পথের পাঁচালী/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ


পথের পাঁচালী
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

বৈশাখমাসের দিন। প্রায় দুপুর বেলা।

 সর্ব্বজয়া বাট্‌না বাটিতে বাটিতে দান হাতের কাছে রক্ষিত একটা ফুলের সাজিতে (অনেকদিন হইতে ফুলের সহিত ইহার কোনো সম্পর্ক নয়, মশলা রাখিবার পাত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়) মশলা খুঁজিতে গিয়া বলিল—আবার জিরে-মরিচের পুঁটুলিটা কোথায় নিয়ে পালালি? বড্ড জ্বালাতন কচ্ছিস্ অপু—রাঁধতে দিবিনে? তারপর একটু পরেই বোলো এখন—মা ক্ষিদে পেয়েছে!

 অপুর দেখা নাই।

 —দিয়ে যা বাপ আমার, লক্ষ্মী আমার—কেন জ্বালাতন কচ্ছিস্ বল্ দিকি? দেখচিস বেলা হ'য়ে যাচ্চে?

 অপু রান্নাঘরের ভিতর হইতে দুয়ারের পাশ দিয়া ঈষৎ উঁকি মারিল, মায়ের চোখ সেদিকে পড়িতেই তাহার দুষ্টুমির হাসি-ভরা টুকটুকে মূখখানা শামুকের খোলার মধ্যে ঢুকিয়া পড়িবার মত তৎক্ষণাৎ আবার দুয়ারের আড়ালে অদৃশ্য হইয়া পড়িল। সর্ব্বজয়া বলিল—দ্যাখ দিকি কাণ্ড—কেন বাপু দিক করিস্ দুপুর বেল? দিয়ে যা—

 অপু পুনরায় হাসিমুখে ঈষৎ উঁকি মারিল।

 —ঐ আমি দেখতে পেয়েচি—আর লুকুতে হবে না, দিয়ে যা—

 সর্ব্বজয়া ছেলেকে ভালভাবেই চিনিত। যখন অপু ছোট্ট-খোকা দেড়-বছরেরটি, তখন দেখিতে সে এখনকার চেয়েও টুকটুকে ফর্সা ছিল। সর্ব্বজয়ার মনে আছে, সে তাহার ডাগর চোখ-দূুটিতে বেশ করিয়া কাজল পরাইয়া কপালের মাঝখানে একটি টিপ পরাইয়া দিত ও তাহার মাথায় একটা নীল রংএর কম দামের ঘণ্টিওয়ালা পশমের টুপি পরাইয়া, কোলে করিয়া সন্ধ্যার পূর্ব্বে বাহিরের রকে দাঁড়াইয়া ঘুম পাড়াইবার উদ্দেশ্যে সুর টানিয়া টানিয়া বলিত—

আয়রে পাখী ই—ই লেজঝোলা,
আমার খোকনকে নিয়ে—এ—এ—গাছে তোলা···

 খোকা ট্যাঁপ-ট্যাঁপা ফুলো-ফুলো গালে মায়ের মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকিত, হঠাৎ কি মনে করিয়া সম্পূর্ণ দন্তহীন-মাড়ি বাহির করিয়া আহ্লাদে আটখানা হইয়া মল-পরা অসম্ভবরূপ ছোট্ট পায়ে মাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া মায়ের পিঠের দিকে মুখ লুকাইত। সর্ব্বজয়া হাসিমুখে বলিত—ওমা, খোকা আবার কথায় লুূকুলো? তাইতো, দেখতরে তো পাচ্ছিনে! ও খোকা!···পরে সে ঘাড়ের দিকে মুকখ ফিরাইতেই শিশু আবার হাসিয়া মুখ সামনের দিকে ফিরাইত এবং নির্ব্বোধের মত হাসিয়া মায়ের কাঁধে মুখ লুকাইত। যতই সর্ব্বজয়া বলিত—ওমা, কৈ আমার খোকা কৈ—আবার কোথায় গেলো—কৈ দেখি,—ততই শিশুর খেলা চলিত। বারবার সামনে পিছনে ফিরিয়া সর্ব্বজয়ার ঘাড়ে ব্যথা হইলেও শিশুর খেলা হইত না। সে তখন একেবারে আন্‌কোরা টাট্‌কা, নতুন সংসারে আসিয়াছে। জগতের অফুরন্তু আনন্দভাণ্ডারের এক অণুর সন্ধান পাইয়া তাহার অবোধ মন তখন সেইটাকে লইয়াই লোভীর মত বারবার আস্বাদ করিয়া সাধ মিটাইতে পারিতেছে না—তখন তাহাকে থামায় এমন সাধ্য তাছার মায়ের কোথায়? খানিকক্ষণ এরূপ করিতে করিতে তাহার ক্ষুদ্র শরীরে শক্তির ভাণ্ডার ফুরাইয়া আসিত, সে হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হইয়া হাই তুলিতে থাকিত—সর্ব্বজয়া ছোট্ট হাঁ-টির সামনে তুড়ি দিয়া বলিত—ঘাট ঘাট—এই দ্যাখো দেয়ালা ক'রে ক'রে এইবার বাছার আমার ঘুম আস্‌চে। পরে সে মুগ্ধ-নয়নে শিশু-পুত্রের টিপ-কাজল-পরা কচি-মুখের দিকে চাহিয়া বলিত—কত রঙ্গই জানে সন্‌কু আমার—তবুও তো এই ধেটের দেড়বছরের! হঠাৎ সে আকুল চুম্বনে খোকার রাঙা-গাল দু'টি ভাইয়া ফেলিত। কিন্তু মায়ের এই গার আদরের প্রতি সম্পূর্ণ ঔদাসীন্য প্রদর্শন করিয়াই শিশুর নিদ্রাতুুর আঁখিপাতা ঢুলিয়া আসিত; সর্ব্বজয়া খোকার মাথাটা আস্তে আস্তে নিজের কাধে রাখিয়া বলিত—ওমা, সন্দেবেলা দ্যাখো ঘুমিয়ে পড়লো! এই ভাবচি সন্দেটা উৎরুলে দুধ খাইয়ে তবে ঘুম পাড়বে—দ্যাখো কাণ্ড!···

