিক সংখ্যা খুব সুন্দর হইয়াছে। অনুগ্রহ করিয়া সম্পাদক মহাশয়কে তাঁহার এই কৃতিত্বের জন্য আমার অভিনন্দন জানাইবেন। তিনি আমার নিকট একটি বাণী চাহিয়াছিলেন কিন্তু আমি সেই সঙ্গে কয়েকটি প্রস্তাবও করিয়া পাঠাইয়াছি। উহা কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হইয়াছিল; তবু আমার মতামত জানাইবার একটি সুযোগের সদ্ব্যবহারের আশায় উদ্‌গ্রীব হইয়া ছিলাম। সেই কারণেই উহা আমি পাঠাইয়াছি। তখন আমি বুঝিতে পারি নাই যে, অদূর ভবিষ্যতে গেজেট সম্বন্ধে সম্পাদক মহাশয়কে আমার মতামত জানাইবার কোনও সুযোগ পাইব এবং প্রস্তাবগুলি পাঠাইবার ইহাই একমাত্র কারণ। আরও কয়েকটি জরুরী বিষয় আপনাকে জানাইতে চাই এই কারণে যে, আপনার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও উৎসাহের দ্বারা ঐ সম্বন্ধে কোনও ব্যবস্থা করিবেন। ইতিপূর্ব্বে কোনও কোনও সদস্যের নিকট লিখিয়াছি কিন্তু কোনও ফল হয় নাই।

 রাস্তার আলো সম্বন্ধে গ্যাস কোম্পানীর সহিত চুক্তি ১৯৩১ সালে শেষ হইবে। উহা শেষ হইবার ৫ বৎসর পূর্ব্বে (অর্থাৎ ১৯২৬ সালে) নূতন চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার কথা, যাহাতে ১৯৩১ সালে কাজ শুরু করার জন্য নূতন পার্টি প্রস্তুত হইতে পারে। আমাদের সম্মুখে চারিটি উপায় খোলা আছে:

 (১) এই বিভাগকে পৌরসভার অধীনে আনা ও গ্যাস সরবরাহ করা।

 (২) এই বিভাগকে পৌরসভার অধীনে আনা ও গ্যাসের পরিবর্ত্তে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা।

 (৩) সহরের রাস্তায় বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করিবার জন্য নূতন কোনও কোম্পানীর সহিত চুক্তি করা।

 (৪) গ্যাস কোম্পানীর সহিত নূতন করিয়া চুক্তি করা।

 আপনি বোধহয় অনুমান করিতে পারেন, আমি এই বিভাগটিকে পৌরসভার অধীনে আনারই পক্ষপাতী। পৃথিবীর বড় বড় সহরে পৌরসভাগুলিই রাস্তায় বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করিয়া থাকে; তবে আমরা কেন পারিব না? যদি আমরা গ্যাসের ব্যবহার চালু রাখিতে চাই তাহা হইলে উহার উপজাত জিনিসগুলিকে শিল্পে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলির নিকট বিক্রয় করিয়া কাজে লাগাইতে পারি অথবা পৌরসভাই উহার দ্বারা শিল্প পরিচালনা করিতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, Phenyle অথবা Phenocol না কিনিয়া আমরা নিজেরাই বীজাণুনাশক দ্রব্য উৎপাদন করিতে পারি। গ্যাস কোম্পানীর সমগ্র কারখানাটি সেলামী দিয়া কিনিয়া লইয়া উহা আমাদের নিজেদের পরিচালনাধীনে আনাও সম্ভব হইতে পারে। ইহা আমি বুঝিতে পারি না যে, কেন উহা লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইবে না।

