পথের দাবী/২২
২২
জলপথে শত্রু-পক্ষীয় জাহাজের গতিরোধ করিবার উদ্দেশে নদীর ধারে, সহরের শেষ প্রান্তে একটি ছোট রকমের মাটির কেল্লা আছে, এখানে সিপাহী-শান্ত্রী অধিক থাকে না, শুধু ব্যাটারি চালনা করিবার জন্য কিছু গোরা গোলন্দাজ ব্যারাকে বাস করে। ইংরাজের এই নির্ব্বিঘ্ন শান্তির দিনে এখানে বিশেষ কড়া-কড়ি ছিল না; নিষেধ আছে, অন্যমনস্ক পথিক কেহ তাহার সীমানার মধ্যে গিয়া পড়িলে তাড়া করিয়াও আসে, কিন্তু ঐ পর্য্যন্তই। ইহারই একধারে গাছ-পালার মধ্যে পাথরে বাঁধানো একটা ঘাটের মত আছে, হয়ত কোন উচ্চ রাজকর্ম্মচারীর আগমন উপলক্ষ্যে ইহার সৃষ্টি হইয়া থাকিবে, কিন্তু এখন ইহার কাজও নাই, প্রয়োজনও নাই। ভারতী মাঝে মাঝে একাকী আসিয়া এখানে বসিত। কেল্লার রক্ষণাবেক্ষণের ভার যাহাদের প্রতি ছিল তাহাদের কেহ যে দেখে নাই তাহা নহে, সম্ভবতঃ স্ত্রীলোক বলিয়া এবং ভদ্র স্ত্রীলোক বলিয়াই আপত্তি করিত না। বোধ করি এইমাত্র সূর্য্যাস্ত হইয়া থাকিবে, কিন্তু অন্ধকার হইতে তখনও কিছু বিলম্ব ছিল। নদীর কতক অংশে, এবং পরপারবর্ত্তী গাছপালার উপরে শেষ স্বর্ণাভা ছড়াইয়া পড়িয়াছে, দলে দলে পাখীর সারি এদিক হইতে ওদিকে উড়িয়া চলিয়াছে, কাকের কালো দেহে, বকের সাদা পালকে, ঘুঘুর বিচিত্র পাণ্ডুর সর্ব্বাঙ্গে আকাশের রাঙা আলো মিশিয়া হঠাৎ যেন তাহাগিকে কোন অজানা দেশের জীব করিয়া তুলিয়াছে। তাহাদের অবাধ স্বচ্ছন্দ গতি অনুসরণ করিয়া ভারতী নির্নিমেষচক্ষে চাহিয়া রহিল। কি জানি, কোথায় ইহাদের বাসা, কিন্তু সে অলক্ষ্য আকর্ষণ কাহারও এড়াইয়া যাইবার জো নাই। এই কথা মনে করিয়া দুই চক্ষু তাহার জলে ভরিয়া উঠিল। হাত দিয়া মুছিয়া ফেলিয়া চাহিয়া দেখিল দূর বৃক্ষশ্রেণীর সোনার দীপ্তি নিবিয়া আসিতেছে এবং মাথার উপরে গাছপালা নদীতে দীর্ঘতর ছায়াপাত করিয়া জল কালো করিয়া আনিয়াছে এবং তাহারই মধ্য হইতে অন্ধকার যেন সুদীর্ঘ জিহ্বা মেলিয়া সম্মুখের সমস্ত আলোক নিঃশব্দে লেহন করিয়া লইতেছে।
সহসা নদীর ডানদিকের বাঁক হইতে একখানি ক্ষুদ্র শাম্পান নৌকা সুমুখে উপস্থিত হইল। নৌকার মাঝি ভিন্ন অন্য আরোহী ছিল না। সে চট্টগ্রামী মুসলমান। ক্ষণকাল ভারতীর মুখের দিকে চাহিয়া তাহার চট্টগ্রামের দুর্ব্বোধ্য মুসলমানী বাঙলায় কহিল, আম্মা, ওপারে যাবে? এক খানা পয়সা দিলেই পার করে দিই।
ভারতী হাত নাড়িয়া কহিল, না, ওপারে আমি যাবো না।
মাঝি বলিল আচ্ছা দুটো পয়সা দাও, চল।
ভারতী কহিল, না বাপু, তুমি যাও! বাড়ি আমার এপারে,ওপারে যাবার আমার দরকার নেই।
