২৪

নদীপথের সমস্তক্ষণ ভারতীর মন কত-কি ভাবনাই যে ভাবিতে লাগিল তাহার নির্দ্দেশ নাই। অধিকাংশই এলো-মেলো—শুধু যে চিন্তাটা মাঝে মাঝে আসিয়া তাহাকে সব চেয়ে বেশি ধাক্কা দিয়া গেল সে সুমিত্রার ইতিবৃত্ত। তাহার প্রথম যৌবনের দুর্ভাগ্যময় অপরূপ কাহিনী। সুমিত্রাকে বন্ধু বলিয়া ভাবিবার দুঃসাহস কোন মেয়ের পক্ষেই সহজ নয়, তাহাকে ভালবাসিতে ভারতী পারে নাই, কিন্তু সর্ব্ব বিষয়ে তাহার অসাধারণ শ্রেষ্ঠতার জন্য হৃয়ের গভীর ভক্তি তাহাকে অর্পণ করিয়াছিল। কিন্তু সেদিন যত অপরাধই অপূর্ব্ব করিয়া থাক্, নারী হইয়া অবলীলাক্রমে তাহাকে হত্যা করার আদেশ দেওয়ায় ভক্তি তাহার অপরিসীম ভয়ে রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছিল,—বলির পশু রক্ত-মাখা খড়্গের সম্মুখে যেমন করিয়া অভিভূত হইয়া পড়ে,—তেমনি। অপূর্ব্বকে ভারতী যে কত ভালবাসিত সুমিত্রার তাহা অপরিজ্ঞাত ছিল না, ভালবাসা যে কি বস্তু সেও তাহার অবিহিত নয়, তথাপি আর একজনের প্রাণাধিকের প্রাণদণ্ডাজ্ঞা দিতে নারী হইয়া নারীর তিলার্দ্ধ বাধে নাই। বেদনার আগুনে বুকের ভিতরটা যখন তাহার এমনি করিয়া হু হু করিয়া জ্বলিতে থাকিত, তখন সে আপনাকে আপনি এই বলিয়া বুঝাইত যে কর্ত্তব্যের প্রতি এতবড় নির্ম্মম নিষ্ঠা না থাকিলে পথেরদাবীর কর্ত্রী করিত তাহাকে কে? যাহাদের নিজের জীবনের মূল্য নাই, রাজদ্বারে রাজার আইনে যে সকল প্রাণ বাজেয়াপ্ত হইয়া গেছে তাহারা নির্ভর করিত তবে কিসে? তাহার জন্ম, তাহার শিক্ষা, তাহার কৈশোর ও যৌবনের বিচিত্র ইতিহাস, তাহার আসক্তির অনতিবর্ত্তনীয় দৃঢ় সংসক্তি তাহার কর্ত্তব্যবোধ, তাহার পাষাণ হৃদয় সকলের সঙ্গেই আজ ভারতী সঙ্গতি দেখিতে লাগিল। নারী বলিয়া তাহার বিরুদ্ধে যে প্রচণ্ড অভিমান ভারতীর ছিল, আজ সে যেন আপনা আপনিই একেবারে বাহুল্য হইয়া গেল। আর তাহাকে সে নিজের স্বজাতি বলিয়া ভাবিতেই পারিল না। আজ তাহার মনে হইল, স্নেহের দিক দিয়া, সুমিত্রার কাছে দাবী করিবার, ভিক্ষা জানাইবার মত পরিহাস পৃথিবীতে যেন আর দ্বিতীয় নাই।

 নৌকা ঘাটে আসিয়া লাগিতেই একজন গাছের আড়াল হইতে বাহির হইয়া আসিল। ডাক্তারের হাত ধরিয়া ভারতী নীচের সিঁড়িতে পা দিতে যাইতেছিল, হঠাৎ লোকটার প্রতি চোখ পড়িতেই সে সভয়ে পা তুলিয়া লইল।

 ডাক্তার মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, ও আমাদের হীরা সিং, তোমাকে পৌঁছে দেবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে? কেরা সিংজী, খবর সব ভালো?  হীরা সিং বলিল, সব আচ্ছা।

 আমিও যেতে পারি নাকি?

