২৩

 হাত-মুখ ধুইয়া আসিয়া ডাক্তার তাঁহার বোঁচকার উপরে চাপিয়া বসিলেন। পূর্ব্বোক্ত ছেলেটি মস্ত মোটা একটা বর্ম্মী সিগার টানিতে টানিতে ঘরে ঢুকিল এবং কয়েক মুহূর্ত্ত ধরিয়া নাক-মুখ দিয়া অপর্য্যাপ্ত ধূম উদ্গীরণ করিয়া চুরুটটি ডাক্তারের হাতে দিয়া প্রস্থান করিল। ভারতীর মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন অনুভব করিয়া ডাক্তার সহাস্যে কহিলেন, অমনি পেলে আমি সংসারে কিছুই বাদ দিতে ভালবাসিনে ভারতী। অপূর্ব্বর কাকাবাবু আমাকে যখন রেঙ্গুনের জেটিতে প্রথম গ্রেপ্তার করেন, তখন পকেট থেকে আমার গাঁজার কলকে বার হয়ে পড়েছিল। নইলে, বোধ হয় ছুটি পেতাম না। এই বলিয়া তিনি মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন।

 ভারতী এ ঘটনা শুনিয়াছিল, কহিল, সে আমি জানি এবং হাজার ছুটি পেলেও যে ওটা তুমি খাও না তা-ও জানি। কিন্তু এ বাড়িটি কার দাদা?

 আমার।

 আর এই বর্ম্মী মেয়েটি এবং শিশুগুলি।

 ডাক্তার হাসিয়া ফেলিয়া কহিলেন, না ওঁরা আমার একটি মুসলমান বন্ধুর সম্পত্তি। আমারি মত ফাঁসি-কাঠের আসামী, কিন্তু সে অন্য বাবদে। সম্প্রতি স্থানান্তরে গেছেন, পরিচয় ঘটবার সুযোগ হবে না।

 ভারতী কহিল, পরিচয়ের জন্য আমি ব্যাকুল নই; কিন্তু সর্ব্বদিক থেকে তুমি যে স্বর্গপুরীতে এসে আশ্রয় নিয়েচ, তার থেকে আমাকে বাসায় রেখে এসো দাদা, এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

 ডাক্তার হাসিমুখে জবাব দিলেন, এ স্বর্গপুরী যে তোমার সইবে না, সে তোমাকে আনবার পূর্ব্বেই আমি জানতাম। কিন্তু তোমাকে বলবার আমার যত কথা ছিল, সে তো এই স্বর্গপুরী ছাড়া প্রকাশ করবারও আর দ্বিতীয় স্থান নেই ভারতী। আজ তোমাকে একটুখানি কষ্ট পেতেই হবে।

 ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি শীঘ্রই আর কোথাও যাবে?

 ডাক্তার কহিলেন, হ্যাঁ। উত্তর এবং পূর্ব্বের দেশগুলো আর একবার ঘুরে আসতে হবে। ফিরতে হয় ত বছর দুই লাগবে। কিন্তু আজ তুমি নানারকমে এত ব্যথা পেয়েচ বোন, যে সকল কথা বলতে আমার লজ্জা হয়। কিন্তু আজকের রাত্রির পরে আর যে সহজে তোমাকে দেখা দিতে পারবো সে ভরসাও করিনে।

 কথা শুনিয়া ভারতী উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল, কহিল, তুমি কি তাহলে কালই চলে যাচ্ছো?

 ডাক্তার মৌন হইয়া রহিলেন। ভারতী মনে মনে বুঝিল ইহার আর পরিবর্ত্তন নাই। তারপরে এই রাত্রিটুকু অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই এ দুনিয়ায় সে একেবারে একাকী। খোঁজ করিবারও কেহ থাকিবে না!