মাঝি গেল না, একটু হাসিয়া কহিল, পয়সা না হয় নাই দেবে, চল তোমাকে একটু বেড়িয়ে নিয়ে আসি। এই বলিয়া সে ঘাটের একধারে নৌকা ভিড়াইতে উদ্যত হইল। ভারতী ভয় পাইল, গাছ-পালার মধ্যে স্থানটা অন্ধকার এবং নির্জ্জন। দীর্ঘদিন এদেশে থাকার জন্য ইহাদের ভাষা বলিতে না পারিলেও ভারতী বুঝিত। এবং ইহাও জানিত চট্টগ্রামের এই মুসলমান মাঝি সম্প্রদায় অতিশয় দুর্বৃত্ত। তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া ক্রুদ্ধস্বরে কহিল, তুমি যাও বলচি এখান থেকে নইলে পুলিশ ডাকবো।
তাহার উচ্চ কণ্ঠ ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাতে বোধ হয় চট্টগ্রামী মুসলমান এবার ভয় পাইয়া থামিল। ভারতী চাহিয়া দেখিল লোকটার বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ পার হইয়াছে, কিন্তু সখ যায় নাই। পরণে লতা-পাতা ফুল-কাটা লুঙ্গী, কিন্তু তেলে ও ময়লার অত্যন্ত মলিন। গায়ে মূল্যবান মিলিটারী ফ্রক কোট, জরির পাড়, কিন্তু যেমন নোংরা তেমনি জীর্ণ। বোধহয় কোন পুরাতন জামা-কাপড়ের দোকান হইতে কেনা। মাথায় বেলদার নেকড়ার টুপি, কপাল পর্য্যন্ত টানা। এই মূর্ত্তির প্রতি রোষদৃপ্তচক্ষে চাহিয়া ভারতী কয়েক মুহূর্ত্ত পরেই হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, দাদা, চেহারা যাই হোক, কিন্তু গলার আওয়াজটাকে পর্য্যন্ত বদলে মুসলমান করে ফেলেচ।
মাঝি কহিল, যাবে, না পুলিশ ডাকবে?
ভারতী কহিল, পুলিশ ডেকে তোমায় ধরিয়ে দেওয়াই উচিত। অপূর্ব্ববাবুর ইচ্ছেটা আর অপূর্ণ রাখি কেন!
মাঝি কহিল, তার কথাই বলচি। এসো জোয়ার আর বেশি নেই, এখনো কোশ দুই যেতে হবে।
ভারতী নৌকায় উঠিল, ঠেলিয়া দিয়া ডাক্তার পাকা মাঝির মতই দ্রুতবেগে অগ্রসর হইলেন। যেন দুইখানা দাঁড় টানাই তাঁহার পেশা। কহিলেন, লামা জাহাজ চলে গেল দেখলে?
ভারতী কহিল, হ্যাঁ।
ডাক্তার কহিলেন, অপূর্ব্ব এই দিকেই ফার্স্ট ক্লাস ডেকে দাঁড়িয়েছিল দেখতে পেলে?
ভারতী ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, না।
ডাক্তার কহিলেন, তার বাসায় কিংবা আফিসে আমার যাবার জো ছিল না, তাই জেটির একধারে শাম্পান বেঁধে আমি ওপরে দাঁড়িয়েছিলাম। হাত তুলে সেলাম করতেই—
ভারতী ব্যাকুল হইয়া কহিল, কার জন্যে কিসের জন্যে এতবড় ভয়ানক কাজ করতে গেলে দাদ? প্রাণটা কি তোমার একেবারেই ছেলেখেলা।
ডাক্তার মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না একেবারেই না। আর গেলাম কিসের জন্যে? ঠিক সেইজন্যে যে জন্যে তুমি চুপটি করে এখানে একলা বসে আছ বোন।
ভারতী উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন কিছুতেই চাপিতে পারিল না। কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, কখ্খনো না। এখানে আমি এমনি এসেছি—প্রায় আসি। কারও জন্যে আমি কখ্খনো আসিনি। তোমাকে চিনতে পারলেন?
