পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৯৭
পরবর্ত্তী দুইখানি পত্র বিভাবতী বসুকে লিখিত
শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়
পূজনীয়া মেজবৌদিদি,
আপনার চিঠি কয়েকদিন হল পেয়েছি। অশোক এত ভালো সূতা কাটতে শিখেছে শুনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। আশ্চর্য্য যে হই নাই তা বলতে পারি না। বস্তুতঃ সূতা কাটা এত সহজ যে, আমার মনে হয় অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরাও শিক্ষা পেলে কাটতে পারে। আসাম অঞ্চলে একটা রীতি প্রচলিত আছে যে বিবাহের সময় কন্যার পক্ষে খুব ভাল সূতা কাটা জানা চাই—আমাদের মধ্যে যেমন এক সময় খুব ভাল রান্না জানার প্রথা ছিল। গোরা, অরুণা প্রভৃতি কেন সূতা কাটে না? তারা অবসর নিশ্চয় যথেষ্ট পায়। আমার মনে হয় যে একবার যদি নিজের হাতে কাটা সূতার কাপড় কেহ চোখে দেখে তা হ’লে তার সূতা কাটার উৎসাহ খুব বেড়ে যাবে। নিজের হাতের রান্না যেমন মিষ্টি লাগবেই লাগবে—নিজের হাতে কাটা সূতার জামাকাপড়ও সেরূপ ভাল লাগবেই লাগবে।
ভগবানের ইচ্ছায় আজকাল আমার প্রায় প্রত্যেকটি চিঠির কয়েক লাইন কাটা হয়ে তার গন্তব্য স্থানে পৌঁছায়। তার অর্থ বোধ হয় আপনারা বুঝতে পারেন।
আপনার চিঠি পাবার পূর্ব্বেই এখানে পায়রার আড্ডা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশতঃ এর মধ্যে একটি পায়রা এর মধ্যেই একটা হুলো বেরালের উদরস্থ হয়েছে। এখানে, কোর্ট বসিয়ে বেরালের বিচার করা হ’ল। খাবার দিয়ে রাত্রে ফাঁদ পেতে বেরালকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথমে কথা উঠে যে বেরালের ফাঁসি হওয়া উচিত। কারণ মানুষ হত্যা করলে জেলখানায় মানুষের ফাঁসি হয়ে থাকে। তার পর কথা উঠে যে ফাঁসি দিয়ে যখন কাহারও কোনও লাভের সম্ভাবনা নাই, তখন বেরাল ভোজনের ব্যবস্থা করা উচিত। এদেশে কতকগুলো লোক অভাবে পড়লে বেরাল খেতে আপত্তি করে না—সেরূপ কয়েদী জেলের মধ্যে আছে। জেলখানায় কয়েদীদের পক্ষে যখন মৎস্য-মাংস দুষ্প্রাপ্য, তখন তাহারা একটা বেরাল পেলে রান্না করে খেতে প্রস্তুত হতে পারে—এরূপ প্রস্তাব একজন ভদ্রলোক করলেন। সর্ব্বশেষে হঠাৎ সকলের মধ্যে বৈষ্ণব ভাব জেগে উঠল এবং বেরালকে বস্তায় বন্ধ করে বনবাসে পাঠাবার হুকুম জারি করা হয়ে গেল।