 ডাক্তার কহিতে লাগিলেন, হাঁটা-পথে আমাকে দক্ষিণ চীনের ক্যানটনের ভিতর দিয়ে এগোতে হবে। আর ও-পথে কর্ম্ম-সূত্রে যদি না আমেরিকার গিয়ে পড়ি ত প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলো ঘুরে আবার এই দেশেতেই এসে আশ্রয় নেব। তারপরে আগুন যদি না জ্বলে, আমি এইখানেই রইলাম ভারতী। একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, আর ফিরতে যদি না-ই পারি বোন, বোধ হয় খবর একটা পাবেই।

 এই মানুষটির শান্তকণ্ঠের সহজ কথাগুলি কতই সামান্য, কিন্তু ইহার ভয়ঙ্কর চেহারা ভারতীর চোখের সম্মুখে ফুটিরা উঠিল। সে কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া কহিল, হাঁটাপথে চীনদেশে যাওয়া যে কত ভয়ানক সে আমি শুনেচি। কিন্তু তুমি মনে মনে হেসো না দাদা, আমি তোমাকে ভয় দেখাতে চাইনি, কতটুকু তোমাকে আমি চিনি। কিন্তু, বেরিয়েই যদি যাও, এইখানেই আবার কেন ফিরে আসতে চাও? তোমার নিজের জন্মভূমিতে কি তোমার কাজ নেই?

 ডাক্তার কহিলেন, তাঁরই কাজের জন্যে আমি এদেশ ছেড়ে সহজে যাবো না। মেয়েরা এ দেশের স্বাধীন, স্বাধীনতার মর্ম্ম তারা বুঝবে। তাদের আমার বড় প্রয়োজন। আগুন যদি কখনো এদেশ জ্বলেছে দেখতে পাও, যেখানেই থাকো ভারতী, এই কথাটা আমার তখন স্মরণ ক’রো, এ আগুন মেয়েরাই জ্বেলেচে। কথাটা আমার মনে থাকবে ত?

 এই ইঙ্গিত ভারতী বুঝিল, কহিল, কিন্তু তোমার পথের পথিক ত আমি নই!

 ডাক্তার কহিলেন, তা আমি জানি। কিন্তু পথ তোমার যাই কেন না হোক, বড় ভাইয়ের কথাটা স্মরণ করতে ত দোষ নেই,—তবু ত দাদাকে মাঝে মাঝে মনে পড়বে!

 ভারতী কহিল, বড় ভাইকে মনে পড়বার আমার অনেক জিনিয় আছে। কিন্তু এমনি করেই বুঝি তোমার বিপথে মানুষকে তুমি টেনে আনো দাদা। আমাকে কিন্তু তা পারবে না। এই বলিয়া সহসা সে উঠিয়া পড়িল এবং গুটানো সতরঞ্চিটা ঝাড়িয়া পাতিয়া দিয়া বাঁশের আলনা হইতে কম্বল বালিশ প্রভৃতি পাড়িয়া লইয়া স্বহস্তে শয্যা রচনা করিতে আরম্ভ করিয়া দিয়া আস্তে আস্তে বলিল, অপূর্ব্ববাবুর জাহাজের চাকা আজ আমাকে যে পথের সন্ধান দিয়ে গেছে, এ জীবনে সেই আমার একটিমাত্র পথ। আবার যেদিন দেখা হবে, এ কথা তুমিও সেদিন স্বীকার করবে।

 ডাক্তার ব্যগ্র হইয়া বলিয়া উঠিলেন, হঠাৎ এ আবার কি শুরু করে দিলে ভারতী? ঔ ছেঁড়া কম্বলটুকু কি আমি নিজে পেতে নিতে পারতাম না? এর ত কোন দরকার ছিল না।

 ভারতী কহিল, তোমার ছিল না বটে, কিন্তু আমার ছিল। যার জন্যে যখনই বিছানা পাতি দাদা, তোমার ওই ছেঁড়া কম্বলটুকু আর কখনো ভুলব না। মেয়েমানুষের জীবনে এরও যদি না দরকার থাকে ত কিসের আছে বলে দিতে পারো?

 ডাক্তার হাসিয়া কহিলেন, এর জবাব আমি দিতে পারলাম না বোন, তোমার কাছে আমি হার মানচি। কিন্তু তুমি ছাড়া নিজের পরাজয় আমাকে কোন দিন কোন মেয়েমানুষের কাছেই স্বীকার করতে হয়নি।

 ভারতী হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করিল, সুমিত্রাদিদির কাছেও না?