 হীরা কহিল, আপকো কঁহি যানা দুনিয়ামে কই রোক সক্‌তা? এই বলিয়া সে একটু হাসিল।

 বুঝা গেল পুলিশের লোক ভারতীর বাসার প্রতি নজর রাখিয়াছে ডাক্তারের যাওয়া নিরাপদ নয়।

 ভারতী হাত ছাড়িল না, চুপি চুপি কহিল, আমি যাবো না দাদা।

 কিন্তু তোমার ত পালিয়ে থাকবার দরকার নেই ভারতী।

 ভারতী তেমনি আস্তে আস্তে বলিল, দরকার থাকলেও আমি পালাতে পারবো না। কিন্তু এর সঙ্গে যাবো না।

 ডাক্তার আপত্তির কারণ বুঝিলেন। অপূর্ব্বর বিচারের দিন এই হীরা সিংই তাহাকে ভুলাইয়া লইয়া গিয়াছিল। একটু চিন্তা করিয়া কহিলেন, কিন্তু তুমি ত জানো ভারতী পাড়াটা কত খারাপ, এত রাত্রে একলা যাওয়া ত তোমার চলে না। আর আমি যে—

 ভারতী ব্যাকুলকণ্ঠে বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, না দাদা, তুমি আমাকে পৌঁছে দেবে, আমি ত এখনও পাগল হইনি যে—

 এই বলিয়া সে অসম্পূর্ণ কথার মাঝখানেই থামিয়া গেল। কিন্তু এত রাত্রে ও পাড়ায় একাকী যাওয়াও যে অসম্ভব, এ সত্যই বা তাহার চেয়ে বেশি কে জানিত? হাত ছাড়িয়া নৌকা হইতে নামিবার কিছুমাত্র লক্ষণ না দেখিয়া ডাক্তার স্নেহার্দ্রস্বরে আস্তে আস্তে বলিলেন, আমার ওখানে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে তোমাকে আমার নিজেরই লজ্জা করে। কিন্তু যাবে দিদি আর এক জায়গায়? আমাদের কবির ওখানে? সে নদীর ঠিক আর পারেই থাকে। যাবে?

 ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, কবি কে দাদা?

 ডাক্তার কহিলেন, আমাদের ওস্তাদজী; বেহালা-বাজিয়ে,—

 ভারত খুশী হইয়া কহিল, তাঁকে কি ঘরে পাওয়া যাবে? আর মদ জুটে থাকে ত অজ্ঞান হয়েই হয়ত আছেন।

 ডাক্তার কহিলেন, আশ্চর্য্য নয়। কিন্তু আমার গলা শুনলেই তার নেশা কেটে যায়। তাছাড়া কাছেই নবতারা থাকেন—হয়ত তোমাকেও দুটো খাইয়ে দিতেও পারব।

 ভারতী ব্যস্ত হইয়া বলিল, রক্ষে কর দাদা, এই শেব রাত্রিতে আর আমাকে খাওয়াবার চেষ্টা করো না, কিন্তু তাই চলো যাই, সকাল হলেই আমরা ফিরে আসবো।

 ডাক্তার পুনরায় নৌকা ভাসাইয়া দিলে হীরা সিং অন্ধকারে পুনরায় যেন মিলাইয়া গেল। ভারতী কৌতূহলী হইয়া প্রশ্ন করিল, দাদা, এই লোকটিকে পুলিশে এখনও সন্দেহ করেনি?

 ডাক্তার কহিলেন, না। ও টেলিগ্রাফ অফিসের পিয়ন, মানুষের জরুরি তার বিলি করে বেড়ায়, তাই ওকে দিনরাত্রি কোন সময়ে কোনখানেই বে-মানান দেখায় না।

 সেইমাত্র জোয়ার শুরু হইয়াছে, বাড়ি হইতে বাহির হইয়া বড় নদীতে কতকটা উজাইয়া না গেলে ও-পারের যথাস্থানে নৌকা ভিড়ানো শক্ত, এইজন্য কিনারা ঘেঁসিয়া ধীরে ধীরে অত্যন্ত সাবধানে লগি ঠেলিয়া যাওয়ার পরিশ্রম অনুভব করিয়া ভারতী হঠাৎ বলিয়া উঠিল, থাকগে, কাজ নেই দাদা আমার ওখানে গিয়ে। তার চেয়ে বরঞ্চ চল, তোমার বাড়িতেই ফিরে যাই। জোয়ারের টানে আধঘণ্টাও লাগবে না।

 ডাক্তার কহিলেন, কেবল সেজন্য নয় ভারতী, ওর সঙ্গে দেখা করাও আমার বিশেষ প্রয়োজন।

 প্রত্যুত্তরে ভারতী উপহাসতরে হাসিয়া বলিল, ওর সঙ্গে কোন মানুষের কোন প্রয়োজন থাকতে পারে এ তো আমার সহজে বিশ্বাস হয় না দাদা?

 ডাক্তার ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া বলিতে লাগিলেন, তোমরা কেউ ওকে জানো না ভারতী, ওর মত সত্যকার গুণী সহসা কোথাও তুমি পাবে না। ওই ভাঙা বেহালাটি মাত্র পুঁজি করে ও যায়নি এমন জায়গা নেই। তাছাড়া ও ভারি পণ্ডিত! কোথায় কোন্‌ বইয়ে কি আছে ও ছাড়া জেনে নেবার আমার আর দ্বিতীয় লোক নেই। ওকে আমি যথার্থ ভালবাসি।

 ভারতী মনে মনে অপ্রতিভ হইয়া কহিল, তাহলে ওঁকে তুমি মদ ছাড়াবার চেষ্টা করো না কেন?