 সর্ব্বজয়া জানিত—ছেলে আটবছরের চুইলে কি হইবে, সেই ছেলেবেলাকার মত মায়ের সহিত লুকোচুরি খেলিবার সাধ এখনও মিটে নাই।

 এমন সব স্থানে সে লুকায় যেখান হইতে অন্ধও তাহাকে বাহির করিতে পারে; কিন্তু সর্ব্বজয়া দেখিয়াও দেখে না—এক জায়গায় বসিয়াই এদিকে ওদিকে চায়, বলে—তাই তো! কোথায় গেল? দেখতে তো পাচ্ছিনে! অপু ভাবে—মাকে কেমন ঠকাইতে পারা যায়! মায়ের সহিত এ খেলা করিয়া মজা আছে। সর্ব্বজয়া জানে যে, খেলায় যোগ দিবার ভান করিলে এইরূপ সারাদিন চলিতে পারে, কাজেই সে ধমক দিয়া কহিল—তা হোলে কিন্তু থাকলো প'ড়ে রানন্নাবান্না। অপু, তুমি ঐ রকম করো, খেতে চাইলে তখন মজাটা—

 অপু হাসিতে হাসিতে গুপ্তস্থান হইতে বাহির হইয়া মশলার পুঁটুলি মায়ের সামনে রাখিয়া দিল।

 তাহার মা বলিল, যা একটু খেল৷ কর্‌গে ম৷ বাইরে। দেখ গে যা দিকি তোর দিদি কোথায় আছে। গাবতলায় দাঁড়িয়ে একটু হাঁক দিয়ে ডাক দিকি। আর আজ নাইবার দিন—হতচ্ছাড়া মেয়ের নাগাল পাওয়ার জো আছে? যা তো, লক্ষ্মী ছেলে—

 কিন্তু এখানে মাতৃ-আদেশ পালন করিয়া সুপুত্র হইবার কোনো চেষ্টা তাঙ্গার দেখা গেল না। সে বাটনা-বাটা-রত মায়ের পিছনে গিয়া কি করিতে লাগিল।

 হু-উ উ-উ-উম—

 সর্ব্বজয়া পিছন ফিরিয়া দেখিল অপু বড়ি দেওয়ার জন্ত চালের বাতায় রক্ষিত একটা পুরানো চট্‌ আনিয়া মুড়ি দিয়া মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়া বসিয়া আছে।

 —দ্যাখো দ্যাখো, ছেলের কাণ্ড দ্যাখো একবার। ও লক্ষ্মীছাড়া, ওতে যে সাত-রাজ্যির ধুলো। ফ্যাল্ ফ্যাল্—সাপ মাকড় আছে না কি আছে ওর মধ্যে—আজ কদিন থেকে তোলা রয়েছে।

 হু-উ-উ-উ উম্—(পূর্ব্বাপেক্ষা গভীর সুরে)

 —নাঃ, বল্লে যদি কথা শোনে—বাবা আমার, সোনা আমার, ওখানা ফ্যাল্—আমার বাট্‌নার হাত—দুষ্টুমি কোরো না, ছিঃ!

 থলে মোড়া মূর্ত্তিটা হামাগুড়ি দিয়া এবার দুই কদম আগাইয়া আসিল। সর্ব্বজয়া বলিল, ছুঁবি ছুঁবি—ছুঁওনা মাণিক আমার—ওঃ, ভয়ে একেবারে কাঠ হ'য়ে গিইচি—ভারি ভয় হয়েছে আমার!

