সেদিন রাত্রে গােপির পায়ের যন্ত্রণা খুব বাড়িয়া গেল। তাহাকে নূতন ঘরে আনা হইয়াছিল, সারারাত সে ছটফট করিয়া গােঙাইয়া কাটাইয়া দিল। মালা জাগিয়া বসিয়া রহিল তাহার শিয়রে। কুবেরও অনেক রাত অবধি জাগিয়া রহিল। তারপর সে ঘুমাইয়া পড়িল বটে কিন্তু ভালাে ঘুম হইল না। শেষরাত্রে উঠিয়া বসিয়া সে ডাকিল, গােপির মা?

 জবাব দিল কপিলা।—গােপির মা ঘুমায়।

 কুবের উঠিয়া আসিয়া বলিল, যা তুই ঘুমা গা কপিলা, আমি বইয়া থাকি।

 কপিলা চাপা গলায় বলিল, আরে পুরুষ! রাত ভইরা ঘুমাইয়া বিয়ানে কয়, যা তুই ঘুমা গা কপিলা। কাউয়ায় ডাক পাড়ে শুনছ মাঝি?

 তাইতাে বটে! ফরসা হইয়া আসিয়াছে যে!

 ঝাঁপ খুলিয়া কুবের বাহিরে গেল। গণেশের বাড়ি গিয়া ডাকাডাকি করিয়া তুলিল গণেশকে। যুগল কাল বােনের বাড়ি নেমন্তন্ন খাইতে আসিয়া রাত্রে এখানেই ঘুমাইয়াছিল, সে-ও উঠিয়া আসিল। কুবের বলিল, গণেশ, মাইয়ারে ত হাসপাতালে নেওন লাগে, বড়াে কাতর মাইয়া, রাইত্ ভইরা চেঁচাইয়া মরছে।

 গণেশ বলিল, হ?—ব কুবির, তামুক খা। হাসপাতালে নেওন ত সহজ কথা না! কিবা নিবি ভাবছস নি?

 নাও নিয়া যামু, আবার কিবা?

 সমস্যার সমাধানে গণেশ খুশি হইয়া বলিল, তবে চিন্তা নাই, যুগইলার নাওখান মিলব আইজ, ও নিয়া আইছে যুগইলা।—নাওখান দিবি না যুগইলা তর?

 যুগল সাগ্রহে নৌকা দিতে সম্মত হইল। বলিল, সেও সঙ্গে যাইবে। খুব বুঝি ফুলিয়াছে গােপির পা-টা? কোথায় চোট লাগিয়াছে? আগে কেন মেয়েকে হাসপাতালে দেয় নাই কুবের—আগেই লইয়া যাওয়া উচিত ছিল। যাই হােক, আজ যদি হাসপাতালে লইতেই হয়, দেরি করিয়া লাভ কী? বেলা হইয়া গেলে হাসপাতালে ডাক্তারকে পাওয়া যাইবে না।

 একটা চওড়া কাঠের তক্তায় শােয়াইয়া ধরাধরি করিয়া গােপিকে নদীতীরে লইয়া যাওয়া হইল। কাঁথা বালিশ হাতে করিয়া কপিলা গেল সঙ্গে। ইতিমধ্যে জেলেপাড়ায় খবর রটিয়া গিয়াছিল। গ্রামের একটি মেয়েকে হাসপাতালে নেওয়া প্রতিমা বিসর্জনের চেয়ে কম গুরুতর ব্যাপার নয় জেলেপাড়াবাসীদের কাছে—এই ভােরে নদীতীরে একটি ছােটোখাটো ভিড় জমিয়া গিয়াছিল। প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে কুবেত একেবারে হয়রান।

 কপিলা আগে নৌকায় উঠিয়া কাঁথাপত্র বিছাইয়া দিল, তারপর গােপিকে তুলিয়া শােয়ানাে হইল। যন্ত্রণায় ও ভয়ে গােপির মুখখানা ফ্যাকাশে হইয়া গিয়াছে। হাসপাতাল? না জানি কী ভয়ংকর সেই স্থান! কে জানে সেখানে কী হইবে তাহার! কপিলার একটা হাত গােপি সবলে আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিল।

 নৌকা খােলা হইবে এমন সময় দেখা গেল রাসু ছুটিয়া আসিতেছে। নদীতীরে পৌছিয়া সে লাফাইয়া নৌকায় উঠিয়া পড়িল।

 কুবের জিজ্ঞাসা করিল, কীরে রাসু?

 রাসু হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, আমিও যামু।

 চলুক! এতবড়াে নৌকা, স্থানাভাব হইবে না। বেশি লােক সঙ্গে থাকিলে গােপিকে উঠানাে নামানাের বরং সুবিধাই হইবে।

 মহকুমা শহর আমিনবাড়ি, সেইখানে সরকারি হাসপাতাল। কেতুপুর হইতে আমিনবাড়ি বেশি দূর নয়, ঘণ্টা তিনেক লাগিল পৌঁছিতে। রাসুর সাধ ছিল গােপিকে ঘাট হইতে হাসপাতাল পর্যন্ত লইয়া যাইতে সেও কাঁধ দিবে, কিন্তু তার প্রয়ােজন হইল না। সকলকে নৌকায় বসিয়া থাকিতে বলিয়া যুগল নামিয়া গেল, খানিক পরে কোথা হইতে খুঁজিয়া পাতিয়া লইয়া আসিল একটা পালকি। যুগল কি কম পাকা লােক। পালকি চাপিয়া গােপি হাসপাতালে গেল।