 ডাক্তার কহিলেন, আমি কাউকে কোন কিছু ছাড়াবারই ত চেষ্টা করিনে ভারতী। একটুখানি চুপ করিয়া বলিলেন, তাছাড়া ও কবি, ও গুণী, ওদের জাত আলাদা। ওদের ভাল-মন্দ ঠিক আমাদের সঙ্গে মেলে না। কিন্তু তাই বলে দুনিয়ার ভাল-মন্দের বাঁধা আইনে ওকে মাপ করে চলে না। ওর গুণের ফল তারা সবাই মিলে ভোগ করে, শুধু দোষের শাস্তিটুকু সহ্য করে ও নিজে। তাই মাঝে মাঝে ও বেচারা যখন ভারি দুঃখ পায়, তখন আর একটি লোক যে মনে মনে তার অংশ নেয়, সে আমি।

 ভারতী কহিল, তুমি সকলের জন্যই দুঃখ বোধ কর দাদা, তোমার মন মেয়েদের চেয়েও কোমল। কিন্তু তোমার গুণীকে তুমি বিশ্বাস কর কি করে? উনি মাতাল হয়ে ত সমস্তই বলে ফেলতে পারেন।

 ডাক্তার কহিলেন, ওই জ্ঞানটুকুই ওর বাকী থাকে! আর একটা সুবিধা এই যে, ওর কথাই বিশেষ কেউ বিশ্বাসও করে না।

 ভারতী কহিল, ওর নাম কি দাদা?

 ডাক্তার কহিলেন, অতুল, সুরেন, যখন যা মনে আসে। আসল নাম শশিপদ ভৌমিক।

 আমার মনে হয় উনি নবতারার বড় বাধ্য।

 ডাক্তার মুচকিয়া হাসিলেন, বলিলেন, আমারও মনে হয়। এই বলিয়া তিনি পরপারের জন্য নৌকার মুখ ফিরাইলেন। স্রোত ও দাঁড়ের প্রবল আকর্ষণে ক্ষুদ্র তরণী অত্যন্ত দ্রুতবেগে চলিতে লাগিল এবং দেখিতে দেখিতে এপারে আসিয়া ঠেকিল। চারিদিকেই সাহেব কোম্পানীর বড় বড় কাঠের মাড় স্তূপাকার করা, তাহার ফাঁকে ফাঁকে জোয়ারের জল ঢুকিয়া দুরবর্ত্তী জাহাজের তীব্র আলোকে ঝিক ঝিক করিতেছে, ইহারই একটা ফাঁকের মধ্যে ডিঙি প্রবিষ্ট করাইয়া দিয়া ভাক্তার ভারতীর হাত ধরিয়া নামিয়া পড়িলেন। পিচ্ছিল কাঠের উপর দিয়া সাবধানে পা টিপিয়া কিছুদূর অগ্রসর হইয়া একটা সঙ্কীর্ণ পথ পাওয়া গেল, আশে-পাশে ছোট-বড় ডোবা, লতা-গুল্ম ও কাঁটাগাছে পরিপূর্ণ হইয়া আছে, তাহারই একধার দিয়া এই প‍থ অন্ধকার বনের মধ্যে যে কোথায় গিয়াছে তাহার নির্দ্দেশ নাই। ভারতী সভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, দাদা, ও-পারের এমনি একটা ভয়ঙ্কর স্থান থেকে আর একটা তেমনি ভয়ানক জায়গায় নিয়ে এলে। বাঘ-ভালুকের মত এ-ছাড়া কি তোমরা আর কোথাও থাকতে জানো না? আর কিছু ভয় না কর সাপের ভয়টা ত করতে হয়?

 ডাক্তার হাসিয়া কহিলেন, সাপ বিলাত থেকে আসেনি দিদি—তাদের ধর্ম্মজ্ঞান আছে, বিনা অপরাধে কামড়ায় না।

 মন্তব্য শুনিয়া ভারতীর আর এক দিনের কথা মনে পড়িল। সেদিনও তাঁহার এমনি সহাস্য কণ্ঠস্বরে ইউরোপের বিরুদ্ধে কি অপরিসীম ঘৃণাই প্রকাশ পাইয়াছিল। তিনি পুনশ্চ কহিলেন, তার বাঘ-ভালুক বোন? কতদিনই ভাবি, এই ভারতবর্ষে মানুষ না থেকে যদি কেবল বাঘ-ভালুকই থাকতো! হয়ত বিদেশ থেকে শিকার করতে এরা আসতো, কিন্তু এমন অহর্নিশিরক্তশোষণের জন্য কামড়ে পড়ে থাকত না।