 অপু হি-হি করিয়া হাসিয়া থলেখানা খুলিয়া এক পাশে রাখিয়া উঠিয় দাঁড়াইল। তাহার মাথার চুল, মূখ, চোখের ভুরু, কান ধূলায় ভরিয়া গিয়াছে। মূখ কাঁচু-মাচু করিয়া সে সামনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাত কিচ কিচ করিতেছে।

 —ওমা আমার কি হবে! হ্যারে হতভাগ, ধূলো মেখে যে একেবারে ভূত সেজেচিস্? উঃ—ওই পুরোনো থলেটার ধূলো! একেবারে পাগল!

 ধূলিধূসরিত অবোধ পুত্রের প্রতি করুণা ও মমতায় সর্ব্বজয়ার বুক ভরিয়া আসিল; কিন্তু অপুর পরণে বাসি কাপড়—নাহিয়া-ধুইয়া ছোয়া চলে না বলিয়া বলিল,—ঐ গামছাখানা নে, ঐ দিয়ে ধূলোগুলো আগে ঝেড়ে ফ্যাল্। ছেলে যেন কি একটা!

 থানিকটা পরে ছেলেকে রান্নাঘরে পাহারার জন্য বসাইয়া সে জল আনিতে বাহির হইয়া যাইতেছে, দেখে দরজা দিয়া দুর্গা বাড়ী ঢুকিতেছে। মুখ রৌদ্রে রাঙা,মাথার চুল উস্‌কো-খুস্‌কো, অথচ ধূলোমাখা পায়ে আল্‌তা পরা। একেবারে মায়ের সামনে পড়াতে আঁচলে-বাঁধা আম দেখাইয়া ঢোঁক গিলিয়া কহিল—এই পুণ্যিপুকুরের জন্যে ছোলার গাছ আন্‌তে গেলাম রাজীদের বাড়ী, আম পেড়ে এনেচে, ভাগ হচ্চে, তাই রাজীর পিসিমা দিলে।

 —আহ, মেয়ের দশা দ্যাখো, গায়ে খড়ি উড়চে, মাথার চুল দেখলে গায়ে জ্বর আসে,—পুণিাপুকুরের জন্যে ভেবে তো তোমার রাত্তিরে ঘুম নেই!—পরে মেয়ের পায়ের দিকে চাহিয়া কহিল—ফের বুঝি লক্ষ্মীর চুব্‌ড়ি থেকে আল্‌তা বের ক'রে পরা হয়েচে?

 দুর্গা আঁচল দিয়া মুখ মুছিয়া উস্‌কোখুস্‌কো কপাল হইতে সরাইয়া বলিল—লক্ষ্মীর চুবড়ির আল্‌তা বৈকি ? আমি সেদিন হাটে বাবাকে দিয়ে আল্‌তা আনালাম এক পয়সার, তার দরুণ দু’পাতা আলতা আমার পুতুলের বাক্সে ছিল না বুঝি?—

 হরিহর কল্‌কে হাতে রান্নাঘরের দাওয়ায় আগুন লইতে আসিল।

 সর্ব্বজয়া বলিল—ঘণ্টায় ঘণ্টায় তোমাকে আগুন দি কোথা থেকে? সুঁদ্‌রী-কাঠের বন্দোবস্ত ক'রে রেখেচো কিনা একেবারে! বাঁশের চেলার আগুন কতক্ষণ থাকে যে আবার ঘড়ি-ঘড়ি তামাক খাওয়ার আগুন যোগাবো? পরে আগুন তুলিবার জন্য রক্ষিত একটা ভাঙা পিতলের হাতাতে খানিকটা আগুন উঠাইয়া বিরক্তমুখে সামনে ধরিল। পরে স্বর নরম করিয়া বলিল—কি হোল?

 —এক রকম ছিল তো সবই ঠিক, বাড়ীসুদ্ধ সবাই মন্তর নেবার কথাই হয়েছিল; কিন্তু একটু মুস্কিল হ'য়ে যাচ্ছে। মহেশ বিশ্বেসের শ্বশুরবাড়ীর বিষয়-আশয় নিয়ে কি গোলমাল বেধেছে, বিশ্বেস মশায় গিয়েচে সসেখানে চলে—সেই আসল মালিক কিনা। তাই আবার একটু পিছিয়ে গেল; আবার এদিকেও তো অকাল পড়চে আষাঢ় মাস থেকে।

 —আর সেই যে বাসের জায়গা দেবে—বাস করাবে বলেছিল, তার কি হোল?

 —এই নিয়ে একটু মুস্কিল বেধে গেল কিনা? ধরো যদি মন্তর নেওয়া পিছিয়ে যায়, তবে ও কথা আর কি ক'রে ওঠাই?

 সর্ব্বজয়া খুব আশায় আশায় ছিল, সংবাদ শুনিয়া আশাভঙ্গ হইয়া পড়িল। বলিল, তা অওখানে না হয়, অন্য কোনো জায়গায় দেখো না? বিদেশে মান আছে, এখানে কেউ পৌঁছে? এই দ্যাখো আম-কাঁটালের সময় একটা আম-কাঁটাল ঘরে নেই—মেয়েটা কাদের বাড়ী থেকে আজ দু'টো আধপচা আম নিয়ে এল।—পরে সে উদ্দেশে বাড়ীর পশ্চিম দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল,—এই ঘরের দোর থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি আম পেড়ে নিয়ে যায়—বাছারা আমার চেয়ে চেয়ে দ্যাখে,—এ কি কম কষ্ট?