 ডাক্তার মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না।

 শয্যা প্রস্তুত হইলে ডাক্তার তাঁহার বোঁচকার আসন ছাড়িয়া বিছানায় আসিয়া উপবেশন করিলেন। ভারতী অদূরে মেঝের উপর বসিয়া ক্ষণকাল অধোমুখে নীরবে থাকিয়া কহিল, যাবার পূর্ব্বে আর একটি কথা যদি তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, ছোট বোনের অপরাধ মাপ করবে?

 করব।

 তবে বল সুমিত্রাদিদি তোমার কে? কোথায় তাঁকে তুমি পেলে?

 তাহার প্রশ্ন শুনিয়া ডাক্তার অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তাহার পরে মৃদু হাসিয়া কহিলেন, ও যে আমার কে, এ জবাব সে নিজে না দিলে আর জানবার উপায় নেই। কিন্তু যেদিন ওকে চিনতাম না বললেও চলে, সেদিন নিজেই আমি স্ত্রী বলে ওর পরিচয় দিয়েছিলাম। সুমিত্রা নাম আমারই দেওয়া—আজ সেইটেই বোধ করি ওর নজির।

 ভারতী গভীর কৌতূহলে স্থির হইয়া চাহিয়া রহিল। ডাক্তার কহিলেন, শুনেচি ওর মা ছিল নাকি ইহুদী মেয়ে, কিন্তু বাপ ছিলেন বাঙালী ব্রাহ্মণ। প্রথমে সার্কাসের দলের সঙ্গে জাভায় যান, পরে সুরাভারা রেলওয়ে স্টেশনে চাকরি করতেন। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন সুমিত্রা মিশনারিদের স্কুলে লেখাপড়া শিখতো, তিনি মারা যাবার পরে বছর পাঁচ-ছয়ের ইতিহাস আর তোমার শুনে কাজ নেই।

 ভারতী মাথা নাড়িয়া কহিল, না দাদা, সে হবে না, তুমি সমস্ত বল।

 ডাক্তার কহিলেন, আমিও সমস্ত জানিনে ভারতী, শুধু এইটুকু জানি যে, মা, মেয়ে, দুই মামা, একটি চীনে এবং জন-দুই মাদ্রাজী মুসলমান মিলে এঁরা জাভায় লুকানো আফিঙ গাঁজা আমদানি-রপ্তানীর ব্যবসা করতেন। তখনও কিছুই জানিনে কি করেন, শুধু দেখতে পেতাম বাটাভিয়া থেকে সুরাভায়ার পথে রেল গাড়িতে সুমিত্রাকে প্রায়ই যাওয়া-আসা করতে। অতিশয় সুশ্রী বলে অনেকের মত আমারও দৃষ্টি পড়েছিল। এই পর্য্যন্তই। কিন্তু হঠাৎ একদিন পরিচয় হয়ে গেল তেগ স্টেশনের ওয়েটিংরুমে। বাঙালীর মেয়ে বলে তখনই কেবল প্রথম খবর পেলাম।

 ভারতী বলিল, সুন্দরী বলে আর সুমিত্রাদিদিকে ভুলতে পারলে না—দাদা?

 ডাক্তার কহিলেন, সে যাই হোক, একদিন জাভা ছেড়ে কোথায় চলে গেলাম ভারতী, বোধ হয় ভুলেও গিয়েছিলাম,—কিন্তু বছর খানেক পরে অকস্মাৎ বেঙকুলান শহরের জেটিতে দেখা সাক্ষাৎ। এক তোরঙ্গ আফিঙ, চারিদিকে পুলিশ আর তার মাঝে সুমিত্রা। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে তার জল পড়তে লাগলো, এ সন্দেহ আর রইল না যে আমাকে তাকে বাঁচাতেই হবে। আফিঙের সিন্ধুকটাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে একেবারে স্ত্রী বলে তার পরিচয় দিলাম। এতটা সে ভাবেনি, সুমিত্রা চমকে গেল। সুমাত্রার ঘটনা বলে সুমিত্রা নামটাও আমারই দেওয়া। নইলে তার সাবেক নাম ছিল, রোজ দাউদ। তখন বেঙকুলানের মামলা-মকদ্দমা পাদাঙ শহরে হোতো, আমার একজন পরম বন্ধু ছিলেন পল ক্রুগার, তাঁর বাড়িতে সুমিত্রাকে নিয়ে এলাম। মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সুমিত্রাকে খালাস দিলেন বটে, কিন্তু সুমিত্রা আর আমাকে খালাস দিতে চাইলে না।