 পৌরসভার অধীনে আসিলে গ্যাসের পরিবর্ত্তে আমরা বিদ্যুৎ ব্যবহার করিব কিনা উহা গভীরভাবে বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে। এ সমস্যার সমাধান সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে আর্থিক সঙ্গতির উপর। গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব্বে আমি লাইটিং সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকে বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদনের কারখানা পরিচালনা করিতে কিরূপ খরচ পড়িতে পারে তাহার একটি তুলনামূলক বিবরণ তৈরী করিতে বলিয়াছিলাম। জানি না এ কাজে তিনি অগ্রসর হইয়াছেন কিনা। মোটের উপর, বিদ্যুতের অনুকূলেই উহা যাইবে বলিয়া বোধহয়। ইহা আপনার অজানা নাই যে, পাম্পিং স্টেশনগুলিতে ও সহরের কয়েকটি রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করিতে বিদ্যুৎ খরচের জন্য আমর। Electric Supply Corporation-কে বছরে কয়েক লক্ষ টাকা দিয়া থাকি। যদি আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করিতে পারি তাহা হইলে সমস্ত পাম্পিং স্টেশন উহার দ্বারাই পরিচালিত হইতে পারিবে এবং খরচের ব্যাপারেও অনেক সাশ্রয় হইবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হইবার পূর্ব্বে সব দিক সতর্কতার সহিত বিবেচনা করিয়া দেখা কর্ত্তব্য। এক বৎসর না লাগিলেও অন্ততঃ ৬ মাস আলোচনা চালাইতে লাগিবে—তাই এখনই অবিলম্বে উহা উত্থাপিত হওয়া প্রয়োজন।

 আমি কিছুদিন যাবৎ Municipal Market-এ একটি ঠাণ্ডাঘর প্রতিষ্ঠার কথা ভাবিতেছি। অবিক্রীত মাছ, মাংস ও ফল ইহার ফলে রক্ষা করা সম্ভব হইবে। বাজারে প্রত্যহ বেশ কিছু পরিমাণ খাদ্য নষ্ট হয়; এবং এই ক্ষতি পেষাইয়া লইবার জন্য সব জিনিষের দাম বাড়াইয়া দেওয়া হয়। যদি একটি ঠাণ্ডা ঘরের দ্বারা উহা রোধ করা সম্ভব হয় তাহা হইলে খাদ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পাইবে এবং দামও কমিয়া যাইবে। এই বিষয়টি মার্কেট কমিটির নিকট উত্থাপন করা যাইতে পারে।

 ইংলণ্ডে Food Preservation Department বলিয়া একটি বিভাগ আছে এবং কেম্ব্রিজে আমার এক বন্ধু (মিঃ পি পারিজা, বোটানীর অধ্যাপক, র‍্যাভেনশ’ কলেজ, কটক) ঐ বিভাগে প্রায় এক বৎসর Paid Research Scholar হিসাবে কাজ করিয়াছেন। তিনি আপেল ও উহার রক্ষার উপায় সম্বন্ধে গবেষণা করিয়াছিলেন। কয়েকদিন পূর্ব্বে লণ্ডন টাইমসে একটি প্রবন্ধ পড়িতেছিলাম যাহাতে বলা হইয়াছে, আপেল রক্ষা সম্বন্ধে কোনও পরীক্ষাই এখনও সফল হয় নাই। এ সম্বন্ধে সর্ব্বাধুনিক গবেষণা ও উহার বাস্তব প্রয়ােগ সম্বন্ধে আপনাকে তথ্য সরবরাহের জন্য আপনি ব্যক্তিগতভাবে অথবা সেক্রেটারী মারফৎ মিঃ পারিজাকে পত্র দিতে পারেন। ইংলণ্ডের Ministry of Health অথবা London County Council-এর সহিতও যােগাযােগ করিতে পারেন তথ্যানুসন্ধানের জন্য। খাদ্য রক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা হইলে সরবরাহ বৃদ্ধি পাইবেই এবং দামও কমিবে; তাই এ ব্যাপারে অন্যান্য দেশ কতদূর কি অগ্রসর হইয়াছে উহার সহিত পরিচিত হওয় আমাদের অবশ্য প্রয়ােজন।

 বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্ত্তনের বিষয়ে বোম্বাই, দিল্লী ও চট্টগ্রাম আমাদের চাইতে আগাইয়া গিয়াছে। কি লজ্জার কথা! প্রায় ৩ মাস পূর্ব্বে ডপুটি মেয়রকে এ বিষয়ে পত্র দিয়াছিলাম কিন্তু আমার মনে হয় না যে, তিনি বিন্দুমাত্র উদ্যমের পরিচয় দিয়াছেন। ১৯২৬ সালে কয়েকটি নির্দ্দিষ্ট অঞ্চলে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্ত্তনের ইচ্ছা আমার ছিল—তাহা হইলে বর্ত্তমান কর্পোরেশন যখন বিদায় লইবে তখন এ সম্বন্ধে এক বৎসরের অভিজ্ঞতা তাহাদের সঞ্চয় হইত। আইনে এরূপ কোনও ব্যবস্থা নাই যাহাতে উহা আমরা প্রবর্ত্তন করিতে পারি; এজন্য কর্পোরেশনকে বিশেষ ক্ষমতা দিতে হইবে। আমাকে জানানো হইয়াছে যে, কাউন্সিলের গত অধিবেশনে বাবু সুরেন্দ্রনাথ রায়ের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হইয়া একটি প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে, যাহাতে স্থানীয় গভর্ণমেণ্টকে এই ক্ষমতা দেওয়া হইয়াছে,— তাঁহারা বিজ্ঞপ্তির দ্বারা বিশেষ ক্ষমতা অর্পণ করিয়া কোনও স্থানীয় সংস্থাকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্ত্তন ও এতৎ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য নিযুক্ত করিতে পারিবেন।

 নদীর উৎস, ধারা ও বিলুপ্তি—সব মিলাইয়া ইহা একটি বিজ্ঞান। বিদেশে কিছু সংখ্যক ইঞ্জিনীয়ার এ সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান অর্জ্জন করিয়াছেন। ছোট ছোট নদী তৈরী করিয়া বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে উহার সম্ভাব্য গতিপথ সম্বন্ধে পরীক্ষাকার্য্য চালান হয়। বিদ্যাধরী সম্বন্ধে জানিতে উৎসুক কোনও নদীবিশেষজ্ঞকে সেখানকার ভূমি পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে এবং নকল নদী তৈরী করিয়া পরীক্ষা চালাইতে হইবে। ভবিষ্যতে কলিকাতার নর্দ্দমা তৈরী সম্বন্ধে কোনও পরিকল্পনাই কার্য্যকরী হইবে না যতক্ষণ না আপনি বিদ্যাধরী এলাকার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কোনও ভবিষ্যদ্বাণী (অথবা ধারণা) করিতে পারিতেছেন। Mr. Wilkinson অথবা যে কোনও পয়ঃপ্রণালী-বিশেষজ্ঞ দ্বিতীয় সমস্যাটির বিষয়ে কিছু করিতে পারেন; কিন্তু প্রথমোক্তটির সমাধান একমাত্র নদী-বিশেষজ্ঞের দ্বারাই সম্ভব হইতে পারে। বিদ্যাধরী কমিটি এতদিনে প্রথম সমস্যাটির কাছাকাছি পৌঁছাইতে পারিয়াছেন।

 ইউরোপ ও আমেরিকার বিশিষ্ট নদী-বিশেষজ্ঞদের সম্বন্ধে খোঁজ খবর জানিতে চাহিয়া আপনি ডাঃ বেণ্টলীকে ব্যক্তিগতভাবে পত্র লিখিতে পারেন। ঐ সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহের জন্য কর্পোরেশনের পক্ষ হইতেও ইংলণ্ডের Institute of Civil Engineers-এর কাছে সাহায্য চাওয়া যাইতে পারে। আপনি যদি এই বিষয়টির ভারও গ্রহণ করেন তাহা হইলে আনন্দিত হইব।

 Markets Committee-র কার্য্যাবলী জানিবার জন্য উৎসুক হইয়া আছি। ভবিষ্যতে যত ঝড়-ঝাপ্টাই আসুক না কেন Trial Manshatala Boat উহা কাটাইয়া উঠিতে পারিবে বলিয়া গভীর আশা পোষণ করি। কার্য্যকরী কোনও প্রস্তাবের কথা ভাবিতে পারিলে মেজদাদাকে মাঝে মাঝে লিখিয়া জানাইব। আশা করি আপনি আমার প্রস্তাবগুলি বিবেচনা করিয়া দেখিবেন।