 হাসপাতালে তখন রােগীর ভিড় জমিয়াছে। একটা ছােটো ছেলের ফোড়া অপারেশন করা হইতেছিল, কী তাহার তীব্র চীৎকার। গােপি তাে দেখিয়া শুনিয়া বিবর্ণ হইয়া গােঙাইতে আরম্ভ করিল। কুবেরের মুখখানাও শুকাইয়া পাংশু হইয়া গিয়াছে। সকলেই অল্পবিস্তর ভীত ও সন্ত্রস্ত। শুধু অবিচলিত আছে রাসু। ময়নাদ্বীপ হইতে পলাইয়া আসিয়া নোয়াখালির হাসপাতালে সে পনেরােটা দিন কাটাইয়া দিয়াছিল, এ তাহার পরিচিত স্থান। সকলকে সে অভয় দিয়া বলিতে লাগিল, ভয় নাই, ভয় নাই, সব ঠিক হইয়া যাইবে।

 সে-ই গিয়া ডাক্তারকে গােপির অবস্থা বলিয়া নামধাম লিখাইয়া আসিল। কী গর্ব রাসুর! দেখুক কুবের, কেমন চটপটে পাকা লােক সে! দেখিয়া রাখুক!

 বেলা প্রায় এগারােটার সময় অবসর করিয়া ডাক্তারবাবু গােপির পা পরীক্ষা করিলেন। পরীক্ষা করিয়া রাগের সীমা রহিল না ডাক্তারের। রাসুই কিনা বুক ঠুকিয়া কথা বলিতেছিল, তাহাকেই গােপির অভিভাবক ঠাওরাইয়া ধমক দিয়া ডাক্তার আর কিছু রাখিলেন না। এতকাল কী করিতেছিল তাহারা, বসিয়া বসিয়া ঘাস কাটিতেছিল? আগে আনিতে পারে নাই গােপিকে? পা যদি এবার কাটিয়া বাদ দিতে হয়?

 অপারেশন টেবিলে শুইয়া গােপি কপিলার হাত শক্ত করিয়া ধরিয়াছিল, গােঙাইয়া গােঙাইয়া সে তাে কাঁদিতে থাকেই, কপিলাও মৃদু সুর তােলে কান্নার—তারপর ডাক্তারের ধমকে আচমকা স্তব্ধ হইয়া যায়। পরীক্ষা শেষ করিয়া ডাক্তার বড়াে ভয়ানক কথা বলিলেন। এখানে রাখিয়া যাইতে হইবে গােপিকে। তবে একথাও তিনি বলিলেন যে, রাখা না-রাখা গােপির বাপের খুশি, জোরজবরদস্তি নাই।

 হাসপাতালের বারান্দায় পরামর্শ সভা বসিল। ডাক্তারের ধমকে রাসু বড়াে দমিয়া গিয়াছিল, সে আর কথা বলিল না—হয়তাে এতক্ষণে গােপির অবস্থার গুরুত্ব বুঝিয়া মনটাও তার খারাপ হইয়া গিয়া থাকিতে পাবে। ঘরের মধ্যে গােপি কাঁদিতে লাগিল—আগাে মাসি আমি থাকুম না, আমারে নিয়া যাও—আর বাহিরে কুবের গণেশ আর যুগল গভীর মুখে বলাবলি করিতে লাগিল যে এবার কী করা কর্তব্য। পরামর্শ করা একান্ত মিছে, ডাক্তার যে কথা বলিয়াছে তারপর গােপিকে না রাখিলে চলিবে না এখানে, তবু তারা অজ্ঞ ও ভীরু গ্রামবাসী কিনা, দীর্ঘ পরামর্শ ছাড়া কোনাে সিদ্ধান্তই তারা করিতে পারে না।

 গােপিকে মেয়ে-ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়া দেওয়া হইল। তারপর আর তাহাদের গােপির কাছে থাকিবার উপায় রহিল না। আবার সেই চারটার সময় আসিয়া মেয়েটার সঙ্গে তাহারা দেখা করিতে পারিবে।

 গােপি কপিলাকে কিছুতে ছাড়িবেনা। কাঁদিয়া কাঁদিয়া সে বলিতে লাগিল, আগাে মাসি, নিয়া যাও, কই থুইয়া যাও আমারে?


হাঁটিতে হাঁটিতে তাহারা ফিরিয়া গেল নদীর ঘাটে। পথে কিনিয়া লইল কিছু চিড়ামুড়ি। এত বেলা অবধি কেহ তাহারা কিছু খায় নাই।

 নীরবে সকলে জলযােগ শেষ করিল। এবার? কী করিবে তাহারা এবার?

 যুগলের থাকিবার উপায় নাই। নৌকা তাহার ভাড়া হইয়া আছে, সকালবেলাই তাহার দেবীগঞ্জে যাওয়ার কথা ছিল। কুবের এখন গ্রামে ফিরিবে তাে? গ্রামের ঘাটে সকলকে নামাইয়া দিয়া যুগল সােজা চলিয়া যাইবে দেবীগঞ্জে।

 কুবের বলিল, তােমরা যাও, বৈকালে মাইয়াটারে একবার না দেইখা আমি যামু না।

 রাসু বলিল, আমিও থাকি, আঁই?