 ভারতী হাসিয়া কহিল, খালাস কোনদিন পাবেও না দাদা।

 ডাক্তার কহিতে লাগিলেন, ক্রমশঃ তাদের দলের লোক খবর পেয়ে উঁকি-ঝুঁকি মারতে লাগলো, বন্ধু ক্রুগারও দেখতে পেলাম সৌন্দর্য্যে চঞ্চল হয়ে উঠছেন, অতএব তাঁর জিম্মাতে রেখেই একদিন চুপি চুপি সুমাত্রা ছেড়ে সরে পড়লাম।

 ভারতী আশ্চর্য্য হইয়া বলিল, এদের মাঝে তাঁকে একলা ফেলে রেখে? উঃ,—তুমি কি নিষ্ঠুর দাদা!

 ডাক্তার বলিলেন, হাঁ, অনেকটা অপূর্ব্বর মত। আবার বছর খানেক কেটে গেল। তখন সেলিবিস দ্বীপে ম্যাকেসার শহরে একটি ছোট্ট অখ্যাত হোটেলে বাস করছিলাম, একদিন সন্ধ্যার সময় ঘরে ঢুকে দেখি সুমিত্রা বসে। তার পরণে হিন্দু মেয়েদের মত তসরের শাড়ি আর এই প্রথম আজ আমাকে সে হিন্দু মেয়ের মতই হেঁট হয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল। বললে, আমি সমস্ত ছেড়ে চলে এসেচি, সমস্ত অতীত মুছে ফেলে দিয়েছি, আমাকে তোমার কাজে ভর্ত্তি করে নাও, আমার চেয়ে বিশ্বস্ত অনুচর তুমি আর পাবে না।

 ভারতী বিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া প্রশ্ন করিল, তার পরে?

 ডাক্তার কহিলেন, পরের ঘটনা শুধু এইটুকুই বলতে পারি ভারতী, সুমিত্রার বিরুদ্ধে নালিশ করবার আমি আজও কোন হেতু পাইনি। যে একুশ বছরের সমস্ত সংস্কার একদিনে মুছে ফেলে আসতে পারে, তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু বড় নিষ্ঠুর।

 ভারতী চুপ করিয় বসিয়া রহিল, তাহার কেবলই ইচ্ছা করিতে লাগিল জিজ্ঞাসা করে, হোক নিষ্ঠুর, কিন্তু তাঁকে তুমি কতখানি ভালবাসো? কিন্তু লজ্জার এ কথা সে কিছুতেই মুখ দিয়া উচ্চারণ করিতে পারিল না। অথচ ওই আশ্চর্য্য রমণীর গোপন অন্তরের অনেক ইতিহাসেরই আজ সে সন্ধান পাইল। তাহার নির্ম্মম মৌনতা, কঠোর ঔদাসীন্য—কিছুরই অর্থ বুঝিতে যেন আর তাহার বাকী রহিল না।

 হঠাৎ একটা অতর্কিত দীর্ঘশ্বাস ভাক্তারের মুখ দিয়া বাহির হইয়া পড়ায় মুহূর্ত্তকালের জন্য তিনি লজ্জায় ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। কিন্তু ওই মুহূর্ত্তের জন্যই। সুদীর্ঘ সাধনায় দেহ ও মনের প্রতি বিন্দুটির উপরেই অসামান্য অধিকার এতদিন তিনি বৃথাই অর্জ্জন করেন নাই। পরক্ষণেই তাঁহার শান্ত কণ্ঠ ও সহজ হাস্যমুখ ফিরিয়া আসিল, বলিলেন, তারপরে সুমিত্রাকে নিয়ে আমাকে ক্যানটনে চলে আসতে হ’ল।

 ভারতী হাসি গোপন করিয়া ভালমানুষের মত মুখ করিয়া কহিল, চলে না-ই আসতে দাদা, কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়েছিল বল? আমরা ত কেউ দিইনি।