ডাক্তার সহাস্যে বলিলেন, না, একেবারেই না। এ বিদ্যে আমার খুব ভাল করেই শেখা,—এ দাড়ি-গোঁফ ধরা সহজ কর্ম্ম নয়, কিন্তু আমার ভারি ইচ্ছে ছিল অপূর্ব্ববাবু যেন আমাকে চিনতে পারেন। কিন্তু এত ব্যস্ত যে তার সময় ছিল কই?
ভারতী নীরবে চাহিয়া ছিল, সেই অত্যন্ত উৎসুক মুখের প্রতি চাহিয়া ক্ষণকালের জন্য ডাক্তার নির্ব্বাক হইয়া গেলেন।
ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, তারপরে কি হ’ল।
ডাক্তার বলিলেন, বিশেষ কিছুই না।
ভারতী চেষ্টা করিয়া একটু হাসিয়া কহিল, বিশেষ কিছু যে হয়নি সে শুধু আমার ভাগ্য। চিনতে পারলেই তোমার ধরিয়ে দিতেন, আর সে অপমান এড়াবার জন্যে আমাকে আত্মহত্যা করতে হতো। চাকরি যাক, কিন্তু প্রাণটা বাঁচলো? এই বলিয়া সে দূর পরপারে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া নিশ্বাস মোচন করিল।
ডাক্তার নীরবে নৌকা বাহিয়া চলিতে লাগিলেন।
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকিয়া ভারতী সহসা মুখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল, কি ভাবচ দাদা?
বল ত দেখি?
বলব? তুমি ভাবছো এই ভারতী মেয়েটি আমার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ চিনতে পারে। নিজের প্রাণ বাঁচাতে কোন শিক্ষিত লোকই যে এত বড় হীনতা স্বীকার করতে পারে,—লজ্জা নেই, কৃতজ্ঞতা নেই, মায়াদয়া নেই,—খবর দিল না, খবর নেবার এতটুকু চেষ্টা করলে না,—ভয়ের তাড়নায় একেবারে জন্তুর মত ছুটে পালিয়ে গেল, এ কথা আমি কল্পনা করতেও পারিনি, কিন্তু ভারতী একেবারে নিঃসংশরে জেনেছিল। ঠিক এই না? সত্যি ব’লো।
ডাক্তার ঘাড় ফিরাইরা নিরুত্তরে দাঁড় টানিয়া চলিতে লাগিলেন, কিছুই বলিলেন না।
আমার দিকে একবার চাও না দাদা।
ডাক্তার মুখ ফিরাইয়া চাহিতেই ভারতীর দুই ঠোঁট থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল, কহিল, মানুষ হয়ে মনুষ্য-জন্মের কোথাও কোন বালাই নেই, এমন কি করে হয় দাদা? এই বলিয়া সে দাঁত দিয়া জোর করিয়া তাহার ওষ্ঠাধারের কম্পন নিবারণ করিল, কিন্তু দুই চোখের কোণ বাহিয়া ঝর ঝর করিয়া অশ্রু গড়াইয় পড়িল।
ডাক্তার সায় দিলেন না, প্রতিবাদ করিলেন না, সান্ত্বনার একটি বাক্যও তাঁহার মুখ দিয়া বাহির হইল না। কেবল পলকের জন্য যেন মনে হইল তাঁহার সুর্ম্মাটানা চোখের দীপ্তি ঈষৎ স্তিমিত হইয়া আসিল।
ইরাবতীর এই ক্ষুদ্র শাখানদী অগভীর ও অপ্রশস্ত বলিয়া স্টীমার বা বড় নৌকা সচরাচর চলিত না। জেলেদের মাছ ধরার পানসি কিনারায় বাঁধা মাঝে মাঝে দেখা গেল, কিন্তু লোকজন কেহ ছিল না। মাথার উপরে তারা দেখা দিয়াছে, নদীর জল কালো হইয়া উঠিয়াছে, নির্জ্জন ও পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতার মধ্যে ডাক্তারের সতর্ক চালিত দাঁড়ের সামান্য একটুখানি শব্দ ভিন্ন আর কোন শব্দ কোথাও ছিল না। উভয় তীরের বৃক্ষশ্রেণী যেন সম্মুখে এক হইয়া মিশিয়াছে। তাহারই ঘনবিন্যস্ত শাখা-পল্লবের অন্ধকার অভ্যন্তরে সজল দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া ভারতী নীরবে স্থির হইয়া বসিয়াছিল। তাহাদের শাম্পান যে কোন ঠিকানায় চলিয়াছিল ভারতী জানিত না, জানিবার মত উৎসুক সচেতন মনের অবস্থাও তাহার ছিল না, কিন্তু সহসা প্রকাণ্ড একটা গাছের অন্তরালে গুল্ম-লতা-পাতা-সমাচ্ছন্ন অতি সঙ্কীর্ণ খাদের মধ্যে তাহাদের ক্ষুদ্র তরী প্রবেশ করিল দেখিয়া সে চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?