প্রায় একমাস কাল মুরগী ডিমে তা দিয়ে, ডিম ফুটে ছানা বাহির হ’ল। ইয়াঙ্কা ছিলেন সেই সব মুরগী দেখা শোনার কাজে। গোড়া থেকেই ইয়াঙ্কা প্রভু ডিম সরাতে আরম্ভ করলেন। যেখানে ডিম হয় ৫৬টা সেখানে ঘরে উঠে মাত্র ২।৩টা। বাকী কয়টা তার কৃপায় অদৃশ্য হয়। যেদিন ধরা পড়লেন, সেদিন একেবারে নেকা। তার বয়স মাত্র ৭১ বৎসর কিন্তু পেটটা অতিশয় বড়। অনেকে বলেন যে তিনি ভোলানাথের অবতার; কারণ পেটটা একেবারে মহাদেবের মত। ইয়াঙ্কার কৃপায় প্রত্যহ মুরগীর ছানা মরতে আরম্ভ করল। ১০।১২ থেকে দাঁড়াল তিনটা। সেগুলি এখনও পর্য্যন্ত জীবিত আছে। বোধ হয় মরবার আর আপাততঃ আশা নাই। একদিন তার অযত্নের দরুন চিল এসে ছোঁ মেরে একটী মুরগীর ছানা নিয়ে গেল। সকাল বেলা যখন ধরা পড়ল তখন ইয়াঙ্কা সাধু সেজে বল্লেন, “মুসীতু” অর্থাৎ “ছিল না”। অনেক ধম্কা-ধম্কির পর সত্য কথা স্বীকার করলেন।
কিন্তু আসলে ইয়াঙ্কা লোক মন্দ নয়। সে বুঝেছে যে জগতে সার সত্য হচ্ছে পেট। “তস্মিন্ তুষ্টে জগৎ তুষ্টং”—পেট ঠাণ্ডা হলেই জগৎ সন্তুষ্ট হয়। এবং পেটের জন্য সে কোনও কাজ করতে পশ্চাৎপদ হয় না। বুদ্ধের স্তব বর্ম্মা ভাষায় সে বেশ বলতে পারে— তার কাছ থেকে আমি সে স্তব শুনে শিখেছি। যখন ফিরব তখন আপনাদের সকলকে সে স্তব শোনাব।
বাঙ্গলা দেশ থেকে চারজন কয়েদীকে এ জেলে বদলী করে আনা হয় আমাদের কাজকর্ম্ম করার জন্য। কিন্তু তাদের মধ্যে কাজের লোক মাত্র একজন। তার উপরেই রান্নাঘরের ভার। এখানে এত রকম লোক দেখতে পাওয়া যায় যে তাতে আনন্দ যেমন পাওয়া যায়—শিক্ষাও সেরূপ হয়।
কবিরাজী ঔষধ খেয়ে প্রায় দুই মাস বেশ উপকার পেয়েছিলাম। এখন বোধ হয় ঔষধ বদলাতে হবে কারণ বিশেষ সুবিধা বোধ হয় না। গরমও পড়তে আরম্ভ করেছে—শ্রীসকালেই যত গণ্ডগোল। যাক্ দিনগুলি কেটে যাবে তাতে সন্দেহ নাই। আমার চিঠিগুলি আপনি রেখে দেবেন এবং মেজদাকে বলবেন রেখে দিতে।
আশা করি ওখানকার সকল খবর ভাল। আমি মেজদাদাকে লিখছি চিত্রাঙ্কন ও সঙ্গীতের জন্য মাষ্টার ছেলেমেয়েদের জন্য রাখতে। তাঁর মত কি হবে জানি না— তবে আমি এই দুই জিনিষের অভাব নিজের জীবনে বোধ করি। সেইজন্য ছেলেমেয়ের সুশিক্ষা হ’লে সুখী হব।
সরস্বতী পূজা আমরা এখানেও করেছিলুম। পূজার খরচ নিয়ে আমাদের সহিত কর্ত্তৃপক্ষের গণ্ডগোল চলেছে। দুর্গাপূজার টাকা ও সরস্বতী পূজার টাকা এখনও সরকার দেয় নাই। আমি কয়েকটি কাগজ এর সহিত পাঠাচ্ছি—তার থেকে বুঝতে পারবেন যে আমাদের সংক্রান্ত খরচ মঞ্জুর করবার ভার বাঙ্গলা সরকারের উপর—বর্ম্মা সরকারের উপর নয়। বর্ম্মা সরকার বলেন যে খরচের ভার বাঙ্গলা সরকারের উপর এবং বাঙ্গলা কাউন্সিলে সরকারের পক্ষ হতে বলা হয়েছিল যে সব খরচ মঞ্জুর করে বর্ম্মা সরকার। এই কাগজগুলি হতে বুঝতে পারবেন যে পূজার খরচ নামঞ্জুর করেছে বাঙ্গলা সরকার। এই কাগজগুলির মধ্যে দুই দরখাস্তের নকল পাঠাচ্ছি। এই দরখাস্তগুলি আমরা বর্ম্মা সরকারের নিকট পাঠিয়েছি।
শ্রীসুভাষ।