 ভারতী চুপ করিয়া রহিল। সমস্ত জাতি-নির্ব্বিশেষে কাহারও এতখানি বিদ্বেষ তাহাকে অত্যন্ত ব্যথিত করিত। বিশেষ করিয়া এই মানুষটির এতবড় বিশাল বক্ষতল হইতে যখন গরল উছলিয়া উঠিত, তখন দুই চক্ষু তাহার জলে পরিপূর্ণ হইয়া যাইত। নিজের মনে প্রাণপণে বলিতে থাকিত, ইহা কখনও সত্য না, কিছুতে সত্য নয়। এমন হইতেই পারে না।

 কিছুক্ষণ হইতে একটা অপূর্ব্ব সুস্বর মাঝে মাঝে আসিয়া তাহাদের কানে লাগিতে ছিল, সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া ডাক্তার বলিলেন, ওস্তাদজী আমাদের জেগে আছেন এবং সজ্ঞানে আছেন,—এমন বেহালা তুমি কখনো শোননি ভারতী।

 আরও কয়েক পা অগ্রসর হইয়া ভারতী স্তব্ধ হইয়া থামিল। কোথায় কোন অন্ধকারের বুক চিরিয়া কত কান্নাই যেন ভাসিয়া আসিতেছে। তাহার আদি-অন্ত নাই, এ সংসারে তাহার তুলনা হয় না। মিনিট দুয়ের জন্য ভারতীর যেন সংজ্ঞা রহিল না। ডাক্তার তাহার হাতের উপর একটুখানি চাপ দিয়া কহিলেন, চল।

 ভারতী চকিত হইয়া কহিল, চল। আমি কখনো এমন ভাবিনি, কখনো এমন শুনিনি।

 ডাক্তার আস্তে আস্তে বলিলেন, পৃথিবীতে আমার অগম্য ত স্থান নেই, এর চেয়ে ভাল আমিও কখনো শুনেচি মনে হয় না। একটু হাসিয়া বলিলেন, কিন্তু পাগলার হাতে পড়ে ঐ বেহালা বেচারার দুর্দ্দশার অবধি নেই। আমি বোধ হয়, ওকে দশবার উদ্ধার করে দিয়েছি। এখনো শুনচি অপূর্ব্বর কাছে পাঁচ টাকায় বাঁধা আছে।

 ভারতী কহিল, আছে। ওঁর নাম করে টাকাটা আমি তাঁকে পাঠিয়ে দেব।

 গাছ-পালার আড়ালে একখানা দোতলা কাঠের বাড়ি। একতলাটা পাঁক, জোয়ারের জল এবং দেনো গাছে দখল করিয়াছে, সুমুখে একটা কাঠের সিঁড়ি এবং তারই সর্ব্বোচ্চ ধাপে একটা তোরণের মত করিয়া তাহাতে মস্ত বড় একটা রঙীন চীনা লণ্ঠন ঝুলিতেছে। ভিতরের আলোকে স্পষ্ট পড়া গেল তাহার গায়ে বড় বড় কালো অক্ষরে ইংরাজীতে লেখা, —শশি তারা লজ।

 ভারতী বলিল, বাড়ির নাম রাখা হয়েচে শশি-তারা লজ? লজ তো বুঝলাম, শশি-তারা কি?

 ডাক্তার মুখ টিপিয়া হাসিয়া কহিলেন, বোধ হয় শশিপদর শশী এবং নবতারার তারা এক ক’রে শশি তারা লজ হয়েচে।

 ভারতীর মুখ গম্ভীর হইল, কহিল, এ ভারি অন্যায়। এ সব তুমি প্রশ্রয় দাও কি করে?

 ডাক্তার হাসিয়া ফেলিলেন, কহিলেন, তোমার দাদাটিকে তুমি কি সর্ব্বশক্তিমান মনে কর? কে কার লজের নাম শশি-তারা রাখবে, কে কার প্যালেসের নাম অপূর্ব্ব-ভারতী রাখবে, সে আমি ঠেকাব কি করে?

 ভারতী রাগ করিয়া বলিল, না দাদা, এসব নোংরা কাজ তুমি বারণ করে দাও; নইলে আমি ওঁর ঘরে যাবো না।

 ডাক্তার কহিলেন, শুনচি ওদের শীঘ্র বিয়ে হবে।

 ভারতী ব্যাকুল হইয়া বলিল, বিয়ে হবে কি করে, এর যে স্বামী বেঁচে আছে?