ডাক্তার কহিলেন, আমার বাসায়।
সেখানে আর কে থাকে?
কেউ না।
কখন আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে?
পৌঁছে দেব? খাজ রাত্রির মধ্যে যদি না দিতে পারি কাল সকালে যেয়ো।
ভারতী মাথা নাড়িয়া কহিল, না দাদা, সে হবে না। তুমি আমাকে যেখান থেকে এনেচ সেখানে ফিরে রেখে এস।
কিন্তু আমার যে অনেক কথা আছে ভারতী
ভারতী ইহার জবাব দিল না, তেমনি মাথা নাড়িয়া আপত্তি জানাইয়া বলিল, না, আমাকে তুমি ফিরে রেখে এস।
কিন্তু কিসের জন্য ভারতী? আমাকে কি তোমার বিশ্বাস হয় না?
ভারতী অধোমুখে নিরুত্তর হইয়া রহিল।
ডাক্তার কহিলেন, এমন কত রাত্রি ও তুমি একাকী অপূর্বর সঙ্গে কাটিয়েচ, সে কি আমার চেয়েও তোমার বেশি বিশ্বাসের পাত্র?
ভারতী তেমনি নির্ব্বাক হইয়াই রহিল, হাঁ না কোন কথাই কহিল না। খালের ওই স্থানটা যেমন অন্ধকার তেমনি অপ্রশস্ত। দু’ধারের গাছের ডাল যাঝে মাঝে তাহার গায়ে আসিয়া ঠেকিতে লাগিল। এদিকে নদীতে ভাঁটার উল্টা টান গুরু হইয়া গেছে,—ডাক্তার খোলের মধ্যে হইতে লণ্ঠন বাহির করিয়া জ্বালিয়া সম্মুখে রাখিলেন এবং দাঁড় রাখিয়া দিয়া একটা সরু বাঁশ হাতে লইয়া ঠেলিতে ঠেলিতে বলিলেন, আজ যেখানে তোমাকে নিয়ে যাচ্চি ভারতী, দুনিয়ায় কেউ নেই সেখান থেকে তোমাকে উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু আমার মনের কথা বুঝতে বোধ হয় তোমার আর বাকী নেই? এই বলিয়া তিনি হাঃ হাঃ করিয়া যেন জোর করিয়া হাসিতে লাগিলেন। অন্ধকারে তাঁহার মুখের চেহারা ভারতী দেখিতে পাইল না, কিন্তু তাঁহার হাসির স্বরে কে যেন অকস্মাৎ তাহার ভিতর হইতে তাহাকে ধিক্কার দিয়! উঠিল। মুখ তুলিয়া নিঃশঙ্ককণ্ঠে কহিল, তোমার মনের কথা বুঝতে পারি এত বুদ্ধি আমার নেই! কিন্তু তোমার চরিত্রকে আমি চিনি। একলা থাকা আমার উচিত নয় বলেই ওকথা বলেচি দাদা, আমাকে তুমি ক্ষমা কর।
ডাক্তার ক্ষণকাল নিস্তব্ধ থাকিয়া স্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠে কহিলেন, ভারতী, তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার কষ্ট হয়। তুমি আমার বোন, আমার দিদি, আমার মা—এ বিশ্বাস নিজের ’পরে না থাকলে এ পথে আমি আসতাম না। কিন্তু তোমার মূল্য দিতে পারে এ সংসারে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। এর শতাংশের এক অংশও অপূর্ব্ব যদি কোনদিন বোঝে ত জীবনটা তার সার্থক হয়ে যাবে। দিদি, সংসারের মধ্যে তুমি ফিরে যাও,—আমাদের ভেতরে আর তুমি থেকো না। কেবল তোমার কথাটাই বলবার জন্যে আজ অপূর্ব্বর সঙ্গে আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম।
ভারতী চুপ করিয়া রহিল। আজ একটা কথাও না বলিয়া অপূর্ব্ব চলিয়া গেছে। চাকরি করিতে বর্ম্মায় আসিয়াছিল, মাঝে ক’টা দিনেরই বা পরিচয়!