 কুবের বলিল, না রাসু, যা গিয়া তুই। কই থাকুম কী বিত্তান্ত ঠিক নাই, তুই থাইকা করবি কী?

 গণেশ থাকিতে চাহিল, কুবের তাকেও বুঝাইয়া নিবৃত্ত করিল। কপিলা অবশ্যই ফিরিয়া যাইবে, তাই তাহার থাকা না থাকার কথাই উঠিল না, কপিলাও কিছু বলিল না। কিন্তু কপিলাই শেষ পর্যন্ত নৌকায় উঠিল না। সেও বিকাল পর্যন্ত এখানে থাকিবে, গােপিকে আর একবার না দেখিয়া গ্রামে কি সে ফিরিতে পারে? আহা, মাসি মাসি বলিয়া মেয়েটা হয়তাে কাঁদিয়া মরিতেছে। কেহ তাহাকে টলাইতে পারিল না। কুবের কত বলিল, নিজে সে কোথায় থাকিবে ঠিক নাই, মেয়েমানুষ সঙ্গে থাকিলে কত হাঙ্গামা, কত অসুবিধা—তা ছাড়া লােকে বলিবে কী? কপিলা কোনাে কথাই কানে তুলিল না।

 নৌকা চলিয়া গেল।

 কুবের মুখ ফিরাইয়া দেখিল,নদীর বাতাস কপিলাকে স্পষ্ট করিয়াছে, শাড়িখানি মিশিয়া গিয়াছে অঙ্গে। বেগুনি রঙের শাড়িখানি পরিয়াই সে যে আজও পথে বাহির হইয়াছে, এতক্ষণ কুবের তাে তাহা লক্ষ করে নাই! এতক্ষণে খেয়াল করিয়া সে যেন কেমন অসন্তোষ বােধ করিল। কপিলাকে লইয়া এখন সে কী করিবে, যাইবে কোথায়? কী মতলব করিয়াছে কপিলা? থাকিবার ওর কী প্রয়ােজন ছিল?

 কী দ্যাখ মাঝি? কী ভাব? কপিলা বলিল।

 জিগানে কাম কী তর? কুবের বলিল।

 গােসা কর ক্যান? উই দ্যাখ জাহাজ আহে।

 সেইখানে নদীতীরে দাঁড়াইয়া তাহারা চাহিয়া থাকে, চক্রাকারে পাক দিয়া জাহাজ আসিয়া ভিড়ে জেটিতে। কী ভিড় হইয়াছে আজ জাহাজে! আজ পূজা শেষ, আজও দেশ-দেশান্তরের মানুষ গৃহে ফিরিতেছে। আর, কী অদৃষ্ট কুবেরের, মেয়েটাকে আজ এই বিদেশে হাসপাতালে ফেলিয়া রাখিয়া মূঢ়ের মতাে সে দাঁড়াইয়া আছে নদীতীরে, কোথায় যাইবে কী করিবে ঠিক নাই! ভোঁ দিয়া জাহাজ ছাড়িয়া যায়। নদীর আলােড়িত জল ঢেউ তুলিয়া তীরে আছড়াইয়া পড়ে। মেয়েটার জন্য এমনই ঢেউ উঠিয়াছে কুবেরের বুকে।

 হঠাৎ কপিলা বলিল, মাঝি, পয়সাকড়ি আনছ?

 হ।

 কত?

 তা দিয়া কী কাম তর?

 আমি কিছু আনছি, লাগলে নিও।

 কপিলা আঁচলে গেরাে বাঁধা পয়সা দেখাইল।

 কুবের হাঁ না কিছুই বলিল না। জেটি নির্জন হইয়াছে দেখিয়া খানিক পরে জেটিতে গিয়া ছায়ায় তাহারা বসিয়া রহিল। কুবের তাকায় না কপিলার দিকে, একটার পর একটা বিড়ি ধরাইয়া টানিতে থাকে—মিনিটে মিনিটে বিড়ি খাওয়ার মতােই সে যেন বড়ােলােক।

 ক্যামনে ফিরবা মাঝি? খানিক পরে কপিলা জিজ্ঞাসা করিল।

 কেডা জানে? যেমন কাণ্ড তর কপিলা। তরে নিয়া কী যে করুম—

 আমার লাইগা ভাইবাে না মাঝি।

 এতক্ষণে কী মনে করিয়া কুবের হাসিল, বড়াে পােলাপান তুই কপিলা। সোয়ামি শুইনা কী কইব তর ভাবছস নি?