 ডাক্তার হাসিমুখে ক্ষণকাল নীরব হইয়া থাকিয়া বলিলেন, মাথার দিব্যি যে ছিল না তা নয়, কিন্তু ভেবেছিলাম সে-কথা আর কেউ জানবে না, কিন্তু, তোমাদের দোষ এই যে শেষ পর্য্যন্ত না শুনলে আর কৌতূহল মেটে না। আবার না বললে এমন সব কথা অনুমান করতে থাকবে যে তার চেয়ে বরঞ্চ বলাই ভাল।

 ভারতী কহিল, আমিও তাই বলচি দাদা। ঐটুকু তুমি বলে ফেল।

 ডাক্তার কহিলেন, ব্যাপারটা এই যে সুমিত্রা আমার হোটেলেই একটা দোতলার ঘর ভাড়া নিলে। আমি অনেক নিষেধ করলাম, কিন্তু কিছুতেই শুনলে না। যখন বললাম, আমাকে তাহলে অন্যত্র যেতে হবে, তখন তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। বললে, আমাকে আপনি আশ্রয় দিন। পরদিনই ব্যাপারটা বোঝা গেল। সেই দাউদের দল দেখা দিলেন। জন-দশেক লোক, একজন অর্দ্ধেক আরবি, অর্দ্ধেক নিগ্রো ছোটখাটো একটা হাতীর মত, অনায়াসে সুমিত্রাকে স্ত্রী বলে দাবী করে বসলো।

 ভারতী কহিল, আবার তোমারই সাক্ষাতে! তোমাদের দুজনের বোধ করি খুব ঝগড়া বেঁধে গেল?

 ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, হাঁ। সুমিত্রা অস্বীকার করে বারবার বলতে লাগল সমস্তই মিথ্যা, সমস্তই একটা প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্র। অর্থাৎ, তারা তাকে চোরাই আফিঙ বেচার কাজে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। প্রশান্ত মহাসাগরের সমস্ত দ্বীপগুলোতেই এদের ঘাঁটি আছে—এদের একটা প্রকাণ্ড দুর্বৃত্তের দল। এরা না পারে এমন কাজ নেই। বুঝলাম সুমিত্রা কেন আমার কাছ থেকে যেতে চায়নি এবং তার চেয়েও বেশি বুঝলাম যে এ সমস্যার সহজে নীমাংসা হবে না। তাদের কিন্তু বিলম্ব সয় না, সদ্যসদ্যই একটা রফা করে সুমিত্রাকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। বাধা দিলাম, পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেব ভয় দেখলাম, তারা চলে গেল, কিন্তু রীতিমত শাসিয়ে গেল যে তাদের হাত থেকে আজও কেউ নিস্তার পায়নি। কথাটা নেহাৎ তারা মিথ্যে বলে যায়নি।

 ভারতী শঙ্কায় পরিপূর্ণ হইয়া কহিল, তারপর?

 ডাক্তার কহিলেন, রাত্রিটা সাবধান হয়ে রইলাম। তারা যে সদলবলে ফিরে এসে আক্রমণ করবে তা জানতাম।

 ভারতী ব্যগ্র হইয়া কহিল, তখনি তোমরা পালিয়ে গেলে না কেন? পুলিষে খবর দিলে না কেন? ডচ্ গভর্ণমেণ্টের পুলিশ-পাহারা বলে কি কিছু নেই নাকি?

 ডাক্তার কহিলেন, না থাকার মধ্যেই। তা ছাড়া থানা-পুলিশ করা আমার নিজেরও খুব নিরাপদ নয়। যাই হোক, রাত্রিটা কিন্তু নিরাপদেই কাটলো। এখানে সমুদ্রের কিনারা বয়ে যাবার অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যের নৌকা পাওয়া যায়, পরদিন সকালেই একটা ঠিক করে এলাম, কিন্তু সুমিত্রার হল জ্বর—সে উঠতে পারলে না। অনেক রাত্রে দোর খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল, জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, হোটেল ওয়ালা কবাট খুলে দিয়েছে এবং জন দশ-বারো লোক বাড়িতে ঢুকচে। তাদের ইচ্ছে ছিল আমার দরজাটা কোনমতে আটকে রেখে তারা পাশের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে সুমিত্রার ঘরে গিয়ে ঢোকে।

 ভারতী বিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া কহিল, তারপর? তোমরা পালালে কোথা দিয়ে?