সে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের ছেলে, তাহার দেশ আছে, সমাজ আছে, বাড়ি-ঘর আত্মীয়-স্বজন কত কি! আর অস্পৃহ ক্রীশ্চানের মেয়ে ভারতী। দেশ নাই, গৃহ নাই, মা-বাপ নাই, আপনার বলিতে কোথাও কেহ নাই। এ পরিচয় যদি আজ হইয়াই থাকে ত অভিযোগের কি-ই বা আছে! তারতী তেমনি নিঃশব্দেই স্থির হইয়া বসিয়া রহিল, কেবল অন্ধকারে দুই চক্ষু বাহিয়া তাহার অবিরল জল গড়িতে লাগিল।
অনতিদূরে গাছপালার মধ্যে হইতে সামান্য একটু আলো দেখা গেল। ডাক্তার দেখাইয়া কহিলেন, ঐ আমার বাসা। এই বাঁকটা পেরোলেই তার দোরগোড়ায় গিয়ে উঠবো। খুব ফ্রি ছিলাম, কি একরকম মায়ায় জড়িয়ে গেলাম, ভারতী, তোমার জন্যেই আমার ভাবনা। কোনো একটা নিরাপদ আশ্রয় পেয়েচ শুধু এইটুকু যদি যাবার আগে দেখে যেতে পারতাম!
ভারতী অঞ্চলে অশ্রু মুছিয়া ফেলিল, আমি ত ভালই আছি, দাদা।
ডাক্তারের মুখ দিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস বাহির হইয়া আসিল। এই বস্তুটা এতই অসাধারণ যে, ভারতীর কানে গিয়া তাহা বিঁধিল। কহিলেন, কোথায় ভাল আছ ভাই? আমার লোক এসে বললে তুমি ঘরে নেই। ভাবলাম জেটির কোথাও এক জায়গায় তোমাকে পাবো, পেলাম না বটে, কিন্তু তখনি নিশ্চয় মনে হ’ল এই নদীর ধারে কোথাও-না-কোথাও দেখা তোমার মিলবেই। দুর্ভাগ্য তোমার আনন্দই শুধু চুরি করে পালায়নি, ভারতী, তোমার সাহসটুকু পর্য্যন্ত নষ্ট করে দিয়ে গেছে।
এ কথার সম্পূর্ণ তাৎপর্য্য বুঝিতে না পারিয়া ভারতী নীরব হইয়া রহিল। ডাক্তার কহিতে লাগিলেন, সেদিন রাত্রে নিশ্চিন্ত মনে আমাকে বিছানা ছেড়ে দিয়ে তুমি নীচে শুলে। হেসে বললে, দাদা, তুমি কি আবার মানুষ যে তোমাকে আমার লজ্জা বা ভয়? তুমি ঘুমোও। কিন্তু আজ আর সে সাহস নেই। বিশেষ নির্ভর করবার লোক অপূর্ব্ব নয়, তবু সে কাছেই ছিল বলে কালও হয়ত এ আশঙ্কা তোমার মনেও হ’তো না। আশ্চর্য্য এই যে তোমার মত মেয়েরও নির্ভর স্বাধীনতাকে তার মত একটা অক্ষম লোকেও না কত সহজেই ভেঙে দিয়ে যেতে পারে!
ভারতী মৃদুকণ্ঠে কহিল, কিন্তু উপায় কি দাদা?
ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, উপায় হয়ত নেই। কিন্তু আমি ভাবছি বোন, চরিত্রকে তোমার সন্দেহ করতে আজ কেউ কাছে নেই বলে তোমার নিজের মনটাই যদি অহরহ তোমাকে সন্দেহ করে বেড়ায় তুমি বাঁচবে কি করে? এমন করে ত কারও প্রাণ বাঁচে না ভারতী।
এমন করিয়া ভারতী আপনাকে আপনি বিশ্লেষণ করিয়া দেখে নাই। তাহার সময় ছিলই বা কই! তাহার শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের অবধি রহিল না, কিন্তু সে নির্ব্বাক হইয়া রহিল।
ডাক্তার বলিতে লাগিলেন, আমি আর একটি মেয়েকে জানি, সে জাতে রুশ। কিন্তু তার কথা থাক্। কবে তোমাদের আবার দেখা হবে আমি জানিনে, কিন্তু মনে হয় যেন একদিন হবে। বিধাতা করুন, হোক। তোমার ভালবাসার তুলনা নেই, সেখান থেকে অপূর্ব্বকে কেউ সরাতে পারবে না, কিন্তু নিজেকে তার গ্রহণযোগ্য করে রাখবার আজ থেকে এই যে জীবনব্যাপী অতি-সতর্ক সাধনা শুরু হবে, তার প্রতিদিনের অসম্মানের গ্লানি মনুষ্যত্বকে যে তোমার একেবারে খর্ব্ব করে দেখে ভারতী! হায় রে! এমন চিরশুদ্ধ হৃদয়ের মূল্য যেখানে নেই, সেখানে এমনি করে বোঝাতে হয়! পদ্মফুল চিবিয়ে না খেয়ে যারা তৃপ্তি মানে না, দেহের শুদ্ধতা দিয়ে এমনি করেই কান মলে তার কাছে দাম আদায় হয়। হবেও হয়ত। কি জানি, কপালে বাঁচবার মিয়াদ ততদিন আমার আছে কি না, কিন্তু যদি থাকে দিদি, বোন বলে গর্ব্ব করবার তখন সব্যসাচীর আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে তাহলে কি করতে বল? তুমিই ত আমাকে বারংবার বলেচ সংসারের মধ্যে ফিরে যেতে।
কিন্তু মাথা হেঁট করে যেতে ত বলিনি।
ভারতী বলিল, কিন্তু মেয়েমানুষের উঁচু মাথা ত সবাই পছন্দ করে না দাদা।
ডাক্তার বলিলেন, তবে যেয়ো না।
ভারতী ম্লানমুখে হাসিয়া বলিল, সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো দাদা, যাওয়া আমার হবে না। সমস্ত পথ নিজের হাতে বন্ধ করে কেবল একটি পথ খুলে রেখেছিলাম, সেও আজ বন্ধ হয়ে গেছে এ তো তুমি নিজের চোখেই দেখে এসেচ। এখন, যে পথ আমাকে দেখিয়ে দেবে সেই পথেই চলবো; কেবল এইটুকু মিনতি আমার রেখো, তোমাদের ভয়ঙ্কর পথে আমাকে তুমি ডেকো না। ভগবানের যত দুস্প্রাপ্য বস্তু পাবারও এত রাস্তা বেরিয়েচে, শুধু তোমার লক্ষ্যে পৌঁছিবারই রক্তপাত ছাড়া আর দ্বিতীয় পথ নেই? আমার একান্ত মনের বিশ্বাস মানুষের বুদ্ধি একেবারে শেষ হয়ে যায়নি, কোথাও-না-কোথাও অন্য পথ আছেই আছে। এখন থেকে তারই সন্ধানে আমি পথে বার হবো। ভয়ানক দুঃখ যে কি সে-রাত্রে আমি টের পেয়েছি, যেদিন তোমরা তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলে।