 ডাক্তার কহিলেন, ভাগ্য হলে মরতে কতক্ষণ দিদি? শুনেচি ব্যাটা মরেচে দিন পনর হ’ল।

 ভারতী অতিশয় বিরক্তি সত্ত্বেও হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, ও হয়ত মিছে কথা। তাছাড়া, এক বছর অন্ততঃ ওদের ত থামতেই হবে, নইলে সে যে ভারি বিশ্রী দেখাবে।

 তাহার উৎকণ্ঠা দেখিয়া ডাক্তার মুখ গম্ভীর করিয়া বলিলেন, বেশ, বলে দেখবো। তবে, থামলে বিশ্রী দেখাবে সেইটেই চিন্তার কথা।

 এই ইঙ্গিতের পরে ভারতী লজ্জায় নীরব হইয়া রহিল। সিঁড়িতে উঠিতে উঠিতে ডাক্তার চাপা গলায় বলিতে লাগিলেন, পাগলাটার জন্যেই কষ্ট হয়, শুনেচি ঐস্ত্রীলোকটাকে নাকি ও যথার্থই ভালবাসে। আর কাউকে যদি ভালবাসত। সহসা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, কিন্তু সংসারের ভাল-মন্দের ফরমাস, বন্ধুগণের অভিরুচি,—এসব অতি তুচ্ছ কথা ভারতী! কেবল এইটুকু কামনা করি ওর ভালবাসার মধ্যে যদি সত্য থাকে ত সেই সত্যই যেন ওকে উদ্ধার করে দেয়।

 ভারতী চমকিয়া উঠিল। এবং তেমনি চাপাকণ্ঠেই সহসা প্রশ্ন করিয়া ফেলিল, সংসারে তা কি হয় দাদা?

 ডাক্তার অন্ধকারেই একবার মুখ ফিরিয়া চাহিলেন। তাহার পরে নিঃশব্দ পদে উঠিয়া গুণীর বদ্ধ দরজার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন।

 ডাক শুনিয়া বেহালা থামিল। খানিক পরে ভিতর হইতে দ্বার খুলিয়া শশিপদ বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল! ডাক্তারকে সে সহজেই চিনিল, কিন্তু আঁধারে ঠাওর করিয়া ভারতীকে চিনিতে পারিয়া একেবারে লাফাইয়া উঠিল,—অ্যাঁ? আপনি! ভারতী? আসুন, আসুন, আমার ঘরে আসুন। এই বলিয়া সে দুই হাত ধরিয়া তাহাকে ভিতরে লইয়া গেল। তাহার আনন্দদীপ্ত মুখের অকপট আহ্বানে, তাহার অকৃত্রিম উচ্ছ্বসিত সমাদরে ভারতীর সমস্ত ক্রোধ জল হইয়া গেল। শশী বিছানার কোন এক নিভৃত স্থান হইতে একটা খাম বাহির করিয়া ভারতীর হাতে দিয়া কহিল, খুলে পড়ুন। পরশু দশ হাজার টাকার ড্রাফট আসচে—নট্ এ পাই লেস্! বলতাম না? আমি জোচ্চর! আমি মিথ্যাবাদী। আমি মাতাল। কেমন, হল ত? দশ হাজার। নট্ এ পাই লেস্!

 এই দশ হাজার টাকায় ড্রাফট সম্বন্ধে একটা পুরাতন ইতিহাস আছে, তাহা এইখানে বলা প্রয়োজন। তাহার বন্ধু বান্ধব, শত্রু-মিত্র, পরিচিত অপরিচিত এমন কেহ ছিল না যে অচির ভবিষ্যতে একটা মোটা টাকা প্রাপ্তির সম্ভাবনা শশীর মুখ হইতে শুনে নাই। কেহ বড় বিশ্বাস করিত না, বরঞ্চ ঠাট্টা-তামাসাই করিত, কিন্তু ইহাই ছিল ওস্তাদজীর মূলধন। ইহারই উল্লেখ করিয়া সে একান্ত অসঙ্কোচে লোকের কাছে ধার চাহিত। এবং শীঘ্রই একদিন সুদে-আসলে পরিশোধ করিয়া দিবে তাহা শপথ করিয়া বলিত। এই অত্যন্ত অনিশ্চিত অর্থাগমের উপর তাহার কত আশা-ভরসাই না জড়াইয়া ছিল। বছর পাঁচ-সাত পূর্ব্বে তাহার বিত্তশালী মাতামহ যখন মারা যান তখন সে মাসতুতো ভায়েদের সঙ্গে সম্পত্তির একটা অংশ পাইয়াছিল। এতদিন এইটাই তাহাদের কাছে বিক্রি করিবার কথাবার্ত্তা চলিতেছিল, মাসখানেক পূর্ব্বে তাহা শেষ হইয়াছে। খামের মধ্যে কলিকাতার এক বড় এটর্ণির চিঠি ছিল, টাকাটা দুই-একদিনের মধ্যে পাওয়া যাইবে তিনি লিখিয়া জানাইয়াছেন।

 ভারতী চিঠি পড়িয়া শেষ করিলে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিলেন, বিশ হাজার টাকার কথা ছিল না শশী?