 কউক।

 তা বইকী। কলঙ্ক কিনিবার সাধ যে কপিলার ষােলাে আনা দেখা যায়? কুবের গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে। এ তাে ভালাে কথা নয়। একবাড়িতে যারা বাস করে শুধু দুর্নাম কিনিবার জন্য এখানে তাদের পড়িয়া থাকিবার কোনাে মানে হয় না। শুধু গােপির জন্যই কি কপিলা রহিয়া গেল? গােপিকে সে এত ভালােভাসে? কে জানে, কপিলার মন বুঝিবার ক্ষমতা ভগবান কুবেরকে দেন নাই।

 বেলা পড়িয়া আসিলে দুজনে হাসপাতালে গেল। কুবেরের এবার প্রথম মনে হইল থাকিয়া বুঝি ভালাে করিয়াছে কপিলা। এমন করিয়া নতুবা গােপিকে সে নিজে তাে সান্ত্বনা দিতে পারিত না কপিলার মতাে! তা ছাড়া যে কাণ্ড আজ ডাক্তার করিলেন গােপিকে লইয়া, কপিলা না থাকিলে বুক বাঁধিয়া সেসময় কে থাকিত গােপির কাছে? গােপির হাঁটুর হাড়ই শুধু ভাঙে নাই, মস্ত একটা বাঁশের গোঁজ ঢুকিয়া গিয়াছিল মাংসের মধ্যে, পা ফুলিয়া সেটাকে আড়াল করিয়া ফেলিয়াছে। ডাক্তার এ বেলা সেটা টানিয়া বাহির করিলেন, তারপর ভাঙা হাড়টা যতদূর সম্ভব স্বস্থানে বসাইয়া কোমরের কাছ হইতে পা পর্যন্ত কাঠের তক্তা বসাইয়া বাঁধিয়া দিলেন ব্যাণ্ডেজ। কুবের এসব দেখিল না, বাহিরে বসিয়া সে শুধু গােপির আর্তনাদ শুনিল।

 দুজনে যখন তাহারা হাসপাতাল হইতে পথে নামিয়া আসিল, সন্ধ্যা হইতে বেশি বাকি নাই। দূরে বিসর্জনের বাজনা বাজিতেছিল। গ্রামেই এখন তাহাদের ফিরিতে হইবে। এখানে রাত কাটাইবে কোথায়? কাল আবার কুবের আসিয়া গােপিকে দেখিয়া যাইবে। নদীর ঘাটে গিয়া কুবের নৌকায় নৌকায় চেনা মাঝি খুঁজিয়া বেড়াইল। চেনা মাঝি দু-চারজন মিলিল বটে কিন্তু আজ বিজয়ার সন্ধ্যায় নৌকা তাে কেহ খুলিবে না! দেবীগঞ্জের দিকে যাদের যাওয়ার দরকার ছিল, দিনে দিনে তারা চলিয়া গিয়াছে। তবে গহনার নৌকা[১] ছাড়িবে একটা, কুবের ইচ্ছা করিলে ভাড়া দিয়া যাইতে পারে। নতুবা কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করুক, যে নৌকাই কেতুপুরের দিকে যাক, কুবের তাহাতে গ্রামে ফিরিতে পারিবে।

 কত নাও যাইবাে কাইল, পয়সা দিয়া ক্যান যাইবা কুবের বাই? বলিয়া পরিচিত মাঝি কুবেরকে নৌকায় রাত্রি যাপন করিতে অনুরােধ করে। শুধু পরিচিত মাঝি কেন, পদ্মানদীর মাঝি সে, পদ্মানদীর যে-কোনাে মাঝির নৌকায় রাত্রিযাপনের অধিকার তার জন্মগত, কিন্তু এখানে রাত কাটানােই যে মুশকিল। কপিলার সঙ্গে একত্র এখানে রাত কাটাইয়া গিয়া কাল গ্রামে সে মুখ দেখাইবে কী করিয়া? কী বিপদেই কপিলা তাহাকে ফেলিয়াছে।

 পয়সা দিয়া গহনার নৌকায় যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। কত ভাড়া লইবে কে জানে! জিজ্ঞাসা করিতে গহনার নৌকার মাঝি বলে, সােনাখালি হইয়া তীরে তীরে তাহারা দেবীগঞ্জ পৌছায়, পদ্মা পার হইয়া কুবেরকে কেতুপুরে তাহারা নামাইয়া দিতে পারিবে না। হাসাইলের খাল পর্যন্ত তাহারা এ তীর ঘেঁষিয়া চলিবে, কুবের সেখানে নামিতে পারে, ভাড়া মাথা পিছু তিন আনা।

 হাসাইলের খাল হইতে কেতুপুর দু-ক্রোশের কম নয়। এই রাত্রে অতখানি পথ কপিলা হাঁটিতে পারিবে কিনা সন্দেহ। কুবের জিজ্ঞাসা করে, কী করি কপিলা?

 কপিলা বলে, না গেলাম আইজ? কাইল বিয়ানে গােপির দেইখা মেলা করুম?

 থাকুম কই? নায়?

 তাই কি হয়! ডাকাত না গুণ্ডা নৌকার মাঝি কে জানে, কপিলা কী পারে এই নদীর ঘাটে খােলা নৌকায় শুইয়া থাকিতে? ওই তাে ঘাটের হােটেল দেখা যায়, ওখানে একটা ঘর ভাড়া নেওয়া যাক।

 কী আর করিবে কুবের, দরদস্তুর করিয়া ছ-আনায় বড়ো একটা ঘরের একদিকে ছাঁচের বেড়ায় ঘেরা স্থানটুকু ভাড়া করে। দরজা বা ঝাঁপ কিছুই নাই, ঢুকিবার জন্য একটু ফাঁক রাখিয়া ঘেরিয়া দিয়াছে। ঘরের মধ্যে সারি সারি মােটা পাটি পাতা, অতিথির রাত্রে শয়ন করিবে—ঘেরা স্থানটুকুর মধ্যে একখানা পাটিতেই মেঝের প্রায় সবটা ভরিয়া গিয়াছে। বাহিরে খােলা চালার নীচে খাওয়ার জায়গা, রান্নাঘরেও কতকগুলি পিঁড়ি পড়ে, চালাটার মাঝখানে একটা কালি-পড়া লণ্ঠন রাখা হইয়াছে, বাকি সর্বত্র জ্বলিতেছে কেরােসিনের কুপি।