ডাক্তার হাসিলেন, কহিলেন, এই আমার বাসা। এই বলিয়া ক্ষুদ্র নৌকা জোর করিয়া ডাঙ্গায় ঠেলিয়া দিয়া অবতরণ করিলেন এবং লণ্ঠন হাতে তুলিয়া লইয়া পথ দেখাইয়া কহিলেন, জুতো খুলে নেমে এসো। পায়ে একটু কাদা লাগবে।
ভারতী নিঃশব্দে নামিয়া আসিল। গোটা চারেক মোটা মোটা সেগুন কাঠের খুঁটির উপর পুরাতন ও প্রায় অব্যবহার্য তক্তা মারিয়া একটা কাঠের বাড়ি খাড়া করা হইয়াছে। জোয়ারের জল সরিয়া গিয়া সমস্ত তলাটা একহাঁটু পাঁক পড়িয়াছে, লতা-পাতা, গাছ-পালা পচার দুর্গন্ধে বাতাস পর্য্যন্ত ভারী হইয়া উঠিয়াছে, সুমুখের হাত দুই পরিসর পথটুকু ছাড়া চারদিক কেয়া ও দেনো গাছের এমনি দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ঘেরিয়া আছে যে, শুধু সাপ-খোপ বাঘ-ভালুক নয়, একপাল হাতী লুকাইয়া থাকিলেও দেখিবার জো নাই। ইহার ভিতরে যে মানুষ বাস করিতে পারে তাহা চোখে না দেখিলে কল্পনা করা অসম্ভব। কিন্তু এই লোকটির কাছে সকলই সম্ভব। ভাঙ্গা কাঠের সিঁড়ি ও দড়ি ধরিয়া উপরে উঠিতে একটি সাত-আট বছরের ছেলে আসিয়া যখন দ্বার খুলিয়া ছিল, তখন ভারতী বিস্ময়ে বাক্যহীন হইয়া রহিল। ভিতরে পা বাড়াইতেই দেখিতে পাইল মেঝের উপর চাটাই পাতিয়া শুইয়া একজন অল্পবয়স্কা বর্ম্মী স্ত্রীলোক, তিন-চারটি ছেলেমেয়ে যে যেখানে পড়িয়া, ইহাদেরই একজন ঘরের মধ্যে বোধ হয় একটা অপকর্ম্ম করিয়া রাখিয়াছে,—খুব সম্ভব অনাবশ্যক বোধেই তাহা পরিষ্কৃত হয় নাই—একটা দুঃসহ দুর্গন্ধে গৃহের বায়ুমণ্ডল বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছে। মেঝের সর্ব্বত্র ছড়ানো ভাত, মাছের কাঁটা এবং পিঁয়াজ-রসুনের খোলা, নিকটেই গোটা-দুই-তিন কালি-মাখা ছোট-বড় মাটির হাঁড়ি, ছেলেগুলো হাত ডুবাইয়া খাবলাইয়া ভাত-তরকারী খাইয়াছে তাহা চাহিলেই বুঝা যায়; ইহারই পাশ দিয়া ভারতী ডাক্তারের পিছু পিছু আর একটা ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল। কোথাও কোন আসবাবের বালাই নাই, মেঝের উপর চাটাই পাতা, একধারে একটা সতরঞ্চি গুটান ছিল, ডাক্তার স্বহস্তে ঝাড়িয়া তাহা পাতিয়া দিয়া ভারতীকে বসিতে দিলেন। ভারতী নিঃশব্দে উপবেশন করিয়া দেখিল সেই পরিচিত প্রকাণ্ড বোঁচকাটি ডাক্তারের একপাশে রহিয়াছে। অর্থাৎ সত্য সত্যই ইঁহার এই ঘরটিই বর্ত্তমান বাসস্থান। ও-ঘর হইতে বর্ম্মী স্ত্রীলোকটি কি একটা জিজ্ঞাসা করিল, ডাক্তার বর্ম্মী ভাষাতেই তাহার জবাব দিলেন। অনতিকাল পরেই সেই ছেলেটা সানকিতে করিয়া দু-চাঙড় ভাত, পেয়ালায় ঝোল এবং পাতায় করিয়া খানিকটা মাছপোড়া আানিয়া একধারে রাখিয়া দিয়া গেল। নৌকার লণ্ঠনটি ডাক্তার সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলেন, তাহারই আলোকে এই সকল খাদ্যবস্তুর প্রতি চাহিবামাত্রই ভারতীর গা বমি-বমি করিয়া উঠিল।