 শশী হাত নাড়িয়া বলিল, আহা, দশ হাজার টাকাই কি সোজা নাকি? তাছাড়া নিজের মাসতুতো ভাই,—সম্পত্তি ত একরকম আপনার ঘরেই রইল ডাক্তারবাবু, আর ঠিক সেই কথাই ত মেজদা লিখে জানিয়েছেন। কি রকম লিখেছেন একবার—এই বলিয়া মেজদার চিঠির জন্যে উঠিবার উপক্রম করিতে ডাক্তার বাধা দিয়া বলিল, থাক্ থাক্, মেজদার চিঠির জন্য আমাদের কৌতূহল নেই। ভারতীকে বলিলেন, এই রকম একটা ক্ষেপা মাসতুতো ভাই আমাদের থাকলে—এই বলিয়া তিনি হাসিতে লাগিলেন।

 শশী খুশী হইল না, সে প্রাণপণে প্রমাণ করিতে লাগিল যে, সম্পত্তিটা একপ্রকার বিক্রি না করয়াই এতগুলো টাকা পাওয়া গেল, এবং সে কেবল তার মেজদার মত আদর্শ পুরুষ সংসারে ছিল বলিয়া।

 ভারতী মুচকিয়া হাসিয়া কহিল, সে ঠিক কথা অতুলবাবু, মেজদাকে না দেখেই তাঁর চরিত্র আমার হৃদয়ঙ্গম হয়েচে। ও আর সম্প্রমাণ করবার প্রয়োজন নেই।

 শশী তৎক্ষণাৎ কহিল, কাল কিন্তু আমাকে আর দশটা টাকা দিতে হবে। তাহলে সেদিনের দশ, কালকের দশ আর অপুর্ব্বরাবুর দরুন সাড়ে আট টাকা—পুরোপুরি ত্রিশ টাকাই পরশু-তরশু দিয়ে দেব। নিতে হবে, না বলতে পারবেন না কিন্তু।

 ভারতী হাসিতে লাগিল। শশী কহিতে লাগিল, ড্রাফটটা এলেই ব্যাঙ্কে জমা করে দেব। মাতাল, জোচ্চোর, স্পেণ্ডথ্রিফ্‌ট্ যা মুখে এসেচে লোকে বলেচে, কিন্তু এবার দেখবো। আসলে হাত পড়বে না, কেবল সুদের টাকাতে সংসার চালিয়ে দেবো, বরঞ্চ বাঁচবে দেখবেন, পোস্ট অফিসেও একটা একাউণ্ট খুলতে হবে,—ধরে কিন্তু রাখা চলবে না। চাই কি বছর পাঁচেকের মধ্যে একটা বাড়ি কিনতেও পারবো। আর কিনতেই ত হবে,— সংসার ঘাড়ে পড়ল কিনা। সহজ নয়ত আজকালকার বাজারে।

 ভারতীর মুখের দিকে চাহিয়া ডাক্তার হাঃ হাঃ করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, কিন্তু সে মুখ গম্ভীর করিয়া আর একদিকে চাহিয়া রহিল।

 শশী কহিল, মদ ছেড়ে দিয়েচি শুনেচেন বোধ হয়?

 ডাক্তার কহিলেন, না।

 শশী কহিল, হাঁ একেবারে। নবতারা প্রতিজ্ঞে করিয়ে নিয়েছেন।

 এই লইয়া উহাদের আলোচনা দীর্ঘ হইতে পারিত, কিন্তু একজনের সকৌতুক প্রশ্নমালায় ও অপরের উৎসাহদীপ্ত উত্তর দানের ঘটায় ভারতী বিপন্ন হইয়া উঠিল। সে কোনটাতেই যোগ দিতে পারিতেছে না দেখিয়া ডাক্তার অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়া আসল কথা পাড়িলেন। কহিলেন, শশী, তুমি ত তাহলে এখান থেকে আর শীঘ্র নড়তে পারচ না।

 শশী বলিল, নড়া? অসম্ভব।

 ডাক্তার কহিলেন, বেশ, আমাদের তাহলে এখানে একটা স্থায়ী আড্ডা রইল।

 শশী তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, সে কি করে হতে পারে? আপনার সঙ্গে ত আর আমি সম্বন্ধ রাখতে পারব না। লাইফ আমার রিস্ক করা যায় না।

 ডাক্তার ভারতীকে লক্ষ্য করিয়া হাসিমুখে বলিলেন, আমাদের ওস্তাদের আর যা দোষই থাক্, চক্ষুলজ্জা আছে এ অপবাদ অতি বড় শত্রুতেও দেবে না। পার যদি এই বিদ্যেটা ওর কাছে শিখে নাও ভারতী।