 বাগানের কথার উল্লেখে হরিহর বলিল—উঃ, ও কি কম ধড়িবাজ নাকি? বছরে পঁচিশ-টাকা খাজনা ফেলে ঝেলে হোতো, তাই কিনা লিখে নিলে পাঁচ টাকায়! আমি গিয়ে এত করে বললাম, কাকা, আমার চছেলেটা মেয়েটা আছে, ঐ বাগানে আম-জাম কুড়িয়ে মানুষ হচ্চে। আমার তো আর কোথাও কিছু নেই। আর ধরুন আমাদের জ্ঞাতির বাগান—আপনার তো ঈশ্বর ইচ্ছেয় কোনো অভাব নেই, দু'টো অত বড় বাগান রয়েচে, আম জাম নারকেল সুপারি—আপনার অভাব কি? বাগানখানা গিয়ে ছেড়ে দিন গে যান। তা বল্লে কি জানো? বল্লে নীলমণি দাদা বেঁচে থাকতে ওর কাছে নাকি তিনশো-টাকা ধার করেছিল, তাই অমনি করে শোধ করে নিলে। শোন কথা! নীলমণিদাদার বড্ড অভাব ছিল কিনা, তাই তিনশো টাকার জন্যে গিয়েছে ভুবন মুখুয্যের কাছে হাত পাততে। বৌদিকে ভালমানুষ পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নিলে আর কি!

 —ভালমানুষ তো কত! সেও নাকি বলেছে যে জ্ঞাতি শত্তুর—ওর হাতে বাগান থাকলে তো আর কিছু পাওয়া যাবে না, ফল পাকুড় এমনিই খাবে, তার চেয়ে কিছু কম জমাতেও যদি বন্দোবস্ত হয়, খাঁজনাটা তো পাওয়া যাবে।

 হরিহর বলিল—খাজনা কি আমি দিতাম না? বাগান জমা দেবে, তাই কি আমায় জানতে দিলে? বৌদিদিকে লুচি-মোহনবভোগ খাইয়ে আট ক'রে চুপি চুপি লিঁখিয়ে নিলে।

 বৈকালের দিকটা হঠাৎ চারিদিক অন্ধকার করিয়া কালবৈশাখীর ঝড় উঠিল। অনেকক্ষণ হইতে মেঘ মেঘ করিতেছিল, তবুও ঝড়টা যেন খুব শীঘ্র আসিয়া পড়িল। অপুদের বাড়ীর সামনের বাঁশঝাড়ের বাঁশগুলা পাঁচিলের উপর হইতে ঝড়ের বেগে হটিয়া ওধারে পড়াতে বাড়ীটা যেন ফাঁকা ফাঁকা দেখাইতে লাগিল—ধূলা, বাঁশপাতা, কাঁটালপাতা, খড়, চারিধার হইতে উড়িয়া তাহাদের উঠান ভরাইয়া ফেলিল। দুর্গা বাটীর বাহির হইয়া আম কুড়াইবার জন্য দৌড়িল—অপুও দিদির পিচছু পিছু ছুটিল। দুর্গা ছুটিতে ছুটিতে বলিল—শীগগির ছোট্‌, তুই বরং সিঁদুরকৌটো তলায় থাক্, আমি যাই সোনামুখী-তলায়—দৌড়ো—দৌড়ো। ধূলায় চারিদিক ভরিয়া গিয়াছে—বড় বড় গাছের ডাল ঝড়ে বাঁকিয়া গাছ নেড়া নেড়া দেখাইতেছে। গাছে গাছে সোঁ সোঁ, বোঁ বোঁ শব্দে বাতাস বাধিতেছে—বাগানে শুক্‌না ডাল, কুটা, বাঁশের খোলা উড়িয়া পড়িতেছে—শুক্‌না বাঁশপাতা ছুঁচালো আগাটা উঁচুদিকে তুলিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে আকাশে উঠিতেছে—কুক্‌শিমা গাছের শুঁয়ার মত পালক-ওয়ালা সাদা সাদা ফুল ঝড়ের মুখে কোথা হইতে অজস্র উড়িয়া আসিতেছে—বাতাসের শব্দে কান পাতা যায় না।

 সোনামুখী-তলায় পৌছিয়াই অপু মহা-উৎসাহে চীৎকার করিতে করিতে লাফাইয়া এদিক ওদিক ছুটিতে লাগিল—এই যে দিদি, ওই একটা পড়লো রে দিদি—ঐ আর একটা রে দিদি! চীৎকার যতটা করিতে লাগিল তাহার অনুপাতে সে আম কুড়াইতে পারিল না। ঝড় ঘোর রবে বাড়িয়া চলিয়াছে। ঝড়ের শব্দে আম পড়ার শব্দ শুনিতে পাওয়া যায় না, যদি বা শোনা যায় ঠিক কোন্ জায়গা বরাবর শব্দটা হইল—তাহা ধরিতে পারা যায় না। দুর্গা আট নয়টা আম কুড়াইয়া ফেলিল, অপু এতক্ষণের ছুটাছুটিতে মোটে পাইল দুইটা। তাঁহাই সে খুশির সহিত দেখাইয়া বলিতে লাগিল—এই দ্যাখ দিদি, কত বড় দ্যাখ্‌—ঐ একটা পড়লো—ওই ওদিকে—