ডাক্তার কহিলেন, তোমারও বোধ হয় ক্ষিধে পেয়েচে, কিন্তু এ-সব—
ভারতীর মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না, কিন্তু সে প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া জানাইল, না, না, কিছুতে না। সে ক্রীশ্চান মেয়ে, জাতিভেদ মানে না, কিন্তু যেখান হইতে যেভাবে এই সকল আনীত হইল তাহা ত সে আসিবার পথেই চোখে দেখিয়া আসিয়াছে।
ডাক্তার কহিলেন, আমার কিন্তু ক্ষিদে পেয়েচে ভাই, আগে পেটটা ভরিয়ে নিই। এই বলিয়া তিনি হাত ধুইয়া স্মিতমুখে আহারে বসিয়া গেলেন। ভারতী চাহিয়া দেখিতেও পারিল না, ঘৃণায় ও অপরিসীম ব্যথায় মুখ ফিরাইয়া রহিল। তাহার বুকের ভিতর হইতে কান্না যেন সহস্রধারে ফাটিয়া পড়িতে চাহিল। হায়রে দেশ! হায়রে মুক্তির পিপাসা! জগতে কিছুই ইহারা আর আপনার বলিয়া অবশিষ্ট রাখে নাই। এই গৃহ, এই খাদ্য, এই ঘৃণিত সংশ্রব, এমনি করিয়া এই বন্য পশুর জীবনযাপন, ক্ষণকালের জন্য মৃত্যুও ভারতীর অনেক সুসহ বলিয়া মনে হইল। সে হয়ত অনেকেই পারে, কিন্তু এই যে দেহ-মনের অবিশ্রাম নির্য্যাতন, আপনাকে আপনি স্বেচ্ছায় পলে পলে এই যে হত্যা করিয়া চলার দুঃসহ সহিষ্ণুতা, স্বর্গে-মর্ত্যে কোথাও কি ইহার তুলনা আছে! অধীনতার বেদনা কি ইহাদের এ-জীবনের আর সমস্ত বেদনাবোধই একেবারে ধুইয়া দিয়াছে! কিছুই কোথাও বাকি নাই। তাহার অপূর্ব্বকে মনে পড়িল। তাহার চাকরির শোক, তাহার বন্ধু মহলে হাতের কালশিরার লজ্জা,—ইহারাই ত মাতার সহস্রকোটি সন্তান। ইহারাই ও দেশের মেরু-মজ্জা, খাইরা পরিয়া পাশ করিয়া, চাকরিতে কৃতকার্য্য হইয়া যাহাদের একটানা জীবন জন্ম হইতে মৃত্যু পর্য্যন্ত পরম নিরাপদে কাটিতেছে। আর ওই যে লোকটি একান্ত তৃপ্তিতে নির্ব্বিকার চিত্তে বসিয়া ভাত গিলিতেছে—ভারতীর মূহুর্ত্তের জন্য মনে হইল, হিমাচলের কাছে সহস্র খণ্ড উপলের তিলার্দ্ধ বেশি তাহারা নয়। আর তাহাদেরই একজনকে ভালবাসিয়া, তাহারই ঘরে গৃহণীপণার বঞ্চিত দুঃখে আজ সে বুক ফাটিয়া মরিতেছে। অকস্মাৎ ভারতী জোর করিয়া বলিয়া উঠিল, দাদা, তোমার নির্দ্দিষ্ট এই রক্তারক্তির পথ কিছুতেই ভাল নয়। অতীতের যত নজিরই তুমি দাও—যা অতীত, যা বিগত, সে-ই চিরদিন শুধু অনাগতের বুক চেপে তাকে নিয়ন্ত্রিত করবে, মানব-জীবনে এ বিধান কিছুতেই সত্য নয়। তোমার পথ নয়, কিন্তু তোমার এই সকল বিসর্জ্জন দেওয়া দেশের সেবাই আমি আজ থেকে মাথায় তুলে নিলাম। অপূর্ব্ববাবু সুখে থাকুন, তাঁর জন্যে আর আমি শোক করিনে, আমার বাঁচবার মন্ত্র আজ আমি চোখে দেখতে পেয়েছি।
ডাক্তার সবিস্ময়ে মুখ তুলিয়া ভাতের ডেলার মধ্যে হইতে অস্ফুট কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হ’ল ভারতী?