 প্রত্যুত্তরে শশীর পক্ষ লইয়া ভারতী অত্যন্ত ভালমানুষের মত বলিল, কিন্তু মিথ্যে আশা দেওয়ার চাইতে স্পষ্ট বলাই ত ভাল। আমি পারিনে, কিন্তু অতুলবাবুর কাছে এ বিদ্যে শিখে নিতে পারলে আজ ত আমার ছুটি হয়ে যেতো দাদা।

 তাহার কণ্ঠস্বরের শেষ দিকটা হঠাৎ যেন কেমন ভারি হইয়া গেল। শশী মনোনিবেশ করিল না, করিলেও হয়ত তাৎপর্য্য বোধ করিত না, কিন্তু ইহার নিহিত অর্থ যাঁহার বুঝিবার তাঁহার বিলম্ব হইল না।

 মিনিট-দুই সকলে মৌন হইয়া রহিলেন। প্রথম কথা কহিলেন ডাক্তার, বলিলেন, শশী, দিন-দুয়ের মধ্যে আমি যাচ্ছি হাঁটা-পথে চীনের মধ্য দিয়ে প্যাসিফিকের সব আইল্যাণ্ডগুলোই আর একবার ঘুরব। বোধ হয় জাপান আমেরিকাতেও যাবো। কবে ফিরবো জানিনে, ফিরবই কিনা তাই বা কে জানে, কিন্তু হঠাৎ যদি কখনো ফিরি শশী, তোমার বাড়িতে বোধহয় আমার স্থান হবে না?

 শশী ক্ষণকাল তাঁহার মুখের প্রতি নির্নিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিল, তাহার পরে তাহার নিজের মুখ ও কণ্ঠশব্দ আশ্চর্য্যরূপে পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল। ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হবে। আমার বাড়িতে আপনার স্থান চিরকাল হবে।

 ডাক্তার কৌতুকভরে কহিলেন, সে কি কথা শশী, আমাকে স্থান দেওয়ার চেয়ে বড় বিপদ মানুষের আর আছে কি?

 শশী মূহূর্ত্ত চিন্তা না করিয়া বলিল, সে জানি, আমার জেল হবে। তা হোকগে! এই বলিয়া সে চুপ করিয়া রহিল। খানিক পরে ভারতীকে উদ্দেশ করিয়া ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, এমন বন্ধু আর নেই। ১৯১১ সালে জাপানের টোকিও সহরে বোমা ফেলার জন্যে যখন কোটোকুর সমস্ত দলবলের প্রাণদণ্ড হল, ডাক্তার তখন তার খবরের কাগজের ইংলিশ সাব-এডিটর। বাসার সুমুখের দিকটা পুলিশে ঘিরেচে, আমি কাঁদতে লাগলাম, উনি বললেন, মরলে চলবে না শশী, আমাদের পালাতে হবে। পিছনের জানালা থেকে দড়ি বেঁধে আমাকে নামিয়ে দিয়ে নিজেও নেমে পড়লেন,—ডাক্তারবাবু, উঃ—মনে আছে আপনার? এই বলিয়া সে বিগত স্মৃতির তাড়নায় কণ্টকিত হইয়া উঠিল।

 ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, আছে বৈকি।

 শশী কহিল, থাকার ত কথা। কিন্তু আ-কিম সাহায্য না করলে সেবার ভবলীলা আমাদের সাঙ্গ হত ডাক্তারবাবু। সাংহাই বোটে আর পা দিতে হত না। উঃ—ঐ বেঁটে ব্যাটাদের মত বজ্জাত আর ভূ-ভারতে নেই? আমি ত আর সত্যিই আপনাদের বোমার দলে ছিলাম না—বাসায় থাকতাম, বেহালা শিখতাম। কিন্তু সে কি কথা শুনতো? শয়তান ব্যাটাদের না আছে আইন, না আছে আদালত। ধরতে পারলেই আমাকে ঠিক জবাই করে ছাড়ত। আজ যে এই কথা কইচি, চলেফিরে বেড়াচ্চি সে কেবল ওঁরই কৃপায়। এই বলিয়া সে চোখের ইঙ্গিতে তাহাকে দেখাইয়া দিল। কহিল, এমন বন্ধু দুনিয়ার নেই ভারতী, এমন দয়া-মায়াও সংসারে দেখিনি।

 ভারতীর চক্ষু সজল হইয়া উঠিল, কহিল, তোমার সমস্ত কাহিনী একদিন আমাদের গল্প করে শোনাও না দাদা। ভগবান তোমাকে এত বুদ্ধি দিয়েছিলেন, শুধু কি এই অমূল্য প্রাণটার দাম বোঝবার বৃদ্ধিটুকুই দিতে ভুলেছিলেন! সেই জাপানীদের দেশেই তুমি আবার যেতে চাও?