 এমন সময় হৈ হাই শব্দে ভুবন মুখুয্যের বাড়ীর ছেলে-মেয়ের সব আম কুড়াইতে আসিতেছে শোনা গেল। সতু চেঁচাইয়া বলিল—ও ভাই, দুগগাদি আর অপু আমি কুড়ুচ্ছে—

 দল আসিয়া সোনামুখী-তলায় আসিয়৷ পৌঁছিল। সতু বলিল—আমাদের বাগানে কেন এয়েচ আম কুড়তে? সেদিন মা বারণ করে দিযেচে না? দেখি কতগুলো আম কুড়িয়েচো?

 পরের দলের দিকে চাহিয়া বলিল—সোনামুখীর কতগুলো আম কুড়িয়েচে দেখচিস টুনু?—যাও আমাদের বাগান থেকে দুগগাদি—মাকে গিয়ে নইলে বলে দেবো। রাণু বলিল—কেন তাড়িয়ে দিচ্ছিস্ সতু? ওরাও কুড়ুক—আমরাও কুড়ই।

 —কুড়োবে বই কি! ও এখানে থাকলে সব আম ওই নেবে। আমাদের বাগানে কেন আস্‌বে ও? না, যাও দুগ্‌গাদি—আমাদের তলায় থাক্‌তে দেবো না।

 অন্য সময় হইলে দুর্গা হয়ত এত সহজে পরাজয় স্বীকার করিত না—কিন্তু সেদিন ইহাদেরই কৃত অভিযোগে মায়ের নিকট মার খাইয়া তাহার পুনরায় বিবাদ বাধাইবার সাহস ছিল না। তাই খুব সহজেই পরাজয় স্বীকার করিয়া লইয়া সে একটু মনমরা ভাবে বলিল—অপু, আয় রে চল্। পরে হঠাৎ মুখে কৃত্রিম উল্লাসের ভার মানিয়া বলিল—আমরা সেই জায়গায় যাই চল্ অপু, এখানে থাকতে না দিলে ব'য়ে গেল—বুঝলি তো?—এখানকার চেয়েও বড় বড় আম—তুই আমি মওজা করে কুড়োবো এখন—চলে আয়—এবং এখানে এতক্ষণ ছিল বলিয়া একটা বৃহত্তর লাভ হইতে বঞ্চিত ছিল, চলিয়া খাওয়ায় প্রকৃতপক্ষে শাপে বর হইল, সকলের সম্মুখে এইরূপ ভাব দেখাইখা যেন অধিকতর উৎসাহের সহিত অপুকে পিছনে লইয়া রাংচিতার বেড়ার ফাঁক গলিয়া বাগানের বাহির হইয়া গেল। রাণু বলিল—কেন ভাই ওদের তাড়িয়ে দিলে—তুমি ভারি হিংসুক কিন্তু সতু দা! রাণুর মনে দুর্গার চোখের ভরসাহারা চাহনি বড় ঘা দিল।

 অপু অতশত বোঝে নাই, বেড়ার বাহিরের পথে আসিয়৷ বলিল—কোন জায়গায় বড় বড় আম রে দিদি। পুঁটুদের সল্‌তেখাগী-তলায়? কোন তলায় দুর্গা তাহা ঠিক করে নাই, একটু ভাবিয়া বলিল—চল্ গড়ের পুকুরের ধারের বাগানে যাবি—ওদিকে সব বড় বড় গাছ আছে—চল্—। গড়ের পুকুর এখান হইতে প্রায় পনেরো মিনিট ধরিয়া সুঁড়ি পথে অনবরত বন-বাগান অতিক্রম করিয়া তবে পৌঁছানো যায়। অনেক কালের প্রাচীনা আম ও কাঁঠালের গাছ—গাছতলায় বনচালতা ময়না-কাঁটা ষাঁড়া গাছের দুর্ভেদ্য জঙ্গল। দূর বলিয়া এবং জনপ্রাণীর বাসশূন্য গভীর বলেব মধ্যে বলিয়া এ সব স্থানে কেহ বড় একটা আম কুড়াইতে আসে না। কাছির মত মোটা মোটা অনেক কালের পুরানো গুলঞ্চ লতা এগাছে ওগাছে দুলিতেছে—বড় বড় প্রাচীন গাছের তলাকার বাঁটাভরা ঘন ঝোপজঙ্গল খুঁজিয়া তলায় পড়া আম বাহির করা সহজসাধ্য তো নহেই, তাহার উপর আবার ঘনায়মান নিবড়-কৃষ্ণ ঝোড়ো মেঘে ও বাগানের মধ্যের জঙ্গলে গাছের আওতায় এরূপ অন্ধকারের স্বষ্টি করিয়াছে যে, কোথায় কি ভাল দেখা যায় না। তবুও খুঁজিতে খুঁজিতে নাছোড়বান্দা দুর্গা গোট আট দশ আম পাইল!

 হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল—ওরে অপু—বৃষ্টি এল।

 সঙ্গে সঙ্গে ঝড়টা যেন খানিকক্ষণ একটু নরম হইল—ভিজে মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধ পাওয়া গেল—একটু পরেই মোটা মোটা ফোঁটায় চড়বড় করিয়া গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়িতে সুরু করিল।

 —আয় আমরা এই গাছতলায় দাড়াই—এখানে বিষ্টি পড়বে না—

 দেখিতে দেখিতে চারিদিক ধোঁয়াকার করিয়া বৃষ্টি নামিল—বৃষ্টির ফোঁটা পড়িবার জোরে গাছের পাতা ছিঁড়িয়া উড়িয়া পড়িতে লাগিল—ভরপুর টাট্‌কা ভিজা মাটির গন্ধ আসিতে লাগিল। ঝড় একটু যেন নরম পড়িয়াছিল—তাহাও আবার বড় বাড়িল—দুর্গা যে গাছতল ভাসাইয়া লইয়া চলিল। বাড়ী হইতে অনেক দূর আসিয়া পড়িয়াছে—অপু ভয়ের স্বরে বলিল—ও দিদি—বড্ড যে বিষ্টি এল!

 তুষ্ট আমার কাছে আয়—দুর্গা তাহাকে কাছে আনিয়া, আঁচল দিয়া ঢাকিয়া কহিল—এ বিষ্টি আর কতক্ষণ হবে—এই ধরে গেল বলে—বিষ্টি হোলো ভালই হোলো—আমরা আবার সোনামুখী-তলায় যাবো এখন, কেমন তো?

 দুজনে চেঁচাইয়া বলিতে লাগিল—

নেবুর পাতায় করমচা,
হে বিষ্টি ধ’রে যা—

 কড়্—কড়্—কড়াৎ···প্রকাণ্ড বন-বাগানের অন্ধকার মাথাটা যেন এদিক্ হইতে ওদিক্ পর্য্যন্ত চিরিয়া গেল—চোখের পলকের জন্য চারিধারে আলো হইয়া উঠিল—সামনের গাছের মগডালে খোলো খোলো বন-ধুঁধুল ফল ঝড়ে দুলিতেছে। অপু দুর্গাকে ভয়ে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল—ও দিদি!

 ভয় কি রে? রাম রাম বল্—রাম রাম রাম—নেবুর পাতায় করম্‌চা হে বিষ্টি ধ'রে যা—নেবুর পাতায় করম্‌চা হে বিষ্টি ধ'রে যা—নেবুর পাতায় করম্‌চা—

 বৃষ্টির ঝাপটায় তাহাদের কাপড় চুল ভিজিয়া টস্‌টস্ করিয়া জল ঝরিতে লাগিল— গুম্-গুম্-গুম্-ম্-ম্—চাপা, গম্ভীর ধ্বনি—একটা বিশাল লোহার রুল কে যেন আকাশের ধাতব মেঝেতে এদিক হইতে ওদিকে টানিয়া লইয়া বেড়াইতেছে—অপু শঙ্কিত সুরে বলিল—ঐ দিদি, আবার—

 —ভয় নেই, ভয় কি?—আর একটু স'রে আয়—এঃ, তোর মাথাটা ভিজে যে একেবারে জুবড়ি হ'য়ে গিয়েছে—

 চারিধারে শুধু মুসলধারে বৃষ্টিপতনের হুস্ স্ স্-স্ একটানা শব্দ, মাঝে মাঝে দম্‌কা ঝড়ের সোঁ-ও-ও-ও, বোঁ ও-ও-ও-ও রব, ডালপালার ঝাপটের শব্দ—মেঘের ডাকে কানে তালা ধরিয়া যায়। এক একবার দুর্গার মনে হইতেছিল সমস্ত বাগানখান ঝড়ে মড়-মড় করিয়া ভাঙিয়া উপুড় হইয়া তাহাদের চাপা দিল বুঝি!

 অপু বলিল—দিদি, বিষ্টি যদি আর না থামে?

 হঠাৎ ঝটিকাক্ষুব্ধ অন্ধকার আকাশের এ-প্রাস্ত হইতে লক্‌লকে আলোর জিহ্বা মেলিয়া বিদ্রুপের বিকট অট্ট হাস্যের রোল তুলিয়া এক লহমায় ও প্রাস্তের দিকে ছুটিয়া গেল।

 কড়্ কড়-কড়াৎ!