 কুবের গিয়া চালার নীচে বসিয়া খাইয়া আসে। চালার বাহিরে সকলের দিকে পিছন ফিরিয়া বসিয়া খােলা আকাশের নীচে খায় কপিলা। তারপর এক পয়সার পান কিনিয়া আনে কুবের, ঘেরা স্থানটুকুর মধ্যে বসিয়া দুজনে নীরবে পান চিবায়। সারাদিন কত হাঙ্গামা কত হাঁটাহাটি গিয়াছে, দুপুরে স্নান হয় নাই, পেটে ভাত পড়ে নাই, ক্রমে ক্রমে দুজনেরই ঢুল আসিতে থাকে। আর একটু রাত হইলে কুবের উঁকি দিয়া দেখে, কাপড় মুড়ি দিয়া কেহ কেহ পাটিতে শুইয়া পড়িয়াছে, কোনাে পাটিতে বসিয়া কেহ টানিতেছে তামাক।

 কুবের উঠিয়া দাঁড়ায়, বলে, শাে কপিলা।

 তুমি কই যাও?

 উই পাটিতে শুই গিয়া আমি, যামু কই?

 ক্ষীণ ভীরু কণ্ঠে কপিলা বলে, না, যাইও না মাঝি।

কুবের কি রাগিয়া যায়? কড়া সুরে জিজ্ঞাসা করে, কী করুম তবে?

 ডরামু মাঝি।

 কী আর করিবে কুবের, আবার সে পাটিতে বসে। কপিলা তাহার চাদরখানা পুঁটুলি করিয়া তাহাকে বালিশ করিয়া দেয়। তার নিজের মাথায় দেওয়ার জন্য ছােটো একটি পিঁড়ি আছে। কুবের শুইয়া পড়িলে এতক্ষণে কপিলা চুল খুলিয়া দেয়, আঙুল দিয়া চুল আঁচড়াইতে আঁচড়াইতে বলে, গােপির লাইগা পেরানডা পােড়ায় মাঝি, স্যায় বুঝি ডরাইয়া কাইন্দা মরে।

 বুঝিতে পারা যায় কপিলা কাঁদিতেছে।

 কে জানে কবে মাইয়া সাইরা উঠ্যা বাড়িত্ যাইব! মাইয়ারে ফেইলা ক্যামনে ফিরুম মাঝি কাইল?

 কুবের কাঠ হইয়া পড়িয়া থাকে। এখানে কাঁদিতেছে কপিলা, ওখানে মালাও হয়তাে কাঁদিতেছে এখন। পথের দিকে চাহিয়া কত কী হয়তাে ভাবিতেছে মালা। আর গােপি কী করিতেছে তা যেন ভাবাও যায় না।


পরদিন ভােরে আগে ঘুম ভাঙিল কপিলার। হাই তুলিয়া সে উঠিয়া বসিল, ঠেলা দিয়া কুবেরকে তুলিয়া দিল। বেড়ার বাহিরে পাটিতে এখনও রাত্রির অতিথিরা নাক ডাকাইতেছে, শুধু বাহিরের দুয়ারের কাছে কেরোসিন কাঠের বাক্‌সে বসিয়া তামাক টানিতেছে হােটেলের মালিক। রান্নাঘরে দাসী উনানের ছাই তুলিতেছে। কপিলাকে দেখিয়া ঘুমন্ত কুকুরটা উঠিয়া দাঁড়াইয়া লেজ নাড়িতে লাগিল।

 মৃদু মধুর শীত পড়িয়াছে। কুবেরের চাদরখানা পরিয়া কপিলা প্রথমে নদীতে ডুব দিয়া আসিল, তারপর স্নান করিতে গেল কুবের। কুবের ফিরিয়া আসা পর্যন্ত কপিলা ঘেরা স্থানটুকুর মধ্যে লুকাইয়া রহিল। পুরুষের দৃষ্টিপাতে আজ বড়াে লজ্জা করিতেছে কপিলার, দিনের আলােয় আজ তার মনে হইতেছে জগৎসুদ্ধ সকলেই বুঝি জানে যার পাশে শুইয়া সে রাত কাটাইয়াছে স্বামী সে তাহার নয়।

 মুড়ি আর বাতাসা কিনিয়া কুবের ফিরিয়া আসিল। দু মুঠা খাইয়া কপিলা বলিল, আর সে খাইবে না। না খাক, কুবেরের পেটে জায়গা আছে ঢের। ধীরে ধীরে মুড়ি আর বাতাসা শেষ করিয়া সে বলিল, ল, যাই হাসপাতাল।

 তখন সবে রােদ উঠিয়াছে। এত সকালে গােপির সঙ্গে তাহারা দেখা করিতে পারিল না। নটা পর্যন্ত হাসপাতালের সামনে বসিয়া থাকিতে হইল। তারপর ঘণ্টাখানেক গােপির কাছে থাকিয়া, তাহাকে অনেক আশ্বাস ও সান্ত্বনা দিয়া ঘাটে ফিরিয়া আসিল। জহরের শালা নুরুলের নৌকা কাঠের বােঝা নামাইয়া দেবীগঞ্জ ফিরিয়া যাইতেছিল, সেই নৌকায় তাহারা উঠিয়া বসিল।

 গ্রামের ঘাটে নামিয়া কুবের বলিল, বাড়ি যা কপিলা, আমি গণেশের লগে দেখা কইরা যাই।

 বাড়িতে যদি ঝড়ঝাপটা ক্রন্দন ঘনাইয়া থাকে প্রথম ধাক্কাটা কপিলার উপর দিয়াই যাক! কপিলা কিন্তু একা বাড়ি যাইতে রাজি হইলনা, রুখিয়া বলিল, আরে পুরুষ!