 শশী কহিল, আমিও ঠিক সেই কথাই বলি ভারতী। বলি, অতবড় স্বার্থপর, লোভী, নীচাশয় জাতির কাছে কোন প্রত্যাশাই করবেন না। তারা কোন দিন আপনাকে কোন সাহায্যই করবে না।

 ডাক্তার হাসিয়া কহিলেন, কোমরে সেই দড়ি বাঁধার ঘটনাও শশী ভুললে না, জাপানীদের সে এ জীবনে মাপ করতেও পারলে না। কিন্তু এই তাদের সমস্তটুকু নয় ভারতী, এতবড় আশ্চর্য্য জাতও পৃথিবীতে আর নেই। শুধু আজকের কথা নয়, প্রথম দৃষ্টিতেই তারা সাদা চামড়াকে চিনেছিল। অড়াইশ বৎসর আগে যে জাত আইন করতে পেরেছিল, চন্দ্র সূর্য্য যতদিন বিদ্যমান থাকবে খ্রীষ্টান যেন না তাদের রাজ্যে ঢোকে এবং সে যেন তার চরম শাস্তি ভোগ করে, সে-জাত যাই কেননা করে থাক তারা আমার নমস্য!

 বক্তার দুইচক্ষু এক নিমিষেই প্রদীপ্ত অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল। সেই বজ্রগর্ভ ভয়ঙ্কর দৃষ্টির সম্মুখে শশী যেন উদ্‌ভ্রান্ত হইয়া গেল, সে সভয়ে বারবার মাথা নাড়িয়া বলিতে লাগিল, সে ঠিক! সে ঠিক!

 ভারতীয় মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না, তাহার বুকের মধ্যেটা যেন অভূতপূর্ব্ব অব্যক্ত আবেগে ধথর থর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। তাহার মনে হইল আজ এই গভীর নিশীথে, আসন্ন বিদায়ের প্রাক্কালে এক মুহূর্ত্তের জন্য এই লোকটির সে স্বরূপ দেখিতে পাইল।

 ডাক্তার নিজের বক্ষদেশে আঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া কহিলেন, কি বলছিলে ভারতী, এর মূল্য বোঝাবার মত বুদ্ধি ভগবান আমাকে দেননি। মিছে কথা! শুনবে আমার সমস্ত ইতিহাস? ক্যানটনের একটা গুপ্তসভার মধ্যে সুনিয়াৎ সেন আমাকে একবার বলেছিলেন—

 ভারতী হঠাৎ ভয় পাইয়া বলিয়া উঠিল, কারা যেন সিঁড়ি দিয়ে উঠচে—

 ডাক্তার কান খাড়া করিয়া শুনিলেন, পকেট হইতে ধীরে-সুস্থে পিস্তল বাহির করিয়া কহিলেন, এই অন্ধকারে আমাকে বাঁধতে পারে পৃথিবীতে কেউ নেই। এই বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন, কিন্তু তাঁহার মুখে উদ্বেগের ছায়া পড়িল।

 কেবল বিচলিত হইল না শশী। সে মুখ তুলিয়া কহিল, আজ নবতারাদের একবার আসার কথা ছিল, বোধ হয়—

 ডাক্তার হাসিয়া ফেলিয়া কহিলেন, বোধ হয় নয়, তিনিই। অত্যন্ত লঘু পদ! কিন্তু সঙ্গে তাঁর ‘দের’টা আবার কারা?

 শশী বলিল, আপনি জানেন না? আমাদের প্রেসিডেণ্ট এসেচেন যে। বোধহয়—

 ভারতী অতিমাত্রায় বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে প্রেসিডেণ্ট? সুমিত্রাদিদি?

 শশী মাথা নাড়িয়া কহিল, হাঁ। এই বলিয়া সে দ্রুতপদে দ্বার খুলিতে অগ্রসর হইল। ভারতী ডাক্তারের মুখের প্রতি চাহিয়া দেখিল। তাহার মনে হইল, এতক্ষণে যেন সে তাহার এখানে আসিবার হেতু বুঝিয়াছে। আজ রাত্রিটা বৃথায় যাইবে না, প্রত্যাসন্ন বিক্ষেপের মুখে পথের দাবীর শেষের মীমাংসা আজ অনিবার্য্য। হয়ত আইয়ার আছে, তলওয়ারকর আছে, কি জানি হয়ত নিরাপদ বুঝিয়া ব্রজেন্দ্রও সহর ছাড়িয়া আসিয়া এই বনেই আশ্রয় লইয়াছে! ডাক্তার তাহার অভ্যাস ও প্রথামত পিস্তল গোপন করিলেন না, সেটা বাঁ হাতে তেমনি ধরাই রহিল। তাঁহার শান্ত মুখের উপর ভিতরের কোন কথাই পড়া গেল না সত্য, কিন্তু ভারতীর মুখ অধিকতর পাণ্ডুর হইয়া উঠিল।