 Workshop Comm. কোনও রিপোর্ট দাখিল করিয়াছে কি? বর্ত্ত‌মানে Motor Vehicles Dept -এর অবস্থাই বা কিরূপ? অদূর ভবিষ্যতে ইহার পুনর্গঠনের সম্ভাবন আছে কি? Municipal Railway-র ইঞ্জিনগুলির অবস্থা খারাপ বলিয়া আমার মনে হয় এবং এজন্য আপনাকে E. B. Rly -র সাহায্য গ্রহণ কবিতে হইবে। রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার নূতন মেশিনের জন্য পরবর্ত্তী বাজেটে কিছু অর্থ বরাদ্দ করা কর্ত্তব্য। কর্পোরেশনের মধ্যে আরও যে সব অঞ্চল আসিয়াছে সেখানকার জন্য জলের গাড়ীও প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ব্বে আমাদের নূতন যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে! রাস্তাঘাটের অবস্থা সম্বন্ধে যে অনুসন্ধানকার্য্য শুরু হইয়াছিল উহা আর অগ্রসর হইয়াছে কি? আমার বিশ্বাস, roads department-কে একজন road engineer-এর অধীনে আনিয়া উহার কেন্দ্রীয়করণ করিতে হইবে; অবশ্য তাঁহার ইউরোপে রাস্তাঘাট নির্মাণের আধুনিক পদ্ধতি সম্বন্ধে শিক্ষাপ্রাপ্ত হওয়া চাই। কর্পোরেশনে সে রকম কোনও যোগ্য road engineer নাই। অন্যান্য দেশে রাস্তাঘাটের এত দ্রুত উন্নতি হইয়াছে যে, আমরা অনেক পিছনে পড়িয়া আছি। কোনও যোগ্য লোককে ঠিক করিয়া বিদেশে শিক্ষার জন্য পাঠানোই বোধহয় ভাল হইবে। আমাদের roads department এরূপ অসংগঠিত যে, নূতন নূতন প্রয়োজনের চাপ সহ্য করা উহার পক্ষে সম্ভব নয়, বিশেষতঃ যখন কলিকাতার আয়তন দ্রুত বৃদ্ধি পাইয়াছে। আগামী বৎসর রাস্তার কাজে গুরুতর বিঘ্ন ঘটিবে বলিয়া মনে হয়; ফলে করদাতারা আপনাদের চাপিয়া ধরিবে। সমস্ত Engineering Dept.-এরই পুনর্ব্বিন্যাস প্রয়োজন এবং বিভিন্ন বিভাগের (রাস্তা, পয়ঃপ্রণালী, আবর্জ্জনা) স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করিয়া লইতে হইবে। কলিকাতার মত একটি বিরাট সহরের পক্ষে একজন “সব-জান্তা” চীফ ইঞ্জিনীয়ারের প্রয়োজন আছে কিনা আমার সন্দেহ আছে।

 প্রতি বৎসরই একটি বিশেষ সময়ে কলিকাতায় বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে; এ সম্বন্ধে কোনও তদন্তের ব্যবস্থা করিয়াছেন কি?

 আরও অনেক বিষয় না লিখিয়া আমাকে এখানেই অকস্মাৎ পত্র শেষ করিতে হইতেছে; কারণ এ পত্র অনেক দীর্ঘ হইয়া গিয়াছে এবং আমাকে ডাক ধরিতে হইবে। যাহা লিখিয়াছি উহার উপর পুনরায় চোখ বুলাইতে পারিলাম না—অনুগ্রহ করিয়া এই ব্যস্ততার জন্য ক্ষমা করিবেন।

 গভীর শ্রদ্ধা জানিবেন।

ইতি—

আপনার সহোদরপ্রতিম

সুভাষচন্দ্র বসু।

(ইংরেজী হইতে অনূদিত)