 তখন আর কথাটি না বলিয়া কুবের হনহন করিয়া বাড়ির দিকে চলিতে আরম্ভ করিল। কপিলা পিছাইয়া পড়িল। পথে যার সঙ্গে দেখা হইল সে-ই সাগ্রহে গােপির সংবাদ জিজ্ঞাসা করিল, চাপাহাসি-ঢাকা পরিহাস রূঢ় ইঙ্গিত কিছুই কারও কাছে জুটিল না কুবেরের। এত কী সুনাম সে রাখিয়া গিয়াছিল গ্রামে যে কপিলার সঙ্গে একটা পুরা রাত্রি অজানা স্থানে অতিবাহিত করিয়া আসিয়াও সে সুনাম নিটোল অক্ষত দেখিতে পাইতেছে? ব্যাপারখানা কী? চলিতে চলিতে হঠাৎ কুবেরের মনে পড়ে, দুজন তাে নয়, গােপিকে ধরিলে তারা যে তিনজন! গ্রামের লােক তাকে আর কপিলাকে হােটেলের চাঁচের বেড়ার নির্জনতায় পৃথকভাবে কল্পনা করে নাই, তাহাদের সঙ্গে গােপিকেও একত্র চিন্তা করিয়াছে। কারও মনে তাই সন্দেহ জাগিবার অবকাশ থাকে নাই।

 কুবের দাঁড়াইল। কপিলা কাছে আসিলে বলিল, দ্যাখ্ কপিলা, জিগাইলে কইস রাইতে হাসপাতালে ছিলাম, গােপির কাছে।

 কপিলা মাথা নাড়িয়া বলিল, দূর অ? মিছা কথা আমি কই না মাঝি!

 বলিয়া খানিক আগে কুবের যেমন করিয়াছিল তেমনি হনহন করিয়া কপিলা আগাইয়া গেল।

 কে জানে কী আছে কপিলার মনে। বারণ না মানিয়া কাল ও আমিনবাড়িতে থাকিয়া গেল, আজ বারণ না মানিয়া সত্য কথা বলিতে চায়। বলুক! পুরুষ মানুষ কুবের, কী ভয় তার? কপিলার সত্যবাদিতার ফল যদি কেহ ভোগে ভুগিবে কপিলাই!

 বাড়ি গিয়া কুবের দেখিল, মালার কাছে কপিলা সবিস্তারে আমিনবাড়ির কাহিনি বলিতেছে। কাছে চাটাইটার উপর সে বসিয়া পড়িল। মালাকে সবই বলিবে নাকি কপিলা, হােটেলে রাত্রিযাপনের কথা পর্যন্ত? কপিলা বলিয়া যায়—সন্ধ্যাবেলায় কী বিপদেই তারা পড়িল। হাসপাতালে থাকিতে দিল না, ফিরিবার নৌকা পাওয়া গেল না, কোথায় যায়? শেষে এক মােক্তারবাবু দয়া করিয়া তাদের আশ্রয় দিলেন।—কী নাম য্যান মাঝি মুক্তারবাবুর? মুখ ফিরাইয়া কপিলা জিজ্ঞাসা করিল কুবেরকে।

 কুবের থতমতাে খাইয়া বলিল, কেডা জানে?

 জিগাও নাই?

 কুবের মাথা নাড়িল।

 দুদিনের মধ্যে আর গােপিকে দেখিতে যাওয়া হইল না। জীবিকা অর্জন করিতেই কুবের ব্যস্ত হইয়া রহিল। পরের দিন সকালে মালা ভয়ানক গােলমাল আরম্ভ করিয়া দিল। আই গাে কুবেরের পাষাণ প্রাণ! মেয়েটাকে সে যে কোথায় রাখিয়া আসিল, আর কি তাহার খবর লইতে হইবে না! জন্মের মতাে রাখিয়া দিয়া আসিয়াছে নাকি মেয়েকে, এমন যে নিশ্চিন্ত হইয়া আছে কুবের?

 সারারাত মাছ ধরিয়া কুবের তখন বাড়ি ফিরিয়াছে। ভাত খাইয়া দুপুরবেলা আমিনবাড়ি রওনা হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়া সে মালাকে শান্ত করিল, তারপর ঘুমাইতে গেল পিসির ঘরে। ঘুমাইয়া উঠিয়া স্নান করিয়া আসা অবধি সে আড়চোখে চাহিতে লাগিল কপিলার দিকে। কে জানে কপিলা আজ সঙ্গে যাইতে চাহিবে কি না! কপিলা কিছু বলে না, একবার সামনে আসে একবার অন্তর্হিত হয়।

 খাইতে বসিয়া কুবের বলে, খাইয়া উঠাই আমিনবাড়ি রওনা দিমু কপিলা।

 ফিরবা না আইজ?