 সঙ্গে সঙ্গে বাগানের মাথায় বৃষ্টির ধোঁয়ার রাশি চিরিয়া ফাড়িয়া উড়াইয়া ভৈরবী প্রকৃতির উন্মত্ততার মাঝকখানে ধরা পড়া দুই অশসহায় বালকবালিকার চোখ ঝল্‌সাইয়া তীক্ষ্ণ নীল বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল।

 অপু ভয়ে চোখ বুজিল।

 দুর্গা শুষ্ক গলায় উপরের দিকে চাহিয়া দেখিল,—বাজ পড়িতেছে না কি!—গাছের মাথায় বনধুঁদুলের ফল দুলিতেছ।

 সেই বড় লোহার রুলটাকে আকাশের ওদিক হইতে কে যেন আবার এদিকে টানিয়া আনিতেছিল—

 শীতে অপুর ঠক্ ঠক্‌ করিয়া দাঁতে দাঁত লাগিতেছিল—দুর্গা তাহাকে আরও কাছে টানিয়া আনিয়া শেষ আশ্রয়ের সাহসে বার বার দ্রুত আবৃত্তি করিতে লাগিল—নেবুর পাতায় করম্‌চা হে বিষ্টি ধ'রে যা—নেবুর পাতায় করম্‌চা হে বিষ্টি ধ'রে যা—নেবুর পাতায় করম্‌চা · ভয়ে তাহার স্বর কাঁপিতেছিল।

 সন্ধ্যা হইবার বেশী বিলম্ব নাই। ঝড়-বৃষ্টি খানিকক্ষণ থামিয়া গিয়াছে। সর্ব্বজয়া বাহিরের দরজায় দাঁড়াইয়া আছে। পোথে জমিয়া যাওয়া বৃষ্টির জলের উপর ছপ ছপ শব্দ করিতে করিতে রাজকৃষ্ণ পালিতের মেয়ে আশালতা পুকুরের ঘাটে খাইতেছিল। সর্ব্বজয়া জিজ্ঞাসা করিল—হ্যাঁ মা, দুর্গা আর অপুকে দেখিচিস্ ও দিকে?

 আশালতা বলিল—না খুড়ীমা, দেখিনি তো! কথায় গিয়েচে? তারপর হাসিয়া বলিল—কি ব্যাঙ-ডাকানি জল হয়ে গেল খুউীমা!

 —সেই ঝডের আগে দুজনে বেরিয়েচে আম কুড়োতে যাই ব'লে, আর তো ফেরেনি—এই ঝড়-বিষ্টি গেল, সন্দে হোল, ও মা কোথায় গেল তবে?

 সর্ব্বজয়া উদ্বিগ্ন মনে বাড়ীর মধ্যে ফিরিয়া আসিল। কি করিবে ভাবিতেছে এমন সময় খিড়কীর দরজা ঠেলিয়া আপাদমস্তক সিক্ত অবস্থায় দূুর্গা আগে একটা ঝুনা নারিকেল হাতে ও পিছনে পিছনে অপু একটা নারিকেলের বাগলো টানিয়া লইয়া বাড়ী ঢুকিল। সর্ব্বজয়া তাড়াতাড়ি ছেলে মেয়ের কাছে গিয়া বলিল—ওমা আমার কি হবে! ভিজে যে সব একেবারে পান্তাভাত হইচিস্! কোথায় ছিলি বিষ্টির সময়? ছেলেকে কাছে আনিয়া মাথায় হাত দিয়া বলিল—ওমা, মাথাটা যে ভিজে জুবড়ি। পরে আহ্লাদের সহিত বলিল—নারকোল কোথা পেলি রে দুর্গা?

 অপু ও দুর্গা দুজনেই চাপা কণ্ঠে বলিল—চুপ চুপ মা—সেজজেঠিমা বাগানে যাচ্ছে—এই গেল—ওদের বাগানের বেড়ার ধারের দিকে যে নারকোল গাছটা? ওর তলায় প'ড়ে ছিল। আমরাও বেরুচ্চি সেজ-জেঠিমাও ঢুকলো।

 দুর্গা বলিল—অপুকে তো ঠিক দেখেচে—আমাকেও বোধ হয় দেখেছে। পরে সে উৎসাহের সঙ্গে অথচ চাপ সুরে বলিতে লাগিল—একেবারে গাছের গোড়ায় প'ড়ে ছিল মা, আগে আমি টের পাইনি, সোনামুখী তলায় যদি আম প'ড়ে থাকে তাই দেখতে গিয়ে দেখি বাগলোটা প'ড়ে রয়েচে। অপুকে বললাম—অপু, বাগ্লোটা নে—মার ঝাঁটার কষ্ট, ঝাঁটা হবে। তারপরই দেখি,—হস্তস্থিত নারিকেলটার দিকে উজ্জ্বল মুখে চাহিয়া বলিল—বেশ বড়, না মা?