 ডাক্তার বলিলেন, তার আর সময় হল কই? কিন্তু তাদের আগেই আমি দোর খুলে উপরে যাওয়ার সিঁড়িটা আটকে ফেললাম।

 ভারতী পাংশুমুখে জিজ্ঞাসা করিল, একলা? তারপরে?

 ডাক্তার বলিলেন, তার পরের ঘটনাটা অন্ধকারে ঘটলো, সঠিক বিবরণ দিতে পারব না। তবে নিজেরটা জানি। একটা গুলি এসে বাঁ কাঁধে বিঁধলো, আর একটা লাগলো ঠিক হাঁটুর নীচে। সকাল হলে পুলিশ এলো, পাহারা এলো, গাড়ি এলো, ডুলি এলো, জন-ছয়েক লোককে তুলে নিয়ে গেল,—হোটেল-ওয়ালা এজাহার দিলে ডাকাত পড়েছিল। ইংরাজ রাজত্ব হলে কতদূর কি হ’ত বলা যায় না, কিন্তু সেলিবিসের আইন-কানুন বোধ হয় আলাদা, লোকগুলোর নিশানদিহি যখন হল না, তখন পুঁতে-টুঁতে ফেললে বোধ হয়।

 বিবরণ শুনিয়া ভয়ে ও বিস্ময়ে ক্ষণকাল ভারতীর বাকরোধ হইয়া রহিল, পরে শুষ্ক বিবর্ণ মুখে অস্ফুটকণ্ঠে কহিল, পুঁতে-টুতে ফেললে কি? তোমার হাতে কি তবে এতগুলো মানুষ মারা গেল নাকি?

 ডাক্তার কহিলেন, আমি উপলক্ষ্য মাত্র। নইলে নিজের হাতেই তারা মারা গেল ধরতে হবে।

 আর ভারতী কথা কহিল না, শুধু একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। ডাক্তার নিজেও কিছুক্ষণ স্থির থাকিয়া বলিলেন, তারপরে কতক নৌকায় কতক ঘোড়ার গাড়িতে কতক স্টিমারে মিনাডো শহরে এসে পৌঁছালাম এবং সেখানে থেকে নাম ধাম ভাঁড়িয়ে একটা চীনা জাহাজে চড়ে কোন মতে দু’জনে ক্যানটনে এসে উপস্থিত হলাম। কিন্তু আর বোধ হয় তোমার শুনতে ইচ্ছে করচে না? ঠিক না ভারতী? কেবলি মনে হচ্চে দাদার হাতেও মানুষের রক্ত মাখানো?

 অন্যমনস্ক ভারতী তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে না দাদা?

 এখনি যাবে?

 হাঁ, আমাকে তুমি দিয়ে এসো!

 তবে চল। এই বলিয়া তিনি মেঝের একখানা তক্তা সরাইয়া কি একটা বস্তু লুকাইয়া পকেটে লইলেন। ভারতী বুঝিল তাহা গাদা পিস্তল। পিস্তল তাহারও আছে এবং সুমিত্রার উপদেশ মত সে-ও ইতিপূর্ব্বে গোপনে সঙ্গে লইয়া পথে বাহির হইয়াছে, কিন্তু ইহা যে মানুষ মারিবার যন্ত্র; এ চৈতন্য আজ যেন তাহার প্রথম হইল। আর ঐ যেটা ডাক্তারের পকেটে রইল, হয়ত কত নরহত্যাই উহা করিয়াছে এই কথা মনে করিয়া তাহার সর্ব্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিল।

 নৌকায় উঠিয়া ভারতী ধীরে ধীরে বলিল, তুমি যাই কেননা কর, তুমি ছাড়া আমার আর পৃথিবীতে দ্বিতীয় আশ্রয় নেই। যতদিন না আমার মন ভাল হয় আমাকে তুমি ফেলে যেতে পারবে না দাদা। বল যাবে না?

 ডাক্তার মৃদু হাসিয়া কহিলেন, আচ্ছা, তাই হবে বোন, তোমার কাছে ছুটি নিয়েই আমি যাবো।