 কেডা জানে। হয়তাে হােটেলে থাকুম।

 হােটেলে ক্যান? থাইকো, মুক্তারবাবুগাে বাড়ি থাইকো।

 বলিয়া কপিলা হাসে। লজ্জা পাইয়া ঘাড় হেঁট করিয়া কুবের খাইয়া যায়। না, কপিলার মনের হদিস পাইবার ভরসা তাহার আর নাই। কখন কী বলিবে, কখন কী করিবে, কিছুই অনুমান করিতে পারা যায় না।

 খাইয়া উঠিয়া কুবের ময়লা চাদরটি গায়ে জড়াইয়া যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হইল। বড়াে সে গম্ভীর হইয়া গিয়াছে, যেন এমন একটা অপমান সম্প্রতি তাহার জুটিয়াছে যাহা তাহার প্রাপ্য নয়। বড়াে নির্মম কপিলা, বড়াে দুর্বোধ্য তাহার ব্যবহার।

 রওনা হওয়ার সময় কুবেরকে চার আনা পয়সা দিয়া কপিলা বলিল, গােপিরে ফল কিনা দিবা মাঝি। তারপর মালাকে বলিল, মাঝির লগে যামু নাকি দিদি?

 মালা বলিল, তর গিয়া কাম কী?

 তখন কপিলা বিষণ্ণভাবে একটু হাসিল, কুবেরের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মাঝি কী কও?

 কুবের মাথা নাড়িল, তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া গেল। আমিনবাড়ি সে পৌছিল অপরাহ্নে, কপিলার পয়সা দিয়া স্টিমারঘাট হইতে কমলালেবু কিনিয়া গােপিকে দেখিতে গেল, নদীতীরে ফিরিয়া আসিল সন্ধ্যাবেলা। আজ বাড়ি ফিরিবার নৌকার অভাব নাই, তবু কুবেরের কেন যেন ফিরিতে ইচ্ছা হইতেছিল না, অনেক রাত্রি অবধি নদীতীরে বসিয়া থাকিয়া সে হােটেলে ভাত খাইতে গেল। খাইতে খাইতে সে শুনিতে পাইল বাজারে আজ ভাসান-যাত্রা হইতেছে। আজ কুবের কাছে না থাকিলে কেহ ভয় পাইবে না, খাইয়া উঠিয়া সে বাজারের দিকে পা বাড়াইল।

 বাজারে টিনের চালার নীচে যেখানে তরিতরকারির দোকান বসে সেইখানে যাত্রার আসর বসিয়াছে, লােক জমিয়াছে ঢের। কুবের একপাশে বসিয়া পড়িল। পানবিড়ির দোকান ছাড়া এত রাত্রে পসরা সাজাইয়া কেহ নাই, রূপ-কন্যারাও যাত্রা শুনিতে আসিয়াছে। পেশাদার দল নয়, আলু-বেচা তেল-বেচা মানুষের শখের দল, অনেকে হয়তাে পড়িতেও জানে না, একে ওকে দিয়া পড়াইয়া শুনিয়া শুনিয়া পার্ট মুখস্থ করিয়াছে, শক্ত শক্ত অনেক শব্দই উচ্চারণ হয় না, তাই হাস্যকর রকমে ভাঙিয়া জিহ্বার উপযােগী করিয়া নিয়াছে—বক্তৃতাগুলি কথ্য ও শুদ্ধ ভাষার এক অপরূপ খিচুড়ি। পােশাক পরিচ্ছদের যেমন অভাব, অভিনেতা নির্বাচনে কাণ্ডজ্ঞানেরও তেমনই অভাব। বালক লখিন্দরের পাশে তার চেয়ে একহাত বেশি লম্বা বেহুলা নির্বিকারচিত্তে পার্ট বলে—গলাটি মিহি বলিয়া আর চমৎকার মেয়েলি ঢঙে অভিনয় করিতে পারে বলিয়া ওকে বেহুলা করা হইয়াছে, আর কিছু দেখিবার প্রয়ােজন হয় নাই।

 তবু রাত জাগিয়া ভিড় করিয়া সকলে ভাসান-যাত্রা শোনে, একবার নয় বহুবার। ভাঙা হারমােনিয়াম আর ঢ্যাপসা তবলার সঙ্গত, মশালের লাল আলাে, আলু-বেচা তেল-বেচা অভিনেতা—তবু কী মােহ এ যাত্রার! কুবের ঠায় বসিয়া থাকে। ঢিমাইয়া ঢিমাইয়া অভিনয় চলে, মা মনসা একটা গান করেন, চাঁদ সদাগর দুটো কথা বলে, মৃত লখিন্দর উঠিয়া একটা গান করিয়া আবার মরিয়া যায়। কোথায় কখন কোন দৃশ্যের শুরু, সর্পদষ্ট লখিন্দরের জন্য বেহুলার বহুল বিলাপের পর মা মনসা আবার কেন গান গাহিয়া গাহিয়া চাঁদ সদাগরকে ভয় দেখাইয়া যান যে তাকে পূজা না করিলে লখিন্দরকে সাপে কাটিবে, এসব বুঝিবার দরকার হয় না। কুবের মন দিয়া যাত্রা শােনে। রাত্রি শেষ করিয়া যাত্রা শেষ হইলে পেঁয়াজের যে খালি বস্তাটার উপর সে এতক্ষণ বসিয়া ছিল তার উপরেই কাত হইয়া ঘুমাইয়া পড়ে। কিন্তু বেশিক্ষণ ঘুমানাের সুযােগ সে পায় না। সকাল হইতে না হইতে তাহাকে ঠেলিয়া তুলিয়া দেওয়া হয়। সেখানে এবার দোকান বসিবে।

 অনেক বেলায় সে গ্রামে ফেরে। দেখিতে পায় বাড়িতে অতিথি আসিয়াছে। কপিলার স্বামী শ্যামাদাস!