 অপু খুশির সুরে হত নাড়িয়া বলিল—আমি অম্‌নি বাগলোটা নিয়ে ছুট—

 সর্ব্বজয়া বলিল—বেশ বড় দোমালা নারকোলটা। ছেঁচতলায় রেখে দে, জল দিয়ে নেবো—

 অপু অনুযোগের সুরে বলিল—তুমি বলো মা নারকোল নেই, নারকোল নেই,—এই তো হোল নারকোল। এইবার কিন্তু বড় করে দিতে হবে। আমি ছাড়বে না—কখ্‌খনো—

 বৃষ্টির জলে ছেলেমেয়ের মুখ বৃষ্টিধোয়া জুঁই ফুলের মত সুন্দর দেখাইতেছিল। ঠাণ্ডায় তাহাদের ঠোঁট নীল হইয়া গিয়াছে, মাথার চুল ভিজিয়া কানের সঙ্গে লেপটাইয়া লাগিয়া গিয়াছে। সৰ্ব্বজয়া বলিল—আয় সব, কাপড় ছাড়িয়ে দিই আগে, পায়ে জল দিয়ে রোয়াকে ওঠ্, সব—

 থানিক পরে সর্ব্বজয়া কূয়ার জল তুলিতে ভুবন মুখুয্যের বাড়ী গেল । ভুবন মুখুয্যের খিড়কী-দোর পৰ্য্যন্ত যাইতেই সে শুনিল সেজঠাক্‌রুণ বাড়ীর মধ্যে চীৎকার করিয়া বাড়ী মাথায় করিতেছেন।

 —একটা মুঠে টাকা খরচ ক'রে তবে বাগান নেওয়া—মাগ্‌না তো নয়। তার কোনো গাছটা—যদি হাঘরেদের জন্যে ঢুকবার জো আছে! ঐ ছুঁড়ীটা রাদ্দিন বাগানে বসে আছে। কুটোগাছটা দিয়ে গিয়ে ধরে তুলবে—এতে মাগীরও শিক্ষে আছে, ও মাগী কি কম নাকি?—ও মা, ভাবলাম বিষ্টি থেমেচে, যাই একবার বাগানটা গিয়ে দেখে আসি—এই এও বড় নারকোলটা কুড়িয়ে নিয়ে একেবারে দুড়্‌দুড়্ দৌড়?—এত শত্তুরতা যেন ভগবান্ সহ্যি না করেন—উচ্ছন্ন যান্, উচ্ছন্ন যান্—এই ভস্ সন্দে বেলা বলচি, আর যেন নার্‌কোল খেতে না হয়—একবার শীগগির যেন ছাতিমতলা-সই হন—

 সর্ব্বজয়া খিড়কীর বাহিরে কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ছেলেমেয়ের বর্ষণ সিক্ত কচিমুখ মনে করিয়া সে ভাবিল, যদি গালাগাল ওদের লাগে! বাবা—যে লোক! দাঁতে বিষ আছে! কি করি? কথাটা ভাবিতেই তাহার গা শিহরিয়া উঠিয়া সর্ব্বশরীর যেন অবশ হইয়া গেল। সে আর মুখুয্যেবাড়ী ঢুকিল না—আশশেওড়া বনে, বাঁশঝাড়ের তলায় বর্ষণস্তব্ধ সন্ধ্যায় জোনাকী জ্বলিতেছে, পা যেন আর উঠিতে চাহে না—ভয়ে ভয়ে সে জল তুলিবার ছোট্ট বালতিটা ও ঘড়া কাঁধে লইয়া বাড়ীর দিকে ফিরিল।

 পথে আসিতে আসিতে ভাবিল—যদি নারকোলটা ওদের ফেরৎ দিই—তাহলেও কি গাল লাগবে? তা লেন লাগবে—যার জিনিস তাকে তো ফেরৎ দেওয়া হ'ল তা কখনো লাগে?

 বাড়ীতে পা দিয়াই মেয়েকে বলিল—দুগ্‌গা, নারকোলটা সতুদের বাড়ী দিয়ে আয় গিয়ে।

 অপু ও দুর্গা অবাক হইয়া মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল—

 দুর্গা বলিল—এখ্‌খুনি?

 —হ্যাঁ,—এখ্‌খুনি দিয়ে আয়। ওদের খিড়কীর দোর খলা আছে। চট্ ক'রে যা। ব'লে আয়, আমরা কুড়িয়ে পেইছিলাম, এই নাও দিয়ে গেলাম।

 —অপু আমাকে একটু দাঁড়াবে না, মা? বড্ড অন্ধকার হয়েচে, চল্ অপু আমার সঙ্গে।

 ছেলেমেয়ে চলিয়া গিয়া সর্ব্বজয়া তুলসীতলায় প্রদীপ দিতে দিতে গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিয়া বলিল—ঠাকুর নারকোল ওরা শত্তুরতা ক'রে কুড়ুতে যায়নি সে তো তুমি জানো, এ গাল যেন ওদের না লাগে। দোহাই ঠাকুর, ওদের তুমি বাঁচিয়ে বর্ত্তে রেখো ঠাকুর। ওদের তুমি মঙ্গল কোরো। তুমি ওদের মুখের দিকে চেও। দোহাই ঠাকুর।