 লম্বা চওড়া প্রকাণ্ড জোয়ান মানুষ, ঘাড়-ছোঁয়া বাবরি চুল মাথায়, বোঁচা নাকটার নীচে একজোড়া উদ্ধত গোঁফ—খুঁটিতে ঠেস দিয়া বসিবার ভঙ্গি দেখিলে মনে হয় বিশ্বজগতে কারাে সে তােয়াক্কা রাখে না। কুবেরের মুখখানা ম্লান হইয়া যায়। কে জানে কেন আসিয়াছে শ্যামাদাস!

 শ্যামাদাসের আসিবার উদ্দেশ্য জানিতে বেশি দেরি হইল না। এপক্ষের বউটা তাহার মরিয়া গিয়াছে। কপিলাকে সে নিয়া যাইবে। কখন যাইবে? বেলা পড়িয়া আসিলে একসময় রওনা হওয়া যাইবে, সেজন্য কী! কুবের যদি খাতির করিয়া একটা দিন থাকিয়া যাইতে বলে তাতেও শ্যামাদাসের আপত্তি নাই।

 বসিয়া বসিয়া তাহারা কথাবার্তা বলে,কপিলা একসময় আসিয়া ফিসফিস করিয়া স্বামীর কানে কানে কী যেন সব গােপনে কথা বলে, তারপর হাসিয়া চলিয়া যায়, পিসির ঘরে ঢুকিবার আগে মুখ ফিরাইয়া চোখের একটা দুর্বোধ্য ইঙ্গিতও করে।

 এত বেলায় কুবের ফিরিয়া আসিয়াছে, কই খাওয়ার কথা কপিলা তাে কিছু বলিল না? কুবেরের ক্ষুধাতৃষ্ণার কথা মনে রাখিবার প্রয়ােজন কী কপিলার ফুরাইয়া গিয়াছে? গােপির কথাও তাে কিছু সে জিজ্ঞাসা করিল না?

 গায়ের চামড়াটা কুবেরের আজ বড়াে খসখস করিতেছিল, অনেকদিন তেল মাখা হয় নাই। শ্যামাদাস আসিয়াছে বলিয়াই কপিলা বােধহয় আজ চুলে আবার জবজবে করিয়া নারিকেল তেল দিয়াছে। কালাে একটি বােতলে বিলাসিতার এই উপকরণটি কপিলা সর্বদা মজুত রাখে, একটা কিছু উপলক্ষ পাইলেই বােতলটা কাত করে মাথায়। শ্যামাদাসকে বসিতে বলিয়া কুবের কপিলার কাছে একটু তেল চাহিল। কপিলা করিল কী, রাঁধিবার তেল-রাখা বাঁশের পাত্রটি আনিয়া বলিল, ধর মাঝি, হাত পাত। কুবের হাত পাতিলে পাত্রটা সে একেবারে উপুড় করিয়া ধরিল, এক ফোঁটা তেলও কুবেরের হাতে পড়িল না।

 কপিলা বলিল, আই গাে আই, ত্যাল তাে নাই!

 বলিয়া কী হাসি কপিলার!

 কুবের কথাটি বলিল না, বাঁশের পাত্রটি তার হাত হইতে ছিনাইয়া লইয়া এই দুপুরবেলা অভুক্ত অবস্থায় গ্রামের ভিতরে গিয়া দু পয়সার তেল কিনিয়া আনিল। কপিলাকে দেখাইয়া দাওয়ায় বসিয়া সর্বাঙ্গে ঘষিয়া ঘষিয়া বহুক্ষণ ধরিয়া সে তেল মাখিল, নিজের দেহটিকে সে যেন কপিলার চুলের মতােই তেলে জবজবে করিয়া ছাড়িবে।

 সারাদিন কপিলার সঙ্গে সে কথা বলিল না। কিন্তু সন্ধ্যার পর মাছ ধরিতে যাওয়ার সময় তামাকের গোলাটা সঙ্গে লইতে ভুলিয়া গেল। নৌকায় গিয়া একা সে বসিয়া রহিল প্রতীক্ষায়, একসময় গণেশ ও ধনঞ্জয় আসিয়া তাহার সঙ্গে যােগ দিল, তারপর মৃদু জ্যোৎস্নায় পদ্মার রহস্যময় বুকে নৌকা ভাসিয়া গেল, কিন্তু তামাক পৌছাইয়া দিতে কেহ আসিল না।

 পরদিন কপিলাকে সঙ্গে করিয়া শ্যামাদাস চলিয়া গেল।

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. গহনার নৌকা—প্রত্যহ নিয়মিত সময়ে ছাড়িয়া বহুদূর অবধি যাত্রী লইয়া যাওয়া আসা করে।